LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৪) - khalid Saifullah

khalid Saifullah

আল্লাহর তরবারী

Breaking

Home Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০১৭

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৪)

কিভাবে বেঁচে গেলেন মোবারক

প্রেসিডেন্ট মোবারককে হত্যা করার ব্যাপারে তুরাবি ও মিসরীয় ইসলামী নেতৃবর্গ যে কতটা বদ্ধপরিকর ছিলেন, আগের পর্বে তার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অপারেশন প্ল্যান প্রাথমিক অবস্থায় থাকাকালে সেই এপ্রিল মাসের শেষদিকে আদ্দিস আবাবায় একটি ভিলা ভাড়া নেয়া হয়েছিল, যেটি অগ্রবর্তী হেডকোয়ার্টার ও অস্ত্রশস্ত্র রাখার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হবে। অপারেশন প্ল্যান বাস্তবায়নের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর আদ্দিস আবাবায় নিযুক্ত বিশেষ দলের সাহায্যকারী নেটওয়ার্কটি পূর্বনির্ধারিত ভিলায় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ গোপনে নিয়ে আসতে থাকে। তিন সশস্ত্র দল নিজ নিজ আক্রমণস্থলে যাতে নিরাপদে অবস্থান নিতে পারে এবং অভিযান সম্পন্ন হওয়ার পর যাতে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার ছত্রছায়া পায় সেজন্য নেটওয়ার্কের সুদানী সদস্যরা ইথিওপিয়ার নিরাপত্তা অফিসারদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষায় কত যে সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল বলার নয়। আক্রমণে অংশ নেয়া স্কোয়াডটি প্রেসিডেন্ট মোবারকের আগমনের সময় এবং গমনপথ আগে থেকে একদম সঠিকভাবে জেনে নিতে পেরেছিল। জুনের মাঝামাঝি জাওয়াহিরির সুদান ও ইথিওপিয়া সফরের সময় হত্যা আয়োজনের চূড়ান্ত পর্ব রচিত হয়। ইথিওপীয় ইসলামী জিহাদীদের দিয়ে বাকি অস্ত্র চোরাচালান করে আনা হয় ইথিওপিয়ায়।

 অভিযানে যেসব যানবাহন ব্যবহৃত হবে সেগুলো সংগ্রহ করে রাখা হয়। এমনকি গাড়িবোমাও ঠিক রাখা হয়। অভিযানে যারা অংশ নিবে তাদের থাকার জন্য কয়েকটি এ্যাপার্টমেন্ট ও বাড়িও ভাড়া নেয়া হয়। সেখানে খাবারদাবার ও অন্যান্য জিনিস সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। জাওয়াহিরির সফরের মধ্য দিয়ে এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবার পর সুদানী গোয়েন্দা সংস্থা প্রায় ত্রিশ ইথিওপীয় ইসলামী জিহাদীকে আদ্দিস আবাবা থেকে খার্তুমে সরিয়ে নেয়। আসন্ন অভিযান সম্পর্কে এরা অনেক কিছু জানত। এদের কেউ ধরা পড়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে এটা সুদানীরা চায়নি। অভিযানে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের সবই ছিল সুদানি সেনাবাহিনীর। জুন মাসের মাঝামাঝি তুরাবি আদ্দিস আবাবা অভিযানের তত্ত্বাবধান কাজের দায়িত্বটা সিরাজ মোহাম্মদ হোসেন ওরফে মোহাম্মদ সিরাজ নামে এক সিনিয়র সুদানী গোয়েন্দা অফিসারকে প্রদান করেন। তিনি আদ্দিস আবাবায় গিয়ে অভিযান বাস্তবায়নের অপারেশনাল কমান্ড নেন।

 এই সিরাজ ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে সুদানী কানসাল হিসাবে ছদ্মনামে কাজ করার সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা বিষ্ফোরণে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ২০ জুনের দিকে সিরাজ আগাম প্রস্তুতির গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব বিষয়ে সন্তুষ্ট হবার পর অভিযানে অংশগ্রহণকারী আসতে শুরু করে দেয়। তারা তাদের অস্ত্রপাতি, সড়ক প্রতিবন্ধকতাকারী ট্রাক ও কারবোমা বা গাড়িবোমা ইত্যাদি আঘাত হানার প্রাক্কালে সুদানী গোয়েন্দা সংস্থার আলাদা একটা নেটওয়ার্কের কাছ থেকে পান। নেটওয়ার্কটি চালাতেন শেখ দারবিশ নামে এক সুদানী নাগরিক, যিনি তুরাবির অতি অনুগত ও বিশ্বস্ত। দারবিশ ওদের দুটো বড় সুটকেস বোঝাই ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, আরপিজি লঞ্চার, শেল, গুলিগোলা ও বিস্ফোরক দ্রব্য দেন। প্রথম দলটি তাদের শরীরে অস্ত্রসস্ত্র বহন করবে। দ্বিতীয় দলটি সঙ্গে ট্রাবেল ব্যাগ এনেছিল রকেট ও লঞ্চার বহনের জন্য। কথাছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রয়োজন না হলে সেগুলো ব্যাগ থেকে বের করা হবে না। এই সিদ্ধান্তটাই মারাত্মক ভুল বলে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়।

 আক্রমণের দিনটি ১৯৯৫ সালের ২৬ জুন যথারীতি ঠিকমতোই শুরু হয়। ইথিওপীয় গোয়েন্দা অফিসাররা হোসনী মোবারকের পরিকল্পিত সিডিউল সম্পর্কে শেষ মুহূর্তের তথ্য সর্বক্ষণ সিরাজকে সরবরাহ করে চলেছিল। তার ভিত্তিতে তিনি যথাসময়ে লোক মোতায়েন শুরু করেন। হত্যা প্রচেষ্টার গোটা অধ্যায় জুড়ে মোবারকের আগমনের সময় ও গমনপথ সম্পর্কে গোয়েন্দা বাহিনীর দেয়া তথ্য অতিমাত্রায় সঠিক ছিলো। তার মানে সিরাজের ইথিওপীয় সোর্সগুলো অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ ছিল। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মোবারকের সফরসঙ্গীদর আগমনে বিলম্ব এবং তা থেকে উদ্ভুত বিভ্রান্ত্রির ফলে গোটা অভিযানটি প- হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট মোবারকের বিমান বন্দরে এসে পৌঁছার কথা ছিল সকাল সাড়ে আটটার ঠিক আগে এবং আসার পরপরই আধ মাইলের কিছু বেশি দূরে সম্মেলন কেন্দ্র অভিমুখে রওনা দেয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনামতো সোয়া আটটার পর পরই ঐ রুটে ইথিওপীয় ও মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। মোবারকের প্লেন ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু সফরসঙ্গীরা সময়মতো না আসায় তার কনভয়টিকে গুছিয়ে তোলা যাচ্ছিল না। মোবারকের কনভয় তৈরি হতে বিলম্ব হচ্ছিল বলে ইথিওপীয় পুলিশরাও বিরক্ত হয়ে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। ওদিকে দ্বিতীয় ঘাতক দলটি যে জায়গায় অবস্থান নিয়েছিল তাদের ওপর যাতে সন্দেহের দৃষ্টি না পড়ে সেজন্য তারা রকেট ও রকেট লঞ্চার ট্রাভেল ব্যাগের ভিতর রেখে তাদের ফায়ারিং পজিশন থেকে সামান্য দূরে সরে যায়। 

প্রেসিডেন্ট মোবারক ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। আটটা পঞ্চান্ন মিনিটের দিকে কনভয়ে যেকজন লোক আছে তাদের নিয়েই তিনি অবিলম্বে সম্মেলন কেন্দ্র অভিমুখে রওয়ানা হবার নির্দেশ দিলেন। মোবারকের কনভয় যখন ছুটে চলছে সে সময় জিহদী দলের প্রথম অংশটি পূর্বপরিকল্পনা মতো ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ছোড়ে। কিন্তু নীল রঙের যে টয়োটা ট্রাকটির তখন উল্টো দিক থেকে এসে কনভয়ের সামনে পথরোধ করে দাঁড়ানোর কথা ছিল সেটি যথেষ্ট দ্রুত আসতে পারেনি ওদিকে নিরাপত্তার কারণে জিহাদীদের দ্বিতীয় দলটি যেহেতু তাদের রকেট ও লঞ্চার ইত্যাদি ট্রাভেল ব্যাগের ভিতর রেখে দিয়েছিল, এতো অল্প সময়ের ভিতর তারা ওগুলো ব্যাগ খুলে বের করে ছুঁড়ে মারতে পারেনি। তৃতীয় দলটির সদস্য ছিল একজন। সে ছিল বোমাসজ্জিত গাড়িটির চালক বা সুইসাইড বোমবার। গাড়িটিসহ চালকের যেখানে থাকবার কথা সেখানেই সে ছিল। কিন্তু নীল রঙের টয়োটা ট্রাকটির সামান্য বিলম্বই সব গোলমাল করে দিল। প্রথম দলটির কনভয়ের মূল-লিমুজিনকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। ইথিওপীয়া সরকারের ঐ লিমুজিনেই মোবারকের থাকার কথা ছিল। কিন্তু মোবারক আসলে একটি বিশেষ মার্সিডিজ গাড়িতে ছিলেন। 

এই গাড়িটি তিনি কায়রো থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এনেছিলেন। ওটা শুধু বুলেট প্রুফই ছিল না, আরপিজি রকেটের আঘাত সইবার মতো শক্ত-সমর্থও ছিল। যাই হোক, প্রথম দলটি যখন ভুল গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে চলেছে সে সময় এলো নীল টয়োটা ট্রাক। সামান্য বিলম্বের জন্য ট্রাকটা মোবারকের কনভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকাতে পারেনি। না আটকাতে পেরে ট্রাকের ড্রাইভার এবার সজোরে ধাক্কা লাগানোর চেষ্টা করে লিমুজিনের গায়ে। ধাক্কার হাত থেকে বাঁচবার জন্য গাড়িগুলো যেটা যেদিকে পারল ছুটতে চেষ্টা করল। ওদিকে প্রথম দলটির ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয়ে চলেছে। চারদিকে একটা বিশৃঙ্খল, এলোমেলো অবস্থা। মোবারকের ড্রাইভার বুঝল এমনি এলোমেলো অবস্থার ভিতর দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। তাই সিকিউরিটি প্ল্যান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে সে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে নিল মোবারকের মার্সিডিজ গাড়ি। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগাল বিমানবন্দরের দিকে। এই ভাবে ড্রাইভারের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে রক্ষা পেল মোবারকের জীবন। উল্টোদিকে না ছুটে সামনে এগোলে সম্ভবত বাঁচানো যেত না তাকে। কারণ এ্যামবুশস্থল থেকে আর তিন শ’ফুট দূরেই অপেক্ষা করছিল সুইসাইড বোম্বার- গাড়িবোমা নিয়ে অত্মদানে প্রস্তুত এক মুজাহিদ যোদ্ধা। প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রাণনাশের চেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর অনিবার্য যা ঘটবার কথা অনুমান করে সিরাজ ও তার দলের লোকেরা কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইথিওপীয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিরাপদে খার্তুমে গিয়ে পৌঁছে। মোবারককে যদি হত্যা করা যেতো তাহলে ঐদিনই জিহাদ ও সশস্ত্র যুদ্ধের কার্যক্রম পূর্ণমাত্রায় শুরু করা যেতো মিসরে। মোস্তফা হামজা ঠিক করে রেখেছিলেন যে মোবারক নিহত হবার সবুজ সঙ্কেত পেলেই তিনি মুজাহিদ বাহিনী মিসরে পাঠিয়ে দেবেন। 

এরা মিসরে অনুপ্রবেশ করে নানান রুট ধরে বিভিন্ন শহর-নগরে পৌঁছে স্থানীয় জিহাদী নেটওয়ার্কের সাথে মিলিত হবার পর জিহাদ ও সশস্ত্র সংগ্রামের নজিরবিহীন জোয়ার সৃষ্টি করবে। কিন্তু হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার খবর খার্তুমে পৌঁছলে তুরাবি ও হামজা গোটা অভিযান প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামপন্থীদের কমান্ড সেন্টার গোটা মিসরে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ককে এ্যালার্ট করে দেয়। ফলে মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ধরপাকড় অভিযান শুরু হবার আগেই জিহাদীদের সবাই গা ঢাকা দিতে সক্ষম হয়। মিসরের ইসলামী জিহাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে কায়েকদিন সময় নেয়। শেষে ৪ জুলাই মোবারক হত্যা চেষ্টার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে শেখ ওমর আব্দুর রহমানের সংগঠন আল-জামাহ আল ইসলামিয়া একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় যে ১৯৯৪ সালে মিসরীয় পুলিশের হাতে নিহত এক মুজাহিদ কমান্ডারের হত্যার বদলা নিতে তালাত ইয়াসিন কমান্ডো এই অভিযান চালিয়েছে। মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টি প্রকৃত লোকজনের ওপর যাতে না এসে পড়ে সেজন্যই যে এমন বক্তব্য দেয়া হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

সৌদি আরবে আঘাত হানা শুরু

১৯৯৫ সালের ১৩ নভেম্বর। বেলা ১১টা বেজে ৪০ মিনিট। রিয়াদের মিলিটারি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম ভবনের স্ন্যাকবারে লাঞ্চ করতে বসেছে কয়েক ডজন আমেরিকান। ভবনটা একটা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সৌদি ন্যাশনাল গার্ড-এর সদস্যদের জন্য এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালিয়ে থাকে আমেরিকানরা। তিন তলা ভবনের সামনের দিকে পার্কিং লট। বেশ কয়েকটা গাড়ি আছে সে জায়গায়। ঘড়ির কাঁটা ১১টা ৪০ মিনিটে স্পর্শ করতেই গগণবিদারী এক শব্দে প্রকম্পিত হলো চারদিক। পার্কিং লটে বিষ্ফোরিত হয়েছে একটি গাড়ি বোমা। প্রচন- সে বিস্ফোরণে ভবনের একটা দিক উড়ে গেল। ৪৫ টিরও বেশী গাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। এক মাইল দূরের বাড়ির জানালার কাঁচ ঝনঝন করে ভেঙ্গে গেল। কয়েক মিনিট পর আরো একটি বিস্ফোরণ। সেই একই পার্কিং লটে। তবে এবারেরটা এ্যন্টি পার্সোনেল বোম্ব। প্রাণঘাতী বোমা। প্রথম বিস্ফোরণের পর আহতদের উদ্ধারে যারা ছুটে গিয়েছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন হতাহত হলো দ্বিতীয় বিস্ফোরণে। রিয়াদের কেন্দ্রস্থলে গাড়িবোমা বিস্ফোরণের এই ঘটনাটা নিছক চমক লাগানো জিহাদী  হামলা ছিল না। ছিল তার চেয়েও বেশি কিছু। প্রমাণ হলো যে, সৌদি আরবের অভ্যন্তরে এক ব্যাপকভিত্তিক ও শক্তিশালী ইসলামী জিহাদীদের অন্তর্ঘাতমূলক অবকাঠামোর অস্তিত্ব আছে। জানতে পারা গেল যে, সেই মুজাহিদ বাহিনী তেহরান ও খার্তুমের দ্বারা সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত। এরা মূলত সৌদি আফগান এবং সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর লোকজন নিয়ে গঠিত, যারা দুর্নীতিবাজ আল- সৌদ রাজপরিবারের ওপর বীতশ্রদ্ধ। এরা রাজপরিবারের পতন ঘটানোর জন্য জিহাদ ত্বরান্বিত করতে বদ্ধপরিকর। 

১৩ নভেম্বর রিয়াদের বোমা বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হয়, যার মধ্যে পাঁচজনই আমেরিকান। আহত হয় ৬০ জনেরও বেশি, যার অর্ধেক হলো আমেরিকান। এদের কয়েকজনের অবস্থা ছিল বেশি গুরুতর। আসলে বোমাটা পেতে রাখা হয়েছিল একটা সাদা রঙের ভ্যানগাড়িতে। ২শ’ থেকে সোয়া দু’শ’ পাউন্ডের অতি উচ্চশক্তির বিস্ফোরক দিয়ে  তৈরি ছিল বোমাটা। খুব সম্ভবত চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরি কার্যকর প্লাস্টিকের বিস্ফোরক সেমটেক্স  ছিল বোমার উপাদান। “মিৎসুবিসি ৮১” ভ্যানটি থেকে সূত্র খুঁজে পাওয়ার মতো সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছিল। সব রকম সিরিয়াল নম্বর, এমনকি চেসিসের গা থেকেও সব নম্বর সম্পূর্ণ ঘষে তুলে ফেলা হয়েছিল। অত্যাধুনিক টাইমিং ডিভাইস দিয়ে বোমাটি ফাটানো হয়। সম্ভবত এর সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থাও যুক্ত ছিল। এন্টি-পার্সোনেল বোমাটিও অত্যন্ত নিপুণ ও দক্ষ হাতে বানানো ছিল। তাছাড়া এটি বসানো এবং টাইমিং করার ব্যাপারেও মুনশিয়ানার ছাপ ছিল। বোমাটি আকারে ছোট হলেও এটি তৈরির কাজে এমন সব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে যাতে সম্ভাব্য সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে হতাহত করা যায়। বিস্ফোরণটা যে সময় ঘটানো হয়েছে তা থেকে প্রমাণ হয় যে, এর টার্গেট ছিল আমেরিকানরা। সাধারণত এ সময়ই আমেরিকানরা ভবনের সামনের অংশে স্ন্যাকবারে লাঞ্চ করতে বসত এবং সৌদি ও অন্য মুসলমানরা জোহরের নামাজ পড়ার জন্য যেত নিকটবর্তী মসজিদে। যে সময়টা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল তা থেকে আরও একটা ব্যাপার বুঝা গেছে। তা হলো বোমা ব্যবহারকারী বা ব্যবহারকারীরা ভবনটির ভিতর-বাইরের অনেক কিছুই জানত এবং জায়গাটা দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। 

অভিযানে দু’টো বোমার ব্যবহার থেকে আরও একটা জিনিস বেরিয়ে আসে। গোটা অভিযানের প্রস্তুতির ব্যাপার একধিক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির হাত ছিল। সৌদি সূত্রের এক সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছিল যে, বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনাটি যে মহলেরই হোক না কেন এর টার্গেট নির্বাচনে অতিমাত্রায় সতর্কতা বা সাবধানতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। তেমনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও প্রদর্শন করা হয়েছে অসাধারণ পেশাদারিত্ব মনোভাবের। বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমেরিকান সামরিক বিশেষজ্ঞদের মেরে ফেলা হয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা বা বড় ঘটনা নয়। বড় কথা হলো, বিস্ফোরণের পিছনে যারা রয়েছে তারা বোমা বিস্ফোরণের উন্নত প্রযুক্তি করায়ত্ত করেছে। এবং লক্ষ্য স্থলে পৌঁছার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে গোপনে অনুপ্রবেশ করার সব রকম কলাকৌশল প্রয়োগ করেছে। তাছাড়া বিস্ফোরণের নেপথ্য নায়কদের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধিও অতিশয় প্রখর। রিয়াদ নগরীর কেন্দ্রস্থলে তাদের টার্গেট হিসাবে আমেরিকানদের বেছে নেয়ার উদ্দশ্য ছিল গোটা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমের সর্বাধিক দৃষ্টি কেড়ে নেয়া এবং এক দারুণ রাজনৈতিক হৈ চৈ ফেলে দেয়া। আসলে বিন লাদেনসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী নেতৃবৃন্দ শুধু সৌদি আরবে নয় বরং ঐ অঞ্চলে জিহাদের দ্রুত বিস্তার চাইছিলেন। তাদের সেই পরিকল্পনার অংশ ছিল রিয়াদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি।

 ১৯৯৫ সালের হেমন্তেই গোটা অঞ্চলে ইসলামী জিহাদী তৎপরতার বিস্তার ঘটতে শুরু করেছিল। অক্টোবরের শেষদিকে সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মিসরে। বিশেষ করে সেখানে থানায়, ট্রেনে, ট্যুরিস্ট বাসে নতুন করে হামলা শুরু হয়। কায়রো উত্তরোত্তর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ইসলামী জিহাদী শক্তির মোকাবেলায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নভেম্বরের গোড়ার দিকে মিসর ইসলামী অভ্যুত্থানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় ইরান ও সুদানের স্থির বিশ্বাস জন্মে যে, তারা আরব উপদ্বীপের রক্ষণশীল সরকারগুলোর পতন ঘটাতে পারবে। আর এই পতন ঘটানোর একটা মাত্র উপায় হলো কায়রোকে অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাতে সে এসব রক্ষণশীল সরকারগুলোর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে না পারে। ১৯৯৫ এর নভেম্বর ইরান-সুদানসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, তাদের সেই মহাপকিল্পনার সৌদি অংশটা বাস্তবায়িত করার সময় এসে গেছে। ১৩ নভেম্বর রিয়াদের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি ছিল তারই প্রথম মহড়া।জিহাদী ও সশস্ত্র কার্যকলাপে কোমর বেঁধে নামবার জন্য সৌদি ইসলামী শক্তিসমূহকে নভেম্বরের গোড়াতেই সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়েছিল। রিয়াদ এলাকার ইসলামী নেটওয়ার্কে ছিল সুদক্ষ জিহাদীদের একটা ছোট গ্রুপ। যার বেশির ভাগই ছিল সৌদি আফগান এবং এদের স্থানীয় সমর্থকবৃন্দ। রিয়াদের সেই অভিযানের প্রাক্কালে ইউরোপ ও এশিয়া থেকে আলাদা আলাদাভাবে আরও কিছু দক্ষ জিহাদীকে এনে স্থানীয় নেটওয়ার্কটির শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। এদের সবাই ছিল সৌদি নাগরিক। 

১৩ নভেম্বারের অভিযানে যারা অংশ নিয়েছিল ও যারা সাহায্য করেছিল তারাও ছিল সৌদি নাগরিক। এদের অনেকেই ছিল রাজতন্ত্রের ওপর বীতশ্রদ্ধ, বিক্ষুব্ধ একশ্রেণীর তরুণ সৌদি, যারা আফগানিস্তানে ট্রেনিং পেয়েছিল। সে সময় র‌্যাডিকেল ইসলামপন্থীদের বিরোধী সৌদি সূত্রে বলা হয় যে, সিআইএ ও আইএসআই এর হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সুদক্ষ সৌদি বোমা প্রস্তুতকারকরা এখন মধ্যপ্রাচ্য ও বসনিয়ায় জিহাদী নেটওয়ার্ককে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রদান করছে এবং সেই নেটওয়ার্কেরই একটা অংশ রিয়দে বোমা ফাটিয়েছে। বিস্ফোণের প্রতিক্রিয়া যা হবার তাই হয়েছিল। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কারোর অসুবিধা হয়নি। উপসাগরীয় দেশগুলোর পত্রপত্রিকায়ও তার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটা সৌদি আরব তথা গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়িফ বিন আব্দুল আজিজও ঘরোয়াভাবে স্বীকার করেছিলেন যে, এই বিস্ফোরণ এক ‘বিপজ্জনক মহামারী’র অংশ। কিন্তু সৌদি সরকার দেখাতে চাইল যে, বিস্ফোরণের লক্ষ্য তৃতীয় পক্ষ তথা আমেরিকানরা; সৌদি রাজতন্ত্র নয়। আর এভাবেই সরকার সৌদি আরবের মাটিতে ইসলামী জিহাদের মূল কারণগুলোর মোকাবালা করতে রাজি হলো না। প্রতিরক্ষা দফতর ও প্রিন্স সুলতানের মুখপাত্র বলে পরিচিত ‘আল হায়াহ’ পত্রিকায় সেই মনোভাব ব্যক্ত করে পরিষ্কার বলা হলো যে, এই বিস্ফোরণ বিদেশীদের কাজ। এর সঙ্গে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ কোন শক্তির সংস্রব নেই। 

সৌদি আরবে জিহাদ বিস্তার-১

রিয়াদে জিহাদী হামলার ঘটনার অনুপযোগী বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ মহলের আর কোন সন্দেহ থাকেনি যে আল- সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদীদের জিহাদ শুরুর ব্যাপারে এতদিন যা ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল এখন তার বাস্তব প্রয়োগ শুরু হলো মাত্র। এ ক্ষেত্রে টার্গেট নির্বাচনই হলো তার প্রমাণ। আঘাত হানা হলো একটি মার্কিন সামরিক স্থাপনায়, যেখানে চরম ঘৃণিত রয়াল গার্ডকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। এতোদিনের ঘোষিত হুঁশিয়ারি আর টার্গেট নির্বাচনের মধ্যে এমন সমন্বয় ছিল যে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি এটা ইসলামী জিহাদীদের কাজ। এর জন্য কোন ঘোষণা দিতে বা লিফলেট ছাড়তে হয়নি। ইসলামী জিহাদীরা ১৯৯৫ সালের এপ্রিল মাসেই সৌদি রাজশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল। ১০ এপ্রিল ইসলামিক চেঞ্জ মুভমেন্টের নামে দেয়া এক ইশতিহারে গোটা আরব উপদ্বীপে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী এবং সেই সঙ্গে অল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে আসন্ন সশস্ত্র হামলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করে দেয়া হয়েছিল। 

ইশতেহারে পাশ্চাত্য বাহিনীকে ১৯৯৫ সালের ২৮ জুনের মধ্যে আরব উপদ্বীপ ত্যাগের শেষ সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়েছিল, অন্যথায় ঐ তারিখ থেকে তাদের ওপর আঘাত হানা হবে। ওতে অভিযোগ করা হয় যে, সৌদি রাজপরিবার ইসলামকে ক্রুসেডের শক্তির সেবায় নিয়োজিত করেছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় হলো এই যে, এই ইশতেহারে ব্যবহৃত অনেক শব্দই পরবর্তীকালে বিন লাদেনকে তার বিভিন্ন ডিক্রী ও ফতোয়ায় ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তাছাড়া রিয়াদে বোমা বিস্ফোরণের স্টাইল এবং তাতে ব্যবহৃত উচ্চ শক্তির বিস্ফোরক ও ফিউজের প্রকৃতি দেখে বোঝা যায় যে, পাকিস্তান ও সুদানে ইসলামী জিহাদী প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে ঠিক এ ধরনের অত্যাধুনিক বোমা তৈরি, সেগুলো কোথায় কিভাবে বসাতে হয় এবং কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটাতে হয় সেই কৌশলগুলো শিখানো হয়েছিল। এসব শিবিরে ট্রেনিং নিয়েই বিন লাদেনের সৌদি অনুসারীরা ১৯৯৫ এর গ্রীষ্মে একের পর এক চমক লাগানো অভিযান চালাতে শুরু করে। তার আগে হাসান আল তুরাবির সুপারিশক্রমে বিন লাদেন ও সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামী নেতৃত্ব আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে সশস্ত্র জিহাদে রূপান্তরিত করে। এ কাজে সাহায্যের জন্য ইরানী গোয়েন্দা সংস্থা গোটা সৌদি আরবে সম্ভাব্য টার্গেট হিসাবে বেশ কিছু মার্কিন স্থাপনার ওপর নজরদারির এক দুঃসাহসিক কার্যক্রম নেয়। এই কার্যক্রম দেড় থেকে দু’বছর ধরে চলেছিল। রিয়াদের মিলিটারি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম ভবন এবং খোবার টাওয়ার্সও (১৯৯৬ এর গ্রীষ্মে হামলা হয়) ছিল এই কার্যক্রমের আওতাভুক্ত।

 ১৩ নভেম্বর রিয়াদের মিলিটারি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম ভবনে বোমা অভিযানের প্রস্তুতি ছিল সর্বাত্মক। তাও এই প্রস্তুতির কিছু কিছু খবর ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। পদস্থ সৌদি কর্মকর্তারা পরে স্বীকার করেন যে বিস্ফোরণের প্রায় এক সপ্তাহ আগে রিযাদ কর্তৃপক্ষকে আসন্ন জিহাদী হমালা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল। বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ আগে ইসলামীক চেঞ্জ মুভমেন্ট রিয়াদে মার্কিন ও ব্রিটিশ দূতাবাস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হুঁশিয়ারিসূচক ফ্যাক্সবার্তা পাঠায়। সৌদি ও পাশ্চাত্যে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এসব হুঁশিয়ারিকে তেমন আমলে দেয়নি। সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীকেও মোটেই এ্যালার্ট রাখা হয়নি। তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা, রিয়াদের গভর্নর প্রিন্স সালমান বিন আব্দুল আজিজ জেনেশুনেই এই জিহাদী অভিযানটি ঘটতে দিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত ফায়দা লুটার জন্যই। প্রিন্স সালমান বাদশাহ ফাহাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। ইসলামী জিহাদ দমন করার যোগ্যতা ও সামর্থ্য দুটোই তাঁর আছে এমন একটা সুনাম তাঁর ছিল। অন্যদিকে ইসলামী জিহাদীদের ক্রমবর্ধমান হুমকিতে গোটা আল-সৌদ রাজপরিবার ছিল আতঙ্কিত। কুশলী প্রিন্স সালমান এই দুটো বিষয়কে তাঁর ক্ষমতায় যাওয়ার এবং সকলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের টিকিট হিসাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা এঁটেছিলেন। শোনা যায় ১৯৯৪ সালের শুরুতে প্রিন্স সালামান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি দেখাশোনার জন্য বাদাশাহ ফাহাদের ব্যক্তিগত ম্যান্ডেট লাভ করেছিলেন। 

সৌদি আরবে জিহাদ বিস্তার-২

১৯৯৫ সালের শরতে ইসলামী জিহাদীদের সঙ্গে প্রিন্স সালমানের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। লন্ডনভিত্তিক সৌদি ইসলামী সংগঠন কমিটি ফর দ্য ডিফেন্স অব লেজিটিমেট রাইটস এর মোহাম্মদ আল মাসারি প্রিন্স সালমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ইনি আল-সৌদ পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও খোলামনা। কিন্তু তাঁর মতো ভন্ড আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলামী জিহাদীদের সঙ্গে তার মাখামাখির ব্যাপারটা লোকদেখানো মাত্র। তার প্রকৃত লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকা। সৌদিদের অনেকের মধ্যে এমন গুজবও ছড়িয়েছিল যে প্রিন্স সালমান ইচ্ছা করেই ঐ বিস্ফোরণ ঘটতে দিয়েছিলেন যাতে রাজপরিবারের ওপর মহলে ইসলামী জিহাদের ভীতি বৃদ্ধি পায় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে জিহাদ দমনের জন্য তারা তাকে ক্ষমতায় বসায়। তবে আল-সৌদ রাজপরিবারের শীর্ষস্থানীয় একটি মহল ১৩ নভেম্বরের বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার প্রকৃত তদন্ত ধামাচাপা দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কারণ সত্যিকারের তদন্ত হলে সৌদি গোয়েন্দা বাহিনীর এক বড় ধরনের ব্যর্থতাই প্রকাশ হয়ে পড়ত। সেই ব্যর্থতার প্রধান বিষয় ছিল একটা গোপন চুক্তি। সৌদি-পাকিস্তান সেই চুক্তির আয়োজক ছিলেন সৌদি গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল। 

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসের সেই চুক্তিতে ঠিক হয় যে, আইএসআই পাকিস্তান-আফগানিস্তানে ট্রেনিং ও আশ্রয় নেয়া সৌদি জিহাদীদের রাস টেনে ধরবে। বিনিময়ে সৌদি আরব পাকিস্তানকে বিপুল অঙ্কের সাহায্য দেবে এবং ওয়াশিংটনের কাছে পাকিস্তানের হয়ে ওকালতি করবে। বাস্তবে যা ঘটেছে, রিয়াদের উপলব্ধি অনুযায়ী তা হলো- আইএসআই ঠিকই সৌদি অর্থ নিয়েছে আবার একই সঙ্গে সৌদি জিহাদীরা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সুদান ও ইরানে ট্রেনিং ও অন্যান্য সাহায্যও লাভ করেছে।১৩ নভেম্বরের বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে ওসামা বিন লাদেন ও সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামীরা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলো সৌদি আরবে যে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করে সেখান থেকে তাদের আর পিছু হটার উপায় ছিল না। ঘটনাটা রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বার পথে যতই কম্পন  সৃষ্টি করুক এতে সমাজের বাকি জনগোষ্ঠীর কাছে সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামীদের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। রিয়াদের ঐ বিস্ফোরণের অল্পদিন পরই সৌদি আরবের অভ্যন্তরে জিহাদী অভিযান বিস্তারের খবর পাওয়া যায়।

 ২০ থেকে ২৫ নভেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে দু’টো বড় ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক অভিযানের চেষ্টা অল্পের জন্য সফল হতে পারেনি। প্রতিরক্ষা দফতর ভবনের সামনে একটি গাড়িবোমা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। আরেকটি গাড়ি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয় পেট্রোমিন অয়েল কোম্পানির পার্কিং লটে। বোমা দু’টো ১৩ নভেম্বর বিস্ফোরিত বোমার অনুরূপ হলেও অভিন্ন ছিল না। তা থেকে বোঝা যায় যে রিয়াদে অতি উন্নত ট্রেনিং পাওয়া বোমা প্রস্তুতকারক একজন ছিল না, ছিল একাধিক এবং এরা সবাই একই ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আসন্ন হামলা সম্পর্কে আবার হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দূতাবাস এবার ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়। ওদিকে তেহরান ও খার্তুমের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতার ফলে সৌদি ইসলামী শক্তিসমূহ আকারে ও ক্ষমতায় ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে এবং দেশজুড়ে বাড়তে থাকে জিহাদী হামলার আশঙ্কা। 

রিয়াদ থেকে এবার ইসলামাবাদ


রিয়াদে ১৩ নভেম্বরের বোমা বিস্ফোরণের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই মিসরীয় “আফগান” বা ইসলামী জিহাদীরা জানান দিয়ে দিল যে তারাও কিছুমাত্র কম যায় না। দিনটা ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর। সকাল ৯টা বেজে ৫০ মিনিট। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে মিসরীয় দূতাবাসের গেট সজোরে ধাক্কা মেরে ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করল দ্রুতগতির একটি ছোট্ট গাড়ি। এর পরপরই ঘটল ছোটখাটো এক বিস্ফোরণ। সামনের রিসেপশন এলাকা যেখানে ভিসা সংগ্রহ ও অন্যান্য কাজের জন্য লোকজন জড়ো হয়েছিল সেখানেই ঘটল বিস্ফোরণটি। ঐ ছোট গাড়ি থেকে ছুড়ে দেয়া একটা হ্যান্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ছিল ওটা। দূতাবাস প্রাঙ্গণে ভয়ার্ত লোকজন যখন ছোটাছুটি করছে সেই গোলমেলে অবস্থার সুযোগে এবার ভাঙ্গা গেট দিয়ে ভিতরে ছুটে এলো নীল রঙের একটা ডাবল কেবিন মাজদা পিকআপ ভ্যান। এসেই প্রচন্ড গতিতে ছুটে মূল ভবনের সামনের অংশে সজোরে আছড়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘটল আরেকটা বিস্ফোরণ। তবে এবারের বিস্ফোরণের ভয়াবহাতা বা প্রচন্ডটা ছিল এমন যে মুহূর্তের মধ্যে দূতাবাস প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হলো ২০ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট গভীর একটা গর্ত। 

মারা গেল ভ্যানের ড্রাইভারসহ ১৯ জন। আহতের সংখ্যা ষাটের অধিক। দু’টো বিস্ফোরণ ছিল এক ও অভিন্ন পরিকল্পনার অংশ। প্রথমে ছোট বিস্ফোরণটা পরবর্তী মূল বিস্ফোরণের পথ প্রসস্ত করার জন্য ঘটানো হয়েছিল যাতে সকলের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। দ্বিতীয় গাড়িটি অর্থাৎ মাজদা পিকআপ ভ্যানটিতে যে উচ্চশক্তির বিস্ফোরক ছিল সম্ভবত তা হবে ন’শ’ পাউন্ড ওজনের। দু’টো আক্রমণই সুইসাইড বোম্বার, মানে আত্মোৎসর্গী যোদ্ধার দ্বারা পরিচালিত হয়। বিস্ফোরণের অল্পক্ষণ পরেই মিসরের প্রধান তিনটি ইসলামী সংগঠন আল-জামাহ আল ইসলামিয়া, আল-জিহাদ আল-ইসলামী এবং ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস গ্রুপ ঘটনার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে। একাধিক সংগঠনের এমন দাবি করার উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ছিল বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে শত্রুপক্ষকে বোকা বানানো। তবে উল্লিখিত তিনটি সংগঠনই ছিল আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট (অওগ) এর অঙ্গ সংগঠন। শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে ইসলামিক জিহাদ এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সংগঠনের দুই সদস্য ইসাম আল কামারি ও ইব্রাহিম সালামাহ এতে আত্মদান করেছে। -------চলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages