রাহমান রাহিম আল্লাহতালার নামে,
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার এবং একে আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে কেউ এমন কাজ না করে, যা তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। এ ব্যাপারে দাওয়াত দেওয়ার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوْا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ فَمِنْهُمْ مَنْ هَدَى اللهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلاَلَةُ- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত[1] কে পরিহার কর। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যককে আল্লাহ হেদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্য বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল’ (নাহল ৩৬)।
সুতরাং যারা নবীদের অনুসরণ করবে তারা সৎপথ পাবে। আর যারা তাঁদের অনুসরণ করবে না কিংবা অবাধ্যতা বা বিরোধিতা করবে তারা পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হবে। এছাড়াও এমন কিছু কাজ-কর্ম রয়েছে, যা মুসলমানের ঈমান ধ্বংস করে দেয়, তাকে ‘মুরতাদে’ পরিণত করে তথা ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। মুরতাদ হওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ও ছহীহ হাদীছ সমূহে অসংখ্য সাবধান বাণী পরিলক্ষিত হয়। মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম একমত যে, এটা হত্যাযোগ্য অপরাধ এবং তার মাল-সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের জন্য বৈধ।ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার বা ঈমান বিনষ্ট হওয়ার কারণ অনেক। তন্মধ্যে দশটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল.
الشرك في عبادة الل1 তথা আল্লাহর ইবাদতে শরীক বা অংশীদার স্থাপন করা!
১. الشرك في عبادة الله তথা আল্লাহর ইবাদতে শরীক বা অংশীদার স্থাপন করা। আল্লাহর সাথে শিরক বিভিন্নভাবে হ’তে পারে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
(ক) ইবাদত পাওয়ার একমাত্র উপযুক্ত সত্তা আল্লাহ তা‘আলাকে না মেনে তাঁর সাথে আরো কাউকে যোগ্য বলে মনে করা। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِيْ جَهَنَّمَ مَلُوْمًا مَدْحُوْرًا ‘আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির কর না। তাহ’লে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’ (বানী ইসরাঈল ৩৯)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, لاَ تَجْعَلْ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُوْمًا مَخْذُوْلاً ‘আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করো না। তাহ’লে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে’ (বানী ইসরাঈল ২২)।
তিনি আরো বলেন, وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ لاَ بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الْكَافِرُوْنَ ‘যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, যার কোন সনদ তার কাছে নেই, তার হিসাব তার পালনকর্তার নিকটে রয়েছে। নিশ্চয়ই কাফিররা সফলকাম হবে না’ (মুমিনূন ১১৭)।
নবীদেরকেও এ ব্যপারে আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَكُوْنَ مِنَ الْمُعَذَّبِيْنَ ‘(হে নবী!) আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকবেন না। তাহ’লে আপনি শাস্তিতে নিপতিত হবেন’ (শু‘আরা ২১৩)।
উল্লেখিত আয়াতে নবী করীম (ছাঃ)-কে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে। অথচ নবীদের জাহান্নামী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা পীর, অলী-আওলিয়া বা কোন কবরবাসীকে ডাকে, তাদের ইবাদত করে, তারা ঈমান হারাবে এবং জাহান্নামী হবে। কারণ উক্ত কাজ স্পষ্ট শিরক। আর এ ধরনের শিরক মুমিনকে ঈমানহীন করে দেয়।
(খ) মৃতব্যক্তির নিকট কিছু চাওয়া বা অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য দো‘আ করা শিরকে আকবার তথা বড় শিরক। কোন মুমিন যদি এ কাজ করে তবে তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। কারণ ভাল-মন্দ দেওয়া, না দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
তিনি বলেন, قُلْ أَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلاَ نَفْعًا وَاللهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্ত্তর ইবাদত কর, যে তোমাদের অপকার ও উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। অথচ আল্লাহ সব শুনেন ও জানেন’ (মায়েদাহ ৭৬)।
আল্লাহর নবী (ছাঃ) নিজেই নিজের উপকার-অপকার করতে পারতেন না বলে কুরআনে প্রমাণ মিলে। সেখানে অন্যদের মাধ্যমে কি করে উপকার আশা করা যায়? আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاءَ اللهُ ‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই কিন্তু আল্লাহ যা চান’ (আ‘রাফ ১৮৮)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ لاَ يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا ‘(হে নবী!) বলুন, তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা ভাল ও মন্দের মালিকও নয়’ (রা‘দ ১৬)।
অন্যত্র তিনি বলেন, وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ ‘আল্লাহ যদি তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তিনি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনিই তার বান্দার উপর পরাক্রান্ত’ (আন‘আম ১৭-১৮)।
মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِيْ بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُوْنَ ‘বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি যদি আল্লাহ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাক, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। (প্রকৃত পক্ষে) নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে’ (যুমার ৩৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন, وَاتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهِ آلِهَةً لاَ يَخْلُقُوْنَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُوْنَ وَلاَ يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ ضَرًّا وَلاَ نَفْعًا وَلاَ يَمْلِكُوْنَ مَوْتًا وَلاَ حَيَاةً وَلاَ نُشُوْرًا ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে কত উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট। তারা নিজেদের ভালও করতে পারে না মন্দও করতে পারে না। আর জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের মালিকও তারা নয়’ (ফুরক্বান ৩)।
তিনি আরো বলেন, إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلاَ تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِيْنَ ‘আপনি মৃতদেরকে ডাক শুনাতে পারবেন না এবং বধিরকেও নয়, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়’ (নামল ২৭)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ مَا يَمْلِكُوْنَ مِنْ قِطْمِيْرٍ، إِنْ تَدْعُوْهُمْ لاَ يَسْمَعُوْا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوْا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ وَلاَ يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيْرٍ- ‘তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খেজুর আটিরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের সে ডাক শুনে না। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয় না। ক্বিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহর ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবে না’ (ফাতির ১৩-১৪)।
(গ) মৃতব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া বা কাউকে বান্দা নেওয়াজ, গরীবে নেওয়াজ, গাওছুল আযম (সর্বোচ্চ সহযোগিতাকারী) মনে করাও বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَوْثَاناً وَتَخْلُقُوْنَ إِفْكاً إِنَّ الَّذِيْنَ تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ لاَ يَمْلِكُوْنَ لَكُمْ رِزْقاً فَابْتَغُوْا عِنْدَ اللهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوْهُ وَاشْكُرُوْا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ- ‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর কাছে রিযিক তালাশ কর, তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আনকাবূত ১৭)।
আল্লাহ পাক আরো বলেন, وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُوْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لاَّ يَسْتَجِيْبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্ত্তর পূঁজা করে, যে ক্বিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারাতো তাদের পূঁজা সম্পর্কেও বেখবর’ (আহকাফ ৫)।
কোন কিছু চাইতে হ’লে কেবল আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ ‘যখন তুমি কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই করবে’।[2]
সাহায্য চাওয়ার দু’টি অবস্থা হ’তে পারে। একটি ‘দো‘আ’ অপরটি ‘ইস্তিগাছা’। সাধারণভাবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার নাম হচ্ছে ‘দো‘আ’। আর দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করার নাম হচ্ছে ‘ইস্তিগাছা’। সুতরাং ইস্তিগাছা শব্দ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা এবং তাদের নামের সাথে ‘গাওছুল আযম’ ব্যবহার করা জায়েয নয়। এসব কেবল আল্লাহর জন্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তিনিই দো‘আকারীর ডাকে সাড়া দেন। তিনিই বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।[3]
(ঘ) আল্লাহ ব্যতীত মৃত বা জীবিত কারো নামে মানত করা শিরক। গায়রুল্লাহর নামে মানত করলে ঐ মানত পূর্ণ করা যাবে না। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيْعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِىَ اللهَ فَلاَ يَعْصِهِ ‘যে ব্যক্তি আললাহর আনুগত্যের কাজে মানত করে, সে যেন তা পূরা করার মাধ্যমে তার আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মানত করে, সে যেন তার নাফরমানী না করে। (অর্থাৎ মানত পূরা না করে)।[4]
নযর বা মানত করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হবে, যদি তা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়। আর আল্লাহর নামে মানত করলে তা আদায় করা ওয়াজিব। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মানত করলে তা শিরক হবে। বিধায় তা পূর্ণ করা হারাম। এরূপ মান্নতের নিয়ত করে থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে এবং তওবা করতে হবে।[5]
অনেকে কবরে মোমবাতি, তেল, আগরবাতি, টাকা-পয়সা, গরু-খাসি, মোরগ-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি মানত করে। তারা মনে করে এর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য হাছিল হবে, রোগমুক্তি হবে, হারানো ব্যক্তিকে ফিরে পাবে, মালের নিরাপত্তা লাভ হবে, নিঃসন্তানের সন্তান হবে ইত্যাদি। এসবই শিরক-এর অন্তর্ভুক্ত। নবীগণ সবচেয়ে সম্মানী ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়া সত্যেও তাঁদের কবর সমূহে কোন নযরানা, মানত দেওয়া হয় না। এ ধরনের মানত, নযরানা তারা কবরবাসীর সম্মান ও বরকতের জন্যই করে থাকে এবং তাদের ধারণা এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হবে। যেমন মক্কার মুশরিকদের ধারণা ছিল। তারা বলত, مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللهِ زُلْفَى ‘তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দিবে বলেই আমরা তাদের ইবাদত করি’ (যুমার ৩)।
এমনকি যেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে পূজা করা হ’ত সেখানেও আল্লাহর নামে মানত করা হারাম। বর্তমানে সেখানে পূজা চলুক বা না চলুক। ছাবিত বিন আয-যাহহাক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূলের যুগে ‘বুয়ানা’ নামক স্থানে একটি উট কুরবানী করার মানত করল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে স্থানে এমন কোন মূর্তি ছিল কি, জাহেলী যুগে যার পূজা করা হত’? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, না। তিনি বললেন ‘সে স্থানে কি তাদের কোন উৎসব বা মেলা অনুষ্ঠিত হ’ত’? তাঁরা বললেন, না। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি তোমার মানত পূর্ণ কর। কেননা আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মানত পূর্ণ করা যাবে না। আদম সন্তান যা করতে সক্ষম নয়, এমন মানতও পুরা করা যাবে না’।[6]
(ঙ) যে স্থানে মুশরিকরা তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করে সে স্থানটি শিরকের নিদর্শনে পরিণত হয়। কারণ এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেব-দেবীর নৈকট্য লাভ করা এবং আল্লাহর সাথে শরীক করা। একারণেই যদি কোন মুসলমান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তেও উক্ত স্থানে পশু যবেহ করে, তবুও তা হবে মুশরিকদের অনুরূপ কাজ। মুশরিকদের দৃষ্টিতে তাদের পুণ্যময় স্থানের অংশীদার। মুশরিকদের কোন কাজের সাথে বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ মিল তাদের প্রতি আসক্তিরই নামান্তর।[7]
মৃতব্যক্তির নামে কোন কিছু যবেহ করাও হারাম। মহান আল্লাহ বলেন, حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيْرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃতপ্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত, যেসব জন্তু আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়’। একটু পরেই বলেন, وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ ‘যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে যবেহ করা হয় এবং যা ভাগ্য নির্ধারক শর দ্বারা বণ্টন করা হয় (তাও হারাম)। এসব পাপ কাজ’ (মায়েদাহ ৩)।
এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَهُ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ آوَى مُحْدِثًا وَلَعَنَ اللهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الأَرْضِ ‘(১) যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা‘নত
(২) যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু-প্রাণী যবেহ করে তার উপর আল্লাহর লা‘নত (৩)
যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা‘নত (৪)
যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করে, তার উপর আল্লাহর লা’নত’।
[8] উল্লিখিত বিষয় সমূহ সুস্পষ্ট রূপে শিরকে আকবর, যা থেকে বিরত থাকা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তা‘আলা শিরকের ব্যাপারে বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً بَعِيْدًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা শিরকের গুনাহ ক্ষমা করবেন না। তবে অন্যান্য গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়’ (নিসা ১১৬)।
অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘নিশ্চয়ই যেআল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার আবাসস্থল হয় জাহান্নাম। আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (মায়েদাহ ৭২)।
ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ وَهْوَ يَدْعُو مِنْ دُوْنِ اللهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[9]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ- ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক। ছাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি? তিনি জবাবে বললেন,
(১) ‘আললাহর সাথে শিরক করা, (২) যাদু করা, (৩) অন্যায়ভাবে এমন কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন, (৪) সূদ খাওয়া, (৫) ইয়াতীমের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা, (৬) ধর্মযুদ্ধ কালীন সময়ে (রণক্ষেত্র) থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করা, (৭) সতী-সাধ্বী উদাসীনা মুমিন নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা’।
[ 10] আবু বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ قُلْنَا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللهِ وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সমূহের কথা বলব না? ছাহাবীগণ বললেন, নিশ্চয়ই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া...’।[11] জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ لَقِىَ اللهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি কোন শিরক করা ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে (মৃত্যুবরণ করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।
[12] আল্লাহ তা‘আলা নবী করীম (ছাঃ)-কেও শিরক থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বললেন এভাবে, لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যদি তুমি শিরক কর, তবে তোমার সমস্ত আমল অবশ্যই বাতিল হয়ে যাবে এবং নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৬৫)।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِىْ غَيْرِىْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করে যে আমলে আমার সাথে অন্যকে শরীক করেছে, এমন আমল ও যাকে সে শরীক স্থাপন করেছে, আমি উভয়ই প্রত্যাখ্যান করি।[13]
ফুটনোটঃ[1]. ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘ত্বাগূত অর্থ হ’ল শয়তান’। ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ)-এর মতে, ইবাদত, অনুসরণ ও আনুগত্যের দিক দিয়ে মা‘বূদ (আল্লাহ)-কে ত্যাগ করে অন্যের ইবাদত করা।
ঐ জাতিকেও ত্বাগূত বলা হয়, যারা আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর বিধান ব্যতীত অন্যের তৈরী বিধান দ্বারা ফায়ছালা করে’। দ্রঃ ফাতহুল মাজীদ ১৯ পৃঃ।
[2]. তিরমিযী হা/২৫১৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯৫৭।
[3]. তাওহীদের মর্মকথা পৃঃ ৭৩ (টীকা)।
[4]. বুখারী হা/৬৬৯৬।
[5]. ফাতহুল মাজীদ ১৩৬ পৃঃ।
[6]. আবূদাঊদ হা/৩৩১৫; ইবনু মাজাহ হা/২১৩০, সনদ ছহীহ।
[7]. তাওহীদের মর্মকথা, ৬৬ পৃঃ টীকা দ্রঃ।
[8]. মুসলিম হা/১৯৭৮; মিশকাত হা/৪০৭০।
[9]. বুখারী হা/৪৪৯৭।
[10]. বুখারী হা/৬৮৫৭; মুসলিম হা/৮৯।
[11]. বুখারী হা/৬৯৭৬; মুসলিম হা/৮৭।
[12]. মুসলিম হা/৯৩।
[13]. মুসলিম হা/৭৬৬৬; মিশকাত হা/৫৩১৫।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন