সাক্ষাতকারে বিন লাদেন সৌদি আরবের অর্থনৈকিত সঙ্কট এবং সে কারণে জনগণের দুর্ভোগের জন্য রাজতন্ত্রকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, “সৌদি ব্যবসায়ীরা দেখতে পেল কিভাবে তাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করা হচ্ছে। কিভাবে তাদের কাছে সরকারী ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ীদের কাছে সরকারের ঋণের পরিমাণ আজ ৩৪ হাজার কোটি সৌদি রিয়াল। যা হচ্ছে এক বিশাল অঙ্ক। এটা হলো সৌদি আরবের অভ্যন্তরে জাতীয় আয়ের শতকরা ৯০ ভাগ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণকে বিদ্যুত, পানি ও জ্বালানির জন্য অধিক মূল্য দিতে হচ্ছে। সৌদি কৃষকগণ ঋণভারে ক্লান্ত। শিক্ষার দ্রুত অবনতি ঘটে চলেছে। লোকে এখন সরকারী স্কুল থেকে সন্তানদের সরিয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারী শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছে।
” বিন লাদেন বলেন, “সৌদিরা এসব সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে। তাদের মনে আছে, বিশিষ্ট আলেম শেখ উদাহ তাদেরকে কি বলেছিলেন। তারা এখন বুঝতে পারছে যে, আমেরিকাই হলো তাদের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ। সাধারণ মানুষটিও জানে, তাদের দেশ হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ। তথাপি হাজারো করের বোঝা ও অন্যান্য কারণে তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। লোকে আজ বুঝতে পারছ যে, সৌদি আরব আমেরিকার উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তারা আজ আমেরিকাকে সৌদি আরব থেকে লাথি মেরে তাড়াতে চায়। রিয়াদ ও খোবারে যা ঘটেছে তা হচ্ছে আমেরিকার বিরুদ্ধে সৌদি জনগণের প্রচন্ড ক্রোধের সুস্পষ্ট অভিপ্রকাশ। সৌদিরা এখন জানে, তাদের প্রধান শত্রু আমেরিকা। যে দেশে এক শ’ বছরের মধ্যে কেউ কখনও বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনেনি, সেখানে খোবারে ২৫০০ কিলো টিএনটির বিস্ফোরণ হলো আমেরিকার দখলদারির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের প্রমাণ।”
এটাই শেষ কথা নয়। বিন লাদেন বলেন, সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতিই যে শুধু তার আমেরিকা বিরোধিতার কারণ, তা নয়। আরও কারণ আছে। তা হলো আমেরিকা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে আঘাত হানছে। বিশ্ব মুসলিমদের সঙ্গে তার সহমর্মিতাই তাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। তিনি বলেন, “ খোবারের বিস্ফোরণ শুধু মার্কিন দখলদারির বিরোধিতা হিসাবে নয়, উপরন্তু বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের প্রতি আমেরিকার বৈরী আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবেও ঘটেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে (১৯৯৬সাল) আত্মোৎসর্গী বোমা বিস্ফোরণে যখন ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ৬০ ইহুদী নিহত হলো। বিশ্বজুড়ে তখন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করা হলো। অথচ ইরাকের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবার পর যখন ৬ লাখ ইরাকী শিশুর মৃত্যু হলো তখন তেমন কোনই প্রতিক্রিয়া হলো না। এই ইরাকী শিশুদের হত্যার ঘটনাটা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড। আমরা মুসলমানরা ইরাকী শাসকগোষ্ঠীকে পছন্দ করি না ঠিকই, তথাপি আমরা মনে করি ইরাকী জনগণ আমাদের ভাই, ইরাকী শিশুরা আমাদের সন্তান।” বিন লাদেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি ইসলামপন্থীদের মধ্যে আসন্ন সংঘাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ নেই। ... এই সঙ্কটের শুধু একটাই সমাধান।
তা হলো, সৌদি আরব থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। ...এই লড়াই হবে এক বৃহত্তর পরিসরে লড়াইয়ের সূচনা। যা গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।”বিন লাদেনের বয়ান ছিল ১২ পৃষ্ঠার এক দলিল, যার শিরোনাম ছিল “ডিক্লেয়ারেশন অব ওয়ার” বা যুদ্ধের ঘোষণা। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, প্রাসঙ্গিক বিষয় ও প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বয়ানে আমেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আফগানিস্তানে ইসলামী শক্তির হাতে ইতোমধ্যে সোভিয়েতের মতো একটি পরাশক্তির পরাজয় ঘটেছে।
” বিন লাদেন বলেন, “সৌদিরা এসব সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে। তাদের মনে আছে, বিশিষ্ট আলেম শেখ উদাহ তাদেরকে কি বলেছিলেন। তারা এখন বুঝতে পারছে যে, আমেরিকাই হলো তাদের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ। সাধারণ মানুষটিও জানে, তাদের দেশ হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ। তথাপি হাজারো করের বোঝা ও অন্যান্য কারণে তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। লোকে আজ বুঝতে পারছ যে, সৌদি আরব আমেরিকার উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তারা আজ আমেরিকাকে সৌদি আরব থেকে লাথি মেরে তাড়াতে চায়। রিয়াদ ও খোবারে যা ঘটেছে তা হচ্ছে আমেরিকার বিরুদ্ধে সৌদি জনগণের প্রচন্ড ক্রোধের সুস্পষ্ট অভিপ্রকাশ। সৌদিরা এখন জানে, তাদের প্রধান শত্রু আমেরিকা। যে দেশে এক শ’ বছরের মধ্যে কেউ কখনও বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনেনি, সেখানে খোবারে ২৫০০ কিলো টিএনটির বিস্ফোরণ হলো আমেরিকার দখলদারির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের প্রমাণ।”
এটাই শেষ কথা নয়। বিন লাদেন বলেন, সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতিই যে শুধু তার আমেরিকা বিরোধিতার কারণ, তা নয়। আরও কারণ আছে। তা হলো আমেরিকা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে আঘাত হানছে। বিশ্ব মুসলিমদের সঙ্গে তার সহমর্মিতাই তাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। তিনি বলেন, “ খোবারের বিস্ফোরণ শুধু মার্কিন দখলদারির বিরোধিতা হিসাবে নয়, উপরন্তু বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের প্রতি আমেরিকার বৈরী আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবেও ঘটেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে (১৯৯৬সাল) আত্মোৎসর্গী বোমা বিস্ফোরণে যখন ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ৬০ ইহুদী নিহত হলো। বিশ্বজুড়ে তখন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করা হলো। অথচ ইরাকের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবার পর যখন ৬ লাখ ইরাকী শিশুর মৃত্যু হলো তখন তেমন কোনই প্রতিক্রিয়া হলো না। এই ইরাকী শিশুদের হত্যার ঘটনাটা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড। আমরা মুসলমানরা ইরাকী শাসকগোষ্ঠীকে পছন্দ করি না ঠিকই, তথাপি আমরা মনে করি ইরাকী জনগণ আমাদের ভাই, ইরাকী শিশুরা আমাদের সন্তান।” বিন লাদেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি ইসলামপন্থীদের মধ্যে আসন্ন সংঘাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ নেই। ... এই সঙ্কটের শুধু একটাই সমাধান।
তা হলো, সৌদি আরব থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। ...এই লড়াই হবে এক বৃহত্তর পরিসরে লড়াইয়ের সূচনা। যা গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।”বিন লাদেনের বয়ান ছিল ১২ পৃষ্ঠার এক দলিল, যার শিরোনাম ছিল “ডিক্লেয়ারেশন অব ওয়ার” বা যুদ্ধের ঘোষণা। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, প্রাসঙ্গিক বিষয় ও প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বয়ানে আমেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আফগানিস্তানে ইসলামী শক্তির হাতে ইতোমধ্যে সোভিয়েতের মতো একটি পরাশক্তির পরাজয় ঘটেছে।
আবু নিদালের সাথে যোগাযোগ
ক্ষমতায় আসার পর তালেবানরা ওসামা বিন লাদেনের প্রতি সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। জালালাবাদে বিন লাদেনকে তারা তার ঘাঁটিগুলো রাখার অনুমতিই শুধু দেয়নি, সেগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থাও করেছিল।বিন লাদেন নিজেও তালেবান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আফগানিস্তানে তখন চার শ’রও বেশি আরব যোদ্ধা ছিল। এদের অনেকে সোভিয়েতবিরোধি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আবার অনেকে বিভিন্ন জিহাদী প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। তালেবানরা চাইছিল এই আরবরা যেন আফগানিস্তান থেকে গিয়ে তালেবানদের সামরিক কার্যক্রমগুলোতে অংশ নেয়।
১৯৯৬ সালের অক্টোবর থেকে তালেবানরা তাদের বিশেষ বাহিনীতে আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ আরবদের সামরিক বিশেষজ্ঞ হিসাবে রিক্রুট করতে থাকে। এ বিষয়টা তারা পাকিস্তানের আইএসআইকে জানাতে ভুলেনি। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি আইএসআই তালেবানদের পাকিস্তানের জামাতে ইসলামীর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিজবুল মুজাহিদীন পরিচালিত প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো বন্ধ করে দিতে বলে। কিছুদিন পর তারাই আবার এসব শিবির হরকত-উল-আনসারের হাতে তুলে দেয়ার অনুরোধ জানায়। বাহ্যত এর উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীর জিহাদে সাহয্য করা। নভেম্বরের শেষদিকে আইএসআই নিজেও খোস্ত এলাকায় তাদের প্রশিক্ষণ অবকাঠামো হরকত-উল-আনসারের কাছে হস্তান্তর করে। জিহাদী সংগঠন হরকত-উল-আনসার ছিল আইএসআই-এর কাঠোর নিয়ন্ত্রণে। কাশ্মীর ছাড়াও হরকতের সদস্যরা আজও বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে বার্মা, তাজিকিস্তান, বসনিয়া, চেচনিয়া এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত তৎপর আছে। হরকতের সদস্যদের মধ্যে পাকিস্তানী, কাশ্মীরী, আফগান, আরব প্রভৃতি জাতির লোকজন আছে।
তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পরও আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আইএসআই-এর প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বিনা বাধায় চালু ছিল। এ সময় পরবর্তী দফা জিহাদী অভিযানের ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামো সংহত করে তোলার ক্ষেত্রে ওসামা বিন লাদেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে খার্তুমে জিহাদী শীর্ষ বৈঠক থেকে আফগানিস্তানে ফিরে আসার পথে তিনি তেহরানে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে সাবরি আল-বানা (আবু নিদাল) সহ বেশ কয়েকজন জিহাদী নেতার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়। তারা মধ্য প্রাচ্যের গোটা তল্লাট জুড়ে জিহাদী অভিযানের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করেন। বিন লাদেন ও আবু নিদাল গোটা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে গুপ্তহত্যা, সারোটাজ, বোমাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের জিহাদী হামলায় নিদালের লোকবল ও অস্ত্রসম্পদ ব্যবহারের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখেন। আবু নিদালের তখন পৃষ্ঠপোষক ছিল ইরান। তা সত্ত্বেও আবু নিদাল এসব অভিযান চালানোর জন্য লাদেনের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তেহরানে অবস্থানকালে আরও একটা কাজ করেছিলেন বিন লাদেন।। তা হলো মিসরের বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার করা।
তেহরানের প্রাধান্যপুষ্ট হিজবুল্লাহ ইন্টরন্যাশনালে বিন লাদেন তখনও বেশ উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই অবস্থান থেকে তিনি আফগানিস্তানে তাঁর জিহাদী অবকাঠামো বিস্তারের জন্য ইরানের ব্যাপক সাহায্য চেয়ে বসেন। কিন্তু তখন কাবুল ও তেহরানের সম্পর্কে ভাঙ্গন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছিল বলে এই সাহায্যের বিষয়টা বেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় ইরান লাদেনকে আফগানিস্তানে তাঁর নিরাপদ আশ্রয় কোনভাবে নষ্ট না করার পরামর্শ দেয় এবং তাঁকে আশ্বাস দেয় যে, ইরানের সাহায্য তিনি পাবেন ঠিকই। তবে সেটা সরাসরি নয়, পাকিস্তানের হাত দিয়ে। ইসলামী আন্দোলনের আঞ্চলিক কার্যক্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা ও মতবিনিময়ের জন্য হিজবুল্লাহ ইন্টরন্যাশনালের অন্যতম নেতা হিসাবে বিন লাদেনকে প্রায়ই তেহরানে যেতে হতো। এই সফর ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি তেহরানে এক বৈঠকে যোগদান করেন। যেখানে ইরানী গোয়েন্দা সংস্থা “ভিভাগ” এর শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং আহমদ শাহ মাসুদের সহকর্মীদের নেতৃত্বাধীন একটি আফগান প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিল।
ব্যাপারটা লাদেনের জন্য বেশ নাজুক ও বিব্রতকর হওয়ারই কথা। কারণ তখনও তিনি তালেবানদের আতিথ্য ও নিরাপত্তা ভোগ করছিলেন। অন্যদিকে আহমদ শাহ মাসুদ তখনও ছিলেন তালেবানদের অন্যতম বড় শত্রু । যিনি আফগানিস্তানের বন্ধুর উত্তর পূর্বাঞ্চল দখল করে রেখেছিলেন। কিন্তু বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে আফগানিস্তান সংক্রান্ত কোন বিষয় ছিল না বলেই সম্ভবত লাদেন তালেবানদের বিরাগভাজন হননি। তাঁরা তাঁকে যথারীতি আগের মতোই সমাদর করেছিল। তোহরান বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর আরবদের মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ইসলামপন্থীদের নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং নতুন গোয়েন্দা ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। বর্তমান ইসলামী জিহাদী সংগঠনগুলোর ওপর পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান দৃষ্টি পড়ায় এটা দরকার হয়ে পড়েছিল।
ওসামা বিন লাদেন এই নয়া সংগঠনের প্রস্তুতিমূলক কাজকর্মের প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে আবির্ভূত হন। নয়া ব্যবস্থাটি হচ্ছে বহুস্তরবিশিষ্ট। এতে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল এই যে, বিপুলসংখ্যক সম্ভাব্য জিহাদীকে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে প্রাথমিক ও মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এদের মধ্য থেকে অধিক সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের এরপর উন্নততর প্রশিক্ষণের জন্য ইরানের মাশাদে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওসামা বিন লাদেন মাশাদে নতুন হেডকোয়ার্টারও স্থাপন করেন। যাতে করে আফাগনিস্তানের পরিস্থিতি তাঁর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠলে তিনি সেখানে চলে যেতে পারেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত কোম শহরে তিনি একটা বাড়িও কেনে ফেলেন নিজের জন্য।
বিন লাদেনের ঘাটি
আফগানিস্তানে বিন লাদেনের উদ্যোগে জিহাদের এক নতুন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এই ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বিন লাদেন ও তালেবানরা খোস্তা-এর কাছে খাস্তেতে বদর-১ ও বদর-২ শিবির চালাতে থাকে। খাস্ত এলাকাটি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে অবস্থিত। আইএসআইও আগের মতোই এসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। বদর-১ এবং বদর-২ এই দুটো শিবিরে আলোচ্য সময় প্রায় ৬শ’ বিদেশী স্বেচ্ছাসেবক ছিল। এদের অনেকেই আরব। বাকিরা প্রধানত পাকিস্তানী, ভারতীয় কাশ্মীরী, ফিলিপিনো এবং ক্রমবর্ধমান হারে মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের লোক। এখানে আরেকটি কথাও বলে রাখা ভাল, তা হচ্ছে বদর শিবির দুটোই একটা নতুন সড়ক ব্যবহার করে থাকে।
সর্ব আবহাওয়ার উপযোগী এই সড়কটি ১৯৯৬ সালে নির্মিত হয়েছে। এই সড়কের মাধ্যমে খাস্তে এলাকাটি পাকিস্তানের মিরান শহরের সঙ্গে যুক্ত। ওদিকে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিন লাদেন ও তালেবানরা শিনদান্দ, ওয়াহবান ও ফারাহ জেলায় তিনিটি গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশিক্ষণ শিবিরও পরিচালনা করে। সে সময় শিবিগুলোতে এক হাজারের মতো আরব স্বেচ্ছাসেবক ট্রেনিং নিচ্ছিল। ইসলামী জিহাদীদের নাশকাতামূলক কার্যকলাপের ক্রমবর্ধমান হুমকি সম্পর্কে ১৯৯৭ সালের প্রথমদিকে মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয় যে, “ওসামা বিন লাদেন আফগান তালেবান আন্দোলনের ছত্রছায়ায় আসলে গোপনে গোপনে আরব জিহাদীদের এক নতুন গ্রুপ গড়ে তুলছেন। যার লক্ষ্য হচ্ছে বেশকিছু আরব ও ইসলামী রাষ্ট্রে জিহাদী সংগঠন সৃষ্টি করা। এই তৎপরতার মূল ধারাটি আফগানিস্তান ইরান ও সুদানের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হলেও এর প্রাণকেন্দ্র রয়েছে আফগানিস্তানের খোরাসান প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলে- যেখানে অসংখ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।” রিপোর্টে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় যে, এই উদ্যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বেশকিছু আরব ও ইসলামী দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করা। গেরিলা প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনা করা ছাড়াও বিন লাদেন খোরাসানের পার্বত্য এলাকায় কায়েকটা সুরক্ষিত ঘাঁটি ও সদর দফতরও স্থাপন করেছিলেন।
এসব ঘাঁটি ও সদর দফতর ছিল গভীর গিরিগুহার ভিতরে লুকানো। সম্প্রতি ঐ ঘাঁটিগুলো দেখে এসেছেন “আল কুদস-আল আরাবী” পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল বারী আতওয়ান। তিনি জানান, “ঈগলের বাসা” বলে আখ্যায়িত আরব যোদ্ধাদের এই ঘাঁটিগুলো তুষারাচ্ছাদিত পর্বতের ৮২০০ ফুট উঁচুতে গিরিগুহায় অবস্থিত। অসংখ্য সশস্ত্র প্রহরী সেই ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত। ঘাঁটি অভিমুখী সড়কগুলো বিমান বিধ্বংসী কামান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান দ্বারা সুরক্ষিত। সর্বত্রই রয়েছে চেক পয়েন্ট। রক্ষীদের সঙ্গে রকেট লাঞ্চারও আছে। এমনকি যে কোন বিমান হামলা মোকাবিলার জন্য ষ্ট্রিংগার ক্ষেপাণাস্ত্রও আছে।
সভ্যজগত বা লোকালয় থেকে বিন লাদেনের ঘাঁটি একেবারে বিচ্ছিন্ন হলেও বিশ্বের বাকি অংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষার উত্তম ও আত্যাধুনিক ব্যবস্থাও আছে সেখানে। ঘাঁটিতে ছোটখাটো জেনারেটর আছে, কম্পিউটার আছে। আধুনিক গ্রাহক সরঞ্জাম আছে। তা ছাড়া হাজার রকমের তথ্য সংরক্ষণের প্রচলিত ও অত্যাধুনিক উভয় রকম ব্যবস্থাও আছে। সমস্ত আরব ও বিদেশী পত্রপত্রিকার প্রেস কাটিং সযত্নে সংরক্ষিত রাখা হয়ে থাকে সেখানে। বিন লাদেন লন্ডন ও উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে দৈনিক প্রেস রিপোর্ট পান। অর্থাৎ দুনিয়ার ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রতিদিনই তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। আতওয়ান বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও কমান্ডারদের বুদ্ধিবৃত্তিগত গুণাবলী দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এই মানুষটির চারপাশে যেসব মুজাহিদ আছেন তাঁদের বেশির ভাগই আরব। এরা বিভিন্ন বয়সী হলেও অধিকাংশই তরুণ।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় ডিগ্রীর অধিকারী তাঁরা। আবার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকও আছেন। তাঁরা পরিবার পরিজন চাকরিবাকরি ছেড়ে এসে আফগান জিহাদে যোগ দিয়েছিলেন। এখন কাজ করছেন লাদেনের সঙ্গে। এমন স্বেচ্ছাসেবকের অভাব নেই যারা সর্বদাই শাহাদাতবরণের জন্য প্রস্তুত। বিন লাদেনের প্রতি মুজাহিদদের শ্রদ্ধার কোন সীমা পরিসীমা নেই। বিন লাদেনকে রক্ষার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে জীবন দিতে প্রস্তুতই শুধু নয়, যে কোন মহল থেকে তাঁর সমান্যতম ক্ষতি করা হলে তার উপযুক্ত বদলা না নিয়ে তাঁরা ছাড়বে না- এমন প্রবল তাঁদের ভালবাসা এই মানুষটির প্রতি। আফগানিস্তান থেকে বিন লাদেনকে বের করে দেয়ার জন্য সৌদি আরব ও মিসরের মতো প্রধান আরব দেশগুলোর দিক থেকে প্রবল চাপ আসা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত তালেবান ও পাকিস্তানীরা তাঁর নিরাপত্তার সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে রেখেছে।
১৯৯৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে কাবুল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিন লাদেনকে সমর্থন ও নিরাপত্তা দানের কথা ঘোষণা করে। ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করে তালেবান তথ্যমন্ত্রী আমীর খান মুত্তাকি বলেন “ওসামা বিন লাদেন আমাদের সম্মানিত মেহমান এবং মেহমানকে রক্ষা করা মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব”। মুত্তাকি তখন স্বীকার করেছিলেন যে, বিন লাদেন নানগরহর প্রদেশের জালালাবাদের কাছে “তোরা বুড়া” সামরিক ঘাঁটিতে বসবাস করছেন। বিন লাদেনের সঙ্গে আছেন তাঁর ৫০ সহকর্মী। এদের ৪০ জনই পরিবার পরিজন নিয়ে আছেন। এছাড়া তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর নিজের পরিবার এবং অসংখ্য দেহরক্ষী। তোরা বুড়ায় বিন লাদেন পাথরের তৈরি একটি ভবনের মধ্যে তার অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করেছেন। ঘাঁটির চারদিকে আছে সন্ধানী পোস্ট, কয়েকটি ট্যাংক এবং স্থল ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তোরা বুড়া ঘাঁটিটি পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ রক্ষার কাজে এবং পাকিস্তান হয়ে আরব ও অন্যান্য দেশের মুসলমানদের আফগানিস্তানে আসা যাওয়ার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
আলবেনিয়ায় গেরিলা শিবির স্থাপন
ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আমেরিকান ও ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য সৌদি আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জিহাদের এই বানীতে তিনি আমেরিকানদের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়ে বলেন, অন্য যে কোন বিষয়ে শক্তি অপচয় করার চেয়ে একজন আমেরিকান সৈন্য হত্যা করতে পারা ঢের ভাল।বিশ্বময় জিহাদ ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান সম্বলিত তাঁর অসংখ্য বাণীর মাধ্যে এটা ছিল প্রথম বাণী। ১৯৯৭ সালের মার্চের প্রথমদিকে তিনি আরেকটা বানী দেন। এবার আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তাঁর হুমকিটা ছিল আরও জোরালো ও শাণিত। তাতে তিনি বলেন, পবিত্র ভূমি সৌদি আরব দখল করে রাখার কারণে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদার হতে থাকবে। আফগানিস্তানে থেকে বিন লাদেন যেমন নিজের অবস্থান সংহত ও মার্কিনবিরোধী প্রচারযুদ্ধ তীব্রতর করে তুলছিলেন, অন্যদিকে তখন পারস্য উপসাগরীয় এলাকা ও বলকান অঞ্চলে ইসলামী র্যাডিকেলরা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলছিল।
১৯৯৭ সালের প্রথমদিকে বিন লাদেন আলবেনিয়ায় গেরিলা প্রশিক্ষণ শিবির ও সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এই শিবিরগুলো র্যাডিকেল ইসলামপন্থীদের নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। সারায়েভো কর্তৃপক্ষ কোন কারণে তাদের ইসলামী মিত্রদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সে ক্ষেত্রে এই শিবিরগুলোর বদৌলতে তাদের তৎপরতা চালাতে কোনরকম অসুবিধায় পড়তে হতো না। তাছাড়া এসব শিবিরের সমর্থনে কসোভোয় ইসলামী গেরিলাদের তৎপরতা বিস্তার করাও সহজ হয়। পাকিস্তান ও সুদান থেকে আলবেনিয়ার শিবিরগুলোতে ১শ’রও বেশি বিশেষজ্ঞ মুজাহিদ পাঠানো হয়েছিল। এরা প্রধানত ছিল আরব। বাদবাকি জিহাদীরা নানা ধরনের ইসলামী দাতব্য ও ধর্মীয় সংগঠনের ছত্রছায়ায় আগে থেকেই বসনিয়া-হারজেগোভিনায় তৎপর ছিল। বলাবাহুল্য, এ সময়ের দিকে বসনিয়া ও আলবেনিয়ায় ইসলামী মানবিক ও সাহায্য সংগঠনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
১৯৯৭ সালের জুন মাসের শেষদিকে সুদানের ধর্মীয় নেতা হাসান আল তুরাবি পাশ্চাত্যের ওপর নতুন করে আঘাত হানার মধ্য দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া ইসলামী আন্দোলনে নতুন প্রাণসঞ্চারের লক্ষ্যে খার্তুমে সুন্নী জিহাদী নেতাদের এক গোপন বৈঠক ডাকেন। এতে ওসামা বিন লাদেন নিজে অংশ না নিলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন আইমান আল জাওয়াহিরি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জিহাদের নামে আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসলামী জিহাদী তৎপরতা প্রসারিত ও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়। আগষ্ট মাসের মধ্যেই সুদানের ইসলামী শিবিরগুলোতে জোর প্রস্তুতির ভাব চোখে পড়ে। এ সময় ওসামা বিন লাদেন পর্যবেক্ষণ সফরে সুদানে আসেন। জিহাদী অভিযান পরিকল্পনাগুলো পর্যালোচনা করে তিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নিয়োজিত তাঁর শক্তি ও সম্পদের এক বড় অংশ আসন্ন জিহাদী অভিযানে নিয়োগ করায় অঙ্গীকার করেন। এ সময় সুদানের আল-দামাজিনে বিন লাদেনের খামারে বিশেষজ্ঞ জিহাদীদের জন্য বিশেষ শিবির স্থাপন করা হয়।
সৌদি আরব-তালেবান-লাদেন
আফগানিস্তানে তালেবান শক্তির উত্থান ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পিছনে সাহায্য-সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের পরই সৌদি আরবের স্থান। বিশেষ করে এক্ষেত্রে সৌদি তহবিলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তালেবানী মার্কা ইসলামী বিপ্লবের সাথে সৌদি আরবের আল-সৌদ রাাজরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিগত কোন পার্থক্য নেই।(!) সৌদি আরবের সাথে তালেবানদের অত্মিক নৈকট্য অতি প্রবল। কারণ তালেবানদের হার্ডকোর অংশটা হচ্ছে পাকিস্তানের মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত আফগান শরণার্থী। এসব মাদ্রাসার ইমাম ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতা সৌদি আরবের ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও ডিগ্রী লাভ করেছেন। এঁরা আসার সময় কঠিন ও রক্ষণশীল ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্র সঙ্গে করে এনছিলেন এবং সেগুলোর শিক্ষা আফগান ও পাকিস্তানী ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন। আরেকটি ব্যাপারও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে সৌদি রাজপরিবার ও তালেবানী নেতৃত্ব উভয়েই ওয়াহাবী ভাবধারার অনুসারী।
তালেবানদের পিছনে সৌদি শাসকশ্রেণীর ঢালাওভাবে আর্থিক সাহায্য দেয়ার পিছনে আরও একটা কারণ কাজ করেছে বলে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা। সেটা হলো সৌদি ইসলামী র্যাডিকেলপন্থী যুবসমাজকে সৌদি আরব থেকে বহু দূরে আফগানিস্তানের মাটিতে ব্যস্ত রাখা, যাতে তারা সৌদি রাজশক্তির জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি না করে। এ জন্যই সৌদি প্রশাসনের একটা মহল এই শ্রেণীর সৌদি যুবকদের তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে নানাভাবে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। আর্থিক সাহায্য হলো সেই কৌশলগুলোরই একটি। কিন্তু আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় আরোহণের পর সৌদি আরবে র্যাডিকেল ইসলামী শক্তিগুলো নতুন করে উজ্জীবিত হয় এবং আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিভিন্ন লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে। মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি এমন বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিদ্রোহের ভাবধারাটা বিশেষভাবে দেখা দেয় সৌদি “আফগানদের” মধ্যে। অর্থাৎ আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সৌদিদের মধ্যে। সৌদি শাসক শ্রেণী আরও লক্ষ্য করে যে, সৌদি আরবে বিদ্রোহের মনোভাব সৃষ্টিতে বিন লাদেনরেও বিরাট ভূমিকা আছে।
তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রিয়াদ ১৯৯৮ সালের জুনের প্রথমদিকে এক বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়। সৌদি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল এবং সৌদি হজ্জ ও ওয়াকফ্ মন্ত্রী মাহমুদ সাকারের নেতৃত্বে গোয়েন্দা ও ধর্মবিষয়ক কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল কান্দাহারে পৌঁছায়। সৌদিরা তালেবানদের সামনে নানা ধরনের টোপ ফেলে। তার মধ্যে একটি হলো তালেবানরা বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেবে। বিনিময়ে তারা অঢেল সৌদি সাহায্য ছাড়াও মার্কিন স্বীকৃতি পাবে। লাদেনের ব্যাপারে তালেবানরা কোন প্রস্তাবেই রাজি হয়নি। শেষে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয় যে আরব “আফগানরা” সৌদি আরব বা উপসাগরের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি কোন হুমকির কারণ হবে না। আগে থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে কিছুদিন পরই সৌদি আরবের একটি শীর্ষস্থানীয় পরিবারের দু’জন প্রতিনিধি বিন লাদেনের ঘাঁটিতে গিয়ে তাঁকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চাঁদা হিসাবে দিয়ে আসেন। চাঁদাটা এই সমঝোতা হিসাবে দেয়া যে, সৌদি আরবে তিনি কোন তৎপরতা চালাবেন না। শোনা যায় আল-সৌদ রাজপবিারের কিছু কিছু সদস্যের দেয়া অর্থও ছিল এই চাঁদার অংশ। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই সঙ্কট দেখা দেয়। কাবুলে সৌদি চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স ছিলেন সালমান আল উমারি। তাঁর কার্যালয় ছিল পাকিস্তানে। সেখান থেকে কান্দাহারে গিয়ে তিনি এক সিনিয়র তালেবান নেতার সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে বসেন।
উমারি দাবি করেন যে, তালেবানদের বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে হবে। সেই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, সৌদি আরব বিন লাদেনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তালেবান নেতা তখন জিজ্ঞাসা করেন যে একজন মূসলমানকে একটা অমুসলিম রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার প্রস্তাব তিনি একজন মুসলমান হিসাবে কিভাবে দিতে পারলেন? ব্যস, শুরু হলো তীব্র কথাকাটাকাটি। তালেবান নেতা বললেন, “আপনি কি সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের? যদি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে থাকেন তাহলে আমি নিজেকে বিন লাদেনের দূত হিসাবে পরিচয় দিতে সম্মানিত বোধ করব।” তালেবান কর্তৃপক্ষ রিয়াদের নীতির দৃশ্যত আমূল পরিবর্তনের কথা ইসলামাবাদকে জানিয়ে দিল। শঙ্কিত রিয়াদ ইসলামাবাদকে আশ্বস্ত করল যে, সৌদি নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে ইসলামাবাদের মধ্যস্থতায় কান্দাহারে এক বৈঠকে সৌদি আরব ও তালেবানদের মধ্যে এক সুদূরপ্রসারী সমঝোতা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধান প্রিন্স তুর্কি, তালেবান নেতৃবৃন্দ, আইএসআই কর্মকর্তা ও বিন লাদেনের প্রতিনিধিরা।
সমঝোতা হলো এই যে, বিন লাদেন ও তাঁর অনুসারীরা সৌদি আরবে নাশকতা চালানোর কাজে আফগানিস্তানের অবকাঠামো ব্যবহার করবে না। অন্যদিকে সৌদিরাও আর বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেয়ার কিংবা আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার অথবা জিহাদী শিবির ও স্থাপনা বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানাবে না। বৈঠকে প্রিন্স তুর্কি আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয়কে তেলসহ উদার আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। সমঝোতার কিছুদিন পর পাকিস্তান ও তালেবানের জন্য অস্ত্র ক্রয়ের পেমেন্ট বাবদ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইউক্রেনে পাঠানো হয়। এই অস্ত্র ১৯৯৮ সালের আগষ্টের প্রথমদিকে তালেবানদের আক্রমণাভিযান এবং গোটা আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দারুণ সহায়ক হয়েছিল। ইতিমধ্যে ৭ আগস্ট নাইরোবি ও দারেস সালামের মার্কিন দূতাবাসে ঘটে গেল বোমা হামলা।
আমেরিকার ক্রুজ হামলা
১৯৯৮ সালের ২০ আগস্ট মার্কিন নৌবাহিনী আফগানিস্তানের খোস্ত এলাকার জিহাদী প্রশিক্ষণ শিবির ও স্থাপনাগুলোর ওপর ৭৫ থেকে ৮০ টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানে। নাইরোবি ও দারুস সালামে মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার জবাবে এই আক্রমণ চালানো হয়। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায় যে, ১৩টি ক্ষেপণাস্ত্র মারকায খালিদ বিন ওয়ালিদ নামক এলাকায়, ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র মারকায আমীর মুয়াবিয়া এলাকায় এবং ৫টি ক্ষেপণাস্ত্র জালালুদ্দীন হক্কানীর ঘাঁটিতে আঘাত হানে। অন্য ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আশপাশের গ্রামে গিয়ে পড়ে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েই শুধু নয়, ক্ষেপণাস্ত্রের উড়ন্ত ঠুকরাগুলোর ঘায়েও বিপুলসংখ্যক গ্রামবাসী নিহত হন। আক্রান্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে আইএসআই নিয়ন্ত্রিত হরকত-উল-আনসারের ঘাঁটিতে প্রায় ১২শ’ যোদ্ধা ছিল। যাদের প্রায় সবাই পাকিস্তানী, ভারতীয়, কাশ্মীরী ও আফগান। হক্কানীর ঘাঁটিতে মুজাহিদদের মধ্যে দু’শ’ ছিল আফগান এবং বেশকিছু আরব। বিন লাদেনের হিসাবে সবসুদ্ধ নিহত হয় ২৮ জন। তার মধ্যে ১৫ জন আফগান, ৭জন পাকিস্তানী, দু’জন মিসরীয়, তিনজন ইয়েমেনী ও একজন সৌদি। আহতের সংখ্যা ৩৫।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জিহাদী ঘাঁটিগুলোর দারুণ ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সত্যিই কতটা ক্ষতি হয়েছিল? খোস্ত এলাকার যিনি আদি অকৃত্রিম কমান্ডার সেই জালালুদ্দীন হাক্কানী তো ফুঁ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কথাটা। সোভিয়েত দখলদারির সময় লালফৌজ দু’দফা বড় ধরনের বিমান ও স্থল অভিযান চালিয়ে জাভারার শিবিরগুলো দখলও করতে পারেনি, ধ্বংসও করতে পারেনি। তখন অবিশ্রান্ত বিমান হামলা চলেছিল, গোলাবর্ষণ চলেছিল। ছোট খাটো কিছু ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয়নি হক্কানীর শিবিরগুলোর। পর্বতের গভীরে সুরক্ষিত স্থানগুলোতে নির্মিত ওগুলো। ৬০-৭০ টি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র সেগুলোর কি করতে পারবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন হক্কানী। হক্কানী জানান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সালমান ফারসী শিবির মোটামুটি অক্ষত ছিল। আল-বদর শিবিরগুলো, যেগুলোর আরেক নাম আবু জান্দাল বা আরব শিবির সেগুলোর নূন্যতম ক্ষতি হয়েছে, আর খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমীর মুয়াবিয়া শিবিরের খানিকটা ক্ষতি হয়েছে। এসব শিবিরের অস্ত্র ও গোলাবারুদের গুদামগুলো ছিল গভীর গিরিগুহায়। সেগুলোর কিছুই হয়নি। সম্পূর্ণ অটুট ছিল। তবে ক্ষতি অবশ্যই হয়েছিল। মুজাহিদ শিবির এলাকায় পাঁচটি মসজিদ তৈরি হয়েছিল।
মুজাহিদরা ছাড়াও এসব মসজিদে আশপাশের গ্রামবাসীরা এসে নামাজ আদায করত। শিবির এলাকা ও সংলগ্ন গ্রামের ৪টি মসজিদ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শহীদ হয়। প্রায় দু’শ’ কুরআনের পোড়া পাতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রবল আঘাত হনে। ইসলামী জিহাদীরা এর বদলা নেয়ার নতুন শপথ নেয়। তারা বলতে থাকে যে, মসজিদ শহীদ ও পবিত্র গ্রন্থের অবমাননা করে আমেরিকা নিজের মৃত্যু ডেকে আনছে। তবে মার্কিন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিন লাদেনকে যতটুকু না আঘাত হেনেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি বিব্রত করেছিল পাকিস্তান সরকারকে। কারণ এ ঘটনার পর প্রকাশ হয়ে পড়ে যে খোস্তের শিবিরগুলোতে পাকিস্তনের আন্তঃসার্ভিস গোয়েন্দা সংস্থার (আইএরআই) বেশ কিছু সদস্য ছিল। এবং তারা কাশ্মীরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য হরকত-উল-আনসারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।
---চলমান।
1 টি মন্তব্য:
উসামা বিন লাদেন কে ছিলেন...এখন মুসলিম বিশ্ব ঠিকই বুঝতে পারছে। উনার সাথে যদি মুসলিম বিশ্ব কাজ করতো তাহলে আমাদের মুসলমানদের উপর বর্বর নির্য়াতন দেখতে হত না। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ প্রর্দশন করুক এবং বিশ্ব মুসলিমকে হেফাযত করুক। আমিন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন