Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

মুসলিম বোনদের যা অনুধাবন করা দরকার

প্রতিটি মুসলিম বোনের জন্য অপরিহার্য হলো ইসলাম তার কাছে কী চায় তা জানা। আল্লাহর অভিপ্রায় উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত হওয়া। ইসলাম চায় মানুষের চেতনা পরিচ্ছন্ন রাখতে। চায় নারীকে ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে রাখতে। ইসলাম নিশ্চিত করে নারীর ইহকালীন সার্বিক নিরাপত্তা এবং পরকালীন মুক্তি। ইসলাম এমন একটি পুণ্যময় সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট, যেখানে মানুষের সহজাত লালসাকে উদ্বিপ্ত করা হয় না। উত্তেজিত করা হয় না তার কাম প্রবৃত্তিকে। এতে বরং সর্বত্র বিদ্যমান ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। এটি সুন্দর পথ বেষ্টিত। উত্তম চরিত্র মাধুর্যের বর্মে সুরক্ষিত। ইসলামে যথাযথভাবে লক্ষ্য রাখা হয় নারী-পুরুষের দৈহিক, মানসিক ও প্রাকৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতি। ইসলাম তাই প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। প্রত্যেকের অধিকার ও প্রাপ্যও সুস্পষ্ট বলে দিয়েছে। নারী বা পুরুষ- কেউই যাতে রিপুর তাড়নায় বিপথগামী, ধ্বংসের পথযাত্রী না হয় সেজন্য এই দীন বিয়েকে বানিয়েছে সর্বোত্তম ব্যবস্থা আর বৈবাহিক সম্পর্কের সৌন্দর্যকে বানিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। আর নারী-পুরুষের জন্য হারাম করেছে ব্যভিচার ও এর প্রতি প্ররোচনা দানকারী এবং এর ইন্ধনদাতা সবকিছু। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন :  -

আর তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ। (সূরা বানী ইসরাঈল: ২৩)

 এ লক্ষ্যে নারীর জন্য করেছে পর্দা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্দেশ দিয়েছে তাদের গৃহাভ্যন্তরে থাকতে, নিষিদ্ধ করেছে সব ধরনের বেহায়া ও বেলেল্লপনা। এদিকে পুরুষদের আদেশ দিয়েছে তাদের কাছে আসার আগে অনুমতি গ্রহণ করতে। বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ থেকে নিজেকে সংযত করতে। কারণ, উভয় লিঙ্গের মধ্যেই প্রোথিত করা হয়েছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজাত আকর্ষণ। আল্লাহ তাআলা তা করেছেন মানব প্রজাতির বংশবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার স্বার্থে। এরই ভিত্তিতে নারী-পুরুষ উভয়ের রয়েছে তাদের স্বভাব-প্রকৃতি ও জৈবিক চাহিদা অনুপাতে প্রয়োজনীয় ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা। যেহেতু বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ দুর্বার ও দুর্দমনীয় বিষয়। আর প্রাণীজগতে- মানুষ যার শ্রেষ্ঠতম জাতি- উভয়ের মাঝে এ প্রবল ঝোঁকের অনেক কারণও বিদ্যমান, তাই ইসলাম এই আকর্ষণের উত্তাপকে আপাত শীতল এবং এ প্রবণতার বহ্নিকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়েছে। এটিকে শালীন ও শোভনীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রেখেছে। যাতে তার প্রয়োগ ঘটে কেবল পবিত্র ও নিরাপদ ক্ষেত্রে। সেহেতু সব পরপুরুষ থেকে নারীর জন্য তার আল্লাহ প্রদত্ত ও অর্জিত সৌন্দর্য তথা সারা দেহ আবৃত রাখার বিধান বা শরয়ী পর্দা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাতে সে সুরক্ষিত থাকে দুর্বিনীত দৃষ্টি থেকে। একইভাবে তার জন্য সকল উত্তেজক আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এবং উলঙ্গপনা ও সৌন্দর্য প্রদর্শনকে বড় অপরাধ বিবেচনা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য, তাকে লাঞ্ছনা, স্বেচ্ছাচারিতা, অবাধ মেলামেশা, সন্দেহপূর্ণ বন্ধুত্ব ও বিষাক্ত হাস্য-রসিকতা থেকে উন্নত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রাখা। আল্লাহ  তায়ালা বলেন,  -

হে নবী পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোন নারীর মত নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আল-আহযাব: ৩২-৩৩)

এখানে নবীপত্নীগণ ও তাঁদের পরবর্তী সকল মুমিন নারীকে সম্বোধন করা হয়েছে। ইসলাম এ পন্থা অবলম্বন করেছে পর্দা, পবিত্রতা ও লজ্জার প্রচারে। অবনত দৃষ্টি, লজ্জাস্থান হেফাজত, নারী-পুরুষের আত্মিক শূচি রক্ষায়। নারীর প্রতি যৌন লোলুপতা রুখতে। ফিতনা-ফাসাদ ও সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং ভুল বোঝাবুঝি থেকে তাকে দূরে রাখতে। নারীরা হলেন ইসলামী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মৌল। কারণ, তাদের ওপরই ন্যস্ত আগামী প্রজন্মের আবেগ-অনুভূতি এবং চিন্তা-চেতনাকে সুস্থ ও অমলিন রাখার দায়িত্ব। প্রবৃত্তি তথা রিপুর তাড়না ও অধোমুখী পাশবিক আচরণের দূষণ থেকে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার সুকঠিন যিম্মাদারিও অর্পণ করা হয়েছে তাদের ওপর। এভাবেই নারীরা অবদান রাখেন সমাজকে পবিত্র করতে এবং এর প্রকৃত সম্পদ ও মর্যাদা অটুট ও অক্ষুণ্ন রাখতে। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা মুসলিম নারীদের ওপর এসব দায়িত্ব অর্পণ করে, এর মাধ্যমে তাদের সম্মানিত বানিয়ে তাদেরকে চরিত্রহীনতার সব ধরণের সংশ্লেষ এবং অশান্তি সৃষ্টিকারী ক্ষুধার্ত পুরুষের চোরা দৃষ্টির আওতা থেকে যোজন দূরে অবস্থানে করার নির্দেশ দিয়েছেন। উপরন্তু তাদেরকে পাপাচারীদের নাগাল থেকে আপন ইজ্জত-আব্রু রক্ষার উপদেশও দিয়েছে এই পবিত্র ধর্ম। তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বৈধ ক্ষেত্র ছাড়া আপন লজ্জাস্থানকে যে কোনো মূল্যে সুরক্ষিত রাখতে। তবে হ্যা, আল্লাহ তায়ালা সম্মানিতা মহিলাদের জন্য সৌন্দর্যচর্চাও বৈধ করেছেন। কেন নয়, তিনিই তো তাদের স্বভাব এমন বানিয়েছেন যে, তারা সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য চর্চা করতে পছন্দ করে। ইসলাম এই সহজাত আগ্রহকে অস্বীকার বা অবদমন করে না। বরং একে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে। সে যেন তার সমুদয় রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য সুধা দিয়ে একমাত্র স্বামীরই হৃদয় হরণ করে। নারী যখন তার কমনীয়তা ও মোহময়তা স্বামীতেই সমর্পণ করে, তখন তা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় এবং ছাওয়াবের কাজ। এদিকে ইঙ্গিত করে হাদীছে যেমন বলা হয়েছে,

  • আবূ যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  -‍‍আর তোমাদের লজ্জাস্থানেও রয়েছে সদকা। সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের কেউ তার যৌন চাহিদা মেটাবে আর তাতেও তার জন্য ছাওয়াব হবে? তিনি বললেন, তোমরা কি মনে করো সে যদি তা হারাম জায়গায় মেটায় তবে কি তার সে থেকে গুনাহ উপার্জিত হবে না? (অবশ্যই হবে) ঠিক সেভাবেই যখন সে তা হালাল জায়গায় মেটাবে, তার জন্য ছাওয়াব লেখা হবে। (মুসলিম: ৬০০১; মুসনাদ আহমদ: ২১৫১১)  
  • আল্লাহ তায়ালা মুমিন নারীদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। আপন ইজ্জত রক্ষা করে এবং আকর্ষণীয় অঙ্গগুলো আবৃত রাখে। যাতে কোনো অসুস্থ অন্তর বা অসংযত দৃষ্টির অধিকারী পুরুষ তার টিকিটিও স্পর্শ করতে না পায়। তিনি বলেন,  - 

    আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। (সূরা আন-নূর: ৩১)

    একজন মুমিন নারী যার হৃদয় আল্লাহর নূরে উদ্ভাসিত, সে কখনো আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যে ছাড় দেয় না। সে কখনো আল্লাহ ও তদীয় রাসূল নির্দেশিত বিষয় পালনে কিংবা তাঁদের নিষেধকৃত বিষয় বর্জনে পিছপা হয় না। যদিওবা তার মন চায় রূপ প্রদর্শন করতে এবং সৌন্দর্য প্রকাশ করতে। কারণ, সজীব আত্মাধারী নারীরা পূর্বসূরী পুণ্যাত্মা নারীদেরই আদর্শ মানেন। যাদের সম্পর্কে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, 


    • আল্লাহ হিজরতকারী অগ্রবর্তী নারীদের ওপর রহমত করুন। যখন তিনি নাযিল করলেন,‌‌‌‌ আর তারা যেন তাদের বক্ষের ওপর ওড়না টেনে দেয়’ তখন তারা তাদের নিম্নাংশের কাপড়ের প্রান্ত ছিড়ে ফেলেন এবং তা দিয়ে ওড়না বানিয়ে নেন। (বুখারী: ৮৫৭৪)

      আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হজ অবস্থায় তাদের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকে অনুমান করা যায় পর্দা রক্ষায় তাঁরা কতটা আন্তরিক ছিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, -

      • আমরা ইহরাম অবস্থায় সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আরোহীরা আমাদের সঙ্গে পথ চলছিলেন। যখন তারা আমাদের আড়াআড়ি হন, আমাদের সঙ্গীনীরা তাদের বড় চাদর মাথা থেকে চেহারায় ঝুলিয়ে দেন। তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যাবার পরই আমরা তা উন্মুক্ত করি। (আবূ দাঊদ : ৫৩৮১; বাইহাকী : ৩৩৮৮)।

        ভেবে দেখুন, পর্দা রক্ষায় তাঁরা কতটা সচেতন যে হজের সময়ও (যেখানে সাধারণত: মহিলাদের মুখ খোলা রাখতে হয় সেখানেও) এ ব্যাপারে তাঁরা শৈথিল্য দেখাতেন না। প্রিয় মুমিন বোন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সম্মানিত করেছেন। তোমার মর্যাদা উন্নীত করেছেন। তোমার রুচিকে মার্জিত করেছেন। তোমার সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন অনুভূতি দান করেছেন। তাই যে যুক্তিতেই হোক না কেন তুমি নিজেকে দেহ প্রদর্শনী ও পশুসুলভ উলঙ্গপনার জন্য প্রস্তুত করো না। আল্লাহ তাআলা তোমার ওপর অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন, তোমাকে লাজুকতার ভূষণ এবং লজ্জা ও সৌন্দর্যের আবরণ দান করেছেন। যেখানে সর্ব সাধারণের রুচি বিকৃতি এবং পশু বৃত্তির প্রভাবে নগ্নতা ও উলঙ্গপনায় আগ্রহের আতিশয্য দেখা যাচ্ছে, সেখানে তোমার রুচিকে তিনি একজন মুমিন নারীর উপযুক্ত বানিয়েছেন। তোমার অনুভূতি পরিচ্ছন্ন আর চেতনা পরিশুদ্ধ।প্রিয় ভগ্নী, তুমি তো আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বেচ্ছায় অগ্রসর হয়েছো। সৎ কাজের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে এসেছো। অবাধ্যাচারিনীরা যেখানে বল্গাহীন বিচরণ করছে, পাপাচারিণীরা যেখানে সৌন্দর্যের প্রদর্শনী আর পাপের ফেরি করে করে ফিরছে, সেখানে তুমি দীনী বাধ্যবাধকতা ও আল্লাহর দাসত্বের দাবী পূরণ করে বিভ্রান্তির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছো। ফিতনার উৎসসমূহ উপড়ে ফেলেছো। দিয়েছো তাড়িয়ে উত্তেজনা ও উম্মক্ততাকে। অবিচল থেকেছো সম্মান ও মর্যাদার পথে। আঁকড়ে ধরেছো হেদায়েত নামের পাথেয়। আগ্রণী থেকেছো শূচিতা ও পবিত্রতায়। ধরে রেখেছো পর্দা ও লজ্জার ভূষণ। আখলাকের মাধ্যমে প্রমাণ দিয়েছো আল্লাহর প্রকৃত দাসত্বের। আর নমুনা হয়েছো নিম্নোক্ত আল্লাহর বাণীর : -

        পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের ওপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযাতকারিণী ওই বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযাত করেছেন।“(সূরা আন-নিসা: ৩৪) 
         হে ঈমানের দৌলতধন্য বোন, আল্লাহ ও রাসূলের দৃষ্টি নত রাখা এবং লজ্জাস্থান হেফাযতের নির্দেশ তোমার হৃদয় ধারণ করেছে। তোমার অমলিন আত্মাকে সুরেলা কণ্ঠে কথা বলা ও সশব্দ পদবিক্ষেপে চলা থেকে, তেমনি দাঙ্গা-বিশৃঙ্খলায় উস্কানিদাতা শয়তানি প্ররোচনা প্রভাবিত কথা বা কর্ম থেকে নিবৃত রেখেছো। বস্তুত তুমি নিজেকে পূর্বসুরী নেককার, সাহাবীয়া ও মুমিন জননী পুণ্যবতীদের আদর্শে গড়ে তুলেছো। ফলে তা পরিণত হয়েছে তোমার অবিচ্ছেদ্য স্বভাবে। সম্মান ও মর্যাদা এবং সুষমা ও শূচিতার ভূষণে তুমি নিজেকে অলংকৃত করেছো। আর এসবকে গ্রহণ করেছো তুমি নিজের পালনীয় বিধান বলে। বস্তুত এসবে কোনো মুমিন নারীর জন্য দ্বিমত করার অবকাশ নেই। যেমন বোঝা যায় নিচের আয়াত থেকে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,  -

        আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। (সূরা আল-আহযাব: ৩৬)
         প্রিয় ভগ্নী, নিশ্চয় এটি আনুগত্যের সৌভাগ্য, যা দিয়ে তুমি তোমার মর্যাদা অটুট রাখবে। অন্তর পবিত্র এবং চরিত্র মাধুর্যকে উজ্জ্বলতর করবে। শুভ্রতা ও শুদ্ধতায় নিজেকে অলংকৃত করবে। আল্লাহর এ আনুগত্য ও দাসত্ব দিয়েই অধঃপতিতদের লিপ্সাকে বিচূর্ণ এবং শয়তানী লালসার জিভকে সংবরণ করবে। প্রিয় বোন, পুরুষদের কামার্ত ভিড় থেকে দূরত্ব অবলম্বনকারী, জীবন্ত হৃদয় পর্দাকারী যে নিজেকে যাবতীয় অপদস্ততা ও নীচুতা থেকে রক্ষা করে, তার অবস্থা দেখ, কী তার সম্মান-মর্যাদা, কী তার ভক্তি ও শ্রদ্ধা। আর এর সঙ্গে তুলনা করে দেখ সর্বত্রগামী প্রদর্শনপ্রিয় নির্লজ্জ, অপমানিত ও লাঞ্ছিত নারীর অবস্থা। এ দুই শ্রেণীর নারীদের মাঝে বিস্তর ব্যবধান এবং যোজন ফারাক। তুমি আল্লাহ তাআলার বর্ণনা দেয়া মাদায়েনের সে বৃদ্ধের দুই কন্যার সাদৃশ্য অবলম্বন করো। কুরআনে যার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে:  -

        অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন লাজুকভাবে হেঁটে তার কাছে এলো.... (সূরা আল-কাসাস: ২৫) 
        দেখ কী আদব, কী লাজুকতা ! আর কেমন আত্মিক শূচিতা! ঘটনাটি চিন্তার সঙ্গে সবিস্তারে পড়ে দেখ। জানতে পারবে সত্যিকার পুণ্যবতীরা কেমন সুরক্ষিত থাকেন। দেখো সলাজ পদবিক্ষেপে এসে কেমন বিনয়ভরা কণ্ঠে তিনি বাবার নির্দেশ পালন করলেন। কুরআনের ভাষায় তার উক্তি ছিল এমন,  -

        আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, আমাদের পশুগুলোকে আপনি যে পানি পান করিয়েছেন তার বিনিময়ে। (সূরা আল-কাসাস: ২৫) 
        অতএব, আসুন হে প্রিয় বোন, পুরুষ হৃদয়ে ঝড়তোলা লাস্যময় চলন আর মনোযোগ আকৃষ্ট করা কোমল বচন ত্যাগ করি। আল্লাহর কাছে এ থেকে তাওবা করি। তাওবা করি অশ্লীল পোশাক ও সৌন্দর্য বিকাশকারী লেবাস থেকে। তাওবা করি পুরুষদের সাদৃশ্য গ্রহণ, পুরুষদের বেশ ধারণ থেকে। আসুন হে বোন, আল্লাহর নির্দেশ মত পরিপূর্ণ পর্দা ও পবিত্রতার জীবন যাপন করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার মা-বোনকে ইসলামের প্রথম যুগের নেককার নারীদের মতো পর্দানশীল ও দীনদার হবার তাওফীক দিন। মহান আল্লাহ তাদের সকলকে পঙ্কিল জীবনের স্পর্শ থেকে দূরে রাখুন। আমীন।    

দায়াতের জন্য দলল /সংগঠন

আল্লাহ ও তার রসূলের অনুগত আলেম ও দাঈর নির্দিষ্ট পরিচয়ের কোন রঙ নেই। ইবনুল কাইয়্যেম (রঃ) অনুগত বান্দার লক্ষণ উল্লেখ ক’রে বলেন, “সে কোন নির্দিষ্ট (দলীয়) নামের বাঁধনে নিজেকে বাঁধে না, কোন পরিকল্পনা বা প্রতীকের ফাঁদে সে ফাসে না, কোন নির্দিষ্ট নাম বা পরিচ্ছদে সে সুপরিচিত হয় না এবং মনগড়া কল্পিত পদ্ধতি ও নীতিও সে মানে না। বরং যখন সে জিজ্ঞাসিত হয় যে, “তোমার গুরু কে?” তখন বলে, রসূল।” “তোমার নীতি কী?” বলে, ‘অনুসরণ।” “তোমার পরিচ্ছদ কী?” বলে, “সংযম (তাকওয়া)৷” “তোমার মযহাব কী?” বলে, (ক্বুরআন ও সুন্নাহর প্রতিষ্ঠা)।” “তোমার উদ্দেশ্য কী?” বলে, “আল্লাহর সন্তুষ্টি।” “তোমার খানকাহ কোথায়?” বলে, “মসজিদ।” “তোমার বংশ কী?” বলে, “ইসলাম।” শায়খ বাকর আবু যায়দ তালেবে ইলমকে সম্বোধনপূর্বক অসিয়ত ক’রে বলেন, ‘ইসলাম (আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ) ও সালাম (শান্তি) ছাড়া মুসলিমদের আর কোন নিদর্শন নেই। অতএব হে তালেব ইলম!! আল্লাহ তোমার মধ্যে ও তোমার ইলমে বারকত দান করুন। ইলম সন্ধান কর। আমল অন্বেষণ কর এবং আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান কর সলফের পথ ও পদ্ধতিমতে। কোন জামাআতে (দলে বা সংগঠনে) প্রবেশ করো না। তা করলে প্রশস্ততা থেকে তুমি সংকীর্ণ খাচায় বন্ধ হয়ে যাবে। ইসলামের পুরোটাই তোমার জন্য চলার পথ ও জীবন-পদ্ধতি এবং সমগ্র মুসলিমরাই এক জামাআত। আর আল্লাহর হাত জামাআতের উপর। যেহেতু ইসলামে কোন দলাদলি নেই। আমি তোমার জন্য আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি যে, তুমি যেন বিছিন্ন হয়ে বিভিন্ন বাতিল ফির্কা, জামাআত, মাযহাব এবং অতিরঞ্জনকারী দলের মাঝে দৌড়ে না যাও, তার উপর তুমি তোমার সম্প্রীতি ও বিদ্বেষের বুনিয়াদ না রাখ। সুতরাং তুমি রাজপথের তালেবে ইলম হও, সুন্নাহর অনুসারী হও, সলফের (সাহাবাবৃন্দের) পদাঙ্কানুসরণ কর, সজ্ঞানে আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান কর। মানীদের মান ও অগ্রগামিতা স্বীকার কর। জেনে রেখো, অভিনব গঠন ও গতিভিত্তিক দলাদলি— যা সলফের যুগে পরিচিত ছিল না।–তা ইলমের পথে প্রধান প্রধান প্রতিবন্ধকসমূহের অন্যতম এবং জামাআত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ। যেহেতু এই দলাদলিই ইসলামী সংহতির রজজুকে কত ক্ষীণ ক’রে ফেলেছে এবং এরই কারণে মুসলিম সমাজে কত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমার প্রতি সদয় হন, তুমি বিভিন্ন দল ও ফির্কা থেকে সাবধান হও; যার চক্রান্ত ও দুরভিসন্ধি সুস্পষ্ট। এ সমস্ত দল তো গৃহছাদে সংযুক্ত পানি নিকাশের পাইপের মত, যা ঘোলা পানি সমূহকে (নিজের মধ্যে একত্রে) জমা করে এবং নিরর্থক বর্জন করে। তবে হ্যা, তোমার প্রতিপালক যার প্রতি করুণা করেছেন, ফলে সে নবী ﷺ ও তার সাহাবাবৃন্দের পথে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” (তাসনীফুন্নাস) সুতরাং দাঈর উচিত, দলাদলির ছোবল থেকে দূরে থাকা। দলাদলি থেকে সেইরূপ দূরে পলায়ন করা, যেমন বাঘ দেখে দূরে পলায়ন করা হয়। সত্যিকারের একজন আলেম হবেন। উদার মনের, ভিতর-বাহির সমান পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের। পরন্তু কোন দলের কবলে পড়লে তার হৃদয়ে বিদ্বেষ, রেষারেষি, খোটা-খোচা ও পরচর্চার নিরাপদ স্থান লাভ করবে। কারণ ফির্কাবন্দী ও দলাদলি স্বামী-স্ত্রীর মাঝেও বিচ্ছেদ ঘটায়। দাঈ কোন নির্দিষ্ট দল বা জামাআতের হলে তিনি দাওয়াতের ময়দানে অনেক লোককে হারাবেন। নির্দিষ্ট নাম ও প্রতীক ব্যবহার ক’রে দাওয়াত দিলে অনেক মানুষ তার নিকট থেকে দূরে সরে যাবেন। আহলে ইলম হলে তার মূল্যবান ইলম থেকে বহু মুসলমান বঞ্চিত হয়ে যাবেন। অথচ তা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনেক দল ও জামাআত সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীনকালে বহু ফির্কা প্রকাশ পেয়েছে, যেমন খাওয়ারিজ, মু’তাযিলা, জাহমিয়্যাহ, শিয়া প্রভৃতি। বর্তমান যুগেও বহু ফির্কা ও জামাআত নিজ নিজ সঠিকতার দাবী নিয়ে ময়দানে কাজ করছে। দাঈর উচিত, সে সকল ফির্কা ও জামাআতকে ডানে-বামে ফেলে রেখে সরল পথে সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া। হুযাইফাহ বিন য়্যামান বলেন, লোকেরা আল্লাহর রসূল ﷺ কে ভাল ও মঙ্গল বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করত, আর আমি ভূক্তভোগী হওয়ার আশঙ্কায় অনিষ্ট ও অমঙ্গল বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম। একদা আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা মূর্খতা ও অমঙ্গলে ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে এই মঙ্গল দান করলেন। কিন্তু এই মঙ্গলের পর আর অমঙ্গল আছে কি?” তিনি বললেন, “হ্যা, আছে।” আমি বললাম, অতঃপর ঐ অমঙ্গলের পর আর মঙ্গল আছে কি?” তিনি বললেন, “হ্যা, আর তা হবে ধোঁয়াটে” (অর্থাৎ, বিশুদ্ধ ও খাটি মঙ্গল থাকবে না। বরং তার সাথে অমঙ্গল, বিঘ্ন, মতানৈক্য এবং চিত্ত-বিকৃতির ধোঁয়াটে পরিবেশ থাকবে।) আমি বললাম, তার মধ্যে ধোঁয়াটা কি?” তিনি বললেন, “এক সম্প্রদায় হবে, যারা আমার সুন্নাহ (তরীকা) ছাড়া অন্যের সুন্নাহ (তরীকা) অনুসরণ করবে এবং আমার হেদায়াত (পথনির্দেশ) ছাড়াই (মানুষকে) পথপ্রদর্শন করবে। যাদের কিছু কাজকে চিনতে পারবে (ও ভালো জানবে) এবং কিছু কাজকে অদ্ভূত (ও মন্দ) জানবে।” আমি বললাম, “ঐ মঙ্গলের পর আর অমঙ্গল আছে কি?” তিনি বললেন, “হ্যা, (সে যুগে) জাহান্নামের দরজাসমূহে দন্ডায়মান আহবানকারী (আহবান করবে)। যে ব্যক্তি তাদের আহবানে সাড়া দেবে, তাকে তারা ওর মধ্যে নিক্ষিপ্ত করবে।” আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে তাদের পরিচয় বলে দিন।” তিনি বললেন, “তারা আমাদেরই চর্মের (স্বজাতি) হবে এবং আমাদেরই ভাষায় কথা বলবে।” আমি বললাম, “আমাকে কি আদেশ করেন -যদি আমি সে সময় পাই?” তিনি বললেন, “মুসলিমদের জামাআত ও ইমাম (নেতা)র পক্ষাবলম্বন করবে।” আমি বললাম, কিন্তু যদি ওদের জামাআত ও ইমাম না থাকে?” তিনি বললেন, “ঐ সমস্ত দল থেকে দূরে থাকবে; যদিও তোমাকে কোন গাছের শিকড় কামড়ে থাকতে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার ঐ অবস্থাতেই মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ৫৩৮২নং) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ বলেন, একদা রসূল ﷺ স্বহস্তে একটি (সরল) রেখা টানলেন, অতঃপর বললেন, “এটা আল্লাহর সরল পথ।” তারপর ঐ রেখাটির ডানে ও বামে আরো অনেক রেখা টেনে বললেন, “এই হচ্ছে বিভিন্ন পথ, যার প্রত্যেকটির উপর রয়েছে শয়তান, যে ঐ পথের দিকে আহবান করে (দাওয়াত দিতে) থাকে।” অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ- وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ অর্থাৎ, নিশ্চয় এটিই আমার সরল পথ, সুতরাং এরই অনুসরণ কর ও বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না। করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দান করেছেন যেন তোমরা সাবধান হও। (সূরা আনআম ১৫৩ আয়াত, আহমাদ, হাকেম, মিশকাত ১/৫৯) আল্লাহর রসূল ﷺ বলেন, “ইয়াহুদী একাত্তর দলে এবং খ্রিস্টান বাহাত্তর দলে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। আর এই উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। যার মধ্যে একটি ছাড়া বাকী সব ক’টি জাহান্নামী হবে।” অতঃপর ঐ একটি দল প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, “তারা হল জামাআত। যে জামাআত আমি ও আমার সাহাবা যে মতাদর্শের উপর আছি, তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (সুনান আরবাআহ, মিশকাত ১৭১-১৭২, সিলসিলাহ সহীহাহ ২০৩, ১৪৯২নং) ইরবায বিন সারিয়াহ (রযিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল ﷺ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে আমার পরে জীবিত থাকবে, সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ (পথ ও আদর্শ) এবং আমার পরবর্তী সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ অবলম্বন করো। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, দাঁতে কামড়ে ধরো। আর দ্বীনে নবরচিত কর্ম থেকে সাবধান থেকো। কারণ প্রত্যেক নবরচিত (দ্বীনী) কর্মই হল ‘বিদআত’। আর প্রত্যেক বিদআতই হল ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ আবু দাঊদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৮১৫ নং ইবনে মাজাহ মিশকাত ১৬৫নং) বলা বাহুল্য, উপর্যুক্ত হাদীসসমূহে সিরাতে মুস্তাকীম” তথা সাহাবা ও সলফে সালেহীনের পথ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এবং সেই সাথে নানা ফির্কা থেকে দূরে থাকতে তাকীদ করা হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, সেই রাজপথের পথিক হওয়া, যে পথ বড় উজজল, যে পথের রাতটাও দিনের মতো। সেই মেরুদন্ডসম পথকেই সালফিয়াত বলা হয়। যেহেতু সে পথের পথিকরা সলফ তথা সাহাবাগণের বুঝ অনুসারে কুরআন-হাদীস বুঝে। যাদের পথ অবলম্বন ছাড়া মুসলিম বেহেশতের পথ পেতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং বিশ্বাসীদের পথ ভিন্ন অন্য পথ অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ফিরিয়ে দেব, যেদিকে সে ফিরে যেতে চায় এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব। আর তা কত মন্দ আবাস! (নিসাঃ ১১৫) এখানে জেনে রাখা ভাল যে, সালাফিয়াত কোন মযহাব বা ফির্কার নাম নয়। এ হল প্রকৃত ও আসল ইসলামের নাম। মুসলিমদের নানা মত ও নানা পথ হওয়ার সময় যে ব্যক্তি সলফদের মত ও পথ অবলম্বন করে, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত ও আসল মুসলিম। পক্ষান্তরে যদি কেউ জানতে চায় যে, সালাফীদের নেতা কে? তাহলে তার জেনে রাখা উচিত যে, সাহাবাদের নেতা শেষ নবী মুহাম্মদ ﷺ । আর সে যদি তাদের পথ ধরে চলে, তাহলে সেও সালাফী, অর্থাৎ সেই আসল মুসলিম। তারা এবং তার অনুসারীরাই হল (হাদীসে বর্ণিত) ‘জামাআত”। তারাই হলেন নানা ‘আহলে বিদআহ ও ফুরক্বাহ’র মাঝে ‘আহলে সুন্নাহ অলজামাআহ’। তারাই হলেন ‘জামাআতুল মুসলিমীন’। নানা আক্কেলপন্থীদের মাঝে তারাই হলেন সুন্নাহ বা হাদীসপন্থী। তাদেরকেই “আহলে সুন্নাহ বা হাদীস বা আষার” বলা হয়। যেহেতু অন্যেরা যখন আক্কেল থেকে দলীল দেয়, তখন তারা সুন্নাহ ও হাদীস থেকে দলীল পেশ করেন। অন্যেরা যখন অন্যের ‘সুন্নাহ’ (তরীকা)কে অবলম্বন করে, তারা তখন নবীর ‘সুন্নাহ’ ও তরীকাকে অবলম্বন করেন। অন্যেরা মতভেদের সময় যখন ‘অমুক-তমুক’-এর পক্ষাবলম্বন করেন, তারা তখন নবী ও তার সাহাবার পক্ষাবলম্বন করেন। কোন মতভেদের সময় যখন অন্যেরা ‘অমুক-তমুক’-এর পক্ষপাতিত্ব করে, তখন তারা কেবল কিতাব ও সুন্নাহর পক্ষপাতিত্ব করেন। মতভেদ তো হতেই পারে, তা বলে কি তার ফায়সালা নেই? অবশ্যই আছে। অন্যেরা অন্যের ফায়সালা মানে, আর তারা মানেন আল্লাহ ও তার রসূলের ফায়সালা। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا অর্থাৎ, হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসূল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (ও উলামা)দের অনুগত হও। আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (নিসাঃ ৫৯) তারাই হলেন জামাআত। এক রাষ্ট্রে একই নেতার নেতৃত্তে ঐক্যবদ্ধ জামাআত অথবা নবী ও সাহাবার পথের অনুগামী জামাআত, চাহে তার সংখ্যা কম হোক বা বেশি। যেহেতু অনুগামীদের সংখ্যাধিক্য হকের দলীল নয়। সংখ্যায় কম হলেও কষ্টিপাথরে যারা হকপন্থী, তারাই হকপন্থী। আর হকপন্থীর সংখ্যা কমই হয়ে থাকে; যেমন কুরআন-হাদীসে সে কথার বহু প্রমাণ রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রযিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) বলেন, ‘হকের অনুসারীই হল জামাআত, যদিও তুমি একা হও” (ইবনে আসাকের মিশকাত ১/৬১ টীকা নং ৫) সেই জামাআতই হল ‘ফির্কাহ নাজিয়াহ ও তায়েফাহ মানসূরাহ”। এই দলের ব্যাপারেই প্রিয় নবী ﷺ বলেছেন, “সর্বকালে আমার উম্মতের একটি দল হকের সাথে বিজয়ী থাকবে, তাদেরকে যারা উপেক্ষা করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না; যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্ব মুহুর্ত) এসে উপস্থিত হবে।” (মুসলিম) ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদেরকে যে যে উপাধি দিয়ে ভূষিত করা হয়েছে, তা কিন্তু কোন স্থান-কাল-পাত্রের সাথে নির্দিষ্ট নয়। যেহেতু ইসলামের ফজর থেকে নিয়ে কিয়ামত আসার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সেই জামাআত অবশিষ্ট আছে ও থাকবে। উক্ত উপনামে ইসলামের সকল দিক শামিলও আছে। আকীদা, আহকাম, আখলাক, মাসায়েল, ফাযায়েল, জিহাদ, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি সব কিছু। কোন এক বা একাধিক দিক ছেড়ে অন্য একটা দিক নিয়ে সে দল পরিচিত ও প্রসিদ্ধ হয় না। কেবল তাবলীগ নিয়ে, অথবা কেবল জিহাদ নিয়ে, অথবা কেবল ইসলামী রাষ্ট্রগঠন নিয়ে এক এক প্রবণতায় এক এক দলে ও জামাআতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। কোন শির্ক-বিদআত নিয়ে তো নয়ই, কোন ব্যক্তি বিশেষের মত নিয়েও কোন দল বা জামাআত সৃষ্টি করে না। “বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কুরআন ও হাদীস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবী ও তাবেঈনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তাঁরা ফির্কাবন্দী সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হল, কুরআন এবং হাদীসে রসূল ﷺ । কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন (ভক্তিভাজন) ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হল। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হল, যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল। এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল।” (আহসানুল বায়ান ৯৩পৃঃ) মুসলিমদের এই জামাআত ইসলামের স্বর্ণযুগে কেবল “মুসলিম” বলেই পরিচিত ছিল। আল্লাহর নবী ﷺ -এর যুগে কোন দলাদলি ছিল না। বরং তিনি এই শ্রেণীর দলাদলির বিভক্তিকে অপছন্দ করতেন। বানী মুস্তালাক্ব যুদ্ধে এক আনসারী ও এক মুহাজিরীর মধ্যে কোন কলহ বাধলে আনসারী আনসারের নাম ধরে এবং মুহাজিরী মুহাজিরীনের নাম ধরে আহবান করলেন। তা শুনে মহানবী ﷺ বললেন, “জাহেলিয়াতের আহবান? অথচ আমি তোমাদের মাঝে রয়েছি! তা বর্জন কর, কারণ তা পচা (দুর্গন্ধময়)।” (তিরমিয়ী,৩৩১৫নং) নববী যুগ ছিল অন্ধ পক্ষপাতিত্ব বর্জিত। তখন কোন দলাদলি বা ফির্কা মাযহাব ছিল না। মুনাফিক ছাড়া সকল মুসলিমগণ এক জামাআতের ছিলেন। মহানবী ﷺ জামাআত ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করার তাকীদও দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, “ তোমরা জামাআত (ঐক্য) আকড়ে ধরে থাকবে এবং দলাদলি বা বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান থাকবে। কারণ শয়তান একক ব্যক্তির সাথে এবং সে দু’জন থেকে অধিক দূরে। যে ব্যক্তি জান্নাতের প্রশস্ততা চায় সে জামাআত (ঐক্য) আঁকড়ে ধরুক। ” (কিতাবুস সুন্নাহ শায়বানী ৮৯৭নং) “জামাআত (ঐক্য) হল রহমত এবং বিচ্ছিন্নতা হল আযাব।” (মুসনাদে আহমাদ, কিতাবুস সুন্নাহ শায়বানী ৮৯৫ সহীহুল জামে’ ৩১০৯নং) “যে ব্যক্তি আনুগত্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নিল, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এ অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার জন্য কোন প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বায়আত না করে মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মরা মরল।” এর অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, “যে ব্যক্তি জামাআত (ঐক্য) ত্যাগ ক’রে মারা গেল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল।” (মুসলিম) “যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার ক’রে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও। অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যেটি (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।” (আবু দাঊদ-হাসান সূত্রে) বর্ণনাকারী সায়েব বলেন, “এখানে জামাআত বলতে উদ্দেশ্য নামাযের জামাআত।” আর তার প্রমাণ হাদীসের প্রথমাংশ। “জামাআতের উপর আল্লাহর হাত থাকে। সুতরাং যে (জামাআত থেকে) পৃথক হবে, সে পৃথক হয়ে জাহান্নামে যাবে।” (তিরমিযী) “আমার (অন্তর্ধানের) পরে অনেক কিছু (আপত্তিকর ঘটনা) ঘটবে। সুতরাং যাকে জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখবে অথবা উম্মতে মুহাম্মাদিয়্যাহর ঐক্যকে নষ্ট করতে দেখবে, তাকে হত্যা ক’রে ফেলো, তাতে সে যেই হোক না কেন।” (মুসলিম) নচেৎ বুঝতেই তো পারছেন, যে কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত নয়, সে হত্যাযোগ্য নয়। বরং এ হাদীসে স্পষ্টভাবে দলাদলি ও ঐক্যবদ্ধ জামাআতকে ভাগাভাগি করতে নিষেধ করা হয়েছে। “তিন ব্যক্তি সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করো না; যে জামাআত (ঐক্য) ত্যাগ করে নেতার অবাধ্য হয়ে মারা যায়, যে ক্রীতদাস বা দাসী প্রভু থেকে পলায়ন করে মারা যায়, এবং সেই নারী যার স্বামী অনুপস্থিত থাকলে—তার সাংসারিক সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস বন্দোবস্ত করে দেওয়া সত্তেও—তার অনুপস্থিতিতে বেপর্দায় বাইরে যায়।” (সিলসিলা সহীহাহ ৫৪২নং) “যে ব্যক্তি জামাআত (ঐক্য) থেকে আধ হাত পরিমাণ বিচ্ছিন্ন হল সে যেন ইসলামের রশিকে নিজ গলা হতে খুলে ফেলল। তবে যদি সে পুনরায় জামাআতে ফিরে আসে। তবে ভিন্ন কথা।” (আহমাদ, সহীহ তিরমিযী ২২৯৮ সহীহুল জামে’ ১৭২৮নং) “তিনটি বিষয় এমন আছে, যাতে কোন মুসলিমের হৃদয় খিয়ানত করতে পারে না। (এক) নির্ভেজাল ভাবে আল্লাহর জন্য আমল করা। (দুই) সাধারণ মুসলিমদের জন্য কল্যাণ কামনা করা। (তিন) মুসলিমদের জামাআত (ঐক্য)কে আঁকড়ে ধরে থাকা। কেননা, তাদের (ঐক্যবদ্ধতার) আহবান তাদের সকলকে পরিবেষ্টন করে রাখে।” (মিশকাত তাহক্বীক্ব সহ হাদীস নং২২৮) উমার (রযিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু) বলেছেন, ‘জামাআত ছাড়া ইসলাম নেই। নেতৃত্ব ছাড়া জামাআত নেই। আর আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব নেই।’ (দরেমী ২৫১নং) বুঝতেই পারছেন যে, উক্ত নির্দেশাবলিতে ‘জামাআত’ বলতে কোন সংগঠন, জামাআত বা দল নয়। আর বায়আত বলতে রাষ্ট্রনেতার হাতে আনুগত্যের বায়আত। সুতরাং উক্ত বাণীসমূহকে সংগঠন অর্থে ব্যবহার ক’রে ইসলামের মাঝে দল তৈরি করা অবশ্যই বৈধ নয়। যেমন জান-মাল দিয়ে জিহাদ করার আয়াত ও হাদীসসমূহকে তাবলীগের অর্থে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়, যদিও তাবলীগ এক প্রকার জিহাদ এবং জিহাদে তাবলীগ আছে। জ্ঞাতব্য যে, কোন দল বা ফির্কা সৃষ্টি না ক’রে কিছু লোকের দাওয়াতের কাজ জামাআতবদ্ধভাবে করা। আপত্তিকর নয়। যেমন সফরে একাধিক লোক গেলে জামাআত ও আমীর এবং মসজিদে-মসজিদে জামাআত ও ইমাম উক্ত হাদীসসমূহের পরিপন্থী নয়। (সূত্রঃ- আব্দুল হামীদ ফাইযি মাদানী, দ্বীনের দাওয়াত, ১২৮-১৩৫ পৃষ্ঠা)

আল কায়েদা উপমহাদেশের নায়েবে আমীর শহীদ উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহিমাহুল্লাহর একটি উর্দু বয়ান সিরিজ রিলিজ করেছে আস সাহাব উপমহাদেশ শিরোনাম- দুরুসে শরিয়াহ- পার্ট ১-৩










 আল কায়েদা উপমহাদেশের নায়েবে আমীর শহীদ উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহিমাহুল্লাহর একটি উর্দু বয়ান সিরিজ রিলিজ করেছে আস সাহাব উপমহাদেশ
শিরোনাম- দুরুসে শরিয়াহ- পার্ট ১-৩
বয়ানটি ডাউনলোড করে নিজে শুনুন ও উলামা ও তুলাবা হজরতদের কাছে পৌঁছে দিন।
নিচের লিংকে সব পর্বের লিংক দেওয়া আছে-
অডিও
https://archive.org/details/ilm_frq
ভিডিও
https://archive.org/details/ilm_ustad
কোনো ফাইলের ডাউনলোড লিঙ্ক না পেলে আর্কাইভে লগ-ইন করুন। ইনশা'আল্লাহ ডাউনলোড করতে পারবেন। আর্কাইভ আইডি না থাকলে এই আই ডি/পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন -
(যদি আর্কাইভ থেকে ডাউনলোড করতে গেলে Item not available দেখায়)
লগ ইন আই ডি - k_sumon17@yahoo.com
পাসওয়ার্ড - $##$ghjk1234










হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিক, “মধ্যমপন্থা” আর সিরাতুল মুস্তাক্বীম


হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিক বলে একটা কনসেপ্ট আছে। ধরুন আপনি নতুন করে ট্যাক্স ১৫% বাড়াতে চান। আপনি জানেন যে ১৫% বৃদ্ধির কথা বললে কেউই মানবে না। তাই আপনি কিছু লবিস্ট নিয়োগ করলেন, যাদের কাজ হবে ট্যাক্স কেন ৩০% বাড়ানো উচিৎ এবং আবশ্যক এটা প্রমানে নানা যুক্তি দাড় করানো। এটার পক্ষে লেখালেখি করা, সিম্পোসিয়াম করা, কনফারেন্স করা। মোট করা ৩০% ট্যাক্স বৃদ্ধির পক্ষে জনসমর্থন তৈরি করা এবং সমর্থনের একটা ফ্রেইমওয়ার্ক তৈরি করা। এবার আপনি আরেক পক্ষকে বলবেন ট্যাক্স কেন ৩০% বাড়ানোর বদলে ১০% কমিয়ে দেয়া উচিৎ সেটার পক্ষে একইভাবে আরেকদল লবিস্ট নিয়োগ করলেন। এরা আগের দলের মতো একই কাজ করবে, তবে ১০% ট্যাক্স হ্রাসের পক্ষে। দুই দলকে তর্কবিতর্ক, রিফিউটেশান-পাল্টা রিফিউটেশান করতে দিন। একজনকে আরেকজনের যুক্তি খন্ডন করতে দিন। শেষমেশ আপনি এসে বলুন, দেখো তোমাদের দুজনের কথাতেই যুক্তি আছে, তাই আসো আমরা একটা কম্প্রোমাইযে আসি, মিডল গ্রাউন্ডে [মধ্যম পন্থা?] আসি। ৩০% বাড়ানোর দরকার আসলে নেই, কম হলেও চলে। আর ১০% কমানো তো আসলে আনরিয়েলিস্টিক। তাই আসো আমরা ১৫% বাড়াই। আর এই দুই পক্ষের ঝগড়ায় বিভ্রান্ত জনগন মনে করলো, হ্যা এটা একটা সেন্সিবল, মডারেশানের কাজ হয়েছে। আপনি যে রেসাল্ট চাচ্ছিলেন তাই পেলেন, কিন্তু চাপিয়ে না দিয়ে আপনি মানুষের consent বা সম্মতি তৈরি করে নিলেন। জিনিয়াস! হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিকের ভাষায়, প্রথমে আপনি যা চালু করতে চাচ্ছিলেন, ১৫% ট্যাক্স বৃদ্ধি, এটা হল এজেন্ডা। এই উদ্দেশ্যে এক পক্ষ ৩০% ট্যাক্স বাড়াতে বলা শুরু করলো। এটা হল থিসিস আরেক দল তাদের বিরোধীতায় ১০% ট্যাক্স কমাতে বললো, এটা হল অ্যান্টি-থিসিস শেষ পর্যন্ত থিসিস আর অ্যান্টি-থিসিসের মিশ্রণে আপনি পেলেন সিনথেসিস, যা হল প্রকৃত পক্ষে আপনার মূল এজেন্ডার বাস্তবায়ন। অর্থাৎ ১৫% ট্যাক্স বৃদ্ধি। থিসিস + অ্যান্টিথিসিস = সিনথেসিস (= এজেন্ডা)। এখানে + চিহ্নের বদলে কিউমিলেটিভ সামেশান আরও অ্যাপ্রোপ্রিয়েট, বাট কাজ চালানোর জন্য আপাতত এটুকু ঠিক আছে। ইসলামে যে মধ্যম পন্থার কথা বলা হয়েছে সেটা হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টীকের "সিনথেসিস" না। দুটা পযিশানের মাঝামাঝি নেয়াটা সিরাতুল মুস্তাক্বীম না। সিরাতুল মুস্তাক্বীম একটা স্বতন্ত্র বিষয়, যেটার স্বাধীন অস্তিত্ব, বৈশিস্ট ও পরিচয় আছে। হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিকের ক্ষেত্রে কোন অ্যাবসলিউট মানদন্ড নেই, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। তাই থিসিস বা অ্যান্টি-থিসিসের যথার্থতা আপনি কোন অ্যাবসলিউট মানদন্ডে মাপতে পারবেন না। ইসলামের শুরুই হয়েছে একটা অ্যাবসোলিউট মানদন্ড নির্ধারণ করে। আল ফুরক্বান - The Criterion. আল ফুরক্বান, রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ এবং সালাফের ইজমা এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং - এই হল আপনার মানদন্ড। একটা টোটাল প্যাকেজ। স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যাকেজ, যাতে সংযোজন বা বিয়োজনের কোন জায়গা নেই। এই মানদন্ড একটা নির্দিষ্ট পথকে সিরাতুল মুস্তাক্বীম বলে চিহ্নিত করে দিয়েছে। সুতরাং আমাদের সিরাতুল মুস্তাক্বীমের কনসেপ্ট থিসিস আর অ্যান্টি-থিসিসের উপর নির্ভরশীল না। অর্থাৎ সিরাতুল মুস্তাক্বীমের সংজ্ঞা 'ইরজা [leniency] আর গুলুহ [extremism]-র উপর নির্ভরশীল না। সিরাতুল মুস্তাক্বীম সুসংজ্ঞায়িত এবং নির্দিষ্ট। বরং 'ইরজা এবং গুলুহ-র সংজ্ঞা সিরাতুল মুস্তাক্বীমের উপর নির্ভরশীল। আমরা যখন বলি সিরাতুল মুস্তাক্বীম মধ্যম পন্থা তখন আমরা ডান-বামের সংজ্ঞা আগে ঠিক করে, পরে "মধ্যম"-এর সংজ্ঞা দেই না। আমরা বলি মধ্যম কি এটা পরিস্কারভাবে নির্ধারিত। এর বামে গেলে ইরজা, ডানে গেলে গুলুহ, । সিরাতুল মুস্তাক্বীম এর চাইতে বেশি উদার হলে সেটা 'ইরজা, আর এর চাইতে বেশি কঠোর হলে সেটা গুলুহ। এখন কেউ যদি বলে সমাধান হল গণতন্ত্র, আর কেউ যদি বলে সমাধান হল গণতন্ত্র সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা,আর তৃতীয় কেউ যদি বলে না সমাধান হল "মধ্যম পন্থা", "ইসলামী গণতন্ত্র" - তাহলে সেটা শাব্দিকভাবে মধ্যম পন্থা হল বটে, কিন্তু সিরাতুল মুস্তাক্বীম হল না। আপনি দুটো জিনিষের মাঝামাঝি একটা জিনিষ নিয়ে সেটাকে সিরাতুল মুস্তাক্বীম বলে চালিয়ে দিতে পারেন না। আপনি সিরাতুল মুস্তাক্বীম এর অংশ সেটাকে বলবেন যেটা কুর'আন সুন্নাহ আর সালাফের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর বেইসিসে সঠিক বলে প্রমানিত হবে। আগে ইসলামের মানদন্ড অনুযায়ী সঠিক হওয়া বুঝতে হবে, তারপর আপনি সেটাকে মধ্যম পন্থা বলতে পারেন। কোন র‍্যান্ডম মানদন্ড অনুযায়ী কিছু একটা মধ্যম, তাই অটোম্যাটিকালি সেটা সিরাতুল মুস্তাক্বীমের অংশ হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন না। এই সেইম জিনিষটা ফ্রি-মিক্সিং এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাকফিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, "ইসলামী" ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একজন বললো সব ব্যাঙ্ক হারাম। আরেকজন বললো সব ব্যাঙ্ক হালাল। আরেকজন বললো না সব ব্যাঙ্ক হারাম কিন্তু "ইসলামী' ব্যাঙ্ক ছাড়া - আর এটা আগের দুটোর মাঝামাঝি, তাই এটা মধ্যম পন্থা, সিরাতুল মুস্তাক্বীম - এরকম মনে করা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল। ইসলামী ব্যাঙ্ক বা ফ্রি-মিক্সিং যাই হোক না কেন, আগে স্বতন্ত্রভাবে সেটার যথার্থতা ইসলামের মানদন্ডে প্রমাণ করতে হবে। এবং মন্দের ভালো কখনোই আপনার এই যথার্থতা প্রমানের স্টারটিং পয়েন্ট হতে পারে না। ক্ষেত্র বিশেষে কোন কিছুর জায়েজ হওয়া দিয়ে আপনি সম্পূর্ণভাবে সেই জিনিষের হালাল হওয়া প্রমাণ করতে পারেন না। বিশেষ অবস্থায় শুকরের মাংস খাওয়া জায়েজ, এটাকে আপনি আপনার বেইসিস ধরে শুরু করতে পারেন না। এক্সসেপশান থেকে জেনারেল রুলিং আসে না। আল্লাহু মুস্তা'আন। নিশ্চয় আমাদের কোমলতা ও কঠোরতার ভিত্তি আল্লাহ্‌-র দ্বীন। হারামে লিপ্ত ব্যক্তির প্রতি অবশ্যই আমরা কোমল হতে পারি, এবং সেটা দরকারও। কিন্তু হারামের ব্যাপারে কোন কোমলতা চলবে না। একই ভাবে বাধ্য হয়ে হারাম করছে এমন মানুষের সহমর্মিতা প্রাপ্য, কিন্তু যে হারামকে হালাল দাবি করছে তার এই কাজ ঘৃনার জন্য, সহমর্মিতা পাবার যোগ্য না। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মূর্তিপূজারীদের বিভিন্নভাবে আহবান করেছেন। কোমলতার সাথে, ও কঠোরতার সাথে। কিন্তু না তিনি মূর্তির সাথে কোমল ব্যবহার করেছেন, আর না মূর্তিপূজার কনসেপ্টের ব্যাপারে কোমলতা প্রদর্শন করেছেন। তিনি মূর্তিপূজকদের আমন্ত্রন জানিয়েছেন, কিন্তু মূর্তিপূজাকে আক্রমণ করেছেন। শুধু তাই না মূর্তিপূজকের মূর্তিপূজার সাথে সংশ্লিষ্ট ধারণা এবং আচার-অনুষ্ঠানকে তিনি আক্রমণ করেছেন। আর এটাই মিল্লাতু ইব্রাহীম। কোমলতার সংজ্ঞা আমাদের কাছে এটা না যে আমরা ভুলকে ভুল বলবো না। আর এজন্য যদি আমাদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয় কিম্বা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত বলা হয়, তাহলে তো আমাদের আগে আমাদের চেয়ে কোটি গুণ উত্তম ব্যক্তিদের সমন্ধে একই কথা বলা হয়েছিল। আর তাদের তুলনায় আমরা তো ধূলোবালির চাইতেও অধম - আল্লাহ্‌ তাদের সকলের উপর শান্তি বর্ষণ করুন। আল্লাহ-র দ্বীনের বিষয় তাউয়ীল করে বদলে দেয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই। দুনিয়া গেলে যাবে কিন্তু এই দ্বীনের সাথে কম্প্রোমাইয করা সম্ভব না, এবং দ্বীনকে দুনিয়া-কমপ্লায়েন্ট করাও সম্ভব না। যে যাই বলুক না কেন, যতোই সেটা কনভিনিয়েন্ট হোক না কেন, বা যতোই জেল-যুলুম-রিমান্ড কিম্বা হত্যার ভয় দেখানো হোক না কেন। নিঃসন্দেহে এটাই মিল্লাতু ইব্রাহীম।

নাস্তিকতার বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাই ১ – “পৃথিবীতে এতো ধর্মের মাঝে কোন ধর্মটি সঠিক?”


নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী এবং সংশয়বাদীদের কিছু রেডিমেইড ‘যুক্তি’ থাকে। যখন স্রষ্টা, পরকাল ও স্রষ্টার আনুগত্যের আবশক্যতার কথা বলা হয় তৎক্ষণাৎ এই মুখস্থ উত্তরগুলো তারা পেশ করেন, এবং মোক্ষম জবাব দিয়ে প্রতিপক্ষকে লা-জওয়াব করা গেছে এটা ভেবে পরিতৃপ্তি অনুভব করেন। এছাড়া যারা বিশ্বাস রাখেন কিন্তু বিশ্বাস সম্পর্কে তেমন একটা জ্ঞান রাখেন না, তাদের মনে সংশয় সৃষ্টি করতেও নাস্তিকরা এসব রেডিমেইড “যুক্তি” ব্যবহার করেন। এরকম মুখস্থ “যুক্তি”-র সংখ্যা সীমিত হওয়াতে দেখা যায় ঘুরেফিরে একই “যুক্তি” বিভিন্ন আঙ্গিকে সামনে আসছে। এরকম একটি “যুক্তি” হল – সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যাধিক্য ও পারস্পরিক ভাবে সাংঘর্ষিক হবার “যুক্তি”। শুনতে যতো জটিল মনে হয় আসলে বাস্তবে বিষয়টা ততোটা জটিল না। সাধারণত এই “যুক্তি” প্রশ্ন আকারে উপস্থাপন করা হয়। যেমন - পৃথিবীতে এতো ধর্মের মাঝে কোন ধর্মটি সঠিক? প্রতিটি ধর্ম নিজ নিজ স্রষ্টার কথা বলে, প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা দাবি করে একমাত্র তাদের ধর্মই সঠিক, একমাত্র তাদের ধর্ম অনুসরণ করেই মুক্তি পাওয়া যাবে। এর মাঝে আপনার ধর্ম যে সঠিক তার প্রমান কি? নাস্তিকদের এই যুক্তিটির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে এবং আন্তরিকভাবে যদি কোন সাধারণ বুদ্ধিবিবেচনাসম্পন্ন ব্যক্তি চিন্তা করেন তাহলে তার মনে দ্বিতীয় আরেকটি এই প্রশ্নের উদয় হবার করা (তবে এক্ষেত্রে চিন্তার ক্ষেত্রে কিছুটা নিরপেক্ষ হওয়া এবং স্রষ্টার প্রশ্নের উত্তর খোজার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া আবশ্যক)। প্রশ্নটি হল, এই প্রশ্নের মাধ্যমে প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য কি? প্রশ্নকারী কি এই প্রশ্নের মাধ্যমে ওই বিষয়গুলোর উত্তর খুজতে সচেষ্ট যে প্রশ্নগুলো নিয়ে ধর্ম আলোচনা করে? অথবা যে প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে আস্তিক ও নাস্তিকদের মতপার্থক্য? স্রষ্টা, স্রষ্টার আনুগত্য, সৃষ্টির সূচনা, মানব অস্ত্বিতের লক্ষ্য, মৃত্যু, পরকাল, নৈতিকতা, ভালো ও মন্দ – ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট উত্তর খোজার লক্ষ্যে কি এ প্রশ্ন করা হচ্ছে? নাকি এটা কি কথার পিঠে বলা একটি কথা – একটি রেটোরিকাল যুক্তি? প্রশ্নটা আরো স্পেসিফিক ভাবে করি। যেই যুক্তি বা প্রশ্নটা নাস্তিকরা উত্থাপন করছেন সেটা কি আদৌ সত্যকে খোজার সাথে সম্পর্কিত? নাকি সেটা একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নির্দিষ্ট একটা কথোপকথনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য তৈরি করা একটি যুক্তি? সহজ ভাষায় এই প্রশ্নের পেছনে উদ্দেশ্য বা intent কি সত্যের অন্বেষণ নাকি তর্কে জেতা? আপনি যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন প্রশ্নকারী ইতিমধ্যেই তার প্রশ্নের মাধ্যমে সম্ভাব্য সব উত্তরকে ভুল সাব্যস্ত করে বসে আছেন। এ প্রশ্নটা এমনভাবে তৈরি করা যাতে করে সম্ভাব্য যেকোন উত্তরকে গ্রহণ না করার জাস্টিফিকেশান তৈরি করা যায়। আপনি যে উত্তরই দিন না কেন সে বলবে – “তুমি এটা বলছো কিন্তু আরেকজন তো আরেকটা বলবে। তো আমি তোমাদের কার কথা শুনবো।” অর্থাৎ উত্তর খোজাটা আদৌ প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য না। সে আসলে আপনি কি উত্তর দেবেন তা শুনতে, কিংবা আপনার উত্তর সঠিক কি না তা পরীক্ষা করে দেখতেও আগ্রহী না। বরং তার উদ্দেশ্য হল সম্ভাব্য উত্তরগুলোর সংখ্যাধিক্য এবং পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক হবার বিষয়টি উত্থাপন করে সম্ভাব্য সকল উত্তর সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করা। ধরুন আপনি একজন নাস্তিক। একজন ধর্মে বিশ্বাসী লোক – সেটা যেকোন ধর্ম হতে পারে – আপনাকে এসে প্রশ্ন করলো আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না কে? অথবা ধরুন আপনাকে প্রশ্ন করা হল আপনি কি বিশ্বাস করেন? এক্ষেত্রে ধর্মে বিশ্বাসী লোককে উপরের প্রশ্ন করে আপনি ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিতে পারবেন – “কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করবো? কোন ধর্মে বিশ্বাস করবো? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর কি? সঠিক উত্তর কিভাবে বের করবো, যখন সবাই বলছে তার উত্তরই সঠিক?” এটুুকু বলে ধর্মে বিশ্বাসী লোকটাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাস্তিকরা বলে – “অতএব ধর্ম-টর্ম এগুলো মানুষ নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য এখন এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান এসব কিছু নেই, সব মানুষের বানানো...” ইত্যাদি। প্রশ্ন হল যে প্রশ্ন থেকে এই আলোচনার শুরু সেই প্রশ্ন থেকে কি যৌক্তিকভাবে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায়? অনেক ধর্ম থাকা, এবং এ ধর্মগুলোর বক্তব্য সাংঘর্ষিক হওয়া কি সবধর্মের ভুল হবার প্রমান? আলোচনা সম্ভবত একটু বেশি তাত্ত্বিক হয়ে যাচ্ছে, আমি একটা উদাহরণ দিয়ে জিনিষটা বোঝানোর চেষ্টা করি। মনে করুন সমুদ্রপাড়ের একটি শহর। ধরুন হাজার বছর আগের কথা। একদিন সকালে শহরবাসী আবিষ্কার করলো একটি ছোট্ট নৌকা সৈকতে এসে ভিড়েছে। নৌকাতে অচেতন দুটি প্রাণী। একজন মূমুর্ষু ব্যক্তি এবং তার বুকে আনুমানিক ছয় মাসের একটি শিশু। লোকজন তাদেরকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করার কিছুক্ষন পরই লোকটি মারা গেলেন। তবে মৃত্যুর আগে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরে পেয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে গেলেন। শিশুটির মা তাদের সাথেই জাহাজে ছিলেন। জহাডুবি হওয়াতে তিনি এবং তার সন্তান জাহাজের অন্যান্য যাত্রীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তিনি শহরের লোকেদের প্রতিজ্ঞা করালেন তার সন্তানকে দেখে রাখার এবং সন্তানের মা আসলে তার কাছে সন্তানটি তুলে দেবার। শহরের লোকজন আর কোন তথ্য লোকটির কাছ থেকে জানার আগেই তিনি মারা গেলেন। ধরা যাক, এক বছর পর এক জাহাজে চেপে একশ জন মহিলা হাজির হলেন এবং সকলেই সেই শিশুটির মাতৃত্বের দাবি করে বসলো। একশ জনের একশ জনই নিজের দাবিকে আত্মবিশ্বাসের সাথে সত্য বলে প্রচার করতে থাকলো। নিজের দাবির স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি-প্রমান উপস্থাপন করলো। শহরের লোকজন পড়লো মহাসমস্যায়। কি করা যায় তা ঠিক করার জন্য এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকা হল। বৈঠকে শহরের মেয়র দাঁড়িয়ে বললেন – উপস্থিত লোকসকল! আসুন দেখা যাক আমরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কি জানি। আমরা জানি - ক) একশ জনের প্রত্যেকেরই এ শিশুর মা হওয়া সম্ভব না। যদি একজনের দাবি সঠিক হয় তাহলে অবধারিত ভাবে বাকি ৯৯ জনের দাবি ভুল। খ) এই একশো জনের মধ্যে আসলেই এ শিশুর মা উপস্থিত আছে – কেবলমাত্র তাদের দাবির ভিত্তিতে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না। গ) এই একশোজনের মাঝে শিশুটির প্রকৃত মা উপস্থিত নেই- এটাও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। ঘ) কোন ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে এ শিশুটির মা, সেটাও নিছক দাবির ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না। ঙ) যদি শিশুটির প্রকৃত মা এই একশো জনের মাঝে উপস্থিত থাকে তাহলে এটা আবশ্যক যে ৯৯% দাবিকারী এখানে মিথ্যা বলছে। আর যদি শিশুটির মা এখানে উপস্থিত না থাকে তাহলে এখানে ১০০% দাবিকারীই মিথ্যা বলছে। হে শহরবাসী আপনারা বলুন আমরা কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারি? মেয়রের কথার পর নেমে আসলো পিনপতন নীরবতা। মিনিট খানেক সবাই যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলো। তারপর এক শিশু দাড়িয়ে বললো, আমি জানি এ সমস্যা সমাধান কি। যেহেতু সবাই বলছে তার দাবিই সঠিক, যেহেতু প্রত্যেকের দাবি অন্যান্যদের দাবির সাথে সাংঘর্ষিক এবং যেহেতু এখানে কমপক্ষে ৯৯% দাবিদার মিথ্যাবাদী - অতএব স্পষ্টভাবে প্রমান হয় যে এই শিশুটির আসলে কোন মা-ই নেই। আমরা ধরে নেবো নৌকায় চেপে আসা সেই ব্যক্তিও মিথ্যা বলেছে এবং মাতৃত্বের দাবিকারীরাও সবাই মিথ্যা বলছে। আর আমরা বিশ্বাস করবো এই শিশুটির কোন মা নেই, এবং তার কোন পিতাও নেই। পিতা ও মাতা ছাড়াই এ শিশু এসেছে। আর যেহেতু শিশুটির কোন মা নেই, পিতাও নেই, তাই সেই ব্যক্তির কাছে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এটা মানতেও আমরা আর বাধ্য নেই। এই শিশুটির কথাকে কি যৌক্তিক? হত পারে সে অবুঝ, পাগল, প্রতিবন্ধী অথবা সে সঠিক উত্তর খুজতেই চায় না। কিন্তু তাকে কি আদৌ সত্যান্বেষী বলা যায়? নাস্তিকদের “যুক্তিটি” এবং যুক্তির ভিত্তিতে দেওয়া তাদের উপসংহার হল এই শিশুর কথার মতো। যেহেতু সবাই নিজেকে ঠিক দাবি করছে, যেহেতু অনেকে দাবি করছে -তাই সব ধর্মই নিশ্চিতভাবে ভুল এবং কোন স্রষ্টা নেই! ধর্মের সংখ্যাধিক্য এবং ধর্মগুলোর বক্তব্য পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হওয়া প্রতিটি ধর্মের ভুল হবার প্রমান না, যদিও এটা অবধারিত যে সবগুলো ধর্ম সঠিক হতে পারেন না। একই ভাবে অনেকগুলো ধর্ম থাকা, প্রতিটি ধর্মের বিভিন্ন বক্তব্য থাকা স্রষ্টার অনস্তিত্বের প্রমান না। যদি সমুদ্রপাড়ের শহরের মানুষ আসলেই সমস্যার সমাধান করতে চায় তবে তাদেরকে হয় মাতৃত্বের দাবিকারীরা কি কি দলিল-প্রমান উত্থাপন করেছে তা পরীক্ষা করতে হবে, অথবা অন্য কোন পদ্ধতিতে শিশুটির মাতৃপরিচয় সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত হতে হবে। সমস্যা বেশ জটিল তাই ধরে নিলাম এই শিশুর মা নেই, বাবা নেই – এটা কোন সমাধান না। তাই নাস্তিকরা যা বলে তা না কোন প্রমান, না কোন সঠিক উত্তর। বরং তারা প্রমানহীন, যৌক্তিকতাহীন আরেকটি দাবি, আরেকটি বিলিফ সিস্টেম বা ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আসেন। আর তা হলঃ কোন স্রষ্টা নেই, অতএব স্রষ্টাকে মানার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু যেখানে তারা ভাওতাবাজি করেন বুঝে কিংবা না বুঝে তা হল – দুনিয়ার সব ধর্মকে যদি তারা ভুল প্রমান করেনও (যেটা তারা করতে পারেন না) তবুও কিন্তু স্রষ্টার অনস্তিত্ব – স্রষ্টা নেই – এটা প্রমাণিত হয় না। সুতরাং অন্য ধর্মে কেন ভুল বা প্রত্যেক ধর্মের ভুল হবার ৯৯% সম্ভাবনা আছে – এধরণের কথা না বলে তাদের উচিৎ এটা প্রমান করে দেখানো যে স্রষ্টা নেই। কিন্তু তারা এই কাজটা করেন না। তারা বরং আলোচনাকে ডাইভার্ট করেন বা ভিন্নখাতে প্রভাবিত করেন, এবং কথার মারপ্যাঁচ এবং রেটোরিকাল যুক্তি দিয়ে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু অপরের দাবির ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি তাদের দাবির পক্ষে প্রমান না। অর্থাৎ নাস্তিকদের অবস্থানটা হল এই – তারা বিশ্বাস করেন স্রষ্টা নেই। কিন্তু তারা তাদের এই দাবির পক্ষে প্রমান উত্থাপন করতে পারেন না। তারা স্রষ্টা আছে এই দাবিকে ভুলও প্রমান করতে পারেন না, এবং মহাবিশ্বের উৎস ও সূচনার কারন হিসেবেও কোন সন্তোষজনক উত্তর তারা দিতে পারেন না। বরং তারা একটা স্ট্যাটিস্টিকাল পয়েন্টে তর্কটা নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। তারা বলতে চান – যদি অনেক ধর্ম থাকে আর এর মধ্যে শুধু একটি ধর্মই সঠিক হতে পারে, তাহলে স্ট্যাটিস্টিকালি একজন নাস্তিকের অবিশ্বাস ততোটাই যৌক্তিক যতোটা একজন বিশ্বাসীর বিশ্বাস। দুটোরই ভুল হবার সম্ভাবনা। [তাদের এই অবস্থানের মাঝেও একটা ভুল আছে, তবে সেই আলোচনাতে এখন যাচ্ছি না।] সমস্যাটা হল কোন চায়ের আড্ডায়, কিংবা তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রে এধরনের আর্গুমেন্টের ব্যবহার হয়তো একজন নাস্তিকের পযিশানকে অপরের সামনে জাস্টিফাই করার ক্ষেত্রে কার্যকর, কিন্তু মূল বিষয়ে – অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্কের বিষয়ে - পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোন কিছুই এ ধরণের আর্গুমেন্ট থেকে পাওয়া যায় না। আপনি যদি দুনিয়ার সব ধর্মকে ভুল প্রমাণিত করেনও তাও কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া হয় না। এই স্ট্যাটিস্টিকাল পয়েন্টটা এমন সব প্রশ্নের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর একটি। কারন যেকোন প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর সঠিক হবার অর্থ অবশ্যই অন্য সকল উত্তর ভুল। ধরুন একটি কাঁচের জারে নির্দিষ্ট সংখ্যক বিভিন্ন আকার ও রঙের ছোট ছোট রাবারের বল আছে। আপনি যদি জারটি এক নজর দেখিয়ে তারপর মানুষকে প্রশ্ন করেন – বলুন তো এখানে কয়টি বল আছে? তাহলে এ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যা অসীম। যদি ১০০০ জনকে প্রশ্ন করেন হয়তো ১০০০টা ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাবেন। কিন্তু তার অর্থ কি এ প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই? অবশ্যই না। অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বল সেই জারে থাকবে, এই সংখ্যা বদলাবে না। অবশ্যই সঠিক উত্তর একটিই হবে এবং তা ছাড়া বাকি সব উত্তর ভুল হবে। সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যাধিক্য ও তাদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হওয়া প্রমান করে না যে, সঠিক উত্তর নেই।[1] ধর্মের অনুসরণ, ধর্মীয় অনুশাসন পালন এগুলো স্রষ্টায় বিশ্বাসের পরবর্তী ধাপ। আবশ্যক প্রথম ধাপ তর্কে জেতা কিংবা নিজের অবস্থানকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাই কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সত্যের অন্বেষণ না। একজন সত্যান্বেষী ব্যক্তি যিনি সংশয়ে আছেন তিনি প্রথমে এই প্রথম ধাপের মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন। আর একজন ক্যারিয়ার নাস্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাইয়ের মাধ্যমে তর্কে জেতার চেষ্টা করবে। সুতরাং যদি কোন নাস্তিক পরবর্তীতে এই প্রশ্ন আপনার সামনে উপস্থাপন করেন তাহলে যদি কেউ তর্কে জিততে চান তাহলে তাকে বলুন – যদি আমি ধরে নেই দুনিয়ার সব ধর্মই ভুল, তবুও তো সব ধর্মের ভুল হওয়া তোমার বিশ্বাসকে (নাস্তিকতার বিশ্বাস – স্রষ্টা নেই, পরকাল নেই, স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির দায়বদ্ধতাও নেই) সত্য প্রমান করে না। তাই তাদের ভুল তোমার পক্ষে প্রমান না। বরং তুমি তোমার দাবির পক্ষে প্রমান পেশ করো। আর যদি তুমি সেটা না পারো তাহলে অন্ধ বিশ্বাসী আর অন্ধ অবিশ্বাসী তোমার মধ্যে পার্থক্য কি? আর তাই যদি আসলেই কেউ সত্যান্বেষী হন তাহলে এসব মুখস্থ প্রশ্ন বাদ দিয়ে তার উচিত ভিন্ন একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। রেটোরিকাল কুতর্ক ছেড়ে মূল বিষয়ে প্রশ্ন করা, শেকড় থেকে শুরু করা। প্রশ্নটি হল – এই মহাবিশ্বের অরিজিন কি? পৃথিবী, সৌরজগত, ছায়াপথ নীহারিকা থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রন, প্রোটন পর্যন্ত - ম্যাক্রো স্কেল থেকে শুরু করে ন্যানো স্কেল পর্যন্ত – এসব কিছু কি নিজ থেকে সৃষ্টি হয়েছে? নাকি এগুলো নাকি এগুলো সবসময় ছিল এবং সবসময় থাকবে? নাকি এগুলো নির্দিষ্ট এক পর্যায়ে শুরু হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পর বিলীন হয়ে যাবে – আর এর পুরোটাই হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে? নাকি এসব কিছুর একজন স্রষ্টা আছেন? <><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><> [1] নাস্তিকরা বলতে পারেন এই উদাহরণ তৈরি করা হয়েছে পিতামাতা ছাড়া শিশু জন্মাতে পারে না এই প্রমানিত বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে। জারের উদাহরনেও জারের মধ্যে বল আছে আগে এটা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্রষ্টা আছে সেটা একইভাবে প্রমাণিত না। তাই এটি একটি False Analogy. সেই ক্ষেত্রে উত্তর হবে, এটি False Analogy না, কারন এ থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের চেষ্টা করা হচ্ছে না। শিশুর জন্য যেহেতু পিতামাতা থাকা আবশ্যক, তাই অবশ্যই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যক – এই যুক্তি এখানে দেওয়া হচ্ছে না। এখানে শুধু বলা হচ্ছে দাবিদার অনেক হওয়া, কিংবা অধিকাংশ বা সকল দাবিকারীর দাবির মিথ্যা হওয়াও প্রমান করে না যে শিশুটি পিতামাতা ছাড়া জন্মেছে।সম্ভাব্য উত্তর অনেক হওয়া প্রমান করে না যে জারে কয়টি বল আছে এই প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই। একইভাবে অনেক ধর্ম থাকা এবং তাদের বক্তব্য পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক হওয়াও কোন ভাবেই প্রমান করে না যে স্রষ্টা নেই। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রশ্নটা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের সঠিক বা বেঠিক হবার উপর নির্ভরশীল না কোন ভাবে সংযুক্তও না। বরং আমরা এটাই বলছি যে ধর্মের সংখ্যা, ধর্মের বক্তব্য, তাদের পারস্পরিক সংঘাত ইত্যাদি ছেড়ে মূল আলোচনায় আসুন। অহেতুক পানি ঘোলা করা বাদ দিয়ে, মূল প্রশ্নের মীমাংসা করুন, একজন বা একাধিক স্রষ্টা আছেন কি না, সেই আলোচনায় আসুন। https://www.youtube.com/channel/UCGbIXAXZxoWtJQeQfCqP9bg

তিনি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন —আল-বাক্বারাহ ২৪৫


বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

কে আছে যে আল্লাহকে ﷻ ধার দেবে? তাহলে তিনি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন। আল্লাহই ﷻ কমিয়ে দেন এবং বাড়িয়ে দেন। তাঁর কাছেই তোমরা ফিরে যাবে। [আল-বাক্বারাহ ২৪৫] এই আয়াত পড়ে যে কোনো মুসলিমের লজ্জা পাওয়া উচিত। আল্লাহ ﷻ আমার কাছে ধার চাইছেন? আমি দুনিয়ার লোভে এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছি যে, তিনি ﷻ এই ভাষা ব্যবহার করে আমাকে বলছেন তাঁর পথে খরচ করতে? ধরুন, আপনার মা ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে কাজ করে আপনাকে বড় করেছেন, আপনার পড়ালেখার খরচ যোগান করেছেন। তিনি আপনাকে একটুও কষ্ট করতে দেননি, যেন আপনার পড়াশুনায় কোনো ক্ষতি না হয়, যেন আপনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। আপনার মায়ের এই বিরাট আত্মত্যাগের জন্য আপনি বড় হয়ে শিক্ষিত হলেন, ডিগ্রি অর্জন করলেন, যথেষ্ট সম্পত্তির মালিকও হলেন। আপনার মা আপনার যত এত কষ্ট না করলে আপনি এত উপরে উঠতে পারতেন না। একদিন তিনি আপনাকে অনুরোধ করছেন, ‘বাবা, আমাকে কিছু টাকা ধার দেবে? আমি আগামী বছরই ফেরত দিয়ে দেবো। আর আমি তোমাকে ধারের টাকার দ্বিগুণ ফেরত দেবো। কোনো চিন্তা করো না বাবা। একটু ধার দেবে?’ —যখন মা তাকে এই ভাষায় অনুরোধ করছেন, দ্বিগুণ ফেরত দেওয়ার কথা বলছেন, এথেকেই বোঝা যায়, সে ছেলে হিসেবে কতটা নীচে নেমেছে, কতটা লোভী হয়ে গেছে যে, তাকে এভাবে বোঝাতে হচ্ছে।

আল্লাহ্‌কে ধার দেয়া কি? আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কয়েকটি খাত দিয়েছেন খরচ করার জন্য। বাবা-মা, পরিবার, নিকট আত্মীয়, এতিম, মিসকিন, দুস্থ পথচারী, জিহাদ — এই সব ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের সম্পত্তি খরচ করাই হচ্ছে আল্লাহর ﷻ পথে খরচ করা। তিনি ﷻ একে ধার বলে এটাই বোঝাচ্ছেন যে, দুনিয়াতে আমরা যখন সম্পত্তি খরচ করি, তখন তা আমাদের কাছ থেকে চলে যায়। কিন্তু যখন আমরা আল্লাহর ﷻ পথে সম্পত্তি খরচ করি, সেটা আমাদের কাছ থেকে চলে যায় না। বরং সেটা ধার হিসেবে জমা হয়। আল্লাহ ﷻ একদিন তাঁকে দেওয়া সমস্ত ধার ফেরত দেবেন, বহুগুণে ফেরত দেবেন। আমাদের অনেকেরই দান করতে গেলে অনেক কষ্ট হয়। কোনো এতিমখানায় দান করলে, বা কোনো গরিব আত্মীয়কে হাজার খানেক টাকা দিলে মনে হয়: কেউ যেন বুকের একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটাকে এভাবে চিন্তা করতে পারি— দুনিয়াতে আমার একটি ক্ষণস্থায়ী কারেন্ট একাউন্ট রয়েছে, এবং আখিরাতে আমার আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্ট রয়েছে। আমি আল্লাহর ﷻ রাস্তায় যখন খরচ করছি, আমি আসলে আমার দুনিয়ার একাউন্ট থেকে আখিরাতের একাউন্টে ট্রান্সফার করছি মাত্র। এর বেশি কিছু না। আমার সম্পত্তি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে না, আমারই থাকছে, যতক্ষণ না আমি দান করে কোনো ধরনের আফসোস করি, বা দান করে মানুষকে কথা শোনাই।[১] একদিন আমরা দেখতে পাবো: আমাদের ওই একাউন্টে কত জমেছে এবং আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে প্রতিটা দানের বিনিময়ে ৭০০ গুণ বেশি মুনাফা দিয়েছেন।[১] সেদিন আমরা শুধুই আফসোস করব, “হায়, আর একটু যদি আখিরাতের একাউন্টে ট্রান্সফার করতাম! তাহলে আজকে এই ভয়ংকর আগুন থেকে বেঁচে যেতাম!” এই আয়াতের আগের আয়াত ক্বিতাল সম্পর্কে আদেশ। এরপরেই আল্লাহ ﷻ তাকে ধার দিতে বলে ক্বিতাল বা যুদ্ধের জন্য আমাদের সম্পত্তি খরচ করতে বলেছেন। যুদ্ধের জন্য প্রচুর খরচ দরকার। বিরাট সামরিক বাহিনী তৈরি, তাদের বেতন, খাওয়ার খরচ, যুদ্ধের সরঞ্জাম কেনা, প্রযুক্তি তৈরি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি, যানবাহনের খরচ ইত্যাদি হাজারো খাতে প্রচুর পরিমাণে খরচ করতে হয়। এই খরচ যোগানের ব্যবস্থা করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য দায়িত্ব। যথেষ্ট খরচ না করলে মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনীর তুলনায় দুর্বল হবে, যুদ্ধে হেরে যাবে, তারপর দেশ দখল হয়ে যাবে শত্রুর কাছে। শত্রু তখন আমাদের মেরে, জমি জমা সব দখল করে নিয়ে যাবে। এভাবে আমরা সবদিক থেকেই হারাবো। একারণেই যুদ্ধের জন্য খরচ করার প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এই খরচের বিনিময়ে এত বড় পুরষ্কারের কথা বলা হয়েছে। তিনি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে একদিন আপনি রাস্তায় একটা বুড়ো ফকিরকে দেখে কষ্ট পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে, তাকে দোকানে নিয়ে জামাকাপড় কিনে দিলেন। এর বিনিময়ে হয়তো আল্লাহ ﷻ আপনাকে দুনিয়াতে এক কঠিন অসুখে পড়ে, চিকিৎসার পেছনে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করা থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। শুধু তাই না, আখিরাতে গিয়ে হয়তো দেখবেন: কয়েকশ একরের ঘন সবুজ বাগানের মাঝখানে এক বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের দরজায় লেখা, ‘সেই ভিক্ষুকের জন্য’। একদিন আপনি এক গরীব আত্মীয়কে ভীষণ বিপদের সময় সাহায্য করলেন। আপনার টাকা পয়সা টানাটানি থাকার পরেও আপনি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে তাকে অনেকগুলো টাকা দিয়ে দিলেন। এর জন্য হয়তো আল্লাহ ﷻ আপনাকে অফিসে বসের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করে চাকরি হারানো থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। আর আখিরাতে গিয়ে দেখবেন: উঁচু পাহাড়ে এক বিশাল ফুল-ফলের বাগান, বাগানের মাঝখানে ঝর্ণা, ঝর্ণার পাশে লম্বা টেবিলে সারি সারি খাবার এবং পানীয় সাজিয়ে রাখা আছে। টেবিলে একটা ছোট নোটে লেখা, ‘সেই আত্মীয়ের জন্য’। আল্লাহ্‌ই কমিয়ে দেন বাড়িয়ে দেন আমাদের যা কিছু আছে – বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক ক্ষমতা, প্রতিভা – এই সব কিছু হচ্ছে রিযক্ব رزق এবং এগুলো সবই আল্লাহর ﷻ দেওয়া।[১] রিযক্ব অর্থ যে সমস্ত জিনিস ধরা ছোঁয়া যায়, যেমন টাকাপয়সা, বাড়ি, গাড়ি, জমি, সন্তান এবং একই সাথে যে সমস্ত জিনিস ধরা ছোঁয়া যায় না, যেমন জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মেধা।[২] এগুলোর কোনটাই আমরা শুধুই নিজেদের যোগ্যতায় অর্জন করিনি। আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে এই সবকিছু দিয়েছেন। এখন আপনার মনে হতে পারে, “কোথায়? আমি নিজে চাকরি করে, দিনের পর দিন গাধার মতো খেঁটে বাড়ি, গাড়ি করেছি। আমি যদি দিনরাত কাজ না করতাম, তাহলে কি এগুলো এমনি এমনি হয়ে যেত?” ভুল ধারণা। আপনার থেকে অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে আছে, যারা আপনার মতই দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেছে, কিন্তু তারা বাড়ি, গাড়ি করতে পারেনি। আল্লাহ ﷻ কোনো বিশেষ কারণে আপনাকে বাড়ি, গাড়ি করার অনুমতি দিয়েছেন দেখেই আপনি এসব করতে পেরেছেন। তিনি যদি অনুমতি না দিতেন, তিনি যদি মহাবিশ্বের ঘটনাগুলোকে আপনার সুবিধামত না সাজাতেন, আপনি কিছুই করতে পারতেন না। আল্লাহ ﷻ আপনাকে সামর্থ্য দিয়েছেন, সুযোগ দিয়েছেন, আপনি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিশ্রম করেছেন। আল্লাহর ﷻ হুকুম ছিলো আপনার পরিশ্রমের ফলস্বরূপ আপনি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন, তাই আপনি অর্থ উপার্জন করছেন। না হলে পারতেন না। একারণেই আল্লাহ ﷻ আল-বাক্বারাহ-এর তৃতীয় আয়াতে বলেছেন যে, তিনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন, সেটা থেকে যেন আমরা খরচ করি। আল্লাহর ﷻ রাস্তায় খরচ করতে গিয়ে যেন আমরা মনে না করি যে, “এগুলো সব আমার, দিবো না কাউকে!” বরং এগুলো সবই আল্লাহর ﷻ। তিনি আপনাকে কিছুদিন ব্যবহার করার জন্য দিয়েছেন। একদিন তিনি সবকিছু নিয়ে যাবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা আপনাকে উলঙ্গ করে, একটা সস্তা সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে, মাটির গর্তে পুঁতে দিয়ে আসবে। কয়েকদিন কান্নাকাটির পর সবাই আবার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে, আপনাকে ভুলে যাবে। অনেকসময় আমরা চাকরি হারিয়ে ফেললে, বা ব্যবসায় লোকসান হলে সব দোষ হয় বসের, পার্টনারের, বন্ধুর, না হলে বউয়ের। আমরা মনে করি, অমুকের জন্যই আজকে আমি সব হারিয়ে ফেললাম। আজকে আমার এই দুরবস্থার জন্য সব দোষ তার। তার জন্য আমি এত করলাম, আর সে আমার সাথে এমন করতে পারলো? —এভাবে তার প্রতি আক্রোশ ধরে রেখে বছরের পর বছর পার করি। অনেক সময় বহু বছরের সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলি। আল্লাহ ﷻ এই আয়াতে বলছেন, “আল্লাহই ﷻ কমিয়ে দেন এবং বাড়িয়ে দেন”। আমাদের রিযক্ব আসে আল্লাহর ﷻ কাছ থেকে। তিনি যখন সিদ্ধান্ত নেন রিযক্ব বাড়িয়ে দেবেন, তখন আমাদের দিনকাল ভালো যায়, চাকরি হয়, ব্যবসায় লাভ হতে থাকে, ছেলেমেয়ে উপরে উঠতে থাকে, বিদেশে যাওয়া হয়। যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন রিযক্ব কমিয়ে দেবেন, তখন চাকরি চলে যায়, ব্যবসা ধ্বসে যায়, ছেলেমেয়ে দূরে চলে যায়, দেশে ফিরে আসতে হয় ইত্যাদি। মানুষের জীবনে রিযক্ব-এর উঠানামা হবেই। আর এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ ﷻ হাতে। যেই বন্ধুকে আপনি দোষ দিচ্ছেন চাকরি হারানোর জন্য, সেই বন্ধু আসলে রিজক কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার একটি মাধ্যম। যেই পার্টনারের ভুলের জন্য ব্যবসা ধ্বসে গেল, সেই পার্টনারের ভুল ছিল আপনার রিযক্ব কমিয়ে দেওয়ার একটি উপলক্ষ। আমরা যখন খুব ভালভাবে উপলব্ধি করবো যে, আল্লাহ ﷻ হচ্ছেন আর-রাযযাক্ব, একমাত্র রিযক্ব দাতা, তখন আমরা কখনোই দিনকাল খারাপ গেলে অন্য কাউকে দোষ দেবো না। মেনে নেবো যে, এখন আল্লাহ ﷻ আমাকে কম রিযক্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই আমার জীবনে এসব ঘটছে। আল্লাহর ﷻ সিদ্ধান্তের জন্য কাউকে দোষ দেওয়ার কোনো মানে নেই। আল্লাহ ﷻ যখন আবার রিযক্ব বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন আমার অবস্থা আবার ভালো হয়ে যাবে। বরং আমি চিন্তা করে দেখি, এখন আমি কী করতে পারি, যা করলে আল্লাহ ﷻ আমাকে আরও রিযক্ব দেবেন? রিযক্ব বাড়ানোর জন্য আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কী কী করতে বলেছেন? তার কাছেই তোমরা ফিরে যাবে টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি দূরের কথা, আমি তো নিজেই আল্লাহর ﷻ কাছে ফিরে যাবো। তখন কী হবে? কু’রআনে বার বার এই কথাটা আসে, “তাঁর কাছেই তোমরা ফিরে যাবে”। আমাদের সময় নিয়ে এই কথাটার মর্ম উপলব্ধি করার প্রয়োজন, কারণ এটার মর্ম উপলব্ধি করলে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে। কিছু মুসলিম আছে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজানে ত্রিশটা রোজা রাখে, কিন্তু গত এক বছরেও কোনোদিন কোনো এতিম খানায় একটা টাকাও দিতে পারেনি। ড্রাইভার, কাজের বুয়া, বাড়ির দারোয়ান তার কাছে বার বার টাকা চাইতে এসে— “দিবো, দিবো, রমজান আসুক” —এই শুনে খালি হাতে ফিরে গেছে। গরিব আত্মীয়স্বজন এসে কয়েকদিন থেকে ফিরে গেছে, কিন্তু কোনো টাকা নিয়ে যেতে পারেনি। মসজিদে বহুবার সে বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য টাকার আবেদন শুনেছে, কিন্তু কোনোদিন পকেটে হাত দিয়ে একটা একশ টাকার নোট বের করে দিতে পারেনি। ঘরের মধ্যে এসি ছেড়ে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়া সোজা কাজ, কিন্তু পকেট থেকে হাজার টাকা বের করে গরিব আত্মীয়, প্রতিবেশী, এতিমখানায় দেওয়া যথেষ্ট কঠিন কাজ। এর জন্য ঈমান লাগে। এই ধরনের মানুষদের আল্লাহর ﷻ সাথে সম্পর্ক কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পর্যন্তই। আল্লাহর ﷻ প্রতি তাদের বিশ্বাস এখনও এতটা মজবুত হয়নি যে, তারা আল্লাহর ﷻ উপর বিশ্বাস রেখে হাজার খানেক টাকা নির্দ্বিধায় একটা এতিমখানায় দিয়ে দিতে পারে। কিয়ামতের দিনের প্রতিদান নিয়ে এখনও তাদের সন্দেহ ততটা দূর হয়নি যে, তারা নির্দ্বিধায় গরিব আত্মীয়দের চিকিৎসায় দশ হাজার টাকা লাগলেও, সেটা হাসিমুখে দিয়ে দিতে পারে। তারা যদি সত্যিই মু’মিন হতো, তাহলে তারা প্রতিদিন সকালে উঠে চিন্তা করতো, “আজকে আমি কাকে আল্লাহর ﷻ সম্পদ ফিরিয়ে দিতে পারি? আল্লাহর ﷻ কোন মেহমানকে আজকে আমি খাওয়াতে পারি? কার কাছে গিয়ে আজকে আমি জান্নাতের জন্য সিকিউরিটি ডিপোজিট করতে পারি?” তাহলে কি সব টাকা পয়সা আল্লাহ্‌কে দিয়ে দিব? কু’রআনের একটি আয়াত পড়ে কোনো সিদ্ধান্তে চলে গেলে ভুল সিধান্ত নেওয়া হবে। কু’রআনে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে ভারসাম্য করতে বলেছেন। বহু আয়াত আছে যেখানে আমাদেরকে বাবা-মা, পরিবার, সন্তান এর অধিকার আদায় করতে বলেছেন, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব দিয়েছেন। বহু আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে তাঁর এই অসাধারণ পৃথিবী ঘুরে দেখতে বলেছেন, সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গবেষণা করতে বলেছেন, তাঁর সৃষ্ট হালাল আনন্দ উপভোগ করতে বলেছেন। সেই আয়াতগুলো মানতে গেলে দুনিয়াতে টাকা খরচ করতে হবে, টাকা জমিয়ে রাখতে হবে। যদি সব টাকা দান করে দেই, তাহলে কোনোদিন সেই আয়াতগুলোর উপর আমল করা হবে না। কু’রআনের একটা বড় অংশের উপর আমল না করেই আমরা মরে যাবো। সুতরাং সম্পত্তি কীভাবে ব্যবহার করবো, কোথায় কতটুকু ব্যবহার করবো, এটা পুরো কু’রআন পড়ে সম্পূর্ণ ধারণা নিয়ে তারপরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো একটা আয়াত পড়ে ঝোঁকের মাথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে হবে না। আমরা হাদিস থেকে উদাহরণ পাই, একজন সাহাবি এই আয়াত শুনে তার দুটো বাগানই আল্লাহর ﷻ পথে দান করে দিতে চাইলে, রাসুল ﷺ তাকে একটি দান করে অন্যটি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য রেখে দিতে বলেন। এভাবেই আমরা সম্পত্তি নিজেদের প্রয়োজনে এবং আল্লাহর ﷻ পথে খরচ করতে ভারসাম্য করবো।

কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর অনুমতিতে —আল-বাক্বারাহ ২৪৬-২৫২

মুসলিমদের উপর যখন অমুসলিমরা নির্যাতন করে, তাদের সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়, কর্তৃত্ব দখল করে নেয়, বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়, তখন মুসলিমরা কীভাবে যুদ্ধ করে তাদের অধিকার আদায় করবে, তা আল্লাহ ﷻ আল-বাক্বারাহ’তে তালুত এবং দাউদ ﷺ-এর ঘটনার মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। এই আয়াতগুলো থেকে আমরা জানতে পারি: তারা কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করেছিলেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে একটি মুসলিম সম্প্রদায় হাতে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করতে পারে। মাত্র ছয়টি আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে ইতিহাসের সেই অসাধারণ ঘটনার পরিষ্কার বর্ণনা দেবেন, যেই ঘটনা নিয়ে বাইবেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিভ্রান্তিকর বর্ণনা আছে। এই আয়াতগুলো থেকে একজন নেতা অনেক উপলব্ধির বিষয় পাবেন। একই সাথে অনুসারীরাও বিভিন্ন প্রকারের নেতাদের সম্পর্কে সাবধান হতে পারবেন—
বনি ইসরাইলের ওই গোত্র প্রধানদের কথা ভেবে দেখেছ, যারা তাদের নবীকে বলেছিল, “আমাদের জন্য এক রাজা নির্ধারণ করে দিন, যেন আমরা আল্লাহর ﷻ পথে যুদ্ধ করতে পারি।” তিনি বলেন, “যদি এমন হয় যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কিন্তু তারপরেও তোমরা যুদ্ধ করলে না, তখন?” তারা বলল, “কেন আমরা আল্লাহর ﷻ পথে যুদ্ধ করবো না, যখন কিনা আমাদের ঘরবাড়ি থেকে আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কয়েকজন বাদে বেশিরভাগই পিঠটান দিলো। আল্লাহ ﷻ অন্যায়কারীদের ভালো করে চেনেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৬] এই আয়াতে বেশ কিছু শেখার ব্যাপার রয়েছে। কখন আল্লাহ ﷻ যুদ্ধ করার অধিকার দেন? যখন মুসলিমদের উপর আক্রমণ হয়, তাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল হয়ে যায়, তখন তারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করার জন্য পরিষ্কার প্রমাণ কু’রআনে রয়েছে। এথেকেই দেখা যায়, ক্বিতাল বা যুদ্ধ হচ্ছে মূলত আত্মরক্ষামূলক। এর আগের আয়াতগুলোতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ক্বিতাল বা যুদ্ধ করার কঠিন আদেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে সাবধান করেছেন, আমরা যেন যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন না করে পালিয়ে না যাই। ঠিক এরপরেই তিনি আমাদেরকে যুদ্ধের একটি ঘটনা বলে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, কখন কোন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করার অনুমতি তিনি দিয়েছেন। কিছু উগ্রপন্থী নেতা এর আগের আয়াতগুলো, যেমন: “তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা মৃত্যুর ভয়ে হাজারে হাজারে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল? তখন আল্লাহ ﷻ তাদেরকে বললেন, “মরো”। তারপরে একদিন তিনি তাদেরকে জীবিত করলেন। আল্লাহ ﷻ মানুষের অনেক কল্যাণ করেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কৃতজ্ঞতা দেখায় না। [আল-বাক্বারাহ ২৪৩] আর আল্লাহর ﷻ পথে যুদ্ধ (ক্বিতাল) করো। জেনে রেখো, আল্লাহ ﷻ সব শুনছেন, সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৪]” —এগুলো বলে মানুষকে আক্রমণাত্মক জিহাদের দোহাই দিয়ে মুসলিমদেরকে দিয়ে অবৈধ হামলা, নিরীহ মানুষ হত্যা ইত্যাদির দিকে উস্কে দেয়। কিন্তু তারা খুব সাবধানে এরপরের আয়াতগুলো এড়িয়ে যায়, কারণ পরের আয়াতে আল্লাহ ﷻ পরিষ্কার করে কখন, কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করা বৈধ, সেটা জানিয়ে দিয়েছেন। আরেকটি শেখার ব্যাপার হলো: মানুষের মধ্যে অনেক নেতা থাকবে, যারা নির্যাতিত মানুষদেরকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য, যুদ্ধ করার জন্য অনেক রক্ত গরম করা বক্তৃতা দেবে। কিন্তু যখনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার পরিস্থিতি হবে, তখন তাদের আসল চেহারা বের হয়ে যাবে। এরা যুদ্ধের আদেশ আসলে নিজেরা পিঠটান দেবে, অথবা সুকৌশলে নিজেরা যুদ্ধে না গিয়ে, অন্যদেরকে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এথেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই, যেসব তথাকথিত নেতারা ‘জিহাদ! জিহাদ!’ করে মুসলিমদেরকে এত ডাকাডাকি করছেন, তারা নিজেরা কেন জিহাদে যাচ্ছেন না? বসে বসে এত বই না লিখে, এত লেকচার না দিয়ে, নিজেরা কেন যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন না? যখনই কেউ আমাদেরকে জিহাদে যাওয়ার জন্য বুদ্ধি দেওয়া শুরু করবে, কীভাবে বর্ডার পার হতে হয়, কীভাবে প্লেনে করে গোপনে অমুক দেশে যেতে হয়, কীভাবে হোটেলে হামলা করতে হয়, তাদেরকে আমাদের প্রথম প্রশ্ন করতে হবে, “আমাকে যেই বুদ্ধি দিচ্ছেন, সেটা নিজে করছেন না কেন? গলাবাজি না করে আগে নিজে করে দেখান?” তাদের নবী তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ ﷻ তালুত-কে তোমাদের রাজা নির্ধারণ করেছেন।” কিন্তু তারা বলল, “সে কীভাবে আমাদের রাজা হতে পারে, যেখানে রাজত্ব করার অধিকার তার থেকে আমাদের বেশি? তার তো অনেক সম্পত্তিও নেই?” তিনি বললেন, “তোমাদের চেয়ে তাকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত আল্লাহই ﷻ নিয়েছেন এবং তাকে তিনি ﷻ অনেক জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তি দিয়েছেন।” আল্লাহ ﷻ যাকে চান, তাকেই রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ ﷻ সবকিছুর ব্যাপারে সব জ্ঞান রাখেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৭] একজন নবী ঘোষণা দিলেন যে, আল্লাহ ﷻ নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন রাজাকে! নবী বেঁচে থাকতেও কোনো এক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব একজন রাজা দিতে পারে। এথেকে দেখা যায়, নবী থাকার সময়ও রাজতন্ত্র বৈধ, এবং রাজার আনুগত্য করতে মানুষ বাধ্য, যতক্ষণ না রাজা মানুষকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করতে বলছে। একজন নবীর মতো সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের ধর্মীয় নেতা রাজত্বের নেতৃত্ব নিজে না নিয়ে যে অন্য কোনো যোগ্য নেতাকে দিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই আয়াত। এই আয়াত থেকে প্রমাণ মেলে যে, ধর্মীয় দিক থেকে একজন অনেক উপরে উঠলেই সে সব কিছুর যোগ্য হয়ে যায় না। একটি দেশের রাজা বা খালিফা হওয়ার যোগ্যতা শুধুই একজন আলেমের থাকবে, তা নয়। বরং অন্য কারো আরও বেশি যোগ্যতা থাকতে পারে।[১৭] রাজার কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে, সেটাও আল্লাহ ﷻ এখানে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অনেক সম্পত্তি থাকাটা রাজা হওয়ার জন্য মোটেও দরকার নেই। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বেশিরভাগ রাজারা ছিলেন বিরাট ধনকুবের। বিপুল পরিমাণের সম্পদ নিয়ে তারা জৌলুশের জীবন পার করে গেছেন। কিন্তু ইসলামে সম্পত্তির সাথে নেতৃত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নেতৃত্বের জন্য দরকার জ্ঞান এবং শক্তি। যদি রাজার জ্ঞান না থেকে শুধুই শক্তি থাকে, তাহলে সেই শক্তি ব্যবহার হবে বিরাট অন্যায় ঘটাতে। আর যদি জ্ঞান থাকে, শক্তি না থাকে, তাহলে শুধু জ্ঞান দিয়ে শত্রুকে পরাজিত করা যাবে না, এবং সে একজন অনুসরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব হবে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাসুল ﷺ। তিনি পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও নিয়মিত প্রচণ্ড গরমে মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজে যুদ্ধ করার মতো সবল ছিলেন। মরুভূমিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এক কথা, আর যুদ্ধের সরঞ্জাম পরে দিনের পর দিন যুদ্ধ করা আরেক কথা। এর জন্য যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্য দেহ থাকা দরকার। অথচ আজকে আমরা হাজ্জ করতে গেলে এয়ারকন্ডিশন্ড হোটেল থেকে বের হয়ে মসজিদ পর্যন্ত গিয়েই হাঁপিয়ে যাই। আমরা অনেকেই রাসুলের ﷺ খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়ার সুন্নাহ মানি, যেটা একটা ভুয়া সুন্নাহ। মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে, দিনের বেশিরভাগ সময় বসে থেকে ভুঁড়ি বানাই। অথচ রাসুল ﷺ যে নিয়মিত শারীরিক চর্চা করতেন, নিজেকে শক্ত সামর্থ্য রাখতেন, সেই সুন্নাহ আমরা ভুলে গেছি। যুদ্ধে যাওয়া তো দূরের কথা, মসজিদে দিনে পাঁচবার যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যও আমাদের অনেকের নেই।
তাদের নবী তাদেরকে বললেন, “তার নেতৃত্বের প্রমাণ হলো যে, তাদের কাছে তাবুত (সিন্দুক) আসবে, যাতে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রশান্তি, এবং মুসা ও হারুনের অনুসারীদের রেখে যাওয়া কিছু জিনিস। সেটা ফেরেশতারা বয়ে আনবে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে তাদের জন্য এক বিরাট নিদর্শন রয়েছে, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।” [আল-বাক্বারাহ ২৪৮] এই তাবুত বা সিন্দুক নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। বাইবেলে এনিয়ে অনেক কাহিনী আছে, যেগুলোর শুদ্ধটা যাচাই করা কঠিন। Arc of Covenant নামে পরিচিত অলৌকিক ক্ষমতার এই সিন্দুকের ইতিহাস রক্তাক্ত। বেশ কয়েকবার এটি হাত বদল হয়েছে এবং যে রাজত্ব এটা জয় করেছে, সেই রাজত্ব শান্তি এবং বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছে বলে বাইবেলে অনেক ঘটনা আছে। একারণে এই অলৌকিক সিন্দুকের দখল নিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তবে মুসলিমদের জন্য এই সব ইতিহাস জানার প্রয়োজন নেই। আমাদের শুধু দেখতে হবে, এই আয়াতে আমাদের উপলব্ধি করার কী রয়েছে। কু’রআন মানুষকে গল্প বলে মনোরঞ্জন করার জন্য পাঠানো হয়নি। কু’রআনের প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি শব্দ বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যেন মানুষ নিজেদের সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে। আমরা এই আয়াত থেকে উপলব্ধি করতে পারি যে, তালুত-কে যখন নবী রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন, তখন তারা তা মেনে নিলো না। একজন নবীর নির্দেশ মানতেও তারা রাজি ছিল না। যতক্ষণ না তাদেরকে এই সিন্দুক অলৌকিকভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এথেকে শেখার হলো, কিছু নেতা থাকবে, যাদেরকে বাইরে থেকে দেখে ধর্মের অনুসারী মনে হবে। কিন্তু যখনই ধর্ম তাদেরকে নিজেদের সম্মান, স্বার্থ বিসর্জন দিতে বলবে, তখনি তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে যাবে। পরিষ্কার প্রমাণ থাকার পরেও তারা সেটা মানতে চাইবে না।
তারপর যখন তালুত তার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তখন তিনি বললেন , “আল্লাহ ﷻ তোমাদেরকে একটি নদী দিয়ে পরীক্ষা করবেন। যে সেই নদী থেকে পান করবে, সে আর আমার দলের নয়। কিন্তু যে সেটার স্বাদ নেবে না, সে আমার দলের। তবে যে এক আঁজলা পান করবে, তার দোষ হবে না।” কিন্তু কয়েকজন বাদে বাকি সবাই পেট ভরে পানি খেলো। তারপর যখন সে এবং তার সাথের বিশ্বাসীরা পার হলো, তখন তারা বলল, “আমাদের কোনো ক্ষমতাই নেই জালুত এবং তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।” কিন্তু যারা নিশ্চিত ছিল যে তারা আল্লাহর ﷻ সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, তারা বলল,“কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর ﷻ অনুমতিতে। আল্লাহ ﷻ ধৈর্য-নিষ্ঠাবানদের সাথে আছেন।” [আল-বাক্বারাহ ২৪৯] একজন নেতার জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ হলো তার বাহিনীর ভেতরে নিষ্ঠাবান অনুসারীদের চিহ্নিত করা এবং কারা তাকে প্রয়োজনের সময় অনুসরণ করবে না, সেটা আগেভাগেই বের করে ফেলা। এই মানুষগুলোকে যত আগে সম্ভব বাহিনী থেকে বের করে দিতে হবে। না হলে তারা বাহিনীর সম্পদ নষ্ট করবে, মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দেবে, তারপর দরকারের সময় নিজেরা তো পালাবেই, অন্যের মনোবলও ভেঙ্গে দেবে। তালুত তার বাহিনীর মধ্যে কে নিষ্ঠাবান, আর কে বিপদে পড়লে পিঠটান দেবে, সেটা বের করার জন্য তাদেরকে এক পরীক্ষা দিলেন। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীকে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এই যাত্রা পথে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী হলো পানি। বাহিনীর ঘোড়া, উট, গরু, হাতি, মানুষ সবার জন্য পানি দরকার। পানি হলো একটি সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই সেনাবাহিনী যখন কোনো নদী বা জলাশয় খুঁজে পায়, তারা যতটুকু পারে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে নেয়। কিন্তু তালুত তার বাহিনীকে এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষা দিলেন। চোখের সামনে নদী ভর্তি পানি টলটল করছে, কিন্তু তারা সেই পানি পান করতে পারবে না। এবং তারা সেটা করবে না শুধুই তাদের সেনাপতিকে বিশ্বাস করে, তার প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের কাছে মনে হয়েছিল যে, সেটা কোনো যৌক্তিক দাবি নয়। বাস্তবতা দেখতে হবে। এখন যুদ্ধ চলছে। সবাই তৃষ্ণার্ত। পানির এত বড় একটা সুযোগ ছেড়ে দেওয়াটা বিরাট বোকামি। এই সব ভেবে তারা সেনাপতির নির্দেশকে অমান্য করলো। এথেকেই বেড়িয়ে পড়লো তাদের মধ্যে কে সত্যিই সেনাপতির প্রতি পুরোপুরি অনুগত, আর কে নিজের প্রবৃত্তির প্রতি অনুগত। যারা এত বড় লোভ, পিপাসার কষ্ট সামাল দিতে পেরেছিল শুধুই সেনাপতির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে, তারাই ছিল প্রকৃত বিশ্বাসী অনুসারী। তারাই যুদ্ধে এসেছিল সঠিক নিয়ত নিয়ে — আল্লাহর ﷻ সন্তুষ্টি অর্জন এবং নেতার প্রতি আনুগত্যের দায়িত্ববোধ থেকে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তালুত বলেছিলেন, “কিন্তু যে সেটার স্বাদ নেবে না, সে আমার দলের।” তিনি বলেননি, যে সেটা ‘পান’ করবে না। তিনি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এক দুই আঁজলা পানি পান পান করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেটা দেখতে চাইছিলেন সেটা হলো, কে আছে যে নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে, তার আদেশ অমান্য করে পেট ভরে পানি খাবে। —এথেকেই তার বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পানি ছুঁয়ে না দেখার অবাস্তব পরীক্ষা দেননি। তার পরীক্ষা ছিল শুধুই মুনাফিক, প্রবৃত্তির দাসদের বাছাই করে ছেঁটে ফেলার পরীক্ষা। এই পরীক্ষা থেকে তালুত বাছাই করে নিলেন সেই সব নিষ্ঠাবান সৈন্যদেরকে, যারা তার সাথে যুদ্ধ করার যোগ্য। তাদেরকে নিয়ে তিনি নদী পার হয়ে যুদ্ধের ময়দানে গেলেন। সেখানে গিয়ে তাদের অনেকে জালুত এবং তার বিশাল বাহিনী দেখে আশা হারিয়ে ফেললো। অনেকেই সেখান থেকে পালিয়ে গেল, এইভেবে যে, দুই বাহিনীর মধ্যে লোকবলের এত বিশাল পার্থক্য থাকলে কোনোভাবেই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। এটা বরং আত্মহত্যা। কিন্তু তারপরেও তালুতের সাথে কয়েকজন ইস্পাত দৃঢ় মনোবলের সৈন্য ছিলেন, যারা ঈমানের এই ভয়ঙ্কর কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে তালুতের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেন। এরা এক অসাধারণ কথা বললেন— “কত বার এমন হয়েছে যে, ছোট একটা দল বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে আল্লাহর ﷻ অনুমতিতে।” আমরা অনেক সময় সঙ্ঘবদ্ধ অমুসলিম শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের তুচ্ছ মনে করি। আশা হারিয়ে ফেলি এই ভেবে যে, আমাদের পক্ষে কোনোদিনও ওদের বিরুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। ওদের আছে বিশাল বাহিনী, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ওদের দখলে। ইউনাইটেড নেশন্স ওদের কথায় ওঠাবসা করে। ওরা কোনো জায়গায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে অন্য দেশগুলোও তাদের সাথে যোগ দেয়। আর এদিকে মুসলিমরা বড়ই একা, বিভক্ত, প্রযুক্তিতে একেবারেই পিছিয়ে, অর্থনীতিতে দুর্বল, সারা পৃথিবীতে অপমানিত, ঘৃণিত। এই দুর্বল বিশ্বাস থেকে আমরা অনেকেই নিজেদের উপর অন্যায় হলে, এমনকি আক্রমণ হলেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করি না। কোনো ধরনের প্রতিরোধ করাটা আমাদের কাছে আত্মহত্যার সামিল বলে মনে হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা সময় নষ্ট মনে হয়। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে অসাধারণ এক শিক্ষা দিয়েছেন। ইতিহাসে এক বার, দুইবার নয়, বহুবার ছোট একটি দল বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেছে, যখন সেই ছোট বাহিনী ইসলাম সমর্থিত উপায়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছে। তালুত-এর যুদ্ধ, বদর-এর যুদ্ধ এগুলো সবই উজ্জ্বল উদাহরণ যে, আল্লাহ ﷻ নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সত্যিকারের ঈমানদার বান্দাদেরকে নিজে সাহায্য করেন। তার সাহায্যে ঈমানদার বান্দারা বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও অলৌকিকভাবে জয়ী হয়। সুতরাং যারা ইসলাম সম্মত আত্মরক্ষামূলক ক্বিতাল বা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, তাদের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ ﷻ তাদেরকে জয়ী করবেনই। কু’রআনেই সেই অঙ্গীকার রয়েছে। আর যারা ইসলাম সম্মত যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন না, তাদের নিয়ত যতই ভালো থাকুক না কেন, তারা আসলে নিজেরা আত্মহত্যা করে পুরো মুসলিম জাতির জন্য বিরাট ফাসাদ তৈরিতে সহযোগিতা করতে যাচ্ছেন। আয়াতের এই অংশটি উগ্রপন্থী দলরা অপব্যবহার করে মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে। তারা তাদের অবৈধ মারামারিতে সরল প্রাণ মুসলিমদের বাগিয়ে নেওয়ার জন্য আয়াতের এই অংশ ব্যবহার করে। আয়াতে এই অংশ কোট করার আগে আমাদেরকে দেখতে হবে, তারা আমাদেরকে যেই যুদ্ধে অংশ নিতে বলছে, তার সাথে এই আয়াতে তালুত-এর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কতখানি মিল রয়েছে। এই আয়াতের প্রেক্ষাপটের অনুরূপ অবস্থা তৈরি হয়েছে কি? মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে কি কোনো কাফির বাহিনী যুদ্ধ করতে এসেছে? আমরা কি সত্যিই আত্মরক্ষায় যুদ্ধ করছি? মুসলিম বাহিনীর নেতা কি রাসুল ﷺ এর এক আদর্শ অনুসারী? যিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনো নবী বা রাসুল নন। তাহলে তিনি কি তালুত-এর মতো একজন মুসলিম রাজা, যাকে আল্লাহ ﷻ এবং রাসুল পরিষ্কার কর্তৃত্ব দিয়েছেন? মুসলিম জাতি কি তার আনুগত্য মেনে নিয়েছে? —এই সব শর্ত পূরণ না করে কেউ এই আয়াতের দোহাই দিয়ে কোনো ধরনের হামলা করতে বললে বুঝতে হবে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজের কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করা। না হয় সে নিজেই ব্যাপক বিভ্রান্ত। ইসলামের সঠিক জ্ঞান তার মধ্যে নেই, অথবা তার ব্যক্তিগত আক্রোশ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তালুতের সাথে শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়া সেই সম্মানিত বিশ্বাসীরা যুদ্ধে যাওয়ার সময় আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চেয়ে যে দু’আ করেছিলেন, সেই দু’আ আল্লাহ ﷻ কু’রআনে সারা মানবজাতির জন্য বাধাই করে রেখেছেন, যা মানুষ যুগ যুগ ধরে কিয়ামত পর্যন্ত পড়ে আল্লাহর ﷻ কাছে সাহায্য চাইবে—
তারপর যখন তারা জালুদ আর তার বাহিনীর সামনে দাঁড়ালো, তারা বলল, “ও আমাদের রব, আমাদের উপর ধৈর্য-নিষ্ঠা বর্ষণ করুন। আমাদেরকে দৃঢ় পায়ে অবিচল রাখুন। আমাদেরকে কাফিরদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করুন।” [আল-বাক্বারাহ ২৫০] তাদের প্রথম চাওয়া ছিল, أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا “আমাদের উপর সবর বর্ষণ করুন।” أَفْرِغْ হচ্ছে ঢেলে দেওয়া, বোতল ঢেলে খালি করে ফেলা।[৫][১] আল্লাহর ﷻ কাছে তারা শুধু সবর চাইলেন না, বরং বললেন তাদের উপর ক্রমাগত সবর বর্ষণ করে, তাদের অন্তর পূর্ণ করে দিন। যত সবর আছে, সব দিয়ে দিন। —কষ্টের সময় সবর বড়ই প্রয়োজন। আর সবর সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাঁড়িওলা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুম্মার খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।” ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামাজ পড়লেই আল্লাহ ﷻ আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা এবং কু’রআনের এই আয়াতে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু শব্দের অর্থগুলো ঠিকমত না বোঝা। সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাবো, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করবো না, এই ভেবে যে: একদিন আল্লাহ ﷻ সব ঠিক করে দেবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৭] আছে— তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল। আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৭] এর লেখা— শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার মেয়ে-জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল। উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা।[৫][৭] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর ﷻ আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪]
তারপর তারা আল্লাহর ﷻ অনুমতিতে ওদেরকে পরাজিত করলেন। দাউদ জালুতকে হত্যা করলেন। আল্লাহ ﷻ তাকে রাজত্ব, প্রজ্ঞা দিলেন, এবং তাকে তিনি যা চাইলেন শেখালেন। যদি আল্লাহ ﷻ কিছু মানুষকে দিয়ে অন্যদেরকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হতো। কিন্তু আল্লাহ ﷻ বিশ্ববাসীর প্রতি অনেক কল্যাণ করেন। [আল-বাক্বারাহ ২৫১] পৃথিবীতে কোনো জাতি অঢেল ক্ষমতা, সমৃদ্ধি, প্রাচুর্যতে থেকে ন্যায়, নিষ্ঠা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। বেশিরভাগ জাতি কয়েক যুগ যেতে না যেতেই অন্যায়, অশ্লীলতায় ডুবে গেছে। সেটা অমুসলিমদের বেলায় যেমন হয়েছে, মুসলিমদের বেলায়ও হয়েছে। একারণেই আল্লাহ ﷻ মানুষের মধ্যে কিছু দল তৈরি করেন, যারা সেই সমৃদ্ধশালী অন্যায়কারী জাতিগুলোকে পরাজিত করে আবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। আরেক জাতি তৈরি হয়। তারপর যুগ পার হয়। একসময় দেখা যায় সেই জাতি নিজেরাই আবার অন্যায়ে ডুবে গেছে। তখন আরেক দল এসে তাদেরকে পরাজিত করে আবার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে। আল্লাহ ﷻ যদি এভাবে শক্তিশালী অন্যায়কারী জাতিগুলোকে বার বার পরাজিত না করতেন, তাহলে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক অন্যায় ছড়িয়ে পড়তো।
এই হচ্ছে আল্লাহর ﷻ নিদর্শন, যা তিনি তোমার (মুহাম্মাদ সা:) উপর যথাযথভাবে তিলাওয়াত করেন। তুমি অবশ্যই রাসুলদের একজন। [আল-বাক্বারাহ ২৫২] সুত্র: [১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স

বৃদ্ধাশ্রম : কিছু অনুযোগ, কিছু অনুরোধ

বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ্য করে বললে, বলতে হবে- বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণার বোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি- যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। এখন যা আছে তা হল, ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচে’ বেশি আপন, যাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে আমাদের মানুষ করেছেন নিজের সব দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে আমার হাসি মাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যকুল থাকতেন, আমি না খেলে যিনি খেতেন না, আমি না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে থাকতেন আমার শিয়রে, যে বাবা-মা তিলে তিলে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন আমাকে মানুষ করার জন্য, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রমগুলো। মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস। এক-দু’ দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম? এ প্রশ্নের উত্তর বড়ই করুণ। যে সন্তান বাবা-মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, মা-বাবাই ছিল যার সারা জীবনের আশ্রয়স্থল, সে কিনা আজ বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না, বাবা-মাকে ঝামেলা মনে করছে। তাঁদেরকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। অথবা অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যেন তারা নিজেরাই ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন। অনেকের ভাব এমন, টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও বাবা-মাকে দেওয়ার মত সময়ের তাদের অভাব আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের নেই। তাই বাবা-মা একা নির্জনে থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে অন্যদের সঙ্গে কাটানোই নাকি ভালো মনে হয়। এ ধরনের নানা অজুহাতে বাবা-মাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একসময় যারা নামী দামী বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও চাকরিজীবী ছিলেন, বর্ণাঢ্য ছিল যাদের জীবন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বহু পিতা-মাতা এখন বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবার ও সন্তান থেকেও ‘সন্তানহারা এতীম’ হয়ে জীবন যাপন করছেন। এরচে’ বড় দুঃখ মা-বাবার জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। পত্রিকার পাতায় নজর বুলালেই এর প্রমাণ মেলে। বিভিন্ন সময়ই বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে লেখা বৃদ্ধ পিতা-মাতার চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়। যা পড়ে চোখের পানি সংবরণ করা যায় না। আমরা যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করছি, তাদেরকে বোঝা মনে করছি, বৃদ্ধাশ্রমে তাদেরকে ফেলে রেখেছি, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছি- আজ তারা বৃদ্ধ। তারা তো বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসেননি। তারা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না। বরং আমরা সন্তানরাই তো তাদের ‘বোঝা’ ছিলাম। তারা তো কখনো আমাদেরকে বোঝা মনে করেননি। আমাদেরকে বড় করে তোলার জন্য তারা বিন্দু পরিমাণ কমতি করেননি। কত যতœ করে বুকে আগলিয়ে আমাদের লালন-পালন করেছেন । মা আমাদের জন্য কতই না কষ্ট করেছেন। গর্ভধারণের কষ্ট। প্রসবের কষ্ট। স্তন্যদানের কষ্ট। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়ার কষ্ট। এ তো প্রাথমিক কষ্ট। এরপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মা আমাদের জন্য কত যে কষ্ট করেছেন, এর কোনো হিসেব নেই। পৃথিবীতে এমন মা নেই যার এ কষ্টগুলো হয় না। মায়েরা এ কষ্টগুলো সহ্য করেই থাকেন। আল্লাহ তাআলা মায়ের কষ্ট ও তাদের প্রতি সন্তানদের করণীয় বর্ণনা করে কুরআনে ইরশাদ করেন- وَ وَصَّیْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَیْهِ حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰی وَهْنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْنِ اَنِ اشْكُرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیْكَ اِلَیَّ الْمَصِیْرُ . “আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি- (কারণ) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে- তুমি শোকর কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।” -সূরা লোকমান (৩১) : ১৪ এ আয়াত তো একথাই বলে, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার শোকর কর। কারণ তারা তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তোমাদেরকে আদর-যত্নে মানুষ করেছেন। হায় আমরা যদি এ আয়াতের মর্ম উপলব্ধি করতে পারতাম! পিতা-মাতার শোকর আদায়ের সবচে’ উপযুক্ত সময় হল তাদের বার্দ্ধক্য। কারণ এ সময় তারাও শিশুর মত হয়ে যান। নিজেরা কিছুই করতে পারেন না। সন্তানই তখন তাদের অন্ধের যষ্ঠি। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنْهَرْهُمَا وَ قُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَ قُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا رَبُّكُمْ اَعْلَمُ بِمَا فِیْ نُفُوْسِكُمْ اِنْ تَكُوْنُوْا صٰلِحِیْنَ فَاِنَّهٗ كَانَ لِلْاَوَّابِیْنَ غَفُوْرًا. “তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে উফ্ (পর্যন্ত) বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর এবং দুআ কর, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।” -সূরা বনী ইসরাঈল, (১৭) : ২৩-২৪ আল্লাহ তাআলা কী সুন্দর দুআ শিক্ষা দিয়েছেন- ‘হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।’ এ দুআ থেকে বুঝে আসে যে, সন্তান শৈশবে যে ধরনের লালন-পালনের মুখাপেক্ষী হয়, ঠিক তেমনি পিতা-মাতাও বৃদ্ধ বয়সে সে ধরনের মমতাপূর্ণ আচরণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। তাই আল্লাহ তাআলা এ দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের সাথে মমতাপূর্ণ আচরণের আদেশ দিয়েছেন। এ সময় তাদের সাথে দূর্ব্যবহার করা তো দূরের কথা উফ্ বলতে পর্যন্ত আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তাদেরকে ধমক দিতে নিষেধ করেছেন। অপরদিকে বার্ধক্যে মা-বাবার খেদমত করতে পারাটা যেমন জান্নাতে দাখেল হওয়ার কারণ তেমনি মা-বাবার খেদমত না করাটাও হতভাগা হওয়ার কারণ। এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, أن النبي صلى الله عليه وسلم رقى المنبر، فلما رقى الدرجة الأولى قال: آمين، ثم رقى الثانية فقال: آمين، ثم رقى الثالثة فقال: آمين، فقالوا: يا رسول الله، سمعناك تقول: آمين ثلاث مرات؟ قال: لما رقيت الدرجة الأولى جاءني جبريل صلى الله عليه وسلم فقال: شقي عبد أدرك رمضان، فانسلخ منه ولم يغفر له، فقلت: آمين. ثم قال: شقي عبد أدرك والديه أو أحدهما فلم يدخلاه الجنة، فقلت: آمين. ثم قال: شقي عبد ذكرت عنده ولم يصل عليك، فقلت: آمين. “নবীজী একবার মেম্বারে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমীন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন (কী বিষয় আল্লাহর রাসূল!) আপনাকে (এভাবে) আমীন বলতে শুনলাম। তখন নবীজী বললেন, আমি যখন মেম্বারে আরোহণ করলাম তখন জিবরীল আগমন করলেন এবং বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে রমযান মাস পেল, আর রমযান গত হয়ে গেল কিন্তু তার গোনাহ মাফ হলো না। আমি বললাম, আমীন। তারপর বলল, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে তার মা-বাবাকে অথবা কোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল অথচ তারা (মা-বাবা) তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালো না (অর্থাৎ তাদের খেদমতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।) আমি বললাম, আমীন। তৃতীয় বার বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হল আর সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না। বললাম, আমীন।” -আলআদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী, হাদীস ৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৫১ জিবরিল আলাইহিস সালামের বদদুআ আর নবীজীর আমিন বলা- দু’টি বিষয় লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় বৃদ্ধ মা-বাবার খেদমত কত বড় বিষয়। খেদমত না করাটা কত বড় অন্যায়! আর উপরের আয়াতে তো আমরা এটা দেখেছি যে শিরকের পরেই আল্লাহ মা-বাবার প্রতি সদাচারের বিষয়টি অতি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করছেন। এ সকল বিষয় যার উপলব্ধিতে আছে সে কি মা-বাবার প্রতি ‘বৃদ্ধাশ্রমের’ অবিচার করতে পারে। শৈশবে সন্তানের একমাত্র ভরসাস্থল তার বাবা-মা। পৃথিবীর সকল সন্তানের ক্ষেত্রেই এমন। একটি প্রতীকী গল্প বলি- বাবা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে গ্রামের নদীর উপর তৈরি বাশের সাঁকো পার হচ্ছিলেন। মেয়ের জন্য বাবা ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি মেয়েকে বললেন- “মা! শক্ত করে আমার হাত ধর।” মেয়ে উত্তর দিল: “না বাবা, বরং আপনিই আমার হাত ধরুন”। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তোমার হাত ধরা আর তুমি আমার হাত ধরার মধ্যে পার্থক্য কী? তুমি ধরলে যা হবে, আমি ধরলেও তো তাই হবে। মেয়ে বাবাকে বলে: “অনেক বড় পার্থক্য বাবা! যদি আমি আপনার হাত ধরি এবং সাঁকো পার হতে গিয়ে আমার কিছু হয়, তাহলে আমি ভয়ে আপনার হাত ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু আপনি যদি আমার হাত ধরেন, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যা-ই ঘটুক না কেন, জীবন গেলেও আপনি আমার হাত ছাড়বেন না! ” আমরা যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখছি শৈশবে তারাই কিন্তু ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। গল্পের মেয়েটির মত আমরাও কিন্তু বাবা-মায়ের কোলে নিজেকে সবচে’ বেশি নিরাপদ মনে করতাম। আর আজ কি না আমাদের সেই বাবা-মায়ের ঠিকানা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার একটি গল্প পড়েছিলাম এক কিতাবে- অসহায় মা তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বাস করেন শহরে। ছেলে বুঝ হওয়া অবধি দেখে আসছে তার মায়ের একটা চোখ নেই। এজন্য মাকে দেখতে কুৎসিত দেখায়। এ নিয়ে স্কুলে তার বন্ধুরা হাসাহাসি করে। একদিন মা স্কুলের পাশ দিয়ে কোথাও যাওয়ার সময়, ছেলেকে দেখতে স্কুলে গেলেন। ছেলে লজ্জায় দেখা করতে এল না। মা কিছু না বলে ফিরে এলেন। ছেলে এক সময় বড় হলো। পড়ালেখা শেষ করে চাকুরি নিলো। বিয়ে শাদি করে আলাদা হয়ে গেলো। মায়ের সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখলো না। খোঁজখবরও নিলো না। অনেক দিন পর ছেলে তার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনীর দাওয়াত পেয়ে আসলো। কী মনে করে সে আগের এলাকা দেখতে এলো। এই ফাঁকে মা কেমন আছে সেটাও দেখা হয়ে যাবে। যে ভাড়া বাড়িতে মা থাকতেন সেখানে এসে দেখলো, এখন সেই বাড়িতে অন্য ভাড়াটিয়া থাকে। পাশের বাড়ির মায়ের বয়েসি এক মহিলা ছেলেটিকে দেখে বের হলেন। ছেলেটিকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন : এটা তোমার আম্মু মারা যাওয়ার আগে তোমাকে দিতে বলে গেছেন। চিঠিটাতে লেখা ছিল :
‘বাবা! আমি জানি আমার একটা চোখ না থাকাতে আমাকে ভারি কুৎসিত দেখাতো। সেজন্য অন্যদের মতো তুমিও আমাকে পছন্দ করতে না। আমার চোখ না থাকার কারণটা জানলে নিশ্চয় তুমি আর আমাকে ঘৃণা করতে পারতে না। তুমি তখন ছোট। তোমার আব্বু, আমি আর তুমি অন্য এক শহরে থাকতাম। একদিন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তোমার আব্বু মারা যান। আমিও গুরুতর আহত হই। আর তোমার একটা চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমার একটি চোখ তোমাকে দিয়ে দিই। এরপর আমরা এই শহরে চলে আসি। এই ঘটনা আর কেউ জানে না, আমি আর কাউকে বলিনি।’ এমনই হয় মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এ তো একটি উদাহরণ মাত্র। মায়ের ভালোবাসা সন্তানের জন্য হাজারো গুণ বেশি। এমন মাকেও মানুষ ভুলে যায়। বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। হায় মানবতা! হায়রে মানুষ!! আমরা কেন বুঝি না, আজকের আমি ক’দিন পরেই বার্ধক্যে পা দেব। এটাই জীবনের ধর্ম। আমি কি ভেবে দেখেছি, আমি বৃদ্ধ হলে আমার আশ্রয় কোথায় হবে- যখন আমি আমার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখেছি। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক আমাদের সবার ঠিকানা। একইসাথে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করে এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা দরকার মনে করছি। আর তা হল, ‘বৃদ্ধাশ্রম মানবতার কলংকিত কারাগার’, ‘বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি এক নির্মম উপহাস’- এ কথাগুলো যেমন সত্য তেমনি একথাও সত্য যে, বৃদ্ধাশ্রম বর্তমান সময়ের এক তিক্ত বাস্তবতা। সামাজিক, মানসিক ও আদর্শিক নানা পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। অবহেলিত হচ্ছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা। এতে করে তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছেন। অবশেষে তাদের ঠাঁই নিতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। তাই যারা সমাজের এই তিক্ত বাস্তবতাকে সামনে রেখে অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের জন্য নিজের উদ্যোগে, নিজ খরচে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করছেন, ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে বৃদ্ধদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের এই উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। এ ক্ষেত্রেও দ্বীনদার বিত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার। সমাজে অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ ‘মা-বাবা’কে তাদের জীবনের শেষ দিনগুলোতে একটু ভালবাসা, মায়া-মমতা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে তারাও হতে পারেন অনেক বড় সাওয়াবের অধিকারী। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- من نفس عن مؤمن كربة من كرب الدنيا، نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة، ومن يسر على معسر، يسر الله عليه في الدنيا والآخرة، ومن ستر مسلما، ستره الله في الدنيا والآخرة، والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه. “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব কষ্টসমূহের একটি দূর করে দেয়, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে, আল্লাহ তাআলা তার দুনিয়া ও আখেরাতের অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাআলা বান্দার সহায়তায় থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহায়তায় থাকে।” -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮ যারা অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধদের পিছনে নিজের অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয় করবে, এই হাদীসের মর্মের ব্যাপকতায় তারাও শামিল হবেন। ইনশাআল্লাহ। যারা অসহায় বৃদ্ধদের কিংবা সন্তানদের কাছে অবহেলিত বাবা-মায়ের সেবার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করছেন তাদের উচিত, ‘এক সন্তানের কাছে অবহেলিত বাবা-মায়ে’র শেষ দিনগুলো যেন বৃদ্ধাশ্রমে ‘আরেক সন্তানের ঘরে’র মতই কাটে। বৃদ্ধাশ্রমগুলো যেন বাস্তব অর্থেই শেষ সময়ে তাদের আরাম-আয়েশের ভরসাস্থল হয়। সে দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। পাশাপাশি নিচের বিষয়গুলোর প্রতিও লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি : এক. বৃদ্ধাশ্রম শুরু থেকেই একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তাই বৃদ্ধাশ্রমগুলো যেন শতভাগ সেবামূলক হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসায়ী মনোভাব কিংবা দায়সারাভাব যেন বৃদ্ধাশ্রমের এ সেবামূলক কাজের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট না করে দেয়। দুই. বৃদ্ধাশ্রম যেহেতু বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল, তাই সেবক সেবিকারা যেন তাদের সাথে মমতা ও সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ করেন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এ তো মানবতার দাবিও বটে। আসলে আমরা যদি এভাবে চিন্তা করি, এখানে যারা অবহেলিত হয়ে এসেছেন তারা তো অবশ্যই কোনো না কোনো সন্তানের পিতা-মাতা। আর আমরা যারা এখানে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছি কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে সেবার কাজে নিয়োজিত আছি আমরাও কিন্তু পিতা-মাতারই সন্তান। তাদের সাথে সন্তানসূলভ আচরণ করা এ শুধু সৌজন্যই নয় বরং মানবতার দাবিও। তাই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে সেবার মান আরো উন্নত করা দরকার। তিন. বৃদ্ধাশ্রমে যারা আসেন তারা যেহেতু জীবনের শেষ সময়টা এখানে কাটান তাই তাদের এই শেষ সময়টা যেন দ্বীনী পরিবেশে, ইবাদত-বান্দেগী ও তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমেই কাটে সে দিকেও বিশেষ যতœ নিতে হবে। বৃদ্ধাশ্রমে যদি দ্বীনী পরিবেশ কায়েম করা যায় তাহলে এর মাধ্যমে তারা আত্মিক প্রশান্তিও লাভ করবেন। আত্মিক প্রশান্তি মানুষকে হতাশা, দুঃখ ও বেদনা থেকে মুক্তি দেয়। মানুষ কষ্টের মাঝেও এক অনাবিল সুখের খোঁজ পায়। এজন্য বৃদ্ধাশ্রমকে যদি দ্বীনী তালীম ও ইবাদতের উপযোগী করে তোলা যায় তাহলে অন্তত শেষ জীবনে হলেও তারা নিজেদেরকে আখেরাতমুখী করে ঈমান-আমল নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারবেন। এ তো একজন মুসলমানের জন্য মহা সফলতা। আল্লাহ তাআলা সূরা নাসরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জীবনের শেষ সময়ে আল্লাহ তাআলার হামদ ও তাসবীহ এবং বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফারের আদেশ করে উম্মতকে এ শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যেন জীবনের শেষ সময়ে বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার হামদ ও তাসবীহ, জিকির-আজকার করেন, ইবাদত-বন্দেগীতে রত থাকেন। আল্লাহ তাআলার দরবারে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا “তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করুন ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল।” -সূরা নাসর (১১০) : ৩ চার. বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষ থেকে ‘প্রবীণ নির্যাতনে’র বিষয়ে সচেতনতামূলক সভা সেমিনারের আয়োজন করা। এর মাধ্যমে যারা মাতা-পিতাকে অবহেলা করেন তাদের মানবিক চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা। বৃদ্ধাশ্রমের একটি কার্যক্রম এরকমও হতে পারে যে, যারা তাদের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যেতে আসবে তাদেরকে পিতা-মাতার সেবা করার সাওয়াব ও তাদেরকে সময় দেওয়ার লাভের বিষয়গুলো বুঝিয়ে তাদের মানবতাবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলা- যেন তারা তাদের পিতা-মাতাকে নিজেদের কাছে রাখার প্রতি উৎসাহী হন। আশা করি এর মাধ্যমে ‘প্রবীণ নির্যাতন’ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আসুন পিতা-মাতার জন্য দুআ করি- رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا ‘হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।’ আমীন। 

ইসলামে_মুসলিম_উম্মাহর_ভ্রাতৃত্ব





পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান :

মুসলমানরা পরস্পরের মান-ইয্যতের নিরাপত্তা বিধান, দুঃখ-কষ্টে অংশগ্রহণ, গঠনমূলক সমালোচনা, উপদেশ-নছীহত, একত্রে বসবাস সহ সার্বিক বিষয়ে পরস্পরের সহযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের পরিবেশ তৈরীতে ভ্রাতৃত্বের কোন বিকল্প নেই।
____________
রাসূল (ছাঃ) বলেন,
وَاللهُ فِىْ عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِىْ عَوْنِ أَخِيْهِ.

‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বান্দার সাহায্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে’।১

এছাড়াও দুনিয়াবী ক্ষণস্থায়ী জীবনে স্বার্থপরতার মূলোৎপাটন, সর্বদা ভোগের বিপরীতে ত্যাগের মনোভাব তৈরী করার মধ্য দিয়ে পরকালীন জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ সুগম করাই ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মূল উদ্দেশ্য।

উল্লিখিত উদ্দেশ্য হাছিলের লক্ষ্যে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক তথা ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিষয়ে মহান আল্লাহ এবং নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মুসলিম সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। নিম্নে তার যৎসামান্য উপস্থাপন করা হ’ল।
____________________
নো‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

تَرَى الْمُؤْمِنِيْنَ فِىْ تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بَالسَّهَرِ وَالْحُمَّى. ‘

তুমি ঈমানদারদেরকে তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুগ্রহের ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায় দেখবে। যখন দেহের কোন অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন সমস্ত শরীর তজ্জন্য বিনিদ্র ও জ্বরে আক্রান্ত হয়’। (২)
_____________________
অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

اَلْمُؤْمِنُوْنَ كَرَجُلٍ وَّاحِدٍ إِنِ اشْتَكَى عَيْنُهُ اِشْتَكَى كُلُّهُ وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اِشْتَكَى كُلُّهُ.

নো‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

‘সকল মুমিন এক ব্যক্তির মত। যদি তার চক্ষু অসুস্থ হয়, তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যদি তার মাথায় ব্যথা হয়, তখন তার সমস্ত দেহই ব্যথিত হয়’। (৩)
_______________________
আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
নবী (ছাঃ) বলেছেন,

الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا ثُمَّ شَبَّكَ بَيْنَ أَصَابَعِهِ.
‘একজন মুমিন আর একজন মুমিনের জন্য এক গৃহের মত, যার একাংশ অপরাংশকে সুদৃঢ় রাখে। অতঃপর তিনি এক হাতের অঙ্গুলিগুলি অপর হাতের অঙ্গুলির মধ্যে প্রবিষ্ট করালেন’।(৪)

উল্লিখিত তিনটি হাদীছে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সুদৃঢ় অবস্থানের স্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠেছে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের স্বতন্ত্র অবস্থান ও কর্মপরিধি থাকলেও বিপদে যেমন পরস্পরের প্রতি সহমর্মী-সমব্যাথী, তেমনি বর্ণে, বংশে, কর্মক্ষেত্রে বা ভৌগলিক অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে বিশ্বের সকল মুসলমান একটি অখন্ড শরীরের মত। মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতার কথা হাদীছে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
_____________
আনাস (রাঃ) বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

أُنْصُرْ أََخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللهِ أَنْصُرُهُ مَظْلُوْمًا، فَكَيْفَ أَنْصُرُهُ ظَالِمًا؟ قَالَ: تَمْنَعُهُ مِنَ الظُّلْمِ، فَذَالِكَ نَصْرُكَ إِيَّاهُ.

‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত হোক। তখন এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অত্যাচারিতকে তো সাহায্য করব; কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখবে। এটিই তাকে তোমার সাহায্য করার নামান্তর’। (৫)

পারস্পরিক সহযোগিতার পুরস্কার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,

اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَيَظْلِمُهُ، وَلاَيُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِىْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِىْ حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُّسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অভাব মোচনে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের কোন একটি বড় বিপদ দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন’। (৬)
___________________
অন্য হাদীছে রাসূল (ছ:) বলেন:


اَلْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَيَظْلِمُهُ، وَلاَيَخْذُلُهُ، وَلاَيَحْقِرُهُ، اَلتَّقْوَى هَهُنَا وَيُشِيْرُ إِلىَ صَدْرِهِ ثَلاَثَ مِرَارٍ بِحَسْبِ امْرِءٍ مِّنَ الشَّرِّ أَنْ يُّحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.

‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। কাজেই সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না এবং তাকে হীন মনে করবে না। ‘তাক্বওয়া’ (আল্লাহভীতি) এখানে একথা বলে তিনি তিনবার নিজের বক্ষের দিকে ইংগিত করলেন। তিনি আরো বলেন, কোন ব্যক্তির মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নিজের কোন মুসলমান ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। বস্ত্ততঃ একজন মুসলমানের সব কিছুই অপর মুসলমানের জন্য হারাম। তার জান, মাল ও ইয্যত’। (৭)

▷ পারস্পরিক কল্যাণ কামনা :

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আর একটি উদ্দেশ্য হ’ল পারস্পরিক কল্যাণ কামনা করা। পারস্পরিক কল্যাণ কামনার বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, اَلدِّيْنُ اَلنَّصِيْحَةُ ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা’। (৮) বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি কথাটি তিন বার উল্লেখ করেন।
____________________
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,

بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّم عَلَى إِقَامِ الصَّلَوةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَوةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ.

‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে ছালাত আদায়, যাকাত প্রদান এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করার অঙ্গীকার করে বায়‘আত করলাম’।(৯)
___________________
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
حَقُّ الْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتٌّ

‘একজন মুমিনের উপরে আরেক মুমিনের ছয়টি কর্তব্য রয়েছে’। তন্মধ্যে একটি হ’ল وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ ‘যখন সে তোমার কাছে পরামর্শ চাইবে, তখন তুমি তাকে (কল্যাণকর) উপদেশ দিবে’।(১০)

অন্য একটি প্রসিদ্ধ হাদীছে বলা হয়েছে, এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল, وَيُنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ ‘এবং উপস্থিত বা অনুপস্থিত উভয় অবস্থায় তার কল্যাণ কামনা করবে’।(১১)

মানুষ তার দ্বীনী ভাইয়ের কল্যাণ কামনায় সর্বদা উদগ্রীব থাকবে। তারই মঙ্গল সাধনে সর্বোতভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। তার কোন ক্ষতি হোক এমন কোন বিষয় তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। অথচ সমাজে দেখা যায়, এক শ্রেণীর মানুষ তার দ্বীনী ভাইয়ের কল্যাণ কামনার পরিবর্তে তার ক্ষতি করার জন্য সর্বদা সময়, শ্রম, মেধা ও বুদ্ধি অপচয় করে থাকে। প্রতিনিয়ত নানা কূটকৌশল ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করে। একটি কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হ’লে নতুন ফন্দী আটে। বাহ্যিকভাবে তারা মানুষের কাছে ভাল হ’লেও প্রকৃতপক্ষে তারা নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক। এ জাতীয় লোককে আল্লাহ পসন্দ করেন না; বরং তিনি প্রকৃতি ‘মুহসিন’ বান্দাকে পসন্দ করেন’ (বাক্বারাহ ১৯৫)।

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে যার মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে, সম্পর্ক অটুট থাকবে, সাথে সাথে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
------------------------
-----------------------

ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির উপায় :

ইসলামী শরী‘আতে মুমিনের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিভিন্ন নিয়ামকের বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে সেসব কর্ম ও আচরণ গ্রহণ ও অনুসরণ করলে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়, বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং এর ফলে দু’টি হৃদয় শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঘনিষ্ঠতর ও মযবুত হয়। এক্ষেত্রে শরী‘আতের কিছু আহকাম আছে আবশ্যকীয় এবং কিছু আছে ইচ্ছাধীন। তবে পারস্পরিক ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিকশিত ও ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য উভয়েরই গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিম্নে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির কতিপয় নিয়ামক সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-

▶ সালাম প্রদান : মুমিন জীবনে সালামের গুরুত্ব অপরিসীম। আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে তাঁর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম যে নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা হ’ল ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান।১২ সালামের বহুমুখী দিক রয়েছে। যেমন সালামের ফযীলত, সালাম প্রদানকারী অহঙ্কার হ’তে মুক্ত, সালাম প্রদান করা হক্ব, সালাম না দেওয়া কৃপণতা ইত্যাদি। এছাড়াও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল, সালাম প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। কারণ সালামের অর্থই হ’ল দ্বীনী ভাইয়ের প্রতি শান্তি, রহমত ও বরকত প্রার্থনা করা। সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি প্রসঙ্গে নিম্নের হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য।
____________________
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

لاَتَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوْا، وَلاَتُؤْمِنُوْا حَتَّى تَحَابُّوْا، أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوْهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ .

‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। আর তোমরা ঈমানদার হিসাবে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলে দিব না যা তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি করবে? (আর তা হচ্ছে) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করবে’।১৩

নবী করীম (ছাঃ) যখন রাস্তায় চলতেন, তখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে যার সঙ্গেই তাঁর দেখা হ’ত, তাকে তিনি সালাম দিতেন। আমাদেরকেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণে মুসলিম নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সকলকে সালাম প্রদান করতে হবে। এতে সকলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে, পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তবে সালামের আদান-প্রদান যখন সঠিক অনুভূতি নিয়ে করা হবে অর্থাৎ এক ভাই অপর ভাইকে শান্তির জন্য দো‘আ করবে এবং এর মাধ্যমে তার হৃদয়ে ভালবাসা ও শুভ কামনার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, কেবল তখনই সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পাবে। অন্যথা প্রচলিত অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে শুধু মুখে তোতা পাখির মত দু’টি আরবী শব্দ নিঃসৃত হ’লে সালামের হক্ব আদায় হ’তে পারে, কিন্তু তাতে পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

▶ মুছাফাহা করা : সালামের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয় হ’ল মুছাফাহা। যার অর্থ পরস্পর হাত মিলানো বা করমর্দন করা। কদমবুচি বা পদচুম্বন ইসলামী শরী‘আতে বৈধ না হ’লেও মুছাফাহা এবং মু‘আনাকা তথা কোলাকুলি বৈধ। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ قَتَادَةَ، قَالَ : قُلْتُ لِأَنَسٍ : أَكَانَتِ الْمُصَافَحَةُ فِىْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمُ؟ قَالَ نَعَمْ .

কাতাদা (রাঃ) বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে মুছাফাহার প্রচলন ছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, ছিল’।১৪ মুসলমানদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হ’লে সালাম বিনিময়ের পর হৃদয়ের গভীরে আন্তরিকতার যে প্রগাঢ় আবেগ নিহিত থাকে, সেই প্রেরণা থেকেই আপোসে করমর্দন করে থাকে। এর মাধ্যমে যেমন বন্ধুত্ব সুসংহত হয়, তেমনি উভয়ের গোনাহ মাফ হয়।
______________
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَا مِنْ مُّسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَلَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَّتَفَرَّقَا.

‘যখন দু’জন মুসলমানের পরস্পর সাক্ষাৎ হয় এবং তারা মুছাফাহা করে, পৃথক হওয়ার পূর্বেই তাদের উভয়ের গোনাহ মাফ করে দেওয়া যায়’।১৫ তাই পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃত গোনাহ হ’তে পরিত্রাণ লাভের সহজ ও সুন্দর মাধ্যম হিসাবে মুমিন জীবনে বেশী বেশী সালাম ও মুছাফাহার প্রচলন করা উচিত।

▶ হাদিয়া প্রদান : হাদিয়া প্রদান ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির একটি অন্যতম নিয়ামক। প্রকৃতপক্ষে ভাল কথা বলা, উৎকৃষ্ট আচরণ করা, সৎ পরামর্শ প্রদান ইত্যাদিও এক ধরনের হাদিয়া। এর মাধ্যমে একজন মানুষ অতি সহজেই অন্যের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে তার সাথে যোগসূত্র রচনা করতে পারে। তেমনি বস্ত্তগত হাদিয়ার মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি ও বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়। হাদিয়া প্রদানে উৎসাহিত করে রাসূল (ছাঃ) যেমন উপদেশ দিয়েছেন, তেমনি হাদিয়া প্রদানের উপকারিতাও বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,



تَهَادُوْا تَحَابُّوْا
‘তোমরা একে অপরকে হাদিয়া পাঠাও, এর দ্বারা পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে’।১৬
______________
আনাস (রাঃ) বলতেন,
يَا بَنِىَّ! تَبَاذَلُوْا بَيْنَكُمْ، فَإِنَّهُ أَوَدُّ لِمَا بَيْنَكُمْ

‘হে বৎসগণ! তোমরা একে অপরের জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে, এতে তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে’।১৭ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে যেমন তাঁর সঙ্গী-সাথীদের হাদিয়া দিতেন, তেমনি ছাহাবীগণও তাঁকে ও অন্য ছাহাবীদেরকে হাদিয়া প্রদান করতেন।

▶ হাসিমুখে কথা বলা : হাসিমুখে কথা বলার মাধ্যমে অতি সহজেই অন্যের মন জয় করা সম্ভব। তাছাড়া কর্কষভাষী বা কঠিন হৃদয়ের মানুষকে কেউ পসন্দ করে না।
____________
মহান আল্লাহ বলেন,

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّواْ مِنْ حَوْلِكَ.

‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলে। যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের লোক হ’তে, তবে তোমার নিকট থেকে তারা দূরে সরে যেত’ (আলে ইমরান ১৫৯)। অনুরূপভাবে মিষ্টি হেসে কথা বলাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাদাক্বা হিসাবে উল্লেখ করেছেন।১৮

তাছাড়া ভাল ও সুন্দর কথা পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে আত্মরক্ষায় সহায়ক হিসাবে ভূমিকা পালন করবে।
__________________
রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,

إِتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ فَمَنْ لَّمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ.

‘জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর। যদিও তা অর্ধেক খেজুরের বিনিময়েও হয়। যে তাও দান করতে অক্ষম, সে লোকজনকে ভাল ও সুন্দর কথা দ্বারা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করবে’।১৯ অন্যত্র তিনি আরো বলেন,

وَالْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ.
‘ভাল কথাও ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে’।২০ অপর হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ ذَرٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ : قَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَتَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوْفِ شَيْئًا وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلِيْقٍ.

আবু যর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, ‘ভাল কাজের কোনটাকেই তুচ্ছ মনে করবে না। যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎও হয়’।২১

উল্লিখিত আয়াত ও হাদীছের আলোকে একথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, পরকালে পাপ মুক্তির অসীলা হিসাবে হাসিমুখে কথা বলার গুরুত্ব অপরিসীম। সাথে সাথে দুনিয়াবী জীবনে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধিতেও হাসিমুখ ও কোমল আচরণের বিকল্প নেই।







তথ্যসুত্রঃ
-
১. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪ ‘ইলম’ অধ্যায়।
২. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৫৩ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘সৃষ্টির প্রতি দয়া-অনুগ্রহ’ অনুচ্ছেদ।
৩. মুসলিম, মিশকাত, হা/ ৪৯৫৪।
৪. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৫৫।
৫. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৫৭।
৬. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৫৮।
৭. মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৫৯।
৮. মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৬৬।
৯. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৯৬৭।
১০. মুসলিম, হা/২১৬২; ইবনু হিববান, হা/২৪২।
১১. নাসাঈ, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৪২৫; মিশকাত হা/৪৬৩০।
১২. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬২৮।
১৩. মুসলিম, ‘সালাম’ অধ্যায়, মিশকাত, হা/৪৬৩১।
১৪. বুখারী, মিশকাত, ‘মুছাফাহা’ অধ্যায়, হা/৪৬৭৭।
১৫. আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, ঐ অধ্যায়, হা/৪৬৭৯ হাদীছ ছহীহ।
১৬. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৯৪; ইরওয়াউল গালীল হা/১৬০১, সনদ হাসান।
১৭. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৫, সনদ ছহীহ, ‘হাদিয়া গ্রহণ করা’ অনুচ্ছেদ।
১৮. তিরমিযী; মিশকাত হা/১৯১১ ‘ছাদাক্বার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।
১৯. বুখারী ও মুসলিম, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৬৯৪।
২০. বুখারী ও মুসলিম, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৬৯৫; মিশকাত হা/১৮৯৬।
২১. মুসলিম, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/৬৯৬; মিশকাত হা/১৮৯৪।
-

-



Ad Code

Responsive Advertisement