Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

নফসের ধোকা ও তার কোড়বাণি

আপনি যতবার অন্যায়ভাবে আপন প্রবৃত্তির খায়েশ মেটাবেন, হোক সে ট্যারা চোখে গাইর-মাহরাম নারীর দিকে তাকানো অথবা মোবাইল বা টেলিভিশন বা ল্যাপটপের পর্দায় তাকিয়ে থেকে স্বল্পবসনা চরিত্রহীন নারীদের দেহের বিভঙ্গ দেখা, অথবা কোন কিছু অন্যায়ভাবে ভোগ করা। আপনি আপনার চাহিদাকে হারাম উপায়ে পূরণ করবেন, কিংবা যতবার অন্যায়ভাবে প্রবৃত্তির চাওয়া পূরণ করবেন, আপনি কিন্তু প্রতিনিয়ত আপনাকেই ধ্বংস করছেন।
প্রতিটি কামনা ও বাসনার প্রতি সাড়া আপনাকে নামিয়ে দিবে নিচে। আপনি বুঝতে পারবেন আপনার মনুষ্যত্বের পতন। আপনার নামাজে মনোযোগ কমে যাবে, ইবাদতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন, কুরআনের আয়াত শুনে অন্তরে তার কোন প্রভাব পড়বেনা, আল্লাহর কাছে কাঁদতে পারবেন না, হৃদয় পাপে শক্ত হয়ে যেতে থাকবে, হারাম থেকে বেচে থাকা কঠিন মনে হবে। আপনি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে প্রতিনিয়ত এইভাবেই নিজের জীবন ও ঈমানকে ক্রমশ ধ্বংস করতে থাকবেন।
!
যখন আপনি শয়তানের কথা একটু শুনতে শুরু করলেন, তখন আপনি তাকে সামান্য ক্ষমতা দেওয়া শুরু করলেন। যখন আপনি তাকে একটু বেশী শুনতে শুরু করলেন, তখন তাকে আরও ক্ষমতা দেওয়া শুরু করলেন। আপনি যদি তাকে এইভাবে শুনতে থাকেন তাহলে সে আপনাকে তার কাজের আদেশ করতে শুরু করবে। আপনি যখন এই অবস্থার মধ্যে পড়বেন যে আপনি বলছেন আমি কোনভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারছিনা, আমি জানিনা যে কে আমাকে দিয়ে এই সমস্ত খারাপ কাজ করায়? আমি জানিনা যে কে আমাকে এই সকল করতে উস্কানি দেয়? কি কারণে আমি সেখানে যাই আমি তাও জানিনা। সে আমাকে বলে যাও লগইন কর ভয়ংকর অশ্লীল ওয়েবসাইট গুলিতে আর নোংরা জিনিসগুলি দেখতে উস্কানি দেয়, কেন সে আমাকে দিয়ে এইগুলি করায়? কেন আমি শেষ পর্যন্ত এই কাজগুলি করছি? কেন আমি আমার চোখ নিচু করতে পারছিনা যখন আমি লিফটে উঠি? কেন আমি আমার চোখ নিচু করতে পারছিনা যখন আমি রাস্তা দিয়ে হেটে যাই? আমি নিজেকে কোনভাবেই সাহায্য করতে পারছিনা এমনকি আমাকে কি করতে হবে তাও জানিনা। তখনই বুঝবেন শয়তান আপনাকে ভালভাবেই ধরেছে, সে আপনাকে বেশ শক্তভাবেই ধরেছে, সে ক্রমাগত আপনাকে গ্রাস করে ফেলেছে আর এটা শুধু খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে থাকবে। আপনি এই জটিল সমস্যার সমাধানও খুঁজছেননা আর এটা আপনার ভিতরের আধ্যাত্মিকতাকে একেবারেই ধংস করে দিবে। আল্লাহর সাথে আপনার সম্পর্ক পুরপোরি নির্ভর করে পরিষ্কার হৃদয় এর উপরে। যতবারই আপনি নষ্টামি কর্মের মুখোমুখি হবেন আরও বেশী ময়ালা, আরও বেশী কালিমা, আপনার অন্তরকে পুরপোরিভাবে ঢেকে দিবে। এটা শুধু স্রোতের মত বাড়তে থাকবে, সেই সময় যদি আপনার সামনে আল্লাহর কথা বলা হয় আপনার চোখ দিয়ে একফোটা পানিও পড়বেনা। এটা হবার কারণ হল ওইসব প্রকাশিত অশ্লীলতার দরুন আপনার হৃদয় পাপে সম্পুর্ণরুপে শক্ত হয়ে গেছে। আপনি যে গুনাহ'র কাজগুলি করার জন্য আপনার চোখ জোড়া ব্যবহার করেছেন। এমনকি আপনি আর এটার জন্য মোটেও পরোয়া করেননা।
!
আপনি জানেন যে একটি ভাল হৃদয় যখন সে দেখে কোন খারাপ কাজ ঘটে গেছে, যা কিনা আল্লাহর হুকুমের বাইরে তখন সে অস্থির হয়ে ওঠে। এটা তাকে আকৃষ্ট করেনা। এটা তাকে বিরক্তিবোধ করায়। সে বলে উঠে না এটা ভুল, সংগে সংগেই তার সতর্ক মন জেগে উঠে, বিপদসংকেত বেজে উঠে। কিন্তু যখনই আপনি এই অবস্থায় চলে যাবেন যে আপনার মধ্যে কোন গুনাহ করার পরেও কোন অপরাধবোধ কাজ করছেনা, আপনি শুধু মনে করছেন এটা কিছুইনা, আপনি এটাকে ভুল বলেই মনে করছেননা। যখন আপনি কোন মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন তখন আপনি শুধু এটাকেই পাত্তা দিচ্ছেন যে কেউ আমাকে দেখে ফেলল কিনা। যখন দেখবেন কেউ আপনাকে দেখছেনা তখনই আপনি মেয়েটার দিকে ভালভাবে তাকাবেন। এটার অর্থ হল আল্লাহর ভয় আপনার মন থেকে চলে গেছে, আপনি শুধু ভয় পান যে জিনিষ দেখা যায় তাকে, অদেখা শক্তিকে আপনি ভয় পাননা। আপনি আপনার মনের কু-প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছেন। এটা হল একটি ভয়ংকর আধ্যাত্মিক দুরঅবস্থা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-
“তোমরা চোখের মাধ্যমে যে সামান্য চুরি করে দেখ এবং অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে তিনি জানেন।” ৪০/সূরা আল-মু’মিন, আয়াত- ১৯)
“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি।” (৫০/ সূরা ক্বাফ,আয়াত- ১৬)
“আপনি কি তাকে দেখেন না, যে তারা মনের কু-প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি দায়িত্ব নিবেন? আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে?” (সূরা আল ফুরকান, আয়াত-৪৩,৪৪)

অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।” (৮২/সূরা ইনফিতার, আয়াত-১০,১১)
!
এই দুরাবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে প্রকৃত মুমিনদের কাতারে শামীল হতে হবে। কারন প্রকৃত মুমিনদের উপর শয়তানের কোন কর্তৃত্ব নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করার বিপরিতে তার আয়াতসমূহ এড়িয়ে যায় তার পিছনে শয়তান লেগে যায়। কারন অন্তর যখন কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না সেই অন্তর যেন তালাবদ্ধ। সেই তালাবদ্ধ ও পরিত্যক্ত অন্তরে তখন প্রবেশ ঘটে শয়তানের এবং সে মনের আনন্দে নিষিদ্ধ কাজগুলো কেও আমাদের কাছে সুন্দর করে দেখায়। নিষিদ্ধ কাজগুলোকে তখন আর অসুন্দর লাগে না, মনে হয় "ইশ্! কি সুন্দর! ইশ্! কি আনন্দ!" মনে রাখবেন, পাপাসক্ত অন্তর কখনো পবিত্র ভালোবাসার সৌন্দর্যকে অনুভব করতে পারে না। যদি ফিরে পেতে চান হৃদয়ের শান্তি, যদি অনুভব করতে চান প্রিয়জনদের ভালোবাসা। আপনাকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থেকে নিজের নফসের পশুত্বকে কুরবানি দিয়ে ফিরে আসতেই হবে। অবশ্যই পরকালীন জীবনের সাফল্যের আশায় আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-
“যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল-খুশী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত।” (সূরা আন নাযিয়াত, আয়াত ৩৫-৪১)
“অবশ্যই যারা আমার প্রকৃত মুমিন বান্দা হবে তাদের ওপর তোমার (শয়তান) কোন জোর খাটবে না। তোমার জোর খাটবে শুধুমাত্র এমন বিপথগামীদের ওপর যারা তোমার অনুসরণ করবে।” ১৫/সূরা আল-হিজর, আয়াত-৪২)
“কিন্তু সে তা (আমার আয়াতসমূহ) এড়িয়ে

র্যান্ডের আত্মকাহানী



র্যান্ডের নাম শুনে অনেকে হয়তো নড়েচড়ে বসেছেন। আমেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিঙ্কট্যাঙ্ক RAND Corporation এর মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শ তৈরীর জন্য ২০০৩ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত রিপোর্ট Civil Democratic Islam এর কথা হয়তো অনেকেই জানেন । এই রিপোর্টে বিশ্লেষক শেরিল বেনার্ড বিশ্বের মুসলিমদের মোটাদাগে চারটি এবং অধিকতর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে আটটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এই শ্রেণীগুলোর চিন্তাধারার পার্থক্য বোঝানোর জন্য মুসলিম বিশ্বে কতগুলো কনটেম্পরারি ইস্যুতে শ্রেণীগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রভেদ তারা তুলে ধরেছে। . সেগুলো কোন কোন ইস্যু? .

গণতন্ত্র, হিজাব, জিহাদ, সংখ্যালঘু অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী অধিকার, ইসলামী রাষ্ট্র, বহুবিবাহ ইত্যাদি। . মনে হচ্ছে না- বহুবিবাহ! সিরিয়াসলি!! এত এত জিনিস থাকতে র্যান্ডও পড়লো বহুবিবাহ নিয়ে!!! . অনেকে বলেন, সমাজে এত এত সুন্নাহ বাকি থাকতে কিছু লোক বহুবিবাহ নিয়ে আলাপ করে কেন। এদের আসলে র্যান্ডের কাছে প্রশ্ন করা উচিত, সালাত, সিয়াম, হাজ্জ, যাকাতের মতো ইসলামের একেবারে বুনিয়াদি সব বিধান বাদ দিয়ে হিজাব, জিহাদ, গণতন্ত্র দিয়ে তারা মুসলিমদের যাচাই করবে কেন। . কেন করবে, তারা বোঝে, বুঝি না আমরা। ইসলামের যতগুলো বিধান আছে সেগুলোর মধ্যে কিছু বিধানকে দুনিয়ার প্রায় সব মুসলিম কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে মানার পক্ষে। আর কতগুলো বিধান আছে যেগুলো এসে গেলে অনেকেই কুরআন সুন্নাহকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের যুক্তি, বিবেক ব্যবহার করে যুগ-সময়ের দোহাই দেয়। নিজের মতো মডার্নাইজ করার চেষ্টা করে। পার্থক্যগুলো তখনই তৈরী হয়। .

 যেমন আপনি কোনও মুসলিমকে দেখবেন না বলবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ে সালাত পাঁচ ওয়াক্ত প্রয়োজন ছিল, এখন সময় বদলেছে, তিন ওয়াক্ত পড়লেই হয়। কিংবা আল্লাহ্র রাসূলের যুগে সাওম ছিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত, এখন অত দীর্ঘক্ষণ না রাখলেও চলে। কেউ বলবে না। . কিন্তু দুনিয়াতে অজস্র মুসলিম আছে যারা বলবে জিহাদ জিনিসটা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে ধর্মীয় ও পলিটিক্যাল কারণে দরকার ছিল, এখন এর দরকার নেই। . এজন্য মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য তুলে ধরতে র্যান্ড মানদণ্ড হিসেবে এমন কতগুলো বিষয়গুলোকে সামনে এনেছে, যা নিয়ে খোদ মুসলিমরাই শতধাবিভক্ত, এবং একটা বড় অংশই এগুলো নিয়ে ডিফেন্সিভ মেন্টালিটিতে বাস করে। এমনই একটা বিষয় হলো বহুবিবাহ। . র্যান্ডের রিপোর্টে বহুবিবাহের ব্যাপারে মুসলিমদের ভাগগুলোর অবস্থান আমি সংক্ষিপ্তরূপে উল্লেখ করছি। আটটা শ্রেণী বলতে গেলে লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় আমি মূল চারটার কথা উল্লেখ করছি। . প্রথম শ্রেণীটি হচ্ছে, ফান্ডামেন্টালিস্ট তথা মৌলবাদী।

 এরা হচ্ছে সেসব মুসলিম যারা কুরআন-সুন্নাহর হুবহু অনুসরণকে মানবমুক্তির একমাত্র পথ মনে করে। এরা ইসলামকে সমাজের সবক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে চায় এবং ইসলামের বিধানগুলোর মধ্যে কোনওরকম পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন নিয়ে আসার পক্ষপাতী নয়। . এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: মৌলবাদীরা মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার প্রধান বাধা। এরা পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং মূল্যবোধের ঘোর বিরোধী। আমেরিকাকে তারা শত্রুজ্ঞান করে। এদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলাটাই আমেরিকার জন্য কার্যকর স্ট্র্যাটেজি হবে। . র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে মৌলবাদীদের অবস্থান: এরা বহুবিবাহকে একটা ভালো প্র্যাক্টিস মনে করে। এরা বিশ্বাস করে পশ্চিমা নৈতিকতা ব্যাভিচার, পরকীয়াসহ নানা অনাচারের জনক। এর বিপরীতে বহুবিবাহ অনেক কল্যাণকর একটি বিধান। . দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে, ট্রেডিশনালিস্ট। এই শ্রেণীতে আছে মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ নরমপন্থী আলেম এবং সংস্কারপন্থী ইসলামিস্ট। তারা ইসলামকে মেনে চলতে চায় তবে মৌলবাদীদের মতো কঠোরভাবে নয়। .

এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: ট্রেডিশনালিস্টরা আমেরিকার জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ না। এদের মধ্যে আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানো সম্ভব। এদেরকে যেকোনমূল্যে মৌলবাদীদের সাথে একত্রিত হওয়া রোধ করতে হবে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। . র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে ট্রেডিশনালিস্টদের অবস্থান: এরা মনে করে বহুবিবাহ জায়েয, তবে অনেক শর্ত আছে। আর বহুবিবাহ জায়েয হলেও একবিবাহই উত্তম। ট্রেডিশনালিস্টদের মধ্যে যারা সংস্কারপন্থী তারা মনে করে রাষ্ট্রীয় আইন যদি অনুমোদন না করে তবে বহুবিবাহ বৈধ নয়। .

 তৃতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে, মডার্নিস্ট। নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এরা ইসলামের আধুনিকায়নে বিশ্বাসী। ইসলামের অনেক বিধানের সরাসরি ইমপ্লিমেন্টেশানকে তারা বর্তমান সময়ে ইম্প্র্যাক্টিক্যাল মনে করে। কুরআন সুন্নাহর পরিবর্তে যুক্তি-বিবেক খাটিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিধানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এরা ইসলামের বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ল্যাসিক্যাল উলামাদের চেয়ে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। এরা মনে করে





রে, মডার্নিজমের প্র্যাক্টিস ইসলামকে বরং শক্তিশালীই করবে। . এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: মডার্নিস্টরা মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার সবচেয়ে মিত্রভাবাপন্ন। পশ্চিমা নৈতিকতা ও ধ্যানধারণার প্রসারে এরাই আমেরিকার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তাই এদেরকে বেশি বেশি প্যাট্রনাইজ করা প্রয়োজন। ক্লাসিক্যাল উলামাদের বক্তব্যের পাশাপাশি মডার্নিস্টদের ব্যাখ্যাকেও মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। . র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে মডার্নিস্টদের অবস্থান: মডার্নিস্টরা বহুবিবাহকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ের জন্য প্রযোজ্য প্রথা মনে করে, যার উপযোগিতা বর্তমান যুগে নেই। .

চতুর্থ শ্রেণীটি হচ্ছে, সেক্যুলার সম্প্রদায়। মুসলিম বিশ্বে যারা সেক্যুলার ধ্যানধারণা লালন করে, রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃথকীকরণের নীতিতে বিশ্বাসী, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলামের হস্তক্ষেপের বিরোধী, তারাই এ শ্রেণীটির প্রতিনিধিত্ব করে। . এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: পশ্চিমা সেক্যুলার গণতন্ত্রের সাথে এদের মতাদর্শের গভীর সম্পর্ক আছে। সে হিসেবে আদর্শিকভাবে এরা মডার্নিস্টদের থেকেও আমেরিকার বড় মিত্র হবার কথা ছিল। কিন্তু অন্যান্য পার্সপেক্টিভে তাদের সাথে আমেরিকার কিছু বিরোধ রয়েছে। যেমন এদের বামপন্থী নীতি, আমেরিকাবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও, মৌলবাদীদের মোকাবিলায় সেক্যুলাররা একটা বড় শক্তি। . র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে সেক্যুলারদের অবস্থান: এরা বহুবিবাহকে অনুমোদন করে না।

জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি দাজ্জালি সিষ্টেম





খালিদ সাইফুল্লাহ

দাজ্জাল vs মুসলিম

জন্ম নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ সেক্স, আযল করা ও ইসলামের বিধান (A-Z বিস্তারিত পড়ুন এবং সচেতন হোন, প্লিজ)

জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের পটভূমি :
জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Birth control) আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই (Malthus) এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হ’ল বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত An essay on population and as it effects, the future improvment of the society. (জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এর প্রভাব) নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস (Francis Place) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন (Charles knowlton) ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত The Fruits of philosophy নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন।

আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন (New Malthusian Movment) নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডাঃ নোল্টনের (Fruits of philosophy) গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডাঃ ড্রাইসডেল (Drysdale)-এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়।

১৮৭৯ সালে মিসেস বাসন্ত-এর রচিত Law of population (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (Birth Control Clinics) খুলে দেয়। [1]

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রকাশ্যে সন্তান হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারণা চলছে। যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’, দুইটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিক গর্ভবর্তী মায়ের সেবার নামে গর্ভপাত ঘটানোর গ্যারেজে পরিণত হয়েছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি :

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দু’প্রকার : (১) সাময়িক ব্যবস্থা ও (২) স্থায়ী ব্যবস্থা।

[১] সাময়িক ব্যবস্থা :

(ক) আযল তথা যোনির ভিতরে বীর্যপাত না করা (With drawal)

(খ) নিরাপদ সময় মেনে চলা (Safe period) ।

(গ) কনডম ব্যবহার। (ঘ) ইনজেকশন পুশ। (ঙ) পেশীতে বড়ী ব্যবহার। (চ) মুখে পিল সেবন ইত্যাদি।

[২] স্থায়ী ব্যবস্থা :

(ক) পুরুষের অপারেশন। (খ) নারীর অপারেশন।

(ক) পুরুষের অপারেশন : পুরুষের অন্ডকোষে উৎপাদিত শুক্রকীটবাহী নালী (Vas deferens) দু’টি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে, কিন্তু বীর্যে xy ক্রমোজম শুক্রকীট না থাকায় সন্তান হয় না। [2]

(খ) নারীর অপারেশন : নারীর ডিম্বাশয়ে উৎপাদিত ডিম্ববাহী নালী (Fallopian Tube কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পূর্ণ xx ক্রমোজম ডিম্ব (Matured Ovum) আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। [3]

নারী অথবা পুরুষে যেকোন একজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অপর জনকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। কারণ নারীর ডিম্ব পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত না হ’লে সন্তানের জন্ম হয় না। [4]

জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল :

জন্মনিয়ন্ত্রণের বহুবিদ কুফল রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-

ব্যাভিচারের প্রসার :

ব্যাভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَاءَ سَبِيْلاً

‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)

কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরও একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তাহ’ল অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হবার আশংকা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়ার ফলে, এ আশংকা থেকে একদম মুক্ত। যারা নৈশক্লাবে নাচ-গান করে, পতিতা বৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে উঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা করে না। তাছাড়া কখনও হিসাব নিকাশে গড়মিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামের সন্তান হত্যার গ্যারেজে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে।

ইংল্যান্ডে প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৮৬ জন নারী বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অবৈধ সন্তান জন্মের সময় এদের শতকরা ৪০ জন নারীর বয়স ১৮-১৯ বছর, ৩০ জন নারীর বয়স ২০ বছর এবং ২০ জন নারীর বয়স ২১ বছর। এরা তারাই যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও এ দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছিল। [5] সেখানে প্রতি তিন জন নারীর একজন বিয়ের পূর্বে সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। ডাঃ চেসার তার রচিত ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন’। [6]

Indian Council for Medical Research-এর ডিরেক্টর জেনারেল অবতার সিংহ পেইন্টাল বলেন, We used to think our women were chaste, But people would be horrified at the level of promise culty here. অর্থাৎ আমাদের নারীদেরকে আমরা সতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অবৈধ যৌনকর্ম এখানে এতবেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লোকে এতে ভীত না হয়ে পারে না। [7]

আমেরিকার বিদ্যালয় সমূহে অশ্লীল সাহিত্যের চাহিদা সর্বাপেক্ষা বেশী। যুবক-যুবতীরা এসব অধ্যয়ন করে অশালীন কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়া হাইস্কুলের শতকরা ৪৫ জন ছাত্রী স্কুল ত্যাগ করার পূর্বে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর এদের যৌন তৃষ্ণা অনেক বেশী। [8] বৃটেনেও শতকরা ৮৬ জন যুবতী বিয়ের সময় কুমারী থাকে না। [9] প্রাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় অধিকাংশ খন্ডকালীন যৌনকর্মী হিসাবে অর্জন করে থাকে। মঙ্গোলয়েড দেশসমূহে যৌন সম্পর্কীয় বিধি-বিধান অত্যন্ত শিথিল। থাইল্যান্ডের ছাত্রীদের বিপুল যৌনতা লক্ষ্য করা যায়। [10]

চীনের ক্যান্টন শহরে কুমারীদের প্রেম বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। [11] পশ্চিমা সভ্যতার পূজারীরা সর্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। [12] চীনে যৌন স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত পোষ্টারে যার সাথে খুশী যৌন মিলনে কুণ্ঠিত না হবার আহবান জানানো হয়। [13] ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার দাবীতে পুরুষের মত নারীরাও নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃংখল ও অনাচারী এবং সুযোগ পেলেই হন্যে হয়ে তৃপ্ত করত যৌনক্ষুধা। অশুভ এই প্রবণতার ফলে বৈবাহিক জীবন ও পরিবারের প্রতি চরম অনিহা সৃষ্টি হয়। [14] অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৭৫ লাখ নারী পুরুষ বিবাহ ব্যতীত ‘লিভ টুগেদার’-এ। [15]

প্রাশ্চাত্যের যুবতীরা যাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে, সেজন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে গর্ভনিরোধের দ্রব্যাদি দেয়া হয় এবং এ সকল দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়ে তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। এমনকি মায়েরা কন্যাদেরকে এই সকল দ্রব্য ব্যবহারের কায়দা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদির ব্যবহার সম্পর্কে স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বের করে এবং বিশেষ কোর্সেরও প্রবর্তন করে। এর অর্থ হ’ল- সকলেই নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছে যে, যুবক-যুবতীরা অবৈধ যৌন সম্ভোগ করবেই। [16]

প্রাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সবচাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান জন্ম, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ ও যৌন ব্যাধিই এর প্রমাণ। অপর দিকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে কোন আইন-বিচার ও আইনী শাস্তির বিধান নেই। বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। [17]

সম্প্রতি ভারতেও অবৈধ যৌন সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর নির্বিঘ্নে বিবাহ বন্ধন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত ঘটানোর হিড়িক পড়ে গেছে।

জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব :

নারীর ব্যাভিচার দিনদিন প্রসার লাভ করে চলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মারাত্মক জটিল সব রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণু নাশক ঔষধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণা কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তেই নারী দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃংখলা (Nervous instability) দেখা দেয়। যেমন- নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষমেজায, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যান্সার, অনিয়মিত ঋতু, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। [18] নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গণরিয়া, এমনকি এইডস-এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়। [19]

সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি হয়। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচ. আই. ভি (HIV)। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ. আই. ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন। [20] বল্গাহীন ব্যাভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। [21]

এছাড়া জন্ম নিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে নানা প্রকার রোগ বদঅভ্যাসের প্রসার ঘটেছে। তন্মধ্যে কনডম ব্যবহার বা আযল করার জন্য নারীরা মিলনে পরিতৃপ্ত না হ’তে পেরে অবৈধ মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, স্তনচাকা বা পিন্ড, স্তন ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে স্তনে এ ধরনের ব্যথা ও পিন্ড তৈরী হয় এবং ৭৫% নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে। [22] বুক ও জরায়ুর কার্সিনোমা হ’তে পারে শর্করা জাতীয় খাদ্য সহ্য হয় না, লিভার দুর্বল হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যহত হয়, বুকের দুধ কমে যায় এবং Lactation কম হয় এবং দেহে ফ্যাট জমা হয়। [23] এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও স্থানচ্যুতি সহ আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জন্মের হার কমে যাওয়া :

আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করেন

وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ

‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’(ইসরা ১৭/৩১)

কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল,

وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ

‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)

এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্রের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সেজন্যেই ক্রমশঃ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে হরাস পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বংশধর উৎপাদন ব্যাহত হ’লে মানব জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী সক্রিয় হবে।

জাহেলী যুগে সন্তানের আধিক্য থেকে বাঁচার জন্য লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত। গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে, সবগুলোই মানব বংশ ধ্বংসের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ। [24]

জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করেছে। [25] জন্মনিয়ন্ত্রণ জন্মহার হরাসের একমাত্র কারণ না হ’লেও অন্যতম প্রধান কারণ একথা নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হরাস পাওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ জন্ম নিয়ন্ত্রণের দরুণ ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের জন্ম হার হরাস প্রাপ্তির কারণ গুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার কারণেই জন্মহার হরাস পাচ্ছে। [26]

ফ্রান্স সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। একশত বছর পর সেখানে প্রতিটি যেলায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমে যেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার হার কমে যাওয়ার ফলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বে তার প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়। [27]

ফিডম্যান বলেন, সমষ্টিগতভাবে আমেরিকান শতকরা ৭০টি পরিবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে জন্মনিরোধের প্রচেষ্টা। [28] যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্যের লোকেরা জন্ম নিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর সভ্যতার কারণে অন্যান্য জাতিও বিপদের সম্মুখীন।

সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাতে ক্রমশঃ পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালবাসা হ্রাস এবং অবশেষে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তাছাড়া নারীদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে বৈকল্য দেখা দেয় এবং তার মেজাজ দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠে, ফলে দাম্পত্য জীবনের সকল সুখ-শান্তি বিদায় নেয়। সন্তানই স্বামী-স্ত্রীকে চিরদিন একত্রে সংসার গঠনের ভূমিকা রাখে। এজন্য বলা যায়, সন্তানই পরিবার গঠনের সেতুবন্ধন।

ইউরোপ ও আমেরিকাতে দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং জন্মনিরোধ আন্দোলন প্রসারের সঙ্গে তালাকের সংখ্যাও দিন দিন দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, সেখানে এখন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। [29]

সমস্ত ইউরোপের সামাজিক দৃশ্যপট বদলে যায় শিল্প বিপ্লবের অভিঘাতে। আমূল পরিবর্তন আসে গ্রামীন জীবনেও, ভেঙ্গে যায় পারিবারিক জীবনের ভিত। নারীরা কল-কারখানায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে শুরু করে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান তরুণ নিহত হ’ল। ফলে বিধবা হ’ল অগণিত নারী। যুদ্ধ বিড়ম্বিতা নারীরা বাধ্য হয়ে পুরুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে কারখানা মালিকের নিকটে শ্রম বিক্রয়ের পাশাপাশি কমনীয় দেহটাও মনোরঞ্জনের জন্য দিতে হ’ল। যৌবনের তাড়নায় ইন্দ্রিয় ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য তাকে বেছে নিতে হ’ল অবাধ বিচরণের পথ। আর নারীর মনের গভীরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হ’ল অতৃপ্ত যৌনতা এবং দামী পোশাক ও প্রসাধনীর প্রতি প্রচন্ড মোহ। [30]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে চরিত্রের ক্ষতি সাধিত হয়। এ ব্যবস্থা নারী-পুরুষের অবাধ ব্যভিচারের সনদ দিয়ে থাকে। কেননা এতে জারজ সন্তান গর্ভে ধারণ ও দুর্নাম রটনার ভয় থাকে না। এজন্য অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। Dr. Westr Marck তার বিখ্যাত গ্রন্থ Future of Marriage in Western Civilaization-এ বলেন, গর্ভনিরোধ বিদ্যা বিয়ের হার বাড়াতে পারে। কিন্তু এর ফলে বিয়ে বন্ধন ছাড়াই যৌন মিলনের পথও অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায়। [31]

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে শিশুরাও তাদের মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়। যদি অন্য ছোট-বড় ভাই বোন খেলার সাথী হিসাবে থাকে, তবে তাদের সাথে একত্রে থাকা ও মেলামেশা, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি শিক্ষণীয় গুণাবলী তার মাঝেও প্রস্ফুটিত হয়। মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, একাকিত্বের ফলে শিশুদের মন-মগজের সুষ্ঠু বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এমনকি দু’টি শিশুর বয়সের পার্থক্য বেশী হ’লে নিকটস্থ ছোট শিশু না থাকার কারণে বড় শিশুটির মস্তিষ্কে (Neurosisi) অনেক ক্ষেত্রে রোগও সৃষ্টি হয়। [32]

অর্থনৈতিক ক্ষতি :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি এ সমস্ত উপকরণ ব্যবহারের জন্য জাতীয় রাজস্বে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। এটাকে এক ধরনের অপচয় বললেও ভুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তোমরা) অপব্যয় কর না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (ইসরা ১৭/২৭)

‘খাও ও পান কর, অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পসন্দ করে না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)

বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ জনসংখ্যা হ্রাস জনিত যুক্তি দিন দিন অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হ’ল- জন্মহার ধারাবাহিকভাবে (Topering) কমে যাওয়ার ফলে একদিকে পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হরাস পায়। পক্ষান্তরে বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। [33] কেনসি হাসান বলেন, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করলে সমাজের অর্থনৈতিক তৎপরতাও অনেক বেড়ে যায়। সে সময় সম্প্রসারণকারী শক্তিগুলি (Expansive) সংকোচনকারী শক্তিগুলির (Contractive) তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়। তখন অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। আর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা হ্রাস পায়।

প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানী করে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। এই বিশাল জনসংখ্যা যদি শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, তাহ’লে এ জনসংখ্যা ক্ষতির কারণ না হয়ে আশীর্বাদের কারণ হবে। যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রাজস্ব খাতে বিরাট ভূমিকা রাখছে, নিশ্চয়ই তা বেকারত্ব দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

অন্যথা ‘পরিবার পরিকল্পনার’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে জনশক্তির অপমৃত্যু, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবক্ষয়। এই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় কনডম, ইনজেকশন, বড়ি ও খাবার পিল ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে যে খাবার পিল বিতরণ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিন্তু বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী যে পিল বের করেছে তা উচ্চ মূল্যে (৫০-৮০ টাকা) ক্রয় করে জনগণ ব্যবহার করছে। এতে পুঁজিবাদীরা জনগণের পকেট ফাঁকা করে চলেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে।

গ্রামাঞ্চলে একটি শিশুর জন্ম দানের জন্য এত টাকা ব্যয় করতে হয় না, যত টাকা ব্যয় করতে হয় জন্মনিরোধ উপকরণাদি ক্রয়ের জন্য। [34]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে শ্রমজীবী লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলে পুঁজিবাদীরা উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানী করে মিল-কারখানায় উৎপাদন করছে। এতে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা হরাস পাওয়ার ফলে পণ্যের ব্যবহারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে আসছে। অতএব জন্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের কোন সুফল বয়ে আনেনি বরং অর্থনৈতিক ও নৈতিকতার মহা ক্ষতির কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান :

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। কিন্তু মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল কি? যদি একটু চিন্তা করি, তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-এর একাকীত্ব দূর করতে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে হাওয়া (আঃ)-কে শুধু সৃষ্টি করেননি। বরং আরও একটি বিশেষ কারণে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’ল মহান আল্লাহ তাদের ঔরশজাত সন্তান দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। আর সমস্ত মানব তাঁর (আল্লাহর) একত্ব ঘোষণা পূর্বক দাসত্ব করবে। এ হ’ল আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টির একান্ত উদ্দেশ্য। আমরা সেই অনাগত সন্তানদের নির্বিঘ্নে হত্যা করে চলেছি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

َوَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ

‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই রিযিক দান করব’ (আন‘আম ৬/১৫১)

আলোচ্য আয়াতে খাবারের অভাবের আশংকায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই দিব’। ‘আমিই দিব’ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা হ’ল অনাগত সন্তানদের রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর খাদ্য ভান্ডারে খাবারের হিসাব অকল্পনীয়। আবার তিনি বললেন,

‘নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক ভুল’ (ইসরা ১৭/৩১)

তিনি যথার্থই বলেছেন, অনাগত সন্তান হত্যা করা বিরাট ভুল। ভূপৃষ্ঠে একচতুর্থাংশ স্থল, বাকী সব সাগর, মহাসাগর। কিন্তু বর্তমানে মহাসাগরে হাওয়াইন দ্বীপপুঞ্জের মত ছোট-বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে এবং নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের আবাদী জমি ও বাসস্থান বাড়ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (কাহাফ ১৮/৪৬)

আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায়। আর সন্তান হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। [35]

জনৈক রুশ লেখক তার Biological Tragedy of Woman গ্রন্থে বলেছেন, নারী জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানববংশ রক্ষা করা। [36] যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য মানববংশ বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর। নারী দেহের বৃহত্তম অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। [37] মা হাওয়াসহ পৃথিবীর সমস্ত নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানব বংশ রক্ষা ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোতে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন।

আযল-এর বিধান :

প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আযল’ করার যে প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হাদীছে স্পষ্ট আলোচনা আছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-

১. জাবির (রাঃ) বলেন,

كُنَّا نَعْزِلُ وَالْقُرْآنُ يَنْزِلُ

‘আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম অথচ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। [38]

অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে ‘আযল’ সম্পর্কে কোন নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা নিষেধ করেননি।

২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,

আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে (দাসী) বন্দী করে নিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রমণীদের প্রতি আকর্ষণ জাগে। যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে উঠে এবং এ অবস্থায় ‘আযল করাকেই আমরা ভাল মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাবে বললেন, তোমরা যদি তা কর তাতে তোমাদের ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন, তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। [39]

৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

তুমি কি সৃষ্টি কর? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখ, সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা রয়েছে। [40]

ইবনে সীরীন-এর মতে, لاعليكم ان لاتفعلوا এ বাক্যে ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধের একেবারে কাছাকাছি এতে কোন সন্দেহ নেই। [41]

হাসান বছরী বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলের একথায় ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট ভৎর্সনা ও হুমকি রয়েছে। [42]

ইমাম কুরতুবী বলেছেন, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় রাসূল (ছাঃ) যেন বলেছেন, لاتعزلوا وعليكم ان لاتفعلوا তোমরা ‘আযল’ কর না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য। [43]

রাগিব ইসফাহানীর মতে, ‘আযল’ করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থানে নিক্ষেপ না করা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ। [44]

মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন যে, ইবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম যাঁরা ‘আযল’ পসন্দ করতেন না। [45]

عزل অর্থ হ’ল, পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া যেন শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভেতরে স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়।[46]

আইয়ামে জাহেলিয়াতে যেসব কারণে সন্তান হত্যা করা হ’ত, বর্তমান যামানায় জন্মনিয়ন্ত্রণও ঠিক একই কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী যুগের ‘আযল’-এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে যুগে তিনটি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আযল’-এর প্রচলন ছিল।

(এক) দাসীর গর্ভে নিজের কোন সন্তান জন্মানো তাঁরা পসন্দ করতেন না, সামাজিক হীনতার কারণে।

(দুই) দাসীর গর্ভে কারো সন্তান জন্মালে উক্ত সন্তানের মাকে হস্তান্তর করা যাবে না, অথচ স্থায়ীভাবে দাসীকে নিজের কাছে রেখে দিতেও তারা প্রস্ত্তত ছিল না।

(তিন) দুগ্ধপায়ী শিশুর মা পুনরায় গর্ভ ধারণ করার ফলে প্রথম শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশংকা অথবা পুনরায় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মায়ের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের আশংকা, কিংবা সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার অনুপযুক্ত তা চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযোগ্য বিবেচনায় এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

উপরোক্ত তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম দু’টি কারণ আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হয়েছে। শেষের তিন নম্বর কারণ ব্যতিরেকে সম্পদ সাশ্রয়ের জন্য ও নিজের আমোদ-প্রমোদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ নয়।


পরিশেষে বলব, জন্মনিয়ন্ত্রণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। বরং জনসংখ্যাকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদন বাড়ানো, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়ণের মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে না বুঝে পরাজয় বরণ করা। একটি কাপড় কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হ’লে কাপড়টি বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের যুগে আমরা মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!!



[1] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃঃ ১৩-১৫।
[2] . ডা. এস.এন. পান্ডে, গাইনিকলজি শিক্ষা, (কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭), পৃঃ ১২৪।
[3] . ঐ, পৃঃ ১২৫।
[4] . ঐ, পৃঃ ১৪।
[5] . Sehwarz Oswald, The Psycology of Sex (London : 1951), P. 50.
[6] . Cheser Is Chastity Outmoded, (Londen : 1960), P. 75.
[7] . নারী ৯৭ পৃঃ; হাফেয মাসঊদ আহমদ; আত-তাহরীক (বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে নারী : একটি সমীক্ষা-) (৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা জানুয়ারী ২০০৩), পৃঃ ৪
[8] . George Lindsey, Revolt of Modern Youth P-82-83.
[9] . দৈনিক ইনকিলাব, ৬ই জুন ১৯৯৮ ইং।
[10] . মাসিক পৃথিবী (প্রশ্চাত্যে যৌন বিকৃতি, জুলাই ২০০১ইং, পৃঃ ৫২-৫৩।
[11] . জহুরী খবরের খবর, ১ খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[12] . মরিয়ম জামিলা, ইসলাম ও আধুনিকতা, ৯৯ পৃঃ।
[13] . খবরের খবর, ১ম খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[14] . সায়্যেদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, ৯৮ পৃঃ।
[15] . দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ এপ্রিল ২০১১, পৃঃ ৫।
[16] . নারী, পৃঃ ৮৫; আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০০৩, পৃঃ ৪।
[17] . ইসলাম ও আধুনিকত, পৃঃ ২৩।
[18] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬২।
[19] . Her self, Dr. Lowry, P-204.
[20] . কারেন্ট নিউজ (ডিসেম্বর সংখ্যা ২০০১), পৃঃ ১৯।
[21] . The New Straits Jimes, (Kualalampur, Malaysia, 23 june 1988), P-9.
[22] . প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১০, পৃঃ ৪।
[23] . গাইনিকলজি শিক্ষা, পৃঃ ১২৩।
[24] . মাওলানা আব্দুর রহিম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।
[25] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১২৮।
[26] . Report of the Royal Commission on population (1949), P-34.
[27] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১১২।
[28] . Family Planning Sterility and Population Growth (Newyork : 1959), P-5.
[29] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৮-৬৯।
[30] . ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৯৮-১০১।
[31] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৯।
[32] . David M Levy, Maternal Over Protiction- (Newyork : 1943), P-35.
[33] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৭৩।
[34] . British Medical Journal, (London : 8 July, 1961), P-120.
[35] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৪০।
[36] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৫৮।
[37] . The Psychology of Sex, P-17.
[38] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৪।
[39] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৬।
[40] . সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০৩৮।
[41] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩।
[42] . ঐ।
[43] . ঐ।
[44] . ঐ, পৃঃ
[45] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১০১-১০২।
[46] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।

সুন্নাত ও বিদায়াতের পরিচয়



পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের হিদায়াতের জন্য যুগে যুুগে আম্বিয়ায়ে কিরাম (আ.)কে প্রেরণ করেছেন। সেই সুমহান ধারার সর্বশেষ পয়গাম্বর হলেন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আল্লাহ তা‘আলা সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করা, তাঁর অনুসারী হওয়া, তাঁকে সম্মান করা সকল উম্মতের মুহাম্মদী তথা সকল মুসলমানের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসার প্রতি তাগিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন-

قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

“(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ¶মা করে দিবেন। আর আল্লাহ পরম ¶মাশীল দয়ালু। (সূরাহ আলে-ইমরান, আয়াত : ৩১)

এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি বা মহব্বত লাভ করার জন্য হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করাকে শর্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে যত বেশী মহব্বত করবে, তার অনুকরণ-অনুসরণে যে যত বেশী যত্নবান হবে, সে তত বেশী আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা ঈমানের দাবী-এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভালবাসার কিছু ধাপ বা স্তর রয়েছে। যেমন, আমরা আমাদের মাকে ভালবাসি, স্ত্রীকেও ভালবাসি, আবার কন্যাকেও ভালবাসি। এখন প্রশ্ন হল, মায়ের ভালবাসা যেমন স্ত্রীকে দেয়া যাবে না, তেমনি স্ত্রীর ভালবাসা মাকে দেয়া যাবে না। আবার কন্যার ভালবাসা যেমন স্ত্রীকে দেয়া যাবে না, তেমনি স্ত্রীর ভালবাসাও কন্যাকে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সকল ভালবাসাকে যদি সমান্তরালে মূল্যায়ন করা হয়, তবে সামাজিক ও পারিবারিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।

জাগতিক ক্ষেত্রে যেমন ভালবাসার শ্রেণী বিন্যাস রয়েছে, আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসার ক্ষেত্রেও তেমনি সংশ্লিষ্ট ধাপ বা স্তর রয়েছে। সুতরাং মহান আল্লাহকে তাঁর রবুবিয়্যাত অনুযায়ীই মহব্বত করতে হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের আসনেই মহব্বত করতে হবে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের কিছু বাতিল বিদ‘আতপন্হী লোক আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বতের এ সীমাকে লংঘন করে আল্লাহর বিভিন্ন রবুবিয়্যাতের গুণকে রাসূলের জন্য সাব্যস্ত করে। এভাবে তারা নবীজীকে ভালবাসার নামে এমন কিছু আকীদা পোষণ করে থাকে-যা সরাসরি শিরক কিংবা বিদ‘আত। তারা নবীজীর জন্ম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে মনগড়া কাল্পনিক কিছু অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তেমনি মীলাদের নামে মনগড়া গলদ তরীকায় দরূদ পাঠ করে, নবীজীকে হাজির-নাজির বিশ্বাস করে মীলাদের মজলিসে দাঁড়িয়ে কিয়াম করে, নবীজীকে ইলমে গাইবের অধিকারী মনে করে, তাঁকে মুখতারে কুল বিশ্বাস করে ইত্যাদি শিরকী আকীদা পোষণ করে এবং বিভিন্ন বিদ‘আত কাজ করে।

ইসলাম মহান আল্লাহর সর্বশেষ পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবন বিধান। এর মধ্যে কোন প্রকার সংযোজন-সংকোচন বা সংশোধন কিংবা পরিবর্তন-পরিবর্ধেনর অবকাশ নেই। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের ৮১ দিন পূর্বে দশম হিজরী সনের ৯ জিলহজ্জ শুক্রবার বাদ আসর বিদায় হজ্বের দিনে সোয়া ল¶ সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর বিশাল সমাবেশে ইসলামের পূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার প¶ থেকে পবিত্র কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-

اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا

“আজকের দিনে তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করলাম। ”

(সূরাহ মায়িদা আয়াত, আয়াত নং ৩)

উপর্যুক্ত আয়াতে কারীমা থেকে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। আর আকীদা ও আমলের সমষ্টির নাম হল দ্বীন। সুতরাং আমল ও আকীদা কোনটিতেই কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার অবকাশ নেই। এ উভয় ক্ষেত্রে হিদায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি মৌলিকভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

অতএব, শরীয়তের দলীল দ্বারা সমর্থিত নয়-এমন কোন বিষয় যদি দ্বীনের সাথে কেউ সংযোজন করে, তবে তা হবে বিদ’আত। আর সংযোজনকারীকে বলা হবে বিদ’আতী।

সুন্নাত ও বিদ’আত দুই বিপরীতার্থক আরবী শব্দ। ইসলামী তাহযীবের যতগুলো মৌলিক পরিভাষা রয়েছে, যে সব পরিভাষার উপর ইসলামী জীবন ব্যবস্হার সম্যক অনুধাবন নির্ভরশীল, এ দু’টো শব্দ তারই মধ্যে গণ্য। এ দু’টো শব্দের সঠিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ এবং এ দু’টোর দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের আকীদা ও আমল-আখলাক যাচাই ও পরখ করা একান্তভাবে জরুরী।

বস্তুত সুন্নাত ও বিদ‘আত সম্পর্কে সম্যক অবগতির অভাবে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বিভিন্ন ভ্রান্তির জাল বিস্তার লাভ করে। অপরদিকে দ্বীনের কাজ নয় বা কোন প্রকার সাওয়াবের কাজ নয়, এমন কোন বিষয়কেও অতি পুণ্যের কাজ মনে করা হয়।

আলোচ্য প্রবন্ধে সুন্নাত ও বিদ’আত-এর সংজ্ঞা এবং উভয়ের পার্থক্যের বিশদ আলোচনার পাশাপাশি কতিপয় কুরআন ও সুন্নাহ বিবর্জিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর মাসলাকের বিরোধী কিছু শিরক ও বিদ’আতী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

 

সুন্নাত শব্দের অর্থ


সুন্নাত (السّنَّۃَ)-এর আভিধানিক অর্থ : পথ। যেমন, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

سُنَّۃَ اللّٰہِ الَّتِیۡ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلُ ۚۖ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّۃِ اللّٰہِ تَبۡدِیۡلًا

“আল্লাহর সুন্নাত-যা পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে রয়েছে এবং আল্লাহর এ সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন দেখবে না কখনো। ” (সূরাহ ফাতাহ, আয়াত : ২৩)

পবিত্র কুরআনে এই সুন্নাতকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَنَّ ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

“নিশ্চয়ই এ হচ্ছে আমার সঠিক সফল দৃঢ় পথ। অতএব, তোমরা এ পথই অনুসরণ করে চলবে। এ ছাড়া অন্য পথের অনুসরণ করবে না। তা করলে তোমাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের এরূপ-ই নির্দেশ দিয়েছেন; যেন তোমরা ভয় করে চল। ” (সূরাহ আন‘আম, আয়াত নং ১৫৩)

আলোচ্য আয়াতে কারীমায় ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ বলতে সেই বিষয়ই বুঝানো হয়েছে, যা বোঝায় ‘সুন্নাত’ শব্দ থেকে।

সুন্নাত শব্দের পারিভাষিক অর্থ
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ, আদত-অভ্যাস এবং তাঁর কার্যানুমোদন অর্থাৎ তিনি যা করেছেন ও করতে বলেছেন এবং তাঁর সামনে যা করা হয়েছে-যাতে তিনি তাতে কোনরূপ আপত্তি করেননি, তৎসমুদয় কাজই হলো মূলত রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত।

সেই সাথে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং তাবিয়ীন ও তাবে-তাবিয়ীন (রহ.)গণের দ্বীন সম্পর্কীয় কথা, আকীদা-বিশ্বাস এবং আমল-আখলাকও রাসূলে কারীমের নির্দেশানুযায়ী সুন্নাতের অন্তভর্ুক্ত। যেমন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عَلَيْكُم‘ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الخُلَفَاءِ الرَّشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ

“আমার সুন্নাত এবং আমার সত্যানুসারী খলীফাগণের সুন্নাত তোমাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। ”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে ইরশাদ হয়েছে-

وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ

“তোমরা যদি তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে গোমরাহ হয়ে যাবে। ” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৪))

রাসূলের সুন্নাত মানে রাসূলের আদর্শ, রাসূলের কর্মবিধান। আর তা অনুসরণ না করা মানে তার বিপরীত কর্মাদর্শ মেনে চলা। তাহলে যে লোক রাসূলের বিপরীত কর্মাদর্শ পালন ও অনুসরণ করে চলবে, সে কিছুতেই ইসলামপন্হী হতে পারে না। সে কখনো মুসলিম হতে পারে না।



বিদ‘আত শব্দের অর্থ


বিদ‘আত (اَلْبِدْعَةُ)-এর আভিধানিক অর্থ : কোনরূপ পূর্ব-নমুনা না দেখে এবং অন্যকিছুর অনুকরণ-অনুসরণ না করেই কোন কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা। আর দ্বীনের ক্ষেত্রে যে বিদ‘আত সংঘটিত হয়ে থাকে, তার সংজ্ঞা হল-দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদ‘আত হচ্ছে এমন কোন বিষয় নবআবিষ্কার করা, যার অস্তিত্ব পূর্বে ছিলো না এবং যার প্রতি শরীয়তে কোনরূপ অনুমোদন নেই। তা শরীয়তের নিয়ম হিসেবে বা ছাওয়াবের কাজ মনে করে করাই হচ্ছে বিদ‘আত। (মিরকাত শরহে মিশকাত)

ইমাম নববী (রহ.) বলেন-“শরীয়তে এমন সব কাজ করা বিদ‘আত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। ”

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) বলেন-“হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল না এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করাকেই শরীয়তের পরিভাষায় বিদ’আত বলা হয়। (মিরকাত)

বিদ‘আত সম্পর্কে হাদীস শরীফে সতর্ক করা হয়েছে। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ

“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে-যা এই দ্বীনের মধ্যে নেই, তা বাতিল বলে গণ্য হবে। ”

(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন-“যে লোক ইসলামে এমন কোন বিষয় প্রবেশ করাবে এবং তাকে ইসলামের কাজ বলে চালিয়ে দিবে, যার অনুকূলে কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল বিদ্যমান নেই, তা-ই প্রত্যাহারযোগ্য। আর এরই অপর নাম বিদ‘আত। ” (মিরকাত, শরহে মিশকাত)

আল্লামা আইনী (রহ.) স্বীয় উমদাতুল ক্বারী গ্রন্হে বলেন-“মূলত বিদ‘আত হল এমন নতুন কাজ আবিষ্কার করা যার কোন অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল না।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বুখারী শরীফের শরাহ-গ্রন্হ ‘ফাতহুল বারী’তে বলেন-“বিদ‘আতের অর্থ হলো-এমন নতুন কাজ-যার কোন দৃষ্টান্ত পূর্ববতর্ী যুগে নেই। আর শরীয়তের পরিভাষায় যা সুন্নাতের পরিপন্হী, তা নিন্দনীয়।

মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (রহ.) ‘তা‘লীমুল ইসলাম’ কিতাবে বলেন-“বিদ‘আত ওই বিষয়গুলোকে বলা হয়, যার ভিত্তি শরীয়তে বিদ্যমান নেই। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসে যার দলীল পাওয়া যায় না এবং সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়ীন ও তাবি-তাবিয়ীনদের যুগে যার অস্তিত্ব ছিল না, অথচ দ্বীনের কাজ মনে করে তা পালন করা হয়।

মাওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানী (রহ.) স্বীয় তাফসীরগ্রন্হে বলেন-“কুরআন-সুন্নাহ এবং খাইরুল কুরুন অর্থাৎ প্রাথমিক তিন যুগে যে কাজের মূল ভিত্তি নেই, তা দ্বীনের কাজ মনে করে করাই হলো বিদ‘আত।

 

বিদ‘আতের প্রকারভেদ


সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত ধারণা হল-বিদ‘আত দু’প্রকার। একটি হলো বিদ‘আতে হাসানাহ অর্থাৎ ভাল বিদ‘আত এবং অপরটি হলো বিদ‘আতে সাইয়্যিআহ অর্থাৎ মন্দ বিদ‘আত। বিদ‘আতের এই বিভাগও একটি অভিনব বিদ‘আত। কেননা, বিদ‘আত মাত্রই মন্দ। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে- كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ“প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। ” সুতরাং বুঝা গেলো-ইসলামে ভাল বিদ‘আত বলতে কিছু নেই।

অথচ একশ্রেণীর মানুষ বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ দু’ভাগে করে বহুসংখ্যক বিদ‘আতকে ভাল বানানোর প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। যা নিতান্তই নিন্দনীয়।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং তাদের ভ্রষ্ট পথ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। যেমন, তিনি প্রায়ই খুতবায় ইরশাদ করেন-

إِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ

“সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হিদায়াত হলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথনির্দেশনা। আর সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হলো নব-আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ। অনন্তর প্রতিটি বিদ‘আত গোমরাহী এবং প্রতিটি গোমরাহী দোজখের মধ্যে পড়বে। ” (সহীহ বুখারী)

অপর এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ , وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ

“সাবধান, তোমরা নব-আবিষ্কৃত কাজসমূহ থেকে দূরে থাকবে। কারণ, প্রতিটি নব-আবিষ্কৃৃত কাজই বিদ‘আত আর প্রত্যেক বিদ‘আতই হচ্ছে গোমরাহী। ” (সুনানে আবু দাউদ)

বস্তুত বিদ‘আতে হাসানা বা সাইয়্যিআহ-এর যে বিভক্তি করা হয়, আসলে তা হলো আভিধানিক অর্থে, শরীয়তের পরিভাষায় নয়। যেমন-হযরত উমর (রা.) জামা’আত সহকারে নিয়মিত ২০ রাক‘আত তারাবীহ আদায়ের আয়োজনকে উত্তম বিদ‘আত বলেছেন। এটা তিনি বলেছেন আভিধানিক অর্থ হিসেবে অর্থাৎ বিষয়টি নতুনভাবে ইন্তিজামের সাথে চালু করা হয়েছে-যদিও তার আমল ইসলামে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিলো।

অনুরূপ দ্বীনী ইল্‌মকে জিন্দা রাখার জন্যে নিয়মিত মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, কুরআন হাদীসের সঠিক জ্ঞানলাভের জন্যে নাহু, সরফ, বালাগাত, মান্তেক ইত্যাদি ইলমের অধ্যায় তৈরী করা, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের নব-আবিষ্কৃৃত যানবাহন এবং যোগাযোগের যাবতীয় যন্ত্রপাতি, মাইক্রোফোন, টেলিফোন, মোবাইল, রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার ইত্যাদি এবং বাসা-বাড়ীর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন-বিদ্যুৎ, লাইট, ফ্যান, এসি, ফ্রিজ ইত্যাদি নব-শাব্দিক অর্থে আবিষ্কৃত হলেও পারিভাষিক অর্থে বিদ‘আত নয়। কেননা, এগুলো কেউ ইসলামের আমল বা ছাওয়াবের বিষয় মনে করে ব্যবহার করে না। দুনিয়াবী জরুরতের জন্য ব্যবহার করে।

সুতরাং মূলকথা এই দাঁড়ালো যে, সুন্নাতে রাসূলের মধ্যে নেই বা সাহাবায়ে কিরামের আমলেও নেই অথবা আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ইজতিহাদপ্রসূতও নয়, বরং তাদের যুগের পরের লোকেরা নিজেদের খেয়াল-খুশী তো ইবাদত-বন্দেগীর নামে যেসব নতুন বিষয় সৃষ্টি করেছে অথবা খাইরুল কুরুনের কোন বিষয়ের মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-সংকোচন বা সংশোধনের পথ অবলম্বন করা হয়েছে, এসবই হলো মনগড়া আমল বা বিদ‘আত।

সকল মুসলমানের এ বিদ‘আত থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। বরং সকলের ঈমানী দায়িত্ব হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত অনুসারে জীবন নির্বাহ করা।

সমকামি এজেন্ডাঃ ব্লু-প্রিন্ট




 ১৯৮৭ সালে অ্যামেরিকান ম্যাগাযিন ‘গাইড’ এর নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় মার্শাল কার্ক এবং হান্টার ম্যাডসেনের লেখা প্রায় ৫০০০ শব্দের একটি আর্টিকেল। দু’বছর পর নিউরোসাইক্রিয়াট্রি রিসার্চার কার্ক এবং পাবলিক রিলেইশান্স কনসালটেন্ট ম্যাডসেন একে পরিণত করেন ৩৯৮ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে। হান্টার ও ম্যাডসেনের এই আর্টিকেল উপস্থাপিত ধারণা ও নীতিগুলো পরবর্তী ৩ দশক জুড়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে রাজনীতি, মিডিয়া, অ্যাকাডেমিয়া, বিজ্ঞান, দর্শন ও চিন্তার জগতে। সারা বিশ্বজুড়ে। সমকামীদের ম্যাগাযিন গাইডে প্রকাশিত মূল আর্টিকেলটির নাম ছিল “The Overhauling of Straight America ”। ৮৯ তে প্রকাশিত সম্প্রসারিত বইয়ের নাম দেওয়া হয় - After the Ball: How America Will Conquer Its Fear and Hatred of Gays in the 90s.  কার্ক ও ম্যাডসেনের উদ্দেশ্য ছিল সিম্পল –সমকামিতা ও সমকামিদের প্রতি অ্যামেরিকানদের মনোভাব বদলে দেওয়ার জন্য একটি স্টেপ বাই স্টেপ ব্লু-প্রিন্ট বা ম্যানুয়াল তৈরি করা।  কিন্তু কেন প্রায় তিন দশক পর বাংলাদেশে বসে কার্ক-ম্যাডসেনকে নিয়ে চিন্তা করা? কার্ক-ম্যাডসেনের নাম শুনেছেন বা তাদের লেখার সম্পর্কে জানেন এবং মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। শুধু বাংলাদেশেই না, বিশ্বজুড়েই। কিন্তু তাদের ব্লু-প্রিন্টের প্রভাব কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করে নি এমন সমাজ বা রাষ্ট্র খুজে পাওয়াটাও কঠিন।

গত ৩০ বছরে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরন, সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমকামিতার মধ্য এতোটা অস্বাভাবিক একটি বিষয়ের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রায় হুবহু মিলে যায় কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের সাথে। আর বাংলাদেশেও সমকামিতার প্রচার, প্রসার এবং সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা তৈরির জন্য এখন এই একই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে, একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।  বর্তমানে ২২টি দেশে সমলৈঙ্গিক ‘বিয়ে’ আইনগত ভাবে স্বীকৃত। কোন আগ্রাসী সেনাবাহিনী শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এদেশগুলোর জনগোষ্ঠীর উপর সমকামিতা চাপিয়ে দেয় নি। তবে নিঃসন্দেহে মানুষের স্বভাবজাত মূল্যবোধ, ফিতরাহর বিরুদ্ধে গিয়ে জঘন্য একটি বিকৃতিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেওয়া, মানুষের মাঝে এই বিকৃতির গ্রহনযোগ্য তৈরি করা একটি যুদ্ধের অংশ। এই যুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক, আদর্শিক। এই যুদ্ধ সর্বব্যাপী এবং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপনি এই যুদ্ধের অংশ। আর এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের স্ট্র্যাটিজির মূল ভিত্তি কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট। আর তাই কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট সম্পর্কে জানা, শত্রুর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানা একটি আবশক্যতা, কোন অ্যাকাডেমিক কৌতুহল না। তবে কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের দিকে তাকানোর আগে গত তিন দশকে এর অর্জিত সাফল্যের দিকে একটু তাকানো যাক।


The Overhauling of Straight America 

       একটা সহজ উদাহরন দিয়ে শুরু করা যাক। Gallup এর হিসেব অনুযায়ী ৮৭-তে, অর্থাৎ আর্টিকেলটি লেখার সময়, যাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ৩২% সমকামি সম্পর্ক বৈধ হওয়া উচিৎ বলে উত্তর দিয়েছিল। ৫৭% বলেছিল এধরনের কাজ সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ঘোষণা করা উচিৎ। ত্রিশ বছর পর ২০১৭ তে এসে দেখা গেল ব্যাপারটা প্রায় পুরোপুরি উল্টে গেছে। ৬৪% উত্তরদাতা এখন মনে করেন এধরনের বিয়ে বৈধ হওয়া উচিৎ, আর মাত্র ৩৪% এর বিরুদ্ধে [১]। ১৯৮৯ সালে ১৯% উত্তরদাতা বিশ্বাস করতেন মানুষ জন্মসূত্রে সমকামি হয়। ৪৮% মনে করতেন সমকামিরা সমকামিতাকে স্বেচ্ছায় বেছে নেয়। ত্রিশ বছরের কম সময়ের মধ্যে তে ৪২% উত্তরদাতা বিশ্বাস করা শুরু করলো সমকামিতা জন্মগত [২]।  

অথচ ১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত খোদ অ্যামেরিকান সাইক্রিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশান সমকামিতাকে একটি মানসিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করতো। অর্থাৎ ৫০ বছর আগে যা বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল আজ অর্ধেকের বেশি মানুষ তার উল্টোটা বিশ্বাস করছে, যদিও সব বৈজ্ঞানিক গবেষনার ফলাফল বারবার বলছে সমকামিতার কোন জেনেটিক ভিত্তি নেই, এটি জন্মগত না, বরং স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া একটি বিকৃতি।  পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫ তে এসে অ্যামেরিকান খ্রিস্টানদের ৫৪% মনে করে সমকামিতার বিরোধিতা করার বদলে সমকামিতাকে সামাজিক ভাবে মেনে নেওয়া উচিৎ। অ্যামেরিকান প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ৬২% সমকামি ‘বিয়ে’-কে সমর্থন করে, আর ৬৩% মনে করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সমকামিতার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই [৩]। অথচ সমকামিতা যে একটি জঘন্য বিকৃতি, চরম পর্যায়ের সীমালঙ্ঘন এবং অত্যন্ত ঘৃণিত পাপাচার এ ব্যাপারে বাইবেলের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট।   অ্যামেরিকান সমকামিতা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ GLAAD এর সমীক্ষ অনুযায়ী ২০১৬ সালে রিলিয  হওয়া প্রায় ১৭.৫% হলিউড সিনেমাতে LGBT (Lesbian,Gay, Bi-sexual, Queer) চরিত্রের উপস্থিতি ছিল [৪] । 

পাশাপাশি গত ১০ বছরের প্রায় সব প্রাইমটাইম টেলিভিশন শো-তে কমপক্ষে একটি সমকামি বা অন্যকোন বিকৃতকামি চরিত্র রাখা হয়েছে। কিন্তু Gallup এর মতে অ্যামেরিকার মোট সংখ্যার মাত্র ৩.৯% সমকামি। মিডিয়াতে সমকামিদের ওভাররিপ্রেসেন্টেশানের সঠিক মাত্রাটা বোঝার জন্য এ তথ্য মাথায় রাখুন যে অ্যামেরিকান মিডিয়ার দর্শক শুধু অ্যামেরিকাতেই সীমাবদ্ধ না। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ অ্যামেরিকান মিডিয়ার দর্শক ও ভোক্তা। এই কোটি কোটি মানুষের কাছে অ্যামেরিকান মিডিয়া সমকামিতা, সমকামি ‘বিয়ে’, সমকামি যৌনাচারকে সাধারন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে। 

সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী ২২টি দেশে সমকামি ‘বিয়ে’-কে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জার্মানির সংসদে গত ৩০শে জুন, ২০১৭ সমলৈঙ্গিক ‘বিয়ে’র স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিল পাশ হয়েছে। উল্লেখ্য জার্মানির সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৬ জন নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবি করে থাকে। এই ৪জনই এই বিকৃতি ও চরম সীমালঙ্ঘনের আইনগত বৈধতা দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।  রাজনীতি, অ্যাকাডেমিয়া এবং মিডিয়ার উপর এই ক্ষুদ্র বিকৃত মানসিকতার মাইনরটির প্রভাবের মাত্রা কতোটুকু তা শুধু উপরের তথ্যগুলোর আলোকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না। তবে একটা বেইসিক আইডিয়া এখান থেকে আপনি পাবেন। এই প্রভাবের উৎস কী? আর এই প্রভাবের ব্যাপ্তি কতোটুকু?

 আর একটা তথ্য দেই। আপনি নিজেই বাকি হিসেবটা মিলিয়ে নিন।  পৃথিবী জুড়ে অনেকগুলো অ্যাডভোকেসি গ্রুপ সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও ধনী গ্রুপ হল HRC বা Human Rights Campaign। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে HRC-র বার্ষিক আয় ছিল ৩.৮৫ কোটি ডলার। এই অর্থের উৎস? বড় বড় কর্পোরেশানগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ডোনেইশান। HRC এর ডোনার এবং কর্পোরেট পার্টনারদের মধ্যে আছে স্টারবাকস, লিবার্টি মিউচুয়াল ইনশুরেন্স, অ্যামেরিকান এয়ারলাইন্স, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, ব্যাঙ্ক অফ অ্যামেরিকা, শেভরন, কোকাকোলা, পেপসিকো, লেক্সাস অটো, গুগল, অ্যামাযন, আইবিএম, নাইকি, গোল্ডম্যান অ্যান্ড স্যাক্স, জেপি মরগান চেইস অ্যান্ড কো, ডেল, শেল অয়েলসহ আরো অনেকে [৫]।   বিশাল বাজেটের ব্যাপক প্রভাবশালী এসব অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আসলে কী করে?

 লবিয়িং এর মাধ্যমে, প্রেশার গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে এবং অবশ্যই অর্থের মাধ্যমে এরা প্রভাবিত করে মিডিয়াকে, রাজনীতিবিদদের, সমকামিতার সাথে সংশ্লিস্ট বিভিন্ন রিসার্চকে (যাতে করে সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করা যায়), এবং সরকারের পলিসিকে। যেমন অ্যামেরিকাতে এই মূহুর্তে অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো একটি প্রধান লক্ষ্য হল প্রতিটি স্কুলে, হাইস্কুল ও প্রাইমারি পর্যায়ে Gay-Straight Alliance Club অর্থাৎ স্বাভাবিক শিশু ও সমকামি শিশু ঐক্য পরিষদ জাতীয় কিছু তৈরি করা। প্রতিটি স্কুলে গড়ে ওঠা এই ক্লাবগুলোর কাজ হবে শিশুদের মধ্যে সমকামিতার প্রসার ঘটানো এবং স্বাভাবিকীকরন। 

 গ্লোবাল এজেন্ডা ও বাংলাদেশঃ

 বিষয়গুলো শুধু অ্যামেরিকাতে বা পশ্চিমা বিশ্বে সীমাবদ্ধ না। বরং সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের এই এজেন্ডা গ্লোবাল, এবং বিশ্ব রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে সমকামিতা কোন অসুস্থতা না কোন বিকৃতিও না। অর্থাৎ সমকামিতা স্বাভাবিক। OHCHR, UNDP, UNFPA, UNHCR, UNICEF, UNODC, UN Women, WFP, ILO, UNESCO, World Bank এবং UNAIDS –সহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বৈষম্য নিরসন মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নামে উন্নতশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের জন্য কাজ করছে। এদের মধ্যে Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights (OHCHR) সমকামিতাকে মানবাধিকারের সংজ্ঞার ভেতরে ফেলে এর প্রচার করছে [৬] ।

 OHCHR সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য Free & Equal নামে একটি আলাদা ক্যাম্পেইন চালু করেছে যার ঘোষিত উদ্দেশ্যে মাঝে আছে শিশুদের সমকামিতা সম্পর্কে সচেতন করা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে সমকামিতা ও সমকামের প্রতি সহনশীলতা তৈরি করা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সমকামিতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা [৭] । Free & Equal ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘ সমকামি ‘বিয়ে’-কে বৈধতা দেয়ার জন্য বলিউডের মিউযিক ভিডিও-ও তৈরি করেছে।   

 পৃথিবীর যেকোন জায়গায় সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যা কিছু করা হচ্ছে, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো এই গ্লোবাল এজেন্ডার অংশ। বাংলাদেশে যারা সমকামিতার প্রচার, প্রসার ও স্বাভাবিকীকরনের জন্য এখনো পর্যন্ত যেসব কাজ করা হয়েছে তার সবকিছুই কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের সাথে খাপেখাপে মিলে যায়। একারনে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বোঝার জন্য কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট  সম্পর্কে ধারণা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আলাদা ভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।

 বরং যে মডেলের মাধ্যমে অ্যামেরিকায় অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে এখন সেই একই মডেল বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই পায়ুকাম প্রচার করা ইয়াহু চ্যাট গ্রুপ, ফেইসবুক গ্রুপ, ফোরাম, রুপবান ম্যাগাযিন, শাহবাগে সমকামি প্যারেড, বইমেলায় সমকামিতা নিয়ে কবিতার বই প্রকাশ, গ্রামীনফোনের ফান্ডিং এ আরটিভিতে প্রচারিত নাটক, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও এনজিও গুলোর মাধ্যমে পায়ুকামে উৎসাহিত করা, বিনামূল্যে কনডম-লুব্রিকেন্ট বিতরণ - এই সবকিছুকে দেখতে হবে একটি বৃহৎ, গ্লোবাল এজেন্ডার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে। যে বিষয়টা উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল শত্রুপক্ষ জানে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বা কম্পোনেন্টের যেকোন একটা দিয়ে রাতারাতি জনমত বদলে ফেলা যাবে না। সেটা তাদের উদ্দেশ্যও না। বরং তাদের উদ্দেশ্য হল ছোট ছোট ইঙ্ক্রিমেন্টাল পরিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সামাজিক মূল্যবোধকে বদলে দেওয়া। এটাই কালচারাল সাবভারশানের টাইম-টেস্টেড পদ্ধতি। হঠাৎ করে একটা বড় পরিবর্তন সমাজে উপর চাপিয়ে দিতে চাইলে সেটা ব্যাকফায়ার করার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় পরিবর্তনটা উপস্থাপন করা হয় তখন এক পর্যায়ে গিয়ে সমাজ তা মেনে নেয়।  


সহজ উদাহরনঃ একটা সময় বাংলাদেশে বুকে ওড়না না দিয়ে গলায় ওড়না দেয়াটা খারাপ মনে করা হতো। এই সময়টাতে যেসব মেয়েরা জিন্স-টিশার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতো তাদের ব্যাপারে সমাজের অধিকাংশের ধারণা ছিল এরা উগ্র, অশ্লীল ইত্যাদি। কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে যারা একসময় জিন্স-টিশার্ট পরিহিতাদের উগ্র বলতেন তারাই তাদের মেয়েদের এখন জিন্স-টিশার্ট পড়াচ্ছে, এবং ব্যাপারটা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ‘নরমাল’। গলায় ওড়না ঝোলানো থেকে টি-শার্টে আসার ব্যাপারটা রাতারাতি করার চেস্টা সমাজ মেনে নেয়নি। বিরোধিতা করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন পরিবর্তন হয়েছে তখন সেই একই সমাজ খুশি মনে একে মেনে নিয়েছে।   কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্টের প্রথম ধাপ এটাই। মানুষকে সমকামিতার ব্যাপারে ডিসেনসেটাইয করা।  . 
   

 ‘প্রথম কাজ হল সমকামি এবং সমকামিদের অধিকারের ব্যাপারে অ্যামেরিকার জনগনের চিন্তাকে অবশ করে দেওয়া, তাদের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে দেওয়া [desensitization]। মানুষের চিন্তাকে অবশ করে দেওয়ার অর্থ হল সমকামিতার ব্যাপারে তাদের মধ্যে উদাসীনতা তৈরি করা...একজন স্ট্রবেরি ফ্লেইভারের আইস্ক্রিম পছন্দ করে আরেকজন ভ্যানিলা। একজন বেইসবল দেখে আরেকজন ফুটবল। এ আর এমন কী!’  [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]


 কার্ক-ম্যাডসেনের মতে প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্দেশ্য এই একটি। সমকামিতা  যে একটি জঘন্য বিকৃতি, চরম সীমালঙ্ঘন, ও ঘৃণ্য পাপাচার তা সম্পর্কে মানুষের সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করে দেওয়া। তাদের ভাষায় –  

‘সমকামিতা একটি ভালো জিনিস - একেবারেই শুরুতেই তুমি সাধারন মানুষকে এটা বিশ্বাস করাতে পারবে, এমন আশা বাদ দাও। তবে যদি তুমি যদি তাদের চিন্তা করাতে পারো যে সমকামিতা হল আরেকটা জিনিষ (ভালো না খারাপ না – জাস্ট আরেকটা ব্যাপার) তাহলে ধরে নাও আইনগত ও সামাজিক অধিকারের আদায়ের লড়াইয়ে তুমি জিতে গেছো।’ [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]


সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের জন্য যারা কাজ করছে তাদের রেটোরিক খেয়াল করলে দেখবেন তাদের অধিকাংশ ঠিক এই মেসেজটাই দিতে চাচ্ছে। ‘সমকামিতা ভালো বা খারাপ না, জীবনের একটা বাস্তবতা মাত্র’। পহেলা বৈশাখের সময় শাহবাগে সমকামি প্যারেড কিংবা ঈদের সময় ঈদের নাটক হিসেবে সমকামিদের গল্প তুলে ধরার পেছনে একটি মূল উদ্দেশ্য হল সমাজের বিকৃতকামী এক্সট্রিম মাইনরিটিকে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা। একই সাথে সমকামিতাকে ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত করা, যেমনটা জাতিসংঘের Free & Equal ক্যাম্পেইনেও করা হয়েছে।
ভিকটিমহুড – সমকামিতা জন্মগতঃ  কার্ক-ম্যাডসেনের আরেকটি সাজেশান হল সমকামিদের ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা। সমকামিদের ভিকটিম হিসেবে চিত্রিত করার দুটি ডাইমেনশান থাকবে। প্রথমত, সমকামিতাকে একটি সিদ্ধান্তের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বা জন্মগত হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সমকামিদের জন্মগতভাবেই ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, সমকামিদের সমাজ দ্বারা নির্যাতিত হিসেবে চিহ্নিত করা।  বাংলাদেশে এবং বিশ্বজুড়ে যারা সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের কাজ করে তাদের প্রপাগ্যান্ডা ও বক্তব্য আপনি সবসময় এ দুটো মোটিফ দেখতে পাবেন। সমকামিরা জন্মগতভাবেই সমকামি এটা প্রমানের উদ্দেশ্য হল যদি সমকামিতাকে জন্মগত বা প্রাকৃতিক প্রমান করা যায় তাহলে সমকামিদের সম্পূর্ণ নৈতিক দায়মুক্তি সম্ভব। সমকামিতা যদি জন্মগত হয় তাহলে সমকামিতা একটি ‘অ্যাক্ট’ বা ক্রিয়া হিসেবে নৈতিকভাবে নিউট্রাল, কারন এর উপর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রন নেই। কিন্তু সমকামি জন্মগত – এই দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তো নেই-ই, বরং বিভিন্ন পরীক্ষা ফলাফল ইঙ্গিত করে যে Sexual Oreintation নির্ভর করে ব্যক্তির ‘চয়েস’ বা স্বেচ্ছায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর [৮]।   

 আরেকটি বিষয় হল সমকামিতা যদি জন্মগত হয় তাহলে অন্যান্য বিকৃত যৌনাচার কেন জন্মগত বলে গন্য হবে না? শিশুকামি, বা পশুকামিদের কেন অপরাধী গণ্য করা হবে? ইন ফ্যাক্ট শিশুকামের সাথে সমকামের, বিশেষ করে পায়ুকামের সম্পর্ক তো হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন গ্রিসে শিশুদের সাথে মধ্য বয়স্ক পুরুষদের পায়ুকামী সম্পর্ক বা Pederasty প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চালু ছিল  প্লেইটো তার রিপাবলিক ও ল’স – রচনাতে প্রাচীন পেডেরাস্টি এবং সমকামিতার ব্যাপক প্রচলনকে গ্রীসের অধঃপতনের একটি কারন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। অ্যামেরিকাতেও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সাথে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারের জন্য আন্দোলন করা NAMBLA (North American Man Boy Love Association) – দীর্ঘদিন ছিল গে-প্রাইড প্যারেডের নিয়মিত অংশ। বিখ্যাত অ্যামেরিকান কবি সমকামি অ্যালেন গিন্সবার্গ (সেপ্টেবর অন যশোর রোড – এর রচয়িতা) ছিল NAMBLA এর সদস্য। এছাড়া অসংখ্য সমীক্ষার মাধ্যমে একথা প্রমাণিত যে সমকামিতার সাথে অন্যান্য যৌন বিকৃতির বিশেষ করে শিশুকামিতার ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে [ ৯]। সমকামিতার বিশেষ করে পায়ুকামিতার সাথে শিশুকামের গভীর সম্পর্কের ব্যাপারে সংক্ষেপে বোঝার জন্য পায়ুকামি ও শিশুকামি কেভিন বিশপের এই উক্তিটি যথেষ্ট -  

"Scratch the average homosexual and you will find a pedophile" [Kevin Bishop in an interview. Angella Johnson, “The man who loves to love boys,” Electronic Mail & Guardian, June 30, 1997]



 সুতরাং যদি সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষন জন্মগত হতে পারে তাহলে সমলিঙ্গের অল্পবয়েসীদের প্রতি আকর্ষন কেন জন্মগত হতে পারবে না? কেন ধর্ষনের তাড়না অনুভব ধর্ষকরা জন্মগত বিচ্যুতির কারনে ভিকটিম গণ্য হবে না? কেন পশুকাম জন্মগত বলে গণ্য হবে না? Sexual Oreintation যদি জন্মগতই তবে কেন তা কেবলমাত্র সমকামিদের ক্ষেত্রে জন্মগত বলে বিবেচিত হবে? কিন্তু সব যুক্তি, প্রমান এবং বিবেচনাবোধের বিরুদ্ধে গিয়ে সমকামের প্রচারকরা একে জন্মগত বলে যাচ্ছে। আর ‘জন্মগত’ এই বৈশিষ্ট্যের কারনে কেন সমকামিদের আলাদা ভাবে দেখা হবে, এ নিয়ে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে। এবং এ দুটি দিক থেকে সমকামিদের ভিকটিম প্রমান করার মাধ্যমে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।  


মিডিয়াঃ কার্ক-ম্যাডসেনের মতে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরন ও গ্রহনযোগ্যতা তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের একটি হল মিডিয়া। বিশেষ করে ভিযুয়াল মিডিয়া –

‘সোজা ভাষায়, ভিযুয়াল মিডিয়া, টিভি ও সিনেমা হল ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালি মাধ্যম। অ্যামেরিকান প্রতিদিন গড়ে টিভি দেখে। এই সাতঘন্টা সময় সাধারন মানুষের চিন্তার জগতে ঢোকার এমন একটি দরজা আমাদের জন্য খুলে রেখেছে যার মধ্য দিয়ে একটা ট্রোজান হর্স ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব...যতো বেশি ও যতো উচ্চস্বরে সম্ভব, সমকাম, সমকামিতা এবং সমকামিদের কথা বলুন। বারবার দেখতে দেখতে থাকলে প্রায় যেকোন কাজই মানুষের কাছে ‘নরমাল’ মনে হওয়া শুরু করে...তবে মানুষের সামনে আগেই সমকামি আচরণ উপস্থাপন করা যাবে না – কারন তা মানুষের কাছে জঘন্য বলে মনে হবে এবং মানুষ সমকামিতার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তাই সমকামিদের যৌনাচার সাধারন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যাবে না। আগে তাবুর মধ্যে উটের নাক ঢুকাতে দিন, তারপর আস্তে আস্তে বাকিটাও ঢুকানো যাবে।’ [Kirk & Madsen, The Overhauling of Straight America ]


 আর বাস্তবিকই ধীরে ধীরে এই দরজার মধ্য দিয়ে ট্রোজান হর্স ঢুকাতে সমকামি মাফিয়া সমর্থ হয়েছে। ৯০ এবং ২০০০ এর প্রথম দশক জুড়ে বিভিন্ন ডেইলি সোপ ধীরে ধীরে সাধারন অ্যামেরিকানদের মধ্যে সমকামিতার গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জৌ বাইডেন ২০১২ সালে সরাসরি সমকামিতা প্রচার করা টিভি সিরিয ‘উইল অ্যান্ড গ্রেইস’-এর নাম উল্লেখ করে বলে –

“একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে একজন নারী আরেকজন নারীকে বিয়ে করবে এতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই...আমার মনে হয় না অ্যামেরিকান মানুষকে (সমকামিতা সম্পর্কে) শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে উইল অ্যান্ড গ্রেইসের মতো ভূমিকা আর কেউ বা আর কোন কিছু রাখতে পেরেছে। যা অন্যরকম মানুষ সেটাকে ভয় পায়। কিন্তু এখন মানুষ (সমকামিতার ব্যাপারে) বুঝতে শুরু করেছে।”[১০]



   আর একইভাবে আজ বাংলাদেশেও এই একই দরজার ভেতর দিয়ে সেই একই ট্রোজান হর্স ঢোকানোর জন্য কর্মতৎপরতা চলছে। কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট বাংলাদেশে প্রায় অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমকামিতার প্রচারে মিডিয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্ক-ম্যাডসেনের মত ছিল প্রাথমিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করা, এবং তারপর ধীরে ধীরে ভিযুয়াল মিডিয়ার দিকে আগানো। বাংলাদেশে সমকামিতা প্রচারের কাজ শুরু হয় ৯০ এর দশকের শেষের দিকে। প্রাথমিকভাবে সমকামিতা প্রচারকদের কাজ ছিল অনলাইন চ্যাট গ্রুপ, মেইল গ্রুপ, ফোরাম ইত্যাদির মাধ্যমে সমকামিদের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচিতি তৈরি করা, বিভিন্ন সময় একত্রে ‘মিলিত’ হওয়া এবং কিছু নির্দিষ্ট অঙ্গনে সমকামিতার প্রচার করা, এবং সমকামিতার পক্ষে জনমত তৈরি করা। 

পাবলিক স্ফেয়ারে যখন তারা তাদের বিকৃতি প্রচারের শুরু করে তখন তারা সেটা করে প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে। ২০১০ সালে বইমেলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে বের হয় কুখ্যাত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামেরিকা প্রবাসি ইসলামবিদ্বেষি অভিজিৎ রায়ের বই ‘সমকামিতা’। অভিজিৎ রায় এই বইয়ে বিজ্ঞানের জগাখিচুড়ি ব্যাখ্যা দিয়ে, এবং নানা লজিকাল ফ্যালাসি ব্যবহার করে সমকামিতা-কে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ হিসেবে প্রমান করার চেষ্টা করে। তার অন্যান্য লেখার মতো এই লেখাটিও ছিল মূলত বিভিন্ন পশ্চিমা লেখকের লেখার ছায়া অনুবাদ। ২০১০ সালে অগাস্টে   আলতাফ শাহনেওয়াজ নামে একজনের  লেখা অভিজিৎ রায়ের বইটির রিভিউ প্রকাশ করে প্রথম আলো। আর এর মাধ্যমে প্রায় সবার অলক্ষ্যে তাদের বিশাল পাঠকবেইসের ড্রয়িং রূপে এই জঘন্য বিকৃতির সাফাই পৌছে দেয় প্রথম আলো।  




বাংলাদেশে প্রকাশ্যে সমকামিতার প্রসারে পরবর্তী বড় পদক্ষেপটি আসে ২০১৪ সালে, রূপবান নামে একটি ম্যাগাযিনের মাধ্যমে। আর এই ম্যাগাযিনের পক্ষে প্রচারনা চালানো হয় প্রিন্ট মিডিয়া (যেমন ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে) এবং অনলাইনের মাধ্যমে। ২০১৪ সালে রূপবানের প্রথম সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ হাই-কমিশনার রবার্ট গিবসন, ব্যারিস্টার সারা হোসেনসহ আরো অনেকে। এ থেকে গ্লোবাল সমকামি মাফিয়ার প্রভাব এবং বাংলাদেশে এদের বিস্তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ম্যাগাযিনটির প্রকাশনার খবর ফলাও করে প্রচার করা হয় ডেইলি স্টার, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন, বিবিসি সহ বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমে। রূপবান পত্রিকার সম্পাদক ছিল সাবেক পররাস্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির আত্মীয় অ্যামেরিকান দূতাবাসে চাকরিরত জুলহাস মান্নান। পরবর্তীতে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা অভিজিৎ রায় এবং জুলহাস মান্নানকে যথাক্রমে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হত্যা করে [১১]। 

 কার্ক-ম্যাডসেনের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যবহারের পর এবার বাংলাদেশে সমকামিতার প্রচারকরা ভিযুয়াল মিডিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি আরটিভিতে প্রচারিত নাটক তাই নতুন কিছু না, বরং প্রায় দুই দশক পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নতুন একট পর্যায়ের শুরু কেবল। গ্রামীনফোন প্রযোজিত এই নাটকে হুবহু কার্ক-ম্যাডসেনের শিখিয়ে দেওয়া ‘যুক্তি’গুলোই তুলে ধরা হয়েছে, এবং নাটকের ডায়ালগের মাধ্যমে সমকামিতাকে জন্মগত ও স্বাভাবিক, এবং সমকামিতা নৈতিকভাবে নিউট্রাল একটি কাজ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। নাটকে দেখানো হয়েছে সমকামি চরিত্রের পক্ষ নিয়ে একটি চরিত্র আরেকটি চরিত্রকে বলছেঃ 


‘ও পায়ুকামি (not straight), এটা কি ওর দোষ? সে কি এটাকে বেছে নিয়েছে? না। ওয়ার্ল্ডে নানা ধরনের মানুষ থাকে, তাহলে ও কেন থাকতে পারবে না? ও কি অস্বাভাবিক? না। ও কি একজন অপরাধী? না। ও তোমার আমার মতোই নরমাল মানুষ।’ [রেইনবো,আরটিভি,নির্মাতাঃ আশফাক নিপুন, প্রযোজনাঃ গ্রামীন ফোন ] 

  
 যদি বাংলাদেশে কার্ক-ম্যাডসেনের ব্লু-প্রিন্ট নির্বিঘ্নে অনুসৃত হতে থাকে তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এরকম আরো অনেক নাটক, শর্টফিল্ম, স্কিট এবং জনসচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন দেখতে পাবো। এক পর্যায়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে সমকামিতার স্বপক্ষে প্রবন্ধ ছাপা হবে। সমকামিতা নিয়ে বানানো নাটক ও সিনেমাকে জাতীয় পুরষ্কার, মেরিল প্রথম-আলো পুরস্কার সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমকামি অধিকার সম্পর্কে প্রকাশ্যে নানা ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হবে, পাবলিক স্কুলের কারিকুলামে সমকামিতা ও সমকামি অধিকার সম্পর্কে আলোচনা যুক্ত করা হবে। এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে সমকামি কোন তরুন বা তরুণীকে দেশী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে ইয়ুথ আইকন হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। আর এভাবে ধীরে ধীরে সমকামিতাকে সামাজিক ও রাস্ট্রীয়ভাবে গ্রহনযোগ্য করে তোলা হবে একসময় একে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অথবা আইনগত স্বীকৃতি ছাড়াই একসময় সমকামিতে সমাজে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা লাভ করবে, যেমনটা বর্তমানে যিনার ক্ষেত্রে হয়েছে।  যদি এইভাবেই চলতে থাকে তাহলে অত্যন্ত অন্ধকার এক ভবিষ্যৎ এর মোকাবেলা আমাদের করতে হবে। 

তাই এ ব্যাপারটা বোঝা জরুরী যে এ দ্বন্দ্বটা সাময়িক কিছু না। কোন একটা নাটক বা বই বা ম্যাগাযিনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ সমকামিতাকে রাতারাতি গ্রহনযোগ্যতা দিতে চাচ্ছে না। এই নাটক, বই বা ম্যাগাযিনগুলোও এভাবে বানানো হচ্ছে না। তারা চাচ্ছে ক্রমাগত মানুষের সামনে সমকামিতা, ও সমকামিতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে, সমকামিতাকে স্বাভাবিক প্রমান করতে। প্রাকৃতিক প্রমান করতে। এই ব্যাপারে মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে দিতে। মানুষকে ডিসেনসেটাইয করতে। জনমতকে পরিবর্তন করতে, সামাজিক মূল্যবোধকে বদলে দিতে। প্রতিপক্ষের আছে প্রায় অফুরন্ত ফান্ডিং, মিডিয়া এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক প্রশাসনিক সমর্থন। সুতরাং একটি নাটকের পর সেই নাটক নিয়ে লেখালেখি করলে অনেক মানুষ এসব সম্পর্কে জেনে যাবে – এমন ধারণা যেমন সঠিক না, তেমনি ভাবে একটি নাটকের পর কেবলমাত্র আরটিভি-গ্রামীনফোন বর্জনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে হারানো যাবে এমন চিন্তা করাও ভুল। যদি আসলেই এই বিশাল মেশিনারীকে থামাতে হয়, যদি এই এজেন্ডার বাস্তবায়নকে বন্ধ করতে হয় তাহলে সমকামি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পেছনে থাকা কাঠামো সম্পর্কে জানতে হবে, একে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তবে সেই আলোচনা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।


"ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছি কি না, এ প্রশ্ন আমাকে করা হবে না..."


মানা আত্ব-ত্বগুত

 মানবজাতির সর্বপ্রথম দায়িত্ব:

আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন, অবগত হোনঃ আল্লাহ আদম সন্তানের উপর সর্বপ্রথম যে বিষয়টি বাধ্যতামূলক করেছেন তা হল ত্বগুতকে পরিত্যাগ, প্রত্যাখ্যাল করা ও আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। এর দলীল হল , আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল এর এই আয়াত -

 “প্রত্যেক জাতির কাছে আমি রসূল পাঠিয়েছি (এ সংবাদ দিয়ে) যে, আল্লাহর ‘ইবাদাত কর আর তাগুতকে বর্জন কর। অতঃপর আল্লাহ তাদের মধ্যে কতককে সৎপথ দেখিয়েছেন, আর কতকের উপর অবধারিত হয়েছে গুমরাহী, অতএব যমীনে ভ্রমণ করে দেখ, সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণতি কী ঘটেছিল!”  [সূরা আন নাহল, ৩৬]

শরাহভাষাঃ ফারাদা (অবশ্য করণীয়) বাধ্যতামূলক ; ত্বগুত শব্দটি এসেছে ত্বাগা ক্রিয়া থেকে , যার অর্থ সীমালঙ্ঘন করা। আর এটি এমন প্রতিটি বিষয়কেই বুঝায় যা কিনা তার নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে যায় ও সীমালঙ্ঘন করে।ব্যাখ্যাঃশাইখ রাহিমাহুল্লাহ তাঁর এই রিসালাহ  শুরু করেছেন মানবজাতির উপর আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত প্রথম আবশ্যক দায়িত্বকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে, যা কিনা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কিতাব থেকেই প্রমাণীত হয় এই ফারযিয়্যাত হলঃ ত্বাগুতকে পরিত্যাগ ও প্রত্যাখ্যান করা ও আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। কেননা আল্লাহ বলেছেন, “প্রত্যেক জাতির কাছে আমি রসূল পাঠিয়েছি (এ সংবাদ দিয়ে) যে, আল্লাহর ‘ইবাদাত কর আর তাগুতকে বর্জন কর। অতঃপর আল্লাহ তাদের মধ্যে কতককে সৎপথ দেখিয়েছেন, আর কতকের উপর অবধারিত হয়েছে গুমরাহী, অতএব যমীনে ভ্রমণ করে দেখ, সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণতি কী ঘটেছিল!” [সূরা আন নাহল, ৩৬]সুতরাং সর্বপ্রথম কাজ হল ত্বগুতকে প্রত্যাখ্যান করা ও এতে অবিশ্বাস করা; ত্বগুত হল– আল্লাহ ব্যাতীত এমন সব কিছু যাকে বা যাদেরকে উপাসনা করা হয় ও তারা সেই উপাসনায় সন্তুষ্ট হয়। ত্বগুতকে প্রত্যাখ্যান করা ও এতে অবিশ্বাস করার অন্তর্ভুক্ত হলঃ আল্লাহ ব্যতীত আর যা কিছুর উপাসনা করা হয়, যেমন কোন গাছ, পাথর, চাঁদ, সূর্য, কোন ফেরেশতা, কোন মানুষ ইত্যাদিকে অপসারন করা। এদের আল্লাহর পাশাপাশি উপাসিত হবার কোন অধিকার নেই, কেননা সৃষ্টিজগতের উপর এদের কোন ক্ষমতাই নেই।এরপরে আসে নিজের দ্বীনকে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা। কেবলমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করা আর উপাসিত হবার ক্ষেত্রে একমাত্র তাঁর অধিকারকেই স্বীকার করে নেয়া। ত্বগুতকে অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান করা ও আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস অর্থাৎ কুফর বিত ত্বগুত ওয়া ঈমান বিল্লাহ -এর এই আবশ্যকতাই হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র প্রকৃত অর্থ (আল্লাহ ব্যতীত আর কোন স্বত্তার উপাসিত হবার অধিকার নেই।) কেননা – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- তে রয়েছে একটি অস্বীকৃতি ও একটি স্বীকৃতি। লা ইলাহা (কোন সত্ত্বার উপাসিত হবার অধিকার নেই)- হল আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল স্বত্তার উপাসিত হবার বিষয়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। এটা হল ত্বাগুতের উপর অবিশ্বাস (কুফর বিত ত্বগুত)। আর ইল্লা আল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত) হল এই স্বীকৃতি দেয়া যে একমাত্র আল্লাহই উপাসিত হবার অধিকার রাখেন।এর মাধ্যমে বান্দার উপর আরোপিত সর্বপ্রথম বাধ্যবাধকতা সুস্পষ্ট হয়। আর কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টি (intellectual insight) বা এজাতীয় কিছু অর্জন করা বান্দার উপর আরোপিত সর্বপ্রথম বাধ্যবাধকতা না, যা কিনা কিছু বিভ্রান্ত কালামশাস্ত্রবিদ বা অন্যরা দাবী করে। বান্দার উপর সর্বপ্রথম বাধ্যবাধকতা হল তাই যা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলঃ কুফর বিত ত্বগুত ওয়া ঈমান বিল্লাহ।


সারাংশঃ

১) বান্দার সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলঃ কুফর বিত ত্বগুত (ত্বগুতকে অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান করা) ওয়া ঈমান বিল্লাহ (আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা)
২) ত্বগুত হল এমন সব কিছু আল্লাহ্‌র পাশাপাশি যাদের ইবাদাত করা হয় এবং তারা এতে সন্তুষ্ট।
৩) কিছু গোমরাহ কালামশাস্ত্রবিদ (আহলুল কালাম) দাবি করে পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মস্তিস্কের ব্যক্তির জন্য সর্বপ্রথম দায়িত্ব হল intellectual insight অর্জন করা। 
===============================================
[ইমাম আল মুজাদ্দিদ শায়খুনা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব - এর রাহিমাহুল্লাহ মানা আত্ব-ত্বগুতের অনুবাদ এবং শারহ। গ্রহন করা হয়েছে  ডঃ মুহাম্মাদ ইবন আবদুর রাহমান আল-খুমাইয়্যিস -এর “Jam’-ul-Funoon fee Sharh Jumlati Mutoon Li’’Aqaa’id Ahlis-Sunnah ‘alal-Madhaahib-il-Arba’ah” - থেকে।

"নারীকে ব্যবহার করে শয়তানের তৈরি একটি ফাঁদ !!! একটি সত্য কাহিনী এবং কিছু শিক্ষা

বারসিসা বনী-ইসরাইলের একজন সুখ্যাত উপাসক, ধর্মযাজক ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। সে ঈসা(আঃ) এর উম্মাত ছিল। সে উপাসনালয়ে একনিষ্ঠভাবে নিজেকে আল্লাহর উপসনায় নিয়োজিত রাখত। তার সময়ে বনী-ইসরাইল জাতির মধ্যে তিন ভাই সিদ্ধান্ত নিল যে তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। কিন্তু তাদের একটি বোন ছিল এবং তারা ভেবে পাচ্ছিলো না যে বোনটিকে তারা কার নিকট রেখে যাবে। লোকজন বলল যে বারসিসা খুব ভালো এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি, সে এই দায়িত্ব বিশ্বাসের সাথে খুব ভালোভাবে পালন করতে পারবে। সুতরাং লোকজনদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই তিন ভাই বারসিসার নিকট গেল। তারা গিয়ে বারসিসাকে বলল যে তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে যেতে চায়, এখন তাদের বোনটিকে কি সে দেখে রাখতে পারবে, মন্দ লোকের থেকে আর তার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে কি না। এর উত্তরে বারসিসা বলল যে সে তাদের কাছে থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় এবং তারা যেন তার কাছে থেকে চলে যায়।
,
কিছু সময় পর তার মনে হল, মূলত শয়তান এসে  তাকে বলল যে(বাস্তবে নয় মনে কুমন্ত্রণা) “তুমি এত সৎ ব্যক্তি, তুমি যেহেতু মেয়েটিকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিলে না, তাহলে নিশ্চয়ই কোনো মন্দ ব্যক্তি মেয়েটির দায়িত্ব নেবে আর এর পরের ব্যাপারটি কি হবে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছো, এই অসহায় মেয়েটিকে আশ্রয় দেয়ার মত ভালো কাজ তুমি ছেড়ে দিতে পারো না।”
এর কিছু সময় পর বারসিসা সেই তিন ভাইকে ডেকে বলল যে তাদের কথা সে রাখতে পারে তবে তাদের বোন তার ধারেকাছেও থাকতে পারবে না, উপাসনালয়ের কাছেও না; অদূরেই তার একটি পুরোনো বাড়ি আছে সেখানে রাখতে যদি তাদের কোনো আপত্তি না থাকে তবে। ভাইয়েরা শর্তে রাজি হয়ে বোনকে বারসিসার দায়িত্বে রেখে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে চলে গেল। আর মেয়েটি সেই পুরোনো বাড়িতে আশ্রয় নিলো।
,
বারসিসা প্রতিদিন তার উপাসনালয়ের দরজার সামনে মেয়েটির জন্য খাবার রেখে দিত। সে মেয়েটিকে খাবার পর্যন্ত দিয়ে আসত না। মেয়েটিকে প্রতিদিন কিছুদূর পথ পেরিয়ে উপাসনালয়ের দরজার সামনে থেকে খাবার নিয়ে যেতে হত। বারসিসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখত না। এরকম কিছুদিন যাওয়ার পর তার মনে হল, মূলত শয়তান এসে তাকে বলল যে(বাস্তবে নয় মনে কুমন্ত্রণা) এতটুকু হেঁটে আসতে এই অসহায় মেয়েটির অবশ্যই কষ্ট হয়, তাছাড়া দুষ্ট লোকের নজর তার দিকে পড়ে। সুতরাং তার উচিত হবে মেয়েটির খাবার তার আশ্রয়স্থলে গিয়ে দিয়ে আসা। এরপর থেকে বারসিসা মেয়েটির আশ্রয়স্থলে গিয়ে প্রতিদিন দরজার সামনে খাবার রেখে আসত।

,
কিছুদিন পর শয়তান এসে আবার বারসিসাকে বলল, মূলত তার মনে হল যে দরজা থেকে খাবার নেয়ার সময় মন্দ লোকের নজর মেয়েটির উপর পড়তে পারে, তাই তার উচিত হবে খাবার ঘরের ভিতর দিয়ে আসা। এরপর থেকে বারসিসা মেয়েটির ঘরে খাবার দিয়ে আসত এবং এক মূহুর্তও অপেক্ষা করত না। এভাবে কিছুদিন গেল। আর এইদিকে সেই তিন ভাই জিহাদে ব্যস্ত থাকায় তাদের ফিরতে বিলম্ব হচ্ছিল। এমতবাস্থায় শয়তান আবার বারসিসার কাছে, মূলত তার চিন্তায় এসে বলল যে সে যে মেয়েটি একা একা রাখছে এতে মেয়েটির হয়ত খারাপ লাগছে, তার তো আপন কেউ কাছে নেই, সে কোথাও বেরও হতে পারে না, কারো সাথে কথাও বলতে পারে না, ঠিক যেন জেলখানায় বন্দী হয়ে আছে। কথা বলার জন্য একটা মানুষ পর্যন্ত নেই, সে কোনো মেয়েটির এই দায়িত্বটি নিচ্ছে না; একটু সামাজিকতা, সুখ-দুঃখের কথা বলা। আর তা না হলে হয়ত পরে দেখা যাবে মেয়েটি বিরক্ত হয়ে ভুল পথে চলে যেতে পারে, পর কোনো পুরুষের সংস্পর্শে চলে আসতে পারে। সেই সময় শয়তান বারসিসার মনে উপস্থিত হল। সে ভাবলো খাবার যখন  দিয়েই আসছি, কিছু সৌজন্যমূলক কথা-বার্তা বলাই যেতে পারে তবে তা ঘরের ভিতরে না হয়ে ঘরের বহিরে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। এরপর তারা এভাবে চিৎকার করে সামান্য কিছু কুশল বিনিময় করা শুরু করল। এভাবে কিছুদিন চলল। এরপর শয়তান আবার তার মনে উদয় হল এবং বলল যে এত কঠিন করে কি বা দরকার, শুধু শুধু কষ্ট করে চিৎকার করে করে, ব্যাপারটি সহজ করে নিলেই তো হয়। ঘরে বসেই তো মেয়েটির সাথে কথা বলা যায়, কথা যখন বলা হচ্ছেই।এরপর থেকে সেই সুখ্যাত, ধার্মিক ব্যক্তি বারসিসা সেই মেয়েটি সাথে একটি ঘরে কথা-বার্তা বলে সময় ব্যয় করতে থাকল। দিন দিন মেয়েটি সাথে তার সময়ক্ষেপনের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকল। একটা সময় বারসিসা মেয়েটির সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে লাগল আর ধীরে ধীরে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকল। বারসিসা মূলত সেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। এমন একটা সময় উপস্থিত হল যে সেই সৎ, ধার্মিক বারসিসা মেয়েটির সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হল, ফলে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ল।

 ,
মেয়েটি একটি সন্তানের জন্ম দিল। আবার সেই শয়তান বারসিসার মনে উদয় হল। কি সর্ব্নাশ! এ কি করেছে বারসিসা! এত সৎ, ধার্মিক, বিশ্বাসী একজন লোক সে। মানুষজন কত ভালো মানুষ হিসেবে জানে তাকে। মেয়েটির ভাইয়েরা ফিরে আসলে তার কি হবে, তারা তার কি অবস্থাই না করবে। তারা তাকে হত্যা করবে, এমন কি সে যদি কাজটি অস্বীকারও কারে, তবুও দায়িত্বে তো সে ই ছিল। আর তখন তাকেই সব কিছুর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। শয়তান তখন তাকে ওয়াসওয়াসা দিল যে উপায় একটাই, এই বাচ্চাটিকে মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। তখন বারসিসার মনে হল যে শুধু বাচ্চাটিকে মেরে ফেললেই কি হবে, মেয়েটি অর্থাৎ বাচ্চাটির মা কি বলে দেবে না সন্তান হত্যা সহ বাকি সব। শয়তান তখন বারসিসাকে বলল যে সে কোনো যে এত বোকা! মেয়েটি অবশ্যই ব্যাপারটি গোপন রাখবে না, সে সবাইকে বলে দেবে। বারসিসা দিশেহারা হয়ে পড়ল, সে এখন কি করবে! শয়তান তখন তকে কুমন্ত্রণা দিল যা এতদিন ধরে ধরাবাহিকভাবে মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে দিয়ে আসছিল যে বারসিসার উচিত তাদের দু’জনকেই অর্থাৎ সন্তান সহ মা কে হত্যা করে তাদের মাটির নিচে পুঁতে ফেলা। বারসিসা ঠিক সেই কাজটিই করল এবং তাদের দু’জনকে সেই বাড়ির নিচে মাটিতে পুঁতে ফেলল।

 ,
কিছুদিন পর মেয়েটির তিন ভাই জিহাদ থেকে ফিরে আসল। তারা বারসিসার কাছে তাদের বোনকে নিতে আসল। বারসিসা তাদের বলল যে ‘আল্লাহর কাছ থেকেই আসে আবার আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়!’ তোমাদের বোন তো অসুখে মৃত্যু বরণ করেছে। তারপর সে তিন ভাইকে মনগড়া একটি স্থান দেখিয়ে বলল যে সেখানে তাদের বোনকে কবর দেয়া হয়েছে। তখন ওই তিন ভাইও বলল যে ‘আল্লাহর কাছ থেকে আসে আবার আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়’। তারা তাদের বোনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তাদের ঘরে ফিরে গেল।
 ,

রাতের বেলা তিন ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই স্বপ্ন দেখলো। মূলত স্বপ্নে তার কাছে এসেছিল সেই কুমন্ত্রণা দানকারী শয়তান। শয়তন স্বপ্নে তাকে বলল যে সে কি বারসিসার কথা বিশ্বাস করে, বারসিসা তো মিথ্যা বলেছে। বারসিসা তাদের বোনের সাথে অসৎ কাজ করেছে, সন্তান সহ তাকে হত্যা করে, সেই আশ্রিত ঘরের মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছে।

,
পরদিন সকালে সেই ভাইটি স্বপ্নের কথা বাকি দুই ভাইকে জানালো। তারা বলল যে তারাও না কি ঠিক একই স্বপ্ন দেখেছে! নিশ্চয়ই এখানে একটা কিন্তু আছে, তিন ভাইয়েরা ভাবলো। তারা গিয়ে বারসিসার দেখানে সেই মিথ্যা কবরটি খুঁড়ল কিন্তু কিছুই পেল না। এরপর তারা সেই আশ্রিত বাড়িতে গিয়ে মাটি খুঁড়ল এবং তারা দেখলো যে তাদের বোনের পঁচে যাওয়া মৃত দেহ এবং তার পাশে একটা শিশু!
 ,

তারা বারসিসাকে গিয়ে ধরলো। তার বলল যে মিথ্যুক, প্রতারক, ভন্ড! কেনো সে এমন করল আর কি দোষে তাদের বোনকে হত্যা করা হল। তারা বারসিসাকে টেনে-হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে গেল। বরসিসাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হল।এবার আবারও শয়তান আসলো বারসিসার কাছে। এবার কিন্তু সে মনের ওয়াসওয়াসা হিসেবে আসে নি। এবার সে সরাসরিই এসেছে আরো অনেক বড় ধোঁকা দিতে, পূর্ণ শক্তি নিয়ে। চূড়ান্ত এবং চরম ধোঁকা দিতে শয়তান মানুষের রূপে বারসিসার নিকট এসে বলল যে সে কি জানে সে কে, সে হল স্বয়ং শয়তান যে কি না তাকে এত ঝামেলার মধ্যে ফেলেছে। সুতরাং সমস্যা সৃষ্টি করেছে সে, তাই সমাধানও একমাত্র সে ই জানে! এখন বারসিসার সিদ্ধান্ত যে সে কি মৃত্যুদন্ড পেতে চায় না কি শয়তানের সমাধান অনুযায়ী বাঁচতে চায় কেননা এই চরমতম মূহুর্তে শয়তানই পারে তাকে সমাধান দিতে। বারসিসা শয়তানকে বলল যে তাকে বাঁচাতে! শয়তান বারসিসাকে বলল যে সিজদাহ কর যে তোমাকে হুকুম দিচ্ছে এখন। বারসিসা শয়তানকে সিজদাহ করল!
 ,
এরপর শয়তান বারসিসাকে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ! তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার খুব ভালো লাগলো, আমি একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।”
 ,
এরপর আর কখনওই বারসিসা শয়তানকে দেখতে পেল না আর এটাই ছিল বারসিসার জীবনের শেষ কাজ। কারণ এর কিছুক্ষণ পরই বারসিসার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছিল। অর্থাৎ তার জীবনের শেষ কাজটি ছিল একটি শিরক। শয়তানকে সিজদাহ করাটা ছিল শিরক। জীবন বাঁচানোর তাগিদে, পৃথিবীর মায়ায় সে শয়তনকে অন্তিম মূহুর্তেও বিশ্বাস করে তাকে সিজদাহ করেছিল কিন্ত শয়তান তো তাকে বাঁচায় নি। অথচ সে ছিল একজন সরল পথের হিদায়াহ্ প্রাপ্ত সৎ একজন উপাসক! যেহেতু সে একটা সময় ভেবেছিল যে কিছু জিনিস দ্বীন তথা জীবন-ব্যবস্থা তথা আদর্শ থেকে বাদ দিলে কি এমন ক্ষতি হয় এবং সে শয়তানের ছোট ছোট ধোঁকাগুলোকে এড়িয়ে চলতে পারে নি বরং প্রশ্রয় দিয়েছিল। একটা একটা ধাপ সে পেরিয়ে যাচ্ছিল। শয়তান তার প্রতি ধোঁকার মাত্রাটা দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছিল আর তাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। সে যেহেতু নিজের ভাবনাকেই প্রাধান্য দিচ্ছিল এবং সে যে এক আল্লাহর উপাসনা করত, তার কথার সাথে নিজের ভাবনা মিলিয়ে দেখে নি, দেখার চিন্তা করে নি আর সেই সুযোগটা শয়তান নিয়েছিল। সে শয়তানের কাছ থেকেই সমাধান নিত, পরমর্শ নিত অথচ তার মনে হত এটাই তো  যৌক্তিক আর এটাই তো বিবেক, এটাই তো ভালো কাজ আর এটাই তো মানবতা! সে ক্রমেই শয়তানের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছিল। তার ফেরার সুযোগ ছিল তার আত্মবিশ্লেষণ করে, তার চিন্তাকে তার এক আল্লাহর সিন্ধান্ত অনুযায়ী চলার মাধ্যমে।
 ,

বারসিসা মূলত অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল। সে ভাবতো সে তো হিদায়াহ্ প্রাপ্ত, সে তো সৎ। সে কখনোই চিন্তা করে নি যে শয়তান তাকে ধোঁকা দিতে পারবে। তবুও তার পরিস্থিতিকে পুঁজি করে শয়তান তাকে ধোঁকা দিয়েছে। শয়তান প্রথমেই এসে তাকে বলে নি যে, ‘সিজদাহ কর আমাকে!’ শয়তান মূলত তার ভালো কাজ করার মানসিকতাকেই কাজে লাগিয়েছে। একটি অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দেয়ার মত ভালো কাজ করার মন্ত্রণা শয়তানই দিয়েছিল। মেয়েটির কষ্ট লাঘবের জন্য তার ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসার মত ভালো কাজে তো শয়তানই উৎসাহ দিচ্ছিল। সে পরে তার কার্যক্রম নিয়ে পর্যালোচনা করত না যে তার আল্লাহ এ ব্যাপারে কি আদেশ দেয়। সে ভাবতো যে সে তো সৎ আর সৎই থাকবে।

 ,
আর এই ছাড় দেয়ার বিষয়গুলো হয়েছিল তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে। তার মনের প্রবৃত্তিগুলো, নারীর প্রতি আকর্ষণগুলো তার কাছে ভালো কাজ বলেই তো মনে হচ্ছিল, মূলত শয়তানই নারীর প্রতি প্রবৃত্তিগুলোকে ভালো কাজের মোড়কে প্রক্রিয়া করে তার কাছে উপস্থাপন করছিল আর সে ভাবছিল যে আরে এটাই তো যৌক্তিক আর এটাই তো শিক্ষা অসহায় মানুষকে সেবা করার! শয়তান তাকে মেয়েটির যথাসম্ভব কাছে নিয়ে গিয়েছিল আর সে নিজেকে রক্ষা করা জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয় নি অর্থাৎ আল্লাহ যে ভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন, তা সে করে নি কিন্তু অনেকটা এরকম পরিস্থিতইতে ইউসুফ(আ) আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।

 ,
আল্লাহর সৃষ্টি নর-নারীর স্বাভাবিক আকর্ষণকে, প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে শয়তান এত দিনের ছোট-ছোট ধোঁকার ফলাফলে বারসিসাকে ব্যাভিচারের মত অনেক বড় গুনাহে লিপ্ত করে ফেলল। এরপরও বারসিসার পথ ছিল। সে তার আল্লাহর বিধানে ফিরে যেতে পারত। বৈধভাবে গ্রহণের পথ তখনও ছিল অথচ সে তা করল না। সে এতদিন অতিরিক্ত আত্নবিশ্বাসে ভুগছিল আর এই বড় গুনাহের পরে সে লোক-লজ্জার ভয় করতে থাকল, জীবনের ভয় করতে থাকল। ঈমানের চেয়ে তখন তার লোক-লজ্জা আর জীবনই বড় হয়ে গেল। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে শয়তান তাকে দিয়ে আরো বড় বড় দুইটি গুনাহ করিয়ে নিলো। সন্তান ও অসহায় নারীকে হত্যার মত বড় গুনাহ করিয়ে নিলো। এরপরও তার ঈমান বাঁচানোর পথ ছিল, আল্লাহর বিধানে ফিরে যাওয়ার পথ ছিল অথচ সে তার জীবনকেই সব থেকে বেশি মূল্য দিচ্ছিল। কারণ সে তার আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, সে তা থেকে সমাধান খোঁজে নি!
 ,

অন্তিম মূহুর্তে শয়তান তার আসল এবং প্রকৃত উদ্দেশ্যটি বাস্তবায়নের জন্য আসলো। সে তার ঈমানকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে আসলো। শয়তান নিজেকে সিজদাহ করতে আহবানের মাধ্যমে তাকে পুরোপুরি অবিশ্বাসী তথা কাফির বানাতে আসলো। অথচ তখনও বারসিসার সুযোগ ছিল পরামর্শদাতা হিসেবে শয়তানকে অবিশ্বাস করা এবং তার আল্লাহর বিধান কে গ্রহণ করা যেই এক আল্লাহর উপাসনা সে করত। অথচ জীবনের মায়ায়, আপাত বাস্তবতার তাগিদে সে শেষ বারের মতও শয়তানের মত প্রকাশ্য শত্রু এবং অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করে বসলো এবং শয়তানকে সিজদাহ করে শেষ বারের মত ঈমানের পরীক্ষায় ঈমান শয়তানের নিকট খুঁইয়ে বসলো। একজন অবিশ্বাসী কাফির অবস্থায় শিরকের মত গুনাহ করে বারসিসার মৃত্যুবরণ করে নিতে হল। আর আমরা জানি যে ঈমানহারা তথা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার মানে হল, অনন্তকালের জন্য জাহান্নামের আগুনের জ্বালানি হওয়া।
 ,

শয়তান বারসিসার সাথে যেই নীতিটি অনুসরণ করলো তা হল, বারসিসসার ঈমানের ত্রুটিটিকে পুঁজি করে তাকে ভালো কাজে উৎসাহ দিতে থাকলো। এভাবে সে বারসিসাকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল এবং একটা সময় সে পিছন থেকে তাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিল। বারসিসার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অথবা অভিজ্ঞতা ছিল না। আল্লাহই মূলত তার ঈমানকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। বারসিসা কিন্তু প্রথম অবস্থায় মেয়েটির দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিল, কেননা তার এই জ্ঞান ছিল যে এই দায়িত্বভার এবং নারী তাকে ফিতনায় ফেলে দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তার ঈমানকে অবশ্যই পরীক্ষা করলেন। সে ফিতনায় পড়ে গেল অথচ আল্লাহ নিকট সাহায্য আর চাইলো না, সাহায্য চাইলো অভিশপ্ত শয়তানের কাছে এবং এতেই সে আল্লাহর নেয়া ঈমানের পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে অকৃতকার্য হয়ে গেল।


ঘটনা থেকে শিক্ষা কি পেলাম?১) শয়তান কখনোই আপনাকে সরাসরি এসে পাপ করতে বলবে না। সে সব সময়ই আপনাকে ভালো ভালো কারণ দেখিয়ে ধোঁকায় ফেলবে, এবং শয়তান আমাদের যে কারো চাইতেই বেশী ধৈর্য্যশীল। কাজেই আমরা সবসময়ই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
 ,

২) কখনোই ভাববেন না যে আপনার অনেক জ্ঞান আছে, বিচার-বুদ্ধি আছে, শয়তান কিছুতেই আপনাকে ধোঁকায় ফেলতে পারবে না। বরং, প্রকৃত জ্ঞানীরা শয়তানের ফাঁদে পড়ার ভয় সবচাইতে বেশী করে। এই কারণেই আপনি দেখবেন আলেমদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি) সবচাইতে বেশী।
 ,
৩) কাহিনীটা নিয়ে চিন্তা করুন। শয়তান যদি প্রথমেই এসে বারসিসাকে বলত – ‘আমাকে সিজদা কর’ – বারসিসা কখনোই তা করতো না। কিন্তু শয়তান তার পরিকল্পনা মাফিক ধীরে ধীরে একটার পর একটা ছোট ছোট ধাপে বারসিসাকে দিয়ে ভুল করিয়ে অবশেষে তাকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে জীবন রক্ষার তাগিদে সে অবশেষে শিরক করে ফেলে, যে পাপ আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।
 ,
৪) শেষ কথা, আল্লাহ যা করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, তা থেকে আমরা বিরত থাকবো। নিজে থেকে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করব না যে – এটা করলে কি হয়? এ আর এমন কি? আল্লাহ নিষেধ করলে কি হবে দেখতে তো মনে হয় এটা একটা ভালো কাজ! এটা তো ছোট্ট একটা পাপ!
 ,
না, আল্লাহর যে কোন অবাধ্যতাই পাপের পথে নিয়ে যায়, আপাতদৃষ্টিতে পাপটা যত ছোটই হোক না কেন, ছোট পাপই বড় পাপের দিকে টানে, বড় পাপ টানে কুফরীর দিকে।
 ,
বর্তমানের তরুণ-তরুণীদের তথাকথিত “রিলেশনশিপ” শয়তানের এই কাজকে আরও সহজ করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ সকলকে শয়তানের ধোঁকা থেকে হিফাজত করুন। আমিন।

 ,
[মূলঃ শাইখ আনওয়ার আল আওলাকি(রহিমাহুল্লাহ) এর লেকচার থেকে]

রেফারেন্স:

পবিত্র কুরআনের বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর ইবনে কাসিরে সূরা হাশরের ১৬-১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় এই কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে।
                  <div id=vuukle-emote></div>
                  <div id=vuukle_div></div>
                  <script src=http://vuukle.com/js/vuukle.js type=text/javascript></script>
                  <script type=text/javascript>
                    var VUUKLE_CUSTOM_TEXT = '{ "rating_text": "Give a rating:", "comment_text_0": "Leave a comment", "comment_text_1": "comment", "comment_text_multi": "comments", "stories_title": "Talk of the Town" }';
                    var UNIQUE_ARTICLE_ID = "Please pass the unique article id of the article";
                    var SECTION_TAGS = "tag1, tag2, tag3";
                    var ARTICLE_TITLE = "Please pass the title or heading of the story";
                    var GA_CODE = "UA-123456";
                    var VUUKLE_API_KEY = "8d9d0fe2-28fd-4072-b10e-c1793a5f00a9";
                    var TRANSLITERATE_LANGUAGE_CODE = "en";
                    var VUUKLE_COL_CODE = "148aa3";
                    var ARTICLE_AUTHORS = btoa(encodeURI('[{"name": "name one", "email":"some_mail@site.com","type": "internal"}, {"name":"name two", "email":"some_other_mail@site.com","type": "external"}]'));
                    create_vuukle_platform(VUUKLE_API_KEY, UNIQUE_ARTICLE_ID, "0", SECTION_TAGS, ARTICLE_TITLE, TRANSLITERATE_LANGUAGE_CODE, "1", "", GA_CODE, VUUKLE_COL_CODE, ARTICLE_AUTHORS);
                  </script>
               

Ad Code

Responsive Advertisement