পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের হিদায়াতের জন্য যুগে যুুগে আম্বিয়ায়ে কিরাম (আ.)কে প্রেরণ করেছেন। সেই সুমহান ধারার সর্বশেষ পয়গাম্বর হলেন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আল্লাহ তা‘আলা সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করা, তাঁর অনুসারী হওয়া, তাঁকে সম্মান করা সকল উম্মতের মুহাম্মদী তথা সকল মুসলমানের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসার প্রতি তাগিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন-
قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
“(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ¶মা করে দিবেন। আর আল্লাহ পরম ¶মাশীল দয়ালু। (সূরাহ আলে-ইমরান, আয়াত : ৩১)
এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি বা মহব্বত লাভ করার জন্য হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করাকে শর্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে যত বেশী মহব্বত করবে, তার অনুকরণ-অনুসরণে যে যত বেশী যত্নবান হবে, সে তত বেশী আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা ঈমানের দাবী-এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভালবাসার কিছু ধাপ বা স্তর রয়েছে। যেমন, আমরা আমাদের মাকে ভালবাসি, স্ত্রীকেও ভালবাসি, আবার কন্যাকেও ভালবাসি। এখন প্রশ্ন হল, মায়ের ভালবাসা যেমন স্ত্রীকে দেয়া যাবে না, তেমনি স্ত্রীর ভালবাসা মাকে দেয়া যাবে না। আবার কন্যার ভালবাসা যেমন স্ত্রীকে দেয়া যাবে না, তেমনি স্ত্রীর ভালবাসাও কন্যাকে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সকল ভালবাসাকে যদি সমান্তরালে মূল্যায়ন করা হয়, তবে সামাজিক ও পারিবারিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।
জাগতিক ক্ষেত্রে যেমন ভালবাসার শ্রেণী বিন্যাস রয়েছে, আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসার ক্ষেত্রেও তেমনি সংশ্লিষ্ট ধাপ বা স্তর রয়েছে। সুতরাং মহান আল্লাহকে তাঁর রবুবিয়্যাত অনুযায়ীই মহব্বত করতে হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের আসনেই মহব্বত করতে হবে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের কিছু বাতিল বিদ‘আতপন্হী লোক আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বতের এ সীমাকে লংঘন করে আল্লাহর বিভিন্ন রবুবিয়্যাতের গুণকে রাসূলের জন্য সাব্যস্ত করে। এভাবে তারা নবীজীকে ভালবাসার নামে এমন কিছু আকীদা পোষণ করে থাকে-যা সরাসরি শিরক কিংবা বিদ‘আত। তারা নবীজীর জন্ম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে মনগড়া কাল্পনিক কিছু অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তেমনি মীলাদের নামে মনগড়া গলদ তরীকায় দরূদ পাঠ করে, নবীজীকে হাজির-নাজির বিশ্বাস করে মীলাদের মজলিসে দাঁড়িয়ে কিয়াম করে, নবীজীকে ইলমে গাইবের অধিকারী মনে করে, তাঁকে মুখতারে কুল বিশ্বাস করে ইত্যাদি শিরকী আকীদা পোষণ করে এবং বিভিন্ন বিদ‘আত কাজ করে।
ইসলাম মহান আল্লাহর সর্বশেষ পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবন বিধান। এর মধ্যে কোন প্রকার সংযোজন-সংকোচন বা সংশোধন কিংবা পরিবর্তন-পরিবর্ধেনর অবকাশ নেই। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের ৮১ দিন পূর্বে দশম হিজরী সনের ৯ জিলহজ্জ শুক্রবার বাদ আসর বিদায় হজ্বের দিনে সোয়া ল¶ সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর বিশাল সমাবেশে ইসলামের পূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার প¶ থেকে পবিত্র কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-
اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا
“আজকের দিনে তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করলাম। ”
(সূরাহ মায়িদা আয়াত, আয়াত নং ৩)
উপর্যুক্ত আয়াতে কারীমা থেকে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। আর আকীদা ও আমলের সমষ্টির নাম হল দ্বীন। সুতরাং আমল ও আকীদা কোনটিতেই কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার অবকাশ নেই। এ উভয় ক্ষেত্রে হিদায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি মৌলিকভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
অতএব, শরীয়তের দলীল দ্বারা সমর্থিত নয়-এমন কোন বিষয় যদি দ্বীনের সাথে কেউ সংযোজন করে, তবে তা হবে বিদ’আত। আর সংযোজনকারীকে বলা হবে বিদ’আতী।
সুন্নাত ও বিদ’আত দুই বিপরীতার্থক আরবী শব্দ। ইসলামী তাহযীবের যতগুলো মৌলিক পরিভাষা রয়েছে, যে সব পরিভাষার উপর ইসলামী জীবন ব্যবস্হার সম্যক অনুধাবন নির্ভরশীল, এ দু’টো শব্দ তারই মধ্যে গণ্য। এ দু’টো শব্দের সঠিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ এবং এ দু’টোর দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের আকীদা ও আমল-আখলাক যাচাই ও পরখ করা একান্তভাবে জরুরী।
বস্তুত সুন্নাত ও বিদ‘আত সম্পর্কে সম্যক অবগতির অভাবে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বিভিন্ন ভ্রান্তির জাল বিস্তার লাভ করে। অপরদিকে দ্বীনের কাজ নয় বা কোন প্রকার সাওয়াবের কাজ নয়, এমন কোন বিষয়কেও অতি পুণ্যের কাজ মনে করা হয়।
আলোচ্য প্রবন্ধে সুন্নাত ও বিদ’আত-এর সংজ্ঞা এবং উভয়ের পার্থক্যের বিশদ আলোচনার পাশাপাশি কতিপয় কুরআন ও সুন্নাহ বিবর্জিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর মাসলাকের বিরোধী কিছু শিরক ও বিদ’আতী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
সুন্নাত শব্দের অর্থ
সুন্নাত (السّنَّۃَ)-এর আভিধানিক অর্থ : পথ। যেমন, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
سُنَّۃَ اللّٰہِ الَّتِیۡ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلُ ۚۖ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّۃِ اللّٰہِ تَبۡدِیۡلًا
“আল্লাহর সুন্নাত-যা পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে রয়েছে এবং আল্লাহর এ সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন দেখবে না কখনো। ” (সূরাহ ফাতাহ, আয়াত : ২৩)
পবিত্র কুরআনে এই সুন্নাতকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَنَّ ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
“নিশ্চয়ই এ হচ্ছে আমার সঠিক সফল দৃঢ় পথ। অতএব, তোমরা এ পথই অনুসরণ করে চলবে। এ ছাড়া অন্য পথের অনুসরণ করবে না। তা করলে তোমাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের এরূপ-ই নির্দেশ দিয়েছেন; যেন তোমরা ভয় করে চল। ” (সূরাহ আন‘আম, আয়াত নং ১৫৩)
আলোচ্য আয়াতে কারীমায় ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ বলতে সেই বিষয়ই বুঝানো হয়েছে, যা বোঝায় ‘সুন্নাত’ শব্দ থেকে।
সুন্নাত শব্দের পারিভাষিক অর্থ
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ, আদত-অভ্যাস এবং তাঁর কার্যানুমোদন অর্থাৎ তিনি যা করেছেন ও করতে বলেছেন এবং তাঁর সামনে যা করা হয়েছে-যাতে তিনি তাতে কোনরূপ আপত্তি করেননি, তৎসমুদয় কাজই হলো মূলত রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত।
সেই সাথে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং তাবিয়ীন ও তাবে-তাবিয়ীন (রহ.)গণের দ্বীন সম্পর্কীয় কথা, আকীদা-বিশ্বাস এবং আমল-আখলাকও রাসূলে কারীমের নির্দেশানুযায়ী সুন্নাতের অন্তভর্ুক্ত। যেমন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَلَيْكُم‘ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الخُلَفَاءِ الرَّشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ
“আমার সুন্নাত এবং আমার সত্যানুসারী খলীফাগণের সুন্নাত তোমাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। ”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ
“তোমরা যদি তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে গোমরাহ হয়ে যাবে। ” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৪))
রাসূলের সুন্নাত মানে রাসূলের আদর্শ, রাসূলের কর্মবিধান। আর তা অনুসরণ না করা মানে তার বিপরীত কর্মাদর্শ মেনে চলা। তাহলে যে লোক রাসূলের বিপরীত কর্মাদর্শ পালন ও অনুসরণ করে চলবে, সে কিছুতেই ইসলামপন্হী হতে পারে না। সে কখনো মুসলিম হতে পারে না।
বিদ‘আত শব্দের অর্থ
বিদ‘আত (اَلْبِدْعَةُ)-এর আভিধানিক অর্থ : কোনরূপ পূর্ব-নমুনা না দেখে এবং অন্যকিছুর অনুকরণ-অনুসরণ না করেই কোন কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা। আর দ্বীনের ক্ষেত্রে যে বিদ‘আত সংঘটিত হয়ে থাকে, তার সংজ্ঞা হল-দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদ‘আত হচ্ছে এমন কোন বিষয় নবআবিষ্কার করা, যার অস্তিত্ব পূর্বে ছিলো না এবং যার প্রতি শরীয়তে কোনরূপ অনুমোদন নেই। তা শরীয়তের নিয়ম হিসেবে বা ছাওয়াবের কাজ মনে করে করাই হচ্ছে বিদ‘আত। (মিরকাত শরহে মিশকাত)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন-“শরীয়তে এমন সব কাজ করা বিদ‘আত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। ”
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) বলেন-“হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল না এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করাকেই শরীয়তের পরিভাষায় বিদ’আত বলা হয়। (মিরকাত)
বিদ‘আত সম্পর্কে হাদীস শরীফে সতর্ক করা হয়েছে। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে-যা এই দ্বীনের মধ্যে নেই, তা বাতিল বলে গণ্য হবে। ”
(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন-“যে লোক ইসলামে এমন কোন বিষয় প্রবেশ করাবে এবং তাকে ইসলামের কাজ বলে চালিয়ে দিবে, যার অনুকূলে কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল বিদ্যমান নেই, তা-ই প্রত্যাহারযোগ্য। আর এরই অপর নাম বিদ‘আত। ” (মিরকাত, শরহে মিশকাত)
আল্লামা আইনী (রহ.) স্বীয় উমদাতুল ক্বারী গ্রন্হে বলেন-“মূলত বিদ‘আত হল এমন নতুন কাজ আবিষ্কার করা যার কোন অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল না।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বুখারী শরীফের শরাহ-গ্রন্হ ‘ফাতহুল বারী’তে বলেন-“বিদ‘আতের অর্থ হলো-এমন নতুন কাজ-যার কোন দৃষ্টান্ত পূর্ববতর্ী যুগে নেই। আর শরীয়তের পরিভাষায় যা সুন্নাতের পরিপন্হী, তা নিন্দনীয়।
মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (রহ.) ‘তা‘লীমুল ইসলাম’ কিতাবে বলেন-“বিদ‘আত ওই বিষয়গুলোকে বলা হয়, যার ভিত্তি শরীয়তে বিদ্যমান নেই। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসে যার দলীল পাওয়া যায় না এবং সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়ীন ও তাবি-তাবিয়ীনদের যুগে যার অস্তিত্ব ছিল না, অথচ দ্বীনের কাজ মনে করে তা পালন করা হয়।
মাওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানী (রহ.) স্বীয় তাফসীরগ্রন্হে বলেন-“কুরআন-সুন্নাহ এবং খাইরুল কুরুন অর্থাৎ প্রাথমিক তিন যুগে যে কাজের মূল ভিত্তি নেই, তা দ্বীনের কাজ মনে করে করাই হলো বিদ‘আত।
বিদ‘আতের প্রকারভেদ
সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত ধারণা হল-বিদ‘আত দু’প্রকার। একটি হলো বিদ‘আতে হাসানাহ অর্থাৎ ভাল বিদ‘আত এবং অপরটি হলো বিদ‘আতে সাইয়্যিআহ অর্থাৎ মন্দ বিদ‘আত। বিদ‘আতের এই বিভাগও একটি অভিনব বিদ‘আত। কেননা, বিদ‘আত মাত্রই মন্দ। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে- كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ“প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। ” সুতরাং বুঝা গেলো-ইসলামে ভাল বিদ‘আত বলতে কিছু নেই।
অথচ একশ্রেণীর মানুষ বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ দু’ভাগে করে বহুসংখ্যক বিদ‘আতকে ভাল বানানোর প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। যা নিতান্তই নিন্দনীয়।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং তাদের ভ্রষ্ট পথ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। যেমন, তিনি প্রায়ই খুতবায় ইরশাদ করেন-
إِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ
“সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হিদায়াত হলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথনির্দেশনা। আর সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হলো নব-আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ। অনন্তর প্রতিটি বিদ‘আত গোমরাহী এবং প্রতিটি গোমরাহী দোজখের মধ্যে পড়বে। ” (সহীহ বুখারী)
অপর এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ , وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
“সাবধান, তোমরা নব-আবিষ্কৃত কাজসমূহ থেকে দূরে থাকবে। কারণ, প্রতিটি নব-আবিষ্কৃৃত কাজই বিদ‘আত আর প্রত্যেক বিদ‘আতই হচ্ছে গোমরাহী। ” (সুনানে আবু দাউদ)
বস্তুত বিদ‘আতে হাসানা বা সাইয়্যিআহ-এর যে বিভক্তি করা হয়, আসলে তা হলো আভিধানিক অর্থে, শরীয়তের পরিভাষায় নয়। যেমন-হযরত উমর (রা.) জামা’আত সহকারে নিয়মিত ২০ রাক‘আত তারাবীহ আদায়ের আয়োজনকে উত্তম বিদ‘আত বলেছেন। এটা তিনি বলেছেন আভিধানিক অর্থ হিসেবে অর্থাৎ বিষয়টি নতুনভাবে ইন্তিজামের সাথে চালু করা হয়েছে-যদিও তার আমল ইসলামে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিলো।
অনুরূপ দ্বীনী ইল্মকে জিন্দা রাখার জন্যে নিয়মিত মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, কুরআন হাদীসের সঠিক জ্ঞানলাভের জন্যে নাহু, সরফ, বালাগাত, মান্তেক ইত্যাদি ইলমের অধ্যায় তৈরী করা, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের নব-আবিষ্কৃৃত যানবাহন এবং যোগাযোগের যাবতীয় যন্ত্রপাতি, মাইক্রোফোন, টেলিফোন, মোবাইল, রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার ইত্যাদি এবং বাসা-বাড়ীর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন-বিদ্যুৎ, লাইট, ফ্যান, এসি, ফ্রিজ ইত্যাদি নব-শাব্দিক অর্থে আবিষ্কৃত হলেও পারিভাষিক অর্থে বিদ‘আত নয়। কেননা, এগুলো কেউ ইসলামের আমল বা ছাওয়াবের বিষয় মনে করে ব্যবহার করে না। দুনিয়াবী জরুরতের জন্য ব্যবহার করে।
সুতরাং মূলকথা এই দাঁড়ালো যে, সুন্নাতে রাসূলের মধ্যে নেই বা সাহাবায়ে কিরামের আমলেও নেই অথবা আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ইজতিহাদপ্রসূতও নয়, বরং তাদের যুগের পরের লোকেরা নিজেদের খেয়াল-খুশী তো ইবাদত-বন্দেগীর নামে যেসব নতুন বিষয় সৃষ্টি করেছে অথবা খাইরুল কুরুনের কোন বিষয়ের মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-সংকোচন বা সংশোধনের পথ অবলম্বন করা হয়েছে, এসবই হলো মনগড়া আমল বা বিদ‘আত।
সকল মুসলমানের এ বিদ‘আত থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। বরং সকলের ঈমানী দায়িত্ব হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত অনুসারে জীবন নির্বাহ করা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন