গোপন লেনদেনে বিন লাদেন
বৈরী পরিস্থিতির কারণে সৌদি আরবে টিকতে না পেরে ১৯৯১ সালে সুদানে চলে গেয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন। ভেবেছিলেন সেখানে নতুন করে ব্যবসায়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবেন। পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে স্থির হয়ে বসবেন। শেষের উদ্দেশ্যটি অবশ্য পূরণ হয়নি। তবে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন ইসলামী জিহাদ আন্দোলন সংগঠনে। ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে গিয়ে বিন লাদেন আগে সুদান ও অন্যান্য দেশে বিশেষ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও পূর্ব আফ্রিকায় কোথায় কী বিনিয়োগের সুযোগ আছে তা পরীক্ষা করে দেখেন।
আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে অর্থ সংস্থান বেশ আকর্ষণীয় ও লাভজনক বিনিয়োগ। ওদিকেই বিন লাদেনের ঝোঁক ছিল বেশি। সেদিকেই তিনি ঝুঁকে পড়লেন এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থলগ্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এই সুসম্পর্কের বদৌলতে পরবর্তীকালে তিনি হয়ে দাঁড়ান বিশ্বব্যাপী ইসলামী জিহাদীদের অর্থ প্রেরণ ও আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম। কিভাবে সেটা ঘটল তার একটা পটভূমি আছে এবং এখানে সে সম্পর্ক দু’চার কথা না বললেই নয়। বিসিসিআই ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা কে না জানেন। ১৯৯১ সালের ৫ জুলাই ব্যাংকটি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানত উপরসাগরীয় আরব দেশগুলোর ধনী শেখদের অর্থ সংস্থানে গঠিত ব্যাংকটি পাকিস্তানীদের দ্বারা পরিচালিত হতো।
বিসিসিআই কত রকম গোপন কর্মকান্ডে যে জড়িত ছিল তার ঠিক নেই। জিহাদী, মুসলিম গুপ্ত সংস্থা ও মুজাহিদদের অর্থ যোগাত। অস্ত্রশস্ত্র ও স্পর্শকাতর স্ট্র্যাটেজিক প্রযুক্তি কেনার ব্যাপারে গোপন আর্থিক লেনদেন করত। উন্নয়নশীল বিশ্বের দুর্নীতিবাজ নেতাদের মেরে দেয়া টাকা পয়সা গচ্ছিত রাখা বা অন্যত্র পাচার করা এসব কাজ তো ছিলই। আশির দশকের বিসিসিআই ব্যাংক ছিল আফগান মুজাহিদদের সিআইএ’র দেয়া গোপন সাহায্য হস্তান্তরের প্রধান মাধ্যম। সৌদি আরব, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশও তাদের গোপন কার্যক্রমের জন্য বিসিসিআইয়ের বিচিত্র কৌশলকে কাজে লাগাত।
কাজে কাজেই আফগান মুজাহিদরা ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠনও যে বিসিসিআই-কে ব্যবহার করেছিল তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সেসব গোপন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট কোন নথিপত্র রাখেনি। নিজেদের জড়িত থাকারও কোন প্রমাণ রাখেনি। আর্থিক শক্তির দিক দিয়ে ব্যাংকটি ছিল অন্তঃসারশূন্য এবং সত্যিকারের আর্থিক সচ্ছলতা কখনই ছিল না। কাজেই ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে ব্যাংকটি যখন বন্ধ করে দেয়া হলো, ক্লায়েন্টদের অনেকেই পথে বসল। জিহাদী ও অন্যান্য গুপ্ত সংস্থার গচ্ছিত বিপুল অঙ্কের অর্থ শুধু যে খোয়া গেল তাই নয়, তাদের লেনদেন পরিচালনার একান্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আর কোন প্রতিষ্ঠানও রইল না।
বিশ্বব্যাপী নতুন ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের জোয়ার যখন সৃষ্টি হতে চলেছে তখন এসব কার্যক্রমে গোপনে ও নিরাপদে অর্থ সংস্থানের এমন একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের অনুপস্থিতি আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের চিন্তায় ফেলল। এই সমস্যার সমাধান এনে পপুলার ইন্টারন্যাশনাল আর্গ্যানাইজেশন এবং আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট এর জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনঃর্নিমাণ করতে পারবে এমন একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা তীব্ররূপে অনুভূত হলো। আর্থিক ক্ষেত্রে এ ধরনের ভজঘট অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এনে দেয়ার ব্যাপারে সে সময় খার্তুমে ওসামা বিন লাদেনের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ ছিলেন না। সেটা বুঝতে পেরেই স্বয়ং তুরাবি ১৯৯১ সালের গ্রীষ্মে সরাসরি এ ব্যাপারে বিন লাদেনের সাহায্য কামনা করলেন। ইসলামী জিহাদ তৎপরতায় সহায়তা দানের জন্য একটা নির্ভরযোগ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্ব তুরাবি সর্বদাই অনুভব করেছিলেন। বশির যখন ক্ষমতা দখল করলেন ততদিনে সুদান গোটা অঞ্চলের, বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকার ইসলামী জিহাদ আন্দোলনে অর্থ সংস্থানের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
আশির দশকের শেষদিকে তুরাবির তত্ত্বাবধানে ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুড পাশ্চাত্যে পরিচালিত কয়েকটি বড় ধরনের ইসলামী অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। যেমন- ইসলামিক হোল্ডিং কোম্পানি, জর্ডানিয়ন ইসলামিক ব্যাংক, দি দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, দি ফয়সাল ইসলামীক ব্যাংক প্রভৃতি। ১৯৯১ সালে আজিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় তাকওয়া ব্যাংক। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুড এই তাকওয়া ব্যাংককে জিহাদীদের বিশ্বব্যাংক হিসাবে গণ্য করতে থাকে। যার লক্ষ্য হচ্ছে পাশ্চাত্যের অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া। ইসলামী জিহাদী সংস্থা বা আন্দোলনগুলো একদিকে তাদের গোপন কার্যক্রমে আর্থিক লেনদেনের জন্য বহুলাংশে বিসিসিআইয়ের ওপর নির্ভর করে চলছিল এবং অন্যদিকে নতুন ইসলামী ব্যাংকগুলোকেও তাদের কর্মকান্ডের সঙ্গে ধাতস্থ করে তুলেছিল। ঠিক এমনি সময় হলো বিপর্যয়। বিসিসিআই মুখ থুবড়ে পড়ল। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুডের কাজকর্ম তখন অর্থাভাবে ব্যাহত হতে লাগল।
ইসলামী আন্দোলনগুলোতে আর্থিক সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে সুদান ও ইরানের মধ্যে একটা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। ইরান সেই অর্র্থ পাঠানোর আগেই তা গোপনে সঞ্চিত রাখার বা ট্রান্সফার করার মতো এ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করার দরকার হয়ে পড়ল। এ অবস্থায় বিন লাদেন স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন। তিনি নিজের কোম্পানির ইন্টারন্যাশনাল এ্যাকাউন্টকে ইসলামী তহবিলের ভেন্যু ও ফ্রন্ট হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ দিলেন। এভাবে ১৯৯১ সালের শেষদিকে তেহরানের পাঠানো ৩ কোটি ডলার জমাও হলো বিন লাদেনের কোম্পানির এ্যাকাউন্টে। বিশ্বজুড়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের ব্যাংকগুলোর কাজকর্ম এবং তারা কোথায় কোথায় গোপনে অর্থ পাঠাচ্ছে তার ওপর তীক্ষ নজর রেখে চলছিল। বিন লাদেনের কোম্পানির এ্যাকাউন্টে অর্থ ট্রান্সফারের কাজটা প্রকাশ্যেই ঘটেছিল এবং তা থেকে কারও কিছুই সন্দেহ করার কারণ ঘটেনি। কেননা লাদেনের তখনকার বাহ্যিক পরিচয় একজন ধনকুবের ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছু ছিল না।
বিন লাদেনের বিস্ময়কর নেটওয়ার্ক
বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধ হবার ফলে দেশে দেশে ইসলামী জিহাদী কার্যকলাপের পিছনে বিভিন্ন মহলের দেয়া অর্থ গোপনে প্রেরণের ক্ষেত্রে সাময়িক অচলাবস্থা দেখা দিলেও এভাবে বিন লাদেন তার একক বুদ্ধি ও চাতুর্যের দ্বারা তা দূর করতে সক্ষম হন। বিন লাদেন এরপর ব্যবস্থাটিকে আরেকটু প্রসারিত করেন। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সুদানী ব্যাংকে বিন লাদেন তাঁর কোম্পানির নামে বেশ কিছু এ্যাকাউন্ট খোলেন। এই এ্যকাউন্টগুলোই গোপনে অর্থ প্রেরণ ও ট্রান্সফারের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। এভাবেই আলজিরিয়ায় নির্বাচনের প্রাক্কালে ধনী ইরানীদের এবং শেখ শাসিত উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর র্যাডিকল ইসলামপন্থীদের দেয়া ১ কোটি ২০ লাখ ডলার খার্তুমে ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক শাখায় গচ্ছিত রাখা হয়। সেখান থেকে তা পোপনে পাচার করা হয় আলজিরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টকে সাহায্য করার জন্য। বলাবাহুল্য, ঐ নির্বাচনে স্যালভেশন ফ্রন্ট কার্য ত বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৯২ সালের প্রথমদিকে সুদানে এভাবে আরও ২ কোটি ডলার ট্রান্সফার করা হয়। তার পর সেখান থেকে পাঠানো হয় আলজিরিয়ায়। এরও উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টকে সাহায্য করা। ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি ইরান জিহাদী প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সুদানকে ৩ কোটি ডলার সাহায্য দেয়। এটা হার্ড কারেন্সিতে দেয়া হয়েছিল। অবশ্য এই অর্থের সিংহভাগ লন্ডনের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়, যা ছিল তুরাবির নিয়ন্ত্রণে। পরে ঐ অর্থ আন্তর্জাতিক জিহাদী তৎপরতায় ব্যয় হয়েছিল। সুদানে জিহাদী প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচ খার্তুম তার জাতীয় বাজেট থেকে মিটিয়েছিল।
বিন লাদেন জানতেন যে, গোপনে অর্থ প্রেরণ ও বিলিবণ্টনের যে ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলেছেন সেটা একটা সাময়িক জোড়াতালি ব্যবস্থা মাত্র। এর চেয়ে অনেক বেশি সুসংবদ্ধ ও স্থায়ী ব্যবস্থা থাকা দরকার। তুরাবিও এই ধারণার সাথে একমত ছিলেন। ওদিকে আফগান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার আফগানিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য পাশ্চাত্যে চোরাচালান করার এবং এই ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা জিহাদী নেটওয়ার্ক বিস্তারে সাহায্যের জন্য যথাযথ সংস্থাকে পাঠানোর ব্যাপারে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যেও অর্থ লেনদেনের আরেক কৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বিন লাদেন এ ব্যাপারে দ্বৈত কৌশল অবলম্বন করলেন। প্রথমে তিনি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকে বেশকিছু এ্যকাউন্ট খুললেন এবং ওগুলোতে নিজের টাকা ও তুরাবির ধনবান সমর্থকদের টাকা জমা রাখলেন। এই টাকা অন্যান্য লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধানত কোল্যাটারল বা জামানত হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে অপেক্ষাকৃত ন্যায়সঙ্গত কিছু কিছু খরচও এসব এ্যাকাউন্ট থেকে মিটানো হয়েছিল। যেমন, ১৯৯৩ সালে সুদান ও অন্যান্য এলাকায় অবস্থানরত আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ সৈনিকদের খাদ্য ও ঔষধপত্র সংগ্রহের খরচ মিটানোর জন্য বিন লাদেন দুই মিলিয়ন ডলারের একটি চেক দিয়েছিলেন। চেকটি ছিল ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংকে বিন লাদেনের ব্যক্তিগত একটি এ্যাকাউন্টের। চেকটা তিনি নিজের হাতে তুরাবিকে দিয়েছিলেন বলে বিন লাদেন দাবি করেন।
কিন্তু ওটা ছিল ছোটখাটো অঙ্কের লেনদেন। বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন পরিচালনার জন্য আরও ব্যাপক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। সেই লক্ষ্যে বিন লাদেন এবং তুরাবির অনুগত কিছু সুদানী ধনী ব্যবসায়ী খার্তুমের শামাল (নর্থ) ইসলামিক ব্যাংকে মূলধন যুগিয়েছিলেন। বিন লাদেন দাবি করেছেন যে, ব্যাংকের মূলধন বাবদ তিনি দিয়েছিলেন ৫ কোটি ডলার। তবে সে অর্র্থটা তার নিজের ছিল, নাকি অন্য কারও ছিল জানা যায়নি। ইসলামী জিহাদের আর্থিক প্রয়োজন মিটাতে শামাল ব্যাংকের মাধ্যমে অনেক রকম লেনদেন করা হয়। এ ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে দেয়ার জন্য সুদান সরকার খুশি হয়ে বিন লাদেনকে পশ্চিম সুদানে ও করডোফানো এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ একর জমির মালিকানা দিয়ে দেন। বিল লাদেনের পক্ষ থেকে আজও এ জমি চাষাবাদের কাজে এবং গবাদিপশু পালনে ব্যবহার করা হচ্ছে।বিন লাদেন উদ্ভাবিত এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কী পরিমাণ অর্থ জড়িত ছিল তার একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে, খুব সম্ভবত ১৯৯৩ বা ৯৪ সালে তুরাবি ইসলামিক এ্যাবার পিপলস কংগ্রেস এর আওতাভুক্ত দেশগুলোতে ইসলামী জিহাদ পরিচালনায় অর্থ সংস্থানের জন্য একটা বিশেষ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রায় ১০ কোটি ডলার এই তহবিল গঠনের জন্য দেয়া হয়। তহবিল দেখাশোনার জন্য তুরাবির সহকর্মী ইব্রাহিম আল-সানুসিকে চেয়ারম্যান করে একটি বিশেষ কমিটিও গঠিত হয়। এই তহবিল ছিল ধরনের অসংখ্য তহবিলের একটি।
কিন্তু এ ছিল সবে শুরু। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ বিন লাদেন তাঁর আফগান জীবনের সময়কার সহায্যদাতা ও পারিবারিক যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন যার প্রকৃত স্বরূপ বের করতে পারা চরম শত্রুর দিক থেকেও ছিল অসম্ভব। প্রথমে বিন লাদেন তাঁর নব উদ্ভাবিত আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থাটিকে আইমান আল-জাওয়াহিরির জিহাদী নেটওয়ার্কের সাহায্যার্থে কাজে লাগান। বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও সহকর্মী জাওয়াহিরি সে সময় ইউরোপে অতিউন্নত ধরনের এক জিহাদী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছিলেন। জাওয়াহিরির জিহাদী নেটওয়ার্কে অর্থ সংস্থানের কাজটি সে সময় “ব্রাদারহুড গ্রুপ’ নামে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপটির মূল শক্তি হিসাবে ছিল এবং সম্ভাবত এখনও আছে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর ১৩৪ আরব ধনকুবের।
এঁদের মাধ্যমে অতিসুকৌশলে জিহাদীদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেয়া হতো। উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া যাতে তারা সাহায্যদাতা দেশেগুলোর সাথে জিহাদীদের কোন রকম যোগসূত্র বের করতে না পারে। ‘ব্রাদারহুড গ্রুপের’ প্রধান সদস্যরা পাশ্চাত্যে অর্থলগ্নির ক্ষেত্রে সুপরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে এদের ৬৫ জনের বড় বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান আছে। নয়া ব্যবস্থায় এসব কোম্পানি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান জিহাদীদের আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম, ছত্রছায়া ও ফ্রন্ট হিসাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে নিযুক্ত জিহাদী বা তাদের নেতৃবৃন্দকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লোকদেখানো চাকরি দিয়ে এবং ব্যবসায়িক ভিসার ব্যবস্থা করে ওসব দেশে তাদের বৈধ উপস্থিতির পথ সুগম করে দিয়েছে। এভাবে বিন লাদেনের উদ্ভাবিত গোটা আর্থিক ব্যবস্থাটি অতি দক্ষতার সাথে ও সুচারুরূপে চলছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এই যে, গোটা পাশ্চাত্যের কোথাও জিহাদীদের উদ্দেশ্যে দেয়া অর্থ ধরা পড়েনি বা আটক হয়নি। বিন লাদেন আয়োজিত এই বিস্ময়কর নেটওয়ার্ক জেনেভা, লন্ডন, শিকাগোসহ বিশ্বের দেশে দেশে নীরবে নিঃশব্দে লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করে চলেছে।
চ্যারিটির ছত্রছায়ায় জিহাদী কর্যক্রম
১৯৯৩ সালের মে মাস। একজন সিনিয়র জিহাদী কমান্ডারের কাছ থেকে উদ্ধার করা কিছু নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে মিসরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশ্চর্য এক তথ্য পেলেন। বলা যেতে পারে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল। তারা জানতে পারলেন যে, মিসরীয় জিহাদীদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম ও প্রিন্টিং প্রেস কিনতে সাহায্য করার জন্য একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ আসছে এবং সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিন লাদেনের সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কোনটি, কিছুতেই তার হদিস বের করা গেল না। মিসরীয় গোয়েন্দারা একটা বড় অঙ্কের অর্থের চালানের কথাও জানতে পারলেন, যা জিহাদী নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। কিন্তু কিছুতেই ঐ অর্থের প্রবাহ রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তারা বুঝলেন, এ জাতীয় অর্থের চালান মিসরে প্রায়ই এসে থাকে। তবে কোন পথে সেটা প্রহেলিকাই থেকে গেল।
১৯৯৪ সালে মিসরীয় নিরাপত্তা সার্ভিস হিসাব করে দেখে যে, প্রতিবছর অজ্ঞাত সূত্র থেকে মিসরে এ জাতীয় অর্থ গড়ে ৫০ কোটি মিসরীয় পাউন্ড এসে থাকে। অস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনা, জিহাদী অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের বেতনভাতা দান, কারারুদ্ধ বা আটক মুজাহিদদের পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ প্রভৃতি কাজে ঐ অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে। সে সময় একটানা অসংখ্য জিহাদী কর্মকান্ড ঘটছিল মিসরে এবং সেগুলোর সাথে অর্থের ঐ অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের একটা নিবিড় যোগসূত্র ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিদেশ থেকে আগত কিছু চেক আটক করা হলেও মিসরের নিরাপত্তা বিভাগ এসব অর্থের উৎসের যেমন হদিস বের করতে পারেনি, তেমনি পারেনি এর প্রবাহ বন্ধ করকে। এমন ব্যাপার শুধু যে মিসরের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল তা নয়, আরও বেশ কিছু দেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অর্থ সরবরাহের এমনি অদৃশ্য ব্যবস্থা বিন লাদেনের উদ্ভাবিত বলে মনে করা হয়। বিন লাদেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যা প্রায় বৈধ মর্যাদা পেয়েছিল। বিশেষ করে পাশ্চাত্যে পরাজিত ইসলামী জিহাদীদের জন্য বিন লাদেন এ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। ব্যবস্থাটি প্রথমে আল-কায়দা ফাউন্ডেশন নামে একটি সাহায্য সংস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি বিন লাদেন ও তার ভাবপুরুষ শেখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম মিলে ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রুশবিরেধী আফগান যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও প্রেরণ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
ঐ যুদ্ধ শেষ হবার পর ফাউন্ডেশনটি পুনর্গঠিত করা হয় এবং এর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ পাঠানো হয় সারা বিশ্বে বিশেষ করে বসনিয়া, আলবেনিয়া ও কসোভোর মতো এলাকার ইসলামী কেন্দ্র ও মানবিক ত্রাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায্যের জন্য, যেখানে মুজাহিদরা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার লড়াইয়ে নিয়োজিত। পরবর্তীকালে এই ফাউন্ডেশনকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানবিক সাহায্য সংগঠন গড়ে ওঠে। ব্যহ্যিকভাবে মনে হতে পারে যে, এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। ভিতরে ভিতরে নিবিড় যোগাযোগ আছে। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অর্থ ও লোকবলও অহরহ দেয়া নেয়া হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষে এদের মধ্যকার সত্যিকারের যোগসূত্র বের করা কিছুতেই সম্ভব হয়নি। এসব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান ও মানবিক প্রকল্পগুলো ইসলামী জিহাদীদের ছত্রছায়া বা আশ্রয়ই শুধু দেয় না, তার চেয়ে ঢেড় বেশি কিছু দিয়ে থাকে। এরা ব্যাপক পরিসরে সামাজিক ও মানবিক সার্ভিসও দেয়। স্কুল, নার্সারি, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খামার, ওয়ার্কশপ প্রভৃতি তার অন্তর্গত। সামগ্রিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুস্থ জনগোষ্ঠীকে আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা যোগায়। তার ফলে এরা জনগোষ্ঠীর ব্যাপক ও যথার্থ সমর্থন লাভ করে থাকে। ইসলামী জিহাদে এদের টেনে আনাও সহজতর হয়। ১৯৯৩ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় প্রায় দু’ডজন চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান ও মানবিক প্রকল্পের ছত্রছায়ায় ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার ইসলামী জিহাদী কাজ করেছে বলে জানা গেছে। এগুলো বিন লাদেনের উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
১৯৯৬ সালে জনৈক মিসরীয় সাংবাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিন লাদেন তার আর্থিক ও মানবিক তৎপরতার ক্ষেত্র ও পরিধির কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, তার সাহায্যের আওতায় আছে ১৩টি দেশ যথা আলবেনিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ড, ব্রিটেন, রুমানিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, লেবানন, ইরাক এবং কিছু উপসাগরীয় দেশ। এক পর্যায়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, তার সাহায্য আসে বিশেষ করে হিউম্যান কনসার্ন ইন্টরন্যাশনাল সোসাইটি নামে একটি সংস্থা থেকে, যা ১৯৮২ সালে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জন্ম আফগানিস্তানে হলেও দারিদ্রক্লিষ্ঠ আফগানিস্তান এক পয়সাও এর তহবিলে দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে সৌদি আরব ও শেখ শাসিত উপসাগরীয় দেশগুলোর বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যাক্তি ও সমর্থকদের দেয়া সাহায্য গোপনে ঐ সোসাইটির তহবিলে জমা করা হয় এবং পরে তা বিভিন্ন মানবিক সাহায্য সংস্থাকে ছড়িয়ে দেয়া হয় যেগুলো আসলে জিহাদীদের ছত্রছায়া হিসাবে কাজ করেছে। সোসাইটির প্রধান কার্যালয় রয়েছে স্টকহোমে এবং এর শাখা অফিস বিশ্বের সর্বত্র ছাড়িয়ে আছে। যেমন ব্রিটেনে আছে আল-মুসাদাই সোসাইটি। বার্লিনে আছে আল-নাজদা (ত্রাণ) সোসাইটি। ইতালিতে আছে ইসলামিক সাপোর্ট সোসাইটি, জাগ্রেবে আছে মুত্তয়াকাক সোসাইটি এবং পেশোয়ারে আছে বায়তুল-আনসার।
---চলমান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন