চাপের মুখে বিন লাদেন এক সময় ভাগলেন। তিনি সৌদি আরব থেকে সুদানের রাজধানী খার্তুমে পালিয়ে গেলেন। সেই যে গেলেন আর তিনি স্বদেশে ফিরতে পারলেন না। ওসামা বিন লাদেন খার্তুমের অভিজাত শহরতলীতে চার স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন নিয়ে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। তারপর এক বৃহত্তর সংগঠনের ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য আফগানিস্তান থেকে বিমানে করে যুদ্ধাভিজ্ঞ বেশ কয়েক শ’ আরব স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে এলেন। সুদানে জীবনযাত্রায় বৈচিত্র ছিল। ফুটবল ম্যাচ হতো। নীল নদে সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো। অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বার জন্য শিয়া-সুন্নী ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন কি না এ নিয়ে কমনরুম টাইপের বিতর্ক হতো। বিতর্ক হতো ইসলামী মতবাদের বিভিন্ন দিক নিয়ে। সুদানে বিন লাদেন নিজের নামে ব্যক্তিগত ব্যাংক এ্যাকাউন্টও খুললেন।
তখন লাদেনের বেশিরভাগ সময় বিশ্বব্যাপী জিহাদের আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার চাইতে বরং অর্থোপার্জনের কাজেই ব্যয় হচ্ছিল। ওসামা বিন লাদেনের সহায় সম্পদ নিয়ে কল্পনার শেষ নেই। লন্ডনে নিযুক্ত সৌদি আরবের প্রবীণ রাষ্ট্রদূত গাজী আল গোসাইবি সম্প্রতি বলেছেন: আমি এমন খবরও পাঠ করেছি যে, লাদেন ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলার সরাসরি লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কথাটা মোটেই ঠিক নয়। সৌদি আরব ছেড়ে চলে যাবার সময় তিনি ঐ পরিমাণ অর্থ সঙ্গে নেননি। অন্যদিকে সৌদি কর্তৃপক্ষও সর্বদা শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল। যাতে সৌদি আরব থেকে লাদেন কানাকড়িও না নিয়ে যেতে পারেন।
খার্তুমে বিভিন্ন সংগঠনের অফিস ছিল। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অফিসটি ছিল লাদেনের আল কায়েদা সংগঠনের। তাঁর সংগঠনটি অন্য যে কোনো সংস্থার মতোই পরিচালিত হত। সংগঠনের বোর্ড অব ডিরেক্টর বা পরিচালকমন্ডলী ছিল। বেশ কয়েকটি উপকমিটি ছিল। এসব কমিটি আর উপকমিটির অনবরত বৈঠক লেগেই থাকত।
তার সংগঠন একটি ব্যবসায় কোম্পানি চালাত। যার নাম ছিল লাদেন ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া চালাত বৈদেশিক মুদ্রার ডিলারশিপ। চালাত একটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং একটি কৃষিপণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিন লাদেন রাজধানী খার্তুম থেকে পোর্ট সুদান পর্যন্ত সাতশ’ মাইল দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। তারই বিনিময়ে সুদান সরকার তাকে তিলের বীজ রপ্তানীর একক অধিকার প্রদান করে। সুদান হল বিশ্বের সর্বাধিক তিল উৎপাদনকারী তিনটি দেশের অন্যতম একটি দেশ। সুতরাং বলাই বাহুল্য সুদান থেকে তিল রপ্তানীর ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক ছিল। এই ব্যবসা থেকে বেশ ভালো মুনাফা করেছিলেন বিন লাদেন। তবে তার অন্যান্য ব্যবসা অতটা সফল হতে পারেনি। আজারবাইজান থেকে বাইসাইকেল আমদানির একটা উদ্যোগ সম্পূর্ণ মার খেয়েছিল। আরও কিছু হঠকারী স্কিমও নেয়া হয়েছিল। সেগুলো আধাআধি বাস্তবায়িত হবার পর চোরাবালির মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও আল কায়েদার মূল ব্যবসা কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ বিন লাদেনের হাতে ছিল। তবে সমস্ত ক্রিয়াকলাপের পিছনে মূল যে উদ্দেশ্য সেটা কখনও বিন লাদেনের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়নি। জর্ডানের জিহাদপন্থী ইসলামীদের নগদ এক লাখ ডলারেরও বেশি দেয়া হয়েছিল। চেচনিয়ায় ইসলামী জিহাদীদের গোপনে নিয়ে আসার জন্য বাকুতে অর্থ পাঠিয়ে দেয়া হয়। আরও এক লাখ ডলার পাঠানো হয় ইরিত্রিয়ার ইসলামী সংগঠনের জন্য। এক পর্যায়ে বিন লাদেন আড়াই লাখ ডলার দিয়ে একটা প্লেন কেনেন। এবং এক পাইলটকে ভাড়া করেন। ক’দিন পরই বিমানটি দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। তিনি সুদানে বেশ কয়েকটি সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেন। শত শত আলজেরীয়, ফিলিস্তিনী, মিসরীয় ও সৌদি নাগরিক এসব শিবিরে বোমা তৈরির কৌশলসহ নানা ধরনের জিহাদী কলাকৌশল শিক্ষা লাভ করে। এদের অনেকে আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এসব ইসলামী মুজাহিদের মধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারককে হত্যার কথাবার্তা ওঠে। কিন্তু সেই হত্যা পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত ছিল না।
নাইরোবিতে মার্কিন দূতাবাসসহ পূর্ব আফ্রিকায় বোমা হামলার সম্ভাব্য টার্গেটগুলোর ওপর কিছু এলোমেলো গুপ্তচরগিরিও চালানো হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে সুদান তার বিশেষ অতিথি বিন লাদেনকে নিয়ে উত্তরোত্তর অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। হাসান আল তুরাবি তখন আফগানিস্তানে নিযুক্ত সুদানী রাষ্ট্রদূত আতিয়া বাদাবির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাদাবি পেশোয়ারে থাকতেন। রুশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় তিনি পশতু ভাষা শিখেছিলেন। আফগান মুজাহিদদের অনেকের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এবং কারোর কারোর সঙ্গে চমৎকার যোগাযোগও ছিল। আফগানিস্তান তখন বিবাদমান সেনা কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণাধীন শত শত এলাকায় খন্ড বিখন্ড ছিল। আতিয়া বাদাবি এমন এক পটভূমিতে জালালাবাদের সবচেয়ে সিনিয়র তিনজন কমান্ডারকে সহজেই একথা বুঝাতে পেরেছিলেন যে একজন ধনবান সৌদিকে তারা যদি নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারে তাহলে তাদের অনেক লাভ হবে। বিশেষ করে প্রতিপক্ষের ওপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে তিন কমান্ডার এরপর সুদানে গিয়ে সরাসরি বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করে তাকে আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এই তিনজন কমান্ডারের কেউই আজ জীবিত নেই।
১৯৯৬-৯৮ মুজাহীদ বাহিনী গঠন
কাবুলে শরতের এক সন্ধা। উত্তরাঞ্চলীয় শহরতলী ওয়াজির আকবর খানের উঁচু দালানঘেরা এক বাড়ির বাইরে ডজনখানেক জাপানী পিক আপ ট্রাক দাঁড়ানো। ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্ষী ও ড্রাইভাররা রুশ বাহিনী চলে যাওয়ার পর থেকে সাত বছরে বড় ধরনের কোন লড়াই এখানে না হলেও প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে এবং সেগুলোর সামনে স্তূপ করে রাখা বালির বস্তার গায়ে গুলির বা বোমার টুকরার আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে ১৯৯৬ সালের অক্টবর মাস তখন। ওসামা বিন লাদেন তালেবান নেতাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কাবুলে এসেছেন। নগরীতে ওটাই ছিল তার প্রথম আগমন এবং একমাস আগে ক্ষমতা দখলকারী কট্টর ইসলামী মিলিশিয়া বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে ওটাই ছিল তার প্রথম সাক্ষাত। সে বছরের মে মাসের বিশষভাবে ভাড়া করা এক পরিবহন বিমানে করে ৩৯ বছর বয়স্ক বিন লাদেন তার চার স্ত্রীর মধ্যে তিন স্ত্রী, আধ ডজন ছেলে মেয়ে ও তার অনুসারী শ খানেক আরব যোদ্ধা জালালাবাদ বিমান বন্দরে এসে পৌঁছান।
কিন্তু যে তিনজন মুজাহিদ কমান্ডার সুদান থেকে তাকে আফগানিস্তানে চলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন তারা এ কয়েক মাসের মধ্যে উৎখাত হয়ে যান এবং এ অবস্থায় বিন লাদেনের আফগানিস্তানের নতুন সরকারের অনুগ্রহভাজন হবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক মাস আগে বিন লাদেন তার এক লিবীয় সহযোগীকে কান্দাহারে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের কাছে পাঠিয়েছিলেন। মোল্লা ওমর তখন তালেবান উপনেতা ও কাবুলের মেয়র মোল্লা মোহাম্মদ রব্বানীকে বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাত করার নির্দেশ দেন এবং তিনি সত্যি কতটা বন্ধুভাবাপন্ন তা যাচাই করে দেখতে বলেন। সে অনুযায়ী তাদের মধ্যে এক বৈঠক হয় এবং ঐ বৈঠক উপলক্ষেই কাবুলে এসেছিলেন বিন লাদেন। বৈঠকে দু’পক্ষই ছিলেন সতর্ক অথচ বন্ধুভাবাপন্ন। লাদেনই প্রথম কথা বলেন। নিজেদের মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ভুলে গিয়ে তিনি মিলিশিয়াদের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য এবং অর্জিত সাফল্যের প্রশংসা করেন এবং নিঃশর্তভাবে নৈতিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। রব্বানী খুবই খুশি ও তুষ্ট হন। তিনি বিন লাদেনকে সরকারের তরফ থেকে নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। বৈঠক থেকে সবাই হাসি মুখে বেরিয়ে আসে। লাদেন ও তালেবানদের মধ্যে এই মৈত্রী নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এটা ছিল বিন লাদেনের বিকাশের চূড়ান্ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা। তালেবানদের নিরাপত্তা আদায় করতে সক্ষম হয়ে তিনি এবার বিশ্বের এযাবতকালের সবচেয়ে দক্ষ একটি জিহাদী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে হাত দেন।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের অংশ নিয়ে বিন লাদেন অতি প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসই কেবল অর্জন করেননি, গোটা ইসলামী বিশ্বে যোগাযোগের এক ব্যাপক বিস্তৃত নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছিলেন। তদুপরি খ্যাতি, শ্রদ্ধা ও প্রশংসার স্বাদও পেয়েছিলেন তিনি। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা লাদেনের পরিচিতি ও কর্তৃত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। সুদানে তিনি গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থানের অনৈসলামীক সরকারগুলোকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত মুসলিম জিহাদীদের ছত্রছায়া সংগঠন আল কায়েদা গঠনের কাজে গুরুত্বের সাথে হাত দিতে সক্ষম হন। তবে সামরিক শক্তি-সামর্থ্য ও রণকৌশলগত চিন্তাধারার দিক দিয়ে বিন লাদেনের এই সংগঠনটি তখনও যথেষ্ট দুর্বল ছিল। আফগানিস্তানে এসে তিনি এ সমস্যার দ্রুত একটা সমাধান খুঁজে পান। যিনি এমন একটি দেশে ফিরে আসেন যেখানে ছয় বছর ধরে নৈরাজ্য চলছিল। হাজার হাজার জিহাদপন্থী মুসলিম দেশের পূর্বাঞ্চলে মুজাহিদদের পুরনো কমপ্লেক্সগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। এদের অনেককে পৃষ্ঠপোষকতা করতো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যারা এই ধর্মানুরাগী যুদ্ধাদেরকে কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করতে চাইতো। অন্যরা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতো সমগ্র বিশ্বের নানা মত ও পথের ইসলমী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে।
---চলমান।
Oldar part
Part 1
Part 2
Part 3
২টি মন্তব্য:
বাকি পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকল
ইনশাআল্লাহ্,
আজকেই দেওয়া হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন