Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিক, “মধ্যমপন্থা” আর সিরাতুল মুস্তাক্বীম


হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিক বলে একটা কনসেপ্ট আছে। ধরুন আপনি নতুন করে ট্যাক্স ১৫% বাড়াতে চান। আপনি জানেন যে ১৫% বৃদ্ধির কথা বললে কেউই মানবে না। তাই আপনি কিছু লবিস্ট নিয়োগ করলেন, যাদের কাজ হবে ট্যাক্স কেন ৩০% বাড়ানো উচিৎ এবং আবশ্যক এটা প্রমানে নানা যুক্তি দাড় করানো। এটার পক্ষে লেখালেখি করা, সিম্পোসিয়াম করা, কনফারেন্স করা। মোট করা ৩০% ট্যাক্স বৃদ্ধির পক্ষে জনসমর্থন তৈরি করা এবং সমর্থনের একটা ফ্রেইমওয়ার্ক তৈরি করা। এবার আপনি আরেক পক্ষকে বলবেন ট্যাক্স কেন ৩০% বাড়ানোর বদলে ১০% কমিয়ে দেয়া উচিৎ সেটার পক্ষে একইভাবে আরেকদল লবিস্ট নিয়োগ করলেন। এরা আগের দলের মতো একই কাজ করবে, তবে ১০% ট্যাক্স হ্রাসের পক্ষে। দুই দলকে তর্কবিতর্ক, রিফিউটেশান-পাল্টা রিফিউটেশান করতে দিন। একজনকে আরেকজনের যুক্তি খন্ডন করতে দিন। শেষমেশ আপনি এসে বলুন, দেখো তোমাদের দুজনের কথাতেই যুক্তি আছে, তাই আসো আমরা একটা কম্প্রোমাইযে আসি, মিডল গ্রাউন্ডে [মধ্যম পন্থা?] আসি। ৩০% বাড়ানোর দরকার আসলে নেই, কম হলেও চলে। আর ১০% কমানো তো আসলে আনরিয়েলিস্টিক। তাই আসো আমরা ১৫% বাড়াই। আর এই দুই পক্ষের ঝগড়ায় বিভ্রান্ত জনগন মনে করলো, হ্যা এটা একটা সেন্সিবল, মডারেশানের কাজ হয়েছে। আপনি যে রেসাল্ট চাচ্ছিলেন তাই পেলেন, কিন্তু চাপিয়ে না দিয়ে আপনি মানুষের consent বা সম্মতি তৈরি করে নিলেন। জিনিয়াস! হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিকের ভাষায়, প্রথমে আপনি যা চালু করতে চাচ্ছিলেন, ১৫% ট্যাক্স বৃদ্ধি, এটা হল এজেন্ডা। এই উদ্দেশ্যে এক পক্ষ ৩০% ট্যাক্স বাড়াতে বলা শুরু করলো। এটা হল থিসিস আরেক দল তাদের বিরোধীতায় ১০% ট্যাক্স কমাতে বললো, এটা হল অ্যান্টি-থিসিস শেষ পর্যন্ত থিসিস আর অ্যান্টি-থিসিসের মিশ্রণে আপনি পেলেন সিনথেসিস, যা হল প্রকৃত পক্ষে আপনার মূল এজেন্ডার বাস্তবায়ন। অর্থাৎ ১৫% ট্যাক্স বৃদ্ধি। থিসিস + অ্যান্টিথিসিস = সিনথেসিস (= এজেন্ডা)। এখানে + চিহ্নের বদলে কিউমিলেটিভ সামেশান আরও অ্যাপ্রোপ্রিয়েট, বাট কাজ চালানোর জন্য আপাতত এটুকু ঠিক আছে। ইসলামে যে মধ্যম পন্থার কথা বলা হয়েছে সেটা হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টীকের "সিনথেসিস" না। দুটা পযিশানের মাঝামাঝি নেয়াটা সিরাতুল মুস্তাক্বীম না। সিরাতুল মুস্তাক্বীম একটা স্বতন্ত্র বিষয়, যেটার স্বাধীন অস্তিত্ব, বৈশিস্ট ও পরিচয় আছে। হেগেলিয়ান ডায়ালেক্টিকের ক্ষেত্রে কোন অ্যাবসলিউট মানদন্ড নেই, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। তাই থিসিস বা অ্যান্টি-থিসিসের যথার্থতা আপনি কোন অ্যাবসলিউট মানদন্ডে মাপতে পারবেন না। ইসলামের শুরুই হয়েছে একটা অ্যাবসোলিউট মানদন্ড নির্ধারণ করে। আল ফুরক্বান - The Criterion. আল ফুরক্বান, রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ এবং সালাফের ইজমা এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং - এই হল আপনার মানদন্ড। একটা টোটাল প্যাকেজ। স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যাকেজ, যাতে সংযোজন বা বিয়োজনের কোন জায়গা নেই। এই মানদন্ড একটা নির্দিষ্ট পথকে সিরাতুল মুস্তাক্বীম বলে চিহ্নিত করে দিয়েছে। সুতরাং আমাদের সিরাতুল মুস্তাক্বীমের কনসেপ্ট থিসিস আর অ্যান্টি-থিসিসের উপর নির্ভরশীল না। অর্থাৎ সিরাতুল মুস্তাক্বীমের সংজ্ঞা 'ইরজা [leniency] আর গুলুহ [extremism]-র উপর নির্ভরশীল না। সিরাতুল মুস্তাক্বীম সুসংজ্ঞায়িত এবং নির্দিষ্ট। বরং 'ইরজা এবং গুলুহ-র সংজ্ঞা সিরাতুল মুস্তাক্বীমের উপর নির্ভরশীল। আমরা যখন বলি সিরাতুল মুস্তাক্বীম মধ্যম পন্থা তখন আমরা ডান-বামের সংজ্ঞা আগে ঠিক করে, পরে "মধ্যম"-এর সংজ্ঞা দেই না। আমরা বলি মধ্যম কি এটা পরিস্কারভাবে নির্ধারিত। এর বামে গেলে ইরজা, ডানে গেলে গুলুহ, । সিরাতুল মুস্তাক্বীম এর চাইতে বেশি উদার হলে সেটা 'ইরজা, আর এর চাইতে বেশি কঠোর হলে সেটা গুলুহ। এখন কেউ যদি বলে সমাধান হল গণতন্ত্র, আর কেউ যদি বলে সমাধান হল গণতন্ত্র সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা,আর তৃতীয় কেউ যদি বলে না সমাধান হল "মধ্যম পন্থা", "ইসলামী গণতন্ত্র" - তাহলে সেটা শাব্দিকভাবে মধ্যম পন্থা হল বটে, কিন্তু সিরাতুল মুস্তাক্বীম হল না। আপনি দুটো জিনিষের মাঝামাঝি একটা জিনিষ নিয়ে সেটাকে সিরাতুল মুস্তাক্বীম বলে চালিয়ে দিতে পারেন না। আপনি সিরাতুল মুস্তাক্বীম এর অংশ সেটাকে বলবেন যেটা কুর'আন সুন্নাহ আর সালাফের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর বেইসিসে সঠিক বলে প্রমানিত হবে। আগে ইসলামের মানদন্ড অনুযায়ী সঠিক হওয়া বুঝতে হবে, তারপর আপনি সেটাকে মধ্যম পন্থা বলতে পারেন। কোন র‍্যান্ডম মানদন্ড অনুযায়ী কিছু একটা মধ্যম, তাই অটোম্যাটিকালি সেটা সিরাতুল মুস্তাক্বীমের অংশ হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন না। এই সেইম জিনিষটা ফ্রি-মিক্সিং এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাকফিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, "ইসলামী" ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একজন বললো সব ব্যাঙ্ক হারাম। আরেকজন বললো সব ব্যাঙ্ক হালাল। আরেকজন বললো না সব ব্যাঙ্ক হারাম কিন্তু "ইসলামী' ব্যাঙ্ক ছাড়া - আর এটা আগের দুটোর মাঝামাঝি, তাই এটা মধ্যম পন্থা, সিরাতুল মুস্তাক্বীম - এরকম মনে করা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল। ইসলামী ব্যাঙ্ক বা ফ্রি-মিক্সিং যাই হোক না কেন, আগে স্বতন্ত্রভাবে সেটার যথার্থতা ইসলামের মানদন্ডে প্রমাণ করতে হবে। এবং মন্দের ভালো কখনোই আপনার এই যথার্থতা প্রমানের স্টারটিং পয়েন্ট হতে পারে না। ক্ষেত্র বিশেষে কোন কিছুর জায়েজ হওয়া দিয়ে আপনি সম্পূর্ণভাবে সেই জিনিষের হালাল হওয়া প্রমাণ করতে পারেন না। বিশেষ অবস্থায় শুকরের মাংস খাওয়া জায়েজ, এটাকে আপনি আপনার বেইসিস ধরে শুরু করতে পারেন না। এক্সসেপশান থেকে জেনারেল রুলিং আসে না। আল্লাহু মুস্তা'আন। নিশ্চয় আমাদের কোমলতা ও কঠোরতার ভিত্তি আল্লাহ্‌-র দ্বীন। হারামে লিপ্ত ব্যক্তির প্রতি অবশ্যই আমরা কোমল হতে পারি, এবং সেটা দরকারও। কিন্তু হারামের ব্যাপারে কোন কোমলতা চলবে না। একই ভাবে বাধ্য হয়ে হারাম করছে এমন মানুষের সহমর্মিতা প্রাপ্য, কিন্তু যে হারামকে হালাল দাবি করছে তার এই কাজ ঘৃনার জন্য, সহমর্মিতা পাবার যোগ্য না। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মূর্তিপূজারীদের বিভিন্নভাবে আহবান করেছেন। কোমলতার সাথে, ও কঠোরতার সাথে। কিন্তু না তিনি মূর্তির সাথে কোমল ব্যবহার করেছেন, আর না মূর্তিপূজার কনসেপ্টের ব্যাপারে কোমলতা প্রদর্শন করেছেন। তিনি মূর্তিপূজকদের আমন্ত্রন জানিয়েছেন, কিন্তু মূর্তিপূজাকে আক্রমণ করেছেন। শুধু তাই না মূর্তিপূজকের মূর্তিপূজার সাথে সংশ্লিষ্ট ধারণা এবং আচার-অনুষ্ঠানকে তিনি আক্রমণ করেছেন। আর এটাই মিল্লাতু ইব্রাহীম। কোমলতার সংজ্ঞা আমাদের কাছে এটা না যে আমরা ভুলকে ভুল বলবো না। আর এজন্য যদি আমাদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয় কিম্বা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত বলা হয়, তাহলে তো আমাদের আগে আমাদের চেয়ে কোটি গুণ উত্তম ব্যক্তিদের সমন্ধে একই কথা বলা হয়েছিল। আর তাদের তুলনায় আমরা তো ধূলোবালির চাইতেও অধম - আল্লাহ্‌ তাদের সকলের উপর শান্তি বর্ষণ করুন। আল্লাহ-র দ্বীনের বিষয় তাউয়ীল করে বদলে দেয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই। দুনিয়া গেলে যাবে কিন্তু এই দ্বীনের সাথে কম্প্রোমাইয করা সম্ভব না, এবং দ্বীনকে দুনিয়া-কমপ্লায়েন্ট করাও সম্ভব না। যে যাই বলুক না কেন, যতোই সেটা কনভিনিয়েন্ট হোক না কেন, বা যতোই জেল-যুলুম-রিমান্ড কিম্বা হত্যার ভয় দেখানো হোক না কেন। নিঃসন্দেহে এটাই মিল্লাতু ইব্রাহীম।

মন্তব্যসমূহ

Ad Code

Responsive Advertisement