Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

শহীদ ড.আব্দুল্লাহ আযযাম (রাহিঃ) জিবনী

শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী . আসবাহ আল হারতিয়া৷ ফিলিস্তিনের জেনিন
প্রদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম৷ যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পাতায় এ গ্রামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ৷ কারণ এ গ্রাম জন্ম দিয়েছে বহু মহামানবকে, বহু মুজাহিদ আর সমরবিদকে, বহু দার্শনিক আর চিন্তাবিদকে, বহু সাহিত্যিক আর ভাষাবিদকে৷ . ১৯৪১ সাল৷ আসবাহ আল হারতিয়া তখন পরাধীন। ইহুদিদের পদভারে রক্তাক্ত৷ দুরন্ত বায়ুর বুকে সন্তানহারা মায়েদের আহাজারি৷ এতিম শিশুদের আর্তচিৎকার৷ অসহায় বৃদ্ধ আর বৃদ্ধাদের চোখে চোখে অশ্রুর বান৷ কৌমার্যছিন্ন যুবতী আর তরুণীদের চোখে প্রতিশোধের লেলিহান আগুন৷ ঠিক তখন আসবাহ আল হারতিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এক নবজাত সন্তান৷ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম৷ পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত হন ইসলামী আকিদাহ-বিশ্বাসে৷ মহব্বত করতে শিখেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, আল্লাহর পথে জিহাদে রত বীর বাহাদুরদেরকে, সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদেরকে। আখিরাতের চিন্তা-ফিকির আর শাহাদাতের তামান্না শৈশব থেকেই তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠতে থাকে।  .

 আব্দুল্লাহ আযযাম একটু ব্যতিক্রমধর্মী - সদা গভীর, নিষ্ঠাবান, চিন্তায় ডুবে থাকা এক কিশোর৷ নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা তাঁর চরিত্রকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে৷ অল্প বয়সেই তিনি দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। ইসলামি চিন্তা-চেতনাকে মুসলমানদের মাঝে জাগ্রত করতে পেরেশান হয়ে পড়েন৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই তাঁর অসাধারণ গুণাবলি দেখে শিক্ষকরা হতবাক হয়ে যেতেন। তারা ভাবতে থাকেন, আমাদের এ সন্তান কালের ব্যবধানে নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে৷ হয়তো আল্লাহ তা'লা তাঁর দ্বারা ইসলামের সংস্কারের কাজ করাবেন৷ সুনামের সাথেই তিনি লেখাপড়া করতে থাকেন৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া সুনামের সাথেই শেষ করেন৷ ক্লাসে সবার চেয়ে ছোট হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সুদর্শন ও মেধাবি। এরপর তিনি এগ্রিকালচারাল কাদরী কলেজে ভর্তি হন এনং সেখান থেকেই ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। .


তারপর দক্ষিণ জর্দানের আদ্দির নামক গ্রামে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন৷ কিন্তু তাঁর পিপাসার্ত মন তখনো ছিল অস্থির-উতলা। তাই দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়াহ বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৬ সালে শরিয়াহ(ইসলামী আইন) এর ওপর বিএ ডিগ্রি লাভ করেন৷ . ১৯৬৭ সাল। ইহুদিরা পশ্চিম তীর দখল করে নিল৷ রক্তে রঞ্জিত হল পশ্চিম তীর৷ চোখের সামনে দেখলেন, নির্যাতন আর নিপীড়নের ভয়াল চিত্র৷ বুক ফাটা আহাজারি, কান্না আর বিলাপের অসহনীয় বেদনায় টানটান করতে থাকে তাঁর হৃদয়। চোখেই জমাট বেঁধে যায় অশ্রু। তিনি শপথ করলেন, না, আর নয়। ইহুদীদের দখলদারিত্বের অধীনে তিনি আর থাকবেন না। . তাঁর পেশিতে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে। চিরচেনা শান্ত সমাহিত সেই আযযম যেন জলন্ত অঙ্গার। তবে অত্যন্ত নীরব। দারুণ চিন্তাশীল। সময়ের ব্যবধানে হলেও তিনি সফলতার মুখ দেখতে চান।


 অত্যাচারীদের হাত গুটিয়ে দিতে চান চিরতরে। . ১৯৭০ সাল। তিনি তখন জর্দানে। ইসরাঈলি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিলেন। শুরু হল তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়। চিন্তায় লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে দৃঢ়পপদে এগিয়ে চললেন। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর অনুধাবন করলেন, না, তাঁকে আরও পড়ে হবে। তাঁকে আরও শিখতে হবে। অল্পবিদ্যা নিয়ে সামনে এগোনো যে বড়ই কঠিন। অত্যন্ত দুষ্কর। তাই তিনি চলে এলেন মিশরে। ভর্তি হলেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার তিনি ইসলামী আইন শাত্রে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করলেন। ১৯৭১ সালে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান্ডিত্যের পুরষ্কার লাভ করেন। সে বছরই তিনি ইসলামি আইনের বিজ্ঞান ও দর্শন ( উসুলুল ফিকাহ) এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে মিশরে অবস্থানকালে শহীদ সাইয়্যেদ কুতুবের রহ. (১৯০৬-১৯৬৬) পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। . শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম দেড় বছর ফিলিস্তিননের জিহাদে অতিবাহত করেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জিহাদে কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু এসময় তিনি মানসিকভাবে প্রশান্ত ছিলেন না।


কারণ তিনি দেখতেন, যারা ফিলিস্তিন জিহাদে রত তারা ইসলাম থেকে অনেক দূরে। মাঝে মধ্যেই তিনি দুঃখ করে বলতেন, ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য এটা কোন ধরনের জিহাদ হচ্ছে, যেখানে মুজাহিদ ভাইয়েরা প্লেইং কার্ড, গান শোনা আর টেলিভিশনে অশ্লীল ছবি দেখে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে! তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতেন, হাজারো মানুষের জনবহুল জায়গায় সালাতের জন্য আহ্বান করা হলে একেবারেই অল্প সংখ্যক লোক উপস্থিত হয় যাদের হাতের আঙ্গুলী দিয়ে গোনা সম্ভব, এদের দিয়ে কী জিহাদ হবে! তাই তিনি তাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তারা তাঁকে প্রতিহত করত। বাধা দিত।  একদিন তিনি এক মুজাহিদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ফিলিস্তিনের এ অভ্যুত্থানের সাথে কি দ্বীনের কোনো সম্পর্ক আছে? তখন সেই মুজাহিদ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলল, এই অভ্যুত্থানের পশ্চাতে দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই।  . এ কথা শুনার পর তাঁর মন ভেঙে যায়। তিনি ফিলিস্তিনের রণাঙ্গন ত্যাগ করে সৌদি আরব চলে আসেন। জেদ্দায় অবস্থিত বাদশা আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মাঝে ইসলামের নির্মল চেতনা ও জিহাদি জযবা সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠদানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারেন, মুসলিম উম্মাহর বিজয় ফিরিয়ে আনতে পারবে ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনী। এ ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়।


 তখন থেকে জিহাদ আর বন্দুক হয়ে যায় তাঁর প্রধান কাজ আর বিনোদনের সঙ্গী। তিনি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ঘোষণা করতে থাকেন, আর কোন সমঝোতা নয়, নয় কোন আলাপ আর আলোচনা। জিহাদ আর রাইফেলই হবে সমাধানের একমাত্র পথ। . ১৯৮০ সাল। হজ্জে এসেছেন এক আফগান মুজাহিদ। সহসা তার সাথে দেখা হয়ে যায় ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. এর। কথার তালে তালে সখ্যতা বৃদ্ধি পেল। একের পর এক শুনলেন আফগান জিহাদের অবিশ্বাস্য কাহিনীমালা। মুজাহিদদের ত্যাগ, কুরবানী আর আল্লাহর সাহায্যের কাহিনীমালা শুনতে শুনতে ড. আব্দুল্লাহ আযযাম অভিভূত হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, এতোদিন ধরে তিনি এ পথটিই খুঁজে ফিরছেন। এরই তালাশে আছেন। এরপর তাঁন মন অস্থির হয়ে উঠে। অশান্ত হয়ে উঠে। তিনি বাদশাহ আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চলে আসেন। . শুরুতে তিনি ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আফগান মুজাহিদ নেতার সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। তখন আফগান জিহাদ সম্পর্কে তিনি বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করেন। নানা বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। চলমান জিহাদের রূপরেখা অনুধাবন করেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পুরোপুরিভাবে আফগান জিহাদে আত্মনিয়োগ করেন। হৃদয়-মন, মেধা-যোগ্যতা, অর্থ-সম্পদ সবকিছু অকাতরে উজাড় করে দান করেন।


 আত্মতৃপ্ত শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের কন্ঠ চিরে বার বার রাসূলের ﷺ এই বাণীটি মুজাহিদদের মাঝে ছাড়িয়ে পড়ত,  “আল্লাহর পথে জিহাদের ময়দানে এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকা ষাট বৎসর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” তারপর তা তাদের হৃদয়ে ছুঁয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করত। শাহাদাতের আশায় তাদের অস্থির করে ছাড়ত। ব্যাকুল করে দিত। . আব্দুল্লাহ আযযাম ও তাঁর প্রিয় শিষ্য উসামা বিন লাদেন পেশোয়ারে অবস্থানকালে মুজাহিদদের সেবা সংস্থা বায়তুল আনসারে যোগ দেন। এ সংস্থা আফগান মুজাহিদদের সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করত। নতুন মুজাহিদদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে সম্মুখ যুদ্ধে প্রেরণ করত। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর পরিবারকেও নিয়ে আসেন।

. এরপর আব্দুল্লাহ আযযাম আরো সামনে অগ্রসর হলেন। জিহাদের প্রথম কাতারে গিয়ে শামিল হলেন। হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সম্মুখ লড়াইয়ে। অসম সাহসিকতায় বীরের মত যুদ্ধ করতে লাগলেন। আল্লাহর রাহে জীবন দেওয়ার জন্য তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। ছুটে চললেন এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে। এক রণক্ষেত্র থেকে আরেক রণক্ষেত্রে। আহ! এ যেন আরেক জীবন। এ জীবনের কোন মৃত্যু নেই। এর স্বাদ, রঙ আর প্রকৃতি একেবারে আলাদা। অনন্য। . তিনি আফগানিস্তানের অধিকাংশ প্রদেশে ছুটে গেলেন। লোগার, কান্দাহার, হিন্দুকুশ পর্বতমালা, পাঞ্জশির উপত্যকা, কাবুল আর জালালাবাদে ছুটে চললেন বিরামহীন গতিতে। ফলে আফগান রণাঙ্গনের সাধারণ যোদ্ধা ও মুজাহিদদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সখ্যতা হয়। বন্ধুত্ব হয়। সবাই তাঁকে তাঁর হৃদয়ের উদারতা, জিহাদী জযবা, আল্লাহর রাহে জীবন দেয়ার আকুতি, মুসলিম উম্মাহর দরদী ব্যক্তিত্বের কারণে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতে থাকে। মহব্বত করতে থাকে। . এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন পেশোয়ারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এবার তিনি একেবারে টইটম্বুর। গোটা আফগান রণাঙ্গনের সমস্যা-সমাধান তাঁর মস্তিষ্কের কোষে কোষে। জিহাদের এই কাফেলাকে সঠিক পথে পরিচালনার ও চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার তামান্নায় তিনি অধীর অস্থির। তাই মুজাহিদদের মাঝে সংস্কারমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন।

মুজাহিদদের পরিশুদ্ধ করতে লাগলেন। জিহাদের পথে নানা বিভ্রান্তির আলোচনা করতে লাগলেন। বিভক্ত মুজাহিদদের গ্রুপগুলোকে একই কাতারে শামিল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের সেই বক্তৃতা সংকলনই পরবর্তীতে ‘ফি জিলালি সুরাতিত তাওবাহ’ নামক গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়। . আফগান মুজাহিদ নেতাদের মাঝে তাঁর প্রভাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাই সবাই তাঁকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। তাঁর প্রস্তাব, পরিকল্পনাকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারতো না। . এরপর তিনি মুসলিম উম্মাহকে জিহাদের ব্যাপারে জাগ্রত করার দিকে মনোনিবেশ করেন। আফগান জিহাদের পবিত্র আহ্বানকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে ছুটে যান বিশ্বের বহু দেশে। সাক্ষাৎ করেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও সমাজসেবক ব্যক্তিত্বদের সাথে। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতে থাকেন। চারদিকে ছুটতে থাকে অনল প্রবাহ। তিনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য, শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের লুন্ঠিত ভুমিকে উদ্ধারের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। . অবসরে তার কলমও ছুটতে থাকে। তিনি জিহাদ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পুস্তকও রচনা করেন। যা এখনো পাঠককে আন্দোলিত করে। আলোড়িত করে। জিহাদের পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে।

পুস্তকগুলোর শীর্ষে রয়েছে- এসো কাফেলাবদ্ধ হই, আফগান জিহাদে আর-রহমানের নিদর্শনসমূহ, মুসলিম ভূমিসমূহের প্রতিরক্ষা ইত্যাদি। . শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের অবিরাম প্রচেষ্টা, মেহনত-মুজাহাদা সফলতার আলো দেখতে পায়। তিনি বিশ্বের মুসলমানদেরকে আফগান জিহাদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ফলে আফগান জিহাদ শুধু আফগান জনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা আফগান জিহাদে অংশগ্রহণ করতে ছুটে আসতে থাকে। তারা ইহুদি-খ্রিস্টানদের হাতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলিম মা-বোনদের উদ্ধারে শপথ গ্রহণ করতে থাকে এবং প্রত্যেক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে। . তিনি তাঁর মানসপটে একটা চিত্রই এঁকেছিলেন। তা হল, জিহাদের মাধ্যমে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বারবার বলতেন, পৃথিবীর বুকে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। তাই তিনি বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাবকে অকুষ্ঠ চিত্তে প্রত্যাখান করেছেন।

আর দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাবেন যতক্ষণ পর্যন্ত হয় তিনি বিজয়ী হবেন, নতুবা তাঁকে হত্যা করা হবে। . আফগান রণাঙ্গন ছিল তাঁর স্বপ্নের চারণভূমি। তাই তিনি বলতেন, আমি কখনও জিহাদের ভুমি পরিত্যাগ করব না, তিনটি অবস্থা ছাড়া। হয় আমি আফগানিস্তানে নিহত হব, নতুবা পেশোয়ারে নিহত হব, নতুবা হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হবে। . একদিন মিম্বারে খুতবাহ দানকালে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আমি মনে করি, আমার প্রকৃত বয়স হচ্ছে নয় বৎসর। সাড়ে সাত বৎসর কেটেছে আফগান জিহাদে আর দেড় বৎসর কেটেছে ফিলিস্তিন জিহাদে। এছাড়া আমার জীবনের বাকী সময়গুলোর কোনো মূল্য আমার কাছে নেই।” তিনি আরও বললেন, জিহাদ পরিত্যাগ করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এক আল্লাহর ইবাদাত করা হবে। জিহাদ চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সব নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করা হবে। জিহাদ চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের সম্মান ও লুন্ঠি্ত ভুমিগুলো ফিরিয়ে আনা হবে। জিহাদ হল চিরস্থায়ী মর্যাদার পথ। .

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ্য করে জুমআর খুতবায় বলতেন, মুসলিম জাতি কখনও অন্য জাতি দ্বারা পরাজিত হয়নি। বরং আমরা আমাদের নিজেদের লোকদের কাছেই পরাজিত হয়েছি। . শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারি ব্যক্তি ছিলেন। ধর্মানুরাগ, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, সংযমশীলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক অলংকার। তিনি কখনও কারো সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন না। তরুণদের তিনি ভিন্ন চোখে দেখতেন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সব ধরনের ভয়-ভীতি মাড়িয়ে হৃদয়ের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি নিয়মিত সিয়াম পালন করতেন। বিশেষ করে নবী দাউদের (আলাইহিস সালাম) সুন্নাহ অনুযায়ী একদিন সিয়াম পালন করতেন, আরেকদিন বিরত থাকতেন। এভাবে তিনি সারা বৎসর সিয়াম পালন করতেন। সোমবার ও বৃহস্পতিবার তিনি সিয়াম পালন করতেন এবং অন্যদেরও এ দু’দিন সিয়াম পালন করতে উৎসাহিত করতেন। . একবার এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। পেশোয়ারে কিছু উগ্র স্বভাবের লোক ঘোষণা দিল, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম কাফের হয়ে গেছে। কারণ তিনি মুসলমানদের সম্পদ অপচয় করছেন। 

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম এ সংবাদ শুনে বিস্মিত হলেন না। ক্ষিপ্তও হলেন না। তাদের সাথে কোন রুঢ় আচরণও করলেন না। বরং তাদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে দিলেন। এরপরও কিছু লোক বিরত হল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে কটু কথা বলতে লাগল। অপবাদ ছড়াতে লাগল। শাইখ আযযাম কিন্তু একেবারেই নীরব। নির্বিকার। তিনি তাদের সম্পর্কে কিছুই বললেন না। বরং নিয়মিত তাদের নিকট উপহার সামগ্রী পাঠাতে লাগলেন। তারপর একসময় তাদের ভুল ভাঙ্গলো। তখন তারা বলতে লাগল, আল্লাহর কসম, আমরা কখনোই শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের মতো মানুষ দেখিনি। তিনি আমাদের নিয়মিত অর্থ ও উপহার সামগ্রী দিয়ে যেতেন। অথচ আমরা তার বিরুদ্ধে কটুবাক্য বলতাম। . শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের চেষ্টা ও মুজাহাদার ফলে আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি মুজাহিদ গ্রুপ একত্রিত হল।

তারা একই আমিরের নির্দেশে চলতে লাগলো, ফলে শত্রুদের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে পড়লো। মুজাহিদরা প্রত্যেক ফ্রন্টে বিজয়মালা ছিনিয়ে আনতে লাগলো। এ অবস্থায় শত্রুরা তাঁকে সহ্য করতে পারছিল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করল। তাঁকে হত্যার কৌশল খুঁজতে লাগল।  . পেশোয়ারে তিনি এক মসজিদে নিয়মিত জুমআর নামায পড়াতেন। নামাযের আগে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতেন। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ তাঁর বক্তৃতা শুনতে ছুটে আসতো। ১৯৮৯ সালে শত্রুরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে তার মিম্বারের নিচে একটি প্রচন্ড শক্তিশালী টিএনটি বিস্ফোরক রেখে দিল। এটা এতোই ভয়াবহ ছিল যে তা বিস্ফোরিত হলে পুরো মসজিদটি ধ্বসে পড়তো। মসজিদের হয়তো কেউই বাঁচতো না। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন। তাই তা বিস্ফোরিত হয়নি! . এইদিকে শত্রুরা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল।

১৯৮৯ সালের ২৪শে নভেম্বর। শুক্রবার। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম যে পথ দিয়ে জুমআর নামায আদায় করতে যেতেন সে পথে শত্রুরা তিনটি বোমা পুঁতে রাখল। রাস্তাটি ছিল সরু। একটির বেশি গাড়ি তা দিয়ে অতিক্রম করতে পারত না। দুপুর ১২.৩০ মিনিটে শাইখের গাড়িটি ঠিক বোমা যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল সেখানে এসে থামল। সে গাড়িতে ছিলেন শাইখ ও তাঁর দুই ছেলে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ। তাঁর আরেক পুত্র তামীম আদনানী আরেকটি গাড়িতে করে পিছনে পিছনে আসছিল। . শাইখ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেন। আর তখনই বিকট শব্দ করে শত্রুদের পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণের ভয়াবহ আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো শহর। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।

তারপরই মসজিদ ও আশপাশের মানুষেরা দৌঁড়ে এল। . কিন্তু ইতোমধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। ঘটনাস্থলে তাঁর গাড়ির বিক্ষিপ্ত টুকরো ছাড়া আর কিছুই পেল না। বিস্ফোরণের ফলে শাইখের দুই ছেলের দেহ ১০০ মিটার উপরে উঠে গিয়েছিল। তাদের দেহ বিভিন্ন গাছের ডালে, বৈদ্যুতিক তারের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের দেহকে রক্ষা করলেন। দেহটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় একটি দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় পাওয়া গেল।তখন তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।  .


তাঁর শাহাদাতের সংবাদে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে এলো। কান্নার রোল পড়ে গেল। মুজাহিদদের শিবিরে শিবিরে সেই কান্না ছড়িয়ে পড়লো। স্তব্ধ হয়ে গেল তাঁর বন্ধু-বান্ধব আর নিকটতম ব্যক্তিরা। . “ওরা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরের পূর্ণ বিকাশ ছাড়া আর কিছুই চান না, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।” .

 ১৯৯৯ সাল। আল-জাজিরা টিভি চ্যানেল শাইখ উসামা বিন লাদেনের এক সাক্ষাৎকার নিল। তিনি তাতে বললেন, “শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একক কোন ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মাহ। একটি জাতি। তাঁর শাহাদাতের পর মুসলিম মায়েরা তাঁর মতো দ্বিতীয়জন জন্ম দিতে পারে নাই।”

 . টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে, “বিংশ শতাব্দীতে জিহাদকে পুনর্জাগরণে তিনিই দায়ী।” . চেচনিয়া জিহাদের ফিল্ড কমান্ডার ইবনুল খাত্তাব রহ. বলতেন, “১৯৮০- এর দশকে শহীদ শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম ছিলেন এমন একটি মুদ্রিত নাম যাঁর কথা চেচনিয়ার জিহাদের ময়দানগুলোতে আজও বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলছে। . আর শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম বলতেন, “কেউ জিহাদের ময়দানে ইন্তেকাল করলে সে যেন ‘শহীদী কাফিলার সাথে’ গিয়ে শরীক হল।” . আল্লাহ শাইখকে কবুল করুন।

. লেখকঃ নাসীম আরাফাত মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

নবিপ্রেমে সহাস্যবদনে জীবনোৎসর্গকারী তরুণ গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ রহ. : সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য






রাহমান রাহীম আল্লাহ্‌ নামে,


১,
পুরো হিন্দুস্তান উত্তাল। স্বামী পণ্ডিত চিমোপতি লাল রচিত রাসুলুল্লাহর সা. এর পবিত্র বৈবাহিক জীবন নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যে ভরপুর কুখ্যাত বই ‘রঙ্গিলা রাসুল’ প্রকাশের অপরাধে প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে চলছে তুখোড় আন্দোলন। ইংরেজ সরকার নীরব। মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যোবোধকে বিনষ্ট করার মানসে হিন্দুদেরকে ধর্মীয় উস্কানিমূলক সকল কাজের বৈধতা দিয়ে রেখেছে ইংরেজ সরকার। মুসলমানরা দগ্ধ হৃদয় নিয়ে প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে বারবার সরকারের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হয়েছে। উল্টো ইংরেজ সরকার প্রকাশক রাজপালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়োগ করেছে। মুসলমানরা যেনো আন্দোলন করে রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারে এজন্য ফিরিঙ্গিরা পূর্বেই ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছে

। আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী আলিমদেরকে ধরে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে আন্দোলনকে নির্বাপিত করতে চেয়েছে। কিন্তু এতে মুসলমানদের ভেতরের জ্বলন আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভার মতো শুধু বেড়েছেই।  ভেতরের আগুন ধীরে ধীরে বাইরেও ছড়িয়েছে। ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে অগণিত মুসলমান সেদিন দিল্লি দরজার অভ্যন্তরে শাহ মুহাম্মাদ গওস রহ. চত্ত্বরে সমবেত হয়। সমাবেশে নেতৃত্ব দান করেন আশিকে রাসুল আমিরে শরিয়ত সাইয়িদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ.। শাহজি রহ. সেদিন নবিপ্রেমে ব্যাকুল হয়ে এমন ইমানদীপ্ত অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেন, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে দাউ দাউ করে ইমানের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। সেই সমাবেশে মুফতি কিফায়াতুল্লাহ রহ. এবং মাওলানা আহমদ সাইদ দেহলবি রহ.ও উপস্থিত ছিলেন। শাহজি রহ. সেদিন তার ভাষণে বলেন—“আজ আপনারা জনাবে ফখরে রাসুল মুহাম্মাদে আরাবি সা. এর ইজ্জত এবং মর্যাদা সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে এখানে সমবেত হয়েছেন। আজ সমগ্র মানবজাতিকে ইজ্জত দানকারী মানুষটির ইজ্জত ঝুঁকির মধ্যে। আজ সেই মহান মানবের ইজ্জত ঝুঁকির মুখে পড়ে আছে, যার দেয়া ইজ্জত নিয়ে সমগ্র সৃষ্টিকুল গর্ব করে।

আজ মুফতি কিফায়াতুল্লাহ এবং মাওলানা আহমদ সাইদের দরজায় উম্মুল মুমিনিন আয়িশা সিদ্দিকা, উম্মুল মুমিনিন খাদিজাতুল কুবরা রা. দাঁড়িয়ে সকরুণ কণ্ঠে আওয়াজ দিচ্ছেন, “আমরা তোমাদের মা। তোমরা কি জানো না যে, কুফফার গোষ্ঠী আমাদেরকে গালি দিচ্ছে।” আরে দেখো, কোথাও উম্মুল মুমিনিন আয়িশা সিদ্দিকা রা. দরজায় দণ্ডায়মান নয়তো?!” শাহজি রহ. কথাটি হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে এমনভাবে উচ্চারণ করেন যে, সাথে সাথে সমবেত জনতা সকলে প্রায় দরজার দিকে ঘুরে তাকায়। পুরো মজলিসজুড়ে কান্না ও আর্তনাদের আওয়াজ ভেসে ওঠে। এরপর শাহজি রহ. বলেন—“তোমাদের মহব্বতের তো এই দশা যে, তোমরা সাধারণ সাধারণ অবস্থায় জীবন উৎসর্গ করে বসো অথচ তোমাদের কি জানা নেই যে, আজ রাসুলুল্লাহ সা. সবুজ গম্বুজের নিচে তড়পাচ্ছেন। আজ খাদিজা এবং আয়িশা রা. পেরেশান। বলো, তোমাদের হৃদয়ে উম্মুল মুমিনিনদের জন্য কোনো জায়গা আছে কি? আজ উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. তোমাদের কাছে হক তলব করে ফিরছেন; সেই আয়িশা, রাসুলুল্লাহ সা. যাকে ভালোবেসে ‘হুমায়রা’ বলে ডাকতেন, সেই আয়িশা, যিনি সাইয়িদে আলম সা. এর তিরোধানের সময় তাকে মিসওয়াক চিবিয়ে দিয়েছেন। স্মরণ রেখো, যদি তোমরা খাদিজা এবং আয়িশা রা. এর জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে পারো, তাহলে তা কম গর্বের কথা নয়। যতোক্ষণ পর্যন্ত একজন মুসলমান জীবিত আছে, রাসুলের ইজ্জতের ওপর হামলাকারীরা কিছুতেই প্রশান্তির সাথে বাঁচতে পারে না। পুলিশ মিথ্যা, সরকার আলসে আর ডিপুটি কমিশনার অযোগ্য। ওরা হিন্দু সংবাদধারার বাচালতা ও বকবক তো বন্ধ করতে পারে না, কিন্তু উলামায়ে কেরামের ভাষণ-বক্তৃতা বন্ধ করে দিতে চায়। সময় এসেছে, আজ এখানে ১৪৪ ধারা টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেয়া হবে। আমি ১৪৪ ধারাকে আমার জোতার নিচে পিষ্ট করে বলবো—

پڑا فلک کو دل جلوں سے کام نہیںجلا کے راکھ نہ کر دوں تو داغ نام نہیں

এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমার নানার এই মালউন গোস্তাখকে কোনো মুসলমান নওজোয়ান হালাক করতে না পারে, তাহলে রাসুলুল্লাহর হুরমতের কসম, এই সাইয়িদজাদা বুড়ো নিজ হাতে এই মহান ফরজ কর্ম সম্পন্ন করবে।”সেদিনই আঞ্জুমানে খুদ্দামুদদীন শহরের ফটকে ফটকে রাজপালকে হত্যা করা ওয়াজিব মর্মে ফতোয়া টানিয়ে দেয়। আলিমউলামা জনসাধারণ সকলের যবানেই ‘শাতিমে রাসুল’কে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর অপরিহার্যতার কথা চর্চা হতে থাকে। 

২,
১০ এপ্রিল ১৮৭৫ তারিখে সনাতন হিন্দুধর্ম থেকে নতুন শাখা উৎসারিত হয়, যার নাম আরিয়া সমাজ। এর প্রবর্তক স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটে জন্মগ্রহণ করে। স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী হিন্দুধর্মকে নতুন করে সংস্কার-সংশোধন করে, তার জন্য নয়া সীমারখা নির্ধারণ করে। সে মূর্তিপূজাকে অস্বীকার করে। দেবদেবীকে উপাস্য হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। জাতপাতকে ধর্মীয় বা প্রকৃতিগত বিভাজন স্বীকার না করে রাজনৈতিক বিভাজন বলে আখ্যায়িত করে।

স্বল্প সময়েই তার এই সংস্কার ধারা শিক্ষিত প্রজন্মকে আকর্ষণ করে। দলে দলে তারা আরিয়া সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। আরিয়া সমাজের জন্য আলাদাভাবে আইন প্রণয়ন করা হয়। এই মতবাদকে সমগ্র হিন্দুস্তানে প্রসার করার জন্য শৃঙ্খলিত পদক্ষেপ নেয়া হয়। আরিয়া সমাজের জন্য নির্ধারিত কোঠা ঘোষণা করা হয়।  ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী দুনিয়া ত্যাগ করে।স্বামী দিয়ানন্দ সরস্বতী শুধু হিন্দুধর্ম সংস্কারের কাজই করেনি, বরং ইসলামের ওপর জ্ঞানগতভাবে আক্রমণ করে। নিজের অপরিপক্ক মাথাকে ব্যবহার করে ইসলাম কোরআন নবি— সবকিছুকেই তার তীর্যক আপত্তির লক্ষ্যস্থল বানায়।

 ইসলামের ওপর তার প্রসিদ্ধ এগারোটি আপত্তি ছিলো। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবি রহ. তার আপত্তিগুলোকে ‘ইনতিসারে ইসলাম’, ‘কিবলাহ নুমা’ এবং ‘তুরকি ব তুরকি’ গ্রন্থত্রয়ে খণ্ডন করেন। নরাধম দিয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুর সুদীর্ঘকাল পর তার রচিত কোরআনের বিরুদ্ধে শত আপত্তিবিদ্রূপে ভরপুর বই ‘সত্তিয়ারথ পোরকাশ’ উর্দুতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। বইটিকে উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে ‘রঙ্গিলা রাসুলে’র লেখক স্বামী পণ্ডিত চিমোপতি এম এ। রাজপাল নামক এক কট্টর হিন্দু প্রকাশক লাহোরে অবস্থিত তার লাইব্রেরি থেকে এ বই প্রকাশ করে মুসলমানদের হৃদয়কে চরমভাবে আহত করে। মুসলমানরা বইটির প্রকাশনার ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-পরিশ্রম করে। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন না করে, তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরমভাবে আঘাত করে ফিরিঙ্গিরা সাদা চামড়ার ভেতরে সুপ্ত নিজেদের চরম কুশ্রী মুখোচ্ছবি প্রকাশ করে। রাজপালের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তার প্রকাশনীর কর্মচারী মুনশি রাম সরকারি সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে। এই মুনশি রাম কিছুদিনের মধ্যেই রাতারাতি ‘শ্রীমান মহাত্মা সোরাগ বাশী সোয়ামী শ্রীদ্ধানন্দজি’ বনে যায়। এরপর সে অবিরল কোরআন ইসলাম এবং নবিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে লিটারেচার প্রকাশ করতে থাকে। তবে তার এই কুকর্মের ধারা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হতে পারে না। এক জানবাজ মুজাহিদ কাজি আব্দুর রশিদ শহিদ রহ. এর হাতে তার জীবননাটিকার যবনিকাপাত হয়। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নরাধম রাজপাল ‘রঙ্গিলা রাসুল’ প্রকাশ করে।

৩,
আমিরে শরিয়ত আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ. এর ইমানদীপ্ত অগ্নিঝরা ভাষণে প্রভাবিত হয়ে লাহোরে অবস্থানকারী অত্যন্ত সুশ্রী ও নুরানি চেহারার অধিকারী এক কাশ্মীরি যুবক গাজি খোদাবখশ ইবনে মুহাম্মাদ আকরাম ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ তারিখে জানবাজি রেখে নরাধম রাজপালের ওপর আক্রমণ চালান।  কুখ্যাত রাজপাল নিজ লাইব্রেরিতে কাজে ব্যস্ত ছিলো। এমন সময় গাজি খোদাবখশ রহ. এসে ধারালো ছুরি নিয়ে রাজপালের ওপর অতর্কিত হামলা চালান।  আকস্মিক এ আঘাতে রাজপাল আহত হয়। তার শরীর থেকে রক্তের ধারা বইতে থাকে। কিন্তু দ্রতবেগে নিজেকে সামলে নিয়ে রাজপাল সেখান থেকে পলায়ন করে। পুলিশ গাজি খোদাবখশ রহ. কে ৩০৭ ধারার অধীনে গ্রেফতার করে।

লাহোর ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট কোর্টে মামলার রায়ের শুনানি হয়। গাজি খোদাবখশ রহ. নিজের পক্ষে কোনো ওকিল গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। রাজপাল আদালতে সকরুণ কণ্ঠে আরজ করে, “আমার ওপর এ হামলা মুক্তচিন্তার বই প্রকাশ এবং মুসলমানদের এজিটেশনের কারণে করা হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অপরাধী খোদাবখশ আমাকে জানে মেরে ফেলবে।” জজ জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি আরো কিছু বলবেন?” রাজপল বললো, “হামলার সময় অপরাধী চিৎকার করে বলছিলো, কাফিরের বাচ্চা, আজ তুই আমার হাতে এসেছিস। আজ আর তোকে জীবিত ছাড়বো না।” জজ গাজি খোদাবখশ রহ. এর কাছে এর ব্যাখ্যা তলব করলে তিনি গর্জে উঠে বলেন, “আমি মুসলমান। রাসুলের ইজ্জত রক্ষা করা আমার ওপর ফরজ। আমি কিছুতেই আমার ‘আকা’ এবং ‘মাওলা’ মুহাম্মাদ সা. এর অপমান বরদাশত করতে পারি না।” এরপর মালউন রাজপালের দিকে ইশারা করে বলেন, “সে আমার প্রিয় রাসুলের শানে গোস্তাখি করেছে। এজন্য আমি তার ওপর জীবনবাজি রেখে আক্রমণ করেছি। কিন্তু এই নরাধম সেসময়ে আমার হাত থেকে একটুর জন্য বেঁচে গেছে।”অপরাধের স্বীকারোক্তি প্রদানের পর আদালত গাজি খোদাবখশ রহ. এর ব্যাপারে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করে, যার মধ্যে তিনমাস একাকী বাসের শাস্তিও রয়েছে। এবং নির্ধারিত মেয়াদ খতম হওয়ার পরে নিরাপত্তা লাভের জন্য পাঁচ পাঁচ হাজার রুপি মূল্যের তিনটি জামানত দাখিল করার ফায়সালা ঘোষণা করা হয়

।এর কিছুদিন পর ১৯ অক্টোবর ১৯২৭ তারিখে মালউন রাজপালকে জাহান্নামে পৌঁছানোর মানসে আফগানিস্তানের কোহাট থেকে গাজি আব্দুল আজিজ নামের এক ইমানদীপ্ত ব্যবসায়ী যুবক লাহোরে আগমন করে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে মালউন প্রকাশকের লাইব্রেরিতে পৌঁছে। ঘটনাক্রমে সেসময়ে রাজপাল দোকানে ছিলো না। তার পরিবর্তে দোকানে বসা ছিলো তার দুই বন্ধু জিতান্দর দাস এবং স্বামী সত্যানন্দ। দোকানে বসে তারা মুক্তমনে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছিলো। আলোচনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছিলো স্বামী সত্যানন্দ। গাজি আব্দুল আজিজ কিছু সময় আড়াল থেকে আলোচনা শুনেন। তিনি স্বামী সত্যানন্দকেই রাজপাল ভেবে বসেন। অনন্তর কোষ থেকে তরবারি বের করে এক আঘাতেই স্বামী সত্যানন্দকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। এরপর তিনি নিজেই সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমি রাসুলের ইজ্জত হরণকারী নরাধমের ভবলীলা সাঙ্গ করেছি। আমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক।  আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গাজি আব্দুল আজিজ রহ. এ কথাগুলো বলেন—“আমার নাম আব্দুল আজিজ। আমি (সুলতান মাহমুদ গজনবির স্মৃতি বিজড়িত) গজনিতে থাকি। আমার মাতৃভূমির গর্ব, সে সুলতান মাহমুদ গজনবির মতো মহান মুজাহিদ মুবাল্লিগ ও মূর্তিবিনাশকারী মনীষীকে গর্ভে ধারণ করেছে, যেই মাহমুদ গজনবি এই ভারতবর্ষের ওপর কমবেশি সতেরোবার হামলা চালিয়ে কুফুর এবং ইলহাদকে বিনাশ করেছেন এবং মূর্তির নগরকে ইসলামের দৌলত দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন। এই সেই মহান মূর্তিবিনাশকারী, যার সামনে সোমনাতের পূজারীরা সম্পদের পাহাড় ঢেলে দিয়ে এই ফরিয়াদ জানিয়েছে যে, মহারাজ, আপনি এই সমস্ত সম্পদ নিয়ে নিন, তবুও আমাদের মূর্তিদের ওপর যেনো কোনো আঘাত না আসে। কিন্তু ইসলামের এই মহান মুজাহিদ নিঃসঙ্কোচে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, মুসলমান মূর্তিবিনাশকারী, মূর্তিবিক্রেতা নয়। এই কথা বলে তিনি সোমনাতের মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছেন। আল্লামা ইকবাল যার নির্মুখাপেক্ষিতা এবং পূর্ণ ইমানের ওপর গর্ব করে বলেন—

قوم اپنی جو زر و مال جہاں پر مرتیبت فروشی کے عوض بت شکنی کیوں کرتی

 তিনি ছিলেন সেই গাজি, যিনি শুনলেন, মুলতানে কারামিতা নামক এক গোষ্ঠী আছে, যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু আদতে তারা কাফির এবং মূর্তিপূজারী। তাদের লৌকিকতার চূড়ান্ত হাল এই ছিলো যে, তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জামাতের সাথে নামাজ পড়তো, কিন্তু সামনে নাউযুবিল্লাহ হযরত রাসুলে কারিম সা. এর কাল্পনিক অবয়ব বানিয়ে রাখতো। মাহমুদ গজনবির কাছে এই ভয়াল রিপোর্ট পৌঁছামাত্রই তিনি ঘূর্ণিবায়ুর মতো দ্রুতবেগে সেখানে হাজির হন এবং মুলতানের হাকিম দাউদ কারামেতির ভবলীলা সাঙ্গ করে সেখানে ইসলামের পতাকা উড্ডিন করেন। আমাকে স্বপ্নে সুলতান মাহমুদ গজনবি আদেশ করেছেন, যাও, সেই মালউনকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে উভয় জাহানের কামিয়াবি অর্জন করো।

 আমার আফসোস হচ্ছে যে, মূল শয়তানকে জাহান্নামে পৌঁছাতে পারলাম না।”গাজি আব্দুল আজিজের এই সারগর্ভ এবং আলিমসুলভ কথামালা শুনে মুসলিম জনতা সমস্বরে তাকবির দিয়ে আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলে। ফিরিঙ্গি হুকুমতের ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট এম বি উগলবি আইনি তাকাজা এবং আরো কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ করে গাজি আব্দুল আজিজ খানকে শাহাদাতের মর্যাদা দেয়ার পরিবর্তে তার ব্যাপারে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে। পরাপর দুইবার অতর্কিত আক্রমণে ভীত হয়ে রাজপাল নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে করে।  তাই সে আদালতের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট রাজপালের নিরাপত্তার জন্য দুই হিন্দু সিপাহী এবং এক শিখ হাবিলদার নিয়োগ করে। রাজপাল পাহারাবেষ্টিত জীবনকে নিরাপদ জীবন ভেবে বসে। সেসময়ে সে লাহোর ছেড়ে কয়েক মাস অন্যান্য শহরনগর ঘুরে আমোদফূর্তি করে আসে। তার ধারণা ছিলো, এই নাতিদীর্ঘ সময়ে ঝামেলা ও বিপদ কেটে যাবে, মুসলমানদের জযবাও নিস্তেজ হয়ে যাবে। লাহোরে ফিরে সে পুনরায় তার কারবার শুরু করে।

৪,
গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ লাহোরের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ৪ ডিসেম্বর ১৯০৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবার নাম তালেমন্দ। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। লাহোরে এবং তার আশপাশে সততা এবং দক্ষতার কারনে তাদের ভালো সুনাম ছিলো। সম্মানের সাথেই দিনাতিপাত করছিলেন। খুব বড় হওয়ার এবং অনেক সম্পদধারী হওয়ার স্বপ্ন ছিলো না। আর দশটি পরিবারের মতো স্বাভাবিকভাবেই জীবনের ধাপগুলো অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষা ছিলো। সেসময়ে শিশুরা মসজিদ থেকেই প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করতো।

 তালেমন্দ তার ছেলেকেও কোরআন শেখার জন্য মসজিদে পাঠিয়েছিলেন।  গাজি ইলমুদ্দিন কিছুদিন সেখানে যাতায়াত করে। কিন্তু অধিক বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করা আর তার নসিবে জোটে না। কুদরত তাকে হয়তো গতানুগতিকতার বাইরে অন্য কোনো মিশনের জন্য প্রস্তুত করছিলো। ইলমুদ্দিনের ভাই মুহাম্মাদুদ্দিন লেখাপড়া করে সরকারি চাকরি লাভ করে। অপরদিকে ইলমুদ্দিন বাবার হাত ধরে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশায় আত্মনিয়োগ করে। বাবার মতো সেও একজন ভালো কাঠমিস্ত্রি হয়। ইলমুদ্দিন বাবার সাথে কাজের প্রয়োজনে লাহোরের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে গমন করতো।ইলমুদ্দিন এবং মুহাম্মাদুদ্দিনের মধ্যে বেশ সখ্যতা ছিলো। ভাই-ভাইয়ের মধ্যে এমন প্রগাঢ় ভালোবাসা খুব কমই নজড়ে পড়ে।  একবারের ঘটনা, ইলমুদ্দিন তখন বাবার সাথে শিয়ালকোটে গিয়েছে। এদিকে মুহাম্মাদুদ্দিন ভাইয়ের ব্যাপারে দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্ন দেখে অস্থির হয়ে মুহাম্মাদুদ্দিনও শিয়ালকোটে গিয়ে পৌঁছে। মুহাম্মাদুদ্দিন যখন বাবার ঠিকানায় পৌঁছে, তখন ইলমুদ্দিন খাটে বসা ছিলো। ভাইকে দেখে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। তালেমন্দ মুহাম্মাদুদ্দিনকে বসতে বলেন। মুহাম্মাদুদ্দিন স্বপ্নে ভাইকে যখম হতে দেখেছিলো। এবার সে লক্ষ করে দেখে, বাস্তবেই ইলমুদ্দিন যখম। হাতে পট্টি বাঁধা। কাজে তখন তো মাত্র হাতেখড়ি হচ্ছে। তাই অসতর্কতায় আঘাত পেয়ে হাত যখম হয়েছে।

সেখানে একদিন অবস্থান করে বাবার নির্দেশে পরবর্তী দিন মুহাম্মাদুদ্দিন লাহোরে ফিরে আসে।ইলমুদ্দিন লেখাপড়া শিখেনি ঠিক, তবে পারিবারিকভাবেই মনুষ্যত্বের দীক্ষা নিয়েছে। সততা সত্যবাদিতা অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার মানসিকতা অনুগ্রহকারীর জন্য জীবনোৎসর্গ করার চেতনা ইত্যাদি বিষয় বাবা-মা’র দৈনন্দিন আচার-রীতি থেকেই তার ভেতরে শেকড় গেঁড়ে নেয়। ইলমুদ্দিন কখনও চিল্লায় যায়নি ঠিক, কখনও হজ-উমরাও করেনি, কখনও খানকাহয়ও যাতায়াত করেনি, আর না কখনও রাযি-কাশশাফ অধ্যয়ন করেছে, মানতিক-ফালসাফা-আসরারে শরিয়ত শিখেছে, না কখনও শায়খের সাথে সম্পর্ক গড়ে দীর্ঘ আমল করেছে, না কখনও মসজিদে গাশত করেছে। কিছুই সে করেনি। দীনি বিষয়ে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যই সে অর্জন করেনি। তার তো সম্বল ছিলো শুধু এক কালিমা। যে কালিমা সে পড়তো। যে কালিমাকে সে ভালোবাসতো। যে কালিমা থেকে সে দুই মহান সত্তাকে অনুভব করতো। আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালোবাসতো। সে হেকমত-মাসলাহাত বুঝতো না। তার ভেতরে জযবা ছিলো। দীনি জযবা। আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালোবাসার জযবা। এজন্যই তো তার স্মরণে আল্লামা ইকবাল বলেন—


اسی گلاں ای کر دے رہ گئے تے تر خاناں دامنڈابازی لے گیا

অপর এক কবিতায় আল্লামা বলেন—
عشق کی اک ہست نے طے کر دیا قصہ تماماس زمین و آسماں کو بے کرا سمجھا تھا میں نے

 ইলমুদ্দিন এক সাদাসিধে মুসলমান। সে দিনরাত তার পেশায়ই ডুবে থাকতো। জগতের কোনো খোঁজখবরই তার ছিলো না। রাজপালের ঘৃণ্য উদ্যোগে সারা হিন্দুস্তান যে উত্তাল— এর বিন্দুমাত্র খোঁজও ইলমুদ্দিনের ছিলো না। একদিন সন্ধ্যেবেলায় কাজ শেষ করে ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরছিলো। দিল্লি দরজার কাছে আসলে সেখানে এক বিশাল সমাবেশ দেখতে পায়। ডায়াস থেকে এক নওজোয়ানের অগ্নিঝরা বক্তৃতার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসে। সে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়ায়। কিন্তু তার মাতৃভাষা পাঞ্জাবি হওয়ায় উর্দু ভাষণ সে খুব বেশি বুঝতে পারে না।

 উর্দু ছিলো প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা। তার তো আর প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করার সুযোগ হয়নি। পাশের এক ব্যক্তিকে অবস্থা জিজ্ঞেস করলে সে তাকে জানায়, রাজপাল নামের এক হিন্দু প্রকাশক রাসুলুল্লাহ সা. এর শানে গোস্তাখিমূলক বই প্রকাশ করেছে। তার প্রতিবাদে আজকের এ সমাবেশ। কথাটা ইলমুদ্দিনের ভেতরে স্পন্দন জাগায়। রাজপালের দুঃসাহসিকতা তার হৃদয়কে চরমভাবে আহত করে। ইলমুদ্দিন দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আলোচনা শুনতে থাকে।  কিছুক্ষণ পর স্টেজে আসেন একজন পাঞ্জাবি বক্তা। ইলমুদ্দিন খুব মনোযোগের সাথে তার আলোচনা শোনে। সেখান থেকেই সে জানতে পারে, রাজপাল তার এই দুঃসাহসিক কাজের কারণে ‘ওয়াজিবুল কতল’ তথা তাকে হত্যা করা অপরিহার্য। ইলমুদ্দিনের মানসজগতে বৈপ্লবিক ঝড় ওঠে। তার চিন্তাভাবনা মনমানসিকতা মুহূর্তেই সব বদলে যায়। কালিমায় এতোদিন একশ্বাসে যে দুই মহান সত্তার নাম নিতো, অশিক্ষিত মানুষটি যে দুই সত্তাকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, সেই রাসুলের শানে এই চরম গোস্তাখিকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সমাবেশ শেষ করে মধ্যরাতে ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরে।

বাবা জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার? আজ হঠাৎ দেরি কেনো? ইলমুদ্দিন সব খুলে বলে। রাজপাল ওয়াজিবুল কতল হওয়ার যে কথা সে শুনে এসেছে তাও বলে। তালেমন্দও একেবারে সাদাসিধে কালিমাপাঠকারী মুসলমান ছিলেন।  সব শুনে তিনিও আলোচনার সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। তিনিও বলেন, এমন বদমাশকে জাহান্নামেই পৌঁছানো উচিত। কথাটা ইলমুদ্দিনের হৃদয়জগতকে ছুঁয়ে যায়। সে যেনো মৌনভাবে ঘর থেকেও অনুমতি পেয়ে যায়।সে রাতে ইলমুদ্দিনের আর ঘুম হয় না। পরবর্তী দিন সে তার বন্ধু শেদার সাথে সাক্ষাত করে। শেদাকে সব খুলে বলে। সেই দিনগুলোতে পুরো হিন্দুস্তানজুড়ে মুসলমানদের মূল আলোচনার বিষয় এই একটাই ছিলো।

 চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাট-বাজার— সর্বত্রই চলছিলো রাজপালের দুঃসাহসিকতা ও আস্পর্ধা নিয়ে আলোচনা। ইলমুদ্দিন নিয়মিত শেদার সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও পরামর্শ করতে থাকলো। কাজকর্ম নাওয়াখাওয়া কোনো কিছুতেই তার আর মন ছিলো না। সারাদিন একই চিন্তা, একই ভাবনা। প্রথমে পরিবারের চোখে বিষয়টা ধরা না পড়লেও আখের তাদের মনেও সন্দেহ জাগে। তারা তো তখনও জানেন না, কী মহান স্বপ্ন-ভাবনা খেলে যাচ্ছে ইলমুদ্দিনের বুকে। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, তাদের ছেলে তাদের জন্য জান্নাতের সওদা করছে, তাদেরকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দানের উদ্যোগ নিচ্ছে। তালেমন্দের এক বন্ধু শেদার সঙ্গে ইলমুদ্দিনের মেলামেশার বিষয়টা তাকে অবগত করে। শেদা অনেক ভালো ছেলে ছিলো। কিন্তু তালেমন্দের সেই বন্ধু তাকে জানায়, শেদা একটা আওয়ারা-লম্পট ছেলে।  তার সাথে মেলামেশা করাটা ইলমুদ্দিনের ঠিক হচ্ছে না। তাকে এখনই ফেরানো উচিত। নইলে দিনদিন সে খারাপ হয়ে যাবে। তালেমন্দ ছেলেকে অনেক করে বোঝায়। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয় না।ইলমুদ্দিন আর শেদা অনেক খুঁজেফিরেও জানতে পারে না যে, কে এই নরাধম রাজপাল আর কোথায়ই বা তার দোকান। সে দেখতেই বা কেমন। পরিশেষে শেদার এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে, নরাধম রাজপালের লাইব্রেরি হাসপাতাল রোডে।

এদিকে ইলমুদ্দিনের অনিয়মানুবর্তিতার বিষয়টি তালেমন্দকে অনেক ভাবায়। ছেলে ঠিকমতো কাজে যায় না, নাওয়াখাওয়ারও কোনো খবর নেই। তার কাছে এর একমাত্র কারণ মনে হয় শেদার সঙ্গে মেলামেশা। এদিকে শেদার ব্যাপারে তিনি আরো জানতে পারেন যে, শেদার বাবা একজন জুয়ারি; জুয়ার পয়সা চুখাতে আখের নিজের দোকানটাও যিনি হারিয়েছেন। তালেমন্দ রাগি স্বভাবের মানুষ ছিলেন।

 একদিন রাতে দেরি করে ঘরে ফিরে ইলমুদ্দিন।  তার অপেক্ষায় ঘরের ভেতর পায়চারি করছিলেন তালেমন্দ। ইলমুদ্দিন ঘরে ফিরলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কোথায় ছিলে আজ সারাদিন? ইলমুদ্দিন জবাব দেয়, শেদার সাথে। উত্তর শুনে তালেমন্দ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছেলেকে গালমন্দ করতে থাকেন। ইলমুদ্দিন মাথা নিচু করে সব শুনে যেতে থাকে। তালেমন্দ রাগের প্রচণ্ডতায় শেষ অবধি বলে বসেন, এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা। যা, ঐ বদমাশের কাছে চলে যা। তোর মুখ আর আমাকে দেখাবি না।বড় ভাই মুহাম্মাদুদ্দিন ঘরেই ছিলো। সে এসে বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে।  ছোট ভাইকে হাত ধরে তার কামরায় নিয়ে যায়।  এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে খুব করে তাকে বোঝায়। খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে বলে। শেদার ব্যাপারে সকলের নেগেটিভ ধারণা দেখে ইলমুদ্দিনও খুব ব্যথিত হয়। কিন্তু সে মনের কথা কাউকেই খুলে বলতে পারে না। কীভাবেই বা বলবে! যেখানে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। সে তো মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে নিয়েছে, যদিও বাহ্যদৃষ্টিতে তা কারোরই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। ছেলের অবস্থার পরিবর্তন না দেখে তালেমন্দ সিদ্ধান্ত নেন, বিশ বছর বয়সী ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেবেন। সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে, অপ্রত্যাশিত অবস্থাও শুধরে যাবে। তারা পাত্রী দেখে ইলমুদ্দিনের বিয়ের কথাবার্তা পাকাপোক্ত করে ফেলেন।

 একরাতের কথা, ইলমুদ্দিন স্বপ্নে দেখে, এক বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, “ইলমুদ্দিন, এখনও ঘুমিয়ে আছো?! দুশমন তোমার নবির শানের খেলাফ প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত। উঠো। জলদি করো।”ইলমুদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। উত্তেজনায় তার সারা শরীর ঘেমে ভিজে যায়। সে অস্থির হয়ে পড়ে। এরপর ঘুমানোর চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারে না। অনন্তর উঠে সরাসরি শেদার ঘরে পৌঁছে। শেদাকে নিয়ে ভাটি দরজার কাছে যায়। এরপর তাকে সব খুলে বলে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইলমুদ্দিন রাতে যে স্বপ্ন দেখেছে, হুবহু একই স্বপ্ন শেদাও দেখেছে। স্বপ্নে দেখা বুযুর্গ উভয়কে একই আদেশ দিয়েছেন। তারা উভয়েই পেরেশান। এবার কে তাহলে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। উভয়ই এই গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে সম্পন্ন করতে চাচ্ছিলো। আখের আলোচনার মাধ্যমে কোনো ফায়সালা করতে না পেরে তারা লটারি করে। লটারিতে ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। শেদার অনুরোধে পুনরায় লটারি করা হয়। এবারও ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। শেদার পীড়াপীড়িতে তৃতীয়বার লটারি করলে এবারও ইলমুদ্দিনের নাম ওঠে। ইলমুদ্দিন নিশ্চিন্ত হয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বাড়িতে ফেরে।

আবারও ইলমুদ্দিন স্বপ্ন দেখে, সেই বুযুর্গ এসে তাকে বলছেন, “উঠো! জলদি করো! দেরি করবে তো অন্য কেউ এসে বাজি নিয়ে যাবে!”ইলমুদ্দিন শেষবারের মতো শেদার সাথে দেখা করে। স্মৃতির নিদর্শনস্বরূপ তাকে একটি ছাতা এবং একটি ঘড়ি উপহার দেয়। এরপর তার কাছ থেকে শেষ বিদায় নেয়। রাতে তার দু’চোখে ঘুম আসে না। ভাবনায় ভাবনায় কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে দেয়।

 পরবর্তী দিন ৬ এপ্রিল ১৯২৯ তারিখে ইলমুদ্দিন সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়। গুমটি বাজারের দিকে যায়। আত্মারাম কামারের দোকানে গিয়ে সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো একটি ছুরি কিনে। কাঠমিস্ত্রি হওয়ার সুবাদে ছুড়ি-চাকু সে ভালোমতোই চিনতো। ছুরি কেনার পর সে অনেকটা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তৎক্ষণাতই হাসপাতাল রোডে পৌঁছে। আনারকলি হাসপাতাল রোডে ইশরত পাবলিশিং হাউজের সামনেই রাজপালের অফিস ছিলো। সেখানে পৌঁছে ইলমুদ্দিন জানতে পারে, রাজপাল এখনও আসেনি। আর যখন সে আসে, তখন তার হেফাজতে পুলিশও এসে হাজির হয়। ইতোমধ্যে রাজপালের অফিসের সামনে এসে একটি কার থামে। ইলমুদ্দিন জানতে পারে, কার থেকে যে লোকটা নামছে, সে-ই রাজপাল।

 এই নরাধমই রাসুলের শানে গোস্তাখিমূলক বই প্রকাশ করেছে এবং তা নামমাত্র মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। রাজপাল গাড়ি থেকে নেমে সাহেবের মতো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে পুলিশকে তার আগমনের কথা জানানোর জন্য টেলিফোন উঠানোর কথা ভাবছে— এমন সময় ইলমুদ্দিন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। সেসময়ে অফিসে দু’জন কর্মচারী ছিলো। কুদারনাথ পেছনের কামরায় বইপত্র রাখছিলো আর ভগতরাম রাজপালের পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। রাজপাল এক তরুণকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে, কিন্তু সে ভাবতেই পারে না যে, মৃত্যু তার এতোই কাছে। ইলমুদ্দিন ভেতরে প্রবেশ করে চোখের পল পড়ার আগেই জামার ভেতর থেকে ছুরি বের করে। তার হাতটা উঁচুতে উঠে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো ছুরির আঘাত রাজপালের বুকে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ছুরির ফলা রাজপালের কলজে ভেদ করে। এক আঘাতেই আহ শব্দ উচ্চারণ করে রাজপালের দেহ মুখ থুবড়ে যমিনে পড়ে। ইলমুদ্দিন দ্রুত পেছনে ফিরে দোকান থেকে পলায়ন করে। দোকানের দুই কর্মচারী বাইরে এসে চিৎকার করতে থাকে, “ধরো! ধরো! ... মেরে ফেলেছে! মেরে ফেলেছে!” কাশ্মীর থেকে রাসকুমারি পর্যন্ত চারিদিকে দাবানলের মতো গাজি ইলমুদ্দিনের বাহাদুরির কথা ছড়িয়ে যায়। সর্বত্র এই ইমানদীপ্ত তরুণের কালজয়ী কারনামার কথা আলোচনা হতে থাকে। গাজি ইলমুদ্দিন নবিপ্রেমের নযরানা পেশ করার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।

৫,
স্বভাবত আদালতের কার্যক্রম কচ্ছপের থেকে ধীরগতিসম্পন্ন হলেও এক্ষেত্রে আদালত ছিলো বড়ই সোচ্চার। গাজি খোদাবখশ এবং গাজি আব্দুল আজিজের ক্ষেত্রে গ্রেফতারের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাদের ফায়সালা শুনিয়ে দেয়া হয়। ফিরিঙ্গিদের আদালতের রঙ্গমঞ্চে তাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই তাদের পক্ষে কোনো ওকিলকে দেখা যায় না। গাজি ইলমুদ্দিনের ক্ষেত্রেও প্রথমে এমনই হয়।

 ১০ এপ্রিল ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনকে সর্বপ্রথম আদালতে ওঠানো হয়। ইমানের চেতনার দাবিতে অবশেষে গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে একঝাঁক মুসলিম ওকিল সাড়া দেন। ব্যারিস্টার খাজা ফিরোজ উদ্দিন, ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন এবং তাদের সহযোগিতায় ডা. এ আর খালেদ, মাস্টার সেলিম এবং আরো কয়েকজন আল্লাহর বান্দা এই মামলার পক্ষে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওকিলরা গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। অসংখ্য দলিল ও আইনের ধারা পেশ করেন। কিন্তু ফায়সালা তো পূর্বনির্ধারিত। ৯ মে ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনের ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। ব্যারিস্টার ফারাখ হুসাইন মোম্বাই গিয়ে ওকিল (পরবর্তীতে কায়িদে আজম) মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাত করেন। গাজি ইলমুদ্দিনের পক্ষে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ তার প্রস্তাবে সম্মত হন। লাহোর হাইকোর্টে আপিল করেন। যথাসময়ে শুনানি হয়। মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ আদালতে বলেন, “ইওর অনার! ইসলামের নবি রাসুলুল্লাহ সা. এর শানে গোস্তাখি করা এবং জনসাধারণের মধ্যে দ্রোহের আগুন উসকে দেয়া ১৩৫ ধারার আলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এতোদসত্ত্বেও প্রকাশক রাজপালের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আইনের নিস্তব্ধতাই গাজি ইলমুদ্দিনকে আইন নিজ হাতে তুলে নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।

এজন্য গাজি ইলমুদ্দিনের অপরাধকে ৩০২ ধারায় মার্ডার গণ্য না করে ৩০৮ ধারায় এজিটেশন কিলিং গণ্য করা উচিত, যার শাস্তি বেশি থেকে বেশি সাত বছর কারাদণ্ড হতে পারে। তাছাড়া গাজি ইলমুদ্দিনের যে বয়স, তাতে সে মৃত্যুদণ্ডের আইনের আওতাভুক্তও নয়।”  লাহোর হাইকোর্টের কট্টর হিন্দু জাস্টিস শাদিলাল কোনো কথায় কর্ণপাত না করে আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ফাঁসির জন্য গাজি ইলমুদ্দিনকে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩১ অক্টোবর ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাত্র একুশ বছর বয়সী অতি সাধারণ মুসলিম কাঠমিস্ত্রি গাজি ইলমুদ্দিন রাসুলের মহব্বতে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করে সবুজ পাখির ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে জান্নাতে বিচরণ করার সৌভাগ্য লাভ করে।ফাঁসি কার্যকর করার পর সেখানেই জানাযা ছাড়া গাজি ইলমুদ্দিনকে দাফন করা হয়।  এদিকে তার শাহাদাতের খবর দাবানলের মতো সারা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। শহিদের লাশ তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরে দাফন করার দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমানরা আল্লামা ইকবালের নেতৃত্বে বরকত আলী মোহামেডান হলে সমাবেশ ঘোষণা করে। ১ নভেম্বর আল্লামা ইকবালের বাসভবনে জলসা সংঘটিত হয়। ২ নভেম্বর আল্লামা ইকবালের দাবিতে প্রোফেশনাল মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ফিরিঙ্গি সরকারের থেকে শহিদের লাশ আদায়ের ব্যাপারে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়।

৫ নভেম্বর আল্লামা ইকবাল, স্যার মুহাম্মাদ শফি, মিয়াঁ আব্দুল আজিজ, মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গভর্নরের সাথে সাক্ষাত করে সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে শহিদের লাশ সমর্পণের জন্য আবেদন করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার শাহাদাতের ১৪ দিন পর মুসলমানদের কাছে শহিদের লাশ অর্পণ করে। শহিদের লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ট্রেনে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুসারে গাজি ইলমুদ্দিনের জানাযায় ছয় লক্ষ মুসলমান অংশগ্রহণ করে। লাহোরের ভাটিচক থেকে শুরু করে সুমনাবাদ পর্যন্ত পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জানাযা শেষে আল্লামা ইকবাল এবং সায়্যিদ দিদার আলী শাহ নিজ হাতে শহিদের লাশ কবরে রাখেন। যখন তার লাশ কবরে রাখা হচ্ছিলো, তখন মাওলানা যফর আলী খান চিৎকার করে বলে ওঠেন, “হায়! আজ এই মর্যাদা যদি আমার নসিবে জোটতো!” ঠিক সেই মুহূর্তেই আল্লামা ইকবালের যবান থেকে উচ্চারিত হয়—

اسی گلاں ای کر دے رہ گئے تے تر خاناں دامنڈابازی لے گیا

আমরা পরিকল্পনাই বানাতে থাকি আর এক কাঠমিস্ত্রির ছেলে এসে মর্যাদা লুফে নিয়ে যায়। 

১৪ নভেম্বর ১৯২৯ তারিখে গাজি ইলমুদ্দিন শহিদ রহ. এর পবিত্র লাশকে তার ওসিয়ত মোতাবেক লাহোরের ভাওয়ালপুর রোডের নিকটস্থ মিয়ানি সাহেব কবরস্থানে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ এই নবিপ্রেমিক খুদে শহিদের সমাধির ওপর অজস্র রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।


লেখাটি পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করুন
 

Ad Code

Responsive Advertisement