২০ আগস্টের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে তা হলো প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে ১২ আগস্ট জানানো হয় যে, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার সাথে বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ ২০ তারিখে এই আঘাত হানার প্রস্তাব দেয়। তারা জানতে পারে যে, ঐ দিন খোস্ত এলাকায় উচ্চপর্যায়ের মুজাহিদ কমান্ডারদের সমাবেশ হওয়ার কথা। উপগ্রহ যোগাযোগ ও অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বিন লাদেন ও অন্যদের মধ্যকার টেলিফোন সংলাপ মনিটর করে তারা এসব জানতে পারে বলে দাবি করা হয়। অবশ্য ১২ আগস্ট প্রেসিডেন্টের কাছে আক্রমণ পরিকল্পনা পেশ করার সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত ছিলো গোপন খবরের সত্যতা পরীক্ষা করে দেখা। কারণ ৮ আগস্ট থেকে গোটা আফগানিস্তানের জিহাদী শিবিরগুলোতে অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য ও আনাগোনা ঘটতে থাকে। ১৩ আগস্ট এক মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন যে, ৭ আগস্টের বোমা হামলার পর থেকে বিন লাদেনের ঘাঁটির লোকজনকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হতে থাকে। লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ আরবী দৈনিক আল-হায়াহ পাকিস্তানী নিরাপত্তা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় যে, বিন লাদেনের কান্দাহার ও জালালাবাদের সদর দফতরে এবং পাহাড়ী প্রদেশ পাকতিয়ার সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলোতে আরব মুজাহিদদের ঘনঘন আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। এমন সম্ভাবনার কথাও বলা হয় যে, খোস্তে এক বড় ধরনের সম্মেলন হতে পারে এবং বিন লাদেন তাতে উপস্থিত থাকতে পারেন। স্বভাবতই আমেকিানরা এমন একটি সুযোগ হারাতে চায়নি।
বিন লাদেনের ব্লু প্রিন্ট
ওসামা বিন লাদেনের জিহাদী নেটওয়ার্ক ধ্বংস এবং তাঁকে হত্যা বা বন্দী করার জন্য আফগানিস্তানে চলছে মার্কিন হামলা। কিন্তু সে অভিযান শেষ পর্যন্ত যদি সফল না হয় তাহলে কি হবে? অনিবার্যভাবে ধরে নেয়া যায় যে, এর ফলে ইসলামী জিহাদীদের পাল্টা আঘাত নেমে আসবে, যার পরিণতিতে লাদেন একজন আঞ্চলিক শক্তির নিয়ন্ত্রায় পরিণত হতে পারেন। সেই মানুষটি তখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার এবং বিশ্বের সিংহভাগ তেল সম্পদ। শোনা যায় লাদেনের আঞ্চলিক আধিপত্যের এটাই হলো নীলনক্সা। লাদেনের নীলনক্সা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বে আফিমের বৃহত্তম উৎস আফাগানিস্তানে ইসলামী শাসন চিরস্থায়ী রূপ নেবে। পাকিস্তানের গোঁড়া রক্ষণশীল জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করবে এবং সৌদি রাজপরিবারে ভঙ্গন লেগে দেশটি গৃহযুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হবে। পর্যবেক্ষক ও গোয়েন্দা মহলের ধরণা, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য লাদেন ভালমতোই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। যতই হামলা হচ্ছে ততই বিশ্বের দেশে দেশে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এই হামলার বিরুদ্ধে ও লাদেনের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে। সৌদি আরবেও জনমত লাদেনের পক্ষে ঝুঁকছে। লাদেন ও তাঁর কর্মকান্ড নিয়ে যথেষ্ঠ গবেষণা করেছেন এমন এক ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ টমাস উয়িথিংটনের মতে, আমেরিকা ও ব্রিটেন যতই বিমান হামলা চালাক, বিন লাদেন ঠিকই তার নিজস্ব হিসাব কষে এগিয়ে চলেছেন। তিনি আসলে এই দুটো দেশকে রক্তাক্ত যুদ্ধে টেনে আনতে চান। সেটা সম্ভব হতে পারে যদি দেশ দুটো বিমান আক্রমণ থেকে স্থল আক্রমণের দিকে অগ্রসর হয়। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে লাদেনের। সেই অভিজ্ঞতাকে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে লড়াইকে প্রলম্বিত করতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন।
আফগানিস্তানে লড়াই যত প্রলম্বিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক দেশগুলোতে বিদ্রোহ ও গণবিক্ষোভ ততই বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সর্বত্রই সরকারবিরোধী শক্তিগুলো উত্তরোত্তর অস্ত্র তুলে নেবে। আর ঠিক এটাই চাইছেন লাদেন। কারণ তা হলেই তার সেই আঞ্চলিক অধিপত্যের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। এদিক দিয়ে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী পাকিস্তানের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক বলে অনেকে মনে করেন। আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে পেশোয়ারে প্রচ- ভিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। জিহাদপন্থী শক্তিগুলো সেই বিক্ষোভকে তীব্রতম অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইবে এমনই আশা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে গোঁড়া রক্ষণশীল অংশের মধ্যে জেনারেল মোশাররফের বিরুদ্ধে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এরা মোশাররফের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দেবে। ক’দিন আগে সেনাবাহিনীর দু’জন জেনারেলকে বরখাস্ত করার ঘটনা তারই আলামত। মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ যদি পাকিস্তানকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয় তাহলে তার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর জিহাদ সমর্থক অংশটির অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসা বিচিত্র কিছু নয়। আর এই অংশটি ক্ষমতায় আসতে পারলে তো লাদেনের জন্য পোয়াবারো। পাকিস্তান তখন হবে তাঁর দ্বিতীয় আবাসভূমি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে লাদেনের সমর্থক কম নেই। সন্দেহ নেই তারা দীর্ঘদিন ধরে লাদেনকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে এসেছে। পাকিস্তানের প্রতি বিন লাদেনের দৃষ্টি পড়ার একটা কারণ হতে পারে এর পারমাণবিক অস্ত্র। বিভিন্ন সময় সাক্ষাতকারে লাদেন এই পরমাণু অস্ত্রের কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানে তালেবানী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে লাদেন অন্তত ৩০টি পারমাণবিক বোমার অধিকারী হতে পারবেন, যার প্রতিটির বিধ্বংসী ক্ষমতা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বেমার প্রায় আড়াই গুণ বেশি। ব্যাপারটা তাঁর জন্য কম প্রলুব্ধকর নয়। ইরান আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার বিরোধিতা করলেও দেশটি বিন লাদেনের আঞ্চলিক অধিপত্যের নীলনক্সার অন্তর্ভূক্ত নয়। তার একটা মূল কারণ দেশটি শিয়া মুসলিমপ্রধান, যারা ঐতিহ্যগতভাবে সুন্নী পশতুদের বিরোধী। আর তালেবান সরকারে এই সুন্নী পশতুদেরই একাধিপত্য। তবে সাবেক আফগান যুদ্ধবাজ গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার তেহরানের র্যাডিকেল বিরুদ্ধবাদীদের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি লাদেনের জন্য সমর্থন গড়ে তুলতে পারেন। তাহলে সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহের আগুন দক্ষিণ ওমান উপসাগরের দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং সৌদি রাজবংশ হবে এর পরবর্তী টার্গেট। সৌদি সরকার লাদেনবিরোধী মার্কিন হামলা সমর্থন করলেও সৌদি জনগোষ্ঠির মধ্যে লাদেনের সমর্থক কম নেই। কারণ তাদের মতে অন্যরা যা করতে পারে না লাদেন তা করতে সক্ষম। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর তাদের মধ্যে লাদেনের ইমেজ আরও বেড়ে গেছে। সৌদি আরবেও জিহাদপন্থী গ্রুপের অস্তিত্ব আছে এবং তারা সে দেশে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি সত্যি তা করতে পারে তাহলে এ জাতীয় হামলার প্রতি ওলামা সম্প্রদায়ের প্রচন্ড সমর্থন থাকবে। কারণ তাদের মতে, একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে একজন অমুসলমানের পক্ষ নেয়া ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। সৌদি আরবে বিন লাদেনের সমর্থক ১০ হাজার সাবেক মুজাহিদ রয়েছে, যারা আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। তবে ক্ষমতা দখলের মতো শক্তি তাদের নেই। লাদেনের জন্য এদের চেয়েও বেশি সহায়ক হবে সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতাদ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব রাজপরিবারের শত শত শাহজাদাকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করেছে। কোন কোন উপদল লাদেনকে রীতিমতো সমর্থন করে। তাঁকে গোপনে নিয়মিত অর্থ সাহায্য দেয় বলে জানা গেছে।
লাদেন এক সময় আমেকিান লবির লোক ছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি সুদূর আফগানিস্তানে গিয়ে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ সংঘটনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই লাদেন আমেরিকার ওপর বিগড়ে যান উপসাগর যুদ্ধের সময় সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্য মোতায়নকে কেন্দ্র করে। ইসলামের পবিত্র ভূমিতে বিধর্মী সৈন্য উপস্থিতির মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে তাঁর মার্কিনবিরোধিতার প্রতি সৌদি রাজপরিবারের একাংশ, উলামা সম্প্রদায়ের বড় অংশ ও সাধারণ জনগণের ব্যাপক সমর্থন আছে। লাদেন যদি মার্কিন হামলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে আফগান যুদ্ধকে প্রলম্বিত করাতে পারেন তাহেল ভবিষ্যতে সৌদি শাসকশ্রেণীর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সেক্ষেত্রে লাদেন অনুগতরা সৌদি সমাজের বিভিন্ন অংশের অসন্তোষকে পুঁজি করে সে দেশে বিদ্রোহ বা গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে সৌদি রাজতন্ত্রকে উৎখাত করলে তো আর কথাই নেই। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে লাদেনের মিত্রদের। আর সম্ভবত সেই সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য রেখেই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি তেলক্ষেত্রগুলো নিরাপদ রাখার চেষ্টায় সে দেশে মোতায়েন মার্কিন সৈন্যসংখ্যা ২০ হাজারে বাড়িয়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিন লাদেনের অনুগত সৈন্যের সংখ্যা কত সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে আফগানিস্তানে অবস্থানরত ১৩ টি আরব দেশের যোদ্ধা তার বাহিনীতে আছে। এছাড়া তাঁর আল কায়দা নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে বিশ্বের দেশে দেশে। এরা তাঁর ইসলামী বিপ্লবকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। ওটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস একদা মুগ্ধতার সঙ্গে পাঠ করেছেন লাদেন। হয়তো সেই সাম্রাজ্যই নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেন তিনি। --------------------------------------------------------------------------------------------বইটিতে যেভাবে আছে আমি সেভাবেই প্রকাশ করেছি। কোন প্রকার কাটছাট করা হয় নি।সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন