র্যডিকেল ভাবধারার পথে
১৯৭৪ সালে জেদ্দায় হাই স্কুলে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ওসামা বিন লাদেন ঠিক করলেন যে, উচ্চ শিক্ষার জন্য অন্য ভাইদের মত তিনি বিদেশে পাড়ি জমাবেন না, দেশেই থাকবেন। তার ভাই সেলিম তখন পরিবারের প্রধান। তিনি ইংল্যান্ডের মিলফিল্ডে সমারসেটের এক বোডিং স্কুলে থেকে লেখাপড়া করেছিলেন। আরেক ভাই ইসলাম প্রথমে সুইডেনে ও পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। ওসামা কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি অনুষদে ভর্তি হন। গুজব আছে যে, ১৭ বছর বয়সে ওসামা তার মায়ের এক সিরীয় আত্মীয়কে বিয়ে করেছিলেন এবং তিনিই নাকি তার প্রথম স্ত্রী। অবশ্য এটা আজ পর্যন্ত কোন মহল থেকেই সমর্থিত হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর লাদেনের ব্যবসায় সম্রাজ্য পরিচালনা করছিলেন বড় ভাই সেলিম।
তিনি আশা করেছিলেন যে, ওসামা পারিবারিক ব্যবসায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসামার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিন লাদেনের পছন্দ ছিল ইসলামী শিক্ষা। পরবর্তীকালে তিনি এই দুটি বিষয়কে আশ্চর্য উপায়ে সমন্বিত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী জর্দানী শিক্ষাবিদ ও অনলবর্ষী বক্তা আব্দুল্লাহ আযযামের টেপ রেকর্ডকৃত বক্তব্য শোনেন। এগুলো তার ওপর সুগভীর প্রভাব ফেলে। আযযামের বাণীবদ্য উপদেশাবলী অনেকটাই ছিল আজকের ওসামার ভিডিও টেপের মতো। আযযামের সেই সব বক্তব্য শুধু ওসামাকেই নয়; তার মতো আরো অনেক বিক্ষুব্ধ তরুণ মুসলমানের মনকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। জেদ্দা তো বটেই বিশেষ করে সেখানকার বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামী চিন্তাধারার প্রাণকেন্দ্র।
জেদ্দার মসজিদ ও মাদরাসাগুলোতে বিরুদ্ধবাদীরা র্যডিকেল ভাবধারা প্রচার করত। বলত যে, একমাত্র রক্ষণশীল ইসলামী মূল্যবোধের সর্বাত্মক পূনর্প্রতিষ্ঠাই মুসলিম বিশ্বকে পাশ্চাত্যের বিপদ ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে। বিন লাদেনের এক ভাই আব্দুল আজিজ এসময়ের কথা স্মরণকরে বলেছেন যে, ওসামা তখন সর্বক্ষণ বই পড়তেন আর নামায কালাম নিয়ে থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় ক্রিয়া কলাপে, বিশ্লেষণকরে ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক ও কুরআন শিক্ষার পর্যালোচনায় তিনি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। ওসামা এসময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো সৌদি রাজ পরিবারের তরুণ সদস্য ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার ভাবী প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের সংঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা।
তবে এসময়ের ঘটনা প্রবাহ তার মনে গভীর রেখাপাত করে। যেমন ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ইরান প্রত্যাবর্তন, পরাক্রান্ত শাহকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এ ঘটনায় মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র যুগপৎ উত্তেজনা ও আতঙ্কের স্রোত বয়ে যায়। সে বছরের নভেম্বর মাসে শিয়া চরমপন্থীরা মক্কার কাবা শরীফের মসজিদুল হারাম দখল করে নেয়। ওসামা বিন লাদেন তখন বয়সে তরুণ। সহজে প্রভাবিত হবার মতো মন তখন তার। তিনি উত্তরোত্তর গোঁড়া মুসলমান হয়ে উঠছিলেন বটে, তবে কোন্ পথ বেছে নেবেন সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত হয়ে উঠতে পারছিলেন না। কাবা শরীফে উগ্রপন্থী হামলা ও মসজিদ দখলের ঘটনায় তিনি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রচুর রক্ত পাতের পর শিয়া চরমপন্থীদের পারাস্ত করা হয়েছিলো। তবে এই উগ্রপন্থী বিদ্রোহীরা তাকে অনুপ্রাণিত করে। এদেরকে তার ন্যায় ও সত্যের পথ অনুসরণকারী খাঁটি মুসলমান বলে মনে হয়। অচিরেই ওসামা বিন লাদেন এদের পদাঙ্ক অনুসরণের সুযোগ পেয়ে যান। ঐ বছরের শেষ দিকে সোভিয়েত ট্যাংক বহর আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে এক নতুন পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সোভিয়েত হামলার বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় আফগান জনগনের জিহাদ এবং সেই জিহাদে অংশ নিতে ওসামা বিন লাদেন এক পর্যায়ে সুদূর সৌদি আরব থেকে পাড়ি জমান আফগানিস্তানে।
পেশোয়ার থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকলেই দেখা যাবে একটা ছোট্র গ্রাম। নাম জাজি। ১৯৮৬ সালে এই গ্রামে সোভিয়েত গ্যারিসনের ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায় আফগান মুজাহিদ বাহিনী। একদিন সকালে এই বাহিনীর এক সিনিয়র কমান্ডার সোভিয়েত সৈন্যদের মুহুর্মুহু মর্টার হামলার মুখে একটি বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মর্টারের গোলায় একের পর এক বিষ্ফোরণে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এমনি সময় কোথা থেকে সেই বাঙ্কারে ডাইভ মেরে প্রবেশ করেন দীর্ঘদেহী একে আরব। তিনি আর কেউ নন ওসামা বিন লাদেন। লাদেন নিজে তখন সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। তাঁর ‘স্থলযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। আশির দশকের মাঝামাঝি আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ জোরদার হয়ে ওঠে। পেশোয়ারের ডর্মিটরিগুলো হাজার হাজার মুসলমান তরুণে ছেয়ে যায়। সবাই যে একই উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল তা নয়। কেউ এসেছিলো এ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। কেউ সহকর্মী বা বন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতার টানে। কেউ বা আইনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায়। তবে বেশিরভাগই এসেছিলো ইসলামের পক্ষে ধর্মীয় যুদ্ধ তথা জেহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য। এখানে আরও একটা কথা বলে নেয়া ভালো যে, সে সময় আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধ তীব্রতর হয়ে ওঠার আংশিক কারণ ছিল প্রতিরোধ সংগ্রামে আমেরিকার আর্থিক সাহায্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া। ১৯৮৬ সালের গোটা গ্রীষ্মকাল বিন লাদেন জাজি গ্রামটির আশপাশের লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। একবার তিনি প্রায় ৫০ জন আরব যোদ্ধার একটি বাহিনী নিয়ে সোভিয়েত হেলিকপ্টার ও পদাতিক বাহিনীর টানা আক্রমণ প্রতিহত করেন। মিয়া মোহাম্মদ আগা নামে তখনকার এক সিনিয়র আফগান কমান্ডার বর্তমানে তালেবান বাহিনীতে রয়েছেন, তিনি সে সময় বিন লাদেনের যুদ্ধ তৎপরতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার বিবরণ দিয়েছেন। পরবর্তী তিন বছর বিন লাদেন আরও কঠিন লড়াই চালিয়ে যান। এতে অনেক সময় তাঁর নিজেরও জীবন বিপন্ন হয়েছিলো।
কয়েক মাস আগে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েতে আক্রমণ করেন। ওসামা বিন লাদেন সে সময় তাঁর জন্মস্থান জেদ্দা শহরে বসবাস করছিলেন। ইরাকী হামলা শুরু হবার পরপরই তিনি সৌদি রাজপরিবারের কাছে একটা বার্তা পাঠান। তাতে তিনি সাদ্দামকে পরাজিত করার জন্য আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ ত্রিশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সৈনিকের একটি বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। বার্তায় লাদেন বলেন, যারা রুশ বহিনীকে হারিয়ে দিয়েছে তারা সহজেই সাদ্দাম হোসেনকেও হারাতে পারবে। এমন একটা বাহিনী গঠিত হলে তিনি যে সে বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন তা আর বলার অপেক্ষা ছিল না।
কিন্তু প্রস্তাবটা দিয়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়েছিলেন বিন লাদেন। বড়ই নির্মম, বড়ই হৃদয়হীনভাবে। সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল সৌদ পরিবার ধর্মানুরাগী ইসলামপন্থীদের কোনো বাহিনী চাননি। একেবারে কিছুতেই না। রাজ পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা লাদেনকে সাক্ষাত দিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রস্তাবটা সটান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তারা। প্রিন্স আব্দুল্লাহর সঙ্গে তার সাক্ষাতকারটি ছিলো সেগুলোরই একটি। কিন্তু তার চেয়েও আরও খারাব কিছু অপেক্ষা করছিলো বিন লাদেনের জন্য। ইসলামের সূতীকাগার সৌদি আরব তথা পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদীনাকে রক্ষা করার জন্য যেখানে তিনি একটা ইসলামী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন। সেখানে দেখতে পেলেন এই দায়িত্বটাই তুলে দেয়া হয়েছে আমেরিকানদের হাতে। রাগে অপমানে ফুঁসতে লাগলেন বিন লাদেন। তাঁর দেশে তিন লাখ মার্কিন সৈন্য এসে পৌঁছল। তারা ঘাঁটি নির্মাণ শুরু করে দিল। মদ্যপান ও সানবাথিং করতে লাগল। এসব দেখে যাওয়া ছাড়া বিন লাদেনের আর কিছুই করার রইল না। তিনি এই সৈন্যদের উপস্থিতিকে বিদেশীদের আগ্রাসন বলে গণ্য করতে লাগলেন।
বিন লাদেন একেবারে চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি গোটা উপসাগরের আলেম সমাজ ও জিহাদপন্থী মুসলমানদের মধ্যে প্রচার কাজ চালাতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যে তিনি একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। সেই পরিচিতিকে পুঁজি করে তিনি সৌদি আরবের সর্বত্র বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। মসজিদগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার অডিও টেপ প্রচার করতে লাগলেন। বিন লাদেনের তৎপরতা এখানেই সীমাবদ্ধ রইল না। তিনি তার সেনাবাহিনীর লোক রিক্রুট করার কাজ শুরু করলেন। ট্রেনিং লাভের জন্য প্রায় চার হাজার রিক্রুটকে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সৌদি শাসকগোষ্ঠী অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। একদিন হানা দেয়া হলো লাদেনের বাড়িতে। গৃহবন্দী করা হল তাকে। উদ্বিগ্ন হলো বিন লাদেনের পরিবার। ওসামার কার্যকলাপের ফলে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভেবে ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হলো। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। পরিশেষে তাঁরা বিন লাদেনকে সত্যিকার অর্থে ত্যাজ্য করতে বাধ্য হলো। লাদেনের উপর চাপ আরও বৃদ্ধি পেল।
-----চলমান।
আগের পর্বগুলো পড়ুন।
প্রথম পর্ব
২য় পর্ব
১৯৭৪ সালে জেদ্দায় হাই স্কুলে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ওসামা বিন লাদেন ঠিক করলেন যে, উচ্চ শিক্ষার জন্য অন্য ভাইদের মত তিনি বিদেশে পাড়ি জমাবেন না, দেশেই থাকবেন। তার ভাই সেলিম তখন পরিবারের প্রধান। তিনি ইংল্যান্ডের মিলফিল্ডে সমারসেটের এক বোডিং স্কুলে থেকে লেখাপড়া করেছিলেন। আরেক ভাই ইসলাম প্রথমে সুইডেনে ও পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। ওসামা কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি অনুষদে ভর্তি হন। গুজব আছে যে, ১৭ বছর বয়সে ওসামা তার মায়ের এক সিরীয় আত্মীয়কে বিয়ে করেছিলেন এবং তিনিই নাকি তার প্রথম স্ত্রী। অবশ্য এটা আজ পর্যন্ত কোন মহল থেকেই সমর্থিত হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর লাদেনের ব্যবসায় সম্রাজ্য পরিচালনা করছিলেন বড় ভাই সেলিম।
তিনি আশা করেছিলেন যে, ওসামা পারিবারিক ব্যবসায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসামার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিন লাদেনের পছন্দ ছিল ইসলামী শিক্ষা। পরবর্তীকালে তিনি এই দুটি বিষয়কে আশ্চর্য উপায়ে সমন্বিত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী জর্দানী শিক্ষাবিদ ও অনলবর্ষী বক্তা আব্দুল্লাহ আযযামের টেপ রেকর্ডকৃত বক্তব্য শোনেন। এগুলো তার ওপর সুগভীর প্রভাব ফেলে। আযযামের বাণীবদ্য উপদেশাবলী অনেকটাই ছিল আজকের ওসামার ভিডিও টেপের মতো। আযযামের সেই সব বক্তব্য শুধু ওসামাকেই নয়; তার মতো আরো অনেক বিক্ষুব্ধ তরুণ মুসলমানের মনকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। জেদ্দা তো বটেই বিশেষ করে সেখানকার বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামী চিন্তাধারার প্রাণকেন্দ্র।
জেদ্দার মসজিদ ও মাদরাসাগুলোতে বিরুদ্ধবাদীরা র্যডিকেল ভাবধারা প্রচার করত। বলত যে, একমাত্র রক্ষণশীল ইসলামী মূল্যবোধের সর্বাত্মক পূনর্প্রতিষ্ঠাই মুসলিম বিশ্বকে পাশ্চাত্যের বিপদ ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে। বিন লাদেনের এক ভাই আব্দুল আজিজ এসময়ের কথা স্মরণকরে বলেছেন যে, ওসামা তখন সর্বক্ষণ বই পড়তেন আর নামায কালাম নিয়ে থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় ক্রিয়া কলাপে, বিশ্লেষণকরে ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক ও কুরআন শিক্ষার পর্যালোচনায় তিনি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। ওসামা এসময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো সৌদি রাজ পরিবারের তরুণ সদস্য ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার ভাবী প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের সংঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা।
তবে এসময়ের ঘটনা প্রবাহ তার মনে গভীর রেখাপাত করে। যেমন ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ইরান প্রত্যাবর্তন, পরাক্রান্ত শাহকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এ ঘটনায় মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র যুগপৎ উত্তেজনা ও আতঙ্কের স্রোত বয়ে যায়। সে বছরের নভেম্বর মাসে শিয়া চরমপন্থীরা মক্কার কাবা শরীফের মসজিদুল হারাম দখল করে নেয়। ওসামা বিন লাদেন তখন বয়সে তরুণ। সহজে প্রভাবিত হবার মতো মন তখন তার। তিনি উত্তরোত্তর গোঁড়া মুসলমান হয়ে উঠছিলেন বটে, তবে কোন্ পথ বেছে নেবেন সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত হয়ে উঠতে পারছিলেন না। কাবা শরীফে উগ্রপন্থী হামলা ও মসজিদ দখলের ঘটনায় তিনি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রচুর রক্ত পাতের পর শিয়া চরমপন্থীদের পারাস্ত করা হয়েছিলো। তবে এই উগ্রপন্থী বিদ্রোহীরা তাকে অনুপ্রাণিত করে। এদেরকে তার ন্যায় ও সত্যের পথ অনুসরণকারী খাঁটি মুসলমান বলে মনে হয়। অচিরেই ওসামা বিন লাদেন এদের পদাঙ্ক অনুসরণের সুযোগ পেয়ে যান। ঐ বছরের শেষ দিকে সোভিয়েত ট্যাংক বহর আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে এক নতুন পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সোভিয়েত হামলার বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় আফগান জনগনের জিহাদ এবং সেই জিহাদে অংশ নিতে ওসামা বিন লাদেন এক পর্যায়ে সুদূর সৌদি আরব থেকে পাড়ি জমান আফগানিস্তানে।
রণাঙ্গনে
সুদানে নির্বাসন
বিন লাদেন একেবারে চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি গোটা উপসাগরের আলেম সমাজ ও জিহাদপন্থী মুসলমানদের মধ্যে প্রচার কাজ চালাতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যে তিনি একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। সেই পরিচিতিকে পুঁজি করে তিনি সৌদি আরবের সর্বত্র বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। মসজিদগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার অডিও টেপ প্রচার করতে লাগলেন। বিন লাদেনের তৎপরতা এখানেই সীমাবদ্ধ রইল না। তিনি তার সেনাবাহিনীর লোক রিক্রুট করার কাজ শুরু করলেন। ট্রেনিং লাভের জন্য প্রায় চার হাজার রিক্রুটকে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সৌদি শাসকগোষ্ঠী অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। একদিন হানা দেয়া হলো লাদেনের বাড়িতে। গৃহবন্দী করা হল তাকে। উদ্বিগ্ন হলো বিন লাদেনের পরিবার। ওসামার কার্যকলাপের ফলে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভেবে ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হলো। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। পরিশেষে তাঁরা বিন লাদেনকে সত্যিকার অর্থে ত্যাজ্য করতে বাধ্য হলো। লাদেনের উপর চাপ আরও বৃদ্ধি পেল।
-----চলমান।
আগের পর্বগুলো পড়ুন।
প্রথম পর্ব
২য় পর্ব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন