Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

আমি কেন জঙ্গি হলাম?


 জঙ্গিবাদের অভিযোগ থেকে কখন আপনি মুক্ত হবেন?

 
 তাগুতের হাতে গ্রেফতারের পূর্বে এক শহীদ আরব মুজাহিদের লেখা শেষ প্রবন্ধ অনুকরণে-
(মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারলে বোঝার আছে অনেক কিছু, চিন্তাশীল সকল ভাইকে সম্পূর্ণটা পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি)
এক
কেন আমি ওয়ান্টেড পার্সন?
চার দিক থেকে জবাব আসতে লাগলঃ সন্ত্রাস......... সন্ত্রাস ...... (জঙ্গিবাদ)। তুমি সন্ত্রাসী (জঙ্গি)। আর সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সন্ত্রাসকে দমন করা, জঙ্গিবাদের নির্মূল করা।
 ঠিক আছে .........।
সন্ত্রাসের এই অপরাধ থেকে আমি মুক্ত হতে চাই, যার ফলে আমি আজ মোস্ট ওয়ান্টেড, আমাকে বন্দি ও হত্যা করা সরকারের দায়িত্ব।  বলুন, কি সেই সন্ত্রাসটি?
 উত্তরঃ মানুষ হত্যা ...............।
 কিন্তু ..............., সৌদি সরকারও তো মানুষ হত্যা করে .........।
তারা শায়েখ ইউসুফ আল-ওয়াইরী, বীর মুজাহিদ দান্দানী সহ অন্যান্য আলেম ও মুজাহিদীনদেরকে হত্যা করেছে। তাহলে সৌদি সরকারও সন্ত্রাসী সুতরাং আমরা  যখন উভয়েই সন্ত্রাসী  আমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে কাঁধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সাথে সামনে বাড়া,তাহলে আমি তাদের কাছে ওয়ান্টেড হলাম কেন? নাকি সৌদি সরকার আমার থেকে ভিন্ন?
কেননা সৌদি সরকার যাদেরকে হত্যা করেছে তারা সন্ত্রাসী?   ভাল কথা ...।   আমিও তো সন্ত্রাসীদেরকেই হত্যা করেছি।আমেরিকানরা কি সন্ত্রাসী নয়?
 ইরাক, আফগানস্থান ফিলিস্তিন সহ অন্যান্য ভূখণ্ডে অ্যামেরিকা যে সন্ত্রাস করেছে,
 এর চেয়ে বড় কোন সন্ত্রাস হতে পারে?!! আমিও সন্ত্রাসীদেরকে হত্যা করলাম, সৌদি সরকারও সন্ত্রাসীদেরকে হত্যা করল!!
 তাহলে আমি কেন সন্ত্রাসী হব? অথচ আমরা উভয় একই কাজ করছি,
 সন্ত্রাসীদেরকে হত্যা করছি?!! বরং সৌদি সরকারই এমন অনেককে হত্যা করছে যারা সন্ত্রাসী নয় ......।
 তারা মার্কিন বাহিনীকে সহায়তার মাধ্যমে ইরাকের সধারন জনগণকে হত্যা করেনি?!!
 নাকি সৌদি সরকার আমাকে ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী হিসাবে কাল তালিকাভুক্ত করেছে এ কারণে,আমি ঐ সৈনিকদেরকে হত্যা করেছি যারা অ্যামেরিকান সন্ত্রাসীদেরকে পাহারা ও নিরাপত্তা দিত?!!     তাহলে সৌদি সরকার কি ঐ সমস্ত ব্যক্তিদেরকে হত্যা করেনি,
 যারা সন্ত্রসীদেরকে পাহারা দিত?!! যেমনটি করেছে তারা কাসীমের মধ্যে।
 অ্যামেরিকান সন্ত্রাসীদের পাহারাদার আর অন্যান্য সন্ত্রাসীদের পাহারাদারদের মাঝে,
 কি এমন পার্থক্য বিদ্যমান?!!!
 দুই
 মনে হয়, এখন আমি বুঝতে পেরেছি ............।
 সৌদি সরকার আমাকে ওয়ান্টেড ঘোষণা দিয়েছে কারণ আমি সন্ত্রাসীদের বন্ধু, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল,আর নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসীর বন্ধুও সন্ত্রাসী।
 কিন্তু সৌদি সরকার ঘোষণা দেয়নি কি, অ্যামেরিকা তাদের বন্ধু?!!
পৃথিবীর সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী কি অ্যামেরিকা নয়?!!
সৌদি ও অ্যামেরিকার মধ্যকার প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা গভীর সম্পর্কের ব্যাপারটা কি নিশ্চিত করেনি?!!
অনুগ্রহ করে আমাকে জবাব দাওঃ
 কেন আমি ওয়ান্টেড হলাম?!!!
 আমি যেমন সন্ত্রাসী সৌদি সরকারও কি একই রকম সন্ত্রাসী নয়?!!
 তাহলে সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে তাদের ভ্রাতাকে কীভাবে তারা তাড়া করে?
 আমি হত্যা করেছি অ্যামেরিকান সন্ত্রাসীদের পাহারাদারদেরকে,
সৌদি হুকুমত হত্যা করছে শরয়ী ইসলামী ‘সন্ত্রাসীদের” আশ্রয় দাতাদেরকে।
আমি যেমন সন্ত্রাসীদেরকে ভালবাসি তাদের প্রতি সহানভুতি প্রকাশ করি,
সৌদি সরকার মার্কিন সন্ত্রাসীদেরকে ভালবাসে, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। বরং তারা এই বন্ধুত্ব নিয়ে গর্ব প্রকাশ করে থাকে।
 তিন
 হতে পারে-আমি ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী,
 কারণ আমি মুসলিমদের দেশে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি।
 কিন্তু ..................।
 ইরাক মুসলিমদের দেশ,
 অ্যামেরিকা ইরাকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
 জঙ্গি বিমান থেকে মিসাইলের আঘাতে পুরো দেশকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে।
 অথচ সৌদি, অ্যামেরিকাকে ওয়ান্টেড হিসাবে আখ্যায়িত করে না।
 এমনকি শত্রু পর্যন্ত ভাবে না বরং তাদেরকে সাহায্য করে।
 সৌদি সরকারের কাছে কোন প্রমাণ আছে, যে আমি সন্ত্রাসীদেরকে কোন সাহায্য করেছি?
 যদি থাকে তাহলে ভাল কথা,
 একই ভাবে সৌদি সরাকারও অ্যামেরিকান সন্ত্রাসীদেরকে,
 সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে।
 আমি কি তাদের আশ্রয় দিয়েছি?
 সৌদি সরকার মার্কিন বাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছে।
 আমি কি তাদের অস্ত্রের হেফাজত করেছি?
 সৌদি সরকার সৌদিকে অ্যামেরিকার অস্ত্রগুদাম বানিয়েছে।
 তারা কি আমার কাছ থেকে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে?
 মার্কিন বিমানগুলো সৌদি থেকে ইরাকে যেয়ে তাদের সন্ত্রাস পরিচালনা করছে।
 আমি কি তাদেরকে মাল দিয়ে সাহায্য করছি?
 অথচ ইরাক-আফগানের যুদ্ধে সৌদি হচ্ছে,
 অ্যামেরিকান সন্ত্রাসীদেরকে সাহায্যকারী অন্যতম একটি রাষ্ট্র।
 ওহে সৌদি শাসকগুষ্ঠি! তোমরা লক্ষ্য কর, আমরা আর তোমরা উভয়েই সন্ত্রাসের অংশীদার!
 হ্যাঁ তবে যদি আমি তোমাদের থেকে আগে বেড়ে থাকি আলহামদুলিল্লাহ্! কেননা আমি মুসলিম।
চার
 হ্যাঁ এখন আমার বুঝে এসেছে......!
 আমি সন্ত্রাসী, কেননা আমি সৌদি শাসকদেরকে তাকফীর করেছি।
  কিন্তু ..................!
 উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তো সৌদি সরকারও সাদ্দামকে তাকফীর করেছিল?!!
 সৌদি সরকার সাদ্দামকে কেন তাকফীর করল?
 এই কারণে তাকফীর করেছে, সে আল্লাহ্ তায়ালার বিধান ছাড়া ভিন্ন বিধানে শাসন পরিচালনা করে? সৌদি সরকারও তো আল্লাহ্ তায়ালার বিধান ব্যতিরেকে ভিন্ন বিধানে শাসন পরিচালনা করে থাকে।
 আর আমি তো তাকফীরে এই ফাতওয়া পেয়েছি সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আলে-শাইয়েখ রহঃ এর ফাতওয়া থেকে, যার ফলে এই ফাতওয়া সৌদি সরকার বাজারে নিষিদ্ধ করেছে।  শায়েখ আবদুল্লাহ বিন হামীদ সহ অন্যান্য শায়েখদের থেকেও একই ফাতওয়া বিদ্যমান আছে।

আর আমি দেখছি বিলাদুল হারামাইনের অধিকাংশ বিষয়ে,
 মানব রচিত আইন দ্বারা ফায়সালা করা হয়।
 তাহলে কেন তারা সাদ্দামকে তাকফীর করল?
 উত্তরঃ এ কারণে, সে একজন বাথিস্ট?
 বাথিস্ট কি? এই শব্দে তো ঈমান ভঙ্গের কারণ সমূহের মধ্যে কোন কারণ বিদ্যমান নেই।
 তারা কি এ কারণেই কুফর মনে করে না যে, বাথিস্টদের কাছে সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বর মাপকাঠি হচ্ছে দ্বীনের পরিবর্তে জাতীয়তা। ?
 সৌদির কাছেও তো সম্পর্ক ও বন্ধুত্বয়ের মাপকাঠি,দ্বীনের পরিবর্তে দেশ ও আরব জাতীয়তার উপর।

বাথিস্টরা কি এ জন্য কাফের,
 কেননা তাদের কাছে একজন আজমি মুসলিমের চেয়ে আরবি কাফের শ্রেষ্ঠ?
 আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সৌদি শাসকদের কাছে একজন আরবি কাফের
 একজন বাংলাদেশী মুসলিমের চেয়ে উত্তম।

হ্যাঁ যদি আমি এ কারণেই সন্ত্রাসী হই যে,
 আমি সৌদি সরকারকে কাফের মনে করি।
 তাহলে সৌদি সরকারও এ জন্য সন্ত্রাসী যে,
 তারা সাদ্দাম হুসাইন কে কাফের মনে করে।

বরং সৌদি সরকার এ ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে------
 ১১ সেপ্টেম্বরের মোবারক আক্রমণ পরিচালনাকারী বীরদেরকে
 সুলতান বিন আব্দুল আযীয তাকফীর করেছে,
 সে বলেছে তারা নাকি ইসলামী মিল্লাত থেকে খারেয হয়ে গেছে।
 তাহলে যে ভাবে আমি ওয়ান্টেড একই ভাবে সুলতান বিন আব্দুল আযীযও যেন ওয়ান্টেড হয়।
 রিয়াদের মধ্যে মার্কিন ক্রসেডারদের উপর আক্রমণ পরিচালনাকারীদেরকে আব্দুল্লাহ তাকফীর করেছে। সুতরাং আমার মত যেন আবদুল্লাহ ওয়ান্টেড হিসাবে গণ্য হয়।
 ওরে সন্ত্রাসীর দল!!!
 আমাকে ঐ সন্ত্রাস বোঝাও! যেটার কারণে আমাকে তোমরা ওয়ান্টেড আখ্যায়িত করছ।?!!!  আমি যা করেছি তা কি অ্যামেরিকা করেনি?!!
 বরং এর চেয়ে অনেক অনেক বেশী করেছে।
 তাহলে তারা কেন সন্ত্রাসী (জঙ্গি) হচ্ছে না।?!!!
 কেন অ্যামেরিকার প্রতি সহানভুতি প্রকাশ অপরাধ বলে বিবেচিত হচ্ছে না?!
 যেভাবে আমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে?!!!

  আমাকে কি তোমরা নাসারা (খ্রিস্টান) হতে বলছ?
 কুফরী করতে বলছ? তাহলে অ্যামেরিকার মত আমি এই সন্ত্রাসের অপরাধ থেকে মুক্তি পাব?!!
 এটাই কি সৌদি সরকার আমার থেকে আশা করে?!
 ইহুদী-নাসারা তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্ম গ্রহণ কর।

সৌদি সরকার সন্ত্রাস করেছে।
 সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখিয়েছে।
 সন্ত্রাসীদেরকে সাহায্য করেছে।
 তাদেরকে মাল দিয়ে শক্তিশালী করেছে।
 মার্কিন সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে সব করেছে।
 তথাপি কেন তারা জঙ্গি-সন্ত্রাসী হবে না?!!
 এই কারণে কি, তারা হচ্ছে একটা হুকমত বা সরকার?!!

তাহলে আমার উপরও তো আবশ্যক হচ্ছে,
 যে কোন ভাবে ক্ষমতা দখল করা।
 যাতে আমিও এই সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাই।

পাঁচ
 আচ্ছা ঠিক আছে ...............।।
 যা আলোচনা হল সব বাদ।!!!

যদিও আমি কোন অভিযোগ ব্যতিরেকেই অভিযুক্ত,
 যে সৌদি সরকার আমাকে ওয়ান্টেড আখ্যায়িত করেছে,
 যদিও সে আমার চেয়ে অনেক বেশী অপরাধে অপরাধী
 তথাপি আমি নিজেকে সমর্পণ করব ............।!

তবে আমি কিছু শর্ত দেব ----------।
 আমি এমন শর্ত দেব না, যার হক শরীয়ত আমাকে দেয়নি।

আমর প্রথম শর্ত হবে,
 আমার ফায়সালা করতে হবে শরয়ী মাহকামাতে,
 ইনসাফের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশ্য মাহকামা।

আমার আর একটি শর্ত হচ্ছে,
আমাকে নির্যাতন করা যাবে না।

আমার শেষ শর্ত হচ্ছে,
আমার যে সমস্ত আপনজনকে সরকার জিম্মি হিসাবে আটক করেছে,
তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে।

হ্যাঁ এগুলোই আমার শর্ত।

কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে,
সৌদি সরকার আমাকে জেলে ভরবে,
আমার সকল শর্ত অস্বীকার করবে।
তাহলে আমার পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে,
সরকারকে এই শর্ত পুরনে বাধ্য করতে
অথচ আমি জিন্দানখানায় শিকলাবদ্ধ।

একটা সমাধান পেয়েছি --------।
 আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এর সাথে সম্পর্ক আছে এমন কোন শায়খের কাছে যাব।
 তিনি হতে পারেন, সাফার আল- হাওালী।
 আমি তার কাছে আমার শর্তগুলো পেশ করব,
 তাকে এ ব্যাপারে সরকারের সাথে আলোচনা করতে বলব।

তিনি যে এটা করতে সক্ষম হবেন, আমি এই নিশ্চয়তা পাব কীভাবে?
 হ্যাঁ এটা করা যেতে পারে যে,সরকার শর্ত মানলে তাকে এ ব্যাপারে মিডিয়ার মধ্যে প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে হবে।
 কিন্তু..................!
 এই একই কাজ কি ফাকআসী করেননি?
 ফাকআসীর শর্তগুলো হেওালি কি সৌদি পত্রিকার সমূহের মধ্যে প্রকাশ করেননি?
 তথাপি ফাকআসী তার হক সমূহের নিশ্চয়তা পেয়েছে কি?!!
 না পায়নি!!!
 স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি নায়েফ দৃশ্যপটে এলো,
 এসে হেওালিকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল।
 ফাকআসীর শর্ত সমূহ অস্বীকার করল।
 নায়েফের দাবি অনুযায়ী হেওালি মিথ্যা বলেছিল কি?
 না এটাই স্বাভাবিক যে নায়েফ হেওালিকে মিথ্যার অপবাদ দিয়েছে?
 তাহলে দুর্বল কারাবন্দী ফাকআসীর ক্ষেত্রে কি অবস্থা হয়েছে?!!
 আর কে আছে এমন, যে ফাকআসীর শর্তের নিশ্চয়তা দেবে, তার জামিন নেবে?
 আমি আত্মসমর্পণের চিন্তা থেকে সরে এসেছি,
 কারণ আমি যে সতর্কতাই নিতে চাই, ফাকআসী তাই গ্রহণ করেছিল।
 কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
 তাই মৃত্যুই আমার কাছে উত্তম ও অধিক প্রিয় ............।

  ছয়
 যদিও আমি আত্মসমর্পণের চিন্তা বাদ দিয়েছি,
 কিন্তু সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে মুক্ত হবার দিঢ় সংকল্প থেকে পিছে সরে আসতে পারিনি।
 সন্ত্রাসের সকল উপকরণ দ্বারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে অ্যামেরিকা।
 তাদেরকে সন্ত্রাসের সকল সংজ্ঞা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায়।
 অথচ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো অ্যামেরিকার ভালবাসা অর্জনে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত,
 আমাকে অপরাধী সাব্যস্তকারী সৌদি সরকার এ ক্ষেত্রে আরও অগ্রগামী।
 অ্যামেরিকার সাথে বন্ধুত্ব, সম্পর্ক ও ভালবাসা তাদের জন্য গর্বের ব্যাপার কেন?
 অথচ আমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ অপরাধ!!!
 যে রাষ্ট্র মার্কিন সন্ত্রসিদেরকে সাহায্য করে,
 তার সাথে সম্পর্ক রাখা জনগণের উপর ওয়াজিব কেন?!!
 আর শরয়ী জঙ্গিদের (সন্ত্রাসীদের) ব্যাপারে সামান্য সহানুভূতি প্রকাশ
 জনগণের জন্য হারাম কেন?!!
 সন্ত্রাসী সৌদি সরকারকে সাহায্য করা,
 কেন জনগণের উপর আবশ্যক?
 আর আমাদেরকে সাহায্য করা হারাম?!!

  আমি কারণ খুঁজে পেয়েছি ......
 হ্যাঁ... হ্যাঁ...  আমি এখন কারণ বুঝতে পেরেছি .........।
 আমি উসামা রহঃ এর আওয়াজ শুনতে পেলাম ----------- 
 
  إنَّ الناس يميلون مع القوي ..  إرهابُنا جريمة .. وإرهاب أمريكا أمر مشروع ..  أبرياؤهم أبرياء .. وأبرياؤنا ليسوا أبرياء .. 
মানুষেরা ঝোঁকে শক্তিশালীর দিকে ...।।
আমাদের “সন্ত্রাস” হচ্ছে অপরাধ
আর অ্যামেরিকার সন্ত্রাস হচ্ছে বৈধ।
তাদের নিরাপরাধ জনসাধারণ নিরাপরাধ
আর আমাদের নিরাপরাধ জনসাধারণ অপরাধী।!!

আল্লাহ্ তায়ালা আপনার প্রতি রহম করুন, হে উসামা!
এখন বুঝেছি কবিতার পংতি।
এখন চিনেছি ঘোড়ার লাগাম।
এখন পেয়েছি সমস্যার সমাধান!

হ্যাঁ এখন বুঝেছি......।।
 আমাকে শক্তিশালী হতে হবে।
যখন তুমি শক্তিশালী হবে,
তখন তুমি যাই কর সন্ত্রাসী হবে না।
ঠিক আছে!!!
কিন্তু আমি যে দুর্বল এটা তাদেরকে কে বলল?
হয়ত আমি শক্তিশালী কিন্তু সেটা তারা জানে না!!?

আচ্ছা!!
তাদেরকে আমার শক্তি দেখাতে হবে,
যেমন তারা অ্যামেরিকার শক্তি দেখেছে।
 আর তখনি আমার সাথে ক্ষমতাশীলরা
উষ্ম বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করবে।
তখনি সৌদি শাসক নড়েচড়ে বসবে,
আমার সাথে চুক্তি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

এই শাসকেই তো শ্যরন এর সাথে চুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে ছিল।
ইয়াহুদী সন্ত্রাসী শ্যরন কি একজন মুসলিম জঙ্গির চেয়ে ভাল?!!!

সন্ত্রাসের (জঙ্গিবাদের) অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাত্র উপায় হচ্ছে ---
তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে।

ঠিক আছে ......।
কিছু সময় অপেক্ষা কর ............।
অচিরেই ইনশাআল্লাহ্ তোমরা আমরা শক্তি দেখতে পাবে ......।।
এটাই ইসলামী সন্ত্রাসীর বার্তা...।।
হে আল্লাহ্!
আপনি মুজাহিদিন সন্ত্রাসীদের ত্রাসকে আপনার পথে কবুল করুন।
হে আল্লাহ্! আপনি নিহত জঙ্গিদের রূহগুলোকে আপনার পথে গ্রহণ করুন। 
কপিরাইট @আহমাদ নাবীল

পশ্চিমা “মরাল সুপিরিওরিটি”-র ফ্যালাসি


পশ্চিমা বিশ্ব এবং মুসলিম বিশ্বে তাদের অন্ধ অনুসারীরা ইসলামকে আক্রমণ করার সময় কয়েকটা ধরাবাঁধা আর্গুমেন্ট ব্যবহার করে। এগুলোর বেশীরভাগই হল প্রাচ্যবিদ বা ওরিয়েন্টালিস্টদের দ্বারা ব্যবহৃত নানা বস্তাপচা যুক্তি, যেগুলোকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং তথ্যগত ভাবে ভুল। যুক্তিগত বা নৈতিক উৎকর্ষ না, ফ্যাকচুয়াল অ্যাকিউরিসি না, এই আর্গুমেন্টগুলোর মূল চালিক শক্তি হল এগুলোর ইনবিল্ট ইসলামবিদ্বেষ। দুঃখজনক আমাদের সমাজে এরকম মানুষের অভাব নেই যারা হাসি মুখে এবং খুশি মনে পশ্চিমা বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক গোলামীকে মেনে নিয়েছেন। পশ্চিমাদের যেকোন দাবি তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে রাজি। এই কারণে আর্গুমেন্টগুলোর প্রচার আমাদের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও বেশ ভালো মতোই হয়েছে। ইসলামবিদ্বেষীদের এরকম একটি আর্গুমেন্ট হল মরাল সুপিরিওরিটি-র আর্গুমেন্ট। পশ্চিমা উদারনৈতিক চিন্তাধারা [Liberalism] এবং সেক্যুলারিসমকে নৈতিকভাবে ইসলামের চাইতে শ্রেষ্ঠতর দাবি করা। লিবারেলিসম আর সেক্যুলারিসমের এথিকাল সিস্টেমকে ইসলামের দেয়া নৈতিক ব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর দাবি করা। ইসলামবিদ্বেষীরা দুই ভাবে এই দাবির পক্ষে যুক্তি দেয়ার চেস্টা করে। প্রথমত তারা ইসলামকে আক্রমণ করে। “ইসলাম নারী স্বাধীনতা দেয় না, ইসলাম চোরের হাত কাটতে বলে, ইসলাম অমানবিক, ইসলাম বর্বর, ইসলাম চারটা বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, ইসলামে বাক স্বাধীনতা নেই, ইসলামের জিহাদের কথা আছে...” এরকম বিভিন্ন কথা বলে। এটা হল নৈতিক ভাবে ইসলাম অধম এটা প্রমাণ করার জন্য চেস্টা। দ্বিতীয়ত, তারা বিভিন্ন ভাবে প্রমাণ করার চেস্টা করে কেন তাদের দর্শন এবং নৈতিক চিন্তাধারা উন্নততর। তারা কত নৈতিক, তারা কত উদার, তারা নীতির প্রশ্নে কতোটা আপোষহীন, তারা মানবাধিকারে কত বিশ্বাসী, মানবতার ধারকবাহক – এসব ব্যপারে বিভিন্ন দাবি করে। আমরা সবাই এদুটো অ্যাপ্রোচের সাথেই পরিচিত। আমরা সবাই কমবেশী এই আর্গুমেন্টগুলো শুনেছি। অনেকে হয়তো কিছুটা প্রভাবিতও হয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে পশ্চিমাদের, এবং তাদের বাদামী চামড়ার অন্ধ অনুসারীদের এই বক্তব্যগুলোকে সমর্থন করে? কোন জাতি বা সভ্যতা কতোটা নৈতিক এটা পরিমাপ করার একটা ভালো উপায় হল সেই জাতি বা সভ্যতা তার অধিনস্ত এবং দুর্বলদের সাথে কি রকম আচরণ করে সেটা লক্ষ্য করা। যাদের উপর তারা কতৃত্ব অর্জন করেছে তাঁদের সাথে কি রকম আচরণ করে সেটা থেকে কোন জাতি আসলেই কতোটা নৈতিক সেটা আপনি বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনের তাগিদে কেউ তার নৈতিকতা কতোটা কম্প্রোমাইয করে সেখান থেকেও আপনি একটা ধারনা পাবেন। নিচের লিঙ্কটি হচ্ছে ২০ শে সেপটেম্বর, ২০১৫ তে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের। http://tinyurl.com/psqpqqd লিঙ্ক থেকে আপনারা সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়তে পারবেন, আমি এখানে সংক্ষিপ্ত ভাবে মূল বিষয়টা বলছি। যেকোন দেশে আগ্রাসন চালানোর সময় আগ্রাসী ভিনদেশী সেনাদল কিছু স্থানীয় লোককে ব্যবহার করে। তারা এসব কোলাবরেটরদের মিত্র বা অ্যালাই বলে থাকে। আফগানিস্তানের মুসলিম তথা তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অ্যামিরিকানরাও কিছু স্থানীয় দালালদের ব্যবহার করছে। অ্যামিরিকার এসব মিত্রদের অনেকেরই হবি হচ্ছে ধর্ষণ । বিশেষ করে কমবয়েসী ছেলেদের ধর্ষণ করা। অ্যামিরিকানদের এই মিত্রদের কম্যান্ডাররা কমবয়েসী শিশু এবং কিশোরদের নিজেদের যৌনদাস হিসেবে ব্যবহার করতো। তাঁদেরকে ২৪ ঘন্টা বিছানার সাথে শেকল দিয়ে বেধে রাখতো আর রাতে ধর্ষণ করা হতো। এবং এই কাজগুলো হতো অ্যামিরিকানদের বেইসের ভেতরে। অর্থাৎ অ্যামিরিকানদের সেনাঘাটিতে, অ্যামিরিকানদের মিত্ররা, অ্যামেরিকানদের উপস্থিতিতে শিশুদের ধর্ষণ করতো। শুধু তাই না, অ্যামিরিকান সেনাবাহিনী এই বিকৃতকাম, ধর্ষক ও সমকামিদের বিভিন্ন গ্রামের নেতৃত্বের পদে বসাতো। তাই এটা বলা অনুচিত হবে না যে, এই শিশু কিশোরদের উপর নির্যাতনের জন্য অ্যামেরিকা দায়ী। এরকম একটি মেরিন বেইসে কিছু কিশোর মুক্ত হবার চেস্টা করার সময় একজন অ্যামেরিকান সেনাকে গুলি করে হত্যা করে। ঐ সেনা মারা যাবার প্রেক্ষিতেই নিউইয়র্ক টাইমসের এই আর্টিকেলটি লেখা। এমন না যে তারা মুসলিম শিশুদের অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আর্টিকেলটি লিখেছে। অনেকে মনে করতে পারেন এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেখা যাক অ্যামেরিকানরা অন্য যে দেশটিতে আগ্রাসন চালিয়েছে সেখানে কি অবস্থা। ইরাকে অ্যামেরিকান আগ্রাসন চলাকালীন সময়ে কুখ্যাত আবু গ্রাইব কারাগারে অ্যামেরিকানর বন্দীদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালানো হয়। যা সে সময় বিশ্ব মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। কিন্তু যা মূল ধারার মিডিয়াতে আলোচিত হয় নি সেটা হল অ্যামেরিকান সেনারা আবু গ্রাইব কারাগের শুধু মুসলিম নারীদেরকেই ধর্ষণ করে নি, বরং তাঁদের সামনে তাঁদের ছোট ছেলেদের ধর্ষণ করেছে এবং সেটার ভিডিও করেছে। লা হাওলা ওয়ালা কু’আতা ইল্লাহ বিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের অক্ষমতা ক্ষমা করুন। http://tinyurl.com/otfeory http://tinyurl.com/qyqrjh এ ব্যাপারে পুলিৎযার জয়ী সাংবাদিক সিমোর হারশ এর বক্তব্যঃ http://tinyurl.com/nnhh59u আচ্ছা এমনকি হতে পারে এটা শুধু অ্যামেরিকানরা করছে, অথবা এটা শুধু ইরাক এবং আফগানিস্তানেই ঘটেছে? আচ্ছা আমরা একটু অন্যদিকে তাকাই। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনী এমন একটি সেনবাহিনী যা পরিচালিত জাতিসংঘের আদর্শ অনুযায়ী। যেমন সোভিয়েত আর্মির পেছনে চালিকা শক্তি ছিল সোশ্যালিসম, যা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শ। তেমনিভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর চালিকা শক্তি হল জাতিসংঘের আদর্শ – সেক্যুলার হিউম্যানিসম বা “ধর্ম নিরপেক্ষ মানবতাবাদ”। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনির সদস্যরা সেক্যুলার হিউম্যানিসমের মহাম আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যেসব অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গেছেন সেখানে ধর্ষণের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এসেছেন। মালি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো বিভিন্ন জায়গায় এই শান্তিরক্ষীরা এই কাজ করেছে। হাইতিতে প্রায় এক দশক ধরে এই ধর্ষণ চলছে। http://tinyurl.com/kq3zytd http://tinyurl.com/nqthgh9 http://tinyurl.com/ndahex4 http://tinyurl.com/q72ojgb এই ধর্ষণের স্বীকার শুধু নারীরা না। প্রতিটি ক্ষেত্রে শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে। একটু প্যাটার্নটা লক্ষ্য করুন। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিকটিম হলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নারী, শিশু এবং বন্দীরা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা দাবি করেছে তারা এসব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যাচ্ছে, গণতন্ত্র আনার জন্য যাচ্ছে, মানবাধিকারের জন্য যাচ্ছে। অর্থাৎ এই মহান আদর্শগুলো দ্বারা বলীয়ান সেনারা সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোকে তাঁদের সবচাইতে দুর্বল সময়ে আক্রমণ করেছে। এবং মানবতা, শান্তি, গন্ততন্ত্র এই আদর্শগুলো তাঁদের এই পৈশাচিকতা, এই প্রিডেটরি বিহেইভিয়ারকে থামাতে পারে নি। সবচাইতে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল তারা তো এসব ঘটনা চেপে রাখার চেস্টা করেছেই, কিন্তু প্রকাশিত হবার পরও তারা এই ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিতে ইচ্ছুক না। তারা কিন্তু বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ায় তাদের সেনাবাহিনী কত নৈতিক, কত মানবতাবাদী। মুসলিমরা জঙ্গী আর তারা মানবতাবাদী। অথচ তাদের সেনাবাহিনী, তাদের আদর্শের ধারকরাই, আফগানিস্তান ও ইরাকে তেজস্ক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করে, ওয়াইট ফসফরাস ব্যবহার করে, শিশুদের ধর্ষণ করে, নারীদের ধর্ষণ করে সেটার ভিডিও করে, নিজেরা নিজেদের ধর্ষণ করে, ড্রোন হামলা করে নিয়মিত শিশু হত্যা করে, ঘন জনবসতি পূর্ণ এলাকায় নির্বিচারে বম্বিং করে। এতো কিছু করার পরও তারা মানবিক। তারা মানবতাবাদী তারা মহান, আর মুসলিমরা বিশ্বাস করে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিরুদ্ধে কটুক্তিকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড, তালিবান মনে করে চুরির শাস্তি হাত কাঁটা, আমরা মনে করি শারীয়াহ মানবজাতির একমাত্র সংবিধান – এজন্য আমরা বর্বর, মধ্যযুগীয়, জঙ্গি!. পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্ট, ইসলামবিদ্বেষী এবং তাদের বাদামী চামড়ার সন্তানরা আমাদের খুব করে বোঝানোর চেস্টা করেন ইসলামকে মানুষকে বন্দী করে, অসম্মানিত করে, অধিকার কেড়ে নেয় আর পশ্চিমাদের আদর্শগুলো মানুষকে সম্মানিত করে। বাস্তবতা হল পশ্চিমাদের আদর্শ মানুষ চরমভাবে অসম্মান করে এবং তাঁকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এসব আদর্শ পুরুষকে লম্পট এবং নারীকে পণ্যে পরিণত করে। এই আদর্শগুলো মানুষকে “অধিকার, মানবতা, স্বাধীনতা-র মতো কিছু সুন্দর সুন্দর শব্দ শুনিয়ে অন্ধ ও বধির বানিয়ে রাখে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত অর্থ-সম্পদ-নারীর পেছনে ছুটে চলা এক ঘোরগ্রস্থ জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করে। এই আদর্শগুলো ন্যায়বিচার দেয় না, সুসাশন দেয় না, নৈতিক উৎকর্ষতা আনে না বরং উল্টোটা করে। এই আদর্শ এমন কিছু মানুষ তৈরি করে যারা মুখে মানবতা আর মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু কাজের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। তাদের বর্বরতা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্রুসেইডার পূর্বপুরুষদের হিংস্র পাশবিকতাকেও ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে ইসলাম প্রকৃত ভাবে মানুষকে মুক্ত করে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করে। নারীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেয়, সুরক্ষিত রাখে এবং মানবচরিত্রের অন্ধকার দিকটিকে লাগাম দিয়ে রাখে। ইসলাম মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনে। সৃষ্টির উপাসনা থেকে মুক্ত করে মানুষকে এক আল্লাহ-র ইবাদাতে নিয়োজিত করে। অর্থ, সম্পদ, সম্মান, ক্ষমতার পেছনে ছোটার বদলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষকে প্রতিযোগিতা করতে শেখায়। এ কারণে যেসব বিকৃতকাম, সমকামি, শিশুকামিদের অ্যামেরিকান সেনারা মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে তালিবান তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করে। অ্যামেরিকানরা যেখানে পপি চাষ থেকে অর্থ উপার্জন করে তালিবানের শাসনামলে সেই পপি চাষ নেমে আসে শুন্যের কোঠায়। অ্যামেরিকা তার তথাকথিত সুপিরিওর শাসন ব্যবস্থা দিয়ে প্রায় এক দশক চেস্টা করেও প্রহিবিশানের সময় মদ নিষিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তালিবান মাত্র কয়েক বছরে পপি চাষ বন্ধ করে ফেলে। ব্রিটীশরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে আর তালিবানের কাছে বন্দী ইয়োভন রিডলী ইসলাম গ্রহণ করে। এটা হল এক সুস্পষ্ট পার্থক্য এই দুই আদর্শের মধ্যে। নিশ্চয় এটা একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য, এবং নিশ্চয় এর মাঝে প্রমাণ আছে তাঁদের জন্য যারা নিজেদের বিচার-বুদ্ধি-বিবেককে এখনো সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমাদের কাছে বন্ধক দেননি। বাহ্যিক চাকচিক্য, চটকদার কথা, মানবতা ও শান্তির রেটরিক এবং পশ্চিমাদের বৈষয়িক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত সাফল্যে আমরা বিভ্রান্ত হই। বিশেষ করে আমরা যারা সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হই তাঁদের মাথায় ছোটবেলা থেকেই গেঁথে দেয়া হয় যে সফলতার সংজ্ঞা হল পশ্চিমাদের মতো হওয়া। একই সাথে এই শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজ আমাদের শেখায় পশ্চিমাদের সব দাবিগুলোকে ধ্রুব বাস্তব সত্য হিসেবে মেনে নিতে। কোন অপ্রিয় প্রশ্ন উত্থাপন না করতে। আমরা পশ্চিমাদের বড় বড় স্কাইস্ক্রেইপার আর বিশাল অর্থনীতি দেখি, কিন্তু এগুলোর পেছনে ঔপনিবেশিক এবং নব্য-ঔপনিবেশিক লুটপাটের ভূমিকা দেখি না। আমরা রেনেসন্স আর এনালাইটেনমেন্ট থেকে শেখার কথা বলি কিন্তু রেনেসন্স আর এনলাইটেমেন্ট মুসলিমদের কাছে কতোটা ঋণী সেটা জানার চেস্টা করি না। আমরা জেনেভা কনভেনশানের কথা বলি, কিন্তু জেনেভা কনভেনশানের প্রায় সাড়ে ১৩০০ বছর আগে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ যে মানবাধিকার এবং যুদ্ধবন্দীর অধিকারের ব্যাপারেয়া মানব ইতিহাসের সর্বোৎকৃষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে গেছেন এটা নিয়ে বলতে সংকোচ বোধ করি। জন স্টুয়ারট মিল, বেন্থাম, লিঙ্কনম, প্লেইটো, মার্ক্স যেখানে এতো কারুকার্যময় ব্যাখ্যা দিয়েছেন এগুলোর মাঝে আল্লাহ-র দেয়া সরল ব্যাখ্যা, যা বেদুইন আর বিজ্ঞানী, সবার কাছেই বোধগম্য, আমাদের আকর্ষণ করে না। আমাদের মধ্যে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করে। আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র, অপাংতেয় মনে করি। আমরা মনে করি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ হবার উপায় হল পশ্চিমাদের অনুসরণ করা। আমাদের সফল হবার উপায় হল ফিরিঙ্গীদের মতো হবার চেস্টা করা। তাই আমাদের সমাজে পশ্চিমাদের অনেক বাদামী চামড়ার সন্তান আছেন যারা পশ্চিমাদের ইসলাম বিদ্বেষ অনুসরণ করাকে সভ্যতা, সাফল্য আর জ্ঞানের মাপকাঠি মনে করেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। এই মানুষগুলো পশ্চিমা বিশ্বকে প্রভু হিসেবে, পশ্চিমা আদর্শকে জীবনবিধান, দ্বীন, হিসেবে গ্রহন করেছে। এই বাদামী ফিরিঙ্গী, নাস্তিক এবং কাফিরদের কথাবার্তা, প্রচার প্রচারণা এবং মিডিয়ার প্রভাবের কারণে অনেক সাধারণ মুসলিম প্রভাবিত হয়ে পড়েন। কিন্তু আপনি যদি অন্ধভাবে ওরিয়েন্টালিস্ট এবং তাদের গোলামদের বক্তব্য গ্রহণ না করে একটু খুঁটিয়ে দেখার চেস্টা করেন, তাহলে দেখবেন, মিথ্যা, প্রতারণা, অনৈতিকতা, পাশবিকতা, এবং পাপাচার কিভাবে এই সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে, দেখবেন কিভাবে অন্ধকার এই সভ্যতাকে ঘিরে রেখেছে। আমি এখানে তাদের সেনাদের আচরণের মাধ্যমে মাত্র একটি উদাহরণ দিয়েছি, এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। আপনি যদি একটু চিন্তা করেন তাহলে এই বুলি সর্বস্ব আদর্শের অন্তঃসারহীনতা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে পড়বে। এরা যেসব আদর্শের ক্যানভাসিং করছে এগুলো গত দুইশ বছরে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ আর নোংরামি ছাড়া পৃথিবীকে কিছু দিতে পারে নি। যেখানে ইসলামের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৩০০ বছরের খিলাফাহ-র ইতিহাস। ১৩০০ বছর ধরে শারীয়াহ এর আলোকে ইসলাম দ্বারা ব্যক্তি, সমাজ ও রাস্ট্রের সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। কারো যদি আসলেই প্রশ্ন জাগে কোন আদর্শ মানব জীবনের সমাধান দেয়ার ব্যাপারে সফল, তাহলে সে ইতিহাস দেখে নিক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, ইসলামই প্রথম মানবাধিকার নিশ্চিত করেছে, ইসলাম নারীকে সম্মান এবং স্বাধীনতা দিয়েছে, ইসলাম ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে, ইসলাম প্রথম ওয়েলফেয়ার স্টেইটের ধারণা এনেছে এবং বাস্তবায়ন করেছে, ইসলাম রাস্ট্রীয় ভাবে জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ইসলাম মানবজাতিকে সর্বোত্তম আদর্শ দিয়েছে। ইসলামই একমাত্র ব্যবস্থা যা মানবজীবনের সমস্যার সফলতার সাথে সমাধান করেছে, বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করে টিকে থেকেছে, নিজ আদর্শের বিস্তার করেছে। ইসলাম এই কাজগুলো বাস্তবে করেছে। ইসলাম পশ্চিমাদের আদর্শের মতো কথায় সীমাবদ্ধ না। ইসলাম কাজের মাধ্যমে তাঁর আদর্শিক উৎকর্ষ প্রমাণ করেছে । পশ্চিমা চিন্তাধারা জীবনবিধানের ব্যাপারে অনেকগুলো মডেল দিয়েছে কিন্তু কোনটাই বাস্তব সমাধান তো দেয়-ই নি বরং নতুন সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আর ইসলাম একটি মডেল দিয়েছে এবং ১৩০০ বছর ধরে সেই মডেলের বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানব জাতির সমস্যার সমাধান দিয়েছে। একজন চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্য প্রমাণ হিসেবে এটুকুই যথেস্ট। এবং ইন শা আল্লাহ, ইসলামী খিলাফাহ আবারো প্রতিষ্ঠিত হবে, আল্লাহ-র মাটিতে আল্লাহ- র শারীয়াহ আবারো কায়েম হবে। আমরা সমর্থন করি আর না করি এটা আল্লাহ-র প্রতিশ্রুতি যা হবেই। যে বিষয়টা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা হল আমরা নিজেদের কিভাবে দেখতে চাই। আমরা কি নিজেদের সম্মানিত অবস্থায় দেখতে চাই, আমরা কি মাথা তুলে মর্যাদা এবং গর্বের সাথে বাঁচতে চাই? নাকি আমরা চাই পশ্চিমা দাসত্ব মেনে নেয়ার মাধ্যমে অপমান আর অন্ধ অণুসরণের এক জীবন? আল্লাহ আমাদের ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেনঃ “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে…” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০] তাই আমাদের সম্মান ইসলামেই নিহিত। আমাদের জন্য আল্লাহ ইসলামকে মনোনীত করেছেন, তাই আর যা কিছুরই অনুসরণ আমরা করি না কেন আমরা কখনোই সফল হতে পারবো না। “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম... “ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯] রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ তোমরা যখন ধারে ক্রয়-বিক্রয় করবে, গাভীর লেজ ধরে থাকবে, কৃষি কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়বে এবং জিহাদ ছেড়ে দিবে, তখন আল্লাহ্ তোমাদের উপর অপমান চাপিয়ে দেবেন এবং তা তোমরা হটাতে পারবে না, যতক্ষন না তোমরা নিজের দ্বীনের দিকে ফিরে আস।(আহমদ, আবু দাউদ, আল হাকিম) আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের সবাইকে বোঝার তাউফিক্ব দান করুন, আমিন।

তিনি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন —আল-বাক্বারাহ ২৪৫


বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

কে আছে যে আল্লাহকে ﷻ ধার দেবে? তাহলে তিনি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন। আল্লাহই ﷻ কমিয়ে দেন এবং বাড়িয়ে দেন। তাঁর কাছেই তোমরা ফিরে যাবে। [আল-বাক্বারাহ ২৪৫] এই আয়াত পড়ে যে কোনো মুসলিমের লজ্জা পাওয়া উচিত। আল্লাহ ﷻ আমার কাছে ধার চাইছেন? আমি দুনিয়ার লোভে এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছি যে, তিনি ﷻ এই ভাষা ব্যবহার করে আমাকে বলছেন তাঁর পথে খরচ করতে? ধরুন, আপনার মা ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে কাজ করে আপনাকে বড় করেছেন, আপনার পড়ালেখার খরচ যোগান করেছেন। তিনি আপনাকে একটুও কষ্ট করতে দেননি, যেন আপনার পড়াশুনায় কোনো ক্ষতি না হয়, যেন আপনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। আপনার মায়ের এই বিরাট আত্মত্যাগের জন্য আপনি বড় হয়ে শিক্ষিত হলেন, ডিগ্রি অর্জন করলেন, যথেষ্ট সম্পত্তির মালিকও হলেন। আপনার মা আপনার যত এত কষ্ট না করলে আপনি এত উপরে উঠতে পারতেন না। একদিন তিনি আপনাকে অনুরোধ করছেন, ‘বাবা, আমাকে কিছু টাকা ধার দেবে? আমি আগামী বছরই ফেরত দিয়ে দেবো। আর আমি তোমাকে ধারের টাকার দ্বিগুণ ফেরত দেবো। কোনো চিন্তা করো না বাবা। একটু ধার দেবে?’ —যখন মা তাকে এই ভাষায় অনুরোধ করছেন, দ্বিগুণ ফেরত দেওয়ার কথা বলছেন, এথেকেই বোঝা যায়, সে ছেলে হিসেবে কতটা নীচে নেমেছে, কতটা লোভী হয়ে গেছে যে, তাকে এভাবে বোঝাতে হচ্ছে।

আল্লাহ্‌কে ধার দেয়া কি? আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কয়েকটি খাত দিয়েছেন খরচ করার জন্য। বাবা-মা, পরিবার, নিকট আত্মীয়, এতিম, মিসকিন, দুস্থ পথচারী, জিহাদ — এই সব ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের সম্পত্তি খরচ করাই হচ্ছে আল্লাহর ﷻ পথে খরচ করা। তিনি ﷻ একে ধার বলে এটাই বোঝাচ্ছেন যে, দুনিয়াতে আমরা যখন সম্পত্তি খরচ করি, তখন তা আমাদের কাছ থেকে চলে যায়। কিন্তু যখন আমরা আল্লাহর ﷻ পথে সম্পত্তি খরচ করি, সেটা আমাদের কাছ থেকে চলে যায় না। বরং সেটা ধার হিসেবে জমা হয়। আল্লাহ ﷻ একদিন তাঁকে দেওয়া সমস্ত ধার ফেরত দেবেন, বহুগুণে ফেরত দেবেন। আমাদের অনেকেরই দান করতে গেলে অনেক কষ্ট হয়। কোনো এতিমখানায় দান করলে, বা কোনো গরিব আত্মীয়কে হাজার খানেক টাকা দিলে মনে হয়: কেউ যেন বুকের একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটাকে এভাবে চিন্তা করতে পারি— দুনিয়াতে আমার একটি ক্ষণস্থায়ী কারেন্ট একাউন্ট রয়েছে, এবং আখিরাতে আমার আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্ট রয়েছে। আমি আল্লাহর ﷻ রাস্তায় যখন খরচ করছি, আমি আসলে আমার দুনিয়ার একাউন্ট থেকে আখিরাতের একাউন্টে ট্রান্সফার করছি মাত্র। এর বেশি কিছু না। আমার সম্পত্তি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে না, আমারই থাকছে, যতক্ষণ না আমি দান করে কোনো ধরনের আফসোস করি, বা দান করে মানুষকে কথা শোনাই।[১] একদিন আমরা দেখতে পাবো: আমাদের ওই একাউন্টে কত জমেছে এবং আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে প্রতিটা দানের বিনিময়ে ৭০০ গুণ বেশি মুনাফা দিয়েছেন।[১] সেদিন আমরা শুধুই আফসোস করব, “হায়, আর একটু যদি আখিরাতের একাউন্টে ট্রান্সফার করতাম! তাহলে আজকে এই ভয়ংকর আগুন থেকে বেঁচে যেতাম!” এই আয়াতের আগের আয়াত ক্বিতাল সম্পর্কে আদেশ। এরপরেই আল্লাহ ﷻ তাকে ধার দিতে বলে ক্বিতাল বা যুদ্ধের জন্য আমাদের সম্পত্তি খরচ করতে বলেছেন। যুদ্ধের জন্য প্রচুর খরচ দরকার। বিরাট সামরিক বাহিনী তৈরি, তাদের বেতন, খাওয়ার খরচ, যুদ্ধের সরঞ্জাম কেনা, প্রযুক্তি তৈরি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি, যানবাহনের খরচ ইত্যাদি হাজারো খাতে প্রচুর পরিমাণে খরচ করতে হয়। এই খরচ যোগানের ব্যবস্থা করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য দায়িত্ব। যথেষ্ট খরচ না করলে মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনীর তুলনায় দুর্বল হবে, যুদ্ধে হেরে যাবে, তারপর দেশ দখল হয়ে যাবে শত্রুর কাছে। শত্রু তখন আমাদের মেরে, জমি জমা সব দখল করে নিয়ে যাবে। এভাবে আমরা সবদিক থেকেই হারাবো। একারণেই যুদ্ধের জন্য খরচ করার প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এই খরচের বিনিময়ে এত বড় পুরষ্কারের কথা বলা হয়েছে। তিনি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে একদিন আপনি রাস্তায় একটা বুড়ো ফকিরকে দেখে কষ্ট পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে, তাকে দোকানে নিয়ে জামাকাপড় কিনে দিলেন। এর বিনিময়ে হয়তো আল্লাহ ﷻ আপনাকে দুনিয়াতে এক কঠিন অসুখে পড়ে, চিকিৎসার পেছনে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করা থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। শুধু তাই না, আখিরাতে গিয়ে হয়তো দেখবেন: কয়েকশ একরের ঘন সবুজ বাগানের মাঝখানে এক বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের দরজায় লেখা, ‘সেই ভিক্ষুকের জন্য’। একদিন আপনি এক গরীব আত্মীয়কে ভীষণ বিপদের সময় সাহায্য করলেন। আপনার টাকা পয়সা টানাটানি থাকার পরেও আপনি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে তাকে অনেকগুলো টাকা দিয়ে দিলেন। এর জন্য হয়তো আল্লাহ ﷻ আপনাকে অফিসে বসের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করে চাকরি হারানো থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। আর আখিরাতে গিয়ে দেখবেন: উঁচু পাহাড়ে এক বিশাল ফুল-ফলের বাগান, বাগানের মাঝখানে ঝর্ণা, ঝর্ণার পাশে লম্বা টেবিলে সারি সারি খাবার এবং পানীয় সাজিয়ে রাখা আছে। টেবিলে একটা ছোট নোটে লেখা, ‘সেই আত্মীয়ের জন্য’। আল্লাহ্‌ই কমিয়ে দেন বাড়িয়ে দেন আমাদের যা কিছু আছে – বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক ক্ষমতা, প্রতিভা – এই সব কিছু হচ্ছে রিযক্ব رزق এবং এগুলো সবই আল্লাহর ﷻ দেওয়া।[১] রিযক্ব অর্থ যে সমস্ত জিনিস ধরা ছোঁয়া যায়, যেমন টাকাপয়সা, বাড়ি, গাড়ি, জমি, সন্তান এবং একই সাথে যে সমস্ত জিনিস ধরা ছোঁয়া যায় না, যেমন জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মেধা।[২] এগুলোর কোনটাই আমরা শুধুই নিজেদের যোগ্যতায় অর্জন করিনি। আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে এই সবকিছু দিয়েছেন। এখন আপনার মনে হতে পারে, “কোথায়? আমি নিজে চাকরি করে, দিনের পর দিন গাধার মতো খেঁটে বাড়ি, গাড়ি করেছি। আমি যদি দিনরাত কাজ না করতাম, তাহলে কি এগুলো এমনি এমনি হয়ে যেত?” ভুল ধারণা। আপনার থেকে অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে আছে, যারা আপনার মতই দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেছে, কিন্তু তারা বাড়ি, গাড়ি করতে পারেনি। আল্লাহ ﷻ কোনো বিশেষ কারণে আপনাকে বাড়ি, গাড়ি করার অনুমতি দিয়েছেন দেখেই আপনি এসব করতে পেরেছেন। তিনি যদি অনুমতি না দিতেন, তিনি যদি মহাবিশ্বের ঘটনাগুলোকে আপনার সুবিধামত না সাজাতেন, আপনি কিছুই করতে পারতেন না। আল্লাহ ﷻ আপনাকে সামর্থ্য দিয়েছেন, সুযোগ দিয়েছেন, আপনি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিশ্রম করেছেন। আল্লাহর ﷻ হুকুম ছিলো আপনার পরিশ্রমের ফলস্বরূপ আপনি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন, তাই আপনি অর্থ উপার্জন করছেন। না হলে পারতেন না। একারণেই আল্লাহ ﷻ আল-বাক্বারাহ-এর তৃতীয় আয়াতে বলেছেন যে, তিনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন, সেটা থেকে যেন আমরা খরচ করি। আল্লাহর ﷻ রাস্তায় খরচ করতে গিয়ে যেন আমরা মনে না করি যে, “এগুলো সব আমার, দিবো না কাউকে!” বরং এগুলো সবই আল্লাহর ﷻ। তিনি আপনাকে কিছুদিন ব্যবহার করার জন্য দিয়েছেন। একদিন তিনি সবকিছু নিয়ে যাবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা আপনাকে উলঙ্গ করে, একটা সস্তা সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে, মাটির গর্তে পুঁতে দিয়ে আসবে। কয়েকদিন কান্নাকাটির পর সবাই আবার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে, আপনাকে ভুলে যাবে। অনেকসময় আমরা চাকরি হারিয়ে ফেললে, বা ব্যবসায় লোকসান হলে সব দোষ হয় বসের, পার্টনারের, বন্ধুর, না হলে বউয়ের। আমরা মনে করি, অমুকের জন্যই আজকে আমি সব হারিয়ে ফেললাম। আজকে আমার এই দুরবস্থার জন্য সব দোষ তার। তার জন্য আমি এত করলাম, আর সে আমার সাথে এমন করতে পারলো? —এভাবে তার প্রতি আক্রোশ ধরে রেখে বছরের পর বছর পার করি। অনেক সময় বহু বছরের সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলি। আল্লাহ ﷻ এই আয়াতে বলছেন, “আল্লাহই ﷻ কমিয়ে দেন এবং বাড়িয়ে দেন”। আমাদের রিযক্ব আসে আল্লাহর ﷻ কাছ থেকে। তিনি যখন সিদ্ধান্ত নেন রিযক্ব বাড়িয়ে দেবেন, তখন আমাদের দিনকাল ভালো যায়, চাকরি হয়, ব্যবসায় লাভ হতে থাকে, ছেলেমেয়ে উপরে উঠতে থাকে, বিদেশে যাওয়া হয়। যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন রিযক্ব কমিয়ে দেবেন, তখন চাকরি চলে যায়, ব্যবসা ধ্বসে যায়, ছেলেমেয়ে দূরে চলে যায়, দেশে ফিরে আসতে হয় ইত্যাদি। মানুষের জীবনে রিযক্ব-এর উঠানামা হবেই। আর এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ ﷻ হাতে। যেই বন্ধুকে আপনি দোষ দিচ্ছেন চাকরি হারানোর জন্য, সেই বন্ধু আসলে রিজক কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার একটি মাধ্যম। যেই পার্টনারের ভুলের জন্য ব্যবসা ধ্বসে গেল, সেই পার্টনারের ভুল ছিল আপনার রিযক্ব কমিয়ে দেওয়ার একটি উপলক্ষ। আমরা যখন খুব ভালভাবে উপলব্ধি করবো যে, আল্লাহ ﷻ হচ্ছেন আর-রাযযাক্ব, একমাত্র রিযক্ব দাতা, তখন আমরা কখনোই দিনকাল খারাপ গেলে অন্য কাউকে দোষ দেবো না। মেনে নেবো যে, এখন আল্লাহ ﷻ আমাকে কম রিযক্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই আমার জীবনে এসব ঘটছে। আল্লাহর ﷻ সিদ্ধান্তের জন্য কাউকে দোষ দেওয়ার কোনো মানে নেই। আল্লাহ ﷻ যখন আবার রিযক্ব বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন আমার অবস্থা আবার ভালো হয়ে যাবে। বরং আমি চিন্তা করে দেখি, এখন আমি কী করতে পারি, যা করলে আল্লাহ ﷻ আমাকে আরও রিযক্ব দেবেন? রিযক্ব বাড়ানোর জন্য আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কী কী করতে বলেছেন? তার কাছেই তোমরা ফিরে যাবে টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি দূরের কথা, আমি তো নিজেই আল্লাহর ﷻ কাছে ফিরে যাবো। তখন কী হবে? কু’রআনে বার বার এই কথাটা আসে, “তাঁর কাছেই তোমরা ফিরে যাবে”। আমাদের সময় নিয়ে এই কথাটার মর্ম উপলব্ধি করার প্রয়োজন, কারণ এটার মর্ম উপলব্ধি করলে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে। কিছু মুসলিম আছে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজানে ত্রিশটা রোজা রাখে, কিন্তু গত এক বছরেও কোনোদিন কোনো এতিম খানায় একটা টাকাও দিতে পারেনি। ড্রাইভার, কাজের বুয়া, বাড়ির দারোয়ান তার কাছে বার বার টাকা চাইতে এসে— “দিবো, দিবো, রমজান আসুক” —এই শুনে খালি হাতে ফিরে গেছে। গরিব আত্মীয়স্বজন এসে কয়েকদিন থেকে ফিরে গেছে, কিন্তু কোনো টাকা নিয়ে যেতে পারেনি। মসজিদে বহুবার সে বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য টাকার আবেদন শুনেছে, কিন্তু কোনোদিন পকেটে হাত দিয়ে একটা একশ টাকার নোট বের করে দিতে পারেনি। ঘরের মধ্যে এসি ছেড়ে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়া সোজা কাজ, কিন্তু পকেট থেকে হাজার টাকা বের করে গরিব আত্মীয়, প্রতিবেশী, এতিমখানায় দেওয়া যথেষ্ট কঠিন কাজ। এর জন্য ঈমান লাগে। এই ধরনের মানুষদের আল্লাহর ﷻ সাথে সম্পর্ক কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পর্যন্তই। আল্লাহর ﷻ প্রতি তাদের বিশ্বাস এখনও এতটা মজবুত হয়নি যে, তারা আল্লাহর ﷻ উপর বিশ্বাস রেখে হাজার খানেক টাকা নির্দ্বিধায় একটা এতিমখানায় দিয়ে দিতে পারে। কিয়ামতের দিনের প্রতিদান নিয়ে এখনও তাদের সন্দেহ ততটা দূর হয়নি যে, তারা নির্দ্বিধায় গরিব আত্মীয়দের চিকিৎসায় দশ হাজার টাকা লাগলেও, সেটা হাসিমুখে দিয়ে দিতে পারে। তারা যদি সত্যিই মু’মিন হতো, তাহলে তারা প্রতিদিন সকালে উঠে চিন্তা করতো, “আজকে আমি কাকে আল্লাহর ﷻ সম্পদ ফিরিয়ে দিতে পারি? আল্লাহর ﷻ কোন মেহমানকে আজকে আমি খাওয়াতে পারি? কার কাছে গিয়ে আজকে আমি জান্নাতের জন্য সিকিউরিটি ডিপোজিট করতে পারি?” তাহলে কি সব টাকা পয়সা আল্লাহ্‌কে দিয়ে দিব? কু’রআনের একটি আয়াত পড়ে কোনো সিদ্ধান্তে চলে গেলে ভুল সিধান্ত নেওয়া হবে। কু’রআনে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে ভারসাম্য করতে বলেছেন। বহু আয়াত আছে যেখানে আমাদেরকে বাবা-মা, পরিবার, সন্তান এর অধিকার আদায় করতে বলেছেন, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব দিয়েছেন। বহু আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে তাঁর এই অসাধারণ পৃথিবী ঘুরে দেখতে বলেছেন, সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গবেষণা করতে বলেছেন, তাঁর সৃষ্ট হালাল আনন্দ উপভোগ করতে বলেছেন। সেই আয়াতগুলো মানতে গেলে দুনিয়াতে টাকা খরচ করতে হবে, টাকা জমিয়ে রাখতে হবে। যদি সব টাকা দান করে দেই, তাহলে কোনোদিন সেই আয়াতগুলোর উপর আমল করা হবে না। কু’রআনের একটা বড় অংশের উপর আমল না করেই আমরা মরে যাবো। সুতরাং সম্পত্তি কীভাবে ব্যবহার করবো, কোথায় কতটুকু ব্যবহার করবো, এটা পুরো কু’রআন পড়ে সম্পূর্ণ ধারণা নিয়ে তারপরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো একটা আয়াত পড়ে ঝোঁকের মাথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে হবে না। আমরা হাদিস থেকে উদাহরণ পাই, একজন সাহাবি এই আয়াত শুনে তার দুটো বাগানই আল্লাহর ﷻ পথে দান করে দিতে চাইলে, রাসুল ﷺ তাকে একটি দান করে অন্যটি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য রেখে দিতে বলেন। এভাবেই আমরা সম্পত্তি নিজেদের প্রয়োজনে এবং আল্লাহর ﷻ পথে খরচ করতে ভারসাম্য করবো।

কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর অনুমতিতে —আল-বাক্বারাহ ২৪৬-২৫২

মুসলিমদের উপর যখন অমুসলিমরা নির্যাতন করে, তাদের সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়, কর্তৃত্ব দখল করে নেয়, বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়, তখন মুসলিমরা কীভাবে যুদ্ধ করে তাদের অধিকার আদায় করবে, তা আল্লাহ ﷻ আল-বাক্বারাহ’তে তালুত এবং দাউদ ﷺ-এর ঘটনার মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। এই আয়াতগুলো থেকে আমরা জানতে পারি: তারা কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করেছিলেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে একটি মুসলিম সম্প্রদায় হাতে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করতে পারে। মাত্র ছয়টি আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে ইতিহাসের সেই অসাধারণ ঘটনার পরিষ্কার বর্ণনা দেবেন, যেই ঘটনা নিয়ে বাইবেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিভ্রান্তিকর বর্ণনা আছে। এই আয়াতগুলো থেকে একজন নেতা অনেক উপলব্ধির বিষয় পাবেন। একই সাথে অনুসারীরাও বিভিন্ন প্রকারের নেতাদের সম্পর্কে সাবধান হতে পারবেন—
বনি ইসরাইলের ওই গোত্র প্রধানদের কথা ভেবে দেখেছ, যারা তাদের নবীকে বলেছিল, “আমাদের জন্য এক রাজা নির্ধারণ করে দিন, যেন আমরা আল্লাহর ﷻ পথে যুদ্ধ করতে পারি।” তিনি বলেন, “যদি এমন হয় যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কিন্তু তারপরেও তোমরা যুদ্ধ করলে না, তখন?” তারা বলল, “কেন আমরা আল্লাহর ﷻ পথে যুদ্ধ করবো না, যখন কিনা আমাদের ঘরবাড়ি থেকে আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কয়েকজন বাদে বেশিরভাগই পিঠটান দিলো। আল্লাহ ﷻ অন্যায়কারীদের ভালো করে চেনেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৬] এই আয়াতে বেশ কিছু শেখার ব্যাপার রয়েছে। কখন আল্লাহ ﷻ যুদ্ধ করার অধিকার দেন? যখন মুসলিমদের উপর আক্রমণ হয়, তাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল হয়ে যায়, তখন তারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করার জন্য পরিষ্কার প্রমাণ কু’রআনে রয়েছে। এথেকেই দেখা যায়, ক্বিতাল বা যুদ্ধ হচ্ছে মূলত আত্মরক্ষামূলক। এর আগের আয়াতগুলোতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ক্বিতাল বা যুদ্ধ করার কঠিন আদেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে সাবধান করেছেন, আমরা যেন যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন না করে পালিয়ে না যাই। ঠিক এরপরেই তিনি আমাদেরকে যুদ্ধের একটি ঘটনা বলে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, কখন কোন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করার অনুমতি তিনি দিয়েছেন। কিছু উগ্রপন্থী নেতা এর আগের আয়াতগুলো, যেমন: “তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা মৃত্যুর ভয়ে হাজারে হাজারে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল? তখন আল্লাহ ﷻ তাদেরকে বললেন, “মরো”। তারপরে একদিন তিনি তাদেরকে জীবিত করলেন। আল্লাহ ﷻ মানুষের অনেক কল্যাণ করেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কৃতজ্ঞতা দেখায় না। [আল-বাক্বারাহ ২৪৩] আর আল্লাহর ﷻ পথে যুদ্ধ (ক্বিতাল) করো। জেনে রেখো, আল্লাহ ﷻ সব শুনছেন, সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৪]” —এগুলো বলে মানুষকে আক্রমণাত্মক জিহাদের দোহাই দিয়ে মুসলিমদেরকে দিয়ে অবৈধ হামলা, নিরীহ মানুষ হত্যা ইত্যাদির দিকে উস্কে দেয়। কিন্তু তারা খুব সাবধানে এরপরের আয়াতগুলো এড়িয়ে যায়, কারণ পরের আয়াতে আল্লাহ ﷻ পরিষ্কার করে কখন, কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করা বৈধ, সেটা জানিয়ে দিয়েছেন। আরেকটি শেখার ব্যাপার হলো: মানুষের মধ্যে অনেক নেতা থাকবে, যারা নির্যাতিত মানুষদেরকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য, যুদ্ধ করার জন্য অনেক রক্ত গরম করা বক্তৃতা দেবে। কিন্তু যখনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার পরিস্থিতি হবে, তখন তাদের আসল চেহারা বের হয়ে যাবে। এরা যুদ্ধের আদেশ আসলে নিজেরা পিঠটান দেবে, অথবা সুকৌশলে নিজেরা যুদ্ধে না গিয়ে, অন্যদেরকে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এথেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই, যেসব তথাকথিত নেতারা ‘জিহাদ! জিহাদ!’ করে মুসলিমদেরকে এত ডাকাডাকি করছেন, তারা নিজেরা কেন জিহাদে যাচ্ছেন না? বসে বসে এত বই না লিখে, এত লেকচার না দিয়ে, নিজেরা কেন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন না? যখনই কেউ আমাদেরকে জিহাদে যাওয়ার জন্য বুদ্ধি দেওয়া শুরু করবে, কীভাবে বর্ডার পার হতে হয়, কীভাবে প্লেনে করে গোপনে অমুক দেশে যেতে হয়, কীভাবে হোটেলে হামলা করতে হয়, তাদেরকে আমাদের প্রথম প্রশ্ন করতে হবে, “আমাকে যেই বুদ্ধি দিচ্ছেন, সেটা নিজে করছেন না কেন? গলাবাজি না করে আগে নিজে করে দেখান?” তাদের নবী তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ ﷻ তালুত-কে তোমাদের রাজা নির্ধারণ করেছেন।” কিন্তু তারা বলল, “সে কীভাবে আমাদের রাজা হতে পারে, যেখানে রাজত্ব করার অধিকার তার থেকে আমাদের বেশি? তার তো অনেক সম্পত্তিও নেই?” তিনি বললেন, “তোমাদের চেয়ে তাকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত আল্লাহই ﷻ নিয়েছেন এবং তাকে তিনি ﷻ অনেক জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তি দিয়েছেন।” আল্লাহ ﷻ যাকে চান, তাকেই রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ ﷻ সবকিছুর ব্যাপারে সব জ্ঞান রাখেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৭] একজন নবী ঘোষণা দিলেন যে, আল্লাহ ﷻ নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন রাজাকে! নবী বেঁচে থাকতেও কোনো এক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব একজন রাজা দিতে পারে। এথেকে দেখা যায়, নবী থাকার সময়ও রাজতন্ত্র বৈধ, এবং রাজার আনুগত্য করতে মানুষ বাধ্য, যতক্ষণ না রাজা মানুষকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করতে বলছে। একজন নবীর মতো সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের ধর্মীয় নেতা রাজত্বের নেতৃত্ব নিজে না নিয়ে যে অন্য কোনো যোগ্য নেতাকে দিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই আয়াত। এই আয়াত থেকে প্রমাণ মেলে যে, ধর্মীয় দিক থেকে একজন অনেক উপরে উঠলেই সে সব কিছুর যোগ্য হয়ে যায় না। একটি দেশের রাজা বা খালিফা হওয়ার যোগ্যতা শুধুই একজন আলেমের থাকবে, তা নয়। বরং অন্য কারো আরও বেশি যোগ্যতা থাকতে পারে।[১৭] রাজার কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে, সেটাও আল্লাহ ﷻ এখানে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অনেক সম্পত্তি থাকাটা রাজা হওয়ার জন্য মোটেও দরকার নেই। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বেশিরভাগ রাজারা ছিলেন বিরাট ধনকুবের। বিপুল পরিমাণের সম্পদ নিয়ে তারা জৌলুশের জীবন পার করে গেছেন। কিন্তু ইসলামে সম্পত্তির সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নেতৃত্বের জন্য দরকার জ্ঞান এবং শক্তি। যদি রাজার জ্ঞান না থেকে শুধুই শক্তি থাকে, তাহলে সেই শক্তি ব্যবহার হবে বিরাট অন্যায় ঘটাতে। আর যদি জ্ঞান থাকে, শক্তি না থাকে, তাহলে শুধু জ্ঞান দিয়ে শত্রুকে পরাজিত করা যাবে না, এবং সে একজন অনুসরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব হবে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাসুল ﷺ। তিনি পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও নিয়মিত প্রচণ্ড গরমে মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজে যুদ্ধ করার মতো সবল ছিলেন। মরুভূমিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এক কথা, আর যুদ্ধের সরঞ্জাম পরে দিনের পর দিন যুদ্ধ করা আরেক কথা। এর জন্য যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্য দেহ থাকা দরকার। অথচ আজকে আমরা হাজ্জ করতে গেলে এয়ারকন্ডিশন্ড হোটেল থেকে বের হয়ে মসজিদ পর্যন্ত গিয়েই হাঁপিয়ে যাই। আমরা অনেকেই রাসুলের ﷺ খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়ার সুন্নাহ মানি, যেটা একটা ভুয়া সুন্নাহ। মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে, দিনের বেশিরভাগ সময় বসে থেকে ভুঁড়ি বানাই। অথচ রাসুল ﷺ যে নিয়মিত শারীরিক চর্চা করতেন, নিজেকে শক্ত সামর্থ্য রাখতেন, সেই সুন্নাহ আমরা ভুলে গেছি। যুদ্ধে যাওয়া তো দূরের কথা, মসজিদে দিনে পাঁচবার যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যও আমাদের অনেকের নেই।
তাদের নবী তাদেরকে বললেন, “তার নেতৃত্বের প্রমাণ হলো যে, তাদের কাছে তাবুত (সিন্দুক) আসবে, যাতে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রশান্তি, এবং মুসা ও হারুনের অনুসারীদের রেখে যাওয়া কিছু জিনিস। সেটা ফেরেশতারা বয়ে আনবে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে তাদের জন্য এক বিরাট নিদর্শন রয়েছে, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।” [আল-বাক্বারাহ ২৪৮] এই তাবুত বা সিন্দুক নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। বাইবেলে এনিয়ে অনেক কাহিনী আছে, যেগুলোর শুদ্ধটা যাচাই করা কঠিন। Arc of Covenant নামে পরিচিত অলৌকিক ক্ষমতার এই সিন্দুকের ইতিহাস রক্তাক্ত। বেশ কয়েকবার এটি হাত বদল হয়েছে এবং যে রাজত্ব এটা জয় করেছে, সেই রাজত্ব শান্তি এবং বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছে বলে বাইবেলে অনেক ঘটনা আছে। একারণে এই অলৌকিক সিন্দুকের দখল নিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তবে মুসলিমদের জন্য এই সব ইতিহাস জানার প্রয়োজন নেই। আমাদের শুধু দেখতে হবে, এই আয়াতে আমাদের উপলব্ধি করার কী রয়েছে। কু’রআন মানুষকে গল্প বলে মনোরঞ্জন করার জন্য পাঠানো হয়নি। কু’রআনের প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি শব্দ বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যেন মানুষ নিজেদের সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে। আমরা এই আয়াত থেকে উপলব্ধি করতে পারি যে, তালুত-কে যখন নবী রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন, তখন তারা তা মেনে নিলো না। একজন নবীর নির্দেশ মানতেও তারা রাজি ছিল না। যতক্ষণ না তাদেরকে এই সিন্দুক অলৌকিকভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এথেকে শেখার হলো, কিছু নেতা থাকবে, যাদেরকে বাইরে থেকে দেখে ধর্মের অনুসারী মনে হবে। কিন্তু যখনই ধর্ম তাদেরকে নিজেদের সম্মান, স্বার্থ বিসর্জন দিতে বলবে, তখনি তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে যাবে। পরিষ্কার প্রমাণ থাকার পরেও তারা সেটা মানতে চাইবে না।
তারপর যখন তালুত তার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তখন তিনি বললেন , “আল্লাহ ﷻ তোমাদেরকে একটি নদী দিয়ে পরীক্ষা করবেন। যে সেই নদী থেকে পান করবে, সে আর আমার দলের নয়। কিন্তু যে সেটার স্বাদ নেবে না, সে আমার দলের। তবে যে এক আঁজলা পান করবে, তার দোষ হবে না।” কিন্তু কয়েকজন বাদে বাকি সবাই পেট ভরে পানি খেলো। তারপর যখন সে এবং তার সাথের বিশ্বাসীরা পার হলো, তখন তারা বলল, “আমাদের কোনো ক্ষমতাই নেই জালুত এবং তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।” কিন্তু যারা নিশ্চিত ছিল যে তারা আল্লাহর ﷻ সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, তারা বলল,“কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর ﷻ অনুমতিতে। আল্লাহ ﷻ ধৈর্য-নিষ্ঠাবানদের সাথে আছেন।” [আল-বাক্বারাহ ২৪৯] একজন নেতার জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ হলো তার বাহিনীর ভেতরে নিষ্ঠাবান অনুসারীদের চিহ্নিত করা এবং কারা তাকে প্রয়োজনের সময় অনুসরণ করবে না, সেটা আগেভাগেই বের করে ফেলা। এই মানুষগুলোকে যত আগে সম্ভব বাহিনী থেকে বের করে দিতে হবে। না হলে তারা বাহিনীর সম্পদ নষ্ট করবে, মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দেবে, তারপর দরকারের সময় নিজেরা তো পালাবেই, অন্যের মনোবলও ভেঙ্গে দেবে। তালুত তার বাহিনীর মধ্যে কে নিষ্ঠাবান, আর কে বিপদে পড়লে পিঠটান দেবে, সেটা বের করার জন্য তাদেরকে এক পরীক্ষা দিলেন। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীকে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এই যাত্রা পথে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী হলো পানি। বাহিনীর ঘোড়া, উট, গরু, হাতি, মানুষ সবার জন্য পানি দরকার। পানি হলো একটি সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই সেনাবাহিনী যখন কোনো নদী বা জলাশয় খুঁজে পায়, তারা যতটুকু পারে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে নেয়। কিন্তু তালুত তার বাহিনীকে এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষা দিলেন। চোখের সামনে নদী ভর্তি পানি টলটল করছে, কিন্তু তারা সেই পানি পান করতে পারবে না। এবং তারা সেটা করবে না শুধুই তাদের সেনাপতিকে বিশ্বাস করে, তার প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের কাছে মনে হয়েছিল যে, সেটা কোনো যৌক্তিক দাবি নয়। বাস্তবতা দেখতে হবে। এখন যুদ্ধ চলছে। সবাই তৃষ্ণার্ত। পানির এত বড় একটা সুযোগ ছেড়ে দেওয়াটা বিরাট বোকামি। এই সব ভেবে তারা সেনাপতির নির্দেশকে অমান্য করলো। এথেকেই বেড়িয়ে পড়লো তাদের মধ্যে কে সত্যিই সেনাপতির প্রতি পুরোপুরি অনুগত, আর কে নিজের প্রবৃত্তির প্রতি অনুগত। যারা এত বড় লোভ, পিপাসার কষ্ট সামাল দিতে পেরেছিল শুধুই সেনাপতির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে, তারাই ছিল প্রকৃত বিশ্বাসী অনুসারী। তারাই যুদ্ধে এসেছিল সঠিক নিয়ত নিয়ে — আল্লাহর ﷻ সন্তুষ্টি অর্জন এবং নেতার প্রতি আনুগত্যের দায়িত্ববোধ থেকে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তালুত বলেছিলেন, “কিন্তু যে সেটার স্বাদ নেবে না, সে আমার দলের।” তিনি বলেননি, যে সেটা ‘পান’ করবে না। তিনি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এক দুই আঁজলা পানি পান পান করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেটা দেখতে চাইছিলেন সেটা হলো, কে আছে যে নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে, তার আদেশ অমান্য করে পেট ভরে পানি খাবে। —এথেকেই তার বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পানি ছুঁয়ে না দেখার অবাস্তব পরীক্ষা দেননি। তার পরীক্ষা ছিল শুধুই মুনাফিক, প্রবৃত্তির দাসদের বাছাই করে ছেঁটে ফেলার পরীক্ষা। এই পরীক্ষা থেকে তালুত বাছাই করে নিলেন সেই সব নিষ্ঠাবান সৈন্যদেরকে, যারা তার সাথে যুদ্ধ করার যোগ্য। তাদেরকে নিয়ে তিনি নদী পার হয়ে যুদ্ধের ময়দানে গেলেন। সেখানে গিয়ে তাদের অনেকে জালুত এবং তার বিশাল বাহিনী দেখে আশা হারিয়ে ফেললো। অনেকেই সেখান থেকে পালিয়ে গেল, এইভেবে যে, দুই বাহিনীর মধ্যে লোকবলের এত বিশাল পার্থক্য থাকলে কোনোভাবেই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। এটা বরং আত্মহত্যা। কিন্তু তারপরেও তালুতের সাথে কয়েকজন ইস্পাত দৃঢ় মনোবলের সৈন্য ছিলেন, যারা ঈমানের এই ভয়ঙ্কর কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে তালুতের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেন। এরা এক অসাধারণ কথা বললেন— “কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর ﷻ অনুমতিতে।” আমরা অনেক সময় সঙ্ঘবদ্ধ অমুসলিম শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের তুচ্ছ মনে করি। আশা হারিয়ে ফেলি এই ভেবে যে, আমাদের পক্ষে কোনোদিনও ওদের বিরুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। ওদের আছে বিশাল বাহিনী, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ওদের দখলে। ইউনাইটেড নেশন্স ওদের কথায় ওঠাবসা করে। ওরা কোনো জায়গায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে অন্য দেশগুলোও তাদের সাথে যোগ দেয়। আর এদিকে মুসলিমরা বড়ই একা, বিভক্ত, প্রযুক্তিতে একেবারেই পিছিয়ে, অর্থনীতিতে দুর্বল, সারা পৃথিবীতে অপমানিত, ঘৃণিত। এই দুর্বল বিশ্বাস থেকে আমরা অনেকেই নিজেদের উপর অন্যায় হলে, এমনকি আক্রমণ হলেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করি না। কোনো ধরনের প্রতিরোধ করাটা আমাদের কাছে আত্মহত্যার সামিল বলে মনে হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা সময় নষ্ট মনে হয়। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে অসাধারণ এক শিক্ষা দিয়েছেন। ইতিহাসে এক বার, দুইবার নয়, বহুবার ছোট একটি দল বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেছে, যখন সেই ছোট বাহিনী ইসলাম সমর্থিত উপায়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছে। তালুত-এর যুদ্ধ, বদর-এর যুদ্ধ এগুলো সবই উজ্জ্বল উদাহরণ যে, আল্লাহ ﷻ নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সত্যিকারের ঈমানদার বান্দাদেরকে নিজে সাহায্য করেন। তার সাহায্যে ঈমানদার বান্দারা বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও অলৌকিকভাবে জয়ী হয়। সুতরাং যারা ইসলাম সম্মত আত্মরক্ষামূলক ক্বিতাল বা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, তাদের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ ﷻ তাদেরকে জয়ী করবেনই। কু’রআনেই সেই অঙ্গীকার রয়েছে। আর যারা ইসলাম সম্মত যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন না, তাদের নিয়ত যতই ভালো থাকুক না কেন, তারা আসলে নিজেরা আত্মহত্যা করে পুরো মুসলিম জাতির জন্য বিরাট ফাসাদ তৈরিতে সহযোগিতা করতে যাচ্ছেন। আয়াতের এই অংশটি উগ্রপন্থী দলরা অপব্যবহার করে মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে। তারা তাদের অবৈধ মারামারিতে সরল প্রাণ মুসলিমদের বাগিয়ে নেওয়ার জন্য আয়াতের এই অংশ ব্যবহার করে। আয়াতে এই অংশ কোট করার আগে আমাদেরকে দেখতে হবে, তারা আমাদেরকে যেই যুদ্ধে অংশ নিতে বলছে, তার সাথে এই আয়াতে তালুত-এর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কতখানি মিল রয়েছে। এই আয়াতের প্রেক্ষাপটের অনুরূপ অবস্থা তৈরি হয়েছে কি? মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে কি কোনো কাফির বাহিনী যুদ্ধ করতে এসেছে? আমরা কি সত্যিই আত্মরক্ষায় যুদ্ধ করছি? মুসলিম বাহিনীর নেতা কি রাসুল ﷺ এর এক আদর্শ অনুসারী? যিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনো নবী বা রাসুল নন। তাহলে তিনি কি তালুত-এর মতো একজন মুসলিম রাজা, যাকে আল্লাহ ﷻ এবং রাসুল পরিষ্কার কর্তৃত্ব দিয়েছেন? মুসলিম জাতি কি তার আনুগত্য মেনে নিয়েছে? —এই সব শর্ত পূরণ না করে কেউ এই আয়াতের দোহাই দিয়ে কোনো ধরনের হামলা করতে বললে বুঝতে হবে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজের কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করা। না হয় সে নিজেই ব্যাপক বিভ্রান্ত। ইসলামের সঠিক জ্ঞান তার মধ্যে নেই, অথবা তার ব্যক্তিগত আক্রোশ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তালুতের সাথে শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়া সেই সম্মানিত বিশ্বাসীরা যুদ্ধে যাওয়ার সময় আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চেয়ে যে দু’আ করেছিলেন, সেই দু’আ আল্লাহ ﷻ কু’রআনে সারা মানবজাতির জন্য বাধাই করে রেখেছেন, যা মানুষ যুগ যুগ ধরে কিয়ামত পর্যন্ত পড়ে আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাইবে—
তারপর যখন তারা জালুদ আর তার বাহিনীর সামনে দাঁড়ালো, তারা বলল, “ও আমাদের রব, আমাদের উপর ধৈর্য-নিষ্ঠা বর্ষণ করুন। আমাদেরকে দৃঢ় পায়ে অবিচল রাখুন। আমাদেরকে কাফিরদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করুন।” [আল-বাক্বারাহ ২৫০] তাদের প্রথম চাওয়া ছিল, أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا “আমাদের উপর সবর বর্ষণ করুন।” أَفْرِغْ হচ্ছে ঢেলে দেওয়া, বোতল ঢেলে খালি করে ফেলা।[৫][১] আল্লাহর ﷻ কাছে তারা শুধু সবর চাইলেন না, বরং বললেন তাদের উপর ক্রমাগত সবর বর্ষণ করে, তাদের অন্তর পূর্ণ করে দিন। যত সবর আছে, সব দিয়ে দিন। —কষ্টের সময় সবর বড়ই প্রয়োজন। আর সবর সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাঁড়িওলা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুম্মার খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।” ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামাজ পড়লেই আল্লাহ ﷻ আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা এবং কু’রআনের এই আয়াতে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু শব্দের অর্থগুলো ঠিকমত না বোঝা। সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাবো, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করবো না, এই ভেবে যে: একদিন আল্লাহ ﷻ সব ঠিক করে দেবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৭] আছে— তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল। আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৭] এর লেখা— শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার মেয়ে-জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল। উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা।[৫][৭] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর ﷻ আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪]
তারপর তারা আল্লাহর ﷻ অনুমতিতে ওদেরকে পরাজিত করলেন। দাউদ জালুতকে হত্যা করলেন। আল্লাহ ﷻ তাকে রাজত্ব, প্রজ্ঞা দিলেন, এবং তাকে তিনি যা চাইলেন শেখালেন। যদি আল্লাহ ﷻ কিছু মানুষকে দিয়ে অন্যদেরকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হতো। কিন্তু আল্লাহ ﷻ বিশ্ববাসীর প্রতি অনেক কল্যাণ করেন। [আল-বাক্বারাহ ২৫১] পৃথিবীতে কোনো জাতি অঢেল ক্ষমতা, সমৃদ্ধি, প্রাচুর্যতে থেকে ন্যায়, নিষ্ঠা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। বেশিরভাগ জাতি কয়েক যুগ যেতে না যেতেই অন্যায়, অশ্লীলতায় ডুবে গেছে। সেটা অমুসলিমদের বেলায় যেমন হয়েছে, মুসলিমদের বেলায়ও হয়েছে। একারণেই আল্লাহ ﷻ মানুষের মধ্যে কিছু দল তৈরি করেন, যারা সেই সমৃদ্ধশালী অন্যায়কারী জাতিগুলোকে পরাজিত করে আবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। আরেক জাতি তৈরি হয়। তারপর যুগ পার হয়। একসময় দেখা যায় সেই জাতি নিজেরাই আবার অন্যায়ে ডুবে গেছে। তখন আরেক দল এসে তাদেরকে পরাজিত করে আবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে। আল্লাহ ﷻ যদি এভাবে শক্তিশালী অন্যায়কারী জাতিগুলোকে বার বার পরাজিত না করতেন, তাহলে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক অন্যায় ছড়িয়ে পড়তো।
এই হচ্ছে আল্লাহর ﷻ নিদর্শন, যা তিনি তোমার (মুহাম্মাদ সা:) উপর যথাযথভাবে তিলাওয়াত করেন। তুমি অবশ্যই রাসুলদের একজন। [আল-বাক্বারাহ ২৫২] সুত্র: [১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স

এক ধর্মের উৎসব আরেক ধর্মের জন্য নয়






কাছাকাছি সময়ে এ বছর মুসলমানদের ঈদুল আযহা-কুরবানী এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর যাবতই ঈদ ও পূজা কাছাকাছি সময়ে উদযাপিত হচ্ছে। বর্তমানে শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় বরং পুরো বাংলাদেশ জুড়েই পূজার আয়োজন চলে মহা সমারোহে। প্রস্তুত হয় হাজার হাজার পূজামণ্ডপ। এসকল মণ্ডপে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই ভিড় করে না। বরং বহু মুসলমানও যায় পূজা দেখতে, কেউবা আনন্দ উপভোগ করতে। আর বেশি যান নেতা-নেত্রীরা। ছোট থেকে সর্বোচ্চ স্তরের নেতা-নেত্রীগণও যান। অথচ কয়েক বছর আগেও দৃশ্যপট এমন ছিল না।

এদেশের হিন্দুগণ তাদের এই ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন বহু বহু বছর থেকেই। তখন তা সীমিত থাকত ঢাকেশ্বরী মন্দীর ও নির্দিষ্ট কিছু মন্দীর-মণ্ডপ পর্যন্ত। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের একান্ত ধর্মীয় বিষয় বলে মুসলমানরা সেখানে যেত না। সরকারী-বেসরকারী মুসলিম নেতাদের উপস্থিতিও ছিল কম। কিন্তু বিগত কয়েক বছর থেকে যেভাবে পূজো উদযাপন হচ্ছে এবং সর্বপ্রকারের মিডিয়ায় যেভাবে এর প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে তা সম্পূর্ণই ভিন্ন। এখন পূজার সময় মনে হয় না, এটি এদেশের ১০%-১২% নাগরিকের একটি উৎসব। বরং সবকিছু দেখে মনে হতে পারে এ যেন হিন্দু-প্রধান একটি দেশ।

সে যাই হোক। পূজা যাদের, তারা সেটা নিরাপদে আর আনন্দেই পালন করুক। এসমস্ত পূজামণ্ডপে গিয়ে কিংবা পূজাকেন্দ্রিক কোনো উৎসবে উপস্থিত হয়ে জাতীয় নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন নীতিবাক্য ও উপদেশও উচ্চারণ করে থাকেন। সংখ্যালঘুরা যেন এদেশে বুক ফুলিয়ে চলতে পারেন, তারা যেন তাদের সব অধিকার নিজেরাই আদায় করে নেনÑ সেসব কথাও বলা হয়। বলা হয় তাদেরকে দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা এবং তাদের পাশে যে এ দেশের নেতারা সজাগ ও সক্রিয় আছেনÑ সেকথাগুলোও তারা বলেন। এরই সঙ্গে সম্প্রতি তারা আরেকটি কথাও বলতে শুরু করেছেন। সেটি হচ্ছে, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কোনো কোনো নেতা বলেছেন, ধর্ম সম্প্রদায়ের উৎসব সকলের। আমাদের আলোচনায় আমরা পূজাকেন্দ্রিক উৎসব নিয়ে নেতাদের মুখে উচ্চারিত এ দুটি বাক্য কিংবা এ দুটি বাক্যের মূলকথা বা নির্যাস নিয়েই কিছু আরয করতে চাই। শুরুতেই আমাদের নিবেদন হচ্ছে, যেহেতু এসব পূজা-উৎসব কিংবা অপর ধর্মীয় কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রটিতে ঈমানের প্রশ্ন জড়িত, তাই এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণটি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে হওয়াই প্রয়োজনীয়। অন্য কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক তত্ত¡ কিংবা ভাবাবেগের সাহায্য এক্ষেত্রে গ্রহণ করা সমীচীন নয়। সে হিসেবে প্রথমেই আমরা যে কথাটি পেশ করতে চাই সেটি হচ্ছে, সাধারণ যুক্তিতে কিংবা শরীয়তের আলোকে এই বাক্য দুটিকে বাস্তবসম্মত বলে সাব্যস্ত করা যায় না। কারণ, বিগত কয়েক বছর যাবৎ আমরা এই যে কথাটা শুনছি, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এটি কেবল পূজার সময়ই এবং পূজাকে উপলক্ষ করেই বলা হচ্ছে। মুসলমানদের কোনো উৎসব নিয়ে এ জাতীয় বাক্য উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। আর পূজার বিষয়টি সম্পূর্ণই ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর। যা সংশ্লিষ্ট ধর্মের লোকেরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতির ভিত্তিতে করে থাকে। এ উপলক্ষে তাদের যে উৎসব-আনন্দ সেটি সম্পূর্ণই পূজাকে কেন্দ্র করে। পূজাকে কেন্দ্র করে ‘প্রতিমা’ তৈরি করা হয়। প্রসাদ বিতরণ করা হয়। বহু রকম কেনাকাটা ও আয়োজনের সমারোহ চালানো হয়। এভাবেই পূজাকেন্দ্রিক মহা এক উৎসবের ব্যবস্থা হয়। সুতরাং এ উৎসব-আনন্দ আর ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যেকটাই একটা অপরটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই এখানে উৎসব-আনন্দের বিষয়টিকে পৃথক করে দেখা এবং পূজার বিষয়টিকে পৃথক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়গুলো আসলে পৃথক নয়।

যেমনিভাবে মুসলমানদের ঈদুল আযহায় ঈদের নামায ও কুরবানী-প্রধান দুটি কাজ। এই দুই কাজের ওপর ভিত্তি করেই আনন্দ-উৎসব করা হয়। তাই ঈদুল আযহার আনন্দ-উৎসবকে ঈদের নামায ও কুরবানী থেকে পৃথক করে দেখার সুযোগ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি ঈদের নামায ও কুরবানী করবে না (ওয়াজিব হওয়া সত্তে¡ও), তার জন্য কোনোক্রমেই ঈদুল আযহার আনন্দ-উৎসব করার অধিকার নেই। সে হিসেবে ঈদুল আযহার ব্যাপারে এখন কেউ যদি বলে, ধর্মীয় কাজগুলো মুসলমানদের হলেও এ উৎসবটা সকলের, স্পষ্টতই তা বাস্তবসম্মত হবে না। তাইতো কোনো ঈদের জামাতের আশেপাশে বা জাতীয় ঈদগাহ ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মের লোকদের সমবেত হতে দেখা যায় না। ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বোঝার জন্য ঈদুল আযহা নিয়ে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মানসিক অবস্থা বিচার করলেও যথেষ্ট হবে। তাদের কাছে গরু হলো পবিত্র পশু। এই গরু নিয়ে কত করুণ কাণ্ডই না ঘটে যাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশি হিন্দু-প্রধান দেশে। সেখানে সরকারী দলের লোকদের হাতে নিহত, নিগৃহীত হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ। শুধু গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে বা অভিযোগে। এমনকি গরুর পবিত্রতা প্রকাশ করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ(!) ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকাশ্যে স্বস্তির বাণী প্রকাশ করেছেন। এ হচ্ছে গরু সংক্রান্ত হিন্দুদের বিশ্বাস। অপরদিকে মুসলমানরা সেদিন গরু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর হুকুম পালন করে আনন্দ করে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের এই আনন্দের দিন ও উৎসবটা হিন্দুদের জন্য আনন্দের নয়। অপরদিকে আমাদের জন্য ঠিকই আনন্দের। উট-দুম্বা-ছাগল-ভেড়া-মহিষ কুরবানীর সুযোগ থাকলেও পাক-ভারত উপমহাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুরবানী দেওয়া হয় গরু। এজন্য এতদঞ্চলে কুরবানীর ঈদকেও ‘বকরীদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয। এখানে ‘বকর’ মানে গরু। এতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হল যে, এক ধর্মাবলম্বীদের ধর্মভিত্তিক উৎসবকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হিসেবে সাব্যস্ত করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।

এ বিষয়ে মৌলিক ও দ্বিতীয় আরেকটি কথা হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের কথা বা আকীদায় বিশ্বাস করার কোনো সুযোগই নেই। কারণ, ঈমান ও ইসলাম হচ্ছে একক ও নিরঙ্কুশ বিষয়। এখানে কোনো প্রকারের মিশ্রণের ন্যূনতম সুযোগ নেই। আমরা যদি আমাদের দুই ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পটভ‚মির দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টি আমাদের সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে। মদীনায় ইসলামপূর্বে দু’টি উৎসব চালু ছিল। নওরোয ও মেহেরজান নামে। সাহাবীগণ ওই দুটি উৎসব পালন করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পালনের অনুমতি দেননি। বরং এর উত্তম বিকল্প হিসেবে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র দুটি ধর্মীয় উৎসবÑ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উপহার দিয়েছেন। এ থেকে এ সত্যটি অনুধাবন করা যায় যে যদি মুসলমানদের জন্য অন্যদের উৎসব পালন করার সুযোগ থাকতো তাহলে তিনি ওই উৎসব পালন করা থেকে সাহাবীদের বিরত করতেন না।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ আমরা গ্রহণ করতে পারি। সেটি হচ্ছে ১০ মুহাররম বা আশুরার রোযা। ইয়াহুদীদের সাথে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়ে যায় সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোযার সাথে আগে কিংবা পরে আরো একটি রোযা রাখতে বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের সাথে সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য হওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ হাদীস শরীফে বার বার দেওয়া হয়েছে। ইয়াহুদীদের সাথে সামঞ্জস্য অবলম্বন না করতে কিংবা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে বিভিন্নভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীস শরীফে বেশ কিছু ক্ষেত্রে


خالفوا المشركين خالفوا اليهود

(ইয়াহুদীদের সঙ্গে ভিন্নতা অবলম্বন করো, মুশরিকদের কাজকর্মের সাথে ভিন্নতা অবলম্বন কর) বাক্যটি ধ্বনিত হয়েছে। নামাযে আহŸানের ক্ষেত্রে ইয়াহুদী, নাসারাদের ঘণ্টা বাজানো ও সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার প্রথা গ্রহণ না করা, অভিভাদনের ক্ষেত্রে হস্ত উঠানোর বিকল্প হিসাবে সালামকে গ্রহণ করা, সপ্তাহের পবিত্র দিন হিসেবে শনি, রবির পরিবর্তে জুমা বারকে গ্রহণসহ এ ধরনের বহু ক্ষেত্র বিদ্যমান যেখানে ইসলামের কার্যকলাপকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে পৃথক করা হয়েছে।

তৃতীয়ত পূজার বিষয়টিকে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে কোনো মুসলমানের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে তার সঙ্গে কোনোরকম সংশ্লিষ্টতারই সুযোগ কোনো মুসলমানের নেই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের শুরুর যুগে এ জাতীয় ধর্মাচারের বিরোধিতা করেই ইসলামের তাওহীদ তথা একত্ববাদের দিকে মানুষকে আহŸান করেছেন। এবং সকল প্রকারের মূর্তি ও পূজাকে শিরিক আখ্যা দিয়ে তা থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দিয়েছেন। সুতরাং আকীদাগত বা বিশ্বাসগত দিক থেকে একজন মুওয়াহহিদ (একত্ববাদী মুসলিম)-এর জন্য পূজা-জাতীয় ধর্মাচারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, সমর্থন করা এবং সেটিকে নিজের উৎসবের বিষয় মনে করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।

তবে এক ধর্মের সাথে অপর ধর্মের অনুসারীদের সহাবস্থান এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের আপন আপন পূজা-আরাধনা নির্বিঘেœ পালন করতে সহযোগিতার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। ইসলাম এতে পূর্ণ সমর্থন দেয় ও দায়িত্ব গ্রহণ করে। মাসিক আলকাউসারে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়েই আমরা আলোচনা করেছি। ইসলামের স্পষ্ট নীতি হচ্ছে, যে কোনো ধর্মাবলম্বী নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে তার ধর্ম পালন করুক। নিজস্ব পরিধির মধ্যে তার ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা তার রয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে কোনো প্রকার অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। বরং তাদের নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে থেকে এগুলো পালন করার জন্য ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দেয়া হয়েছে ইসলামী খেলাফতের সময়গুলোতে। হযরত উমর রা. তাঁর শাসনামলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের كنيسة (কানীসা) বানানোর সুযোগও দিয়েছেন। সুতরাং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার এবং ধর্মীয় আচার-আচরণকে এক করে দেখার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব। এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব ও আনন্দও তাদের নিজস্ব। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যদের ধর্মীয় কাজে যোগ দেওয়া, সেগুলোকে পছন্দ করা, সে উৎসবকে নিজের উৎসব মনে করার কোনো একটি বিষয়ই শরীয়ত কর্তৃক সমর্থিত নয়।

মূলত অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সহাবস্থান, নিজস্ব পরিধির মধ্যে তাদের ধর্মপালন ও পালনের অধিকার একটি সমর্থিত ও স্বীকৃত বিষয়। এটি ইসলামেরই নীতি। কিন্তু অপর ধর্মের ধর্মীয় আচার এবং ধর্মভিত্তিক উৎসবকে নিজের উৎসব মনে করা কিংবা সে উৎসবে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অংশ নেয়া সম্পূর্ণ অসমর্থিত, অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবহিভর্‚ত। মূর্তিপূজা সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান-উৎসবে কোনো মুসলমানের পক্ষে এভাবে একাত্মবোধ করার কোনো অবকাশই নেই। এটা ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা এবং ভিত্তিগত চেতনারও বিরোধী।


পরিশেষে দু’তিনটি হাদীস ও আসার পেশ করে নিবন্ধ শেষ করছি। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন,

من تشبه بقوم فهو منهم

‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভ‚ক্ত বলে গণ্য হবে।’ Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১

অন্য একটি বর্ণনায় খলীফা হযরত উমর রা. বলেছেন, اجتنبوا أعداء الله في عيدهم তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাক। Ñআস্সুনানুল কুবরা, হাদীস ১৮৮৬২

অন্য বর্ণনায় তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন ‘কারণ এক্ষেত্রে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাযিল হয়ে থাকে।’ আরেকটি বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেছেন

من بنى ببلاد الأعاجم وصنع نيروزهم ومهرجانهم وتشبه بهم حتى يموت وهو كذلك، حشر معهم يوم القيامة.

অর্থাৎ যারা বিধর্মীদের মত উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ঐ লোকদের সাথেই হবে। Ñআস্সুনানুল কুবরা, হাদীস ১৫৫৬৩

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন। এবং সকল শিরক-মিশ্রণ হতে মুক্ত থেকে খালেছ মিল্লাতে ইব্রাহীমীর ওপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন। 



Ad Code

Responsive Advertisement