LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১২) - khalid Saifullah

khalid Saifullah

আল্লাহর তরবারী

Breaking

Home Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০১৭

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১২)

১৯৯৩ সালে আল রশিদী মোগাদিসুতে জাওয়াহিরির এলিট ইউনিটগুলোর একটি ইউনিটের কমান্ডে ছিলেন। ইসলামী জিহাদীদের সমর্থনপুষ্ট সোমালীদের লড়াইয়ের শক্তি সামর্থ যে কি বিশাল আকারে বেড়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ হচ্ছে ১৯৯৩ সালের ৩ অক্টোবরের ঘটনা। ঐ দিন বিকালে মার্কিন সৈন্যরা জেনারেল আইদিদের দুই উপদেষ্টাসহ ২২ সোমালীকে বন্দী করলে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে যায়। সহস্রাধিক সোমালী যোদ্ধা মার্কিন সৈন্যদের ঘিরে ফেলে অ্যাম্বুশ করতে থাকে। তারা দু’টো মার্কিন হেলিকপ্টার ভূপাতিত করে এবং একটানা ১১ ঘন্টা ধরে মার্কিন সৈন্যদের ওপর গুলি বর্ষণ করে চলে। ১৮ মার্কিন সৈন্য নিহত ও ৭৮ জন আহত হয়। পরদিন সোমালীরা মোগাদিসুর রাজপথে মার্কিন সৈন্যদের লাশ নিয়ে বিজয় উৎসব করে। ৩ অক্টোবরের লড়াইয়ে জাওয়াহিরি ও আল রশিদী দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশেষ করে অ্যাম্বুশগুলো আল রশিদীর সার্বিক কমান্ডে হার্ডকোর ইসলামী জিহাদীরা এবং প্রধানত আরব আফগান ও ইরাকীরা চালিয়েছিল। আরব আফগানদের মধ্যে আলজেরীয় ও মিসরীয় মুজাহিদরা ছিল। ইরাকীরা ভারি অস্ত্র, বিশেষ করে হেলিকপ্টার বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারে অংশ নিয়েছিল। ৩ অক্টোবরের লড়াইয়ের পর মার্কিন বাহিনীকে সোমালীয়া থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়

। পরবর্তীকালে বেশ কিছু বিবৃতি ও সাক্ষাতকারে বিন লাদেন বলেছেন যে, সোমালিয়ার অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মনে করেন। সোমালিয়াতেই প্রথম তিনি নেতৃত্বের পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ ও নীতি নির্ধারণের মতো জটিল বিষয়ে অংশ নেন। তিনি ইরান ও ইরাকের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। মোগাদিসুর লড়াইয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন। বিন লাদেন মোগাদিসুর লড়াইকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর অন্যতম প্রধান সাফল্য বলে মনে করেন। এই সাফল্য থেকে তিনি স্থিরনিশ্চিত হন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগর থেকেও হটিয়ে দেয়া সম্ভব। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর চোখে কাগুজে বাঘের চেয়ে বেশি কিছু নয়।

সৌদি পাসপোর্ট বাতিল; বিন লাদেনের ছদ্মনাম ধারণ

১৯৯৪ সালে বিন লাদেনকে বেশ কিছু কর্মসূচীর দায়িত্ব নিতে দেখা যায়। এ জন্য তাঁর বেশ কয়েকটা দেশ সফরে যাবার প্রয়োজন পড়ে। এসব সফরে গিয়ে  তিনি নিজেকে জটিল র্কাযক্রমের যোগ্য ব্যবস্থাপক ও দক্ষ সংগঠক হিসাবে প্রমাণ করেন। সেই কর্মসূচীগুলোর বেশিরভাগ আজও চালু আছে। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর বন্ধু বা মিত্রদের কিংবা তাদের ইউরোপে রেজিস্টিার্ড কোম্পানির ব্যক্তিগত জেট বিমান ব্যবহার করে তিনি নির্বিঘে যেখানে সেখানে যেতে সক্ষম হন। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর সৌদি পাসপোর্ট বাতিল হবার পর তিনি ভিন্ন নাম ধারণ করে সুদানী কুটনৈতিক পাসপোর্টে বিদেশ যাতায়াত করতে থাকেন। তবে পাশ্চাত্য ও স্থানীয় গোয়ান্দা সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান হুমকি সত্বেও বিন লাদেন জিহাদপন্থী মুসলিম নেতাদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কখনই নিজের আসল পরিচয় গোপণ করার চেষ্টা করেননি।১৯৯৩ সালের শেষ দিকে মুজাহিদরা বড়ধরনের বিজয় উৎসব পালন করে। কারণ, তারা আফ্রিকা শৃঙ্গ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে দিতে পেরেছে। কাজেই পরবর্তী বছরটি নিজ নিজ শক্তিকে পুনর্বিন্যস্ত ও সংগঠিত করাই ছিল বিন লাদেন ও তাঁর সহকর্মীদের জন্য সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সময়।

 সোমালিয়ার ঘটনার পর ইসলামী জিহাদ বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অন্যতম মার্কিনবিরোধী ও পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। সেই সঙ্গে ইসলামী জিহাদী ব্যবস্থায় নতুন কিছু দেশ সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। দেশগুলোর একটি হচ্ছে পাকিস্তান। এই সময় কাশ্মীরের প্রক্সি যুুদ্ধে এবং আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। উভয় ক্ষেত্রে বিন লাদেনকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী শক্তিগুলো কি রকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।এমনকি স্বয়ং জিয়াউল হকও দেশে শরয়ী আইন চালুর ব্যবস্থা করেছিলেন। জিয়াউল হকের মৃত্যুর কিছুদিন পর নির্বাচরে মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন বেনজীর ভুট্টো। পাশ্চাত্যপ্রীতি ও গণতন্ত্রের ধ্বজা ধারণ সত্বেও তিনি কতিপয় মৌলিক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সরকারকে অনুসরণ করে চলেন। 

যেমন  একটি হলো ইসলামী জোটের অন্যতম মুখ্য সদস্যে পরিণত হওয়া এবং দ্বিতীয়টি হলো চীনের নেতৃত্বে ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ট্রান্সএশীয় অক্ষশক্তি তথা মার্কিনবিরোধী র‌্যাডিকেল জোটে সক্রিয় অবদান রাখা। সেই লক্ষে পাকিস্তান ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে স্ট্যাটিজিক সহযোগিতা জোরদার করে তোলে। পাকিস্তান এসব জোটে সুস্পষ্ট ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। সেটা হলো ইসলামাবাদ ইসলামী জোটের সামরিক শক্তির উন্নয়ন এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তিসহ সকল ধরণের সমরাস্ত্রের উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান আমেরিকার তৈরী অস্ত্রের খুচরা অংশসহ পাশ্চাত্যের  অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আইনী-বেআইনী উভয় পথেই সংগ্রহ করবে। পাকিস্তানে সরকারের আড়ালেও এক অদৃশ্য সরকার থাকে। ক্ষমতায় যে-ই আসুক তাকেই এই অদৃশ্য সরকারের মূলনীতিগুলো মেনে চলতে হয়। জিয়াউল হক বা বেনজীর বা নাওয়াজ শরীফ এদিক থেকে কোন ব্যতিক্রম নন।

আমাদের এখানে আলোচ্য সময়টি হলো ১৯৯৩-৯৪ সাল। এসময়ে পাকিস্তানে বেনজীর ভুট্টো আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। এসময় যুদ্ধোত্তর এবং উপসাগর যুদ্ধোত্তর পাকিস্তানের জন্য নতুন স্ট্যাটেজি নেয়া হয়। সেটা হলো ইসলামী ব্লক ও ট্রান্স-এশিয়ান এক্সিসের সঙ্গে আরও বেশি করে একীভূত হওয়া। পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ স্থির নিশ্চিত হন যে, এই দুটো জোটের মধ্যেই পাকিস্তানের ভবিষ্যত নিহিত। তাই ইসলামী আন্দলনের পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনার জন্য হাসান আল তুরাবি ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে খার্তুমে পপুলার অ্যারাব এ্যন্ড ইসলামীক কনফারেন্স  এর অধিবেশন আহবান করলে পাকিস্তান যে তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু  নেই। সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা জানিয়েছিল যে, ইসলামী বিশ্বের গতিপ্রকৃতি, চীনের পরিবর্তনশীল স্ট্যাটেজি এবং পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ সমস্যার প্রেক্ষিতে বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানের সর্বোত্তম স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ইসলামাবাদ ইসলামের  র‌্যাডিকেলপন্থীদের স্ট্র্যাটেজি অনুসরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সম্মেলনে বেনজীর ভুট্টো তাঁর এক উপদেষ্টা পাঠান, যিনি তুরাবি ও অন্যান্য মুসলিম নেতার সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে পিপলস পার্টির ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন এবং আশ্বাস দেন যে, এই দল ইসলামের সমালোচনা করবে না, ইসলামী আইন যতটুকু  যা প্রবর্তিত হয়েছে তা তুলবে না এবং কাশ্মীরে  ভারতবিরোধী জিহাদে দৃঢ় সমর্থন দেবে।

 উপদেষ্টা আরো জানান যে, পাকিস্তান আফগানিস্তান সমস্যার ইসলামী সমাধান খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর।পপুলার অ্যারাব এ্যান্ড ইসলামিক কনফেরান্স অধিবেশনে আর্মড ইসলামিক মুভমেন্টের কাঠামোর মাধ্যে পাকিস্তানের ভূমিকা, বিশেষ করে ইসলামী সশস্ত্র সংগ্রাম তথা আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের প্রতি ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সক্রিয় সাহায্য-সমর্থন দেয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধারা হয়। সরকারী পর্যায়ে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেনজীর ভুট্টোর দুই বিশ্বাসভাজন-সেনাবাহিনীর সাবেক চীফ অব স্টাফ ও ইরানে ঘনিষ্ঠ মিত্র  জেনারেল মীর্জা আসলাম বেগ এবং আইএসআই এর প্রাক্তন প্রধান জেনারেল হামিদ গুল, যিনি আশির দশকের শেষ দিকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিদেশী মুজাহিদদের আগমনকে উৎসাহিত করেছিলেন। এঁরা দু’জনেই ছিলেন র‌্যাডিকেল ইসলামীদের ঘোর সমর্থক।  তুরাবি কাশ্মীরী মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় পাকিস্তানের অঙ্গিকারকে অভিনন্দিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সত্ত্বেও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করেন। এবং এ ব্যাপারে গোটা মুসলিমবিশ্বের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা আশ্বাস দেন যে, আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী তৎপরতার প্রতি সমর্থন বন্ধ বা হ্রাস করার ব্যাপারে পাশ্চাত্যের চাপের কাছে ইসলামাবাদ নতিস্বীকার করবে না। তারা জোর দিয়ে বলেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও অন্যান্য সাহায্য পাওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনেক সময় আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদীদের দমন করার কিংবা তাদের অবকাঠামো খর্ব করার  ভান ধরতে হবে। তবে সেটা হবে কেবল লোক দেখানো ব্যাপার মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী জিহাদীদের প্রতি ইসলামাবাদের সাহায্য সমর্থন প্রসারিত হবে। 

আবার আইএসআই

খার্তুম সম্মেলনে পাকিস্তান যে ওয়াদা করেছিল তা রক্ষার জন্য পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসএই কোমর বেঁধে লেগে পড়ে। ১৯৯৪ সালে ইরানী গোয়েন্দা সংস্থা ভিভাক এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আইএসআই আফগানিস্তানে জিহাদী  অবকাঠামোর, বিশেষ করে আরব ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের প্রশিক্ষণ স্থাপনাগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটায়। আইএসআই ইন্সট্রাক্টরদের চারটি প্রশিক্ষণ শিবিরে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় যেখানে “বিদেশী আফগানদের” (অর্থাৎ আফগান নয় এমন বিদেশীদের) উন্নত অস্ত্র ব্যবহার কৌশল, অত্যাধুনিক বোমা ও বুবি ট্র্যাপ তৈরি এবং সুইসাইড অপারেশন পরিচালনার উপায় শেখানো হতো। এখানে “আইএসআই” প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে এই জন্য যে, পরে দেখা যাবে কিভাবে আইএসআই-এর সঙ্গে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। যাই হোক, আইএসআই ও ভিভাক-এর যৌথ উদ্যোগে যেসব প্রশিক্ষণ শিবিরের উন্নয়ন ও সাম্প্রসারণ ঘটানো হয় তার একটি ছিল আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে খোস্ত ও জাওয়ারের মধ্যবর্তী একটি এলাকায়। আশির দশকে আইএসআই এর প্রশিক্ষণ শিবিরটি আফগান মুজহিদ কমান্ডার জালালুদ্দীন হাক্কানীর জন্য চালাত।

 ১৯৯৮ সালে সেখানে প্রায় একশ’ পাকিস্তানী এবং ৩০ জনেরও বেশি আরব ইন্সট্রাক্টর সারা বিশ্বের ৪০০ থেকে ৫০০ ইসলামী যোদ্ধাকে ট্রেনিং দিচ্ছিল। শিবিরটি সম্পূর্ণ পেশাদারী কায়দায় চালিত হয়। সেখানে প্রত্যেক প্রার্থীকে প্রশিক্ষণের জন্য গ্রহণ করার আগে আইএসআই বিশেষজ্ঞরা পূর্ণাঙ্গ শারীরিক,  মানুষিক ও মেডিক্যাল পরীক্ষা নিত এবং নিরাপত্তামূলক তল্লাশি চালাত। বিষয়ভেদে কোর্সগুলো হতো ৪ মাস থেকে ২ বছর মেয়াদী। ১৯৯৪-৯৫ সালে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৩৫০ জন ছিল তাজিক (এদের ১০০ জন ছিল তাজিকিস্তানের এবং বাকিরা ছিল আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বঞ্চলের) ও প্রায় ১০০ জন ছিল চেচেন সৈন্য। এছাড়া ৩ টি গ্রুপ ছিল বসনিয়া-হারজেগোভিনার, ২টি গ্রুপ ছিল ফিলিস্তিনী,  ১টি গ্রুপ ছিল ফিলিপিন্সী, ১টি গ্রুপ ছিল মোলদাভীয় এবং ২টি গ্রুপ ইউক্রেনীয় (প্রধানত ক্রিমীয় তাতার)। ছাত্রদেরকে ১২ থেকে ১৪ জনের একেকটি স্টাডি টিমের ভাগ করা হতো। নিরাপত্তার কারণে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ বা টিমের মধ্যে যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ রাত্রিকালীন কোর্সও পরিচালনা করা হতো এবং এসময়ে প্রশিক্ষণার্থীদের পরিচিতি ও তৎপরতা বা কার্যক্রম গোপন রাখতে হতো। ১৯৯৮ সালের আগস্টের লাদেনের ঘাঁটিতে মার্কিন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় এ ধরনের কয়েকটি প্রশিক্ষণ শিবিরকেও টার্গেট করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে অপর যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সম্প্রসারণ ঘটানো হয় তার মধ্যেছিল গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হিজবে ইসলামীর ঘাঁটি বলে পরিচিত চর সিয়াবের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এছাড়া পাশ্চাত্যে এবং পাশ্চাত্যপন্থী মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোতে বিশেষ ধরণের অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাছাই করে রাখা দু’শরও বেশি আরব যোদ্ধার জন্য আইএসআই আলাদাভাবে বড় ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালিয়েছিল। আইএসআই পরিচালিত অন্যান্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আফগনিস্তানের বাকি অঞ্চলে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। 

১৯৯৪-৯৫ সালে জিহাদী সংগঠনগুলোর জন্য দেয়া লজিস্টিক্স গোয়েন্দা অর্থে ও অন্যান্য সাহায্যের বেশির ভাগই আইএসআই পৃষ্টপোষকতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানী সংগঠন যথা হরকত-উল আনসার ও মারকাজ আল দাওয়াত আল আরশাদের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান হরকত-উল আনসারের নেতারা গর্ব করে দাবি করেন যে, তাঁদের যোদ্ধারা কাশ্মীর, ফিলিপিন্স, তাজিকিস্তান, বসনিয়া-হারজেগোভিনাসহ বিভিন্ন স্থানে লড়ছে। ১৯৯৫ সালে মারকাজ-আল দাওয়াত আল আরশাদও অনুরূপ দাবি করে জানায় যে, তাদের মুজাহিদরা কাশ্মীর ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিম ইউরোপ, বসরিয়া ও চেচনিয়ায় তৎপর আছে। আফগানিস্তান সঙ্কটে পাকিস্তানের জড়িয়ে পড়া এবং সেখানকার বিশাল জিহাদী ব্যবস্থার লালান পালনে তার সাহয্য-সহায়তা যে শুধু ইসলামী সংহতির চেতনা থেকে হয়েছে তা নয়। এর মধ্যে জাতীয় স্বার্র্থের ব্যাপারটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে আফগানিস্তানের সড়ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পথ সন্ধান করায় আইএসআই এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গোপন তৎপরতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আইএসআই কুশা-হেরাট কান্দাহার-কোয়েটা মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণে এক উচ্চাভিলাষী কার্যক্রমে হাত দেয়। সাবেক সোভিয়েত মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে পশ্চিম ও দক্ষিণ আফগানিস্তান হয়ে এই সড়ক মিশে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক ব্যবস্থার সঙ্গে যে সড়ক ব্যবস্থা দেশের সর্ব প্রধান বন্দর করাচী পর্যন্ত বিস্তৃত। সুতরাং এটা হলো মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকা একমাত্র স্টাট্যাজিক স্থল পথ যা পুনর্নির্মাণ করা হলে অপেক্ষাকৃত সহজে বিশাল বিশাল কনভয় এপথ দিয়ে বহন করা যেতে পারে। এই পথের সঙ্গে মধ্য এশিয়া থেকে তেল ও গ্যাসের পাইপ লাইন করাচী বন্দর পর্যন্ত নেয়া হলে পাকিস্তানের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তা হবে একান্তই গুরুত্বপূর্ন।

 পাকিস্তান যে কোন মূল্যে এ গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথটির ওপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছিল। আইএসআই এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে সব কার্যক্রম চালায় বলা যেতে পারে তারই পরিণতি বা ফলস্বরূপ তালেবান শক্তিটির উত্থান ঘটে। পাকিস্তানের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর ১৯৯৮ সালে স্বীকার করেন যে, ১৯৯৪  সালে তারই নির্দেশনায় তালেবানদের সংগঠিত করা হয়েছিল। কথাটার মধ্যে যথেষ্ট সত্যতা আছে। তালেবানদের সৃষ্টি ও শক্তি বৃদ্ধি ইসলামাবাদের সকল সরকার (এমনকি বেনজীর ভুট্টোর সরকার) কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে এবং সেই মিশন আইএসআই দ্বারা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই তালেবানরাই এখন আফগানিস্তানের প্রায় গোটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমেরিকার প্রবল চাপ সত্ত্বেও এই তালেবানরা ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানের দিকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাকে রক্ষা করছে। 

বলকান অঞ্চলে বিন লাদেন

আফগানিস্তান, আফ্রিকাশৃঙ্গ এবং অন্যান্য এলাকার জিহাদীদের সংগ্রামের সঙ্গে যতই নিজের সংশ্লিষ্টতা থাকে না কেন ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবের তখনকার ক্রমবর্ধমান সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন থেকে নিজেকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেননি। বাদশাহ ফাহাদের স্বাস্থের দ্রুত অবনতি ঘটলেও তার স্থলে কে সিংহাসনে আরোহণ করবেন সে সম্পর্কে তখনও সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছিল না। ফলে উত্তরধিকার প্রশ্নে আল সৌদ রাজপরিবারের অংশীদারদের মধ্যে তিক্ত বিরোধ এবং তা থেকে উদ্ভুত সঙ্কট গ্রাস করে ফেলেছিল সৌদি আরবকে। শীর্ষ স্থানীয় শাহজাদাদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অতৃপ্ত লোভ-লালসার বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জিহাদী ও র‌্যাডিকেল শক্তি এই বিক্ষোভ ও বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবে খাঁটি ইসলামী জীবনধারা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এটা  মূলত ছিল ইসলামপন্থীদের আন্দোলন। রিয়াদ এ আন্দোলন মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ব্যাপক ধরপাকড় চালিয়ে তাদের বিনা বিচারে আটকে রাখে। এভাবে চরম দমননীতির দ্বারা আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া হয়। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি এই আন্দোলন বাস্তব কোন হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। সৌদি আরবের ভিতরের ও বাইরের এই পরিস্থিতি বিন লাদেনের রাজনৈতিক বিকাশের পথে একটা মোড় পরিবর্তন হিসাবে কাজ করে। 

১৯৯৩-৯৪ সালে তিনি আল-সৌদ রাজপরিবারের এককভাবে দেশ শাসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সব রকমের যুক্তি বিচার বিবেচনা করে তিনি স্থির নিশ্চিত হন যে, এই পরিবারটি দেশ পরিচালনার কোন বৈধতা নেই। তাই একদা যিনি সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাকে অতুলনীয় সার্ভিস যুগিয়েছিলেন এবং উপসাগর সঙ্কটের সময় দৃঢ়ভাবে রাজপরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই এখন রাজপরিবারের ঘোরতর ও আপোষহীন শত্রু হয়ে দাঁড়ান। রিয়াদের প্রতি বিন লাদেনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এই বিবর্তনের ব্যবহারিক তাৎপর্য আছে। তিনি এখন সৌদি আরবে ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করার উপায়, বিশেষ করে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর উত্তরোত্তর দমন নিপীড়নের মুখে কি করে সেই আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা এবং এর পাশাপাশি সৌদি আরবে ভবিষ্যত অভ্যুত্থানের অগ্রসেনা হিসাবে কিভাবে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলা যায় সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। বিন লাদেন অবশ্য এ ব্যাপারে সচেতন থেকেছেন যে শেষোক্ত দায়িত্বটি পালন করা যথেষ্ঠ দুরূহ এবং প্রচুর সময়সাপেক্ষ। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী অভিযানের ভিত্তি রচিত হয়। হাসান আল তুরাবি ও তার আন্তর্জাতিক ইসলামী আন্দোলনে বিন লাদেন ও জাওয়াহিরির মতো ‘আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ’ জিহাদী নেতাদের গুরুত্ব ও কার্যকরী ভূমিকার কথা বুঝতে পেরে তাদের অনেক বড় দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেন। লাদেন ও জাওয়াহিরিকে মুখ্য অবস্থানে রেখে এক নতুন কমান্ড কাঠামো নির্মিত হয়। ইসলামী জিহাদ এখন ইউরোপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। 

বিন লাদেন ও জাওয়াহিরি দু’জনেই বলকান অঞ্চল, বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও কসোভোয় র‌্যাডিকেল ইসলামীদের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দুটোই কাজে লাগিয়েছিলেন। খার্তুম ও লন্ডন থকে বিন লাদেন বলকান অঞ্চলে মানবিক ত্রাণ সংগঠনের নেটওয়ার্ক ব্যাপক আকারে সম্প্রসারিত করেন। সেই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তুলেন সহায়ক ঘাঁটি। ঐ ত্রাণ সংগঠনগুলোই গোটা বলকান অঞ্চলে হাজার হাজার মুজাহিদ ধারণ করে আছে। কোন নির্দিষ্ট মানবিক সাহায্যে সংগঠন বন্ধ হলে,  কোন ইসলামী জিহাদী গ্রেফতার বা বহিষ্কার হলে সামগ্রিক জিহাদী নেটওয়ার্কের ওপর লক্ষণীয় কোন প্রভাব পড়ত না। বিন লাদেন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত এই নেটওয়ার্কটির যথেষ্ট নমনীয়তাও ছিল। প্রায়ই এক একটা সংগঠন অদৃশ্য হয়ে যেত। যে জায়গায় গজিয়ে উঠত নতুন সংগঠন। এছাড়া বিপুল সংখ্যক ছদ্মবেশী ইসলামী জিহাদী প্রায়ই এক সংগঠনের আনুগত্য ছেড়ে অন্য সংগঠনের আনুগত্য গ্রহণ করত। তার ফলে জিহাদীদের সন্ধান বের করতে পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উদ্যোগ বহুগুণ জটিল আকার ধারণ করত।

 বলকান অঞ্চলে ইসলামী জিহাদীদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা ও অন্যান্য তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে বিন লাদেন একটা গোপন অর্থ ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছিলেন। তার গড়া সামগ্রিক নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধান করার জন্য বিন লাদেন অন্তত একবার বসনিয়া, আলবেনিয়াসহ বলকান অঞ্চল সফরে গিয়েছিলেন যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে। অন্যদিকে আইমান আল জাওয়াহিরি বলকান অঞ্চলে বহু স্তরবিশিষ্ট ফরোয়ার্ড ও অনসাইট কমান্ড এ্যান্ড কন্ট্রোল সিন্টেম গড়ে তুলেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল বসনিয়ার মুসলমানদের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় মুজাহিদদের অবদান রাখা এবং সেই সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদী তৎপরতা চালানো। তার কমান্ড পোস্টগুলোর মধ্যে অফ-সাইট পোস্টগুলো ছিল ইতালি ও বুলগেরিয়ায় এবং অন-সাইট পোস্টগুলো ছিলো ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হারজেগোভিনা এবং আলজিরিয়ায়। জাওয়াহিরি গোটা বলকান অঞ্চলে অতি সুদক্ষ জিহাদীদের বেশ কয়েকটি সেলও গড়ে তুলেছিলেন এবং যাবতীয় আর্থিক খরচের ব্যাবস্থা করেছিলেন বিন লাদেন।বিন লাদেন ও জাওয়াহিরি পশ্চিম ইউরোপে বেশ কয়েকটি বড় ধরণের জিহাদী প্রকল্পেও জড়িত ছিলেন। পশ্চিম ইউরোপে তৎপরতা চালানোর সুবিধার্থে জাওয়াহিরি দাড়ি-গোফ কামিয়ে পাশ্চাত্যের পোষাক ধারন করে চেহারা একদম বদলে ফেলেছিলেন। জওয়াহিরির ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্কের মূল লক্ষ্য ছিল জরুরী পরিস্থিতিতে খুবই মারাত্মক ধরনের জিহাদী তৎপরতা পরিচালনা ও তত্ত্ববধানের জন্য যথাস্থানে অতি সুযোগ্য লোক নিয়োগ করা।  

ফিলিপিন্সে জিহাদ বিস্তারে লাদেন

ফিলিপিন্সে ইসলামী জিহাদের বিস্তারে বিন লাদেনের প্রভূত অবদান আছে। বলা যেতে পারে এ কাজে তিনি নিজেই জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে বিন লাদেন জিহাদী কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় শুরু করেন। তারই অংশ হিসাবে প্রথমে যে বড় ধরনের নেটওয়ার্কে তিনি সাহায্যকারীর ভূমিকায় জড়িত ছিলেন পরবর্তিকালে সেটি ফিলিপিন্সে বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে একাধারে ত্রাস ও চমক সৃষ্টি করেছিল। গ্রাউন্ডওয়ার্ক তৈরির জন্য বিন লাদেন সেই ১৯৯৩ সালের শীতকালেই ফিলিপিন্সে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপগুলোর মুসলিম জনগোষ্ঠিকে সাহায্য করতে আগ্রহী একজন ধনাঢ্য সৌদি বিনিয়োগকারী হিসেবে হাজির করেন। এ উদ্দেশ্যে সেখানে বেশ কিছু সম্পত্তি কেনেন, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলেন। এসব কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য সরকারী কর্মকর্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। যাই হোক, এভাবেই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর ছদ্ম পরিচয়ে লাদেন ফিলিপিন্স নেটওয়ার্কের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীকালে বিন লাদেনের অবাধ যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে এ দায়িত্বটা তিনি তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ জেএল খলিফার কাছে হস্তান্তর কারেন। প্রয়োজনীয় অর্থ এখন কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়ে থাকে। 

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে খলিফাকে ইমিগ্রেশন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে সানফ্রানসিসকোতে আটক করা হয়। ১৯৯৪ সালের প্রথম দিক থেকে তুখোড় জিহাদীদের বেশ কিছু “সেল” যাদের সিংহভাগই হলো আরব “আফগান” তারা ফিলিপিন্সে এসে দেশের সর্বত্র, বিশেষত বড় বড় শহরে ঘাঁটি গেড়ে বসে। এদের মধ্যে সিনিয়র কমান্ডার ছিলেন রামজী আহমদ ইউসুফ। ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলার গোটা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেছিলেন তিনি। ইউসুফের নেতৃত্বে আগত এই দলটির লক্ষ্য ছিল পূর্ব এশিয়ায় জিহাদী হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে জিহাদী হামলা পরিচালনার জন্য ফিলিপিন্সকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। প্রথম দিকে নেটওয়ার্কটি কিছু তড়িঘড়ি কাজ করে বসে বলে সাফল্য পায়নি। যেমন ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের ম্যানিলা সফরকালে তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কর্ডন ভেদ করার জন্য আগে থেকে যে সব গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার দরকার ছিল নেটওয়ার্ক তা করতে পারেনি। এবং পারেনি বলেই হত্যার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পূর্ব এশিয়ায় বড় ধরনের যে সব অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল পোপ পলকে হত্যা করা এবং একই সঙ্গে দু’টো যাত্রীবাহী মার্কিন বিমান বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়া। নেকওয়ার্কটি ফিলিপিন্সের সবচেয়ে বড় ইসলামী জিহাদী সংগঠনের নেতা আবু সায়াফকে ম্যানিলা সরকারের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম জোরদার করে তুলতে অত্যাধুনিক অভিযান পরিচালনায় সাহায্য করারও পরিকল্পনা করেছিল। ১৯৯৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্কের সদস্য রামজী ইউসুফ সেবু থেকে টোকিও গামী ফিলিপিন্স এয়ারলাইন্সের  একটি যাত্রিবাহী বোয়িং ৭৪৭ বিমানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। জাল ইতালীয় পাসপোর্টে যাত্রীর ছদ্মবেশে বিমানে উঠে ইউসুফ নিজে বোমাটি পেতে রেখে ম্যানিলায় যাত্রা বিরতিকালে নিরাপদে নেমে যান। বিমানটি ওকিনাওয়ার আকাশে থাকাকালে বোমা বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু ওটা খুব ছোট তথা স্বল্পশক্তির ছিল বলে বিস্ফোরিত হলেও বিমানটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়নি। এরপর ইউসুফের সহযোগী সাইদ আকরাম দু’তিন স্থান থেকে হংকং অভিমুখী দু’টো মার্কিন বোয়িং ৭৪৭ মিমানে একই সঙ্গে মধ্য আকাশে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু লাদেনের ঐ নেটওয়ার্কটি ভেঙ্গে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা কর্যকর করা যায়নি। নেটওয়ার্কটির ভাগ্যই ছিল মন্দ।

 ১৯৯৫ সালের জানুয়ারীতে ম্যানিলায় পোপের প্রাণনাশের চেষ্টাও একইভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। বোমা তৈরির সময় উপাদান মিশ্রণে কোন ভুল হয়ে থাকবে যে কারণে বিষাক্ত ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। এ অবস্থায় ইউসুফ ও অন্যান্য জিহাদী তাদের এ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে সাইদ আকরাম ধরা পড়েন। ইউসুফ সহ অন্যরা থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান। সেখান থেকে যান পাকিস্তানে। সিআইএ এসব তথ্য নিখুঁতভাবে যোগার করেছিল। এমনকি ইউসুফ কোন যায়গায় লুকিয়েছিল সে তথ্যটিও। ইউসুফের আত্মগোপন স্থলটি ছিল একটা এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। বিন লাদেনরই একটি কোম্পানী ওটা ভাড়া নিয়েছিল। মার্কিন সরকার এসব সুনির্দিষ্ট তথ্য ইসলামাবাদের কাছে পেশ করলে ইসলামাবাদের সহযোগীতা করা ছাড়া বিকল্প আর কিছু ছিল না। নইলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলতে পারত। মার্কিন-পাকিস্তানী আইন প্রয়োগকারী দল ইউসুফকে ধরতে গেলে ঐ এ্যাপার্টমেন্টে বসবাসরত ইউসুফের আর সকল কমরেড ও জিহাদীকে আইএসআই আগেই সরিয়ে ফেলে। শুধু ইউসুফ ধরা পড়ে। তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
-----চলমান।

কোন মন্তব্য নেই:

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages