Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--শেষপর্ব।

২০ আগস্টের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে তা হলো প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে ১২ আগস্ট জানানো হয় যে, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার সাথে বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ ২০ তারিখে এই আঘাত হানার প্রস্তাব দেয়। তারা জানতে পারে যে, ঐ দিন খোস্ত এলাকায় উচ্চপর্যায়ের মুজাহিদ কমান্ডারদের সমাবেশ হওয়ার কথা। উপগ্রহ যোগাযোগ ও অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বিন লাদেন ও অন্যদের মধ্যকার টেলিফোন সংলাপ মনিটর করে তারা এসব জানতে পারে বলে দাবি করা হয়। অবশ্য ১২ আগস্ট প্রেসিডেন্টের কাছে আক্রমণ পরিকল্পনা পেশ করার সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত ছিলো গোপন খবরের সত্যতা পরীক্ষা করে দেখা। কারণ ৮ আগস্ট থেকে গোটা আফগানিস্তানের জিহাদী শিবিরগুলোতে অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য ও আনাগোনা ঘটতে থাকে। ১৩ আগস্ট এক মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন যে, ৭ আগস্টের বোমা হামলার পর থেকে বিন লাদেনের ঘাঁটির লোকজনকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হতে থাকে। লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ আরবী দৈনিক আল-হায়াহ পাকিস্তানী নিরাপত্তা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় যে, বিন লাদেনের কান্দাহার ও জালালাবাদের সদর দফতরে এবং পাহাড়ী প্রদেশ পাকতিয়ার সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলোতে আরব মুজাহিদদের ঘনঘন আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। এমন সম্ভাবনার কথাও বলা হয় যে, খোস্তে এক বড় ধরনের সম্মেলন হতে পারে এবং বিন লাদেন তাতে উপস্থিত থাকতে পারেন। স্বভাবতই আমেকিানরা এমন একটি সুযোগ হারাতে চায়নি।

বিন লাদেনের ব্লু প্রিন্ট

ওসামা বিন লাদেনের জিহাদী নেটওয়ার্ক ধ্বংস এবং তাঁকে হত্যা বা বন্দী করার জন্য আফগানিস্তানে চলছে মার্কিন হামলা। কিন্তু সে অভিযান শেষ পর্যন্ত যদি সফল না হয় তাহলে কি হবে? অনিবার্যভাবে ধরে নেয়া যায় যে, এর ফলে ইসলামী জিহাদীদের পাল্টা আঘাত নেমে আসবে, যার পরিণতিতে লাদেন একজন আঞ্চলিক শক্তির নিয়ন্ত্রায় পরিণত হতে পারেন। সেই মানুষটি তখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার এবং বিশ্বের সিংহভাগ তেল সম্পদ। শোনা যায় লাদেনের আঞ্চলিক আধিপত্যের এটাই হলো নীলনক্সা। লাদেনের নীলনক্সা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বে আফিমের বৃহত্তম উৎস আফাগানিস্তানে  ইসলামী শাসন চিরস্থায়ী রূপ নেবে। পাকিস্তানের গোঁড়া রক্ষণশীল জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করবে এবং সৌদি রাজপরিবারে ভঙ্গন লেগে দেশটি গৃহযুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হবে। পর্যবেক্ষক ও গোয়েন্দা মহলের ধরণা, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য লাদেন ভালমতোই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। যতই হামলা হচ্ছে ততই বিশ্বের দেশে দেশে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এই হামলার বিরুদ্ধে ও লাদেনের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে। সৌদি আরবেও জনমত লাদেনের পক্ষে ঝুঁকছে। লাদেন ও তাঁর কর্মকান্ড নিয়ে যথেষ্ঠ গবেষণা করেছেন এমন এক ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ টমাস উয়িথিংটনের মতে, আমেরিকা ও ব্রিটেন যতই বিমান হামলা চালাক, বিন লাদেন ঠিকই তার নিজস্ব হিসাব কষে এগিয়ে চলেছেন। তিনি আসলে এই দুটো দেশকে রক্তাক্ত যুদ্ধে টেনে আনতে চান। সেটা সম্ভব হতে পারে যদি দেশ দুটো বিমান আক্রমণ থেকে স্থল আক্রমণের দিকে অগ্রসর হয়। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে লাদেনের। সেই অভিজ্ঞতাকে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে লড়াইকে প্রলম্বিত করতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন। 

আফগানিস্তানে লড়াই যত প্রলম্বিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক দেশগুলোতে বিদ্রোহ ও গণবিক্ষোভ ততই বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সর্বত্রই সরকারবিরোধী শক্তিগুলো উত্তরোত্তর অস্ত্র তুলে নেবে। আর ঠিক এটাই চাইছেন লাদেন। কারণ তা হলেই তার সেই আঞ্চলিক অধিপত্যের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। এদিক দিয়ে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী পাকিস্তানের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক বলে অনেকে মনে করেন। আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে পেশোয়ারে প্রচ- ভিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। জিহাদপন্থী শক্তিগুলো সেই বিক্ষোভকে তীব্রতম অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইবে এমনই আশা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে গোঁড়া রক্ষণশীল অংশের মধ্যে জেনারেল মোশাররফের বিরুদ্ধে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এরা মোশাররফের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দেবে। ক’দিন আগে সেনাবাহিনীর দু’জন জেনারেলকে বরখাস্ত করার ঘটনা তারই আলামত। মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ যদি পাকিস্তানকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয় তাহলে তার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর জিহাদ সমর্থক অংশটির অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসা বিচিত্র কিছু নয়। আর এই অংশটি ক্ষমতায় আসতে পারলে তো লাদেনের জন্য পোয়াবারো। পাকিস্তান তখন হবে তাঁর দ্বিতীয় আবাসভূমি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে লাদেনের সমর্থক কম নেই। সন্দেহ নেই তারা দীর্ঘদিন ধরে লাদেনকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে এসেছে। পাকিস্তানের প্রতি বিন লাদেনের দৃষ্টি পড়ার একটা কারণ হতে পারে এর পারমাণবিক অস্ত্র। বিভিন্ন সময় সাক্ষাতকারে লাদেন এই পরমাণু অস্ত্রের কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানে তালেবানী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে লাদেন অন্তত ৩০টি পারমাণবিক বোমার অধিকারী হতে পারবেন, যার প্রতিটির বিধ্বংসী ক্ষমতা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বেমার প্রায় আড়াই গুণ বেশি। ব্যাপারটা তাঁর জন্য কম প্রলুব্ধকর নয়। ইরান আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার বিরোধিতা করলেও দেশটি বিন লাদেনের আঞ্চলিক অধিপত্যের নীলনক্সার অন্তর্ভূক্ত নয়। তার একটা মূল কারণ দেশটি শিয়া মুসলিমপ্রধান, যারা ঐতিহ্যগতভাবে সুন্নী পশতুদের বিরোধী। আর তালেবান সরকারে এই সুন্নী পশতুদেরই একাধিপত্য। তবে সাবেক আফগান যুদ্ধবাজ গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার তেহরানের র‌্যাডিকেল বিরুদ্ধবাদীদের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি লাদেনের জন্য সমর্থন গড়ে তুলতে পারেন। তাহলে সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহের আগুন দক্ষিণ ওমান উপসাগরের দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং সৌদি রাজবংশ হবে এর পরবর্তী টার্গেট। সৌদি সরকার লাদেনবিরোধী মার্কিন হামলা সমর্থন করলেও সৌদি জনগোষ্ঠির মধ্যে লাদেনের সমর্থক কম নেই। কারণ তাদের মতে অন্যরা যা করতে পারে না লাদেন তা করতে সক্ষম। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর তাদের মধ্যে লাদেনের ইমেজ আরও বেড়ে গেছে। সৌদি আরবেও জিহাদপন্থী গ্রুপের অস্তিত্ব আছে এবং তারা সে দেশে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি সত্যি তা করতে পারে তাহলে এ জাতীয় হামলার প্রতি ওলামা সম্প্রদায়ের প্রচন্ড সমর্থন থাকবে। কারণ তাদের মতে, একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে একজন অমুসলমানের পক্ষ নেয়া ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। সৌদি আরবে বিন লাদেনের সমর্থক ১০ হাজার সাবেক মুজাহিদ রয়েছে, যারা আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। তবে ক্ষমতা দখলের মতো শক্তি তাদের নেই। লাদেনের জন্য এদের চেয়েও বেশি সহায়ক হবে সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতাদ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব রাজপরিবারের শত শত শাহজাদাকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করেছে। কোন কোন উপদল লাদেনকে রীতিমতো সমর্থন করে। তাঁকে গোপনে নিয়মিত অর্থ সাহায্য দেয় বলে জানা গেছে। 

লাদেন এক সময় আমেকিান লবির লোক ছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি সুদূর আফগানিস্তানে গিয়ে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ সংঘটনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই লাদেন আমেরিকার ওপর বিগড়ে যান উপসাগর যুদ্ধের সময় সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়নকে কেন্দ্র করে। ইসলামের পবিত্র ভূমিতে বিধর্মী সৈন্য উপস্থিতির মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে তাঁর মার্কিনবিরোধিতার প্রতি সৌদি রাজপরিবারের একাংশ, উলামা সম্প্রদায়ের বড় অংশ ও সাধারণ জনগণের ব্যাপক সমর্থন আছে। লাদেন যদি মার্কিন হামলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে আফগান যুদ্ধকে প্রলম্বিত করাতে পারেন তাহেল ভবিষ্যতে সৌদি শাসকশ্রেণীর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সেক্ষেত্রে লাদেন অনুগতরা সৌদি সমাজের বিভিন্ন অংশের অসন্তোষকে পুঁজি করে সে দেশে বিদ্রোহ বা গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে সৌদি রাজতন্ত্রকে উৎখাত করলে তো আর কথাই নেই। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে লাদেনের মিত্রদের। আর সম্ভবত সেই সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য রেখেই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি তেলক্ষেত্রগুলো নিরাপদ রাখার চেষ্টায় সে দেশে মোতায়েন মার্কিন সৈন্যসংখ্যা ২০ হাজারে বাড়িয়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিন লাদেনের অনুগত সৈন্যের সংখ্যা কত সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে আফগানিস্তানে অবস্থানরত ১৩ টি আরব দেশের যোদ্ধা তার বাহিনীতে আছে। এছাড়া তাঁর আল কায়দা নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে বিশ্বের দেশে দেশে। এরা তাঁর ইসলামী বিপ্লবকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। ওটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস একদা মুগ্ধতার সঙ্গে পাঠ করেছেন লাদেন। হয়তো সেই সাম্রাজ্যই নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেন তিনি। --------------------------------------------------------------------------------------------বইটিতে যেভাবে আছে আমি সেভাবেই প্রকাশ করেছি। কোন প্রকার কাটছাট করা হয় নি।সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী-

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৬)

সাক্ষাতকারে বিন লাদেন সৌদি আরবের অর্থনৈকিত সঙ্কট এবং সে কারণে জনগণের দুর্ভোগের জন্য রাজতন্ত্রকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, “সৌদি ব্যবসায়ীরা দেখতে পেল কিভাবে তাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করা হচ্ছে। কিভাবে তাদের কাছে সরকারী ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ীদের কাছে সরকারের ঋণের পরিমাণ আজ ৩৪ হাজার কোটি সৌদি রিয়াল। যা হচ্ছে এক বিশাল অঙ্ক। এটা হলো সৌদি আরবের অভ্যন্তরে জাতীয় আয়ের শতকরা ৯০ ভাগ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণকে বিদ্যুত, পানি ও জ্বালানির জন্য অধিক মূল্য দিতে হচ্ছে। সৌদি কৃষকগণ ঋণভারে ক্লান্ত। শিক্ষার দ্রুত অবনতি ঘটে চলেছে। লোকে এখন সরকারী স্কুল থেকে সন্তানদের সরিয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারী শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছে।

” বিন লাদেন বলেন, “সৌদিরা এসব সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে। তাদের মনে আছে, বিশিষ্ট আলেম শেখ উদাহ তাদেরকে কি বলেছিলেন। তারা এখন বুঝতে পারছে যে, আমেরিকাই হলো তাদের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ। সাধারণ মানুষটিও জানে, তাদের দেশ হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ। তথাপি হাজারো করের বোঝা ও অন্যান্য কারণে তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। লোকে আজ বুঝতে পারছ যে, সৌদি আরব আমেরিকার উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তারা আজ আমেরিকাকে সৌদি আরব থেকে লাথি মেরে তাড়াতে চায়। রিয়াদ ও খোবারে যা ঘটেছে তা হচ্ছে আমেরিকার বিরুদ্ধে সৌদি জনগণের প্রচন্ড ক্রোধের সুস্পষ্ট অভিপ্রকাশ। সৌদিরা এখন জানে, তাদের প্রধান শত্রু আমেরিকা। যে দেশে এক শ’ বছরের মধ্যে কেউ কখনও বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনেনি, সেখানে খোবারে ২৫০০ কিলো টিএনটির বিস্ফোরণ হলো আমেরিকার দখলদারির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের প্রমাণ।”

এটাই শেষ কথা নয়। বিন লাদেন বলেন, সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতিই যে শুধু তার আমেরিকা বিরোধিতার কারণ, তা নয়। আরও কারণ আছে। তা হলো আমেরিকা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে আঘাত হানছে। বিশ্ব মুসলিমদের সঙ্গে তার সহমর্মিতাই তাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। তিনি বলেন, “ খোবারের বিস্ফোরণ শুধু মার্কিন দখলদারির বিরোধিতা হিসাবে নয়, উপরন্তু বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের প্রতি আমেরিকার বৈরী আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবেও ঘটেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে (১৯৯৬সাল) আত্মোৎসর্গী বোমা বিস্ফোরণে যখন ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ৬০ ইহুদী নিহত হলো। বিশ্বজুড়ে তখন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করা হলো। অথচ ইরাকের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবার পর যখন ৬ লাখ ইরাকী শিশুর মৃত্যু হলো তখন তেমন কোনই প্রতিক্রিয়া হলো না। এই ইরাকী শিশুদের হত্যার ঘটনাটা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড। আমরা মুসলমানরা ইরাকী শাসকগোষ্ঠীকে পছন্দ করি না ঠিকই, তথাপি আমরা মনে করি ইরাকী জনগণ আমাদের ভাই, ইরাকী শিশুরা আমাদের সন্তান।” বিন লাদেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি ইসলামপন্থীদের মধ্যে আসন্ন সংঘাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ নেই। ... এই সঙ্কটের শুধু একটাই সমাধান।

 তা হলো, সৌদি আরব থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। ...এই লড়াই হবে এক বৃহত্তর পরিসরে লড়াইয়ের সূচনা। যা গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।”বিন লাদেনের বয়ান ছিল ১২ পৃষ্ঠার এক দলিল, যার শিরোনাম ছিল “ডিক্লেয়ারেশন অব ওয়ার” বা যুদ্ধের ঘোষণা। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, প্রাসঙ্গিক বিষয় ও প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বয়ানে আমেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আফগানিস্তানে ইসলামী শক্তির হাতে ইতোমধ্যে সোভিয়েতের মতো একটি পরাশক্তির পরাজয় ঘটেছে।

আবু নিদালের সাথে যোগাযোগ

ক্ষমতায় আসার পর তালেবানরা ওসামা বিন লাদেনের প্রতি সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। জালালাবাদে বিন লাদেনকে তারা তার ঘাঁটিগুলো রাখার অনুমতিই শুধু দেয়নি, সেগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থাও করেছিল।বিন লাদেন নিজেও তালেবান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আফগানিস্তানে তখন চার শ’রও বেশি আরব যোদ্ধা ছিল। এদের অনেকে সোভিয়েতবিরোধি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আবার অনেকে বিভিন্ন জিহাদী প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। তালেবানরা চাইছিল এই আরবরা যেন আফগানিস্তান থেকে গিয়ে তালেবানদের সামরিক কার্যক্রমগুলোতে অংশ নেয়।

 ১৯৯৬ সালের অক্টোবর থেকে তালেবানরা তাদের বিশেষ বাহিনীতে আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ আরবদের সামরিক বিশেষজ্ঞ হিসাবে রিক্রুট করতে থাকে। এ বিষয়টা তারা পাকিস্তানের আইএসআইকে জানাতে ভুলেনি। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি আইএসআই তালেবানদের পাকিস্তানের জামাতে ইসলামীর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিজবুল মুজাহিদীন পরিচালিত প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো বন্ধ করে দিতে বলে। কিছুদিন পর তারাই আবার এসব শিবির হরকত-উল-আনসারের হাতে তুলে দেয়ার অনুরোধ জানায়। বাহ্যত এর উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীর জিহাদে সাহয্য করা। নভেম্বরের শেষদিকে আইএসআই নিজেও খোস্ত এলাকায় তাদের প্রশিক্ষণ অবকাঠামো হরকত-উল-আনসারের কাছে হস্তান্তর করে। জিহাদী সংগঠন হরকত-উল-আনসার ছিল আইএসআই-এর কাঠোর নিয়ন্ত্রণে। কাশ্মীর ছাড়াও হরকতের সদস্যরা আজও বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে বার্মা, তাজিকিস্তান, বসনিয়া, চেচনিয়া এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত তৎপর আছে। হরকতের সদস্যদের মধ্যে পাকিস্তানী, কাশ্মীরী, আফগান, আরব প্রভৃতি জাতির লোকজন আছে। 

তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পরও আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আইএসআই-এর প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বিনা বাধায় চালু ছিল। এ সময় পরবর্তী দফা জিহাদী অভিযানের ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামো সংহত করে তোলার ক্ষেত্রে ওসামা বিন লাদেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে খার্তুমে জিহাদী শীর্ষ বৈঠক থেকে আফগানিস্তানে ফিরে আসার পথে তিনি তেহরানে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে সাবরি আল-বানা (আবু নিদাল) সহ বেশ কয়েকজন জিহাদী নেতার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়। তারা মধ্য প্রাচ্যের গোটা তল্লাট জুড়ে জিহাদী অভিযানের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করেন। বিন লাদেন ও আবু নিদাল গোটা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে গুপ্তহত্যা, সারোটাজ, বোমাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের জিহাদী হামলায় নিদালের লোকবল ও অস্ত্রসম্পদ ব্যবহারের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখেন। আবু নিদালের তখন পৃষ্ঠপোষক ছিল ইরান। তা সত্ত্বেও আবু নিদাল এসব অভিযান চালানোর জন্য লাদেনের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তেহরানে অবস্থানকালে আরও একটা কাজ করেছিলেন বিন লাদেন।। তা হলো মিসরের বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার করা।

 তেহরানের প্রাধান্যপুষ্ট হিজবুল্লাহ ইন্টরন্যাশনালে বিন লাদেন তখনও বেশ উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই অবস্থান থেকে তিনি আফগানিস্তানে তাঁর জিহাদী অবকাঠামো বিস্তারের জন্য ইরানের ব্যাপক সাহায্য চেয়ে বসেন। কিন্তু তখন কাবুল ও তেহরানের সম্পর্কে ভাঙ্গন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছিল বলে এই সাহায্যের বিষয়টা বেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় ইরান লাদেনকে আফগানিস্তানে তাঁর নিরাপদ আশ্রয় কোনভাবে নষ্ট না করার পরামর্শ দেয় এবং তাঁকে আশ্বাস দেয় যে, ইরানের সাহায্য তিনি পাবেন ঠিকই। তবে সেটা সরাসরি নয়, পাকিস্তানের হাত দিয়ে। ইসলামী আন্দোলনের আঞ্চলিক কার্যক্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা ও মতবিনিময়ের জন্য হিজবুল্লাহ ইন্টরন্যাশনালের অন্যতম নেতা হিসাবে বিন লাদেনকে প্রায়ই তেহরানে যেতে হতো। এই সফর ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি তেহরানে এক বৈঠকে যোগদান করেন। যেখানে ইরানী গোয়েন্দা সংস্থা “ভিভাগ” এর শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং আহমদ শাহ মাসুদের সহকর্মীদের নেতৃত্বাধীন একটি আফগান প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিল।

ব্যাপারটা লাদেনের জন্য বেশ নাজুক ও বিব্রতকর হওয়ারই কথা। কারণ তখনও তিনি তালেবানদের আতিথ্য ও নিরাপত্তা ভোগ করছিলেন। অন্যদিকে আহমদ শাহ মাসুদ তখনও ছিলেন তালেবানদের অন্যতম বড় শত্রু । যিনি আফগানিস্তানের বন্ধুর উত্তর পূর্বাঞ্চল দখল করে রেখেছিলেন। কিন্তু বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে আফগানিস্তান সংক্রান্ত কোন বিষয় ছিল না বলেই সম্ভবত লাদেন তালেবানদের বিরাগভাজন হননি। তাঁরা তাঁকে যথারীতি আগের মতোই সমাদর করেছিল। তোহরান বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর আরবদের মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ইসলামপন্থীদের নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং নতুন গোয়েন্দা ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। বর্তমান ইসলামী জিহাদী সংগঠনগুলোর ওপর পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান দৃষ্টি পড়ায় এটা দরকার হয়ে পড়েছিল।

 ওসামা বিন লাদেন এই নয়া সংগঠনের প্রস্তুতিমূলক কাজকর্মের প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে আবির্ভূত হন। নয়া ব্যবস্থাটি হচ্ছে বহুস্তরবিশিষ্ট। এতে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল এই যে, বিপুলসংখ্যক সম্ভাব্য জিহাদীকে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে প্রাথমিক ও মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এদের মধ্য থেকে অধিক সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের এরপর উন্নততর প্রশিক্ষণের জন্য ইরানের মাশাদে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওসামা বিন লাদেন মাশাদে নতুন হেডকোয়ার্টারও স্থাপন করেন। যাতে করে আফাগনিস্তানের পরিস্থিতি তাঁর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠলে তিনি সেখানে চলে যেতে পারেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত কোম শহরে তিনি একটা বাড়িও কেনে ফেলেন নিজের জন্য। 

বিন লাদেনের ঘাটি

আফগানিস্তানে বিন লাদেনের উদ্যোগে জিহাদের এক নতুন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এই ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বিন লাদেন ও তালেবানরা খোস্তা-এর কাছে খাস্তেতে বদর-১ ও বদর-২ শিবির চালাতে থাকে। খাস্ত এলাকাটি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে অবস্থিত। আইএসআইও আগের মতোই এসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। বদর-১ এবং বদর-২ এই দুটো শিবিরে আলোচ্য সময় প্রায় ৬শ’ বিদেশী স্বেচ্ছাসেবক ছিল। এদের অনেকেই আরব। বাকিরা প্রধানত পাকিস্তানী, ভারতীয় কাশ্মীরী, ফিলিপিনো এবং ক্রমবর্ধমান হারে মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের লোক। এখানে আরেকটি কথাও বলে রাখা ভাল, তা হচ্ছে বদর শিবির দুটোই একটা নতুন সড়ক ব্যবহার করে থাকে।

 সর্ব আবহাওয়ার উপযোগী এই সড়কটি ১৯৯৬ সালে নির্মিত হয়েছে। এই সড়কের মাধ্যমে খাস্তে এলাকাটি পাকিস্তানের মিরান শহরের সঙ্গে যুক্ত। ওদিকে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিন লাদেন ও তালেবানরা শিনদান্দ, ওয়াহবান ও ফারাহ জেলায় তিনিটি গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশিক্ষণ শিবিরও পরিচালনা করে। সে সময় শিবিগুলোতে এক হাজারের মতো আরব স্বেচ্ছাসেবক ট্রেনিং নিচ্ছিল। ইসলামী জিহাদীদের নাশকাতামূলক কার্যকলাপের ক্রমবর্ধমান হুমকি সম্পর্কে ১৯৯৭ সালের প্রথমদিকে মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয় যে, “ওসামা বিন লাদেন আফগান তালেবান আন্দোলনের ছত্রছায়ায় আসলে গোপনে গোপনে আরব জিহাদীদের এক নতুন গ্রুপ গড়ে তুলছেন। যার লক্ষ্য হচ্ছে বেশকিছু আরব ও ইসলামী রাষ্ট্রে জিহাদী সংগঠন সৃষ্টি করা। এই তৎপরতার মূল ধারাটি আফগানিস্তান ইরান ও সুদানের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হলেও এর প্রাণকেন্দ্র রয়েছে আফগানিস্তানের খোরাসান প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলে- যেখানে অসংখ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।” রিপোর্টে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় যে, এই উদ্যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বেশকিছু আরব ও ইসলামী দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করা। গেরিলা প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনা করা ছাড়াও বিন লাদেন খোরাসানের পার্বত্য এলাকায় কায়েকটা সুরক্ষিত ঘাঁটি ও সদর দফতরও স্থাপন করেছিলেন। 

এসব ঘাঁটি ও সদর দফতর ছিল গভীর গিরিগুহার ভিতরে লুকানো। সম্প্রতি ঐ ঘাঁটিগুলো দেখে এসেছেন “আল কুদস-আল আরাবী” পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল বারী আতওয়ান। তিনি জানান, “ঈগলের বাসা” বলে আখ্যায়িত আরব যোদ্ধাদের এই ঘাঁটিগুলো তুষারাচ্ছাদিত পর্বতের ৮২০০ ফুট উঁচুতে গিরিগুহায় অবস্থিত। অসংখ্য সশস্ত্র প্রহরী সেই ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত। ঘাঁটি অভিমুখী সড়কগুলো বিমান বিধ্বংসী কামান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান দ্বারা সুরক্ষিত। সর্বত্রই রয়েছে চেক পয়েন্ট। রক্ষীদের সঙ্গে রকেট লাঞ্চারও আছে। এমনকি যে কোন বিমান হামলা মোকাবিলার জন্য ষ্ট্রিংগার ক্ষেপাণাস্ত্রও আছে। 

সভ্যজগত বা লোকালয় থেকে বিন লাদেনের ঘাঁটি একেবারে বিচ্ছিন্ন হলেও বিশ্বের বাকি অংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষার উত্তম ও আত্যাধুনিক ব্যবস্থাও আছে সেখানে। ঘাঁটিতে ছোটখাটো জেনারেটর আছে, কম্পিউটার আছে। আধুনিক গ্রাহক সরঞ্জাম আছে। তা ছাড়া হাজার রকমের তথ্য সংরক্ষণের প্রচলিত ও অত্যাধুনিক উভয় রকম ব্যবস্থাও আছে। সমস্ত আরব ও বিদেশী পত্রপত্রিকার প্রেস কাটিং সযত্নে সংরক্ষিত রাখা হয়ে থাকে সেখানে। বিন লাদেন লন্ডন ও উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে দৈনিক প্রেস রিপোর্ট পান। অর্থাৎ দুনিয়ার ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রতিদিনই তাঁর কাছে পৌঁছে যায়।  আতওয়ান বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও কমান্ডারদের বুদ্ধিবৃত্তিগত গুণাবলী দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এই মানুষটির চারপাশে যেসব মুজাহিদ আছেন তাঁদের বেশির ভাগই আরব। এরা বিভিন্ন বয়সী হলেও অধিকাংশই তরুণ। 

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় ডিগ্রীর অধিকারী তাঁরা। আবার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকও আছেন। তাঁরা পরিবার পরিজন চাকরিবাকরি ছেড়ে এসে আফগান জিহাদে যোগ দিয়েছিলেন। এখন কাজ করছেন লাদেনের সঙ্গে। এমন স্বেচ্ছাসেবকের অভাব নেই যারা সর্বদাই শাহাদাতবরণের জন্য প্রস্তুত। বিন লাদেনের প্রতি মুজাহিদদের শ্রদ্ধার কোন সীমা পরিসীমা নেই। বিন লাদেনকে রক্ষার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে জীবন দিতে প্রস্তুতই শুধু নয়, যে কোন মহল থেকে তাঁর সমান্যতম ক্ষতি করা হলে তার উপযুক্ত বদলা না নিয়ে তাঁরা ছাড়বে না- এমন প্রবল তাঁদের ভালবাসা এই মানুষটির প্রতি। আফগানিস্তান থেকে বিন লাদেনকে বের করে দেয়ার জন্য সৌদি আরব ও মিসরের মতো প্রধান আরব দেশগুলোর দিক থেকে প্রবল চাপ আসা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত তালেবান ও পাকিস্তানীরা তাঁর নিরাপত্তার সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে রেখেছে।

 ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে কাবুল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিন লাদেনকে সমর্থন ও নিরাপত্তা দানের কথা ঘোষণা করে। ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করে তালেবান তথ্যমন্ত্রী আমীর খান মুত্তাকি বলেন “ওসামা বিন লাদেন আমাদের সম্মানিত মেহমান এবং মেহমানকে রক্ষা করা মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব”। মুত্তাকি তখন স্বীকার করেছিলেন যে, বিন লাদেন নানগরহর প্রদেশের জালালাবাদের কাছে “তোরা বুড়া” সামরিক ঘাঁটিতে বসবাস করছেন। বিন লাদেনের সঙ্গে আছেন তাঁর ৫০ সহকর্মী। এদের ৪০ জনই পরিবার পরিজন নিয়ে আছেন। এছাড়া তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর নিজের পরিবার এবং অসংখ্য দেহরক্ষী। তোরা বুড়ায় বিন লাদেন পাথরের তৈরি একটি ভবনের মধ্যে তার অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করেছেন। ঘাঁটির চারদিকে আছে সন্ধানী পোস্ট, কয়েকটি ট্যাংক এবং স্থল ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তোরা বুড়া ঘাঁটিটি পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ রক্ষার কাজে এবং পাকিস্তান হয়ে আরব ও অন্যান্য দেশের মুসলমানদের আফগানিস্তানে আসা যাওয়ার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

আলবেনিয়ায় গেরিলা শিবির স্থাপন

ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আমেরিকান ও ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য সৌদি আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জিহাদের এই বানীতে তিনি আমেরিকানদের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়ে বলেন, অন্য যে কোন বিষয়ে শক্তি অপচয় করার চেয়ে একজন আমেরিকান সৈন্য হত্যা করতে পারা ঢের ভাল।বিশ্বময় জিহাদ ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান সম্বলিত তাঁর অসংখ্য বাণীর মাধ্যে এটা ছিল প্রথম বাণী। ১৯৯৭ সালের মার্চের প্রথমদিকে তিনি আরেকটা বানী দেন। এবার আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তাঁর হুমকিটা ছিল আরও জোরালো ও শাণিত। তাতে তিনি বলেন, পবিত্র ভূমি সৌদি আরব দখল করে রাখার কারণে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদার হতে থাকবে। আফগানিস্তানে থেকে বিন লাদেন যেমন নিজের অবস্থান সংহত ও মার্কিনবিরোধী প্রচারযুদ্ধ তীব্রতর করে তুলছিলেন, অন্যদিকে তখন পারস্য উপসাগরীয় এলাকা ও বলকান অঞ্চলে ইসলামী র‌্যাডিকেলরা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলছিল। 

১৯৯৭ সালের প্রথমদিকে বিন লাদেন আলবেনিয়ায় গেরিলা প্রশিক্ষণ শিবির ও সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এই শিবিরগুলো র‌্যাডিকেল ইসলামপন্থীদের নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। সারায়েভো কর্তৃপক্ষ কোন কারণে তাদের ইসলামী মিত্রদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সে ক্ষেত্রে এই শিবিরগুলোর বদৌলতে তাদের তৎপরতা চালাতে কোনরকম অসুবিধায় পড়তে হতো না। তাছাড়া এসব শিবিরের সমর্থনে কসোভোয় ইসলামী গেরিলাদের তৎপরতা বিস্তার করাও সহজ হয়। পাকিস্তান ও সুদান থেকে আলবেনিয়ার শিবিরগুলোতে ১শ’রও বেশি বিশেষজ্ঞ মুজাহিদ পাঠানো হয়েছিল। এরা প্রধানত ছিল আরব। বাদবাকি জিহাদীরা নানা ধরনের ইসলামী দাতব্য ও ধর্মীয় সংগঠনের ছত্রছায়ায় আগে থেকেই বসনিয়া-হারজেগোভিনায় তৎপর ছিল। বলাবাহুল্য, এ সময়ের দিকে বসনিয়া ও আলবেনিয়ায় ইসলামী মানবিক ও সাহায্য সংগঠনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। 

১৯৯৭ সালের জুন মাসের শেষদিকে সুদানের ধর্মীয় নেতা হাসান আল তুরাবি পাশ্চাত্যের ওপর নতুন করে আঘাত হানার মধ্য দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া ইসলামী আন্দোলনে নতুন প্রাণসঞ্চারের লক্ষ্যে খার্তুমে সুন্নী জিহাদী নেতাদের এক গোপন বৈঠক ডাকেন। এতে ওসামা বিন লাদেন নিজে অংশ না নিলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন আইমান আল জাওয়াহিরি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জিহাদের নামে আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসলামী জিহাদী তৎপরতা প্রসারিত ও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়। আগষ্ট মাসের মধ্যেই সুদানের ইসলামী শিবিরগুলোতে জোর প্রস্তুতির ভাব চোখে পড়ে। এ সময় ওসামা বিন লাদেন পর্যবেক্ষণ সফরে সুদানে আসেন। জিহাদী অভিযান পরিকল্পনাগুলো পর্যালোচনা করে তিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নিয়োজিত তাঁর শক্তি ও সম্পদের এক বড় অংশ আসন্ন জিহাদী অভিযানে নিয়োগ করায় অঙ্গীকার করেন। এ সময় সুদানের আল-দামাজিনে বিন লাদেনের খামারে বিশেষজ্ঞ জিহাদীদের জন্য বিশেষ শিবির স্থাপন করা হয়।  

সৌদি আরব-তালেবান-লাদেন

আফগানিস্তানে তালেবান শক্তির উত্থান ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পিছনে সাহায্য-সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের পরই সৌদি আরবের স্থান। বিশেষ করে এক্ষেত্রে সৌদি তহবিলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তালেবানী মার্কা ইসলামী বিপ্লবের সাথে সৌদি আরবের আল-সৌদ রাাজরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিগত কোন পার্থক্য নেই।(!) সৌদি আরবের সাথে তালেবানদের অত্মিক নৈকট্য অতি প্রবল। কারণ তালেবানদের হার্ডকোর অংশটা হচ্ছে পাকিস্তানের মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত আফগান শরণার্থী। এসব মাদ্রাসার ইমাম ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতা সৌদি আরবের ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও ডিগ্রী লাভ করেছেন। এঁরা আসার সময় কঠিন ও রক্ষণশীল ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্র সঙ্গে করে এনছিলেন এবং সেগুলোর শিক্ষা আফগান ও পাকিস্তানী ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন। আরেকটি ব্যাপারও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে সৌদি রাজপরিবার ও তালেবানী নেতৃত্ব উভয়েই ওয়াহাবী ভাবধারার অনুসারী।

তালেবানদের পিছনে সৌদি শাসকশ্রেণীর ঢালাওভাবে আর্থিক সাহায্য দেয়ার পিছনে আরও একটা কারণ কাজ করেছে বলে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা। সেটা হলো সৌদি ইসলামী র‌্যাডিকেলপন্থী যুবসমাজকে সৌদি আরব থেকে বহু দূরে আফগানিস্তানের মাটিতে ব্যস্ত রাখা, যাতে তারা সৌদি রাজশক্তির জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি না করে। এ জন্যই সৌদি প্রশাসনের একটা মহল এই শ্রেণীর সৌদি যুবকদের তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে নানাভাবে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। আর্থিক সাহায্য হলো সেই কৌশলগুলোরই একটি। কিন্তু আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় আরোহণের পর সৌদি আরবে র‌্যাডিকেল ইসলামী শক্তিগুলো নতুন করে উজ্জীবিত হয় এবং আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিভিন্ন লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে। মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি এমন বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিদ্রোহের ভাবধারাটা বিশেষভাবে দেখা দেয় সৌদি “আফগানদের” মধ্যে। অর্থাৎ আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সৌদিদের মধ্যে। সৌদি শাসক শ্রেণী আরও লক্ষ্য করে যে, সৌদি আরবে বিদ্রোহের মনোভাব সৃষ্টিতে বিন লাদেনরেও বিরাট ভূমিকা আছে।

 তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রিয়াদ ১৯৯৮ সালের জুনের প্রথমদিকে এক বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়। সৌদি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল এবং সৌদি হজ্জ ও ওয়াকফ্ মন্ত্রী মাহমুদ সাকারের নেতৃত্বে গোয়েন্দা ও ধর্মবিষয়ক কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল কান্দাহারে পৌঁছায়। সৌদিরা তালেবানদের সামনে নানা ধরনের টোপ ফেলে। তার মধ্যে একটি হলো তালেবানরা বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেবে। বিনিময়ে তারা অঢেল সৌদি সাহায্য ছাড়াও মার্কিন স্বীকৃতি পাবে। লাদেনের ব্যাপারে তালেবানরা কোন প্রস্তাবেই রাজি হয়নি। শেষে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয় যে আরব “আফগানরা” সৌদি আরব বা উপসাগরের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি কোন হুমকির কারণ হবে না। আগে থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে কিছুদিন পরই সৌদি আরবের একটি শীর্ষস্থানীয় পরিবারের দু’জন প্রতিনিধি বিন লাদেনের ঘাঁটিতে গিয়ে তাঁকে বিপুল অঙ্কের অর্থ চাঁদা হিসাবে দিয়ে আসেন। চাঁদাটা এই সমঝোতা হিসাবে দেয়া যে, সৌদি আরবে তিনি কোন তৎপরতা চালাবেন না। শোনা যায় আল-সৌদ রাজপবিারের কিছু কিছু সদস্যের দেয়া অর্থও ছিল এই চাঁদার অংশ। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই সঙ্কট দেখা দেয়। কাবুলে সৌদি চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স ছিলেন সালমান আল উমারি। তাঁর কার্যালয় ছিল পাকিস্তানে। সেখান থেকে কান্দাহারে গিয়ে তিনি এক সিনিয়র তালেবান নেতার সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে বসেন। 

উমারি দাবি করেন যে, তালেবানদের বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে হবে। সেই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, সৌদি আরব বিন লাদেনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তালেবান নেতা তখন জিজ্ঞাসা করেন যে একজন মূসলমানকে একটা অমুসলিম রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার প্রস্তাব তিনি একজন মুসলমান হিসাবে কিভাবে দিতে পারলেন? ব্যস, শুরু হলো তীব্র কথাকাটাকাটি। তালেবান নেতা বললেন, “আপনি কি সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের? যদি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে থাকেন তাহলে আমি নিজেকে বিন লাদেনের দূত হিসাবে পরিচয় দিতে সম্মানিত বোধ করব।” তালেবান কর্তৃপক্ষ রিয়াদের নীতির দৃশ্যত আমূল পরিবর্তনের কথা ইসলামাবাদকে জানিয়ে দিল। শঙ্কিত রিয়াদ ইসলামাবাদকে আশ্বস্ত করল যে, সৌদি নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে ইসলামাবাদের মধ্যস্থতায় কান্দাহারে এক বৈঠকে সৌদি আরব ও তালেবানদের  মধ্যে এক সুদূরপ্রসারী সমঝোতা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধান প্রিন্স তুর্কি, তালেবান নেতৃবৃন্দ, আইএসআই কর্মকর্তা ও বিন লাদেনের প্রতিনিধিরা। 

সমঝোতা হলো এই যে, বিন লাদেন ও তাঁর অনুসারীরা সৌদি আরবে নাশকতা চালানোর কাজে আফগানিস্তানের অবকাঠামো ব্যবহার করবে না। অন্যদিকে সৌদিরাও আর বিন লাদেনকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেয়ার কিংবা আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার অথবা জিহাদী শিবির ও স্থাপনা বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানাবে না।  বৈঠকে প্রিন্স তুর্কি আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয়কে তেলসহ উদার আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। সমঝোতার কিছুদিন পর পাকিস্তান ও তালেবানের জন্য অস্ত্র ক্রয়ের পেমেন্ট বাবদ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইউক্রেনে পাঠানো হয়। এই অস্ত্র ১৯৯৮ সালের আগষ্টের প্রথমদিকে তালেবানদের আক্রমণাভিযান এবং গোটা আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দারুণ সহায়ক হয়েছিল। ইতিমধ্যে ৭ আগস্ট নাইরোবি ও দারেস সালামের মার্কিন দূতাবাসে ঘটে গেল বোমা হামলা।

আমেরিকার ক্রুজ হামলা

১৯৯৮ সালের ২০ আগস্ট মার্কিন নৌবাহিনী আফগানিস্তানের খোস্ত এলাকার জিহাদী প্রশিক্ষণ শিবির ও স্থাপনাগুলোর ওপর ৭৫ থেকে ৮০ টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানে। নাইরোবি ও দারুস সালামে মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার জবাবে এই আক্রমণ চালানো হয়। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায় যে, ১৩টি ক্ষেপণাস্ত্র মারকায খালিদ বিন ওয়ালিদ নামক এলাকায়, ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র মারকায আমীর মুয়াবিয়া এলাকায় এবং ৫টি ক্ষেপণাস্ত্র জালালুদ্দীন হক্কানীর ঘাঁটিতে আঘাত হানে। অন্য ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আশপাশের গ্রামে গিয়ে পড়ে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েই শুধু নয়, ক্ষেপণাস্ত্রের উড়ন্ত ঠুকরাগুলোর ঘায়েও বিপুলসংখ্যক গ্রামবাসী নিহত হন। আক্রান্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে আইএসআই নিয়ন্ত্রিত হরকত-উল-আনসারের ঘাঁটিতে প্রায় ১২শ’ যোদ্ধা ছিল। যাদের প্রায় সবাই পাকিস্তানী, ভারতীয়, কাশ্মীরী ও আফগান। হক্কানীর ঘাঁটিতে মুজাহিদদের মধ্যে দু’শ’ ছিল আফগান এবং বেশকিছু আরব। বিন লাদেনের হিসাবে সবসুদ্ধ নিহত হয় ২৮ জন। তার মধ্যে ১৫ জন আফগান, ৭জন পাকিস্তানী, দু’জন মিসরীয়, তিনজন ইয়েমেনী ও একজন সৌদি। আহতের সংখ্যা ৩৫।

 ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জিহাদী ঘাঁটিগুলোর দারুণ ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সত্যিই কতটা ক্ষতি হয়েছিল? খোস্ত এলাকার যিনি আদি অকৃত্রিম কমান্ডার সেই জালালুদ্দীন হাক্কানী তো ফুঁ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কথাটা। সোভিয়েত দখলদারির সময় লালফৌজ দু’দফা বড় ধরনের বিমান ও স্থল অভিযান চালিয়ে জাভারার শিবিরগুলো দখলও করতে পারেনি, ধ্বংসও করতে পারেনি। তখন অবিশ্রান্ত বিমান হামলা চলেছিল, গোলাবর্ষণ চলেছিল। ছোট খাটো কিছু ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয়নি হক্কানীর শিবিরগুলোর। পর্বতের গভীরে সুরক্ষিত স্থানগুলোতে নির্মিত ওগুলো। ৬০-৭০ টি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র সেগুলোর কি করতে পারবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন হক্কানী। হক্কানী জানান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সালমান ফারসী শিবির মোটামুটি অক্ষত ছিল। আল-বদর শিবিরগুলো, যেগুলোর আরেক নাম আবু জান্দাল বা আরব শিবির সেগুলোর নূন্যতম ক্ষতি হয়েছে, আর খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমীর মুয়াবিয়া শিবিরের খানিকটা ক্ষতি হয়েছে। এসব শিবিরের অস্ত্র ও গোলাবারুদের গুদামগুলো ছিল গভীর গিরিগুহায়। সেগুলোর কিছুই হয়নি। সম্পূর্ণ অটুট ছিল। তবে ক্ষতি অবশ্যই হয়েছিল। মুজাহিদ শিবির এলাকায় পাঁচটি মসজিদ তৈরি হয়েছিল। 

মুজাহিদরা ছাড়াও এসব মসজিদে আশপাশের গ্রামবাসীরা এসে নামাজ আদায করত। শিবির এলাকা ও সংলগ্ন গ্রামের ৪টি মসজিদ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শহীদ হয়। প্রায় দু’শ’ কুরআনের পোড়া পাতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রবল আঘাত হনে। ইসলামী জিহাদীরা এর বদলা নেয়ার নতুন শপথ নেয়। তারা বলতে থাকে যে, মসজিদ শহীদ ও পবিত্র গ্রন্থের অবমাননা করে আমেরিকা নিজের মৃত্যু ডেকে আনছে। তবে মার্কিন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিন লাদেনকে যতটুকু না আঘাত হেনেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি বিব্রত করেছিল পাকিস্তান সরকারকে। কারণ এ ঘটনার পর প্রকাশ হয়ে পড়ে যে খোস্তের শিবিরগুলোতে পাকিস্তনের আন্তঃসার্ভিস গোয়েন্দা সংস্থার (আইএরআই) বেশ কিছু সদস্য ছিল। এবং তারা কাশ্মীরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য হরকত-উল-আনসারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।
 ---চলমান।

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৫)

মোবারক হত্যা চক্রান্তের মতো ইসলামাবাদের বোমা বিস্ফোরণ অভিযানটিও কড়া নিয়ন্ত্রণ ও গোপনিয়তার মধ্যে পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হয়। জেনেভা থেকে আইমান- আল-জাওয়াহিরি এবং লন্ডন থেকে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ইয়াসির তৌফিক সিড়ি একাজের তত্ত্বাবধান ও অর্থসংস্থান করেছিলেন। ঘটনার চারদিন আগে ১৫ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডে নিযুক্ত মিসরের দু’নম্বর কূটনীতিক আলা আলদীন নাজমীকে তারা গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করে। নাজমী কূটনীতিকের পোশাকে আসলে ছিলেন গোয়েন্দা অফিসার এবং তিনি জেনেভায় জাওয়াহিরির গোপন আশ্রয়স্থলের সন্ধান করছিলেন। মিসরীয় দূতাবাসে বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ছিল মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে মিসরের ইসলামী জিহাদীদের দ্রুত প্রসারমাণ সংগ্রামের অংশ। কিন্তু তার জন্য স্থান হিসাবে ইসলামাবাদকে বেছে নেয়া হয়েছিল কেন? এটা ঠিক যে মিসরীয় ইসলামী জিহাদীদের পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পেশোয়ারে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও প্রশিক্ষণ ঘাঁটি ছিল। তাছাড়া বেশ কিছু সিনিয়র মিসরীয় জিহাদী কাশ্মীরী মুজাহিদদের শিবিরে এবং হরকত-উল-আনসারের মতো আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠনসমূহের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছিল।

সুতরাং এসব ঘাঁটি বা প্রতিষ্ঠানের যে কোন একটা থেকে ইসলামাবাদে মিসরীয় দূতাবাসে অভিযান চালানো অনেক সহজ ও সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ইসলামী জিহাদীরা পাকিস্তানে ছিল অতিথি। সেখানে তাদের আশ্রয় ও সাহায্য সহায়তা দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। সুতরাং যারা তাদের আতিথ্য দিয়েছে, সাহায্য সহায়তা দিয়েছে তাদেরই রাজধানীর বুকে এরকম আঘাত হানা অত্যন্ত অর্থহীন ও দৃষ্টিকটূ লাগার কথা। তাছাড়া অন্যান্য দেশের ইসলামী সংগঠনের মতো মিসরীয় সংগঠনের শিবির ও স্থাপনাগুলোও ছিল আইএসআই এর কড়া নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে। কাজেই আইএসআই’ এর চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিছু করা তাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিল না। তদুপরি আইএসআই এর সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে সিনিয়র মিসরীয় মুজাহিদ কমান্ডারদের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তারা সেই সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলার ঝুঁকি নেবে এটা খুবই অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক।

২৫ জুনের বোমা বিস্ফোরণ যেসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল তার একদিকে ছিল আল সৌদ রাজপরিবারের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং অন্য দিকে এই পরিস্থিতি থেকে ফায়দা লোটার জন্য ইরানের মরিয়া প্রচেষ্টা। রাজ পরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জিহাদী হামলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়। হামলায় অংশগ্রহণকারী দলটি আফগান ও বলকান অঞ্চলের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সৌদি জিহাদীদের নিয়ে গঠিত হলেও এবং ওসামা বিন লাদেনের সাহায্যপুষ্ট হলেও তারা ছিল ইরানী গোয়েন্দা সংস্থার কঠোর নিয়ন্ত্রণে। তেহরানের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া এই অভিযান তারা চালাতে পারত না। আল-খোবারের বিস্ফোরণের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল আল-সৌদ রাজপরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করা কিংবা নিদেনপক্ষে এর ভিতরকে নড়বড়ে করে দেয়ার লক্ষ্যে ধারাবাহিক জিহাদী অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ। অভিযানটি শিয়া ইরানের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হলেও এটি সৌদি সুন্নী মুজাহিদদের দিয়ে সংগঠিত করা হয়। প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো স্থানীয় নেটওয়ার্ককে দিয়ে করা হয়। বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আনা হয় বেকা উপত্যকা এবং দামেস্কের কাছে সিরীয় ও ইরানী গোয়েন্দা বাহিনীর মজুদ থেকে। তৃতীয়ত, সুদক্ষ জিহাদীদের যাদের অীধকাংশই ছিল শিয়া ও ইরানী। দাহরানে আগমন শুরু হয় প্রস্তুতি পর্বের শেষ দিকে। এরা ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিংবা বসনিয়া-হারজেগোভিনার ঘাঁটি থেকে তৃতীয় দেশ হয়ে সৌদি আরবে আসে। এরাই ট্যাঙ্কার বোমা তৈরিসহ বোমা বিস্ফোণের আসল কাজটা করে। বিস্ফোরণটা ঘটায় সৌদিরা।

ওসামা বিল লাদেন আল-খোবারের অভিযানের প্রধান দিকগুলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজতন্ত্রবিরোধী সৌদি ইসলামী র‌্যাডিক্যালদের সঙ্গে সংস্রব থাকার কারণে তিনি যেমন তাদের সরল দিকগুলো জানতেন তেমনি জানতেন দুর্বল দিকগুলোও। অন্যদিকে রিয়াদের ক্ষমতার লড়াইয়ের ভিতরের গতি-প্রকৃতিও তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এই অভিযান পরিচালনায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। আল-খোবারের জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ ছিল শিয়া এবং তারা ইরানের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। তবে নিরাপত্তার কারণে প্রাথমিক সাংগঠনিক কাজগুলো স্থানীয় সুন্নীদের দিয়ে করা হয়; যারা ছিল বিন লাদেনের অনুগত।

পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালের প্রথমদিকে সৌদি আরবের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েক ডজন সৌদি সুন্নী র‌্যাডিক্যাল যুবকদের রিক্রুট করে বেকা উপত্যকায় হিজবুল্লাহ (!) শিবিরগুলোতে জিহাদ ও গুপ্ত তৎপরতার ওপর চার থেকে ছয় সপ্তাহের কোর্স করতে পাঠানো হয়। শিক্ষা লাভ শেষে তারা সিরিয়া ও জর্দান হয়ে সৌদি আরবে ফিরে আসার পর তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। এরা বিস্ফোরণের কয়েক মাস আগে থেকে পেশাদারী গুপ্তচরবৃত্তি চালায়। এদের কেউ কেউ আল-খোবার সেনাছাউনির চার পাশটা আস্তে করে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে দেখে। কেউ কেউ দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়েও দেখে। একবার একটা ট্রাক ছাউনির চারপাশের বেড়া কত শক্ত যাচাই করার জন্য বেড়ার এক জায়গায় ধাক্কা লাগায়। বিস্ফোরণের দু’সপ্তাহ আগে বোমাবাহী ট্যাঙ্কারের ঠিক অনুরূপ একটি ট্যাঙ্কারকে কম্পাউন্ডে ঢোকার চেষ্টা করতে এবং তার পর চারপাশটা চক্কর মেরে যেতে দেখা গেছে। এসব ঘটনা ছিল বেমা বিস্ফোরণের আগের মাসগুলোয় পরিচালিত পর্যবেক্ষণ ও গোয়েন্দা তৎপরতার অতিসমান্য অংশমাত্র। এ ধরনের তৎপরতা সৌদি আরবের অন্যান্য স্থানেও সম্ভাব্য টার্গেটগুলোকে লক্ষ্য করে পরিচলিত হয়।

 চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয় ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে। এ সময় ইরানী গোয়েন্দা আফিসাররা সৌদি আরবে এসে প্রস্তুতির সব কিছু দেখেশুনে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে যান। ১৯৯৬ এর মে মাসে দু’ধরনের সুদক্ষ জিহাদী সৌদি আরবে আসে। প্রথম দফায় আগতদের বেশির ভাগই ছিল সৌদি হিজবুল্লাহ (!) (শিয়া), সুন্নী আফগান, বলকান ও অন্যান্য। এরা ইরান, আফগানিস্তান-পাকিস্তান এবং বসনিয়া-হারজেগোভিনার ঘাঁটি থেকে সৌদি আরবে আসে। এরা এক সঙ্গে দু’ তিনজনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আসে। এরা অভিযান পরিচালনার স্থান এবং বিকল্প টার্গেটগুলো দেখে নেয়। দ্বিতীয় জিহাদী দলটি জুনের প্রথম দিকে দাহরানে আসতে শুরু করে। এরা বেশির ভাগই ছিল শিয়া। সঙ্গত কারণেই স্থানীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ঘটেনি।

অভিনব কৌশল তাকিয়ে ছিল বিশ্ব

জুন মাসের মধ্যে বোমা তৈরির অধিকাংশ উপকরণ- উচ্চশক্তির বিস্ফোরক, দাহ্য প্রদার্থ ও অত্যাধুনিক ফিউজ সৌদি আরবে এসে যায়। বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ সিরিয়া থেকে জর্দান হয়ে আসে। অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও ফিউজগুলো পশ্চিম ইউরোপ থেকে কম্পিউটার পার্টস নাম দিয়ে চোরাচালান করে আনা  হয়। ফিউজসহ মূল চালানের কিছু কিছু অংশ সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের ঠিকানায় আনা হয়েছিলো। ন্যাশনাল গার্ডের অভ্যন্তরে ইসলামী জিহাদীদের সমর্থক ছিল। তারাই এগুলো গ্রহণ করে লুকিয়ে রাখে। মধ্য জুনের আগেই আল-খোবার এলাকার ওপর অনুপুঙ্খ নজরদারির কাজ শেষ হয়। কয়েক সপ্তাহ আগে স্থানীয় নেটওয়ার্ক একটা ক্যাপ্রিস গাড়ি চুরি করে রেখেছিল। সেটি পরে পালানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। 

ওটা পরে দাহরান থেকে ছয় মাইল দূরে দাম্মামে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো। বোমা বিস্ফোরণের কাজে ব্যবহৃত হয় মার্সিডিজ বেঞ্জ ট্যাঙ্কার ট্রাকটি ঘটনার মাত্র ক’দিন আগে একটি নির্মাণ কোম্পানীর গ্যারেজ থেকে চুরি করে নেয়া হয়। তার অর্থ, অভিযানের সামান্য আগেই বোমা তৈরির কাজে হাত দেয়া হয়েছিল। বিস্ফোরকের সঙ্গে তৈল ও দাহ্য পদার্থের মিশ্রণে এর বিধ্বংসী ক্ষমতা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এ ধরণের বোমা সাধারণত ইরানী জিহাদীরা ব্যবহার করে থাকে। প্রস্তুতি সম্পন্ন করার অল্প পরই, খুব সম্ভবত অভিযানের আগে এক্সপার্ট জিহাদীরা দাহরান ত্যাগ করে। বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজটা তারা সৌদি জিহাদী হিজবুল্লাহ (!) সদস্যদের একটি ক্ষুদ্র দলের হাতে ছেড়ে দেয়। বলাবাহুল্য, সে কাজে তারা ব্যর্থ হয়নি।       

সৌদি রাজপরিবারে ক্ষমতাদ্বন্দ্বের অন্তরালে

১৯৯৫ সালের শেষদিকে বাদশাহ ফাহাদ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। যুবরাজ প্রিন্স আব্দুল্লাহ সৌদি আরবের অস্থায়ী শাসক মনোনীত হন। এই নিযুক্তি গোটা আল সৌদ রাজপরিবারের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির কারণ ঘটায়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাদশাহ ফাহাদ আবার নিজের হাতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে প্রবাসে যেতে অস্বীকৃতিই শুধু জানালেন না, আমৃত্যু ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছাও ব্যক্ত করলেন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রিন্স আব্দুল্লাহর অবস্থান এমনিতেই অনিশ্চিত ছিল; সেটা আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ালো। ওদিকে বাদশাহ ফাহাদের মৃত্যুসম্ভাবনাকে সামনে রেখে উত্তরাধিকারের লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। ১৯৯৫-৯৬ সালে সৌদি সিংহাসনের দখল নিয়ে আল-সৌদ পরিবারের অভ্যন্তরে তিনটি পৃথক পৃথক উপদলের মধ্যে লড়াই চলছিল। এগুলো হলো- 


(১) ক্রমবর্ধমান হারে একঘরে হয়ে পড়া প্রিন্স আব্দুল্লাহ (২) প্রিন্স বন্দরের নেতৃত্বে সুদাইরির তরুণ বংশধররা, যাদের পিছনে প্রিন্স বন্দর ও প্রিন্স সুলতানের পূর্ণ সমর্থন ছিল এবং (৩) বাদশাহ ফাহদের অপর দুই আপন ভায়ের নেতৃত্বাধীন সালমান-নাইফ গ্রুপ, যারা সমঝোতার ব্যবস্থা হিসাবে প্রিন্স সালমানকে বাদশাহ করতে চাইছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাদশাহ ইবনে সৌদের প্রিয়তমা স্ত্রী হাসা-আল-সুদাইরির গর্ভজাত সাত পুত্র ছিল। বাদশাহ ফাহাদ ও অপর ছয় ভাই পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে প্রিন্স আব্দুল্লাহ হচ্ছেন তাদের বৈমাত্রেয় ভাই। তথাপি উত্তরাধিকার বিধান অনুযায়ী প্রিন্স আব্দুল্লাহরই পরবর্তী বাদশাহ হওয়ার কথা। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে বাদশাহ ফাহাদের স্বাস্থের অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটেছে জেনে বাদশাহর আপন তিন ভাই সুলতান, সালমান ও নাইফ নিজেদের অবস্থানের শক্তি বৃদ্ধির জন্য জোট বাঁধেন। প্রিন্স আব্দুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী বাদশাহ হওয়ার পর সুদাইরির পুত্র ও পৌত্ররা মিলে তাঁকে ভবিষ্যতে সিংহাসনে বসতে না দেয়ার জন্য একাট্টা হয়ে ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকেন। 

১৯৯৬ সালের প্রথমদিকে এই ষড়যন্ত্র তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু সুদাইরি পুত্রদের দু’টি উপদলের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলে। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে আব্দুল্লাহ উপসাগরীয় শীর্ষ বৈঠকে যোগদানের জন্য মাস্কটে গেলে সুদাইরি পুত্ররা একটা শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সুলতান সুপ্রীম কাউন্সিল অব উলামা’র সদস্যদের তলব করে তাদের সমর্থন দাবি করেন, যাতে তিনি নিজেকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করতে পারেন। প্রিন্স সুলতান ১৯৯৫ এর নভেম্বরে রিয়াদের বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার জন্য প্রিন্স আব্দুল্লাহকে ন্যাশনাল গার্ডে’ প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও উলামাদের সমর্থন কামনা করেছিলেন। বলেছিলেন যে, প্রিন্স আব্দুল্লাহ ন্যাশনাল গার্ডের আনুগত্য সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।প্রিন্স সুলতানের এসব উদ্যোগ অবশ্য অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। কারণ তিনি উলামাদের সমর্থন আদায় করতে পারেননি। উলামা সম্প্রদায় তাঁকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি সিংহাসনে বসার অনুপযুক্ত। শুধু তাই নয়, তার তাঁর এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রিন্স আব্দুল্লাহকেও জানিয়ে দিয়েছিল।

অন্যদিকে প্রিন্স আব্দুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। উলামাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা সমর্থন করতেন। প্যান আরব ও প্যান ইসলামিক সংগ্রামেরও সমর্থক ছিলেন। তার মধ্যে খানিকটা পাশ্চাত্যবিরেধিতা ছিল। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে অবিশ্বাসের চোখে দেখতেন। এসব কারণে তিনি উলামা সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক মিত্র ছিলেন। তবে সুদাইরিভ্রাতাদের তরফ থেকে তার ক্ষমতার প্রতি ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবালায় শুধু উলামা সম্প্রদায়ের সমর্থনই যথেষ্ট ছিল না। এ জন্য তাকে আরেকটা পথও দেখতে হয়েছিল। সেই সমর্থনটা তিনি পেয়েছিলেন দামেস্ক থেকে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের পরিবার তথা আসাদ ক্লানের সাথে প্রিন্স আব্দুল্লাহর এক বিচিত্র ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ১৯৯৬ সালের বসন্তের প্রথম দিকে প্রিন্স আব্দুল্লাহর ইনার সার্কেলের কিছু সদস্য সুদাইরিভ্রাতাদের পতন ঘটানোর পরিকল্পনা নেয়। ঠিক হয় যে সিরীয় গোয়েন্দা সংস্থা ছোটখাটো ধরনের বেশকিছু মার্কিন বিরোধী সন্ত্রাসবাদী অভিযান চালাবে এবং তার জন্য দোষ চাপানো হবে বিভিন্ন ইসলামী জিহাদী সংগঠনের নামে। সন্ত্রাসবাদের এই আকস্মিক জোয়ারে ভারি বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে সুদাইরিরা।

 কারণ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাদেরই হাতে। প্রথমটি প্রিন্স নাইফের এবং পরেরটি প্রিন্স সুলতানের। তাদের এই ব্যর্থতার জন্য আমেরিকাও নাখোশ হবে। ফলে তাদের প্রতি মার্কিন সমর্থন কমবে। এ অবস্থায় তারা সৌদি সিংহাসনের জন্য আর উপযুক্ত বলে গণ্য হবে না। অন্যদিকে প্রিন্স আব্দুল্লাহর পরিচালনাধীন রয়াল গার্ড তথাকথিত “জিহাদী নেটওয়ার্ককে” ধ্বংস করে দেবে। এতে আব্দুল্লাহর জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি দুটোই বৃদ্ধি পাবে। সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীতে তার ঘনিষ্ঠতম সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট আসাদ ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এসব কার্যক্রম শুরু করার সবুজ সঙ্কেত দেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে প্রিন্স আব্দুল্লাহর পাশে সিরিয়ার এভাবে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা একটা বদান্যতা। কিন্তু এখানে বদান্যতার ব্যাপার নেই। যা আছে সেটা হলো আদান-প্রদান। বিভিন্ন ইস্যুতে বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আসাদের গভীর বিরোধ থাকলেও প্রিন্স আব্দুল্লাহ যখন অস্থায়ী বাদশাহ ছিলেন সে সময় সিরিয়া সৌদি আরবের কাছ থেকে বিশেষ আর্থিক সাহায্য লাভ করে, যার পরিমাণ বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার। তা ছাড়া সামরিক ক্ষেত্রেও প্রিন্স আব্দুল্লাহ সিরিয়াকে বিপুল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কাজেই সিরিয়া প্রিন্স আব্দুল্লাহর বিপদের সময় এগিয়ে আসবে এতে তেমন আশ্চর্যের কিছু ছিল না। 

সৌদি প্রিন্সদের ক্ষমতাদ্বন্দ্বের শিকার হলেন লাদেন

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সবুজ সঙ্কেত এলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরবে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার প্রস্তুতি নিল সিরীয় গোয়েন্দা বাহিনী। টার্গেট নির্বাচন করা হলো প্রধানত মার্কিন সামরিক স্থাপনা। সন্ত্রাসবাদীদের সৌদি আরব পাঠানো হলো। পাঠানো হলো অস্ত্র ও বিস্ফোরক। এ কাজে সাহায্য করল ইরান। আর ব্যবহার করা হলো জর্দানের ভূখন্ড। তবে অঘটন যে কিছু ঘটল না তা নয়। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে সিরিয়া ও জর্দান হয়ে আসা একটি সৌদি নম্বর প্লেট লাগানো গাড়ি আটকে দেয়া হলো সৌদি-জর্দান সীমান্তের ক্রসিং পয়েন্ট। নানা ধরনের মোট ৮৪ পাউন্ড ওজনের উচ্চশক্তির বিস্ফোরক ছিল ওতে। এর আগে রিয়াদের ১৩ নভেম্বরের বিস্ফোরণ ঘটনায় জড়িত হাসান আল-স্যারে নামে এক সৌদি নাগরিক পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল।

 তাকে ওখান থেকে ধরে এনে অনেক গোপন তথ্য বের করে ফেলে সৌদি গোয়েন্দারা। তার কাছ থেকে জানতে পারে সৌদি আরবে অস্ত্রশস্ত্র ও লোকলস্কর আনার জন্য কোন পথটি ব্যবহার করেছিল জিহাদীরা।এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যখন সৌদি আরবে জিহাদী হামলার আশঙ্কা বাড়ছিল। অন্যদিকে তখন এই ঘটনাগুলোকে সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতাদ্বন্দ্বে ব্যবহার করছিল বিভিন্ন পক্ষ। অবশ্য এক এক পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেক রকম। প্রিন্স সুলতান, প্রিন্স সালমান ও প্রিন্স নায়িফ প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান সংহত করার চেষ্টায় এই ঘটনাগুলো নিয়ে প্রচারযুদ্ধ চালাতে লাগলেন। তাতে দেখা গেল সৌদি রাজপরিবারে সালমান-নায়িফ পক্ষের-শক্তি বেশ বেড়ে গেছে। সেটা এতই বেড়েছে যে, এই পক্ষের ক্ষমতায় যাওয়ারও জোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে শঙ্কিত হয়ে প্রিন্স সুলতান তখন একটা চাল চাললেন। তিনি জানতেন যে, রিয়াদের শাসকচক্রের একটা মহলের পক্ষ থেকে প্রিন্স সালমান গোপনে বিল লাদেনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছেন। উদ্দেশ্য বিন লাদেন ও তার বাহিনীকে সৌদি আরবের বাইরে জিহাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে প্ররোচিত করা। এ জন্য ঐ মহলটি বিন লাদেনের পিছনে বেশ টাকাপয়সা ঢালত তার ইসলামী বিপ্লব সাহায্য করার নামে। লাদেন আবার কখন সৌদি আরবের দিকে নজর দিয়ে বসেন সেটাই ছিল তাদের ভাবনার বিষয়। প্রিন্স সালমান-নায়িফ উপদলটিকে কোণঠাসায় ফেলার জন্য ১৯৯৬ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে প্রিন্স সুলতান বাদশাহ ফাহাদের নামে একটা অনুরোধ জানান সুদানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল বসিরের কাছে।

 জেনারেল বসির তখন হজ্জ করতে মক্কায় এসেছিলেন। প্রিন্স সুলতানের অনুরোধটা ছিল এই যে, বিন লাদেনকে সুদান থেকে বের করে দিতে হবে। বিনিময়ে সৌদি আরব সুদানকে বিপুল আর্থিক সাহায্য দেবে।প্রেসিডেন্ট বসিরের  মে মাসের মাঝামাঝি  বিন লাদেন ও তার সহচরদের সুদান থেকে বহিস্কারের আদেশ দেন। প্রিন্স সুলতানের প্রভাবাধীন সৌদি পত্রপত্রিকায় সুদান থেকে লাদেনের বহিস্কারকে সৌদি কূটনীতির বড় ধরনের বিজয় এবং সৌদি আরবের অভন্তরীণ নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে অভিনন্দিত করা হয়। 
  
এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রিন্স সুলতানের উপদলটির শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং প্রিন্স সালমান-নায়িফ উপদলটি খানিকটা কোণঠাসা হয়। কিন্তু উলামাদের সঙ্গে সংঘাত বাধায় এবাং তাদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় প্রিন্স সুলতান শেষ পর্যন্ত সিংহাসনের দাবি পরিত্যাগ করেন। বরং তার ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স বন্দর বিন সুলতান যাতে পরবর্তী সৌদি বাদশাহ হতে পারে তা নিশ্চিত করতে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগে লেগে যান। প্রিন্স সুলতান তরুণ প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনার জন্য রিয়াদে সুদাইরীর পক্ষের সকল প্রবীণ ও নবীন সদস্যের জরুরী বৈঠক ডাকেন। প্রিন্স সুলতান তরুণ শাহজাদাদের হুঁশিয়ার করে দেন যে, তার পিছনে সবাই একাট্টা হয়ে না দাড়ালে তারা সমস্ত ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা হারাবে। সোজা কথায় একটা সুদৃঢ় ঐক্যফ্রন্ট রচনা করতে হবে। বৈঠকে প্রিন্স সুলতান জানান যে, প্রিন্স আব্দুল্লাহ অচিরেই ক্ষমতায় আসছেন।

 তখন সুদাইরীদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তি নিশ্চয়ই খর্ব হবে। তবে আব্দুল্লাহর যা বয়স তাতে তার শাসনকাল হবে একটা ক্রান্তিকাল মাত্র। সুতরাং সুদাইরীদের সামনে আসল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের শাহাজাদাদের জন্য ক্ষমতা দখল করা ও তা ধরে রাখা। প্রিন্স সুলতান সোজা কথায় বলতে চাইলেন যে, তার ছেলে প্রিন্স বন্দরকে ঘিরেই যেন পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে এবং এ ব্যাপারে যেন সবাই সমর্থন জানায়। প্রিন্স সুলতান তার এই উদ্যোগের পিছনে বাদশাহ ফাহাদের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হলেন। এর কিছুদিন পরই দ্বিতীয় প্রজন্মের শাহজাদাদের যৌথ নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে প্রিন্স বন্দর বিন সুলতান এবং বাদশাহর পুত্র প্রিন্স মোহাম্মদ বিন ফাহাদের মধ্যে একটা গোপন চুক্তি হয়। চুক্তির প্রতি তাদের দু’জনের পিতার বাদশাহ ফাহাদ ও প্রিন্স সুলতানের সমর্থন ছিল। প্রিন্স বন্দর এরপর থেকে নিজেকে বাদশাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। ক্ষমতার সুতীব্র লড়াইেয়ের মধ্যে তিনি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেন। 

এসব সুবিধার মধ্যে একটি ছিল রাজকীয় গ্যারান্টি, যে গ্যারান্টিবলে তিনি আব্দুল্লাহর ভাবী রাজদরবারে এমন উচু পদ পাবেন যেখান থেকে সিংহাসন দখল করা সহজ হবে। মে মাসে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, প্রিন্স সুলতানের উপদলটি কার্যত এই গ্যারান্টি দিতে সক্ষম হয় যে, দ্বিতীয় প্রজন্মের সুদাইরীদের মধ্যে শীর্ষস্থানটিতে থাকবেন পিন্স বন্দর অন্য কেউ নন। এমনকি প্রাক্তন বাদশাহ ফয়সালের দুই পুত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স সৌদ আল ফয়সাল এবং গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সালও নন। মে মাসের শেষ দিকে প্রিন্স সালমান-নায়িফ উপদলটির ক্ষমতা সহসা বেড়ে যাওয়ায় প্রিন্স বন্দর ও প্রিন্স মোহাম্মদ তাদের পরিকল্পনাকে তরান্বিত করে তোলেন। 

তালেবানরা বিন লাদেনকে কিভাবে নিল

ওসামা বিন লাদেনের আফগানিস্তানে অবস্থান সম্ভব হয়েছে তালেবানদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। এই সমর্থন না পেলে তার কি পরিণতি হতো কিছুই বলা যায় না। বৈরী শক্তির হাতে ধরা পড়া বা নিহত হওয়ার তার সমূহ আশঙ্কা ছিল। লাদেন আফগানিস্তানে আসেন ১৯৯৬ সালে মে মাসে। আর তালেবানরা কাবুল দখল করে সে বছরের সেপ্টেম্বরে। অবশ্য কাবুল দখলের বেশ আগেই তালেবানরা আফগানিস্তানের প্রধান সামরিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী জিহাদে বিন লাদেনের অবদানের কথা ভালভাবেই জানা ছিল তালেবানদের।তদুপরি লাদেনের বিশ্বব্যাপি ইসলামী জিহাদের দৃষ্টি ভঙ্গির সঙ্গে তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক দিক দিয়ে মিল ছিলো। তালেবানরাও বিশ্বজুড়ে সীমান্তমুক্ত ইসলামী সমাজ কায়েমের কথা বলে এসেছে। তাই লাদেনকে সর্বাত্মক সমর্থন প্রদানে তালেবানদের ওয়াদাবদ্ধ থাকাই স্বাভাবিক।

 তালেবানরা লাদেনের সঙ্গে তাদের প্রথম সাক্ষাতের পূর্বে থেকেই সহমর্মিতা ও সংহতির পরিচয় দিয়েছে। তালেবানদের একটি প্রতিনিধি দল জালালাবাদে লাদেনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেখানে লাদেনের প্রতি বিপুল সম্মান ও মর্যাদা দেখিয়ে এক তালেবান কমান্ডার বলেন: হে শেখ! আমাদের এই ভূখ- আফগান ভূখন্ড নয়, এ ভূখন্ড আল্লাহর। আমাদের জিহাদও আফগানদের জিহাদ নয়, বরং সকল মুসলমানদের জিহাদ। তোমার অনুগত শহীদরা আফগানিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে আছে, তাদের কবরই তার স্বাক্ষর। তুমি যে মাটির উপর দিয়ে হেটে যাও সেটাকে আমরা পবিত্র বলে জ্ঞান করি। লাদেনের প্রতি এ ছিল তালেবানদের সুগভীর অনুভূতির প্রকাশ। একারণে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের হুমকি, ভয়ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও আফগানিস্তানে তাঁর নিরাপদ আশ্রয় সম্ভব হয়েছিল। তালেবানরা আফগানিস্তানের মাটিতে লাদেনের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে অন্য আর কোন বিষয়ের প্রতি নজর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু করেছিল তাদের তৎকালিন নেপথ্য চালিকা শক্তি পাকিস্তানের আইএসআই। লাদেনকে নিয়ে যাতে সৌদি নেতৃবৃন্দের সাথে বড় ধরনের কোন বিরোধে জড়িয়ে পড়তে না হয়, বিচক্ষণ আইএসআই কমান্ডাররা তা নিশ্চিত করতে বড়ই ব্যস্ত ছিলেন। 

১৯৯৭ সালে এপ্রিল মাসে সৌদি গোয়েন্দা প্রধান তুর্কী আল-ফয়সাল বেশ কয়েকবার আইএসআই-এর কাছে অভিযোগ করেন যে, সৌদি আরবে বিভিন্ন জিহাদী ঘটনার সঙ্গে লাদেন জড়িত ছিলেন। এথেকে আইএসআই  ধরে নেয় যে, সৌদি আরব লাদেনকে ফেরত চাইতে পারে। ফেরত চাইলে তাকে ফেরত দিতেই হবে এমন ধারণার বশবর্তি হয়ে আইএসআই তালেবানদেরই একটি দলকে দিয়ে লাদেনকে কান্দাহারে শিথিলভাবে গৃহবন্দি করে রাখে। কিন্তু ক’দিন পর পাকিস্তানে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে জানান যে, “বিন লাদেন সৌদি আরবে কোন অপরাধ করেননি এবং সৌদি আরবও তাকে কখনো গ্রেফতারের দাবি জানায় নি”। ব্যাপারটা অতিব লক্ষণীয় যে, তখন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তালেবান নেতৃবৃন্দ ও আইএসআই হাই কমান্ডের সঙ্গে প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সালের সঙ্গে কয়েক ডজনবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কখনই তিনি বা সৌদি সরকারের অপর কোন প্রতিনিধি এ বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। কিংবা বিকল্প কোন বক্তব্যও দেননি। 

সৌদি রাজতন্ত্র সম্পর্কে বিন লাদেন

ব্রিটেনের “দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট” পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের সঙ্গে সাক্ষাতকারে বিন লাদেন তাঁর সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, উপসাগর যুদ্ধের অজুহাতে আমেরিকাকে সৌদি আরবে ঘাঁটি গেড়ে বসতে দেয়া ছিল প্রধানতম কারণ। তবে আল-সৌদ রাজপরিবারের সঙ্গে তার যেটুকুবা ঘনিষ্ঠতা ছিল জনপ্রিয় উলামা শেখ উদাহ ও তার সমর্থকদের গ্রেফতারের পর সেটুকুও শেষ হয়ে যায়। বিন লাদেন বলেন যে, শেখ উদাহকে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে আল- সৌদ রাজপরিবার দেশ শাসনের বৈধতা হারিয়ে ফেলেছে।
 ---চলমান।

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৪)

কিভাবে বেঁচে গেলেন মোবারক

প্রেসিডেন্ট মোবারককে হত্যা করার ব্যাপারে তুরাবি ও মিসরীয় ইসলামী নেতৃবর্গ যে কতটা বদ্ধপরিকর ছিলেন, আগের পর্বে তার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অপারেশন প্ল্যান প্রাথমিক অবস্থায় থাকাকালে সেই এপ্রিল মাসের শেষদিকে আদ্দিস আবাবায় একটি ভিলা ভাড়া নেয়া হয়েছিল, যেটি অগ্রবর্তী হেডকোয়ার্টার ও অস্ত্রশস্ত্র রাখার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হবে। অপারেশন প্ল্যান বাস্তবায়নের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর আদ্দিস আবাবায় নিযুক্ত বিশেষ দলের সাহায্যকারী নেটওয়ার্কটি পূর্বনির্ধারিত ভিলায় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ গোপনে নিয়ে আসতে থাকে। তিন সশস্ত্র দল নিজ নিজ আক্রমণস্থলে যাতে নিরাপদে অবস্থান নিতে পারে এবং অভিযান সম্পন্ন হওয়ার পর যাতে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার ছত্রছায়া পায় সেজন্য নেটওয়ার্কের সুদানী সদস্যরা ইথিওপিয়ার নিরাপত্তা অফিসারদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষায় কত যে সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল বলার নয়। আক্রমণে অংশ নেয়া স্কোয়াডটি প্রেসিডেন্ট মোবারকের আগমনের সময় এবং গমনপথ আগে থেকে একদম সঠিকভাবে জেনে নিতে পেরেছিল। জুনের মাঝামাঝি জাওয়াহিরির সুদান ও ইথিওপিয়া সফরের সময় হত্যা আয়োজনের চূড়ান্ত পর্ব রচিত হয়। ইথিওপীয় ইসলামী জিহাদীদের দিয়ে বাকি অস্ত্র চোরাচালান করে আনা হয় ইথিওপিয়ায়।

 অভিযানে যেসব যানবাহন ব্যবহৃত হবে সেগুলো সংগ্রহ করে রাখা হয়। এমনকি গাড়িবোমাও ঠিক রাখা হয়। অভিযানে যারা অংশ নিবে তাদের থাকার জন্য কয়েকটি এ্যাপার্টমেন্ট ও বাড়িও ভাড়া নেয়া হয়। সেখানে খাবারদাবার ও অন্যান্য জিনিস সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। জাওয়াহিরির সফরের মধ্য দিয়ে এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবার পর সুদানী গোয়েন্দা সংস্থা প্রায় ত্রিশ ইথিওপীয় ইসলামী জিহাদীকে আদ্দিস আবাবা থেকে খার্তুমে সরিয়ে নেয়। আসন্ন অভিযান সম্পর্কে এরা অনেক কিছু জানত। এদের কেউ ধরা পড়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে এটা সুদানীরা চায়নি। অভিযানে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের সবই ছিল সুদানি সেনাবাহিনীর। জুন মাসের মাঝামাঝি তুরাবি আদ্দিস আবাবা অভিযানের তত্ত্বাবধান কাজের দায়িত্বটা সিরাজ মোহাম্মদ হোসেন ওরফে মোহাম্মদ সিরাজ নামে এক সিনিয়র সুদানী গোয়েন্দা অফিসারকে প্রদান করেন। তিনি আদ্দিস আবাবায় গিয়ে অভিযান বাস্তবায়নের অপারেশনাল কমান্ড নেন।

 এই সিরাজ ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে সুদানী কানসাল হিসাবে ছদ্মনামে কাজ করার সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা বিষ্ফোরণে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ২০ জুনের দিকে সিরাজ আগাম প্রস্তুতির গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব বিষয়ে সন্তুষ্ট হবার পর অভিযানে অংশগ্রহণকারী আসতে শুরু করে দেয়। তারা তাদের অস্ত্রপাতি, সড়ক প্রতিবন্ধকতাকারী ট্রাক ও কারবোমা বা গাড়িবোমা ইত্যাদি আঘাত হানার প্রাক্কালে সুদানী গোয়েন্দা সংস্থার আলাদা একটা নেটওয়ার্কের কাছ থেকে পান। নেটওয়ার্কটি চালাতেন শেখ দারবিশ নামে এক সুদানী নাগরিক, যিনি তুরাবির অতি অনুগত ও বিশ্বস্ত। দারবিশ ওদের দুটো বড় সুটকেস বোঝাই ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, আরপিজি লঞ্চার, শেল, গুলিগোলা ও বিস্ফোরক দ্রব্য দেন। প্রথম দলটি তাদের শরীরে অস্ত্রসস্ত্র বহন করবে। দ্বিতীয় দলটি সঙ্গে ট্রাবেল ব্যাগ এনেছিল রকেট ও লঞ্চার বহনের জন্য। কথাছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রয়োজন না হলে সেগুলো ব্যাগ থেকে বের করা হবে না। এই সিদ্ধান্তটাই মারাত্মক ভুল বলে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়।

 আক্রমণের দিনটি ১৯৯৫ সালের ২৬ জুন যথারীতি ঠিকমতোই শুরু হয়। ইথিওপীয় গোয়েন্দা অফিসাররা হোসনী মোবারকের পরিকল্পিত সিডিউল সম্পর্কে শেষ মুহূর্তের তথ্য সর্বক্ষণ সিরাজকে সরবরাহ করে চলেছিল। তার ভিত্তিতে তিনি যথাসময়ে লোক মোতায়েন শুরু করেন। হত্যা প্রচেষ্টার গোটা অধ্যায় জুড়ে মোবারকের আগমনের সময় ও গমনপথ সম্পর্কে গোয়েন্দা বাহিনীর দেয়া তথ্য অতিমাত্রায় সঠিক ছিলো। তার মানে সিরাজের ইথিওপীয় সোর্সগুলো অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ ছিল। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মোবারকের সফরসঙ্গীদর আগমনে বিলম্ব এবং তা থেকে উদ্ভুত বিভ্রান্ত্রির ফলে গোটা অভিযানটি প- হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট মোবারকের বিমান বন্দরে এসে পৌঁছার কথা ছিল সকাল সাড়ে আটটার ঠিক আগে এবং আসার পরপরই আধ মাইলের কিছু বেশি দূরে সম্মেলন কেন্দ্র অভিমুখে রওনা দেয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনামতো সোয়া আটটার পর পরই ঐ রুটে ইথিওপীয় ও মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। মোবারকের প্লেন ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু সফরসঙ্গীরা সময়মতো না আসায় তার কনভয়টিকে গুছিয়ে তোলা যাচ্ছিল না। মোবারকের কনভয় তৈরি হতে বিলম্ব হচ্ছিল বলে ইথিওপীয় পুলিশরাও বিরক্ত হয়ে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। ওদিকে দ্বিতীয় ঘাতক দলটি যে জায়গায় অবস্থান নিয়েছিল তাদের ওপর যাতে সন্দেহের দৃষ্টি না পড়ে সেজন্য তারা রকেট ও রকেট লঞ্চার ট্রাভেল ব্যাগের ভিতর রেখে তাদের ফায়ারিং পজিশন থেকে সামান্য দূরে সরে যায়। 

প্রেসিডেন্ট মোবারক ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। আটটা পঞ্চান্ন মিনিটের দিকে কনভয়ে যেকজন লোক আছে তাদের নিয়েই তিনি অবিলম্বে সম্মেলন কেন্দ্র অভিমুখে রওয়ানা হবার নির্দেশ দিলেন। মোবারকের কনভয় যখন ছুটে চলছে সে সময় জিহদী দলের প্রথম অংশটি পূর্বপরিকল্পনা মতো ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ছোড়ে। কিন্তু নীল রঙের যে টয়োটা ট্রাকটির তখন উল্টো দিক থেকে এসে কনভয়ের সামনে পথরোধ করে দাঁড়ানোর কথা ছিল সেটি যথেষ্ট দ্রুত আসতে পারেনি ওদিকে নিরাপত্তার কারণে জিহাদীদের দ্বিতীয় দলটি যেহেতু তাদের রকেট ও লঞ্চার ইত্যাদি ট্রাভেল ব্যাগের ভিতর রেখে দিয়েছিল, এতো অল্প সময়ের ভিতর তারা ওগুলো ব্যাগ খুলে বের করে ছুঁড়ে মারতে পারেনি। তৃতীয় দলটির সদস্য ছিল একজন। সে ছিল বোমাসজ্জিত গাড়িটির চালক বা সুইসাইড বোমবার। গাড়িটিসহ চালকের যেখানে থাকবার কথা সেখানেই সে ছিল। কিন্তু নীল রঙের টয়োটা ট্রাকটির সামান্য বিলম্বই সব গোলমাল করে দিল। প্রথম দলটির কনভয়ের মূল-লিমুজিনকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। ইথিওপীয়া সরকারের ঐ লিমুজিনেই মোবারকের থাকার কথা ছিল। কিন্তু মোবারক আসলে একটি বিশেষ মার্সিডিজ গাড়িতে ছিলেন। 

এই গাড়িটি তিনি কায়রো থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এনেছিলেন। ওটা শুধু বুলেট প্রুফই ছিল না, আরপিজি রকেটের আঘাত সইবার মতো শক্ত-সমর্থও ছিল। যাই হোক, প্রথম দলটি যখন ভুল গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে চলেছে সে সময় এলো নীল টয়োটা ট্রাক। সামান্য বিলম্বের জন্য ট্রাকটা মোবারকের কনভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকাতে পারেনি। না আটকাতে পেরে ট্রাকের ড্রাইভার এবার সজোরে ধাক্কা লাগানোর চেষ্টা করে লিমুজিনের গায়ে। ধাক্কার হাত থেকে বাঁচবার জন্য গাড়িগুলো যেটা যেদিকে পারল ছুটতে চেষ্টা করল। ওদিকে প্রথম দলটির ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয়ে চলেছে। চারদিকে একটা বিশৃঙ্খল, এলোমেলো অবস্থা। মোবারকের ড্রাইভার বুঝল এমনি এলোমেলো অবস্থার ভিতর দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। তাই সিকিউরিটি প্ল্যান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে সে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে নিল মোবারকের মার্সিডিজ গাড়ি। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগাল বিমানবন্দরের দিকে। এই ভাবে ড্রাইভারের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে রক্ষা পেল মোবারকের জীবন। উল্টোদিকে না ছুটে সামনে এগোলে সম্ভবত বাঁচানো যেত না তাকে। কারণ এ্যামবুশস্থল থেকে আর তিন শ’ফুট দূরেই অপেক্ষা করছিল সুইসাইড বোম্বার- গাড়িবোমা নিয়ে অত্মদানে প্রস্তুত এক মুজাহিদ যোদ্ধা। প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রাণনাশের চেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর অনিবার্য যা ঘটবার কথা অনুমান করে সিরাজ ও তার দলের লোকেরা কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইথিওপীয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিরাপদে খার্তুমে গিয়ে পৌঁছে। মোবারককে যদি হত্যা করা যেতো তাহলে ঐদিনই জিহাদ ও সশস্ত্র যুদ্ধের কার্যক্রম পূর্ণমাত্রায় শুরু করা যেতো মিসরে। মোস্তফা হামজা ঠিক করে রেখেছিলেন যে মোবারক নিহত হবার সবুজ সঙ্কেত পেলেই তিনি মুজাহিদ বাহিনী মিসরে পাঠিয়ে দেবেন। 

এরা মিসরে অনুপ্রবেশ করে নানান রুট ধরে বিভিন্ন শহর-নগরে পৌঁছে স্থানীয় জিহাদী নেটওয়ার্কের সাথে মিলিত হবার পর জিহাদ ও সশস্ত্র সংগ্রামের নজিরবিহীন জোয়ার সৃষ্টি করবে। কিন্তু হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার খবর খার্তুমে পৌঁছলে তুরাবি ও হামজা গোটা অভিযান প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামপন্থীদের কমান্ড সেন্টার গোটা মিসরে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ককে এ্যালার্ট করে দেয়। ফলে মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ধরপাকড় অভিযান শুরু হবার আগেই জিহাদীদের সবাই গা ঢাকা দিতে সক্ষম হয়। মিসরের ইসলামী জিহাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে কায়েকদিন সময় নেয়। শেষে ৪ জুলাই মোবারক হত্যা চেষ্টার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে শেখ ওমর আব্দুর রহমানের সংগঠন আল-জামাহ আল ইসলামিয়া একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় যে ১৯৯৪ সালে মিসরীয় পুলিশের হাতে নিহত এক মুজাহিদ কমান্ডারের হত্যার বদলা নিতে তালাত ইয়াসিন কমান্ডো এই অভিযান চালিয়েছে। মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টি প্রকৃত লোকজনের ওপর যাতে না এসে পড়ে সেজন্যই যে এমন বক্তব্য দেয়া হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

সৌদি আরবে আঘাত হানা শুরু

১৯৯৫ সালের ১৩ নভেম্বর। বেলা ১১টা বেজে ৪০ মিনিট। রিয়াদের মিলিটারি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম ভবনের স্ন্যাকবারে লাঞ্চ করতে বসেছে কয়েক ডজন আমেরিকান। ভবনটা একটা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সৌদি ন্যাশনাল গার্ড-এর সদস্যদের জন্য এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালিয়ে থাকে আমেরিকানরা। তিন তলা ভবনের সামনের দিকে পার্কিং লট। বেশ কয়েকটা গাড়ি আছে সে জায়গায়। ঘড়ির কাঁটা ১১টা ৪০ মিনিটে স্পর্শ করতেই গগণবিদারী এক শব্দে প্রকম্পিত হলো চারদিক। পার্কিং লটে বিষ্ফোরিত হয়েছে একটি গাড়ি বোমা। প্রচন- সে বিস্ফোরণে ভবনের একটা দিক উড়ে গেল। ৪৫ টিরও বেশী গাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। এক মাইল দূরের বাড়ির জানালার কাঁচ ঝনঝন করে ভেঙ্গে গেল। কয়েক মিনিট পর আরো একটি বিস্ফোরণ। সেই একই পার্কিং লটে। তবে এবারেরটা এ্যন্টি পার্সোনেল বোম্ব। প্রাণঘাতী বোমা। প্রথম বিস্ফোরণের পর আহতদের উদ্ধারে যারা ছুটে গিয়েছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন হতাহত হলো দ্বিতীয় বিস্ফোরণে। রিয়াদের কেন্দ্রস্থলে গাড়িবোমা বিস্ফোরণের এই ঘটনাটা নিছক চমক লাগানো জিহাদী  হামলা ছিল না। ছিল তার চেয়েও বেশি কিছু। প্রমাণ হলো যে, সৌদি আরবের অভ্যন্তরে এক ব্যাপকভিত্তিক ও শক্তিশালী ইসলামী জিহাদীদের অন্তর্ঘাতমূলক অবকাঠামোর অস্তিত্ব আছে। জানতে পারা গেল যে, সেই মুজাহিদ বাহিনী তেহরান ও খার্তুমের দ্বারা সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত। এরা মূলত সৌদি আফগান এবং সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর লোকজন নিয়ে গঠিত, যারা দুর্নীতিবাজ আল- সৌদ রাজপরিবারের ওপর বীতশ্রদ্ধ। এরা রাজপরিবারের পতন ঘটানোর জন্য জিহাদ ত্বরান্বিত করতে বদ্ধপরিকর। 

১৩ নভেম্বর রিয়াদের বোমা বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হয়, যার মধ্যে পাঁচজনই আমেরিকান। আহত হয় ৬০ জনেরও বেশি, যার অর্ধেক হলো আমেরিকান। এদের কয়েকজনের অবস্থা ছিল বেশি গুরুতর। আসলে বোমাটা পেতে রাখা হয়েছিল একটা সাদা রঙের ভ্যানগাড়িতে। ২শ’ থেকে সোয়া দু’শ’ পাউন্ডের অতি উচ্চশক্তির বিস্ফোরক দিয়ে  তৈরি ছিল বোমাটা। খুব সম্ভবত চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরি কার্যকর প্লাস্টিকের বিস্ফোরক সেমটেক্স  ছিল বোমার উপাদান। “মিৎসুবিসি ৮১” ভ্যানটি থেকে সূত্র খুঁজে পাওয়ার মতো সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছিল। সব রকম সিরিয়াল নম্বর, এমনকি চেসিসের গা থেকেও সব নম্বর সম্পূর্ণ ঘষে তুলে ফেলা হয়েছিল। অত্যাধুনিক টাইমিং ডিভাইস দিয়ে বোমাটি ফাটানো হয়। সম্ভবত এর সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থাও যুক্ত ছিল। এন্টি-পার্সোনেল বোমাটিও অত্যন্ত নিপুণ ও দক্ষ হাতে বানানো ছিল। তাছাড়া এটি বসানো এবং টাইমিং করার ব্যাপারেও মুনশিয়ানার ছাপ ছিল। বোমাটি আকারে ছোট হলেও এটি তৈরির কাজে এমন সব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে যাতে সম্ভাব্য সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে হতাহত করা যায়। বিস্ফোরণটা যে সময় ঘটানো হয়েছে তা থেকে প্রমাণ হয় যে, এর টার্গেট ছিল আমেরিকানরা। সাধারণত এ সময়ই আমেরিকানরা ভবনের সামনের অংশে স্ন্যাকবারে লাঞ্চ করতে বসত এবং সৌদি ও অন্য মুসলমানরা জোহরের নামাজ পড়ার জন্য যেত নিকটবর্তী মসজিদে। যে সময়টা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল তা থেকে আরও একটা ব্যাপার বুঝা গেছে। তা হলো বোমা ব্যবহারকারী বা ব্যবহারকারীরা ভবনটির ভিতর-বাইরের অনেক কিছুই জানত এবং জায়গাটা দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। 

অভিযানে দু’টো বোমার ব্যবহার থেকে আরও একটা জিনিস বেরিয়ে আসে। গোটা অভিযানের প্রস্তুতির ব্যাপার একধিক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির হাত ছিল। সৌদি সূত্রের এক সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছিল যে, বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনাটি যে মহলেরই হোক না কেন এর টার্গেট নির্বাচনে অতিমাত্রায় সতর্কতা বা সাবধানতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। তেমনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও প্রদর্শন করা হয়েছে অসাধারণ পেশাদারিত্ব মনোভাবের। বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমেরিকান সামরিক বিশেষজ্ঞদের মেরে ফেলা হয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা বা বড় ঘটনা নয়। বড় কথা হলো, বিস্ফোরণের পিছনে যারা রয়েছে তারা বোমা বিস্ফোরণের উন্নত প্রযুক্তি করায়ত্ত করেছে। এবং লক্ষ্য স্থলে পৌঁছার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে গোপনে অনুপ্রবেশ করার সব রকম কলাকৌশল প্রয়োগ করেছে। তাছাড়া বিস্ফোরণের নেপথ্য নায়কদের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধিও অতিশয় প্রখর। রিয়াদ নগরীর কেন্দ্রস্থলে তাদের টার্গেট হিসাবে আমেরিকানদের বেছে নেয়ার উদ্দশ্য ছিল গোটা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমের সর্বাধিক দৃষ্টি কেড়ে নেয়া এবং এক দারুণ রাজনৈতিক হৈ চৈ ফেলে দেয়া। আসলে বিন লাদেনসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী নেতৃবৃন্দ শুধু সৌদি আরবে নয় বরং ঐ অঞ্চলে জিহাদের দ্রুত বিস্তার চাইছিলেন। তাদের সেই পরিকল্পনার অংশ ছিল রিয়াদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি।

 ১৯৯৫ সালের হেমন্তেই গোটা অঞ্চলে ইসলামী জিহাদী তৎপরতার বিস্তার ঘটতে শুরু করেছিল। অক্টোবরের শেষদিকে সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মিসরে। বিশেষ করে সেখানে থানায়, ট্রেনে, ট্যুরিস্ট বাসে নতুন করে হামলা শুরু হয়। কায়রো উত্তরোত্তর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ইসলামী জিহাদী শক্তির মোকাবেলায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নভেম্বরের গোড়ার দিকে মিসর ইসলামী অভ্যুত্থানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় ইরান ও সুদানের স্থির বিশ্বাস জন্মে যে, তারা আরব উপদ্বীপের রক্ষণশীল সরকারগুলোর পতন ঘটাতে পারবে। আর এই পতন ঘটানোর একটা মাত্র উপায় হলো কায়রোকে অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাতে সে এসব রক্ষণশীল সরকারগুলোর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে না পারে। ১৯৯৫ এর নভেম্বর ইরান-সুদানসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, তাদের সেই মহাপকিল্পনার সৌদি অংশটা বাস্তবায়িত করার সময় এসে গেছে। ১৩ নভেম্বর রিয়াদের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি ছিল তারই প্রথম মহড়া।জিহাদী ও সশস্ত্র কার্যকলাপে কোমর বেঁধে নামবার জন্য সৌদি ইসলামী শক্তিসমূহকে নভেম্বরের গোড়াতেই সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়েছিল। রিয়াদ এলাকার ইসলামী নেটওয়ার্কে ছিল সুদক্ষ জিহাদীদের একটা ছোট গ্রুপ। যার বেশির ভাগই ছিল সৌদি আফগান এবং এদের স্থানীয় সমর্থকবৃন্দ। রিয়াদের সেই অভিযানের প্রাক্কালে ইউরোপ ও এশিয়া থেকে আলাদা আলাদাভাবে আরও কিছু দক্ষ জিহাদীকে এনে স্থানীয় নেটওয়ার্কটির শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। এদের সবাই ছিল সৌদি নাগরিক। 

১৩ নভেম্বারের অভিযানে যারা অংশ নিয়েছিল ও যারা সাহায্য করেছিল তারাও ছিল সৌদি নাগরিক। এদের অনেকেই ছিল রাজতন্ত্রের ওপর বীতশ্রদ্ধ, বিক্ষুব্ধ একশ্রেণীর তরুণ সৌদি, যারা আফগানিস্তানে ট্রেনিং পেয়েছিল। সে সময় র‌্যাডিকেল ইসলামপন্থীদের বিরোধী সৌদি সূত্রে বলা হয় যে, সিআইএ ও আইএসআই এর হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সুদক্ষ সৌদি বোমা প্রস্তুতকারকরা এখন মধ্যপ্রাচ্য ও বসনিয়ায় জিহাদী নেটওয়ার্ককে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রদান করছে এবং সেই নেটওয়ার্কেরই একটা অংশ রিয়দে বোমা ফাটিয়েছে। বিস্ফোণের প্রতিক্রিয়া যা হবার তাই হয়েছিল। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কারোর অসুবিধা হয়নি। উপসাগরীয় দেশগুলোর পত্রপত্রিকায়ও তার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটা সৌদি আরব তথা গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়িফ বিন আব্দুল আজিজও ঘরোয়াভাবে স্বীকার করেছিলেন যে, এই বিস্ফোরণ এক ‘বিপজ্জনক মহামারী’র অংশ। কিন্তু সৌদি সরকার দেখাতে চাইল যে, বিস্ফোরণের লক্ষ্য তৃতীয় পক্ষ তথা আমেরিকানরা; সৌদি রাজতন্ত্র নয়। আর এভাবেই সরকার সৌদি আরবের মাটিতে ইসলামী জিহাদের মূল কারণগুলোর মোকাবালা করতে রাজি হলো না। প্রতিরক্ষা দফতর ও প্রিন্স সুলতানের মুখপাত্র বলে পরিচিত ‘আল হায়াহ’ পত্রিকায় সেই মনোভাব ব্যক্ত করে পরিষ্কার বলা হলো যে, এই বিস্ফোরণ বিদেশীদের কাজ। এর সঙ্গে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ কোন শক্তির সংস্রব নেই। 

সৌদি আরবে জিহাদ বিস্তার-১

রিয়াদে জিহাদী হামলার ঘটনার অনুপযোগী বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ মহলের আর কোন সন্দেহ থাকেনি যে আল- সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদীদের জিহাদ শুরুর ব্যাপারে এতদিন যা ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল এখন তার বাস্তব প্রয়োগ শুরু হলো মাত্র। এ ক্ষেত্রে টার্গেট নির্বাচনই হলো তার প্রমাণ। আঘাত হানা হলো একটি মার্কিন সামরিক স্থাপনায়, যেখানে চরম ঘৃণিত রয়াল গার্ডকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। এতোদিনের ঘোষিত হুঁশিয়ারি আর টার্গেট নির্বাচনের মধ্যে এমন সমন্বয় ছিল যে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি এটা ইসলামী জিহাদীদের কাজ। এর জন্য কোন ঘোষণা দিতে বা লিফলেট ছাড়তে হয়নি। ইসলামী জিহাদীরা ১৯৯৫ সালের এপ্রিল মাসেই সৌদি রাজশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল। ১০ এপ্রিল ইসলামিক চেঞ্জ মুভমেন্টের নামে দেয়া এক ইশতিহারে গোটা আরব উপদ্বীপে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী এবং সেই সঙ্গে অল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে আসন্ন সশস্ত্র হামলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করে দেয়া হয়েছিল। 

ইশতেহারে পাশ্চাত্য বাহিনীকে ১৯৯৫ সালের ২৮ জুনের মধ্যে আরব উপদ্বীপ ত্যাগের শেষ সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়েছিল, অন্যথায় ঐ তারিখ থেকে তাদের ওপর আঘাত হানা হবে। ওতে অভিযোগ করা হয় যে, সৌদি রাজপরিবার ইসলামকে ক্রুসেডের শক্তির সেবায় নিয়োজিত করেছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় হলো এই যে, এই ইশতেহারে ব্যবহৃত অনেক শব্দই পরবর্তীকালে বিন লাদেনকে তার বিভিন্ন ডিক্রী ও ফতোয়ায় ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তাছাড়া রিয়াদে বোমা বিস্ফোরণের স্টাইল এবং তাতে ব্যবহৃত উচ্চ শক্তির বিস্ফোরক ও ফিউজের প্রকৃতি দেখে বোঝা যায় যে, পাকিস্তান ও সুদানে ইসলামী জিহাদী প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে ঠিক এ ধরনের অত্যাধুনিক বোমা তৈরি, সেগুলো কোথায় কিভাবে বসাতে হয় এবং কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটাতে হয় সেই কৌশলগুলো শিখানো হয়েছিল। এসব শিবিরে ট্রেনিং নিয়েই বিন লাদেনের সৌদি অনুসারীরা ১৯৯৫ এর গ্রীষ্মে একের পর এক চমক লাগানো অভিযান চালাতে শুরু করে। তার আগে হাসান আল তুরাবির সুপারিশক্রমে বিন লাদেন ও সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামী নেতৃত্ব আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে সশস্ত্র জিহাদে রূপান্তরিত করে। এ কাজে সাহায্যের জন্য ইরানী গোয়েন্দা সংস্থা গোটা সৌদি আরবে সম্ভাব্য টার্গেট হিসাবে বেশ কিছু মার্কিন স্থাপনার ওপর নজরদারির এক দুঃসাহসিক কার্যক্রম নেয়। এই কার্যক্রম দেড় থেকে দু’বছর ধরে চলেছিল। রিয়াদের মিলিটারি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম ভবন এবং খোবার টাওয়ার্সও (১৯৯৬ এর গ্রীষ্মে হামলা হয়) ছিল এই কার্যক্রমের আওতাভুক্ত।

 ১৩ নভেম্বর রিয়াদের মিলিটারি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম ভবনে বোমা অভিযানের প্রস্তুতি ছিল সর্বাত্মক। তাও এই প্রস্তুতির কিছু কিছু খবর ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। পদস্থ সৌদি কর্মকর্তারা পরে স্বীকার করেন যে বিস্ফোরণের প্রায় এক সপ্তাহ আগে রিযাদ কর্তৃপক্ষকে আসন্ন জিহাদী হমালা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল। বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ আগে ইসলামীক চেঞ্জ মুভমেন্ট রিয়াদে মার্কিন ও ব্রিটিশ দূতাবাস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হুঁশিয়ারিসূচক ফ্যাক্সবার্তা পাঠায়। সৌদি ও পাশ্চাত্যে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এসব হুঁশিয়ারিকে তেমন আমলে দেয়নি। সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীকেও মোটেই এ্যালার্ট রাখা হয়নি। তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা, রিয়াদের গভর্নর প্রিন্স সালমান বিন আব্দুল আজিজ জেনেশুনেই এই জিহাদী অভিযানটি ঘটতে দিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত ফায়দা লুটার জন্যই। প্রিন্স সালমান বাদশাহ ফাহাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। ইসলামী জিহাদ দমন করার যোগ্যতা ও সামর্থ্য দুটোই তাঁর আছে এমন একটা সুনাম তাঁর ছিল। অন্যদিকে ইসলামী জিহাদীদের ক্রমবর্ধমান হুমকিতে গোটা আল-সৌদ রাজপরিবার ছিল আতঙ্কিত। কুশলী প্রিন্স সালমান এই দুটো বিষয়কে তাঁর ক্ষমতায় যাওয়ার এবং সকলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের টিকিট হিসাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা এঁটেছিলেন। শোনা যায় ১৯৯৪ সালের শুরুতে প্রিন্স সালামান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি দেখাশোনার জন্য বাদাশাহ ফাহাদের ব্যক্তিগত ম্যান্ডেট লাভ করেছিলেন। 

সৌদি আরবে জিহাদ বিস্তার-২

১৯৯৫ সালের শরতে ইসলামী জিহাদীদের সঙ্গে প্রিন্স সালমানের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। লন্ডনভিত্তিক সৌদি ইসলামী সংগঠন কমিটি ফর দ্য ডিফেন্স অব লেজিটিমেট রাইটস এর মোহাম্মদ আল মাসারি প্রিন্স সালমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ইনি আল-সৌদ পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও খোলামনা। কিন্তু তাঁর মতো ভন্ড আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলামী জিহাদীদের সঙ্গে তার মাখামাখির ব্যাপারটা লোকদেখানো মাত্র। তার প্রকৃত লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকা। সৌদিদের অনেকের মধ্যে এমন গুজবও ছড়িয়েছিল যে প্রিন্স সালমান ইচ্ছা করেই ঐ বিস্ফোরণ ঘটতে দিয়েছিলেন যাতে রাজপরিবারের ওপর মহলে ইসলামী জিহাদের ভীতি বৃদ্ধি পায় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে জিহাদ দমনের জন্য তারা তাকে ক্ষমতায় বসায়। তবে আল-সৌদ রাজপরিবারের শীর্ষস্থানীয় একটি মহল ১৩ নভেম্বরের বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার প্রকৃত তদন্ত ধামাচাপা দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কারণ সত্যিকারের তদন্ত হলে সৌদি গোয়েন্দা বাহিনীর এক বড় ধরনের ব্যর্থতাই প্রকাশ হয়ে পড়ত। সেই ব্যর্থতার প্রধান বিষয় ছিল একটা গোপন চুক্তি। সৌদি-পাকিস্তান সেই চুক্তির আয়োজক ছিলেন সৌদি গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল। 

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসের সেই চুক্তিতে ঠিক হয় যে, আইএসআই পাকিস্তান-আফগানিস্তানে ট্রেনিং ও আশ্রয় নেয়া সৌদি জিহাদীদের রাস টেনে ধরবে। বিনিময়ে সৌদি আরব পাকিস্তানকে বিপুল অঙ্কের সাহায্য দেবে এবং ওয়াশিংটনের কাছে পাকিস্তানের হয়ে ওকালতি করবে। বাস্তবে যা ঘটেছে, রিয়াদের উপলব্ধি অনুযায়ী তা হলো- আইএসআই ঠিকই সৌদি অর্থ নিয়েছে আবার একই সঙ্গে সৌদি জিহাদীরা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সুদান ও ইরানে ট্রেনিং ও অন্যান্য সাহায্যও লাভ করেছে।১৩ নভেম্বরের বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে ওসামা বিন লাদেন ও সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামীরা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলো সৌদি আরবে যে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করে সেখান থেকে তাদের আর পিছু হটার উপায় ছিল না। ঘটনাটা রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বার পথে যতই কম্পন  সৃষ্টি করুক এতে সমাজের বাকি জনগোষ্ঠীর কাছে সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামীদের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। রিয়াদের ঐ বিস্ফোরণের অল্পদিন পরই সৌদি আরবের অভ্যন্তরে জিহাদী অভিযান বিস্তারের খবর পাওয়া যায়।

 ২০ থেকে ২৫ নভেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে দু’টো বড় ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক অভিযানের চেষ্টা অল্পের জন্য সফল হতে পারেনি। প্রতিরক্ষা দফতর ভবনের সামনে একটি গাড়িবোমা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। আরেকটি গাড়ি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয় পেট্রোমিন অয়েল কোম্পানির পার্কিং লটে। বোমা দু’টো ১৩ নভেম্বর বিস্ফোরিত বোমার অনুরূপ হলেও অভিন্ন ছিল না। তা থেকে বোঝা যায় যে রিয়াদে অতি উন্নত ট্রেনিং পাওয়া বোমা প্রস্তুতকারক একজন ছিল না, ছিল একাধিক এবং এরা সবাই একই ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আসন্ন হামলা সম্পর্কে আবার হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দূতাবাস এবার ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়। ওদিকে তেহরান ও খার্তুমের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতার ফলে সৌদি ইসলামী শক্তিসমূহ আকারে ও ক্ষমতায় ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে এবং দেশজুড়ে বাড়তে থাকে জিহাদী হামলার আশঙ্কা। 

রিয়াদ থেকে এবার ইসলামাবাদ


রিয়াদে ১৩ নভেম্বরের বোমা বিস্ফোরণের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই মিসরীয় “আফগান” বা ইসলামী জিহাদীরা জানান দিয়ে দিল যে তারাও কিছুমাত্র কম যায় না। দিনটা ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর। সকাল ৯টা বেজে ৫০ মিনিট। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে মিসরীয় দূতাবাসের গেট সজোরে ধাক্কা মেরে ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করল দ্রুতগতির একটি ছোট্ট গাড়ি। এর পরপরই ঘটল ছোটখাটো এক বিস্ফোরণ। সামনের রিসেপশন এলাকা যেখানে ভিসা সংগ্রহ ও অন্যান্য কাজের জন্য লোকজন জড়ো হয়েছিল সেখানেই ঘটল বিস্ফোরণটি। ঐ ছোট গাড়ি থেকে ছুড়ে দেয়া একটা হ্যান্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ছিল ওটা। দূতাবাস প্রাঙ্গণে ভয়ার্ত লোকজন যখন ছোটাছুটি করছে সেই গোলমেলে অবস্থার সুযোগে এবার ভাঙ্গা গেট দিয়ে ভিতরে ছুটে এলো নীল রঙের একটা ডাবল কেবিন মাজদা পিকআপ ভ্যান। এসেই প্রচন্ড গতিতে ছুটে মূল ভবনের সামনের অংশে সজোরে আছড়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘটল আরেকটা বিস্ফোরণ। তবে এবারের বিস্ফোরণের ভয়াবহাতা বা প্রচন্ডটা ছিল এমন যে মুহূর্তের মধ্যে দূতাবাস প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হলো ২০ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট গভীর একটা গর্ত। 

মারা গেল ভ্যানের ড্রাইভারসহ ১৯ জন। আহতের সংখ্যা ষাটের অধিক। দু’টো বিস্ফোরণ ছিল এক ও অভিন্ন পরিকল্পনার অংশ। প্রথমে ছোট বিস্ফোরণটা পরবর্তী মূল বিস্ফোরণের পথ প্রসস্ত করার জন্য ঘটানো হয়েছিল যাতে সকলের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। দ্বিতীয় গাড়িটি অর্থাৎ মাজদা পিকআপ ভ্যানটিতে যে উচ্চশক্তির বিস্ফোরক ছিল সম্ভবত তা হবে ন’শ’ পাউন্ড ওজনের। দু’টো আক্রমণই সুইসাইড বোম্বার, মানে আত্মোৎসর্গী যোদ্ধার দ্বারা পরিচালিত হয়। বিস্ফোরণের অল্পক্ষণ পরেই মিসরের প্রধান তিনটি ইসলামী সংগঠন আল-জামাহ আল ইসলামিয়া, আল-জিহাদ আল-ইসলামী এবং ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস গ্রুপ ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে। একাধিক সংগঠনের এমন দাবি করার উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ছিল বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে শত্রুপক্ষকে বোকা বানানো। তবে উল্লিখিত তিনটি সংগঠনই ছিল আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট (অওগ) এর অঙ্গ সংগঠন। শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে ইসলামিক জিহাদ এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সংগঠনের দুই সদস্য ইসাম আল কামারি ও ইব্রাহিম সালামাহ এতে আত্মদান করেছে। -------চলবে।

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৩)

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে ফিলিপিন্স পুলিশ ম্যানিলার শহরতলিতে ইসলামী জিহাদীদের আরেকটি “সেল” ভেঙ্গে দেয়। এরা প্রধানত ছিল আরব “আফগান”। এভাবে বড় ধরণের কোন অভিযান পরিচালনা করতে পারার আগেই স্রেফ দুর্ভাগ্যবশত ফিলিপিন্স নেটওয়ার্কটি ধসে পড়ে। এ অবস্থায় লাদেন ফিলিপিন্স অভিযানকে পিছনে রেখে জিহাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য এবার পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্য।

করাচী- বিন লাদেনের আরেক কেন্দ্র

ইসলামী জিহাদীরা নব উদ্যমে আঘাত হানার জন্য ভিতরে ভিতরে যে শাণ দিচ্ছে কিছু কিছু দেশের গোয়েন্দা সংস্থা একেবারে টের পায়নি এমন নয়। বাতাসে এমন ঘ্রাণ পেয়েছিলেন সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধান শাহাজাদা তুর্কি বিন ফয়সলও। সম্ভাব্য জিহাদী হামলারোধে তিনি জরুরী কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেন।  সৌদি আরবের সতর্কতা অবশ্য ওর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাদশাহ ফাহাদের নির্দেশে শাহাজাদা তুর্কি ১৯৯৫ সালের মার্চের প্রথমদিকে পাকিস্তানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর সঙ্গে সরাসরি এসব প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, সৌদি “আফগান”রা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের ভিতরে-বাইরে যেভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে সেটা সবিশেষ উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন “গোটা ইসলামী জিহাদী অবকাঠামোর চাবিকাঠি হলো পাকিস্তান। কারণ, আফগানিস্তানে জিহাদ প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো এখনও আইএসআই নিয়ন্ত্রণ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, হরকত-উল-আনসারের পতাকা তলে বিদেশে জিহাদ পুনরুজ্জীবনের জন্য জোর সাংগঠনিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 
 এই হরকত-উল-আনসার ও আইএসআই-এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আছে।” শাহাজাদা তুর্কি একটা সমঝোতার প্রস্তাব দিলেন বেনজীরকে। বললেন যে, আইএসআইকে দিয়ে এই ইসলামী জিহাদীদের বিশেষ করে সৌদি আফগানদের রাস টেনে ধরতে হবে, বিনিময়ে সৌদি আরব উদার হস্তে পাকিস্তানকে অর্থিক সাহায্য করা ছাড়াও পাকিস্তানী স্বার্থের পক্ষে ওয়াশিংটনের কাছে লবিং করবে। সোজা কথায় পাকিস্তানের প্রতি সুর নরম করার বিশেষ করে প্রেসলার সংশোধনী বাতিল করার জন্য ওয়াশিংটনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানের লাগামহীন পারমাণবিক কর্মসূচীর কারণে সে সময় প্রেসলার সংশোনীর নামে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সব ধরণের সামরিক সাহায্যদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। বেনজীর ভুট্টো রিয়াদকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। রিয়াদও ১৯৯৫-এর এপ্রিলে বেনজীরের যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে পাকিস্তানের পক্ষে জোর লবিং করেছিল। শাহাজাদা তুর্কির বিশেষ প্রতিনিধি এ সময় বারকয়েক ইসলামাবাদে গিয়ে সিনিয়র আইএসআই অফিসারদের সঙ্গে কথাও বলেন। কিন্তু বেনজীরের দিক থেকে সহযোগিতার অঙ্গীকার থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সৌদি আরবের অনুরোধ পুরোপুরি রক্ষা করতে পারেনি। এদিকে মার্চের শেষ দিক থেকে এপ্রিলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত খার্তুমে আবার অনুষ্ঠিত হয় পপুলার এ্যরাব এ্যান্ড ইসলামিক কনফারেন্স যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে উসামা বিন লাদেনও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে পাকিস্তান পরিস্থিতি জিহাদপন্থী নেতাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আইএসআই প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সমস্যা এবং অন্যদিকে সৌদি আরবের আকর্ষণীয় অফারের কথা উল্লেখ করেন।

 জিহাদপন্থী নেতারা পাকিস্তান-মার্কিন বিরোধকে তাদের সার্থে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তারা বেনজির ভুট্টোর সরকারের সঙ্গে সহযোগীতা আরো বাড়িয়ে দেবার অঙ্গিকার করেন। বিনিময়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী আন্দোলনে গোপনে অর্থ সংস্থানের কেন্দ্র হিসাবে করাচীকে আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সুযোগ দিতে রাজি হয়। ঠিক হয় যে আর্থিক লেনদেনের এই নতুন কেন্দ্রটি চালাবেন বিন লাদেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জিহাদী নেটওয়ার্কের কাছে নগদ অর্থ গোপনে পৌঁছে দিবে এই কেন্দ্র। এটি মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু পাকিস্তানী ভূস্বামী, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীর সাথে যুক্ত থাকবে। যাতে করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের কন্ট্রাক্টগুলোকে কাজে লাগানো যায়। এ কেন্দ্রের সঙ্গে যে ওসামা বিন লাদেন জড়িত তা অনেকেরই বহুদিন জানা ছিল না।

টার্গেট এবার সৌদি রাজতন্ত্র

১৯৯৫ সালে মিশর ও সৌদি আরব সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদীদের বিরামহীন ও নিরলস প্রচারাভিযান শুরু হয়। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে চলে চরম সহিংসতা ও ধামাকার কিছু ক্ষণস্থায়ী কার্যকলাপ। সামগ্রিকভাবে এসবের প্রভাব এই দুই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিরি ওপরও এসে পড়ে। ১৯৯৫ সালে এসব ঘটনা চলাকালে ওসামা বিন লাদেন বিশিষ্ট র‌্যাডিকেল ইসলামী নেতা হিসাবে নিজের আসন সুসংহত করে তোলেন। ১৯৯৫ সালের শুরুতে ওসামা বিন লাদেন খার্তুমে তুরাবির আর্মড ইসলামীস্ট মুভমেন্টের হাইকমান্ডের সদস্য হিসাবে কাজ করছিলেন। যে সমান্য ক’জন বিশ্বাসভাজনকে নিয়ে তুরাবির নিজস্ব একটি কোটাবি ছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর মতামত ও পরামর্শ চাওয়া হতো। তুরাবির ইনার সার্কেলের একজন হিসাবে লাদেন আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই মিত্র মিসর ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আর তুরাবির ছায়া তলে থাকা অবস্থায় লাদেন ইসলামী আন্তর্জাতিক জিহাদী আন্দোলনের ক্ষমতার কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইসলামী জিহাদের নেতৃত্বের কাতারে অন্যরাও উঠে আসছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে বলতে হয় আইমান আল-জাওয়াহিরি ও তার অধীনস্থ মিসরের সিনিয়র জিহাদী কমান্ডারদের নাম।

 ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে জাওয়াহিরি হয়ে দাঁড়ান বিন লাদেনের প্রধান জিহাদী কমান্ডার।র‌্যাডিকেল ইসলামী নেতারা সৌদি আরবে জিহাদী অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই কারণে যে, তাঁরা স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন সৌদি আরবে এই ধরনের একটা জোয়ার সৃষ্টির অনুকূল অবস্থা বিরাজ  করছে। আর মিসরের বেলায় তাঁদের এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ হলো তাঁরা জানতেন যে, মিসরকে অন্য কোনভাবে ব্যতিব্যস্ত না রাখা গেলে মিসর সরকার জিহাদপন্থী ইসলামীদের কার্যক্রম, আক্রমণ বা ধামাকার মুখে সৌদি আরব বা অপর কোন রক্ষণশীল আরব সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য হস্তক্ষেপ করে বসতে পারে। সৌদি আরবে জিহাদের বিস্তার আসলে ছিল সৌদি সমাজের অভ্যন্তরে তীব্র হয়ে ওঠা এক সঙ্কটের প্রত্যক্ষ ফল এবং সঙ্কটের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে ছিল অহিংস। উত্তরাধিকার ও রাজতন্ত্রের শাসনের বৈধতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এই সঙ্কট এমন এক বিন্দুতে পৌঁছে যখন র‌্যাডিকেল ইসলামীরা স্বশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

 ১৯৯৪ সালে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি স্বনামধন্য ইসলামী আদর্শ প্রচারক শেখ সালমান-বিন-ফাহাদ আল-উদাহর গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের শুরু। শেখ উদাহ হচ্ছেন একজন তরুণ জনপ্রিয় নেতা, যিনি বেদুইন সমাজ থেকে উঠে এসে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এবং মোটামুাটি ভাবে সকল সৌদি নাগরিকের আস্থা ও সমর্থন পেয়েছিলেন। আসলে এ ধরনের নেতা শেখ উদাহ একা ছিলেন না, আরও অনেকেই ছিলেন। এঁরা বিন লাদেনের জেনারেশনের সঙ্গে গড়ে উঠেছিলেন। এঁরা আফগান যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। ইসলামী জিহাদীদের এক গোপন নেটওয়ার্কের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত ছিলেন।

 ১৯৯৪ সালের মধ্যে এই ইসলামী জিহাদীরা এবং অন্যান্য আরব ও ফিলিস্তিনী জিহাদী সংগঠন একদিকে সৌদি গুপ্ত পুলিশের সার্বক্ষণিক হুমকির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার এবং অন্যদিকে আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জিহাদী সেলগুলোর এক শিথিল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। ওসামা বিন লাদেনও ছিলেন সৌদি আরবের তৃণমুল ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা। আফগানিস্তানে মুজাহিদ নেতা হিসাবেও তাঁর অতুলনীয় ভূমিকা ছিল। সেই ভূমিকা সবারই জানা ছিলো। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। তাঁর লিখিত ও টেপ রেকর্ড করা বক্তৃতামালা গোপন ইসলামী সংগঠনগুলো সৌদি আরব জুড়ে বিলি-বন্টন করে। নীতির প্রশ্নে তাকে ব্যক্তিগতভাবে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সম্পদ হারিয়েছেন। নির্বাসিত জীবনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এসব বিষয় তাঁর মর্যাদা, তাঁর ভাবমূর্তি বাড়ার সহায়ক হয়েছে। সুদানে নির্বাসিত থাকাকালেও বিন লাদেন সৌদি আরবের ইসলামী জিহাদীদের পরিত্যাগ করেননি। বরং নানাভাবেই তাদের সাহায্যের ব্যবস্থা করেছেন। 

তৃণমূল পর্যায়ের নেতা শেখ উদাহের গ্রেফতার সৌদি সমাজের অভ্যন্তরে বেশ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। গ্রেফতারের কয়েকদিন পর সৌদি আরবের অভ্যন্তরে ব্রিগেড অব ফেইথ নামে একটি ইসলামী জিহাদী সংগঠন প্রথম ইশতেহার ছাড়ে। তাতে সৌদি সরকারের উদ্দেশ্যে চরমপত্র ঘোষণা করে বলা হয় যে, পাঁচ দিনের মধ্যে শেখ উদাহকে মুক্তি দেয়া না হলে এই সংগঠন সৌদি ও আমেরিকানদের বিরুদ্ধে জিহাদ অভিযান শুরু করবে। ইশতেহারে বলা হয়, “গোটা আরব উপদ্বীপ আমাদের জিহাদী তৎপরতার জন্য মুক্তাঙ্গনে পরিণত হয়েছে।” শেখ উদাহ নিজেও এই সশস্ত্র জিহাদ অনুমোদন করেছিলেন।

 ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে জেলে থাকা অবস্থাতেও শেখ উদাহ আল-সৌদ রাজপরিবারের শাসকদের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদীদের বিক্ষোভ জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে বাণী বদ্ধ টেপ গোপনে জেল থেকে বাইরে পাচার করেন। এমনি একটি টেপে সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদও ঘোষণা করা হয়। এমনি হাজার হাজার বেআইনী ক্যাসেট গোপনে গোটা  সৌদি আরবে বিলি করা হয়।

 ১৯৯৫ সালের ১০ এপ্রিল “ইসলামিস্ট চেঞ্জ মুভমেন্ট” নামে আরেক ইসলামী জিহাদী সংগঠন আরব উপদ্বীপজুড়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং সেই সঙ্গে আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে আসন্ন সশস্ত্র হামলা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়। ইশতিহারে পাশ্চাত্য বাহিনীকে ১৯৯৫ সালের ২৮ জুনের মধ্যে আরব উপদ্বীপ ত্যাগের শেষ সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয়, অন্যথায় এ তারিখ থেকে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী জিহাদের ন্যায়সঙ্গত টার্গেট হয়ে দাঁড়াবে। ইশতেহারে অভিযোগ করা হয় যে, সৌদি রাজপরিবার ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্রুসেডের শক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়েছে, যার প্রমাণ হলো ইসলামের বিশিষ্ট প্রচারক ও শিক্ষকদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সৌদি আরবের ইসলামী জিহাদী শক্তিগুলো সৌদি শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করার জন্য জিহাদ শুরু করাকেই একমাত্র সম্ভাব্য পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এই হুমকিটা নিছক কাগুজে হুমকি ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার যোদ্ধার এক ইসলামী মুজাহিদ বাহিনী গড়ে উঠেছিল সৌদি আরবে। তার ওপর ছিল আফগান যুদ্ধ প্রত্যাগত ৫ হাজারের ওপর সৌদি মুজাহিদ, যারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও অস্ত্রসজ্জিত হয়েছিল ইরান, সুদান, ইয়েমেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। এছাড়া সৌদি আরবের অভ্যন্তরে এক বিশাল ইসলামী আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক এই সৌদি মুজাহিদদের সমর্থন করার জন্য পস্তুত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলামী জিহাদীরা তাদের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। কেন, সে প্রসঙ্গ পরবর্তী পর্বে আলোচিত হবে। 

হোসনী মোবারককে হত্যার চক্রান্তে বিন লাদেনও ছিলেন

১৯৯৫ সালের জুন মাসের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী নেতারা আরও বড় ধরণের এক অভিযান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আর সে অভিযান হলো মিসরের বিরুদ্ধে। নিরাপত্তার কারণেই সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামীরা আগে থেকে এ অভিযান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। যে কোন আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলনকে জানাজানি হয়ে পড়ার, ধরা পড়ার, নির্যাতন ও বিশ্বাসঘাতকতার হুমকির মধ্য দিয়ে চলতে হয়। তাই এক জিহাদী গ্রুপের পরিকল্পিত অভিযান অপর জিহাদী গ্রুপ আগে থেকে জানতে পারে না। জানা সম্ভবও নয়। খার্তুম ও তেহরান থেকে সৌদি জিহাদীদের শুধু জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, তাদের রাজতন্ত্রবিরোধী অভিযানে আপাতত ক্ষান্ত হতে হবে। জিহাদী ব্যবস্থার কঠোর শৃঙ্খলার কারণে সৌদিরা বিনা বাক্যব্যয়ে সে নির্দেশ পালন করেছিল।

 ১৯৯৫ সালের ২৬ জুন ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মেবারকের প্রাণনাশের চেষ্টা চালানো হয়। প্রেসিডেন্ট মোবারক প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা মিসরে ইসলামী জিহাদ প্রভাবিত যে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল, সেটাও বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তথাপি ঘটনাটি আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে। এবং গোটা অঞ্চলে ইসলামী জিহাদের জোয়ার সৃষ্টিতে বড় ধরনের প্রেরণা যোগায়। মিসরের ইসলামী জিহাদীরা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলো হোসনী মোবারককে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিল। 

১৯৮১ সালে তাঁর পূর্বসূরি আনোয়ার সাদাত ইসলামী জিহাদীদের হাতে নিহত হন। তারা আশা করেছিল এই হত্যার ফলে সরকারের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে এবং ইসলামী শক্তিগুলোর অভ্যুত্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু তা হয়নি হোসনী মোবারকের কারণে। তিনি শুধু সরকারকে স্থিতিশীলতাই দেননি, উপরন্তু ইসলামী জিহাদীদের ওপর হিংসাত্মক দমন-নিপীড়নও চালিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মিসর ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি রক্ষাই শুধু করেনি, উপসাগর যুদ্ধে বহুজাতিক বাহিনীর পক্ষে বলিষ্ঠভাবেও দাঁড়িয়েছিল। তদুপরি মোবারক বার বার বলেছিলেন যে,র‌্যাডিকেল ইসলামীদের চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি যে কোন রক্ষণশীল আরব সরকারকে সমর্থন দিতে বদ্ধপরিকর। এর জন্য যদি মিসরীয় সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রয়োজন হয় তা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হবেন না। সুতরাং হোসনী মোবারককে মেরে ফেললে নানা দিক দিয়ে লাভ হতে পারত ইসলামী জিহাদীদের।আদ্দিসে আবাবায় মোবারকের প্রাণনাশের চেষ্টাটি ছিল ইসলামী জিহাদী আন্দোলন এবং পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের দীর্ঘ আলোচনার ফল। ওসামা বিন লাদেন এসব আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। আক্রমণটা যদিও চালিয়েছিল শেখ ওমর আব্দুর রহমানের সংগঠন আল জামাহ আল ইসলামীয়া। তথাপি গোটা অভিযানটি প্রকৃতপক্ষে ছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফসল। এবং তার মধ্যে তুরাবির সুদানের অবস্থান ছিল সর্বাগ্রে। সমগ্র মিসরে ইসলামী সশস্ত্র সংগ্রামের সার্বিক বিস্তারে সুদান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।

১৯৯৪ সালের শরতের শুরু থেকেই তেহরান, খার্তুম এবং আর্মড ইসলামিক মুভমেন্টের  নেতৃবৃন্দকে বার বার প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারকের হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায়। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে মোবারকের ইতালি সফরের সময় তাকে হত্যা করার জন্য ইতালি এবং বসনিয়া-হারজেগোভিনায় ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্ককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ইতালিতে ইসলামী নেটওয়ার্কের ওপর পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজর থাকায় ষড়যন্ত্রটা ফাঁস হয়ে যায় এবং সেটা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। এরপর খার্তুমের নির্দেশে মোবারককে হত্যা এবং ইসলামীদের গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য খোদ মিসরের একটি ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্কের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়।

 ১৯৯৫ এর জানুয়ারীর প্রথম তিন সপ্তাহে নেটওয়ার্কের সদস্যরা মোবারককে হত্যার জন্য তিন তিনবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ধরা পড়ার ভয়ে জিহাদী দলের প্রধান নেতারা অন্যান্য আরব দেশ হয়ে সুদানে পালিয়ে যায়। মিসরের অন্যান্য ইসলামী সংগঠন, যাদের সঙ্গে এই হত্যা প্রচেষ্টার কোন রকম সংস্রব ছিলনা তাদের ওপর মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নির্মম আঘাত এসে পড়ে। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার এমনি একের পর এক চেষ্টা চলছে এটা প্রকাশ হয়ে গেলে সরকারের স্থিতিশীলতা ক্ষুণ হবে আশঙ্কা করে কায়রো গোটা ব্যাপারটাই চেপে গিয়েছিল। ওদিকে মিসরীয় জিহাদীরা সুদানে পালিয়ে আসার পর আর্মড ইসলামীক মুভমেন্টের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এবং ইরানের প্রতি গোয়েন্দা বিশেজ্ঞরা  প্রেসিডেন্ট মোরাককে হত্যার চেষ্টা কেন বা কোন ত্রুটির কারণে বার বার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখেন। ইরানী বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন যে, মিসরের ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরে সরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন চুপিসারে ঢুকে পড়েছে। তাই আগে থেকে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তাদের পরিকল্পনা। এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও একইভাবে ফাঁস হতে বাধ্য। সুতরাং ভবিষ্যত অভিযানে (মোবারক হত্যা) সর্বোচ্চ মাপের জিহাদী নেটওয়ার্ক কাজে লাগাতে হবে এবং দ্বিতীয়ত সেই অভিযান মিসরের ভিতরে হলে চলবেনা। বাইরে হতে হবে। কারণ স্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোকে আর পুরোপুরি বিশ্বাস করা চলে না। এসব অভিমত পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে তুরাবি পরবর্তী কৌশল নির্ধারণের আগে বিষয়টি নিয়ে মিসরের ইসলামী জিহাদী বাহিনীগুলোর বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেন। 

এ উদ্দেশ্যে তুরাবি ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে খার্তুমে তিন শীর্ষ মিসরীয় কমান্ডার ডাঃ আইমান আল জাওয়াহিরি (আল-জিহাদ), মোস্তফা হামজা (আল-জামাহ আল ইসলামিয়া) এবং রিফাই আহমদ তহা (আল জামাহ আল ইসলামিয়া) এর সঙ্গে আলোচনার জন্য জরুরী বৈঠক ডাকেন। এই তিন নেতার মধ্যে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তারা ঠিকই তুরাবির এ জরুরী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মিসরে ইসলামী বিপ্লব শুরু করার পথে সমস্যা ও অন্তরায়, এর সার্বিক দিক, এমনকি কৌশল পরিবর্তনের বিষয়টিও পর্যালোচনা করে দেখা হয়। তুরাবির সঙ্গে এই তিন কমান্ডারের বৈঠকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে হত্যা করার জন্য এক বড় ধরনের অভিযান চালানোর বিষয়টিও উত্থাপিত হয়। মিসরীয় কমান্ডাররা একমত হন যে মোবারককে হত্যা করার পরিণতিতে যদি মিসরে বড় ধরনের ইসলামী গণঅভ্যুত্থান ঘটে এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ইসলামী জিহাদী অভিযান জোরদার হয় তাহলে সেটা হবে এক অসাধারণ ঘটনা। কিন্তু সেই হত্যা অভিযান চালানো হবে কিনা সে প্রশ্নে তারা নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে ব্যাপারটা তুরাবির হাতে ছেড়ে দেয়। তুরাবি তখন এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে খাতুর্মে অনুষ্ঠিত পপুলার এ্যারাব এ্যান্ড ইসলামিক কনফারেন্স এর অধিবেশনে প্রসঙ্গটি তোলেন। 

সেই বৈঠকে তুরাবি, ওসামা বিন লাদেন ও সুদানি গোয়েন্দা সংস্থার মোস্তফা ইসমাইল ও ওসমানকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। তা ছাড়া হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনী ইসলামিক জিহাদ, হামাস প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও ঠৈকে মতবিনিময় করা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা মিসরের বাইরে প্রেসিডেন্ট মোবারককে হত্যার সম্ভাব্য সব দিক নিয়ে আলোচনা করে এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত প্রদান করেন। তারা বলেন, মোবারককে হত্যার এবং সেই সঙ্গে মিসরে এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। ঐ অভ্যুত্থানে গোটা আন্তার্জাতিক ইসলামী আন্দোলন অংশ নেবে এবং উন্নত ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজাহিদ বাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কায়রো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে।  

মোবারক হত্যা চেষ্টার জাল বিস্তৃত হলো

প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারককে হত্যা এবং মিসরে র‌্যাডিকেল ইসলামীদের অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রাথমিক পরিকল্পনা নেয়া হয় ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে। অভ্যুত্থান ঘটানোর দায়িত্বটির জন্য সিনিয়র কমান্ডার হিসাবে মোস্তফা হামজাকে মনোনী করা হয়। কিন্তু হত্যাকা- ঘটানোর মতো গুরু দায়িত্বে সিনিয়র কমান্ডার হিসাবে কাকে নিয়োগ করা যাবে সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি।তবে গোড়া থেকেই তুরাবি এদায়িত্বে জাওয়াহিরিকে নিয়োগ করার কথা ভাবছিলেন, যদিও জাওয়াহিরি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত ছিলেন। সোমালিয়া যুদ্ধের সময়ই মিসরীয় এই ডাক্তারটির ওপর যথেষ্ট আস্থা গড়ে উঠেছিল তুরাবির। জাওয়াহিরির মতো দক্ষ ও কুশলী অধিনায়ক ইসলামী জিহাদীদের মধ্যে খুব বেশি ছিল না। তাছাড়া জেনেভায় তার সদর দফতরটি এত নিরাপদ ও দুর্ভেদ্য ছিল যে, সেখানে বৈরী কোন শক্তির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা ছিল না। গোটা আরব ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তো বটেই এমনকি ইউরোপ জুড়েও তার ব্যাপক যোগাযোগ ছিল।

 ১৯৯৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে তুরাবি চিকিৎসার নামে সুইজারল্যান্ড যান। সেখান থেকে গোপন সংক্ষিপ্ত সফরে যান জেনেভায়। উদ্দেশ্য জাওয়াহিরির সঙ্গে দেখা করা। দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক হয় জাওয়াহিরিকেই মোবারক হত্যার অভিযানে নেতৃত্ব দিতে হবে। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নেন যে, জুনের শেষদিকে আফ্রিকান শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে আদ্দিস অবাবায় এই হত্যার চেষ্টা চালানো হবে। সিদ্ধান্ত হবার পর জাওয়াহিরি দ্রুত প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেন। ঠিক হয় যে, “ভ্যানগার্ড অব কনকোয়েস্ট আর্গানাইজেশন” এর পতাকাতলে তিনি ঐ অভিযান চালাবেন। মে মাসের শেষ দিনগুলোতে জাওয়াহিরি ফরাসী-সুইস সীমান্তে অবস্থিত “ফার্নি-ভলটেয়ার” নামে একটি ছোট্ট গ্রামে জিহাদী বিশেষজ্ঞদের এক শীর্ষ বৈঠক ডাকেন। জায়গাটা নির্বাচিত করার কারণ হলো বেকায়দায় পড়লে ষড়যন্ত্রকারীরা যেন তৎক্ষণাৎ ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে পারে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা দেখলেই অভিযানের বিশালত্ব ও গুরুত্ব বোঝা যেতে পারে। বৈঠকে এসেছিলেন মোস্তফা হামজা-ছদ্মনামে সুদানী পাসপোর্টে। জাওয়াহিরির সহকারী ফুয়াদ তালাত কাশিম তখন ছিলেন কোপেনহেগেনে। তিনি তার অপারেশনস কমান্ডারকে এ বৈঠকে পাঠান। পেশোয়ার থেকে আহমদ শাকি আল ইসলামবুলিও একজন প্রতিনিধি পাঠান। বৈঠকে আদ্দিস আবাবা অভিযানে কি কি মূল কৌশল প্রয়োগ করা হবে এবং কোন কোন সম্পদ নিয়োগ করা হবে তা ঠিক করা হয়। হামজা সময় নষ্ট না করে সুদানে ফিরে গিয়ে মিসরীয় অভ্যুত্থানের জন্য যোদ্ধা নির্বাচন করেন। ওদিকে পেশোয়ার খার্তুমে ইসলামবুলির পরিকল্পনা সেল এক বিস্তারিত ও অত্যাধুনিক অপারেশনাল প্ল্যান তৈরি করেন।

প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর জাওয়াহিরি ১২ থেকে ১৯ জুন পরিদর্শনমূলক সফরে সূদান ও ইথিওপিয়া যান। জাওয়াহিরি ও হামজা আদ্দিস আবাবা অভিযান ও মিসরে ইসলামী অভ্যুত্থান-উভয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে দেখেন। ইথিওপিয়ান ইসলামিক জিহাদ-এ তুরাবির অনুগত ব্যক্তিদের সহায়তায় জাল ট্রাবেল ডকুমেন্ট নিয়ে জাওয়াহিরি সংক্ষিপ্ত গোপন সফরে আদ্দিস আবাবায় গিয়ে হামলার পরিকল্পিত স্থানগুলো স্বচক্ষে দেখে আসেন। এরপর তিনি খার্তুম গিয়ে অপারেশন প্ল্যানটি সবিস্তারে দেখেন। দেখে সন্তুষ্ট হয়ে জাওয়াহিরি অভিযানের জন্য ট্রেনিং গ্রহণরত জিহাদীদের সঙ্গে মিলিত হন। অভিযান ও তার জন্য শাহাদাতবরণের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। 

অভিযান সফল হবে এমন এক স্থিরবিশ্বাস বুকে নিয়ে জাওয়াহিরি সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। প্ল্যানটা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তিনি তার ঘনিষ্টতম মিসরীয় বন্ধু মোস্তফা হামজা এবং ফুয়াদ তালাত কাশিমকে ২৩ জুন জেনেভায় ডাকেন। এই তিনজন মিলে অভিযান পকিল্পনার বিস্তারিত সকল দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। খারাপ দিক, ভাল দিকগুলো বার বার পরীক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত আদ্দিস আবাবায় ও মিসরের দক্ষিণাঞ্চলে তাদের নেটওয়ার্কগুলোকে চূড়ান্ত সবুজ সঙ্কেত প্রদান করেন। ঐ পর্যায়ে পিছু হটার আর কোন পথ ছিল না।অভিযান সফল হওয়ার ব্যাপারে যাতে সামান্যতম ফাঁক না থাকে সেজন্য ইরানী গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা ইতোমধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষিত অতি তুখোড় যোদ্ধাদের মধ্য থেকে লোক বেছে নেয়া হয়। ১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মে তাদের খাতুর্মের উত্তরে আল কুদস বাহিনীর শিবিরে ইরানী বিপ্লবী গার্ডের বিশেষজ্ঞদের হাতে আলাদাভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, টিমটি গঠন করা হয়েছেল মিসরীয়, সুদানী, আলজিরীয় ও ইথিওপীয় আফগানদের নিয়ে। এমন একটা টিমের ভিতর অনুপ্রবেশ করা কিংবা তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে আঁচ পাওয়া পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। অপারেশনাল প্ল্যানে একজন সুইসাইড বোম্বার এর সম্ভাব্য ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এ জন্য যে মানুষটিকে নির্বাচিত করা হয় সে একজন আরব। 

“ভ্যান গার্ডস অব কনকোয়েস্ট” এর পতাকাতলে আফগানিস্তানের একটি সুইসাইড স্কুল থেকে সদ্য পাস করে বেরিয়েছিল। গোড়াতে লোকটি ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অভিযানে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যোগ দিয়েছিল। সুদানে থাকাকালে ইরানী বিশেষজ্ঞদের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তিনী ইসলামী জিহাদের দক্ষ প্রশিক্ষকরা তাকে ট্রেনিং দিচ্ছিল। মোবারক হত্যা চেষ্টার মাত্র এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করেই তাকে এই অভিযানের সাথে যুক্ত করা হয়। “অপারেশন প্ল্যানটা” তিনটি পৃথক পৃথক দলের সমন্বিত কাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রথম দলটির কাজ হবে ভিন্নদিকে দৃষ্টি চালিত করা। ছোট আকারের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে এই  দলটি বিমানবন্দর থেকে সম্মেলন কেন্দ্রমুখী সড়কের পাশে অবস্থিত ভবনগুলোর ছাদ থেকে মোবারকের কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালাবে। ধরে নেয়া হয়েছিল যে, আক্রান্ত হলে বা গুলিবর্ষণ শুরু হওয়া মাত্র গোটা কনভয়টির চলার গতি মন্থর হয়ে যেতে এমনকি থেমেও যেতে পারে। এমনি বিভ্রান্তিকর বা এলোমেলো অবস্থার সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয় দলটি কনভয়ের মাঝামাঝি এগিয়ে যাবে এবং আরপিজি রকেট ছুড়ে প্রেসিডেন্টের গাড়িটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। যদি ওরা প্রেসিডেন্টের গাড়িটিকে আঘাত করতে না পারে সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের কনভয়ের যেকোন গড়িকে আঘাত হানার জন্য ওদের ওপর নির্দেশ থাকবে। প্রথম দুটি দল ব্যর্থ হলে তৃতীয় দলটি এগিয়ে আসবে। 

কি করবে সেই দলটি? এই দলটি যা করবে সেটা নির্ধারিত হয়েছে মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর। এমনকি মোবারকের দেহরক্ষী দলের মধ্যে ইসলামী জিহাদীদের সোর্সের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে। সেই সোর্সের কাছ থেকে পরিকল্পনাকারীরা জানতে পেরেছিল একটা গোপন কথা। তা হলো প্রেসিডেন্টের ড্রাইভারের ওপর নির্দেশ ছিল যে, কোন জরুরী পরিস্থিতি দেখা দিলে সে যেন ঝড়ের বেগে প্রতিবন্ধক ভেঙ্গে পূর্ণগতিতে গাড়ি নিয়ে সামনে ছুটে চলে। এতে যা-ই হয় হোক তার জন্য তাকে ভাবতে হবে না। হত্যা পরিকল্পনাকরীরা ধরে নিয়েছিল যে, ঘটনাস্থল থেকে সবেগে ছুটে বেরিয়ে আসার পর মোবারকের ড্রাইভার নিশ্চয়ই একটু রিল্যাক্স করবে এবং তার জন্য গাড়ির গতি খানিকটা কমিয়েও দেবে। আর এই পর্যায়ে শক্তিশালী বোমাযুক্ত বিশাল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্টের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগাবে আত্মঘাতি যোদ্ধা (সুইসাইড বোম্বার)। নয়ত অতি কাছাকাছি বিষ্ফোরিত হবে ওটা। ইসলামবুলির বোমা বিশেষজ্ঞরা তাকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, যতই সুরক্ষিত হোক পৃথিবীতে এমন কোন গাড়ি নেই যা এত কাছাকাছি একটা বিষ্ফোরণ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
চলমান...

Ad Code

Responsive Advertisement