Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

আল ইগতিয়াল : গুপ্তহত্যার বিষয়ে ইসলামী বিধান – শাইখ আবু জান্দাল আল আযদী (ফারিস আল জাহরানি)







আল ইগতিয়াল : গুপ্তহত্যার বিষয়ে ইসলামী বিধান – শাইখ আবু জান্দাল আল আযদী (ফারিস আল জাহরানি)

গুপ্ত হত্যার শর্ত


১) যে ব্যক্তি এ কাজ করবে তাকে অবশ্যই সঠিক ইসলামী আকীদার ধারক হতে হবে।
২) যাকে হত্যা করা হবে তাকে অবশ্যই ইসলামী শরিয়া মোতাবেক এই শাস্তির উপযুক্ত হতেহবে অর্থাৎ শুধু হত্যা যোগ্য অপরাধ হলেই চলবে না যেমন ব্যভিচার বা হত্যা; বরং নিশ্চিতভাবে এমন প্রকৃতির অপরাধী হতে হবে যার উপর এই শাস্তি প্রয়োগের বৈধতা রয়েছে।

ইসলামি শরিয়াতে গুপ্ত হত্যার বৈধতা!

মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনী অধ্যয়ন করলে একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাদের জিহাদ তথা সামরিক কৌশল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুপ্ত হত্যা ছিলো একটি শিল্প হিসেবে বিবেচ্য বিষয় এবং তাদের সামরিক কর্মকাণ্ডের একটি অন্যতম অংশ। আল্লাহর পথে জিহাদ ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য হুকুম আহকাম ইসলামে যেমন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তেমনি একই হুকুমের আওতাভুক্ত হবে গুপ্তহত্যার এই শিল্প কলা।
আমরা এই আলোচনায় কাফেরদের নেতৃস্থানীয় যে সব লোকেরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো, যেসব লোকেরা আল্লাহ্*তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে কষ্ট দিয়েছিল তাদেরকে হত্যার কিছু ঘটনা তুলে ধরবো, এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআন ও হাদিসের ভাষ্যসমুহ উপস্থাপন করব, সালাফ আস সালেহীন ওলামায়ে কেরামগন তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কিতাব সমুহে এসব ভাষ্য ও ঘটনা থেকে যেসব ফিকহী মাসআলা মাসায়েল বের করেছেন তা পেশ করবো। আমাদের পাঠকদের সদয় অবগতির জন্য মুল আলোচনা আরম্ভ করার আগেই স্বরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ‘আইম্মাতুল কুফুর’ বা কুফুরের নেতাদের গুপ্তহত্যার বৈধতা এমনই একটি স্বতঃসিদ্ধ মাসআলা যে সালাফ আস সালেহীনদের কেউই এর বৈধতার ব্যপারে দ্বিমত পোষণ করেননি।

কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গুপ্ত হত্যার দলীল


১ম দলীলঃ কাফির মুশরিকদের হত্যার সাধারণ বিধান

আল্লাহ্* রব্বুল আলামিন ঈমানদারদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-

 

فَاقْتُلُواالْمُشْرِكِينَحَيْثُوَجَدْتُمُوهُمْوَخُذُوهُمْوَاحْصُرُوهُمْوَاقْعُدُوالَهُمْكُلَّمَرْصَدٍ

তোমরা মুশরিকদেরকে হত্যা করো যেখানেই তাদেরকে পাও, তাদেরকে ধরো, তাদেরকে বেঁধে ফেলো, তাদেরকে হত্যার জন্য ঘাটিতে ওঁত পেতে অপেক্ষা করতে থাকো। (সূরা আত তাওবা, আয়াত ৫)

এ আয়াতে গুপ্ত হত্যার বৈধতার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ইমাম কুরতুবী রহঃ এ আয়াতের ‘উকু‘দু লাহুম কুল্লা মারসদ‘ এর ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ হলো,

اقعدوالهمفيموضعالغرةحيثيُ رصدون

অর্থাৎ তাদের উপর আক্রমন করার জন্য, তাদেরকে হত্যা করার জন্য, অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমনের জন্য গোপন ঘাটিতে ওঁত পেতে থাকো।
এরপর ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন,

وهذادليلعلىجوازاغتيالهمقب لالدعوة

অর্থাৎ এ আয়াতের মধ্যে এ কথার স্বপক্ষে দলীল রয়েছে যে মুশরিদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পূর্বেও হত্যা করা বৈধ।
(তবে মনে রাখা দরকার যে এ হুকুম কেবল রক্ষণাত্নক জিহাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কেননা আক্রমনাত্নক যুদ্ধের ক্ষেত্রে অবশ্যই আক্রমন শুরু করার পূর্বে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে।)
এই আয়াত কুফফারদের ধরার জন্য গোপন ঘাটি তৈরী, তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা ও তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার বৈধতা দেয়। এ কারণে মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ ইমাম ইবনুল আরাবী রহঃ তার তাফসীর গ্রন্থ আহকামুল কুরআনে বলেন ‘আমাদের ফকীহগন তাদেরকে হত্যার জন্য ওঁত পেতে থাকা এবং তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দেয়ার পূর্বে গুপ্তভাবে হত্যা করা প্রসঙ্গে বলেন যে এ হত্যার ব্যপারে যথেষ্ট মজবুত দলীল প্রমাণ রয়েছে’।
ইমাম ইবনে কাসীর রহঃ তার তাফসীর গ্রন্থে এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে বলেন – وَاحْصُرُوهُمْوَاقْعُدُوا لَهُمْكُلَّمَرْصَد

لاتكتفوابمجردوجدانكملهمبل اقصدوهمبالحصارفيمعاقلهموح صونهموالرصدفيطرقهمومسالكه محتىتضيقواعليهمالواسعوتضط روهمإلىالقتلأوالإسلام

অর্থাৎ ‘তাদেরকে তোমাদের হাতের নাগালে পেয়ে তারপর হত্যা করবে শুধু এমন চিন্তা করে বসে থাকা যথেষ্ট নয়; বরং এ আয়াত বলছে যে তোমরা তাদের বাড়ি ঘরে, তাদের শহর নগরে গিয়ে তাদেরকে আক্রমন করো, ঘাটি স্থাপন করো, ওঁত পেতে থাকো, তাদেরকে ঘিরে ফেলে অবরোধ করে রাখো যাতে করে পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং তারা এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় যে হয় যুদ্ধ করতে হবে অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে হবে’।
বিংশশতাব্দিতে বিশ্বব্যপি জিহাদকে পুনরুজ্জীবনের প্রান পুরুষ মুজাহিদ শায়খ শহীদ ডঃ আব্দুল্লাহ আযযাম রহঃ তার সুরা আত তাওবার তাফসীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে কুফফারদেরকে সতর্ক করার পূর্বেই তাদেরকে গুপ্তভাবে হত্যা করা জায়েয; আর এখানে যেহেতু আল্লাহ্* তায়ালা একাজের হুকুম দিয়েছেন অতএব গুপ্ত হত্যার আমল একটি সুস্পষ্ট বোধগম্য ফরয হুকুম।



২য় দলীলঃ কিসাস বা সমান শাস্তির বিধান প্রয়োগ

আল্লাহ্*রব্বুল আলামিন এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বলেন-

فمناعتدىعليكمفاعتدواعليهبمثلمااعتدىعليكم

যে তোমাদের উপর বাড়াবাড়ি করেছে তোমরাও তার উপর ঠিক ততো খানি বাড়াবাড়ি করবে যতো খানি তারা তোমাদের উপর করেছে।(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৯৪)

 

والذينإذاأصابهمالبغيهمينتصرونوجزاءسيئةسيئةمثلهافمنعفاوأصلحفأجرهعلىاللهإنهلايحبالظالمينولمنانتصربعدظلمهفأولئكماعليهممنسبيلإنماالسبيلعلىالذينيظلمونالناسويبغونفيالأرضبغيرالحقأولئكلهمعذابأليم

(ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হল) তারা যখন অন্যায় বাড়াবাড়ির শিকার হয় তখন তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে; আর দুষ্কৃতির বদলা হল তার সমপরিমাণ দুষ্কৃতি; তবে (কল্যাণকর মনে করে) যে মাফ করে দেবে এবং সংশোধন করে দেবে তার বিনিময় আল্লাহ্*র কাছে রক্ষিত; নিশ্চয়ই তিনি যালিমদেরকে মোটেই ভালোবাসেন না। আর যুলমের শিকার হয়ে যদি কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করে তবে তাদের উপর কোন অভিযোগ দায়ের করা চলবে না; অভিযোগ তো কেবল তাদের উপর যারা মানুষের উপর যুলুম করবেএবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করে বেড়াবে; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা আশ শূরা, আয়াত ৩৯-৪২)

 

وإنعاقبتمفعاقبوابمثلماعوقبتمبه

আর তোমরা যদি তোমাদের শত্রুদেরকে শাস্তি দাও তাহলে ঠিক সেইভাবে তাদেরকে শাস্তি দিবে যেভাবে তারা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। (সূরা আন নাহল, আয়াত ১২৬)

এ সকল আয়াত সমুহ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হলেও এর সামগ্রিক হুকুম সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য। কেননা আল কুরআনের কোন আয়াত বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হলেও সে আয়াতের হুকুম কেবল সেই ঘটনার সাথেই খাস নয় বরং একই রকম সকল ঘটনার ক্ষেত্রেই সে আয়াতের হুকুম সমান ভাবে জারী থাকবে। এ ব্যপারে ইসলামের মূলনীতি হল العبرةبعموماللفظلابخصوصالسبب অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণ করা হবে শব্দের সাধারণ অর্থের উপর ভিত্তি করে; শুধু আয়াত নাযিলের ঘটনার সাথে হুকুমকে খাস করা হবে না।
অতএব আজ কুফফাররা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন অভিযান পরিচালনা করে, গুপ্তচর বৃত্তি করে, ড্রোন আক্রমন করে মুসলিম জাতির বীর সন্তান মুজাহিদদেরকে হত্যা করে, নারী শিশু সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যা করে তাহলে আমাদের পক্ষেও যেভাবে সম্ভব আমরা তাদেরকে আমাদের গুপ্ত হত্যার শিকারে পরিণত করবো, আমরাও তাদের নেতাদেরকে হত্যা করবো, তাদের বেসামরিক সাধারণ মানুষ ওনারী শিশুদেরকে হত্যা করবো। তারা যদি আমাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করে আমরাও তাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করবো। তারা যদি আমাদের কাউকে অপহরণ করে আমরাও তাদের লোকদেরকে অপহরণ করবো, তারা আমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করে নিলে আমরাও তাদের সম্পদ বৈধ কারণে যেভাবে সম্ভব ছিনিয়ে নেব।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহঃ এ আয়াত সমূহের ব্যখ্যায় বলেন, এ সব আয়াত সমূহ প্রমাণ করেযে জান মাল, সহায় সম্পদ, ঘর বাড়ি নারী শিশু যাবতীয় ক্ষেত্রে সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ।
সমান প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধতা ইসলামী শরিয়তে এমনই স্বীকৃত একটি বিধান যে স্বয়ং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও এ কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা বা সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ; অতএব যে অপরাধের কারণে যে শাস্তি মুসলমানদের উপর প্রয়োগ বৈধ সে বিধান কুফফারদের ক্ষেত্রে তো সন্দেহাতীত ভাবে কার্যকর।
অতএব আমেরিকা ও তার দোসররা যেহেতু গোটা পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অবরোধ আরোপ করে ইরাকে নারী শিশু সহ দশ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করছে, আফগানিস্তানে আবাল বৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করে চলছে; ইয়েমেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে চলছে তাদের গোপন ড্রোন আক্রমন সেহেতু তাদের যে কোন নাগরিককে একই ভাবে পৃথিবীর যে কোন স্থানে যে কোন উপায়ে হত্যা করা, তাদের দেশে বোমা হামলা চালানো, তাদের নারী শিশুদেরকে হত্যা করা, তাদেরকে অপহরণ করা, তাদের টাকা পয়সা ধন সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া ও তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করা সম্পূর্ণ বৈধ।

আল্লাহ্*রব্বুল আলামিন এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বলেন-


فمناعتدىعليكمفاعتدواعليهبمثلمااعتدىعليكم

যে তোমাদের উপর বাড়াবাড়ি করেছে তোমরাও তার উপর ঠিক ততো খানি বাড়াবাড়ি করবে যতো খানি তারা তোমাদের উপর করেছে।(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৯৪)

 

والذينإذاأصابهمالبغيهمينتصرونوجزاءسيئةسيئةمثلهافمنعفاوأصلحفأجرهعلىاللهإنهلايحبالظالمينولمنانتصربعدظلمهفأولئكماعليهممنسبيلإنماالسبيلعلىالذينيظلمونالناسويبغونفيالأرضبغيرالحقأولئكلهمعذابأليم

(ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হল) তারা যখন অন্যায় বাড়াবাড়ির শিকার হয় তখন তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে; আর দুষ্কৃতির বদলা হল তার সমপরিমাণ দুষ্কৃতি; তবে (কল্যাণকর মনে করে) যে মাফ করে দেবে এবং সংশোধন করে দেবে তার বিনিময় আল্লাহ্*র কাছে রক্ষিত; নিশ্চয়ই তিনি যালিমদেরকে মোটেই ভালোবাসেন না। আর যুলমের শিকার হয়ে যদি কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করে তবে তাদের উপর কোন অভিযোগ দায়ের করা চলবে না; অভিযোগ তো কেবল তাদের উপর যারা মানুষের উপর যুলুম করবেএবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করে বেড়াবে; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা আশ শূরা, আয়াত ৩৯-৪২)

 

وإنعاقبتمفعاقبوابمثلماعوقبتمبه

আর তোমরা যদি তোমাদের শত্রুদেরকে শাস্তি দাও তাহলে ঠিক সেইভাবে তাদেরকে শাস্তি দিবে যেভাবে তারা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। (সূরা আন নাহল, আয়াত ১২৬)

এ সকল আয়াত সমুহ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হলেও এর সামগ্রিক হুকুম সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য। কেননা আল কুরআনের কোন আয়াত বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হলেও সে আয়াতের হুকুম কেবল সেই ঘটনার সাথেই খাস নয় বরং একই রকম সকল ঘটনার ক্ষেত্রেই সে আয়াতের হুকুম সমান ভাবে জারী থাকবে। এ ব্যপারে ইসলামের মূলনীতি হল العبرةبعموماللفظلابخصوصالسبب অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণ করা হবে শব্দের সাধারণ অর্থের উপর ভিত্তি করে; শুধু আয়াত নাযিলের ঘটনার সাথে হুকুমকে খাস করা হবে না।
অতএব আজ কুফফাররা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন অভিযান পরিচালনা করে, গুপ্তচর বৃত্তি করে, ড্রোন আক্রমন করে মুসলিম জাতির বীর সন্তান মুজাহিদদেরকে হত্যা করে, নারী শিশু সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যা করে তাহলে আমাদের পক্ষেও যেভাবে সম্ভব আমরা তাদেরকে আমাদের গুপ্ত হত্যার শিকারে পরিণত করবো, আমরাও তাদের নেতাদেরকে হত্যা করবো, তাদের বেসামরিক সাধারণ মানুষ ওনারী শিশুদেরকে হত্যা করবো। তারা যদি আমাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করে আমরাও তাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করবো। তারা যদি আমাদের কাউকে অপহরণ করে আমরাও তাদের লোকদেরকে অপহরণ করবো, তারা আমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করে নিলে আমরাও তাদের সম্পদ বৈধ কারণে যেভাবে সম্ভব ছিনিয়ে নেব।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহঃ এ আয়াত সমূহের ব্যখ্যায় বলেন, এ সব আয়াত সমূহ প্রমাণ করেযে জান মাল, সহায় সম্পদ, ঘর বাড়ি নারী শিশু যাবতীয় ক্ষেত্রে সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ।
সমান প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধতা ইসলামী শরিয়তে এমনই স্বীকৃত একটি বিধান যে স্বয়ং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও এ কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা বা সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ; অতএব যে অপরাধের কারণে যে শাস্তি মুসলমানদের উপর প্রয়োগ বৈধ সে বিধান কুফফারদের ক্ষেত্রে তো সন্দেহাতীত ভাবে কার্যকর।
অতএব আমেরিকা ও তার দোসররা যেহেতু গোটা পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অবরোধ আরোপ করে ইরাকে নারী শিশু সহ দশ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করছে, আফগানিস্তানে আবাল বৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করে চলছে; ইয়েমেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে চলছে তাদের গোপন ড্রোন আক্রমন সেহেতু তাদের যে কোন নাগরিককে একই ভাবে পৃথিবীর যে কোন স্থানে যে কোন উপায়ে হত্যা করা, তাদের দেশে বোমা হামলা চালানো, তাদের নারী শিশুদেরকে হত্যা করা, তাদেরকে অপহরণ করা, তাদের টাকা পয়সা ধন সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া ও তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করা সম্পূর্ণ বৈধ।

৩য় দলীলঃ কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ড


এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিলো ৩য় হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখ রাতে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি দলকে প্রেরণ করেন, তিনি তাদেরকে বিদায় জানানোর সময় বলেন, ‘আল্লাহ্*র নামে তোমরা বেরিয়ে পড়ো, হে আল্লাহ্* তুমি তাদেরকে সাহায্য করো’ এর পর তিনি ঘরে এসে সালাত আদায় করতে থাকেন এবং তাদের সফলতার জন্য আল্লাহ্*র দরবারে কান্নাকাটি করে মোনাজাত করতে থাকেন।
জাবিররাঃ থেকে বর্ণীত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক দিন বলেন,

منلكعببنالأشرففإنهآذىالله ورسوله

‘কা’ববিন আশরাফকে হত্যার জন্য কে আছো? সে আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে কষ্ট দিয়েছে’।

আল্লাহ্*র রসূলের একথা শুনে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহরাঃ বলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ আপনি কি সত্যিই চান আমি তাকে হত্যা করে ফেলি? তিনি বলেন, হ্যা আমি তাই চাই। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহরাঃ বলেন, তাহলে আমাকে কিছু (মিথ্যা কথা) বলার অনুমতি দিন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমার যা প্রয়োজন বলো। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ কা’ব বিন আশরাফের কাছে এসে আল্লাহ্*র রসূলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন এ ব্যক্তি আমাদের কাছে শুধু সাদাকা চায়, সে তো আমাদেরকে মহা কষ্টে ফেলে দিয়েছে! তখন সে বলে যে, এখন পর্যন্ত আর কিইবা দেখেছো, সে তো তোমাদেরকে শেষ করে ছাড়বে। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ তখন বলেন, একবার যেহেতু তাঁর অনুসারীর খাতায় নাম লিখিয়েছি এখন আর তাঁর শেষ না দেখে ছাড়ছি না। যাই হোক শোনো, আমরা তোমার কাছে এসেছিলাম (এই বিপদের সময়) তুমি আমাদেরকে এক দুইসা’ ধার দেবে এই জন্য। সে বললো, আচ্ছা তা দেয়া যাবে তবে তার বিনিময়ে আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখতে হবে। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ বললেন আচ্ছা তুমিই বলো তুমি কী বন্ধক চাও; সে (নরপিচাশ) বললো, তোমাদের নারীদেরকে আমার কাছে বন্ধক রাখো। (রাগ ক্ষোভ সব চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকার ভান করে তার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে) তিনি বললেন, আমরা কিভাবে আমাদের নারীদেরকে তোমার কাছে বন্ধক রাখি অথচ তুমি হচ্ছো আরবের সবচেয়ে সুদর্শন সুপুরুষ! তারপর সে বললো, তাহলে তোমাদের সন্তানদেরকে বন্ধক রাখো; তিনি বললেন, কিভাবে আমরা আমাদের সন্তারদেরকে বন্ধক রাখি বলো, তাহলে তো লোকেরা গালাগালি দিয়ে তাদেরকে বলবে যে, এই তোদেরকেই তো মাত্র এক দু’ সা’ এর বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছিলো! তার চেয়ে বরং আমরা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তোমার কাছে বন্ধক রাখি। অবশেষে সে সম্মত হয়। তারা রাতে গোপনে তার সাথে দেখা করার কথা বলে চলে যান।
রাতের বেলা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ কা’ব বিন আশরাফের দুধ ভাই আবু নায়লাকে সাথে নিয়ে আসলেন। তারা দু’জন তাকে ডাক দিলে সে যখন নেমে আসতে যাচ্ছিলো তখন তার স্ত্রী তাকে বললো, ‘এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো? আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তার কথা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝড়ে পড়ছে’। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে সে বলেছে, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তার মুখের আওয়াজের সাথে রক্ত বেরিয়ে আসছে’। সে বললো, আরে! এতো আমার বন্ধু মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ ও আমার দুধভাই আবু নায়লা এসেছে, ওদের সাথে একটু কথা বলতে যাচ্ছি।
মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ আবু নায়লা ছাড়াও আরও দু’জনকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন আবু আবস বিন হাবর ও উব্বাদ বিন বিশার রাঃ। তিনি তাদেরকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন যে, তিনি তার ঘাড় ধরে যখন তার মাথা নুইয়ে দেবেন তখন যেন তারা তাদের কাজ সেরে ফেলে।
অতঃপর সে যখন নেমে এলো তারা বললো বাহ! তোমার শরীর থেকে তো চমৎকার সুঘ্রান আসছে! সে বললো, হ্যা তা তো হতেই পারে কারণ আমার কাছে রয়েছে আরবের সবচেয়ে সুগন্ধিনি নারী। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ বললেন আমি কি একটু তোমার চুল থেকে ঘ্রান শুঁকে দেখতে পারি? সে বললো, অবশ্যই, এই নাও শুঁকে দেখো; সে একবার শুঁকে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষন পর আবার বললো, (ওহ যা ঘ্রান!) আমাকে তোমার মাথাটা আরেকবার শুঁকতে অনুমতি দেবে? এবার সে তার মাথার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথাটা নিচু করে ধরে অন্যদের বললো, এবার তোমাদের কাজ সেরে ফেলো, আর তারা সাথে সাথে তাকে হত্যা করে ফেলে। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
কা’ব বিন আশরাফ নিহত হওয়ার পর তার জাতির ইহুদীরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, আমাদের একজন অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে আপনার অনুসারীদের দ্বারা গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বলেন, তার মতো একই রকম চিন্তার যেসব লোকেরা পালিয়ে গেছে তাদের মতো সেও যদি পালিয়ে যেত তাহলে তার এই দশা হতো না, কিন্তু সে আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আমাদেরকে অপমান করেছে; আর ভবিষ্যতেও কেউ যদি এমন দুঃসাহস দেখায় তাহলে সেও তার ঘাড়ের উপর তলোয়ার ছাড়াকিছু দেখতে পাবে না। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ওসীরাতে ইবনে হিশাম)
ফতহুল বারী গ্রন্থে ইবনে হাজার রহঃ ইকরামা রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর গোটা ইহুদী সম্প্রদায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের কাছে এসে তাদের নেতার গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা তাকে জানায়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রক্ত পনের ব্যপারে কোন কথা না বলে বরং তাদেরকে তিনি মনে করিয়ে দিতে লাগলেন যে সে আল্লাহ্* তায়ালা, তাঁর রসুল ও ঈমানদারদের সম্পর্কে কি সব আপত্তিকর কথাবার্তা বলে বেড়াতো। এত টুকুতেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে ভবিষ্যতেও যদি কেউ তার মতো আচরণ করে তাহলে তার পরিণতিও একই রকম হবে। হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ বলেন কাউকে দাওয়াহ না দিয়ে হত্যার বৈধতার ব্যপারে এ ঘটনা একটি মজবুত দলীল।
কা’ব বিন আশরাফের কুকীর্তির মধ্যে অন্যতম ছিল সে মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা দিতো, আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আপত্তিকর কথাবার্তা বলতো এবং মুসলিম নারীদের সম্পর্কে অশ্লীল কবিতা রচনা করতো ইত্যাদি।
হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ এ প্রসঙ্গে আরও বলেন,

وفيهجوازقتلالمشركبغيردعوة إذاكانتالدعوةالعامةقدبلغت ه

এ ঘটনার মধ্যে সাধারন ভাবে ইসলামের দাওয়াত সবার কাছে পৌঁছে গেলে যে কোন মুশরিককে ব্যক্তিগত ভাবে ইসলামের দাওয়াত না দিয়ে হত্যা করার বৈধতা রয়েছে।
ইমাম বুখারী রহঃ এ হাদিসটিকে জিহাদ অধ্যায়ে ‘যুদ্ধে মিথ্যা বলা’ অনুচ্ছেদে সংকলণ করেছেন।
ইমাম নববী রহঃ এ হাদিসের ব্যখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “কা’ব বিন আশরাফই প্রথম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে নিরাপত্তা চুক্তি লংঘন করেছে, আর মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রাঃ ও তাকে প্রথমে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে তারপর তাকে হত্যা করেছেন বিষয়টি এমন নয়। কাযী আইয়ায রহঃ সহীহ মুলিমের শরাহ গ্রন্থ আল মিনহাজের মধ্যে বলেন, ‘কারো জন্য একথা বলা বৈধ নয় যে কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ড কোন বিশ্বাসঘাতকতা ছিল’; আলী ইবনে আবী ত্বালিব রাঃ এর মজলিসে কোন এক ব্যক্তি এমন মন্তব্য করলে তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন”।
অতএব আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত কোন কাফিরকে গুপ্ত হত্যা করাকে যদি কোন ব্যাক্তি গাদ্দারি বা বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যায়িত করে কিংবা বলে যে এভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা ইসলামে হারাম তাহলে সে ব্যক্তি নির্ঘাত আল্লাহ্*র কিতাব ও রসূলের সুন্নাহকে মিথ্যা সাব্যস্তকারী পথভ্রষ্ট।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ ‘আস স-রিমুল মাসলুল’ গ্রন্থে এ হাদিসের উপর আলোচনা পেশ করে বলেন ‘আল আযা’ শব্দটি প্রয়োগ হয় এমন লঘু শ্রেনীর দুষ্কৃতি বুঝানোর জন্য যার দ্বারা মানুষের অন্তরে কষ্ট দেয়া হয় পক্ষান্তরে ‘যারার’ শব্দটি ব্যবহার হয় সক্রিয় ভাবে চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কাউকে (মানসিক শারীরিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ভাবে) প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে। তাই নিছক ‘আযা’ এর কারণেই যেখানে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ ব্যক্তিকে হত্যা করা আবশ্যক হয়ে যায় সেখানে কেউ যদি আল্লাহ্* তায়ালা কিংবা তাঁর রসুলকে গালি গালাজ করে, দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেতা হলে তার হুকুম কী হতে পারে তা সকলেরই জানা। আর একটি বিষয় হলো এ ঘটনা প্রমাণ করে যে আল্লাহ্*তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে যে কষ্ট দিবে তাকে হত্যা করা যে কোন মুসলমানের জন্য হালাল। এ ঘটনা আরও প্রমাণ করে যে আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে যদি কেউ কষ্ট দেয়, তাদের প্রতি অপমানজনক বা অশোভনীয় কোন কাজ যদি কেউ করে তাহলে তার সাথে মুসলমানদের সম্পাদিত সকল শান্তি চুক্তি স্বয়ংক্রিয় ভাবে বাতিল হয়ে যায়।


৪র্থ দলীলঃ ইবনে আবুল হুকায়েক আবু রাফে’র হত্যাকাণ্ড


আবুরাফে’ ছিলো খায়বার অঞ্চলে বসবাসকারী একজন ইহুদী নেতা, হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। এই ব্যক্তি ছিলো সেসব লোকদের অন্যতম যারা মক্কার মুশরিদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উস্কানি দিতো। সে খন্দক যুদ্ধে মক্কার মুশরিকদেরকে উস্কানি দাতাদের অন্যতম হোতা। ৫ম হিজরী সনের যুলকা’দাহ কিংবা যুলহজ্জ মাসেতাকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার সুত্রপাত হিসেবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক ইমাম যুহরী, আব্দুল্লাহ ও কা’ব বিন মালেক রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন যে, আওস এবং খাযরাজ গোত্রের লোকেরা একে অপরের সাথে ইসলামের জন্য যুদ্ধে কোন গোত্র কেমন ভুমিকা পালন করেছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতো। অন্যান্য দিক থেকে উভয় গোত্র প্রায় সমান সমান থাকলেও আওস গোত্র দ্বারা সংগঠিত কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ডের মতো কোন উদাহরণ খাযরাজ গোত্রের লোকেরা উপস্থাপন করতে পারলো না। তখন তারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললো, ইয়া রসুলাল্লাহ, আপনি আমাদেরকে এমন এক ব্যক্তির নাম বলে দিন যাকে হত্যা করে আমরা আওস কর্তৃক কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার কৃতিত্বের সমতা রক্ষা করতে পারি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাদেরকে আবু রাফে’কে হত্যার নির্দেশ দেন।
এই অভিযানে পাঁচজন সাহাবীর একটি জামাহ অংশ নেয়। তারা হলেন (১) আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক (২) মাসউদ বিন সিনান (৩)আব্দুল্লাহ বিন উনায়স (৪) আবু কাতাদা বিন হারিস (৫) খুযা’য়ী বিন আল আসওয়াদ রাঃ।
সহীহ আল বুখারিতে বারা বিন আযিব রাঃ এর সুত্রে বর্ণীত রয়েছে যে তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের একটি দলকে ইহুদী আবু রাফে’কে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন (আবু আতীক রাঃ) এগিয়ে গিয়ে ইহুদীদের দুর্গে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমি গিয়ে তাদের পশুর আস্তাবলে প্রবেশ করলাম আর তারা দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিল। এদিকে তাদের একজনের একটি গাধা হারিয়ে গিয়েছিলো; তারা গাধাটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লে আমিও গাধা খোঁজার ভান ধরে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তাদেরকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমিও তাদের সাথে গাধা খোঁজ করছি। অবশেষে গাধাটি পেয়ে গেলে তারা যখন দুর্গে প্রবেশ করে তখন আমিও তাদের সাথে আবার দুর্গে প্রবেশ করি। তারপর আমি লক্ষ করলাম যে তারা দুর্গের ফটক বন্ধ করে চাবিটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিলো।অতঃপর তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি চাবি নিয়ে ফটক খুলে রেখে (অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে) আবু রাফে’র ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। আমি ‘ও আবু রাফে’ বলে ডাক দিলে সে আমার ডাকে সাড়া দিলো। আমি তার আওয়াজ দ্বারা তার অবস্থান অনুমান করে তরবারির আঘাত হানলাম, আর অমনি সে চিৎকার করে উঠলো; আর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যেন তার সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এসেছে এমন ভান করে আমি আবার ঘরে প্রবেশ করে গলার স্বর পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও আবু রাফে’ (চিৎকার করলে কেন) তোমার কী হয়েছে? সে বলল, তোমার মা ধ্বংস হোক (তাড়াতাড়ি আসছো না কেন) কি হল তোমার, কে যেন আমার ঘরে ঢুকে আমাকে আঘাত করেছে। তিনি (আবু আতীক) বলেন, অতঃপর আমি আমার তরবারি তার পেটের উপর রেখে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলাম যে তার (মেরুদণ্ডের) হাড্ডি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকার শব্দ হল। (এরপর তার চিৎকারে ও বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দে অন্যরাও জেগে উঠে দরজা খুলতে লাগলো) অতঃপর আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে গিয়ে পড়ে গেলাম এবং এতে আমার পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। যাই হোক কোন মতে আমি বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলাম। আমি তাদেরকে বললাম, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি (আবু রাফে’র) মৃত্যু সংবাদ প্রচারকারিণীর ঘোষণা শুনতে না পাই ততক্ষন পর্যন্ত আমি এ স্থান ত্যাগ করবো না। সত্যিই হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবু রাফে’র মৃত্যু সংবাদ না শুনে আমি সে স্থান ত্যাগ করলাম না। মৃত্যু সংবাদ যখন আমি শুনলাম তখন আমি দাড়িয়ে গেলাম এবং আমার যেন কোন ব্যথাই ছিলো না। অবশেষে আমি আল্লাহ্*র রসূলের কাছে গিয়ে আবু রাফে’কে হত্যার খবর দিলাম। (বুখারী হাদিস নং ৩০২২, ৩০২৩, ৪০৩৮-৪০৪০; আধুনিক প্রকাশনীর ছাপায় হাদিস নং২৮০০ এবং ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ছাপায় হাদিস নং ২৮১০)
(বিভিন্ন হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থে এ ঘটনার আরও খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। আগ্রহী পাঠকগণ চাইলে তা পড়ে আরও বেশী উপকৃত হতে পারেন।)
এক বর্ণনায় রয়েছে যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসার পর তিনি তার পায়ের ব্যথার স্থানে তাঁর মুবারক মুখের থুথু লাগিয়ে দেন এবং আবুল আতিক রাঃ বলতেন এরপর তিনি কখনো সেখানে কোন ব্যথা অনুভব করেননি।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় অবশ্য রয়েছে যে তারা পাঁচজনই দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স রাঃ তার উপর তরবারির আঘাত হানেন; আব্দুল্লাহ বিন আতিক রাঃ এর পা ভেঙ্গে যায় এবং তারা তাকে ধরাধরি করে বের করে নিয়ে আসেন ইত্যাদি।
হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ এই হাদিসের ব্যখ্যায় ফতহুল বারী গ্রন্থে বলেন, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছে এমন মুশরিকদেরকে হত্যার বৈধতা সহ আল্লাহ্*র রসূলের (আনীত দ্বীনের) বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে শক্তি সম্পদ কিংবা জবান দ্বারা কেউ যদি তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে তাদেরকে যে কোন উপায়ে হত্যা করা এবং যুদ্ধরত কাফিরদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির ব্যপারে এ ঘটনা থেকে বৈধতা পাওয়া যায়।


৫ম দলীলঃ খালিদ বিন সুফিয়ান আল হুযায়লীর হত্যাকাণ্ড

খালিদ বিন সুফিয়ান ছিল বনু হুযায়ল গোত্রের লোক। সে আল্লাহ্*র রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মদীনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেছিল। ইমাম আহমাদ রহঃ তার মুসনাদে এবং অন্যন্য অনেক হাদিস সংকলকগন আব্দুল্লাহ বিন উনায়স রাঃ থেকে এ ঘটনার বর্ণনা সংকলন করেছেন। তিনি বলেন,

دعانيرسولاللهصلىاللهعليهو سلمفقال: إنهقدبلغنيأنخالدبنسفيانال هذلييجمعليالناسليغزونيفائ تهفاقتله

একদিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডেকে বলেন ‘আমার কাছে এই সংবাদ এসেছে যে খালিদ বিন সুফিয়ান আল হুযায়লী আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোকজন জড় করছে, অতএব তুমি গিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলো’।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنلسفيانالهذلييهجونيويشت منيويؤذيني

‘সুফিয়ান আল হুযায়লীকে শায়েস্তা করার মতো কে আছো? সে আমাকে অপমান করছে, কষ্ট দিচ্ছে!’

আব্দুল্লাহ বিন উনায়স রাঃ বলেন, আমি আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, আপনি আমার কাছে তার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন যাতে আমি তাকে চিনতে পারি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার চেহারার দিকে তাকালেই তোমার মধ্যে একটা ঘৃণা ও বিরক্তির উদ্রেক হবে। এরপর আমি প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হয়ে পড়লাম, আমি যখন তার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম তখন ঠিক তেমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম যেমনটি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছিলেন। তাকে দেখলাম সে অস্থিরতার সাথে কাঁপছে আর পায়চারী করছে। সেখানে দেখলাম কিছু পতিতাদের আনাগোনা রয়েছে যারা তার কাছে আসা যাওয়া করতো। আমাকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কে? আমি বললাম, আমি আপনার কথা শুনে এবং আপনার বাহিনী প্রস্তুত করার খবর শুনে যোগ দিতে এসেছি। আমি তার সাথে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলাম, এরপর (এক নির্জন গলি পথে এসে) সে যেই আমাকে সুযোগ করে দিলো আমি অমনি তার উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম এবং হত্যার পর রাস্তার ইটা বালু পাথর ইত্যাদি দিয়ে তাকে ঢেকে ফেললাম।

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেন ‘অতঃপর রাত গভীর হয়ে পড়লে লোকেরা যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন আমি চুপচাপ তাকে হত্যা করে তার মাথা কেটে নিয়ে এলাম। তারপর যখন তার কাটা মাথা নিয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলাম তখন তিনি আমাকে দেখেই বললেন, – أفلحالوجهঅর্থাৎ তোমার চেহারা সফলতায় উদ্ভাসিত হয়েছে; আমি বললাম ইয়া রসুলাল্লাহ আমি আল্লাহ্*র ইচ্ছায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বললেন, তুমি সত্য বলেছো। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে তাঁর ঘরে প্রবেশ করে আমাকে একটি লাঠি উপহার দিয়ে বললেন, হে আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স, এই লাঠিটি কেয়ামতের দিন আমার ও তোমার মাঝে (সম্পর্কের) নিদর্শন স্বরূপ তোমার কাছে রেখে দাও।

– إنأقلالناسالمتخصرونيومئذٍ

খুব কম মানুষই সেদিন এমন লাঠির অধিকারী হবে।

বর্ণনাকারী বলেন, আব্দুল্লাহ রাঃ সেই লাঠিটিকে তার তলোয়ারের সাথে লাগিয়ে রেখেছিলেন, তিনি সেটিকে সব সময় সাথে সাথে রাখতেন এমনকি মৃত্যুর সময় তিনি এটি তার সাথে দিয়ে দিতে নির্দেশ দেন; আর এভাবে সে লাঠিটি তার কাফনের মধ্যে দিয়ে তাকে দাফন করা হয়।


ষষ্ট দলিল: ইহুদী নারীর হত্যাকান্ড

ইমাম শা’বী রহঃ হযরত আলি রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন, এক ইহুদী মহিলা ছিল যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি গালাজ করতো এবং তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন রকম আপত্তিকর মন্তব্য করতো। অতঃপর এক ব্যক্তি তার শ্বাসনালী চেপে ধরে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকে মেরে ফেলে। এ ঘটনা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলে তিনি সে মহিলার কোন রক্তমুল্য পরিশোধের নির্দেশ দেননি। ইমাম আবু দাউদ রহঃ ও অন্যান্য সংকলকগণ এঘটনা বর্ণনা করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন এ হাদিসটি উত্তম, কারণ ইমাম শা’বী রহঃ আলী রাঃ কে দেখেছেন এবং তার থেকে তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া এ বর্ণনা যদি মুরসাল শ্রেণীরও হয়ে থাকে তবে ইমাম শা’বী রহঃ জ্ঞানীদের কাছে সহীহ মুরসাল বর্ণনাকারী হিসেবেই পরিচিত। তার থেকে যতো মুরসাল বর্ণনা রয়েছেতা সবই সহীহ, আর তিনি আলী রাঃ বর্ণীত হাদিসের ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া এই হাদিসের অন্যান্য বর্ণনাকারীগণও নির্ভরযোগ্য এবং এর সমর্থনে ইবনে আব্বাস রাঃ এর বর্ণনাও রয়েছে। অতএব এ হাদিসটি হয় খবরে ওয়াহেদ অথবা এর অর্থের দিক থেকে অন্তত ওয়াহেদ শ্রেণীর; আহলে ইলমগন এ হাদিস এবং এমন অন্যান্য যেসব ঘটনা সাহাবীদের থেকে বর্ণীত রয়েছে তা থেকে দলীল গ্রহণে মোটেই ইতস্ততঃ করেননি।
এ ঘটনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, নারী হোক কিংবা পুরুষ, যিম্মী হোক বা চুক্তিবদ্ধ, এমনকি যদি মুসলিম নামধারীও হয় তবুও আল্লাহ্*র রসূলের শানে অসম্মান জনক কথা বললে তাকে হত্যা করা সম্পূর্ণ বৈধ। কারণ এ ঘটনায় অপরাধী হল একজন মহিলা এবং সে মদীনার চুক্তিবদ্ধ ইহুদী সম্প্রদায়ের লোক ছিল

সপ্তম দলীলঃ মুশরিকদের গুপ্তচরকে হত্যার ঘটনা


সালামা ইবনু আকওয়া রাঃ বর্ণনা করেন একবার রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন এক সফরের সময় তাঁর কাছে মুশরিকদের পাঠানো একজন গুপ্তচর আসলো। সে এসে তাঁর সাহাবীদের সাথে বসে বেশ কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে চলে গেলো। এরপর (যখন তিনি জানতে পারলেন যে সে গুপ্তচর ছিলো তখন) তিনি বললেন اطلبوهواقتلوه তাকে খুঁজে বের করে এনে হত্যা করে ফেলো। তারপর (কোন এক সাহাবী) তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করে ফেলে; রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহতের কাছে থাকা মালামাল হত্যাকারীকে প্রদান করেন। (সহীহ আল বুখারী হাদিসনং ৩০৫১, সহীহ মুসলিম হাদিস নং ১৭৫৩, আধুনিক প্রকাশনীর ছাপায় বুখারির হদিসনং ২৮২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছাপায় বুখারির হাদিস নং ২৮৩৩; মুসনাদে আহমাদ হাদিস নং ১৬৫২৩)

অষ্টম দলীলঃ আসমা বিনতে মারওয়ানের হত্যাকাণ্ড



শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ তার‘আস স-রিমুল মাসলুল আ’লা শাতিমির রসুল’ নামক গ্রন্থে এবং ইমাম মাকরিযী রহঃ‘ইমতাউল ইসমা’ নামক গ্রন্থে এ ঘটনাটি সংকলন করেছেন।

ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, খুতামা গোত্রের এক মহিলা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের শানে অপমান জনক কথাবার্তা বলতো; রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক দিন বলেন, আমার পক্ষ থেকে তাকে শায়েস্তা করার কে আছো? সেই মহিলার গোত্রের এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বলল, আমি আছি ইয়া রসুলাল্লাহ। অতঃপর সে তাকে হত্যা করে এসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খবর দেয়। তিনি খবর শুনে (তার রক্তপন প্রসঙ্গে) তিনি বলেন দু’টো রাম ছাগলও তার (রক্তপণের) ব্যাপারে বাদানুবাদ করতে পারে না। (অর্থাৎ তার রক্তপন পরিশোধের কোন প্রশ্নই ওঠে না)
আসহাবুল মাগাযী বা যুদ্ধের ঘটনা সংকলকগনের অনেকেই আরও বিস্তারিতভাবে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইমাম ওয়াকেদী রহঃ বলেন, আব্দুল্লাহ বিন হারিস ফুযায়ল থেকে তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করে যে আসমা বিনতে মারওয়ান ছিল ইয়াযিদ বিন হিসান আল খত্তামির অধিনস্ত। সে আল্লাহ্*র রসুলকে কষ্ট দিতো এবং ইসলামের সমালোচনা করত এবং এ উদ্দেশ্যে সে কবিতা রচনা করতো।
উমায়র বিন আদি আল খত্তামী রাঃ এই দুষ্ট মহিলার কথাবার্তা শুনে বলেন, হে আল্লাহ্* আমি তোমার নামে একটি মান্নত করছি, আমি যদি মদিনায় ফিরতে পারি তাহলে আল্লাহ্*র রসূলের তরফ থেকে আমি তাকে হত্যা করবো। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর থেকে ফিরে আসার পর এক রাতে উমায়র বেরিয়ে পড়েন তার মিশন সফল করতে। তিনি গভীর রাতে এসে তার ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি অন্ধকারে হাতড়ে তাকে বের করে বুঝতে পারেন পান যে সে তার এক বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। তিনি বাচ্চটিকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পেটের মধ্যে তলোয়ার ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেন। মিশন শেষ করে এসে তিনি আল্লাহ্*র রসূলের সাথে ফজর সালাত আদায় করেন।অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমায়রের দিকে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি আসমা বিনতে মারওয়ানকে হত্যা করে ফেলেছ? তিনি বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য করবান হোক ইয়া রসুলাল্লাহ, হ্যা আমি তাকে হত্যা করেছি।
উমায়র রাঃ ভয় পাচ্ছিলেন যেসে মহিলাকে হত্যার কারণে আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আবার কোন ঝামেলা এসে পড়ে কি না; তাই সংশয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রসুলাল্লাহ এ কারণে কি আমার উপর (রক্তমুল্য পরিশোধের) কোন দায় ভার বর্তাবে? তিনি বলেন তার (রক্তমুল্যের) ব্যাপারে দুটো রাম ছাগলও বাদানুবাদ করতে পারে না। অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আশপাশে যারা ছিল তাদেরকে লক্ষ করে বললেন, তোমাদের যখন মন চাইবে এমন কোন ব্যক্তির দিকে তাকাতে যে আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছে তখন তোমরা উমায়র বিন আদি এর দিকে তাকাবে। ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ তখন বলেন, তোমরা এই অন্ধ ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখ যে আল্লাহ্*র আনুগত্যে ঝাপিয়ে পড়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা শুনে বলেন-

لاتقلالأعمىولكنهالبصير

তাকে অন্ধ বল না সে তো চক্ষুষ্মান

উমায়ের রাঃ যখন আল্লাহ্*র রসূলের কাছ থেকে বেরিয়ে এসে তার নিজ গোত্রের এলাকায় আসলেন তখন লোকেরা সেই মহিলার দাফন কাফনে ব্যস্ত ছিলো। তারা তাকে মদিনার দিক থেকে আসতে দেখে সন্দেহ করলো; তাকে জজ্ঞাসা করলো, উমায়র! তুমিই কি এই মহিলাকে হত্যা করেছ? তিনি বললেন, হ্যা আমিই হত্যা করেছি,

فكيدونيجميعاثملاتنظرون

অতএব তোমরা সবাই মিলে আমাকে শায়েস্তা করার যে কোন ফন্দি আঁটতে পারো, আর আমাকে ( তা প্রতিরোধের) কোন অবকাশই দিও না। যার হাতে আমার প্রান আমি সেই সত্ত্বার কসম করে বলছি, তোমরা সকলেও যদি তার মতো একই কথা বলতে তাহলে আমি একা তোমাদের সবার উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তাম; হয় আমি নিহত হতাম অথবা তোমাদেরকে হত্যা করে ফেলতাম।
তার এই সাহসী পদক্ষেপের ফলে আল্লাহ্*র ইচ্ছায় সেই দিনই বনী খুতামার উপর ইসলাম বিজয়লাভ করে। এই গোত্রের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও এতো দিন গোত্রের লোকদের ভয়ে তা গোপন করে রাখতেন; এই ঘটনার পর তারাও প্রকাশ্যে তাদের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। কবি হাসসান বিন সাবিত উমায়র বিন আদির প্রশংসা করে কবিতাও রচনা করেছেন।
এ ঘটনাটি মুহাম্মাদ বিন সা’দ তার তাবাকাতের মধ্যেও সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাঃ দের মাঝে এটা একটা সাধারণ প্রচলন ছিল যে, আল্লাহ্*র রসুলকে কেউ কষ্ট দিয়েছে একথা তারা জানতে পারলে তারা তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে ফেলতেন, কেননা তার এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে এটাই তার প্রাপ্য। কেবল আল্লাহ্*র রসূলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সাপেক্ষে তিনি যদি কাউকে ক্ষমা করে দিতেন তবেই কেউ হত্যার হাত থেকে বাঁচতে পারতো। তবে এ ধরণের অপরাধী কোন ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রার্থনার আগেই যদি কেউ হত্যা করে ফেলত তাহলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হত্যাকারীকে কোন দোষারোপ করতে না, বরং তাকে বাহবা দিতেন এবং তার প্রশংসা করতেন; কেননা সে তো আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছে। যেমন ওমর রাঃ এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলেন এ কারণে যে, সে আল্লাহ্*র রসূলের বিচারে সন্তুষ্ট হয়েছিলো না। আসমা বিনতে মারওয়ান ও অন্য এক ইহুদী নারীকে হত্যার দৃষ্টান্তও একই রকম।
আল্লাহ্*র রসূলের ইন্তেকালের সাথে সাথে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আর বাকি রয়ে গেছে কেবল শাস্তি প্রয়োগের বিধান।

নবম দলীলঃ ইহুদী আবু আফাকের হত্যাকাণ্ড


সীরাত ও যুদ্ধের ঘটনা সংলকদের অনেকেই এ ঘটনা সংকলণ করেছেন। ইমাম ওয়াকেদী রহঃ বর্ণনা করেন যে বনু আমর গোত্রের এক অতিশয় বয়স্ক বৃদ্ধ ছিল যাকে আবু আফাক বলে ডাকা হতো; তার বয়স হয়ে গিয়েছিলো একশত বিশ বছর। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুউ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমন করলে সে ইসলামে তো প্রবেশ করেইনি বরং আদা জল খেয়ে তাঁর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বদর যুদ্ধের জন্য মদিনা থেকে বের হন তখন তাঁর হিংসার আগুন আরও জ্বলে ওঠে, সে যা খুশি তাই বলা আরম্ভ করে, সে আল্লাহ্*র রসূলের শানে অপমানজনক কবিতা লিখে প্রচার করতে লাগে এবং তাঁর সাহাবীদের নামেও বিভিন্ন রকম কুৎসা রটনা আরম্ভ করে।
সালিম বিন উমায়র রাঃ তার এসব শুনে বলেন, আমি মানত করলাম যে হয় আমি তাকে হত্যা করবো অথবা আমি নিহত হব; মদিনায় ফিরে তিনি অপেক্ষায় থাকেন কখন সুযোগ পাওয়া যায়। অতঃপর এক দিন তিনি সেই মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে গেলেন। এক গরমের রাতে আবু আফাক বাইরে শুয়ে ছিল। সালিম বিন উমায়র আস্তে করে তার কাছে গিয়ে শরীরের মাঝখান থেকে এমনভাবে তলোয়ার চালিয়ে দেনযে সে প্রায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। আল্লাহ্*র শক্র তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করে দেয়; সালিম বিন উমায়র চুপিসারে সরে পড়েন। তারপর তার আস পাশের লোকেরা এসে জড় হয়ে বলতে থাকে, আল্লাহ্*র কসম আমরা যদি তার হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পারি তাহলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবো।
ইমাম ওয়াকেদী রহঃ বলেন আবু আফাকের হত্যাকাণ্ড হিজরতের বিশ মাসের মাথায় শাওয়াল মাসে সংগঠিত হয়েছিলো। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন, ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছিলো কা’ব বিন আশরাফের ঘটনার পূর্বে; আর এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে চুক্তিবদ্ধ কোন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরাও যদি আল্লাহ্* তায়ালা কিংবা তাঁর রসূলের শানে অপমানজনক কিছু বলে তাহলে সে ব্যক্তির নিরাপত্তা রহিত হয়ে যায়।

দশম দলীলঃ আসওয়াদ আল আনসীর হত্যাকাণ্ড


আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, তাবাকাতে ইবনে সা’দ, সীরাতে ইবনে হিশাম, তারিখে তাবারী সহ ইসলামের ইতিহাসও আল্লাহ্*র রসূলের যতো সীরাত গ্রন্থ রয়েছে তার প্রায় সকল গ্রন্থেই এ ঘটনা বিশুদ্ধ সনদে সংকলিত হয়েছে। বিভিন্ন সংকলকের বর্ণনার মধ্যে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে সামান্য তারতম্য থাকলেও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক কোন মত পার্থক্য নেই। আমরা এখানে সে সব বর্ণনাসমূহের সমন্বিত একটি ধারা বর্ণনা তুলে ধরবো।
বিদায় হজ্জের পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন তখন বিভিন্ন দিকে ভণ্ডদের মিথ্যা নবুওত দাবীর ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এসব মিথ্যা নবুওত দাবীদারদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিল ইয়েমেনের আসওয়াদ আল আনসী। সে আগে থেকেই গণক শ্রেণীর লোক ছিল, সে যাদু বিদ্যায়ও পারদর্শী ছিল। সে বেশ প্রভাবশালীও ছিল; মানুষকে বিমোহিত ও মন্ত্রমুগ্ধ করার এক বিশেষ দক্ষতা ছিল তার। এসব কারণে সে শুধু সমাজের সাধারণ মানুষের উপরই নয় বরং সমাজের উচুস্তর ও বিত্তশালী লোকদের উপরও সে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে নিজেকে এক রহস্যময় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জনসমক্ষে বের হওয়ার সময় বিশেষ এক ধরণের মুখোশ পড়ে বের হতো।
আসওয়াদআল আনসীর হত্যাকাণ্ডে যিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন তিনি হলেন ফিরোজ আদ দায়লামী। ইয়েমেনে সে সময় যারা প্রভাবশালী ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবনা সম্প্রদায়ের লোকজন। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল পারস্যের সাসানী শাসক শ্রেণীর উত্তর পুরুষ যারা দীর্ঘ দিন ইয়েমেনকে শাসন করেছে এবং এদের মায়েরা ছিল স্থানীয় আরব। ফিরোজ আদ দায়লামি ছিলেন ইয়েমেনের এই আবনা সম্প্রদায়ের লোক।
ইসলামের আবির্ভাবের সময় আবনাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল বাজান এবং সে–ই পারস্য সাম্রাজ্যেরপক্ষ থেকে এ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। যখন সে ইসলামের সত্যতা তথা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আসমানী দাওয়াতের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হল তখন পারস্য সাম্রাজ্য থেকে আনুগত্য প্রত্যাহার করে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার অধিনস্ত লোকেরাও তাকে অনুসরণ করে ইসলাম গ্রহণ করে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে শাসক হিসেবে বহাল রাখেন। কিন্তু আসওয়াদ আল আনসীর আবির্ভাবের কিছু দিন পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আসওয়াদ আল আনসীর গোত্র বনু মুদহিজ সর্বপ্রথম তার মিথ্যা নবুওতের দাবীর প্রতি সমর্থন জানায়। সে তার গোত্রীয় বাহিনী নিয়ে সান’য়া আক্রমন চালিয়ে এখানকার গভর্নর বাধানের পুত্র শাহারকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রী দাদওয়াহকে সে জোরপূর্বক নিজে গ্রহণ করে। সান’য়া থেকে সে আস পাশের অঞ্চলে একের পর এক অভিযান চালাতে থাকে। তার এই অতর্কিতে আক্রমনের ফলে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হাদরা মাওত থেকে তায়েফ ওআল আহসা থেকে এডেন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল তার দখলে চলে আসে।
আসওয়াদ আল আনসীর ফিতনা যখন প্রায় ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন তখন একটি চিঠি দিয়ে মু’য়ায বিন জাবাল রাঃ এর নেতৃত্বে দশ জন সাহাবীকে ইয়েমেনের বিশস্ত অনুসারীদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি যে কোন মুল্যে আসওয়াদ আল আনসীর ফিতনা নির্মূল করার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ্*র রসূলের চিঠি পাওয়ার পর ফিরোজ আদ দায়লামী তার অন্যান্য সাথী সঙ্গীদেরকে নিয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বৈঠকে বসেন। এ ব্যাপারে ফিরোজ আদ দায়লামী বলেন-
‘আমরা আগে থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম আসওয়াদ আল আনসীকে শায়েস্তা করার জন্য, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম না। এরপর আল্লাহ্*র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি পাওয়ার পর আমাদের নৈতিক শক্তি বহু গুনে বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের প্রত্যেকে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে এ দায়িত্ত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য। এদিকে আসওয়াদ আল আনসী তার একের পর এক সফলতার কারণে বেশ অহংকারী হয়ে পড়ে; ফলে সে তার সেনাপতিদের সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করা আরম্ভ করে যে স্বয়ং তাদেরও মনে হচ্ছিলো যে, পান থেকে চুন খসলে তারাও যে কেউ যে কোন সময় তার আক্রোশের শিকার হয়ে যেতে পারে। তার একজন সেনাপতি ছিল কায়েস বিন ইয়াগুস; আমি আমার চাচাত বোন দাদাহকে নিয়ে একদিন কায়েসের সাথে সাক্ষাত করে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম এবং তাকে বললাম যে, তার হাতে তুমি শায়েস্তা হওয়ার আগে বরং তুমি তাকে শায়েস্তা করে ফেলো। সে আমাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয় এবং আমাদেরকে সে আসওয়াদ আল আনসীর বেশ কিছু গোপন তথ্য সরবরাহ করে। এরপর আমরা তিনজন পরিকল্পনা করলাম যে আমরা তাকে দুর্গের ভেতর থেকে আক্রমন করবো এবং আমাদের অন্য ভাইয়েরা বাহির থেকে থেকে আক্রমন করবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আমাদের আত্মীয়া দাদওয়ায়হকেও আমাদের দলে ভেড়াবো, যার স্বামীকে হত্যা করে আসওয়াদ আল আনসীতাকে জোর পূর্বক নিজের স্ত্রী বানিয়ে নিয়েছিলো। আমরা আসওয়াদ আল আনসীর দুর্গে গিয়ে দাদওয়ায়হ এর সাথে সাক্ষাত করে তাকে বললাম, তুমি ভালো করেই টের পাচ্ছো যে এই ব্যক্তি তোমার জীবনকে কিভাবে দুর্বিষহ করে তুলেছে, সে তোমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তোমার সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ সবাইকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদেরকে হত্যা করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে এই ফিতনাকে চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্য এই চিঠি পাঠিয়েছেন। তুমি কি এ ব্যপারে আমাদেরকে সহযোগিতা করবে?
সে বললো, আমি কিভাবে তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে পারি? আমি তার ইতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরে সরাসরি বলে ফেললাম যে আমরা তাকে হত্যা করতে চাই। আমার কথা শুনে সে বললো, ‘আল্লাহ্*র কসম আমিও মনে মনে একই কথা ভাবছিলাম, সেই সত্ত্বার কসম যিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমি তার অধীনে থাকলেও আমার মনে আমার ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে কখনো বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়নি, আল্লাহ্* তায়ালা আমার জন্য তার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেননি; আল্লাহ্*র কসম! আমি যখন থেকে তাকে দেখে আসছি তাকে কেবল মিথ্যাচারী, ভণ্ড, প্রতারক ও শয়তান রূপেই দেখে আসছি; তার থেকে আমি আজ পর্যন্ত ভালো কিছু দেখিনি’।
আমি তাকে বললাম, এখন বলো কিভাবে আমরা তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে পারি। সে তো সব সময় নিরাপত্তা রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
সে আমাদেরকে দুর্গের একটি পরিত্যক্ত রুমের কথা বলে বললো, তোমরা রাতের প্রথম প্রহরে ওখান থেকে প্রবেশ করবে, ওখানে তোমাদের জন্য অস্ত্র ও আলোর ব্যবস্থা করা থাকবে, আর স্বয়ং আমিও সেখানে থাকবো।
আমি বললাম, তুমি যা বলেছো মন্দ নয় তবে এভাবে প্রবেশ করতে গেলে আমরা নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি, তুমি তার চেয়ে আমার কাছে তোমার একজন বিশ্বস্ত একজন কাজের লোককে পাঠাও, আমি তাকে বুঝিয়ে দেবো, দুর্গের কোন স্থানে ভেতর থেকে একটি প্রবেশপথ তৈরি করে রাখলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে।
এরপর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আমরা একদিন রাতে আমাদের তৈরি করা নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে প্রবেশ করলাম, পরিকল্পনা মাফিক সেখানে অস্ত্র ও আলো আগে থেকেই রাখা ছিল; আমরা আস্তে করে আল্লাহ্*র শত্রুর রুমের দিকে অগ্রসর হলাম, আমার আত্মীয়াকে তার দরজায় দাঁড়ানো পেলাম, সে আমাদেরকে তার অবস্থান স্থল দেখিয়ে দিলো। আমরা তার ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম সে গভীর ঘুমে নাক ডাকছে। আমি তার গলায় তলোয়ার চালাতেই সে ষাঁড় জবাই করার সময় যেভাবে শব্দ করে সেভাবে গোঙ্গানি দিয়ে উঠলো। শব্দ শুনে রুমের অদুরে দাড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীরা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছে? কিসের শব্দ হল এটা?
দাদওয়ায়হ তাদেরকে বলল, তোমরা তোমাদের কাজে যাও, আল্লাহ্*র নবীর উপর ওয়াহী অবতীর্ণ হচ্ছে! একথা শুনে তারা চলে গেলো।
আমরা সকাল অব্দি দুর্গের মধ্যেই অবস্থান করলাম। ফজরের সময় ঘনিয়ে এলে আমি একটি ওয়ালের উপর উঠে তিন বার তাকবীর দিলাম; তারপর আযান দেয়া আরম্ভ করলাম, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ (আমি স্বাক্ষ দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ আল্লাহ্*র রসুল )বলে তার সাথে আমিযোগ করলাম ‘ওয়া আশহাদু আন্না আসওয়াদআল আনসী আল কাযযাব’ (এবং আমি আরও স্বাক্ষ দিচ্ছি যে আসওয়াদ আল আনসী হল মহা মিথ্যাবাদী)।
এটাই ছিল আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সংকেত যার দ্বারা আমাদের অন্য সাথীরা মিশন সফল হওয়ার সুসংবাদ পাবে।
আমি এই ঘোষণা দেয়ার পর চারিদিক থেকে মুসলমানরা আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনি দিয়ে একযোগে আক্রমন করে। সকালের আলো ফুটে ওঠার আগেই তার দুর্গের পতন ঘটলো এবং আমাদের মিশন সফল হল এবং সাথে সাথে আমরা বিশেষ দুত মারফত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহ্*র শত্রুর সদলবলে নিহত হওয়ার সংবাদ প্রেরণ করি। কিন্তু বার্তা বাহক মদিনায় পৌঁছে দেখতে পায় যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই রাতেই ইন্তেকাল করেছেন। তবে অন্যান্য সাহাবীদের থেকে তারা জানতে পারেন যে যখন আমাদের অপারেশন সফল হয় তখনই তিনি এ সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন’।
ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণীত আছে যে, যে রাতে আসওয়াদ আল আনসী নিহত হয় সে রাতেই আসমান থেকে ওয়াহির মাধ্যমে আল্লাহ্*র রসূলের কাছে তার নিহত সংবাদ আসে। তিনি আমাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন, আসওয়াদ আল আনসী নিহত হয়েছে। এক মুবারক পরিবারের এক মুবারক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছে। জিজ্ঞাসা করা হল সে ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, ফিরোজ ফিরোজ।

হে আল্লাহ্*! তুমি আমাদের সত্যকে সত্য হিসেবে দেখিয়ে দাও এবং তা অনুসরণের তাওফিক দাও; আর মিথ্যাকে আমাদের মিথ্যা হিসেবে দেখিয়ে দাও এবং আমাদেরকে তা পরিহার করে চলার তাওফিক দাও।

আমাদেরকে তোমার সেই সব বান্দাদের কাতারে শামিল করো যারা তোমার সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে।

আমাদেরকে তুমি তোমার সেই সব বান্দাদের দলে শামিল করো যাদের জান মাল তুমি কবুল করে নিয়েছো।

হে আল্লাহ্*! তুমি আমাদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মুহাব্বাতকে দূর করে দাও, তুমি আমাদের অন্তরে জিহাদের এমন অনন্ত তামান্না তৈরি করে দাও যাতে আমরা আমাদের জান মাল তোমার রাস্তায় কোরবানী করার আগে কিছুতেই ক্ষান্ত না হই।

হে আল্লাহ্* তুমি মুসলিম উম্মাহকে তোমার দ্বীনের দিকে উত্তম ভাবে ফিরিয়ে আনো।

আমীন!!!



সমকামি এজেন্ডাঃ ব্লু-প্রিন্ট




 ১৯৮৭ সালে অ্যামেরিকান ম্যাগাযিন ‘গাইড’ এর নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় মার্শাল কার্ক এবং হান্টার ম্যাডসেনের লেখা প্রায় ৫০০০ শব্দের একটি আর্টিকেল। দু’বছর পর নিউরোসাইক্রিয়াট্রি রিসার্চার কার্ক এবং পাবলিক রিলেইশান্স কনসালটেন্ট ম্যাডসেন একে পরিণত করেন ৩৯৮ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে। হান্টার ও ম্যাডসেনের এই আর্টিকেল উপস্থাপিত ধারণা ও নীতিগুলো পরবর্তী ৩ দশক জুড়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে রাজনীতি, মিডিয়া, অ্যাকাডেমিয়া, বিজ্ঞান, দর্শন ও চিন্তার জগতে। সারা বিশ্বজুড়ে। সমকামীদের ম্যাগাযিন গাইডে প্রকাশিত মূল আর্টিকেলটির নাম ছিল “The Overhauling of Straight America ”। ৮৯ তে প্রকাশিত সম্প্রসারিত বইয়ের নাম দেওয়া হয় - After the Ball: How America Will Conquer Its Fear and Hatred of Gays in the 90s.  কার্ক ও ম্যাডসেনের উদ্দেশ্য ছিল সিম্পল –সমকামিতা ও সমকামিদের প্রতি অ্যামেরিকানদের মনোভাব বদলে দেওয়ার জন্য একটি স্টেপ বাই স্টেপ ব্লু-প্রিন্ট বা ম্যানুয়াল তৈরি করা।  কিন্তু কেন প্রায় তিন দশক পর বাংলাদেশে বসে কার্ক-ম্যাডসেনকে নিয়ে চিন্তা করা? কার্ক-ম্যাডসেনের নাম শুনেছেন বা তাদের লেখার সম্পর্কে জানেন এবং মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। শুধু বাংলাদেশেই না, বিশ্বজুড়েই। কিন্তু তাদের ব্লু-প্রিন্টের প্রভাব কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করে নি এমন সমাজ বা রাষ্ট্র খুজে পাওয়াটাও কঠিন।

গত ৩০ বছরে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরন, সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমকামিতার মধ্য এতোটা অস্বাভাবিক একটি বিষয়ের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রায় হুবহু মিলে যায় কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের সাথে। আর বাংলাদেশেও সমকামিতার প্রচার, প্রসার এবং সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা তৈরির জন্য এখন এই একই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে, একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।  বর্তমানে ২২টি দেশে সমলৈঙ্গিক ‘বিয়ে’ আইনগত ভাবে স্বীকৃত। কোন আগ্রাসী সেনাবাহিনী শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এদেশগুলোর জনগোষ্ঠীর উপর সমকামিতা চাপিয়ে দেয় নি। তবে নিঃসন্দেহে মানুষের স্বভাবজাত মূল্যবোধ, ফিতরাহর বিরুদ্ধে গিয়ে জঘন্য একটি বিকৃতিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেওয়া, মানুষের মাঝে এই বিকৃতির গ্রহনযোগ্য তৈরি করা একটি যুদ্ধের অংশ। এই যুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক, আদর্শিক। এই যুদ্ধ সর্বব্যাপী এবং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপনি এই যুদ্ধের অংশ। আর এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের স্ট্র্যাটিজির মূল ভিত্তি কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট। আর তাই কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট সম্পর্কে জানা, শত্রুর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা একটি আবশক্যতা, কোন অ্যাকাডেমিক কৌতুহল না। তবে কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের দিকে তাকানোর আগে গত তিন দশকে এর অর্জিত সাফল্যের দিকে একটু তাকানো যাক।


The Overhauling of Straight America 

       একটা সহজ উদাহরন দিয়ে শুরু করা যাক। Gallup এর হিসেব অনুযায়ী ৮৭-তে, অর্থাৎ আর্টিকেলটি লেখার সময়, যাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ৩২% সমকামি সম্পর্ক বৈধ হওয়া উচিৎ বলে উত্তর দিয়েছিল। ৫৭% বলেছিল এধরনের কাজ সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ঘোষণা করা উচিৎ। ত্রিশ বছর পর ২০১৭ তে এসে দেখা গেল ব্যাপারটা প্রায় পুরোপুরি উল্টে গেছে। ৬৪% উত্তরদাতা এখন মনে করেন এধরনের বিয়ে বৈধ হওয়া উচিৎ, আর মাত্র ৩৪% এর বিরুদ্ধে [১]। ১৯৮৯ সালে ১৯% উত্তরদাতা বিশ্বাস করতেন মানুষ জন্মসূত্রে সমকামি হয়। ৪৮% মনে করতেন সমকামিরা সমকামিতাকে স্বেচ্ছায় বেছে নেয়। ত্রিশ বছরের কম সময়ের মধ্যে তে ৪২% উত্তরদাতা বিশ্বাস করা শুরু করলো সমকামিতা জন্মগত [২]।  

অথচ ১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত খোদ অ্যামেরিকান সাইক্রিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশান সমকামিতাকে একটি মানসিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করতো। অর্থাৎ ৫০ বছর আগে যা বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল আজ অর্ধেকের বেশি মানুষ তার উল্টোটা বিশ্বাস করছে, যদিও সব বৈজ্ঞানিক গবেষনার ফলাফল বারবার বলছে সমকামিতার কোন জেনেটিক ভিত্তি নেই, এটি জন্মগত না, বরং স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া একটি বিকৃতি।  পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫ তে এসে অ্যামেরিকান খ্রিস্টানদের ৫৪% মনে করে সমকামিতার বিরোধিতা করার বদলে সমকামিতাকে সামাজিক ভাবে মেনে নেওয়া উচিৎ। অ্যামেরিকান প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ৬২% সমকামি ‘বিয়ে’-কে সমর্থন করে, আর ৬৩% মনে করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সমকামিতার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই [৩]। অথচ সমকামিতা যে একটি জঘন্য বিকৃতি, চরম পর্যায়ের সীমালঙ্ঘন এবং অত্যন্ত ঘৃণিত পাপাচার এ ব্যাপারে বাইবেলের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট।   অ্যামেরিকান সমকামিতা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ GLAAD এর সমীক্ষ অনুযায়ী ২০১৬ সালে রিলিয  হওয়া প্রায় ১৭.৫% হলিউড সিনেমাতে LGBT (Lesbian,Gay, Bi-sexual, Queer) চরিত্রের উপস্থিতি ছিল [৪] । 

পাশাপাশি গত ১০ বছরের প্রায় সব প্রাইমটাইম টেলিভিশন শো-তে কমপক্ষে একটি সমকামি বা অন্যকোন বিকৃতকামি চরিত্র রাখা হয়েছে। কিন্তু Gallup এর মতে অ্যামেরিকার মোট সংখ্যার মাত্র ৩.৯% সমকামি। মিডিয়াতে সমকামিদের ওভাররিপ্রেসেন্টেশানের সঠিক মাত্রাটা বোঝার জন্য এ তথ্য মাথায় রাখুন যে অ্যামেরিকান মিডিয়ার দর্শক শুধু অ্যামেরিকাতেই সীমাবদ্ধ না। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ অ্যামেরিকান মিডিয়ার দর্শক ও ভোক্তা। এই কোটি কোটি মানুষের কাছে অ্যামেরিকান মিডিয়া সমকামিতা, সমকামি ‘বিয়ে’, সমকামি যৌনাচারকে সাধারন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে। 

সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী ২২টি দেশে সমকামি ‘বিয়ে’-কে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জার্মানির সংসদে গত ৩০শে জুন, ২০১৭ সমলৈঙ্গিক ‘বিয়ে’র স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিল পাশ হয়েছে। উল্লেখ্য জার্মানির সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৬ জন নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবি করে থাকে। এই ৪জনই এই বিকৃতি ও চরম সীমালঙ্ঘনের আইনগত বৈধতা দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।  রাজনীতি, অ্যাকাডেমিয়া এবং মিডিয়ার উপর এই ক্ষুদ্র বিকৃত মানসিকতার মাইনরটির প্রভাবের মাত্রা কতোটুকু তা শুধু উপরের তথ্যগুলোর আলোকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না। তবে একটা বেইসিক আইডিয়া এখান থেকে আপনি পাবেন। এই প্রভাবের উৎস কী? আর এই প্রভাবের ব্যাপ্তি কতোটুকু?

 আর একটা তথ্য দেই। আপনি নিজেই বাকি হিসেবটা মিলিয়ে নিন।  পৃথিবী জুড়ে অনেকগুলো অ্যাডভোকেসি গ্রুপ সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও ধনী গ্রুপ হল HRC বা Human Rights Campaign। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে HRC-র বার্ষিক আয় ছিল ৩.৮৫ কোটি ডলার। এই অর্থের উৎস? বড় বড় কর্পোরেশানগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ডোনেইশান। HRC এর ডোনার এবং কর্পোরেট পার্টনারদের মধ্যে আছে স্টারবাকস, লিবার্টি মিউচুয়াল ইনশুরেন্স, অ্যামেরিকান এয়ারলাইন্স, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, ব্যাঙ্ক অফ অ্যামেরিকা, শেভরন, কোকাকোলা, পেপসিকো, লেক্সাস অটো, গুগল, অ্যামাযন, আইবিএম, নাইকি, গোল্ডম্যান অ্যান্ড স্যাক্স, জেপি মরগান চেইস অ্যান্ড কো, ডেল, শেল অয়েলসহ আরো অনেকে [৫]।   বিশাল বাজেটের ব্যাপক প্রভাবশালী এসব অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আসলে কী করে?

 লবিয়িং এর মাধ্যমে, প্রেশার গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে এবং অবশ্যই অর্থের মাধ্যমে এরা প্রভাবিত করে মিডিয়াকে, রাজনীতিবিদদের, সমকামিতার সাথে সংশ্লিস্ট বিভিন্ন রিসার্চকে (যাতে করে সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করা যায়), এবং সরকারের পলিসিকে। যেমন অ্যামেরিকাতে এই মূহুর্তে অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো একটি প্রধান লক্ষ্য হল প্রতিটি স্কুলে, হাইস্কুল ও প্রাইমারি পর্যায়ে Gay-Straight Alliance Club অর্থাৎ স্বাভাবিক শিশু ও সমকামি শিশু ঐক্য পরিষদ জাতীয় কিছু তৈরি করা। প্রতিটি স্কুলে গড়ে ওঠা এই ক্লাবগুলোর কাজ হবে শিশুদের মধ্যে সমকামিতার প্রসার ঘটানো এবং স্বাভাবিকীকরন। 

 গ্লোবাল এজেন্ডা ও বাংলাদেশঃ

 বিষয়গুলো শুধু অ্যামেরিকাতে বা পশ্চিমা বিশ্বে সীমাবদ্ধ না। বরং সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের এই এজেন্ডা গ্লোবাল, এবং বিশ্ব রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে সমকামিতা কোন অসুস্থতা না কোন বিকৃতিও না। অর্থাৎ সমকামিতা স্বাভাবিক। OHCHR, UNDP, UNFPA, UNHCR, UNICEF, UNODC, UN Women, WFP, ILO, UNESCO, World Bank এবং UNAIDS –সহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বৈষম্য নিরসন মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নামে উন্নতশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের জন্য কাজ করছে। এদের মধ্যে Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights (OHCHR) সমকামিতাকে মানবাধিকারের সংজ্ঞার ভেতরে ফেলে এর প্রচার করছে [৬] ।

 OHCHR সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য Free & Equal নামে একটি আলাদা ক্যাম্পেইন চালু করেছে যার ঘোষিত উদ্দেশ্যে মাঝে আছে শিশুদের সমকামিতা সম্পর্কে সচেতন করা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে সমকামিতা ও সমকামের প্রতি সহনশীলতা তৈরি করা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সমকামিতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা [৭] । Free & Equal ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সমকামি ‘বিয়ে’-কে বৈধতা দেয়ার জন্য বলিউডের মিউযিক ভিডিও-ও তৈরি করেছে।   

 পৃথিবীর যেকোন জায়গায় সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যা কিছু করা হচ্ছে, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো এই গ্লোবাল এজেন্ডার অংশ। বাংলাদেশে যারা সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের জন্য এখনো পর্যন্ত যেসব কাজ করা হয়েছে তার সবকিছুই কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের সাথে খাপেখাপে মিলে যায়। একারনে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বোঝার জন্য কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট  সম্পর্কে ধারণা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আলাদা ভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।

 বরং যে মডেলের মাধ্যমে অ্যামেরিকায় অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে এখন সেই একই মডেল বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই পায়ুকাম প্রচার করা ইয়াহু চ্যাট গ্রুপ, ফেইসবুক গ্রুপ, ফোরাম, রুপবান ম্যাগাযিন, শাহবাগে সমকামি প্যারেড, বইমেলায় সমকামিতা নিয়ে কবিতার বই প্রকাশ, গ্রামীনফোনের ফান্ডিং এ আরটিভিতে প্রচারিত নাটক, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও এনজিও গুলোর মাধ্যমে পায়ুকামে উৎসাহিত করা, বিনামূল্যে কনডম-লুব্রিকেন্ট বিতরণ - এই সবকিছুকে দেখতে হবে একটি বৃহৎ, গ্লোবাল এজেন্ডার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে। যে বিষয়টা উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল শত্রুপক্ষ জানে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বা কম্পোনেন্টের যেকোন একটা দিয়ে রাতারাতি জনমত বদলে ফেলা যাবে না। সেটা তাদের উদ্দেশ্যও না। বরং তাদের উদ্দেশ্য হল ছোট ছোট ইঙ্ক্রিমেন্টাল পরিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সামাজিক মূল্যবোধকে বদলে দেওয়া। এটাই কালচারাল সাবভারশানের টাইম-টেস্টেড পদ্ধতি। হঠাৎ করে একটা বড় পরিবর্তন সমাজে উপর চাপিয়ে দিতে চাইলে সেটা ব্যাকফায়ার করার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় পরিবর্তনটা উপস্থাপন করা হয় তখন এক পর্যায়ে গিয়ে সমাজ তা মেনে নেয়।  


সহজ উদাহরনঃ একটা সময় বাংলাদেশে বুকে ওড়না না দিয়ে গলায় ওড়না দেয়াটা খারাপ মনে করা হতো। এই সময়টাতে যেসব মেয়েরা জিন্স-টিশার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতো তাদের ব্যাপারে সমাজের অধিকাংশের ধারণা ছিল এরা উগ্র, অশ্লীল ইত্যাদি। কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে যারা একসময় জিন্স-টিশার্ট পরিহিতাদের উগ্র বলতেন তারাই তাদের মেয়েদের এখন জিন্স-টিশার্ট পড়াচ্ছে, এবং ব্যাপারটা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ‘নরমাল’। গলায় ওড়না ঝোলানো থেকে টি-শার্টে আসার ব্যাপারটা রাতারাতি করার চেস্টা সমাজ মেনে নেয়নি। বিরোধিতা করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন পরিবর্তন হয়েছে তখন সেই একই সমাজ খুশি মনে একে মেনে নিয়েছে।   কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের প্রথম ধাপ এটাই। মানুষকে সমকামিতার ব্যাপারে ডিসেনসেটাইয করা।  . 
   

 ‘প্রথম কাজ হল সমকামি এবং সমকামিদের অধিকারের ব্যাপারে অ্যামেরিকার জনগনের চিন্তাকে অবশ করে দেওয়া, তাদের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে দেওয়া [desensitization]। মানুষের চিন্তাকে অবশ করে দেওয়ার অর্থ হল সমকামিতার ব্যাপারে তাদের মধ্যে উদাসীনতা তৈরি করা...একজন স্ট্রবেরি ফ্লেইভারের আইস্ক্রিম পছন্দ করে আরেকজন ভ্যানিলা। একজন বেইসবল দেখে আরেকজন ফুটবল। এ আর এমন কী!’  [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]


 কার্ক-ম্যাডসেনের মতে প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্দেশ্য এই একটি। সমকামিতা  যে একটি জঘন্য বিকৃতি, চরম সীমালঙ্ঘন, ও ঘৃণ্য পাপাচার তা সম্পর্কে মানুষের সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করে দেওয়া। তাদের ভাষায় –  

‘সমকামিতা একটি ভালো জিনিস - একেবারেই শুরুতেই তুমি সাধারন মানুষকে এটা বিশ্বাস করাতে পারবে, এমন আশা বাদ দাও। তবে যদি তুমি যদি তাদের চিন্তা করাতে পারো যে সমকামিতা হল আরেকটা জিনিষ (ভালো না খারাপ না – জাস্ট আরেকটা ব্যাপার) তাহলে ধরে নাও আইনগত ও সামাজিক অধিকারের আদায়ের লড়াইয়ে তুমি জিতে গেছো।’ [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]


সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যারা কাজ করছে তাদের রেটোরিক খেয়াল করলে দেখবেন তাদের অধিকাংশ ঠিক এই মেসেজটাই দিতে চাচ্ছে। ‘সমকামিতা ভালো বা খারাপ না, জীবনের একটা বাস্তবতা মাত্র’। পহেলা বৈশাখের সময় শাহবাগে সমকামি প্যারেড কিংবা ঈদের সময় ঈদের নাটক হিসেবে সমকামিদের গল্প তুলে ধরার পেছনে একটি মূল উদ্দেশ্য হল সমাজের বিকৃতকামী এক্সট্রিম মাইনরিটিকে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা। একই সাথে সমকামিতাকে ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত করা, যেমনটা জাতিসংঘের Free & Equal ক্যাম্পেইনেও করা হয়েছে।
ভিকটিমহুড – সমকামিতা জন্মগতঃ  কার্ক-ম্যাডসেনের আরেকটি সাজেশান হল সমকামিদের ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা। সমকামিদের ভিকটিম হিসেবে চিত্রিত করার দুটি ডাইমেনশান থাকবে। প্রথমত, সমকামিতাকে একটি সিদ্ধান্তের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বা জন্মগত হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সমকামিদের জন্মগতভাবেই ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, সমকামিদের সমাজ দ্বারা নির্যাতিত হিসেবে চিহ্নিত করা।  বাংলাদেশে এবং বিশ্বজুড়ে যারা সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের কাজ করে তাদের প্রপাগ্যান্ডা ও বক্তব্য আপনি সবসময় এ দুটো মোটিফ দেখতে পাবেন। সমকামিরা জন্মগতভাবেই সমকামি এটা প্রমানের উদ্দেশ্য হল যদি সমকামিতাকে জন্মগত বা প্রাকৃতিক প্রমান করা যায় তাহলে সমকামিদের সম্পূর্ণ নৈতিক দায়মুক্তি সম্ভব। সমকামিতা যদি জন্মগত হয় তাহলে সমকামিতা একটি ‘অ্যাক্ট’ বা ক্রিয়া হিসেবে নৈতিকভাবে নিউট্রাল, কারন এর উপর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রন নেই। কিন্তু সমকামি জন্মগত – এই দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তো নেই-ই, বরং বিভিন্ন পরীক্ষা ফলাফল ইঙ্গিত করে যে Sexual Oreintation নির্ভর করে ব্যক্তির ‘চয়েস’ বা স্বেচ্ছায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর [৮]।   

 আরেকটি বিষয় হল সমকামিতা যদি জন্মগত হয় তাহলে অন্যান্য বিকৃত যৌনাচার কেন জন্মগত বলে গন্য হবে না? শিশুকামি, বা পশুকামিদের কেন অপরাধী গণ্য করা হবে? ইন ফ্যাক্ট শিশুকামের সাথে সমকামের, বিশেষ করে পায়ুকামের সম্পর্ক তো হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন গ্রিসে শিশুদের সাথে মধ্য বয়স্ক পুরুষদের পায়ুকামী সম্পর্ক বা Pederasty প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চালু ছিল  প্লেইটো তার রিপাবলিক ও ল’স – রচনাতে প্রাচীন পেডেরাস্টি এবং সমকামিতার ব্যাপক প্রচলনকে গ্রীসের অধঃপতনের একটি কারন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। অ্যামেরিকাতেও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সাথে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারের জন্য আন্দোলন করা NAMBLA (North American Man Boy Love Association) – দীর্ঘদিন ছিল গে-প্রাইড প্যারেডের নিয়মিত অংশ। বিখ্যাত অ্যামেরিকান কবি সমকামি অ্যালেন গিন্সবার্গ (সেপ্টেবর অন যশোর রোড – এর রচয়িতা) ছিল NAMBLA এর সদস্য। এছাড়া অসংখ্য সমীক্ষার মাধ্যমে একথা প্রমাণিত যে সমকামিতার সাথে অন্যান্য যৌন বিকৃতির বিশেষ করে শিশুকামিতার ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে [ ৯]। সমকামিতার বিশেষ করে পায়ুকামিতার সাথে শিশুকামের গভীর সম্পর্কের ব্যাপারে সংক্ষেপে বোঝার জন্য পায়ুকামি ও শিশুকামি কেভিন বিশপের এই উক্তিটি যথেষ্ট -  

"Scratch the average homosexual and you will find a pedophile" [Kevin Bishop in an interview. Angella Johnson, “The man who loves to love boys,” Electronic Mail & Guardian, June 30, 1997]



 সুতরাং যদি সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষন জন্মগত হতে পারে তাহলে সমলিঙ্গের অল্পবয়েসীদের প্রতি আকর্ষন কেন জন্মগত হতে পারবে না? কেন ধর্ষনের তাড়না অনুভব ধর্ষকরা জন্মগত বিচ্যুতির কারনে ভিকটিম গণ্য হবে না? কেন পশুকাম জন্মগত বলে গণ্য হবে না? Sexual Oreintation যদি জন্মগতই তবে কেন তা কেবলমাত্র সমকামিদের ক্ষেত্রে জন্মগত বলে বিবেচিত হবে? কিন্তু সব যুক্তি, প্রমান এবং বিবেচনাবোধের বিরুদ্ধে গিয়ে সমকামের প্রচারকরা একে জন্মগত বলে যাচ্ছে। আর ‘জন্মগত’ এই বৈশিষ্ট্যের কারনে কেন সমকামিদের আলাদা ভাবে দেখা হবে, এ নিয়ে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে। এবং এ দুটি দিক থেকে সমকামিদের ভিকটিম প্রমান করার মাধ্যমে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।  


মিডিয়াঃ কার্ক-ম্যাডসেনের মতে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরন ও গ্রহনযোগ্যতা তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের একটি হল মিডিয়া। বিশেষ করে ভিযুয়াল মিডিয়া –

‘সোজা ভাষায়, ভিযুয়াল মিডিয়া, টিভি ও সিনেমা হল ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালি মাধ্যম। অ্যামেরিকান প্রতিদিন গড়ে টিভি দেখে। এই সাতঘন্টা সময় সাধারন মানুষের চিন্তার জগতে ঢোকার এমন একটি দরজা আমাদের জন্য খুলে রেখেছে যার মধ্য দিয়ে একটা ট্রোজান হর্স ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব...যতো বেশি ও যতো উচ্চস্বরে সম্ভব, সমকাম, সমকামিতা এবং সমকামিদের কথা বলুন। বারবার দেখতে দেখতে থাকলে প্রায় যেকোন কাজই মানুষের কাছে ‘নরমাল’ মনে হওয়া শুরু করে...তবে মানুষের সামনে আগেই সমকামি আচরণ উপস্থাপন করা যাবে না – কারন তা মানুষের কাছে জঘন্য বলে মনে হবে এবং মানুষ সমকামিতার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তাই সমকামিদের যৌনাচার সাধারন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যাবে না। আগে তাবুর মধ্যে উটের নাক ঢুকাতে দিন, তারপর আস্তে আস্তে বাকিটাও ঢুকানো যাবে।’ [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]


 আর বাস্তবিকই ধীরে ধীরে এই দরজার মধ্য দিয়ে ট্রোজান হর্স ঢুকাতে সমকামি মাফিয়া সমর্থ হয়েছে। ৯০ এবং ২০০০ এর প্রথম দশক জুড়ে বিভিন্ন ডেইলি সোপ ধীরে ধীরে সাধারন অ্যামেরিকানদের মধ্যে সমকামিতার গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জৌ বাইডেন ২০১২ সালে সরাসরি সমকামিতা প্রচার করা টিভি সিরিয ‘উইল অ্যান্ড গ্রেইস’-এর নাম উল্লেখ করে বলে –

“একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে একজন নারী আরেকজন নারীকে বিয়ে করবে এতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই...আমার মনে হয় না অ্যামেরিকান মানুষকে (সমকামিতা সম্পর্কে) শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে উইল অ্যান্ড গ্রেইসের মতো ভূমিকা আর কেউ বা আর কোন কিছু রাখতে পেরেছে। যা অন্যরকম মানুষ সেটাকে ভয় পায়। কিন্তু এখন মানুষ (সমকামিতার ব্যাপারে) বুঝতে শুরু করেছে।”[১০]



   আর একইভাবে আজ বাংলাদেশেও এই একই দরজার ভেতর দিয়ে সেই একই ট্রোজান হর্স ঢোকানোর জন্য কর্মতৎপরতা চলছে। কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট বাংলাদেশে প্রায় অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমকামিতার প্রচারে মিডিয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্ক-ম্যাডসেনের মত ছিল প্রাথমিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করা, এবং তারপর ধীরে ধীরে ভিযুয়াল মিডিয়ার দিকে আগানো। বাংলাদেশে সমকামিতা প্রচারের কাজ শুরু হয় ৯০ এর দশকের শেষের দিকে। প্রাথমিকভাবে সমকামিতা প্রচারকদের কাজ ছিল অনলাইন চ্যাট গ্রুপ, মেইল গ্রুপ, ফোরাম ইত্যাদির মাধ্যমে সমকামিদের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচিতি তৈরি করা, বিভিন্ন সময় একত্রে ‘মিলিত’ হওয়া এবং কিছু নির্দিষ্ট অঙ্গনে সমকামিতার প্রচার করা, এবং সমকামিতার পক্ষে জনমত তৈরি করা। 

পাবলিক স্ফেয়ারে যখন তারা তাদের বিকৃতি প্রচারের শুরু করে তখন তারা সেটা করে প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে। ২০১০ সালে বইমেলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে বের হয় কুখ্যাত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামেরিকা প্রবাসি ইসলামবিদ্বেষি অভিজিৎ রায়ের বই ‘সমকামিতা’। অভিজিৎ রায় এই বইয়ে বিজ্ঞানের জগাখিচুড়ি ব্যাখ্যা দিয়ে, এবং নানা লজিকাল ফ্যালাসি ব্যবহার করে সমকামিতা-কে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ হিসেবে প্রমান করার চেষ্টা করে। তার অন্যান্য লেখার মতো এই লেখাটিও ছিল মূলত বিভিন্ন পশ্চিমা লেখকের লেখার ছায়া অনুবাদ। ২০১০ সালে অগাস্টে   আলতাফ শাহনেওয়াজ নামে একজনের  লেখা অভিজিৎ রায়ের বইটির রিভিউ প্রকাশ করে প্রথম আলো। আর এর মাধ্যমে প্রায় সবার অলক্ষ্যে তাদের বিশাল পাঠকবেইসের ড্রয়িং রূপে এই জঘন্য বিকৃতির সাফাই পৌছে দেয় প্রথম আলো।  




বাংলাদেশে প্রকাশ্যে সমকামিতার প্রসারে পরবর্তী বড় পদক্ষেপটি আসে ২০১৪ সালে, রূপবান নামে একটি ম্যাগাযিনের মাধ্যমে। আর এই ম্যাগাযিনের পক্ষে প্রচারনা চালানো হয় প্রিন্ট মিডিয়া (যেমন ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে) এবং অনলাইনের মাধ্যমে। ২০১৪ সালে রূপবানের প্রথম সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ হাই-কমিশনার রবার্ট গিবসন, ব্যারিস্টার সারা হোসেনসহ আরো অনেকে। এ থেকে গ্লোবাল সমকামি মাফিয়ার প্রভাব এবং বাংলাদেশে এদের বিস্তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ম্যাগাযিনটির প্রকাশনার খবর ফলাও করে প্রচার করা হয় ডেইলি স্টার, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন, বিবিসি সহ বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমে। রূপবান পত্রিকার সম্পাদক ছিল সাবেক পররাস্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির আত্মীয় অ্যামেরিকান দূতাবাসে চাকরিরত জুলহাস মান্নান। পরবর্তীতে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা অভিজিৎ রায় এবং জুলহাস মান্নানকে যথাক্রমে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হত্যা করে [১১]। 

 কার্ক-ম্যাডসেনের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যবহারের পর এবার বাংলাদেশে সমকামিতার প্রচারকরা ভিযুয়াল মিডিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি আরটিভিতে প্রচারিত নাটক তাই নতুন কিছু না, বরং প্রায় দুই দশক পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নতুন একট পর্যায়ের শুরু কেবল। গ্রামীনফোন প্রযোজিত এই নাটকে হুবহু কার্ক-ম্যাডসেনের শিখিয়ে দেওয়া ‘যুক্তি’গুলোই তুলে ধরা হয়েছে, এবং নাটকের ডায়ালগের মাধ্যমে সমকামিতাকে জন্মগত ও স্বাভাবিক, এবং সমকামিতা নৈতিকভাবে নিউট্রাল একটি কাজ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। নাটকে দেখানো হয়েছে সমকামি চরিত্রের পক্ষ নিয়ে একটি চরিত্র আরেকটি চরিত্রকে বলছেঃ 


‘ও পায়ুকামি (not straight), এটা কি ওর দোষ? সে কি এটাকে বেছে নিয়েছে? না। ওয়ার্ল্ডে নানা ধরনের মানুষ থাকে, তাহলে ও কেন থাকতে পারবে না? ও কি অস্বাভাবিক? না। ও কি একজন অপরাধী? না। ও তোমার আমার মতোই নরমাল মানুষ।’ [রেইনবো,আরটিভি,নির্মাতাঃ আশফাক নিপুন, প্রযোজনাঃ গ্রামীন ফোন ] 

  
 যদি বাংলাদেশে কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট নির্বিঘ্নে অনুসৃত হতে থাকে তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এরকম আরো অনেক নাটক, শর্টফিল্ম, স্কিট এবং জনসচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন দেখতে পাবো। এক পর্যায়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে সমকামিতার স্বপক্ষে প্রবন্ধ ছাপা হবে। সমকামিতা নিয়ে বানানো নাটক ও সিনেমাকে জাতীয় পুরষ্কার, মেরিল প্রথম-আলো পুরস্কার সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমকামি অধিকার সম্পর্কে প্রকাশ্যে নানা ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হবে, পাবলিক স্কুলের কারিকুলামে সমকামিতা ও সমকামি অধিকার সম্পর্কে আলোচনা যুক্ত করা হবে। এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে সমকামি কোন তরুন বা তরুণীকে দেশী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে ইয়ুথ আইকন হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। আর এভাবে ধীরে ধীরে সমকামিতাকে সামাজিক ও রাস্ট্রীয়ভাবে গ্রহনযোগ্য করে তোলা হবে একসময় একে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অথবা আইনগত স্বীকৃতি ছাড়াই একসময় সমকামিতে সমাজে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা লাভ করবে, যেমনটা বর্তমানে যিনার ক্ষেত্রে হয়েছে।  যদি এইভাবেই চলতে থাকে তাহলে অত্যন্ত অন্ধকার এক ভবিষ্যৎ এর মোকাবেলা আমাদের করতে হবে। 

তাই এ ব্যাপারটা বোঝা জরুরী যে এ দ্বন্দ্বটা সাময়িক কিছু না। কোন একটা নাটক বা বই বা ম্যাগাযিনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ সমকামিতাকে রাতারাতি গ্রহনযোগ্যতা দিতে চাচ্ছে না। এই নাটক, বই বা ম্যাগাযিনগুলোও এভাবে বানানো হচ্ছে না। তারা চাচ্ছে ক্রমাগত মানুষের সামনে সমকামিতা, ও সমকামিতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে, সমকামিতাকে স্বাভাবিক প্রমান করতে। প্রাকৃতিক প্রমান করতে। এই ব্যাপারে মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে দিতে। মানুষকে ডিসেনসেটাইয করতে। জনমতকে পরিবর্তন করতে, সামাজিক মূল্যবোধকে বদলে দিতে। প্রতিপক্ষের আছে প্রায় অফুরন্ত ফান্ডিং, মিডিয়া এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক প্রশাসনিক সমর্থন। সুতরাং একটি নাটকের পর সেই নাটক নিয়ে লেখালেখি করলে অনেক মানুষ এসব সম্পর্কে জেনে যাবে – এমন ধারণা যেমন সঠিক না, তেমনি ভাবে একটি নাটকের পর কেবলমাত্র আরটিভি-গ্রামীনফোন বর্জনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে হারানো যাবে এমন চিন্তা করাও ভুল। যদি আসলেই এই বিশাল মেশিনারীকে থামাতে হয়, যদি এই এজেন্ডার বাস্তবায়নকে বন্ধ করতে হয় তাহলে সমকামি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পেছনে থাকা কাঠামো সম্পর্কে জানতে হবে, একে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তবে সেই আলোচনা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।


নবিপ্রেমে সহাস্যবদনে জীবনোৎসর্গকারী তরুণ গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ রহ. : সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য






রাহমান রাহীম আল্লাহ্‌ নামে,


১,
পুরো হিন্দুস্তান উত্তাল। স্বামী পণ্ডিত চিমোপতি লাল রচিত রাসুলুল্লাহর সা. এর পবিত্র বৈবাহিক জীবন নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যে ভরপুর কুখ্যাত বই ‘রঙ্গিলা রাসুল’ প্রকাশের অপরাধে প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে চলছে তুখোড় আন্দোলন। ইংরেজ সরকার নীরব। মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যোবোধকে বিনষ্ট করার মানসে হিন্দুদেরকে ধর্মীয় উস্কানিমূলক সকল কাজের বৈধতা দিয়ে রেখেছে ইংরেজ সরকার। মুসলমানরা দগ্ধ হৃদয় নিয়ে প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে বারবার সরকারের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়েছে। উল্টো ইংরেজ সরকার প্রকাশক রাজপালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়োগ করেছে। মুসলমানরা যেনো আন্দোলন করে রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারে এজন্য ফিরিঙ্গিরা পূর্বেই ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছে

। আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী আলিমদেরকে ধরে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে আন্দোলনকে নির্বাপিত করতে চেয়েছে। কিন্তু এতে মুসলমানদের ভেতরের জ্বলন আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভার মতো শুধু বেড়েছেই।  ভেতরের আগুন ধীরে ধীরে বাইরেও ছড়িয়েছে। ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে অগণিত মুসলমান সেদিন দিল্লি দরজার অভ্যন্তরে শাহ মুহাম্মাদ গওস রহ. চত্ত্বরে সমবেত হয়। সমাবেশে নেতৃত্ব দান করেন আশিকে রাসুল আমিরে শরিয়ত সাইয়িদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ.। শাহজি রহ. সেদিন নবিপ্রেমে ব্যাকুল হয়ে এমন ইমানদীপ্ত অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেন, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে দাউ দাউ করে ইমানের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। সেই সমাবেশে মুফতি কিফায়াতুল্লাহ রহ. এবং মাওলানা আহমদ সাইদ দেহলবি রহ.ও উপস্থিত ছিলেন। শাহজি রহ. সেদিন তার ভাষণে বলেন—“আজ আপনারা জনাবে ফখরে রাসুল মুহাম্মাদে আরাবি সা. এর ইজ্জত এবং মর্যাদা সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে এখানে সমবেত হয়েছেন। আজ সমগ্র মানবজাতিকে ইজ্জত দানকারী মানুষটির ইজ্জত ঝুঁকির মধ্যে। আজ সেই মহান মানবের ইজ্জত ঝুঁকির মুখে পড়ে আছে, যার দেয়া ইজ্জত নিয়ে সমগ্র সৃষ্টিকুল গর্ব করে।

আজ মুফতি কিফায়াতুল্লাহ এবং মাওলানা আহমদ সাইদের দরজায় উম্মুল মুমিনিন আয়িশা সিদ্দিকা, উম্মুল মুমিনিন খাদিজাতুল কুবরা রা. দাঁড়িয়ে সকরুণ কণ্ঠে আওয়াজ দিচ্ছেন, “আমরা তোমাদের মা। তোমরা কি জানো না যে, কুফফার গোষ্ঠী আমাদেরকে গালি দিচ্ছে।” আরে দেখো, কোথাও উম্মুল মুমিনিন আয়িশা সিদ্দিকা রা. দরজায় দণ্ডায়মান নয়তো?!” শাহজি রহ. কথাটি হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে এমনভাবে উচ্চারণ করেন যে, সাথে সাথে সমবেত জনতা সকলে প্রায় দরজার দিকে ঘুরে তাকায়। পুরো মজলিসজুড়ে কান্না ও আর্তনাদের আওয়াজ ভেসে ওঠে। এরপর শাহজি রহ. বলেন—“তোমাদের মহব্বতের তো এই দশা যে, তোমরা সাধারণ সাধারণ অবস্থায় জীবন উৎসর্গ করে বসো অথচ তোমাদের কি জানা নেই যে, আজ রাসুলুল্লাহ সা. সবুজ গম্বুজের নিচে তড়পাচ্ছেন। আজ খাদিজা এবং আয়িশা রা. পেরেশান। বলো, তোমাদের হৃদয়ে উম্মুল মুমিনিনদের জন্য কোনো জায়গা আছে কি? আজ উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. তোমাদের কাছে হক তলব করে ফিরছেন; সেই আয়িশা, রাসুলুল্লাহ সা. যাকে ভালোবেসে ‘হুমায়রা’ বলে ডাকতেন, সেই আয়িশা, যিনি সাইয়িদে আলম সা. এর তিরোধানের সময় তাকে মিসওয়াক চিবিয়ে দিয়েছেন। স্মরণ রেখো, যদি তোমরা খাদিজা এবং আয়িশা রা. এর জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে পারো, তাহলে তা কম গর্বের কথা নয়। যতোক্ষণ পর্যন্ত একজন মুসলমান জীবিত আছে, রাসুলের ইজ্জতের ওপর হামলাকারীরা কিছুতেই প্রশান্তির সাথে বাঁচতে পারে না। পুলিশ মিথ্যা, সরকার আলসে আর ডিপুটি কমিশনার অযোগ্য। ওরা হিন্দু সংবাদধারার বাচালতা ও বকবক তো বন্ধ করতে পারে না, কিন্তু উলামায়ে কেরামের ভাষণ-বক্তৃতা বন্ধ করে দিতে চায়। সময় এসেছে, আজ এখানে ১৪৪ ধারা টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেয়া হবে। আমি ১৪৪ ধারাকে আমার জোতার নিচে পিষ্ট করে বলবো—

پڑا فلک کو دل جلوں سے کام نہیںجلا کے راکھ نہ کر دوں تو داغ نام نہیں

এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমার নানার এই মালউন গোস্তাখকে কোনো মুসলমান নওজোয়ান হালাক করতে না পারে, তাহলে রাসুলুল্লাহর হুরমতের কসম, এই সাইয়িদজাদা বুড়ো নিজ হাতে এই মহান ফরজ কর্ম সম্পন্ন করবে।”সেদিনই আঞ্জুমানে খুদ্দামুদদীন শহরের ফটকে ফটকে রাজপালকে হত্যা করা ওয়াজিব মর্মে ফতোয়া টানিয়ে দেয়। আলিমউলামা জনসাধারণ সকলের যবানেই ‘শাতিমে রাসুল’কে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর অপরিহার্যতার কথা চর্চা হতে থাকে। 

২,
১০ এপ্রিল ১৮৭৫ তারিখে সনাতন হিন্দুধর্ম থেকে নতুন শাখা উৎসারিত হয়, যার নাম আরিয়া সমাজ। এর প্রবর্তক স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটে জন্মগ্রহণ করে। স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী হিন্দুধর্মকে নতুন করে সংস্কার-সংশোধন করে, তার জন্য নয়া সীমারখা নির্ধারণ করে। সে মূর্তিপূজাকে অস্বীকার করে। দেবদেবীকে উপাস্য হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। জাতপাতকে ধর্মীয় বা প্রকৃতিগত বিভাজন স্বীকার না করে রাজনৈতিক বিভাজন বলে আখ্যায়িত করে।

স্বল্প সময়েই তার এই সংস্কার ধারা শিক্ষিত প্রজন্মকে আকর্ষণ করে। দলে দলে তারা আরিয়া সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। আরিয়া সমাজের জন্য আলাদাভাবে আইন প্রণয়ন করা হয়। এই মতবাদকে সমগ্র হিন্দুস্তানে প্রসার করার জন্য শৃঙ্খলিত পদক্ষেপ নেয়া হয়। আরিয়া সমাজের জন্য নির্ধারিত কোঠা ঘোষণা করা হয়।  ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী দুনিয়া ত্যাগ করে।স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী শুধু হিন্দুধর্ম সংস্কারের কাজই করেনি, বরং ইসলামের ওপর জ্ঞানগতভাবে আক্রমণ করে। নিজের অপরিপক্ক মাথাকে ব্যবহার করে ইসলাম কোরআন নবি— সবকিছুকেই তার তীর্যক আপত্তির লক্ষ্যস্থল বানায়।

 ইসলামের ওপর তার প্রসিদ্ধ এগারোটি আপত্তি ছিলো। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবি রহ. তার আপত্তিগুলোকে ‘ইনতিসারে ইসলাম’, ‘কিবলাহ নুমা’ এবং ‘তুরকি ব তুরকি’ গ্রন্থত্রয়ে খণ্ডন করেন। নরাধম দিয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুর সুদীর্ঘকাল পর তার রচিত কোরআনের বিরুদ্ধে শত আপত্তিবিদ্রূপে ভরপুর বই ‘সত্তিয়ারথ পোরকাশ’ উর্দুতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। বইটিকে উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে ‘রঙ্গিলা রাসুলে’র লেখক স্বামী পণ্ডিত চিমোপতি এম এ। রাজপাল নামক এক কট্টর হিন্দু প্রকাশক লাহোরে অবস্থিত তার লাইব্রেরি থেকে এ বই প্রকাশ করে মুসলমানদের হৃদয়কে চরমভাবে আহত করে। মুসলমানরা বইটির প্রকাশনার ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-পরিশ্রম করে। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন না করে, তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরমভাবে আঘাত করে ফিরিঙ্গিরা সাদা চামড়ার ভেতরে সুপ্ত নিজেদের চরম কুশ্রী মুখোচ্ছবি প্রকাশ করে। রাজপালের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তার প্রকাশনীর কর্মচারী মুনশি রাম সরকারি সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে। এই মুনশি রাম কিছুদিনের মধ্যেই রাতারাতি ‘শ্রীমান মহাত্মা সোরাগ বাশী সোয়ামী শ্রীদ্ধানন্দজি’ বনে যায়। এরপর সে অবিরল কোরআন ইসলাম এবং নবিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে লিটারেচার প্রকাশ করতে থাকে। তবে তার এই কুকর্মের ধারা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হতে পারে না। এক জানবাজ মুজাহিদ কাজি আব্দুর রশিদ শহিদ রহ. এর হাতে তার জীবননাটিকার যবনিকাপাত হয়। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নরাধম রাজপাল ‘রঙ্গিলা রাসুল’ প্রকাশ করে।

৩,
আমিরে শরিয়ত আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ. এর ইমানদীপ্ত অগ্নিঝরা ভাষণে প্রভাবিত হয়ে লাহোরে অবস্থানকারী অত্যন্ত সুশ্রী ও নুরানি চেহারার অধিকারী এক কাশ্মীরি যুবক গাজি খোদাবখশ ইবনে মুহাম্মাদ আকরাম ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ তারিখে জানবাজি রেখে নরাধম রাজপালের ওপর আক্রমণ চালান।  কুখ্যাত রাজপাল নিজ লাইব্রেরিতে কাজে ব্যস্ত ছিলো। এমন সময় গাজি খোদাবখশ রহ. এসে ধারালো ছুরি নিয়ে রাজপালের ওপর অতর্কিত হামলা চালান।  আকস্মিক এ আঘাতে রাজপাল আহত হয়। তার শরীর থেকে রক্তের ধারা বইতে থাকে। কিন্তু দ্রতবেগে নিজেকে সামলে নিয়ে রাজপাল সেখান থেকে পলায়ন করে। পুলিশ গাজি খোদাবখশ রহ. কে ৩০৭ ধারার অধীনে গ্রেফতার করে।

লাহোর ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট কোর্টে মামলার রায়ের শুনানি হয়। গাজি খোদাবখশ রহ. নিজের পক্ষে কোনো ওকিল গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। রাজপাল আদালতে সকরুণ কণ্ঠে আরজ করে, “আমার ওপর এ হামলা মুক্তচিন্তার বই প্রকাশ এবং মুসলমানদের এজিটেশনের কারণে করা হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অপরাধী খোদাবখশ আমাকে জানে মেরে ফেলবে।” জজ জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আরো কিছু বলবেন?” রাজপল বললো, “হামলার সময় অপরাধী চিৎকার করে বলছিলো, কাফিরের বাচ্চা, আজ তুই আমার হাতে এসেছিস। আজ আর তোকে জীবিত ছাড়বো না।” জজ গাজি খোদাবখশ রহ. এর কাছে এর ব্যাখ্যা তলব করলে তিনি গর্জে উঠে বলেন, “আমি মুসলমান। রাসুলের ইজ্জত রক্ষা করা আমার ওপর ফরজ। আমি কিছুতেই আমার ‘আকা’ এবং ‘মাওলা’ মুহাম্মাদ সা. এর অপমান বরদাশত করতে পারি না।” এরপর মালউন রাজপালের দিকে ইশারা করে বলেন, “সে আমার প্রিয় রাসুলের শানে গোস্তাখি করেছে। এজন্য আমি তার ওপর জীবনবাজি রেখে আক্রমণ করেছি। কিন্তু এই নরাধম সেসময়ে আমার হাত থেকে একটুর জন্য বেঁচে গেছে।”অপরাধের স্বীকারোক্তি প্রদানের পর আদালত গাজি খোদাবখশ রহ. এর ব্যাপারে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করে, যার মধ্যে তিনমাস একাকী বাসের শাস্তিও রয়েছে। এবং নির্ধারিত মেয়াদ খতম হওয়ার পরে নিরাপত্তা লাভের জন্য পাঁচ পাঁচ হাজার রুপি মূল্যের তিনটি জামানত দাখিল করার ফায়সালা ঘোষণা করা হয়

।এর কিছুদিন পর ১৯ অক্টোবর ১৯২৭ তারিখে মালউন রাজপালকে জাহান্নামে পৌঁছানোর মানসে আফগানিস্তানের কোহাট থেকে গাজি আব্দুল আজিজ নামের এক ইমানদীপ্ত ব্যবসায়ী যুবক লাহোরে আগমন করে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে মালউন প্রকাশকের লাইব্রেরিতে পৌঁছে। ঘটনাক্রমে সেসময়ে রাজপাল দোকানে ছিলো না। তার পরিবর্তে দোকানে বসা ছিলো তার দুই বন্ধু জিতান্দর দাস এবং স্বামী সত্যানন্দ। দোকানে বসে তারা মুক্তমনে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছিলো। আলোচনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছিলো স্বামী সত্যানন্দ। গাজি আব্দুল আজিজ কিছু সময় আড়াল থেকে আলোচনা শুনেন। তিনি স্বামী সত্যানন্দকেই রাজপাল ভেবে বসেন। অনন্তর কোষ থেকে তরবারি বের করে এক আঘাতেই স্বামী সত্যানন্দকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। এরপর তিনি নিজেই সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমি রাসুলের ইজ্জত হরণকারী নরাধমের ভবলীলা সাঙ্গ করেছি। আমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক।  আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গাজি আব্দুল আজিজ রহ. এ কথাগুলো বলেন—“আমার নাম আব্দুল আজিজ। আমি (সুলতান মাহমুদ গজনবির স্মৃতি বিজড়িত) গজনিতে থাকি। আমার মাতৃভূমির গর্ব, সে সুলতান মাহমুদ গজনবির মতো মহান মুজাহিদ মুবাল্লিগ ও মূর্তিবিনাশকারী মনীষীকে গর্ভে ধারণ করেছে, যেই মাহমুদ গজনবি এই ভারতবর্ষের ওপর কমবেশি সতেরোবার হামলা চালিয়ে কুফুর এবং ইলহাদকে বিনাশ করেছেন এবং মূর্তির নগরকে ইসলামের দৌলত দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন। এই সেই মহান মূর্তিবিনাশকারী, যার সামনে সোমনাতের পূজারীরা সম্পদের পাহাড় ঢেলে দিয়ে এই ফরিয়াদ জানিয়েছে যে, মহারাজ, আপনি এই সমস্ত সম্পদ নিয়ে নিন, তবুও আমাদের মূর্তিদের ওপর যেনো কোনো আঘাত না আসে। কিন্তু ইসলামের এই মহান মুজাহিদ নিঃসঙ্কোচে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, মুসলমান মূর্তিবিনাশকারী, মূর্তিবিক্রেতা নয়। এই কথা বলে তিনি সোমনাতের মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছেন। আল্লামা ইকবাল যার নির্মুখাপেক্ষিতা এবং পূর্ণ ইমানের ওপর গর্ব করে বলেন—

قوم اپنی جو زر و مال جہاں پر مرتیبت فروشی کے عوض بت شکنی کیوں کرتی

 তিনি ছিলেন সেই গাজি, যিনি শুনলেন, মুলতানে কারামিতা নামক এক গোষ্ঠী আছে, যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু আদতে তারা কাফির এবং মূর্তিপূজারী। তাদের লৌকিকতার চূড়ান্ত হাল এই ছিলো যে, তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জামাতের সাথে নামাজ পড়তো, কিন্তু সামনে নাউযুবিল্লাহ হযরত রাসুলে কারিম সা. এর কাল্পনিক অবয়ব বানিয়ে রাখতো। মাহমুদ গজনবির কাছে এই ভয়াল রিপোর্ট পৌঁছামাত্রই তিনি ঘূর্ণিবায়ুর মতো দ্রুতবেগে সেখানে হাজির হন এবং মুলতানের হাকিম দাউদ কারামেতির ভবলীলা সাঙ্গ করে সেখানে ইসলামের পতাকা উড্ডিন করেন। আমাকে স্বপ্নে সুলতান মাহমুদ গজনবি আদেশ করেছেন, যাও, সেই মালউনকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে উভয় জাহানের কামিয়াবি অর্জন করো।

 আমার আফসোস হচ্ছে যে, মূল শয়তানকে জাহান্নামে পৌঁছাতে পারলাম না।”গাজি আব্দুল আজিজের এই সারগর্ভ এবং আলিমসুলভ কথামালা শুনে মুসলিম জনতা সমস্বরে তাকবির দিয়ে আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলে। ফিরিঙ্গি হুকুমতের ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট এম বি উগলবি আইনি তাকাজা এবং আরো কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ করে গাজি আব্দুল আজিজ খানকে শাহাদাতের মর্যাদা দেয়ার পরিবর্তে তার ব্যাপারে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে। পরাপর দুইবার অতর্কিত আক্রমণে ভীত হয়ে রাজপাল নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে করে।  তাই সে আদালতের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট রাজপালের নিরাপত্তার জন্য দুই হিন্দু সিপাহী এবং এক শিখ হাবিলদার নিয়োগ করে। রাজপাল পাহারাবেষ্টিত জীবনকে নিরাপদ জীবন ভেবে বসে। সেসময়ে সে লাহোর ছেড়ে কয়েক মাস অন্যান্য শহরনগর ঘুরে আমোদফূর্তি করে আসে। তার ধারণা ছিলো, এই নাতিদীর্ঘ সময়ে ঝামেলা ও বিপদ কেটে যাবে, মুসলমানদের জযবাও নিস্তেজ হয়ে যাবে। লাহোরে ফিরে সে পুনরায় তার কারবার শুরু করে।

৪,
গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ লাহোরের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ৪ ডিসেম্বর ১৯০৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবার নাম তালেমন্দ। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। লাহোরে এবং তার আশপাশে সততা এবং দক্ষতার কারনে তাদের ভালো সুনাম ছিলো। সম্মানের সাথেই দিনাতিপাত করছিলেন। খুব বড় হওয়ার এবং অনেক সম্পদধারী হওয়ার স্বপ্ন ছিলো না। আর দশটি পরিবারের মতো স্বাভাবিকভাবেই জীবনের ধাপগুলো অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষা ছিলো। সেসময়ে শিশুরা মসজিদ থেকেই প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করতো।

 তালেমন্দ তার ছেলেকেও কোরআন শেখার জন্য মসজিদে পাঠিয়েছিলেন।  গাজি ইলমুদ্দিন কিছুদিন সেখানে যাতায়াত করে। কিন্তু অধিক বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করা আর তার নসিবে জোটে না। কুদরত তাকে হয়তো গতানুগতিকতার বাইরে অন্য কোনো মিশনের জন্য প্রস্তুত করছিলো। ইলমুদ্দিনের ভাই মুহাম্মাদুদ্দিন লেখাপড়া করে সরকারি চাকরি লাভ করে। অপরদিকে ইলমুদ্দিন বাবার হাত ধরে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশায় আত্মনিয়োগ করে। বাবার মতো সেও একজন ভালো কাঠমিস্ত্রি হয়। ইলমুদ্দিন বাবার সাথে কাজের প্রয়োজনে লাহোরের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে গমন করতো।ইলমুদ্দিন এবং মুহাম্মাদুদ্দিনের মধ্যে বেশ সখ্যতা ছিলো। ভাই-ভাইয়ের মধ্যে এমন প্রগাঢ় ভালোবাসা খুব কমই নজড়ে পড়ে।  একবারের ঘটনা, ইলমুদ্দিন তখন বাবার সাথে শিয়ালকোটে গিয়েছে। এদিকে মুহাম্মাদুদ্দিন ভাইয়ের ব্যাপারে দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্ন দেখে অস্থির হয়ে মুহাম্মাদুদ্দিনও শিয়ালকোটে গিয়ে পৌঁছে। মুহাম্মাদুদ্দিন যখন বাবার ঠিকানায় পৌঁছে, তখন ইলমুদ্দিন খাটে বসা ছিলো। ভাইকে দেখে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। তালেমন্দ মুহাম্মাদুদ্দিনকে বসতে বলেন। মুহাম্মাদুদ্দিন স্বপ্নে ভাইকে যখম হতে দেখেছিলো। এবার সে লক্ষ করে দেখে, বাস্তবেই ইলমুদ্দিন যখম। হাতে পট্টি বাঁধা। কাজে তখন তো মাত্র হাতেখড়ি হচ্ছে। তাই অসতর্কতায় আঘাত পেয়ে হাত যখম হয়েছে।

সেখানে একদিন অবস্থান করে বাবার নির্দেশে পরবর্তী দিন মুহাম্মাদুদ্দিন লাহোরে ফিরে আসে।ইলমুদ্দিন লেখাপড়া শিখেনি ঠিক, তবে পারিবারিকভাবেই মনুষ্যত্বের দীক্ষা নিয়েছে। সততা সত্যবাদিতা অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার মানসিকতা অনুগ্রহকারীর জন্য জীবনোৎসর্গ করার চেতনা ইত্যাদি বিষয় বাবা-মা’র দৈনন্দিন আচার-রীতি থেকেই তার ভেতরে শেকড় গেঁড়ে নেয়। ইলমুদ্দিন কখনও চিল্লায় যায়নি ঠিক, কখনও হজ-উমরাও করেনি, কখনও খানকাহয়ও যাতায়াত করেনি, আর না কখনও রাযি-কাশশাফ অধ্যয়ন করেছে, মানতিক-ফালসাফা-আসরারে শরিয়ত শিখেছে, না কখনও শায়খের সাথে সম্পর্ক গড়ে দীর্ঘ আমল করেছে, না কখনও মসজিদে গাশত করেছে। কিছুই সে করেনি। দীনি বিষয়ে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যই সে অর্জন করেনি। তার তো সম্বল ছিলো শুধু এক কালিমা। যে কালিমা সে পড়তো। যে কালিমাকে সে ভালোবাসতো। যে কালিমা থেকে সে দুই মহান সত্তাকে অনুভব করতো। আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালোবাসতো। সে হেকমত-মাসলাহাত বুঝতো না। তার ভেতরে জযবা ছিলো। দীনি জযবা। আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালোবাসার জযবা। এজন্যই তো তার স্মরণে আল্লামা ইকবাল বলেন—


اسی گلاں ای کر دے رہ گئے تے تر خاناں دامنڈابازی لے گیا

অপর এক কবিতায় আল্লামা বলেন—
عشق کی اک ہست نے طے کر دیا قصہ تماماس زمین و آسماں کو بے کرا سمجھا تھا میں نے

 ইলমুদ্দিন এক সাদাসিধে মুসলমান। সে দিনরাত তার পেশায়ই ডুবে থাকতো। জগতের কোনো খোঁজখবরই তার ছিলো না। রাজপালের ঘৃণ্য উদ্যোগে সারা হিন্দুস্তান যে উত্তাল— এর বিন্দুমাত্র খোঁজও ইলমুদ্দিনের ছিলো না। একদিন সন্ধ্যেবেলায় কাজ শেষ করে ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরছিলো। দিল্লি দরজার কাছে আসলে সেখানে এক বিশাল সমাবেশ দেখতে পায়। ডায়াস থেকে এক নওজোয়ানের অগ্নিঝরা বক্তৃতার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসে। সে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়ায়। কিন্তু তার মাতৃভাষা পাঞ্জাবি হওয়ায় উর্দু ভাষণ সে খুব বেশি বুঝতে পারে না।

 উর্দু ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা। তার তো আর প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করার সুযোগ হয়নি। পাশের এক ব্যক্তিকে অবস্থা জিজ্ঞেস করলে সে তাকে জানায়, রাজপাল নামের এক হিন্দু প্রকাশক রাসুলুল্লাহ সা. এর শানে গোস্তাখিমূলক বই প্রকাশ করেছে। তার প্রতিবাদে আজকের এ সমাবেশ। কথাটা ইলমুদ্দিনের ভেতরে স্পন্দন জাগায়। রাজপালের দুঃসাহসিকতা তার হৃদয়কে চরমভাবে আহত করে। ইলমুদ্দিন দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আলোচনা শুনতে থাকে।  কিছুক্ষণ পর স্টেজে আসেন একজন পাঞ্জাবি বক্তা। ইলমুদ্দিন খুব মনোযোগের সাথে তার আলোচনা শোনে। সেখান থেকেই সে জানতে পারে, রাজপাল তার এই দুঃসাহসিক কাজের কারণে ‘ওয়াজিবুল কতল’ তথা তাকে হত্যা করা অপরিহার্য। ইলমুদ্দিনের মানসজগতে বৈপ্লবিক ঝড় ওঠে। তার চিন্তাভাবনা মনমানসিকতা মুহূর্তেই সব বদলে যায়। কালিমায় এতোদিন একশ্বাসে যে দুই মহান সত্তার নাম নিতো, অশিক্ষিত মানুষটি যে দুই সত্তাকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, সেই রাসুলের শানে এই চরম গোস্তাখিকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সমাবেশ শেষ করে মধ্যরাতে ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরে।

বাবা জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার? আজ হঠাৎ দেরি কেনো? ইলমুদ্দিন সব খুলে বলে। রাজপাল ওয়াজিবুল কতল হওয়ার যে কথা সে শুনে এসেছে তাও বলে। তালেমন্দও একেবারে সাদাসিধে কালিমাপাঠকারী মুসলমান ছিলেন।  সব শুনে তিনিও আলোচনার সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। তিনিও বলেন, এমন বদমাশকে জাহান্নামেই পৌঁছানো উচিত। কথাটা ইলমুদ্দিনের হৃদয়জগতকে ছুঁয়ে যায়। সে যেনো মৌনভাবে ঘর থেকেও অনুমতি পেয়ে যায়।সে রাতে ইলমুদ্দিনের আর ঘুম হয় না। পরবর্তী দিন সে তার বন্ধু শেদার সাথে সাক্ষাত করে। শেদাকে সব খুলে বলে। সেই দিনগুলোতে পুরো হিন্দুস্তানজুড়ে মুসলমানদের মূল আলোচনার বিষয় এই একটাই ছিলো।

 চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাট-বাজার— সর্বত্রই চলছিলো রাজপালের দুঃসাহসিকতা ও আস্পর্ধা নিয়ে আলোচনা। ইলমুদ্দিন নিয়মিত শেদার সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও পরামর্শ করতে থাকলো। কাজকর্ম নাওয়াখাওয়া কোনো কিছুতেই তার আর মন ছিলো না। সারাদিন একই চিন্তা, একই ভাবনা। প্রথমে পরিবারের চোখে বিষয়টা ধরা না পড়লেও আখের তাদের মনেও সন্দেহ জাগে। তারা তো তখনও জানেন না, কী মহান স্বপ্ন-ভাবনা খেলে যাচ্ছে ইলমুদ্দিনের বুকে। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, তাদের ছেলে তাদের জন্য জান্নাতের সওদা করছে, তাদেরকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দানের উদ্যোগ নিচ্ছে। তালেমন্দের এক বন্ধু শেদার সঙ্গে ইলমুদ্দিনের মেলামেশার বিষয়টা তাকে অবগত করে। শেদা অনেক ভালো ছেলে ছিলো। কিন্তু তালেমন্দের সেই বন্ধু তাকে জানায়, শেদা একটা আওয়ারা-লম্পট ছেলে।  তার সাথে মেলামেশা করাটা ইলমুদ্দিনের ঠিক হচ্ছে না। তাকে এখনই ফেরানো উচিত। নইলে দিনদিন সে খারাপ হয়ে যাবে। তালেমন্দ ছেলেকে অনেক করে বোঝায়। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয় না।ইলমুদ্দিন আর শেদা অনেক খুঁজেফিরেও জানতে পারে না যে, কে এই নরাধম রাজপাল আর কোথায়ই বা তার দোকান। সে দেখতেই বা কেমন। পরিশেষে শেদার এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে, নরাধম রাজপালের লাইব্রেরি হাসপাতাল রোডে।

এদিকে ইলমুদ্দিনের অনিয়মানুবর্তিতার বিষয়টি তালেমন্দকে অনেক ভাবায়। ছেলে ঠিকমতো কাজে যায় না, নাওয়াখাওয়ারও কোনো খবর নেই। তার কাছে এর একমাত্র কারণ মনে হয় শেদার সঙ্গে মেলামেশা। এদিকে শেদার ব্যাপারে তিনি আরো জানতে পারেন যে, শেদার বাবা একজন জুয়ারি; জুয়ার পয়সা চুখাতে আখের নিজের দোকানটাও যিনি হারিয়েছেন। তালেমন্দ রাগি স্বভাবের মানুষ ছিলেন।

 একদিন রাতে দেরি করে ঘরে ফিরে ইলমুদ্দিন।  তার অপেক্ষায় ঘরের ভেতর পায়চারি করছিলেন তালেমন্দ। ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কোথায় ছিলে আজ সারাদিন? ইলমুদ্দিন জবাব দেয়, শেদার সাথে। উত্তর শুনে তালেমন্দ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছেলেকে গালমন্দ করতে থাকেন। ইলমুদ্দিন মাথা নিচু করে সব শুনে যেতে থাকে। তালেমন্দ রাগের প্রচণ্ডতায় শেষ অবধি বলে বসেন, এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা। যা, ঐ বদমাশের কাছে চলে যা। তোর মুখ আর আমাকে দেখাবি না।বড় ভাই মুহাম্মাদুদ্দিন ঘরেই ছিলো। সে এসে বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে।  ছোট ভাইকে হাত ধরে তার কামরায় নিয়ে যায়।  এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে খুব করে তাকে বোঝায়। খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে বলে। শেদার ব্যাপারে সকলের নেগেটিভ ধারণা দেখে ইলমুদ্দিনও খুব ব্যথিত হয়। কিন্তু সে মনের কথা কাউকেই খুলে বলতে পারে না। কীভাবেই বা বলবে! যেখানে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। সে তো মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে নিয়েছে, যদিও বাহ্যদৃষ্টিতে তা কারোরই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। ছেলের অবস্থার পরিবর্তন না দেখে তালেমন্দ সিদ্ধান্ত নেন, বিশ বছর বয়সী ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেবেন। সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে, অপ্রত্যাশিত অবস্থাও শুধরে যাবে। তারা পাত্রী দেখে ইলমুদ্দিনের বিয়ের কথাবার্তা পাকাপোক্ত করে ফেলেন।

 একরাতের কথা, ইলমুদ্দিন স্বপ্নে দেখে, এক বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, “ইলমুদ্দিন, এখনও ঘুমিয়ে আছো?! দুশমন তোমার নবির শানের খেলাফ প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত। উঠো। জলদি করো।”ইলমুদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। উত্তেজনায় তার সারা শরীর ঘেমে ভিজে যায়। সে অস্থির হয়ে পড়ে। এরপর ঘুমানোর চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারে না। অনন্তর উঠে সরাসরি শেদার ঘরে পৌঁছে। শেদাকে নিয়ে ভাটি দরজার কাছে যায়। এরপর তাকে সব খুলে বলে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইলমুদ্দিন রাতে যে স্বপ্ন দেখেছে, হুবহু একই স্বপ্ন শেদাও দেখেছে। স্বপ্নে দেখা বুযুর্গ উভয়কে একই আদেশ দিয়েছেন। তারা উভয়েই পেরেশান। এবার কে তাহলে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। উভয়ই এই গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে সম্পন্ন করতে চাচ্ছিলো। আখের আলোচনার মাধ্যমে কোনো ফায়সালা করতে না পেরে তারা লটারি করে। লটারিতে ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। শেদার অনুরোধে পুনরায় লটারি করা হয়। এবারও ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। শেদার পীড়াপীড়িতে তৃতীয়বার লটারি করলে এবারও ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। ইলমুদ্দিন নিশ্চিন্ত হয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বাড়িতে ফেরে।

আবারও ইলমুদ্দিন স্বপ্ন দেখে, সেই বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, “উঠো! জলদি করো! দেরি করবে তো অন্য কেউ এসে বাজি নিয়ে যাবে!”ইলমুদ্দিন শেষবারের মতো শেদার সাথে দেখা করে। স্মৃতির নিদর্শনস্বরূপ তাকে একটি ছাতা এবং একটি ঘড়ি উপহার দেয়। এরপর তার কাছ থেকে শেষ বিদায় নেয়। রাতে তার দু’চোখে ঘুম আসে না। ভাবনায় ভাবনায় কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে দেয়।

 পরবর্তী দিন ৬ এপ্রিল ১৯২৯ তারিখে ইলমুদ্দিন সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়। গুমটি বাজারের দিকে যায়। আত্মারাম কামারের দোকানে গিয়ে সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো একটি ছুরি কিনে। কাঠমিস্ত্রি হওয়ার সুবাদে ছুড়ি-চাকু সে ভালোমতোই চিনতো। ছুরি কেনার পর সে অনেকটা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তৎক্ষণাতই হাসপাতাল রোডে পৌঁছে। আনারকলি হাসপাতাল রোডে ইশরত পাবলিশিং হাউজের সামনেই রাজপালের অফিস ছিলো। সেখানে পৌঁছে ইলমুদ্দিন জানতে পারে, রাজপাল এখনও আসেনি। আর যখন সে আসে, তখন তার হেফাজতে পুলিশও এসে হাজির হয়। ইতোমধ্যে রাজপালের অফিসের সামনে এসে একটি কার থামে। ইলমুদ্দিন জানতে পারে, কার থেকে যে লোকটা নামছে, সে-ই রাজপাল।

 এই নরাধমই রাসুলের শানে গোস্তাখিমূলক বই প্রকাশ করেছে এবং তা নামমাত্র মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। রাজপাল গাড়ি থেকে নেমে সাহেবের মতো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে পুলিশকে তার আগমনের কথা জানানোর জন্য টেলিফোন উঠানোর কথা ভাবছে— এমন সময় ইলমুদ্দিন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সেসময়ে অফিসে দু’জন কর্মচারী ছিলো। কুদারনাথ পেছনের কামরায় বইপত্র রাখছিলো আর ভগতরাম রাজপালের পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। রাজপাল এক তরুণকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে, কিন্তু সে ভাবতেই পারে না যে, মৃত্যু তার এতোই কাছে। ইলমুদ্দিন ভেতরে প্রবেশ করে চোখের পল পড়ার আগেই জামার ভেতর থেকে ছুরি বের করে। তার হাতটা উঁচুতে উঠে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো ছুরির আঘাত রাজপালের বুকে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ছুরির ফলা রাজপালের কলজে ভেদ করে। এক আঘাতেই আহ শব্দ উচ্চারণ করে রাজপালের দেহ মুখ থুবড়ে যমিনে পড়ে। ইলমুদ্দিন দ্রুত পেছনে ফিরে দোকান থেকে পলায়ন করে। দোকানের দুই কর্মচারী বাইরে এসে চিৎকার করতে থাকে, “ধরো! ধরো! ... মেরে ফেলেছে! মেরে ফেলেছে!” কাশ্মীর থেকে রাসকুমারি পর্যন্ত চারিদিকে দাবানলের মতো গাজি ইলমুদ্দিনের বাহাদুরির কথা ছড়িয়ে যায়। সর্বত্র এই ইমানদীপ্ত তরুণের কালজয়ী কারনামার কথা আলোচনা হতে থাকে। গাজি ইলমুদ্দিন নবিপ্রেমের নযরানা পেশ করার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।

৫,
স্বভাবত আদালতের কার্যক্রম কচ্ছপের থেকে ধীরগতিসম্পন্ন হলেও এক্ষেত্রে আদালত ছিলো বড়ই সোচ্চার। গাজি খোদাবখশ এবং গাজি আব্দুল আজিজের ক্ষেত্রে গ্রেফতারের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাদের ফায়সালা শুনিয়ে দেয়া হয়। ফিরিঙ্গিদের আদালতের রঙ্গমঞ্চে তাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই তাদের পক্ষে কোনো ওকিলকে দেখা যায় না। গাজি ইলমুদ্দিনের ক্ষেত্রেও প্রথমে এমনই হয়।

 ১০ এপ্রিল ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনকে সর্বপ্রথম আদালতে ওঠানো হয়। ইমানের চেতনার দাবিতে অবশেষে গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে একঝাঁক মুসলিম ওকিল সাড়া দেন। ব্যারিস্টার খাজা ফিরোজ উদ্দিন, ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন এবং তাদের সহযোগিতায় ডা. এ আর খালেদ, মাস্টার সেলিম এবং আরো কয়েকজন আল্লাহর বান্দা এই মামলার পক্ষে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওকিলরা গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। অসংখ্য দলিল ও আইনের ধারা পেশ করেন। কিন্তু ফায়সালা তো পূর্বনির্ধারিত। ৯ মে ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনের ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন মোম্বাই গিয়ে ওকিল (পরবর্তীতে কায়িদে আজম) মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাত করেন। গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ তার প্রস্তাবে সম্মত হন। লাহোর হাইকোর্টে আপিল করেন। যথাসময়ে শুনানি হয়। মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ আদালতে বলেন, “ইওর অনার! ইসলামের নবি রাসুলুল্লাহ সা. এর শানে গোস্তাখি করা এবং জনসাধারণের মধ্যে দ্রোহের আগুন উসকে দেয়া ১৩৫ ধারার আলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এতোদসত্ত্বেও প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আইনের নিস্তব্ধতাই গাজি ইলমুদ্দিনকে আইন নিজ হাতে তুলে নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।

এজন্য গাজি ইলমুদ্দিনের অপরাধকে ৩০২ ধারায় মার্ডার গণ্য না করে ৩০৮ ধারায় এজিটেশন কিলিং গণ্য করা উচিত, যার শাস্তি বেশি থেকে বেশি সাত বছর কারাদণ্ড হতে পারে। তাছাড়া গাজি ইলমুদ্দিনের যে বয়স, তাতে সে মৃত্যুদণ্ডের আইনের আওতাভুক্তও নয়।”  লাহোর হাইকোর্টের কট্টর হিন্দু জাস্টিস শাদিলাল কোনো কথায় কর্ণপাত না করে আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ফাঁসির জন্য গাজি ইলমুদ্দিনকে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩১ অক্টোবর ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাত্র একুশ বছর বয়সী অতি সাধারণ মুসলিম কাঠমিস্ত্রি গাজি ইলমুদ্দিন রাসুলের মহব্বতে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করে সবুজ পাখির ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে জান্নাতে বিচরণ করার সৌভাগ্য লাভ করে।ফাঁসি কার্যকর করার পর সেখানেই জানাযা ছাড়া গাজি ইলমুদ্দিনকে দাফন করা হয়।  এদিকে তার শাহাদাতের খবর দাবানলের মতো সারা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। শহিদের লাশ তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরে দাফন করার দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমানরা আল্লামা ইকবালের নেতৃত্বে বরকত আলী মোহামেডান হলে সমাবেশ ঘোষণা করে। ১ নভেম্বর আল্লামা ইকবালের বাসভবনে জলসা সংঘটিত হয়। ২ নভেম্বর আল্লামা ইকবালের দাবিতে প্রোফেশনাল মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ফিরিঙ্গি সরকারের থেকে শহিদের লাশ আদায়ের ব্যাপারে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়।

৫ নভেম্বর আল্লামা ইকবাল, স্যার মুহাম্মাদ শফি, মিয়াঁ আব্দুল আজিজ, মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গভর্নরের সাথে সাক্ষাত করে সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে শহিদের লাশ সমর্পণের জন্য আবেদন করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার শাহাদাতের ১৪ দিন পর মুসলমানদের কাছে শহিদের লাশ অর্পণ করে। শহিদের লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ট্রেনে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুসারে গাজি ইলমুদ্দিনের জানাযায় ছয় লক্ষ মুসলমান অংশগ্রহণ করে। লাহোরের ভাটিচক থেকে শুরু করে সুমনাবাদ পর্যন্ত পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জানাযা শেষে আল্লামা ইকবাল এবং সায়্যিদ দিদার আলী শাহ নিজ হাতে শহিদের লাশ কবরে রাখেন। যখন তার লাশ কবরে রাখা হচ্ছিলো, তখন মাওলানা যফর আলী খান চিৎকার করে বলে ওঠেন, “হায়! আজ এই মর্যাদা যদি আমার নসিবে জোটতো!” ঠিক সেই মুহূর্তেই আল্লামা ইকবালের যবান থেকে উচ্চারিত হয়—

اسی گلاں ای کر دے رہ گئے تے تر خاناں دامنڈابازی لے گیا

আমরা পরিকল্পনাই বানাতে থাকি আর এক কাঠমিস্ত্রির ছেলে এসে মর্যাদা লুফে নিয়ে যায়। 

১৪ নভেম্বর ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ রহ. এর পবিত্র লাশকে তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরের ভাওয়ালপুর রোডের নিকটস্থ মিয়ানি সাহেব কবরস্থানে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ এই নবিপ্রেমিক খুদে শহিদের সমাধির ওপর অজস্র রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।


লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করুন
 

Ad Code

Responsive Advertisement