Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১৩)

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে ফিলিপিন্স পুলিশ ম্যানিলার শহরতলিতে ইসলামী জিহাদীদের আরেকটি “সেল” ভেঙ্গে দেয়। এরা প্রধানত ছিল আরব “আফগান”। এভাবে বড় ধরণের কোন অভিযান পরিচালনা করতে পারার আগেই স্রেফ দুর্ভাগ্যবশত ফিলিপিন্স নেটওয়ার্কটি ধসে পড়ে। এ অবস্থায় লাদেন ফিলিপিন্স অভিযানকে পিছনে রেখে জিহাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য এবার পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্য।

করাচী- বিন লাদেনের আরেক কেন্দ্র

ইসলামী জিহাদীরা নব উদ্যমে আঘাত হানার জন্য ভিতরে ভিতরে যে শাণ দিচ্ছে কিছু কিছু দেশের গোয়েন্দা সংস্থা একেবারে টের পায়নি এমন নয়। বাতাসে এমন ঘ্রাণ পেয়েছিলেন সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধান শাহাজাদা তুর্কি বিন ফয়সলও। সম্ভাব্য জিহাদী হামলারোধে তিনি জরুরী কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেন।  সৌদি আরবের সতর্কতা অবশ্য ওর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাদশাহ ফাহাদের নির্দেশে শাহাজাদা তুর্কি ১৯৯৫ সালের মার্চের প্রথমদিকে পাকিস্তানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর সঙ্গে সরাসরি এসব প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, সৌদি “আফগান”রা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের ভিতরে-বাইরে যেভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে সেটা সবিশেষ উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন “গোটা ইসলামী জিহাদী অবকাঠামোর চাবিকাঠি হলো পাকিস্তান। কারণ, আফগানিস্তানে জিহাদ প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো এখনও আইএসআই নিয়ন্ত্রণ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, হরকত-উল-আনসারের পতাকা তলে বিদেশে জিহাদ পুনরুজ্জীবনের জন্য জোর সাংগঠনিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 
 এই হরকত-উল-আনসার ও আইএসআই-এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আছে।” শাহাজাদা তুর্কি একটা সমঝোতার প্রস্তাব দিলেন বেনজীরকে। বললেন যে, আইএসআইকে দিয়ে এই ইসলামী জিহাদীদের বিশেষ করে সৌদি আফগানদের রাস টেনে ধরতে হবে, বিনিময়ে সৌদি আরব উদার হস্তে পাকিস্তানকে অর্থিক সাহায্য করা ছাড়াও পাকিস্তানী স্বার্থের পক্ষে ওয়াশিংটনের কাছে লবিং করবে। সোজা কথায় পাকিস্তানের প্রতি সুর নরম করার বিশেষ করে প্রেসলার সংশোধনী বাতিল করার জন্য ওয়াশিংটনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানের লাগামহীন পারমাণবিক কর্মসূচীর কারণে সে সময় প্রেসলার সংশোনীর নামে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সব ধরণের সামরিক সাহায্যদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। বেনজীর ভুট্টো রিয়াদকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। রিয়াদও ১৯৯৫-এর এপ্রিলে বেনজীরের যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে পাকিস্তানের পক্ষে জোর লবিং করেছিল। শাহাজাদা তুর্কির বিশেষ প্রতিনিধি এ সময় বারকয়েক ইসলামাবাদে গিয়ে সিনিয়র আইএসআই অফিসারদের সঙ্গে কথাও বলেন। কিন্তু বেনজীরের দিক থেকে সহযোগিতার অঙ্গীকার থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সৌদি আরবের অনুরোধ পুরোপুরি রক্ষা করতে পারেনি। এদিকে মার্চের শেষ দিক থেকে এপ্রিলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত খার্তুমে আবার অনুষ্ঠিত হয় পপুলার এ্যরাব এ্যান্ড ইসলামিক কনফারেন্স যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে উসামা বিন লাদেনও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে পাকিস্তান পরিস্থিতি জিহাদপন্থী নেতাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আইএসআই প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সমস্যা এবং অন্যদিকে সৌদি আরবের আকর্ষণীয় অফারের কথা উল্লেখ করেন।

 জিহাদপন্থী নেতারা পাকিস্তান-মার্কিন বিরোধকে তাদের সার্থে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তারা বেনজির ভুট্টোর সরকারের সঙ্গে সহযোগীতা আরো বাড়িয়ে দেবার অঙ্গিকার করেন। বিনিময়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী আন্দোলনে গোপনে অর্থ সংস্থানের কেন্দ্র হিসাবে করাচীকে আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সুযোগ দিতে রাজি হয়। ঠিক হয় যে আর্থিক লেনদেনের এই নতুন কেন্দ্রটি চালাবেন বিন লাদেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জিহাদী নেটওয়ার্কের কাছে নগদ অর্থ গোপনে পৌঁছে দিবে এই কেন্দ্র। এটি মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু পাকিস্তানী ভূস্বামী, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীর সাথে যুক্ত থাকবে। যাতে করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের কন্ট্রাক্টগুলোকে কাজে লাগানো যায়। এ কেন্দ্রের সঙ্গে যে ওসামা বিন লাদেন জড়িত তা অনেকেরই বহুদিন জানা ছিল না।

টার্গেট এবার সৌদি রাজতন্ত্র

১৯৯৫ সালে মিশর ও সৌদি আরব সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদীদের বিরামহীন ও নিরলস প্রচারাভিযান শুরু হয়। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে চলে চরম সহিংসতা ও ধামাকার কিছু ক্ষণস্থায়ী কার্যকলাপ। সামগ্রিকভাবে এসবের প্রভাব এই দুই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিরি ওপরও এসে পড়ে। ১৯৯৫ সালে এসব ঘটনা চলাকালে ওসামা বিন লাদেন বিশিষ্ট র‌্যাডিকেল ইসলামী নেতা হিসাবে নিজের আসন সুসংহত করে তোলেন। ১৯৯৫ সালের শুরুতে ওসামা বিন লাদেন খার্তুমে তুরাবির আর্মড ইসলামীস্ট মুভমেন্টের হাইকমান্ডের সদস্য হিসাবে কাজ করছিলেন। যে সমান্য ক’জন বিশ্বাসভাজনকে নিয়ে তুরাবির নিজস্ব একটি কোটাবি ছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর মতামত ও পরামর্শ চাওয়া হতো। তুরাবির ইনার সার্কেলের একজন হিসাবে লাদেন আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই মিত্র মিসর ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আর তুরাবির ছায়া তলে থাকা অবস্থায় লাদেন ইসলামী আন্তর্জাতিক জিহাদী আন্দোলনের ক্ষমতার কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইসলামী জিহাদের নেতৃত্বের কাতারে অন্যরাও উঠে আসছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে বলতে হয় আইমান আল-জাওয়াহিরি ও তার অধীনস্থ মিসরের সিনিয়র জিহাদী কমান্ডারদের নাম।

 ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে জাওয়াহিরি হয়ে দাঁড়ান বিন লাদেনের প্রধান জিহাদী কমান্ডার।র‌্যাডিকেল ইসলামী নেতারা সৌদি আরবে জিহাদী অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই কারণে যে, তাঁরা স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন সৌদি আরবে এই ধরনের একটা জোয়ার সৃষ্টির অনুকূল অবস্থা বিরাজ  করছে। আর মিসরের বেলায় তাঁদের এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ হলো তাঁরা জানতেন যে, মিসরকে অন্য কোনভাবে ব্যতিব্যস্ত না রাখা গেলে মিসর সরকার জিহাদপন্থী ইসলামীদের কার্যক্রম, আক্রমণ বা ধামাকার মুখে সৌদি আরব বা অপর কোন রক্ষণশীল আরব সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য হস্তক্ষেপ করে বসতে পারে। সৌদি আরবে জিহাদের বিস্তার আসলে ছিল সৌদি সমাজের অভ্যন্তরে তীব্র হয়ে ওঠা এক সঙ্কটের প্রত্যক্ষ ফল এবং সঙ্কটের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে ছিল অহিংস। উত্তরাধিকার ও রাজতন্ত্রের শাসনের বৈধতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এই সঙ্কট এমন এক বিন্দুতে পৌঁছে যখন র‌্যাডিকেল ইসলামীরা স্বশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

 ১৯৯৪ সালে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি স্বনামধন্য ইসলামী আদর্শ প্রচারক শেখ সালমান-বিন-ফাহাদ আল-উদাহর গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের শুরু। শেখ উদাহ হচ্ছেন একজন তরুণ জনপ্রিয় নেতা, যিনি বেদুইন সমাজ থেকে উঠে এসে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এবং মোটামুাটি ভাবে সকল সৌদি নাগরিকের আস্থা ও সমর্থন পেয়েছিলেন। আসলে এ ধরনের নেতা শেখ উদাহ একা ছিলেন না, আরও অনেকেই ছিলেন। এঁরা বিন লাদেনের জেনারেশনের সঙ্গে গড়ে উঠেছিলেন। এঁরা আফগান যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। ইসলামী জিহাদীদের এক গোপন নেটওয়ার্কের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত ছিলেন।

 ১৯৯৪ সালের মধ্যে এই ইসলামী জিহাদীরা এবং অন্যান্য আরব ও ফিলিস্তিনী জিহাদী সংগঠন একদিকে সৌদি গুপ্ত পুলিশের সার্বক্ষণিক হুমকির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার এবং অন্যদিকে আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জিহাদী সেলগুলোর এক শিথিল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। ওসামা বিন লাদেনও ছিলেন সৌদি আরবের তৃণমুল ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা। আফগানিস্তানে মুজাহিদ নেতা হিসাবেও তাঁর অতুলনীয় ভূমিকা ছিল। সেই ভূমিকা সবারই জানা ছিলো। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। তাঁর লিখিত ও টেপ রেকর্ড করা বক্তৃতামালা গোপন ইসলামী সংগঠনগুলো সৌদি আরব জুড়ে বিলি-বন্টন করে। নীতির প্রশ্নে তাকে ব্যক্তিগতভাবে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সম্পদ হারিয়েছেন। নির্বাসিত জীবনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এসব বিষয় তাঁর মর্যাদা, তাঁর ভাবমূর্তি বাড়ার সহায়ক হয়েছে। সুদানে নির্বাসিত থাকাকালেও বিন লাদেন সৌদি আরবের ইসলামী জিহাদীদের পরিত্যাগ করেননি। বরং নানাভাবেই তাদের সাহায্যের ব্যবস্থা করেছেন। 

তৃণমূল পর্যায়ের নেতা শেখ উদাহের গ্রেফতার সৌদি সমাজের অভ্যন্তরে বেশ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। গ্রেফতারের কয়েকদিন পর সৌদি আরবের অভ্যন্তরে ব্রিগেড অব ফেইথ নামে একটি ইসলামী জিহাদী সংগঠন প্রথম ইশতেহার ছাড়ে। তাতে সৌদি সরকারের উদ্দেশ্যে চরমপত্র ঘোষণা করে বলা হয় যে, পাঁচ দিনের মধ্যে শেখ উদাহকে মুক্তি দেয়া না হলে এই সংগঠন সৌদি ও আমেরিকানদের বিরুদ্ধে জিহাদ অভিযান শুরু করবে। ইশতেহারে বলা হয়, “গোটা আরব উপদ্বীপ আমাদের জিহাদী তৎপরতার জন্য মুক্তাঙ্গনে পরিণত হয়েছে।” শেখ উদাহ নিজেও এই সশস্ত্র জিহাদ অনুমোদন করেছিলেন।

 ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে জেলে থাকা অবস্থাতেও শেখ উদাহ আল-সৌদ রাজপরিবারের শাসকদের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদীদের বিক্ষোভ জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে বাণী বদ্ধ টেপ গোপনে জেল থেকে বাইরে পাচার করেন। এমনি একটি টেপে সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদও ঘোষণা করা হয়। এমনি হাজার হাজার বেআইনী ক্যাসেট গোপনে গোটা  সৌদি আরবে বিলি করা হয়।

 ১৯৯৫ সালের ১০ এপ্রিল “ইসলামিস্ট চেঞ্জ মুভমেন্ট” নামে আরেক ইসলামী জিহাদী সংগঠন আরব উপদ্বীপজুড়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং সেই সঙ্গে আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে আসন্ন সশস্ত্র হামলা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়। ইশতিহারে পাশ্চাত্য বাহিনীকে ১৯৯৫ সালের ২৮ জুনের মধ্যে আরব উপদ্বীপ ত্যাগের শেষ সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয়, অন্যথায় এ তারিখ থেকে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী জিহাদের ন্যায়সঙ্গত টার্গেট হয়ে দাঁড়াবে। ইশতেহারে অভিযোগ করা হয় যে, সৌদি রাজপরিবার ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্রুসেডের শক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়েছে, যার প্রমাণ হলো ইসলামের বিশিষ্ট প্রচারক ও শিক্ষকদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সৌদি আরবের ইসলামী জিহাদী শক্তিগুলো সৌদি শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করার জন্য জিহাদ শুরু করাকেই একমাত্র সম্ভাব্য পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এই হুমকিটা নিছক কাগুজে হুমকি ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার যোদ্ধার এক ইসলামী মুজাহিদ বাহিনী গড়ে উঠেছিল সৌদি আরবে। তার ওপর ছিল আফগান যুদ্ধ প্রত্যাগত ৫ হাজারের ওপর সৌদি মুজাহিদ, যারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও অস্ত্রসজ্জিত হয়েছিল ইরান, সুদান, ইয়েমেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। এছাড়া সৌদি আরবের অভ্যন্তরে এক বিশাল ইসলামী আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক এই সৌদি মুজাহিদদের সমর্থন করার জন্য পস্তুত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলামী জিহাদীরা তাদের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। কেন, সে প্রসঙ্গ পরবর্তী পর্বে আলোচিত হবে। 

হোসনী মোবারককে হত্যার চক্রান্তে বিন লাদেনও ছিলেন

১৯৯৫ সালের জুন মাসের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী নেতারা আরও বড় ধরণের এক অভিযান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আর সে অভিযান হলো মিসরের বিরুদ্ধে। নিরাপত্তার কারণেই সৌদি র‌্যাডিকেল ইসলামীরা আগে থেকে এ অভিযান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। যে কোন আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলনকে জানাজানি হয়ে পড়ার, ধরা পড়ার, নির্যাতন ও বিশ্বাসঘাতকতার হুমকির মধ্য দিয়ে চলতে হয়। তাই এক জিহাদী গ্রুপের পরিকল্পিত অভিযান অপর জিহাদী গ্রুপ আগে থেকে জানতে পারে না। জানা সম্ভবও নয়। খার্তুম ও তেহরান থেকে সৌদি জিহাদীদের শুধু জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, তাদের রাজতন্ত্রবিরোধী অভিযানে আপাতত ক্ষান্ত হতে হবে। জিহাদী ব্যবস্থার কঠোর শৃঙ্খলার কারণে সৌদিরা বিনা বাক্যব্যয়ে সে নির্দেশ পালন করেছিল।

 ১৯৯৫ সালের ২৬ জুন ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মেবারকের প্রাণনাশের চেষ্টা চালানো হয়। প্রেসিডেন্ট মোবারক প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা মিসরে ইসলামী জিহাদ প্রভাবিত যে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল, সেটাও বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তথাপি ঘটনাটি আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে। এবং গোটা অঞ্চলে ইসলামী জিহাদের জোয়ার সৃষ্টিতে বড় ধরনের প্রেরণা যোগায়। মিসরের ইসলামী জিহাদীরা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলো হোসনী মোবারককে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিল। 

১৯৮১ সালে তাঁর পূর্বসূরি আনোয়ার সাদাত ইসলামী জিহাদীদের হাতে নিহত হন। তারা আশা করেছিল এই হত্যার ফলে সরকারের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে এবং ইসলামী শক্তিগুলোর অভ্যুত্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু তা হয়নি হোসনী মোবারকের কারণে। তিনি শুধু সরকারকে স্থিতিশীলতাই দেননি, উপরন্তু ইসলামী জিহাদীদের ওপর হিংসাত্মক দমন-নিপীড়নও চালিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মিসর ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি রক্ষাই শুধু করেনি, উপসাগর যুদ্ধে বহুজাতিক বাহিনীর পক্ষে বলিষ্ঠভাবেও দাঁড়িয়েছিল। তদুপরি মোবারক বার বার বলেছিলেন যে,র‌্যাডিকেল ইসলামীদের চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি যে কোন রক্ষণশীল আরব সরকারকে সমর্থন দিতে বদ্ধপরিকর। এর জন্য যদি মিসরীয় সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রয়োজন হয় তা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হবেন না। সুতরাং হোসনী মোবারককে মেরে ফেললে নানা দিক দিয়ে লাভ হতে পারত ইসলামী জিহাদীদের।আদ্দিসে আবাবায় মোবারকের প্রাণনাশের চেষ্টাটি ছিল ইসলামী জিহাদী আন্দোলন এবং পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ের দীর্ঘ আলোচনার ফল। ওসামা বিন লাদেন এসব আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। আক্রমণটা যদিও চালিয়েছিল শেখ ওমর আব্দুর রহমানের সংগঠন আল জামাহ আল ইসলামীয়া। তথাপি গোটা অভিযানটি প্রকৃতপক্ষে ছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফসল। এবং তার মধ্যে তুরাবির সুদানের অবস্থান ছিল সর্বাগ্রে। সমগ্র মিসরে ইসলামী সশস্ত্র সংগ্রামের সার্বিক বিস্তারে সুদান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।

১৯৯৪ সালের শরতের শুরু থেকেই তেহরান, খার্তুম এবং আর্মড ইসলামিক মুভমেন্টের  নেতৃবৃন্দকে বার বার প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারকের হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায়। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে মোবারকের ইতালি সফরের সময় তাকে হত্যা করার জন্য ইতালি এবং বসনিয়া-হারজেগোভিনায় ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্ককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ইতালিতে ইসলামী নেটওয়ার্কের ওপর পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজর থাকায় ষড়যন্ত্রটা ফাঁস হয়ে যায় এবং সেটা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। এরপর খার্তুমের নির্দেশে মোবারককে হত্যা এবং ইসলামীদের গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য খোদ মিসরের একটি ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্কের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়।

 ১৯৯৫ এর জানুয়ারীর প্রথম তিন সপ্তাহে নেটওয়ার্কের সদস্যরা মোবারককে হত্যার জন্য তিন তিনবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ধরা পড়ার ভয়ে জিহাদী দলের প্রধান নেতারা অন্যান্য আরব দেশ হয়ে সুদানে পালিয়ে যায়। মিসরের অন্যান্য ইসলামী সংগঠন, যাদের সঙ্গে এই হত্যা প্রচেষ্টার কোন রকম সংস্রব ছিলনা তাদের ওপর মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নির্মম আঘাত এসে পড়ে। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার এমনি একের পর এক চেষ্টা চলছে এটা প্রকাশ হয়ে গেলে সরকারের স্থিতিশীলতা ক্ষুণ হবে আশঙ্কা করে কায়রো গোটা ব্যাপারটাই চেপে গিয়েছিল। ওদিকে মিসরীয় জিহাদীরা সুদানে পালিয়ে আসার পর আর্মড ইসলামীক মুভমেন্টের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এবং ইরানের প্রতি গোয়েন্দা বিশেজ্ঞরা  প্রেসিডেন্ট মোরাককে হত্যার চেষ্টা কেন বা কোন ত্রুটির কারণে বার বার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখেন। ইরানী বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন যে, মিসরের ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরে সরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন চুপিসারে ঢুকে পড়েছে। তাই আগে থেকে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তাদের পরিকল্পনা। এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও একইভাবে ফাঁস হতে বাধ্য। সুতরাং ভবিষ্যত অভিযানে (মোবারক হত্যা) সর্বোচ্চ মাপের জিহাদী নেটওয়ার্ক কাজে লাগাতে হবে এবং দ্বিতীয়ত সেই অভিযান মিসরের ভিতরে হলে চলবেনা। বাইরে হতে হবে। কারণ স্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোকে আর পুরোপুরি বিশ্বাস করা চলে না। এসব অভিমত পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে তুরাবি পরবর্তী কৌশল নির্ধারণের আগে বিষয়টি নিয়ে মিসরের ইসলামী জিহাদী বাহিনীগুলোর বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেন। 

এ উদ্দেশ্যে তুরাবি ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে খার্তুমে তিন শীর্ষ মিসরীয় কমান্ডার ডাঃ আইমান আল জাওয়াহিরি (আল-জিহাদ), মোস্তফা হামজা (আল-জামাহ আল ইসলামিয়া) এবং রিফাই আহমদ তহা (আল জামাহ আল ইসলামিয়া) এর সঙ্গে আলোচনার জন্য জরুরী বৈঠক ডাকেন। এই তিন নেতার মধ্যে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তারা ঠিকই তুরাবির এ জরুরী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মিসরে ইসলামী বিপ্লব শুরু করার পথে সমস্যা ও অন্তরায়, এর সার্বিক দিক, এমনকি কৌশল পরিবর্তনের বিষয়টিও পর্যালোচনা করে দেখা হয়। তুরাবির সঙ্গে এই তিন কমান্ডারের বৈঠকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে হত্যা করার জন্য এক বড় ধরনের অভিযান চালানোর বিষয়টিও উত্থাপিত হয়। মিসরীয় কমান্ডাররা একমত হন যে মোবারককে হত্যা করার পরিণতিতে যদি মিসরে বড় ধরনের ইসলামী গণঅভ্যুত্থান ঘটে এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ইসলামী জিহাদী অভিযান জোরদার হয় তাহলে সেটা হবে এক অসাধারণ ঘটনা। কিন্তু সেই হত্যা অভিযান চালানো হবে কিনা সে প্রশ্নে তারা নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে ব্যাপারটা তুরাবির হাতে ছেড়ে দেয়। তুরাবি তখন এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে খাতুর্মে অনুষ্ঠিত পপুলার এ্যারাব এ্যান্ড ইসলামিক কনফারেন্স এর অধিবেশনে প্রসঙ্গটি তোলেন। 

সেই বৈঠকে তুরাবি, ওসামা বিন লাদেন ও সুদানি গোয়েন্দা সংস্থার মোস্তফা ইসমাইল ও ওসমানকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। তা ছাড়া হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনী ইসলামিক জিহাদ, হামাস প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও ঠৈকে মতবিনিময় করা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা মিসরের বাইরে প্রেসিডেন্ট মোবারককে হত্যার সম্ভাব্য সব দিক নিয়ে আলোচনা করে এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত প্রদান করেন। তারা বলেন, মোবারককে হত্যার এবং সেই সঙ্গে মিসরে এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। ঐ অভ্যুত্থানে গোটা আন্তার্জাতিক ইসলামী আন্দোলন অংশ নেবে এবং উন্নত ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজাহিদ বাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কায়রো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে।  

মোবারক হত্যা চেষ্টার জাল বিস্তৃত হলো

প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারককে হত্যা এবং মিসরে র‌্যাডিকেল ইসলামীদের অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রাথমিক পরিকল্পনা নেয়া হয় ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে। অভ্যুত্থান ঘটানোর দায়িত্বটির জন্য সিনিয়র কমান্ডার হিসাবে মোস্তফা হামজাকে মনোনী করা হয়। কিন্তু হত্যাকা- ঘটানোর মতো গুরু দায়িত্বে সিনিয়র কমান্ডার হিসাবে কাকে নিয়োগ করা যাবে সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি।তবে গোড়া থেকেই তুরাবি এদায়িত্বে জাওয়াহিরিকে নিয়োগ করার কথা ভাবছিলেন, যদিও জাওয়াহিরি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত ছিলেন। সোমালিয়া যুদ্ধের সময়ই মিসরীয় এই ডাক্তারটির ওপর যথেষ্ট আস্থা গড়ে উঠেছিল তুরাবির। জাওয়াহিরির মতো দক্ষ ও কুশলী অধিনায়ক ইসলামী জিহাদীদের মধ্যে খুব বেশি ছিল না। তাছাড়া জেনেভায় তার সদর দফতরটি এত নিরাপদ ও দুর্ভেদ্য ছিল যে, সেখানে বৈরী কোন শক্তির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা ছিল না। গোটা আরব ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তো বটেই এমনকি ইউরোপ জুড়েও তার ব্যাপক যোগাযোগ ছিল।

 ১৯৯৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে তুরাবি চিকিৎসার নামে সুইজারল্যান্ড যান। সেখান থেকে গোপন সংক্ষিপ্ত সফরে যান জেনেভায়। উদ্দেশ্য জাওয়াহিরির সঙ্গে দেখা করা। দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক হয় জাওয়াহিরিকেই মোবারক হত্যার অভিযানে নেতৃত্ব দিতে হবে। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নেন যে, জুনের শেষদিকে আফ্রিকান শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে আদ্দিস অবাবায় এই হত্যার চেষ্টা চালানো হবে। সিদ্ধান্ত হবার পর জাওয়াহিরি দ্রুত প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেন। ঠিক হয় যে, “ভ্যানগার্ড অব কনকোয়েস্ট আর্গানাইজেশন” এর পতাকাতলে তিনি ঐ অভিযান চালাবেন। মে মাসের শেষ দিনগুলোতে জাওয়াহিরি ফরাসী-সুইস সীমান্তে অবস্থিত “ফার্নি-ভলটেয়ার” নামে একটি ছোট্ট গ্রামে জিহাদী বিশেষজ্ঞদের এক শীর্ষ বৈঠক ডাকেন। জায়গাটা নির্বাচিত করার কারণ হলো বেকায়দায় পড়লে ষড়যন্ত্রকারীরা যেন তৎক্ষণাৎ ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে পারে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা দেখলেই অভিযানের বিশালত্ব ও গুরুত্ব বোঝা যেতে পারে। বৈঠকে এসেছিলেন মোস্তফা হামজা-ছদ্মনামে সুদানী পাসপোর্টে। জাওয়াহিরির সহকারী ফুয়াদ তালাত কাশিম তখন ছিলেন কোপেনহেগেনে। তিনি তার অপারেশনস কমান্ডারকে এ বৈঠকে পাঠান। পেশোয়ার থেকে আহমদ শাকি আল ইসলামবুলিও একজন প্রতিনিধি পাঠান। বৈঠকে আদ্দিস আবাবা অভিযানে কি কি মূল কৌশল প্রয়োগ করা হবে এবং কোন কোন সম্পদ নিয়োগ করা হবে তা ঠিক করা হয়। হামজা সময় নষ্ট না করে সুদানে ফিরে গিয়ে মিসরীয় অভ্যুত্থানের জন্য যোদ্ধা নির্বাচন করেন। ওদিকে পেশোয়ার খার্তুমে ইসলামবুলির পরিকল্পনা সেল এক বিস্তারিত ও অত্যাধুনিক অপারেশনাল প্ল্যান তৈরি করেন।

প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর জাওয়াহিরি ১২ থেকে ১৯ জুন পরিদর্শনমূলক সফরে সূদান ও ইথিওপিয়া যান। জাওয়াহিরি ও হামজা আদ্দিস আবাবা অভিযান ও মিসরে ইসলামী অভ্যুত্থান-উভয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে দেখেন। ইথিওপিয়ান ইসলামিক জিহাদ-এ তুরাবির অনুগত ব্যক্তিদের সহায়তায় জাল ট্রাবেল ডকুমেন্ট নিয়ে জাওয়াহিরি সংক্ষিপ্ত গোপন সফরে আদ্দিস আবাবায় গিয়ে হামলার পরিকল্পিত স্থানগুলো স্বচক্ষে দেখে আসেন। এরপর তিনি খার্তুম গিয়ে অপারেশন প্ল্যানটি সবিস্তারে দেখেন। দেখে সন্তুষ্ট হয়ে জাওয়াহিরি অভিযানের জন্য ট্রেনিং গ্রহণরত জিহাদীদের সঙ্গে মিলিত হন। অভিযান ও তার জন্য শাহাদাতবরণের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। 

অভিযান সফল হবে এমন এক স্থিরবিশ্বাস বুকে নিয়ে জাওয়াহিরি সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। প্ল্যানটা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তিনি তার ঘনিষ্টতম মিসরীয় বন্ধু মোস্তফা হামজা এবং ফুয়াদ তালাত কাশিমকে ২৩ জুন জেনেভায় ডাকেন। এই তিনজন মিলে অভিযান পকিল্পনার বিস্তারিত সকল দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। খারাপ দিক, ভাল দিকগুলো বার বার পরীক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত আদ্দিস আবাবায় ও মিসরের দক্ষিণাঞ্চলে তাদের নেটওয়ার্কগুলোকে চূড়ান্ত সবুজ সঙ্কেত প্রদান করেন। ঐ পর্যায়ে পিছু হটার আর কোন পথ ছিল না।অভিযান সফল হওয়ার ব্যাপারে যাতে সামান্যতম ফাঁক না থাকে সেজন্য ইরানী গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা ইতোমধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষিত অতি তুখোড় যোদ্ধাদের মধ্য থেকে লোক বেছে নেয়া হয়। ১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মে তাদের খাতুর্মের উত্তরে আল কুদস বাহিনীর শিবিরে ইরানী বিপ্লবী গার্ডের বিশেষজ্ঞদের হাতে আলাদাভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, টিমটি গঠন করা হয়েছেল মিসরীয়, সুদানী, আলজিরীয় ও ইথিওপীয় আফগানদের নিয়ে। এমন একটা টিমের ভিতর অনুপ্রবেশ করা কিংবা তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে আঁচ পাওয়া পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। অপারেশনাল প্ল্যানে একজন সুইসাইড বোম্বার এর সম্ভাব্য ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এ জন্য যে মানুষটিকে নির্বাচিত করা হয় সে একজন আরব। 

“ভ্যান গার্ডস অব কনকোয়েস্ট” এর পতাকাতলে আফগানিস্তানের একটি সুইসাইড স্কুল থেকে সদ্য পাস করে বেরিয়েছিল। গোড়াতে লোকটি ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অভিযানে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যোগ দিয়েছিল। সুদানে থাকাকালে ইরানী বিশেষজ্ঞদের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তিনী ইসলামী জিহাদের দক্ষ প্রশিক্ষকরা তাকে ট্রেনিং দিচ্ছিল। মোবারক হত্যা চেষ্টার মাত্র এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করেই তাকে এই অভিযানের সাথে যুক্ত করা হয়। “অপারেশন প্ল্যানটা” তিনটি পৃথক পৃথক দলের সমন্বিত কাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রথম দলটির কাজ হবে ভিন্নদিকে দৃষ্টি চালিত করা। ছোট আকারের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে এই  দলটি বিমানবন্দর থেকে সম্মেলন কেন্দ্রমুখী সড়কের পাশে অবস্থিত ভবনগুলোর ছাদ থেকে মোবারকের কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালাবে। ধরে নেয়া হয়েছিল যে, আক্রান্ত হলে বা গুলিবর্ষণ শুরু হওয়া মাত্র গোটা কনভয়টির চলার গতি মন্থর হয়ে যেতে এমনকি থেমেও যেতে পারে। এমনি বিভ্রান্তিকর বা এলোমেলো অবস্থার সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয় দলটি কনভয়ের মাঝামাঝি এগিয়ে যাবে এবং আরপিজি রকেট ছুড়ে প্রেসিডেন্টের গাড়িটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। যদি ওরা প্রেসিডেন্টের গাড়িটিকে আঘাত করতে না পারে সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের কনভয়ের যেকোন গড়িকে আঘাত হানার জন্য ওদের ওপর নির্দেশ থাকবে। প্রথম দুটি দল ব্যর্থ হলে তৃতীয় দলটি এগিয়ে আসবে। 

কি করবে সেই দলটি? এই দলটি যা করবে সেটা নির্ধারিত হয়েছে মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর। এমনকি মোবারকের দেহরক্ষী দলের মধ্যে ইসলামী জিহাদীদের সোর্সের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে। সেই সোর্সের কাছ থেকে পরিকল্পনাকারীরা জানতে পেরেছিল একটা গোপন কথা। তা হলো প্রেসিডেন্টের ড্রাইভারের ওপর নির্দেশ ছিল যে, কোন জরুরী পরিস্থিতি দেখা দিলে সে যেন ঝড়ের বেগে প্রতিবন্ধক ভেঙ্গে পূর্ণগতিতে গাড়ি নিয়ে সামনে ছুটে চলে। এতে যা-ই হয় হোক তার জন্য তাকে ভাবতে হবে না। হত্যা পরিকল্পনাকরীরা ধরে নিয়েছিল যে, ঘটনাস্থল থেকে সবেগে ছুটে বেরিয়ে আসার পর মোবারকের ড্রাইভার নিশ্চয়ই একটু রিল্যাক্স করবে এবং তার জন্য গাড়ির গতি খানিকটা কমিয়েও দেবে। আর এই পর্যায়ে শক্তিশালী বোমাযুক্ত বিশাল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্টের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগাবে আত্মঘাতি যোদ্ধা (সুইসাইড বোম্বার)। নয়ত অতি কাছাকাছি বিষ্ফোরিত হবে ওটা। ইসলামবুলির বোমা বিশেষজ্ঞরা তাকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, যতই সুরক্ষিত হোক পৃথিবীতে এমন কোন গাড়ি নেই যা এত কাছাকাছি একটা বিষ্ফোরণ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
চলমান...

মন্তব্যসমূহ

Ad Code

Responsive Advertisement