Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১১)


ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ায় সেই সত্তরের দশক থেকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনের আন্দোলন চলছিল। ইথিওপিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯৯১ সালের মে মাসে একটি চুক্তি হয়। তদানুযায়ী প্রেসিডেন্ট হাইলে মেঙ্গিসটু মরিয়ম পদত্যাগ করেন এবং মেলেস জেনাবির নেতৃত্বে বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। সংগঠনগুলোর বেশির ভাগই ছিল মুসলিম প্রধান। এগুলোর এধ্যে ইরিত্রিয়া যুক্তফ্রন্ট ১৯৯৩ সালের মে মাসে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।অন্যদিকে সোমালিয়ায় ১৯৯০ সাল থেকে বিদ্রোহী তৎপরতায় নিয়োজিত সংগঠনগুলোর সবাই ছিল প্ল্যানভিত্তিক। তার মধ্যে প্রধান প্রধান সংগঠন হলো ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস (হাউয়ি ক্লান), সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (ইসাক ক্লান), সোমালি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট, (ওগাদেনি ও কিসমায়ু ক্লান) এবং সোমালি ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (রাহানওয়েন ক্লান।) ১৯৯২ সালে সোমালিয়ায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের জন্য প্রাকৃতিক কারণ খরা যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী ছিল মানুষের নিজের ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট সঙ্কট।

 একদিকে উপজাতীয় যুদ্ধ এবং অন্যদিকে সোমালিয়ার প্রধান নেতাদের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই এই বিপর্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সোমালিয়ায় ক্ষমতায় আসেন ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেসের অন্যতম নেতা আলী মাহদি মোহাম্মদ। কিন্তু ১৯৯১ সালের প্রথমদিকে ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মাহদী মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন অংশ ও সংগঠনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফারাহ আইদিদের নেতৃত্বাধীন অংশের মধ্যে বড় ধরনের ভাঙ্গণ ধরে। পরে তা ক্ষমতার তিক্ত লড়াইয়ের রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত ইউএসসি ভেঙ্গে যায়। ১৯৯২ সালে রাজধানী মোগাদিসুতে দুই পক্ষের ক্লান ও সাব ক্লানগুলোর মধ্যে যে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয় তাতে রাজধানীর বেশিরভাগ নগরিক সুবিধা ও সেবা ব্যবস্থা ধসে পড়ে। ইতোমধ্যে সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ ত্রাণে জাতিসংঘ ও পাশ্চাত্য দেশগুলো খাদ্য সাহায্য পাঠায়। সাহায্যের, বিশেষ করে খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য সরকারী বাহিনী ও আইদিদের অনুগত বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই বেঁধে যায়। সাহায্য লুট হয়ে যায়। এই পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক মিশনের নামে সোমালিয়ায় ১৯৯২ সালের নভেম্বরে এক বড় আকারের সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিলে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া হয়।

 জেনারেল আইদিদ হুমকি দেন যে, যে কোন বৈদেশিক সৈন্য মোতায়েন করা হলে সোমালিয়ায় রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। একদিকে সাহায্য ও অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য আইদিদ বাহিনী অন্যান্য সংগঠন যথা এসএনএ, এসএলএ, এসপিএন, এসডিএম প্রভৃতির সঙ্গে জোট গড়ে তোলে এবং গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথগুলো দখল করে নেয়। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আলী মাহদী মোহাম্মদ ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার প্রতিনিধিদের নিয়ে আইদিদবিরোধি জোট গঠন করেন। গৃহযুদ্ধ যখন জোরেশোরে চলছে এ অবস্থায় সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত অসংখ্য দাতব্য বা সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সোমালিয়ায় ইসলামী জিহাদীদের উপস্থিতি বেড়ে যায়। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ অত্যাসন্ন হয়ে ওঠার মুখে তারা বিদেশী সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে এবং বলে যে, এই সাহায্য নিয়ে আসার নামে পাশ্চাত্য আসলে সোমালিয়াকে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার পাঁয়তারা করেছে

। জিহাদীরা ইসলামিক ওয়ার্ল্ড এ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্ল্ড মুসলিম রিলিফ অর্গানাইজেশন প্রভৃতির ছত্রছায়ায় কাজ করে চলে। এগুলোর পিছনে বিশাল আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল বলে এগুলোকে কেউ ঘাটাতে সাহস পেত না। আসলে এগুলো ছিল জিহাদী নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কের বেশকিছু ফ্রন্ট সংগঠন ওসামা বিন লাদেনের গড়া। মুজাহিদদের সাহায্যের জন্য নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে সোমালিয়ায় এক সুপ্রতিষ্ঠিত আর্থিক নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব ছিল। বিভিন্ন জিহাদপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠন এতে অর্থ যোগাত। ১৯৯১ সালের শেষদিকে এই নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ লাভের মধ্য দিয়ে সোমালিয়ার ইসলামী আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা চূড়ান্তরূপে বিন লাদেনের হাতের মুঠোয় চলে আসে। ফলে তার পক্ষে সোমালিয়ায় মার্কিনবিরোধী অভিযানে অর্থ যোগাতে এবং সে অভিযান অব্যাহত রাখতে কোন বেগ পেতে হয়নি।

সোমলিয়ায় দুর্ভিক্ষ ও গৃহযুদ্ধ বিস্তৃত হবার পাশাপাশি সেখানে জিহাদী ইসলামীদের ঘাঁটি সুসংহত ও প্রসারিত করার জন্য ইরান-সুদানের যৌথ প্রয়াস অব্যাহত থাকে। তারই অংশ হিসাবে সুদানে ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, কেনিয়া ও উগান্ডার যোদ্ধাদের জন্য আরও অনেক প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। বলা বাহুল্য, সেগুলো খোলার পিছনে ওসমা বিন লাদেনেরই ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। ১৯৯২ সালের শরতে তুরাবি গোটা পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিনবিরোধী তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশ দেয়ায় অল্পদিনের মধ্যে সুদান থেকে সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় জিহাদী নেতা ও বিশেষজ্ঞের অতিরিক্ত দল পাঠানো হয়।

 সে বছরের ২২ নভেম্বর সোমালিয়ায় মার্কিন সৈন্য প্রেরণ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে এই সব জিহাদী মোতায়েনও বৃদ্ধি পায়। সোমালিয়ার এই জিহাদীদের বলে দেয়া হয়েছিল যে, জিহাদী তৎপরতা চালানো ছাড়াও তারা মিলিশিয়াদের ট্রেনিং ও নেতৃত্ব দেবে। এজন্য তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সাজসরঞ্জামও দেয়া হয়। এই মিলিশিয়াদের অনেকে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের ভিতরে থেকে কাজ করেছে। অন্যরা করেছে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। বেশির ভাগ জিহাদী ইরিত্রিয়া হয়ে সোমালিয়া গেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিরা গোপনে সমুদ্র পথে এসে দক্ষিণ সোমালিয়া ও কেনিয়ায় নেমেছে। সোমালিয়ার এই জিহাদীরা সুদানের মাধ্যমে তেহরানের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিলো। আশির দশকের প্রথম দিকে বৈরুতে মার্কিন শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিরিয়া ও ইরান যেভাবে হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করেছিল ঠিক একইভাবে সোমালিয়ার এই জিহাদীদের মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছিল ইরান।

সোমালিয়া সঙ্কটে বিন লাদেন-২

আমেরিকান মেরিন সোমালিয়ার সৈকতে এসে নামে ১৯৯২-এর ডিসেম্বরের প্রথমভাগে। প্রথম কিছুদিন তাদের শান্তিপূর্ণভাবেই কাটে-স্থানীয় বাহিনীর সঙ্গে বড় ধরনের কোন সংঘর্ষের সম্মূখীন হতে হয়নি। পরিস্থিতি তখন তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকলেও সুদান ও ইরান লোহিত সাগর ও আফ্রিকা শৃঙ্গের ওপর যৌথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এজন্য ইসলামী জিহাদী শক্তিসমূহের প্রশিক্ষণ ও মোতায়েন সম্পন্ন করা হয়। সোমালিয়া এরা স্থানীয় শক্তিগুলোর পূর্ণ সমর্থন লাভ করে। যেমন- সোমালিল্যান্ডের নেতা আবদুর রহমান আহমদ আলী টুর যিনি তার এলাকায় শরয়ী আইন ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন তুরাবির অতি ঘনিষ্টজন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সুদান ও ইরানের সাহায্য পেয়েছিলেন। মধ্যসুদানে তুরাবি ও ওসামা বিন লাদেনের সবচেয়ে সক্রিয় ও অনুগত সমর্থক ছিলেন মোগদিসুর সাবেক পুলিশপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আবশির, যিনি সোমালী স্যালভেশন ডেমোক্র্যটিক ফ্রন্টের (ঝঝউচ) অন্যতম নেতা ছিলেন।

 সুদান, মিসর, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের “সেচ্চাসেবকরা” ১৯৯২ সালে ঝঝউচ এর বাহিনীতে যোগ দেয়। তা ছাড়া জেনারেল আইদিদ ও সুদান সরকারের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার অংশ হিসাবে আইদিদ আগে থেকেই সুদানের বৈষকি ও সামরিক সাহায্য পেয়ে আসছিলেন। ওদিকে ইথিওপিয়ায় ইরান ও সুদানের সাহায্যপুষ্ট ওরোমো লিবারেশন ফ্রন্ট রুপান্তরিত হয়ে গঠিত হয় ইসলামীক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ওরোমো। এই রূপান্তর সোমালিয়ার পরিস্থিতিরি ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। ১৯৯৩ সালে বিন লাদেন আয়োজিত ও সংগঠিত কিছু কিছু সরবরাহ পথ ওরোমো নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। জিবুতিতে তুরাবির সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন সে দেশের নিরাপত্তাপ্রধান ইসমাইল ওমর গুয়েলের চাচা। অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ জিবুতি দিয়ে সোমালিয়া পাঠানো হতো। প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এসব নেটওয়ার্ক তৈরি করা ও পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হতো এবং সেই অর্থ গোপনে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ারও দরকার হতো। সে দায়িত্বটা অনিবার্যরূপে এসে পড়েছিল বিন লাদেনের ওপর। তিনি নিরাপদে সেই অর্থ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন।

 শুধু তাই নয়, ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি সুদান ও ইরান পূর্ব আফ্রিকায় তাদের তৎপরতার ব্যাপক বিস্তার ঘটালে প্রচলিত আর্থিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেই প্রয়োজন মিটানো যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় বিন লাদেন ও তাঁর দল ইউরোপ ও পূর্ব আফ্রিকাজুড়ে তাঁদের প্রচলিত ব্যাবসায় ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টগুলো কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কোন কোন ক্ষেত্রে বিন লাদেন ও তাঁর বন্ধুরা অর্থের গোপন প্রবাহ ত্বরান্বিত করার জন্য পূর্ব আফ্রিকায় বেশ কিছু ছদ্ম কোম্পানি ও ভূয়া এ্যাকাউন্ট খুলে বসেছিলেন।১৯৯২ সালের শরৎকালের মধ্যে সোমালিয়ায় ইসলামী সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে বর্ধিত ও সম্প্রসারিত হয়। তাদের তৎপরতার কেন্দ্র হয় মোগাদিসু, মারকা ও বোসাসো। তুরাবির সৃষ্ট সোমালি ইসলামিক ইউনিয়ন পার্টি (ঝওটচ) উত্তরে বোসাসোয় এবং দক্ষিণে মারকা ও জামামিতে তাদের প্রবল উপস্থিতির স্বাক্ষর রাখে। 

ইথিওপিয়া সীমান্তের কাছে সোমালিল্যান্ড ওগাদেনে মুজাহিদদের জন্য আরও কিছু প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এ ক্ষেত্রেও বিন লাদেন গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুদান সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বেস ক্যাম্প ও গুদাম ইথিওপিয়ার মাটিতে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলে বিন লাদেন সেখানে বৈধ আন্তর্জাতিক কোম্পানী খোলেন। এই কোম্পানিগুলো তখন ঐ এলাকায় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে। এসব প্রকল্পের ছত্রছায়ায় ইথিওপিয়ায় অর্থ প্রেরণ করা হতে থাকে। এই অবকাঠামো সোমালিয়ায় মুজাহিদদের জোয়ার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। 

১৯৯২-এর ডিসেম্বরে মার্কিন মেরিন সোমালিয়ার সৈকতে নামার আগেই জিহাদী ইসলামী সংগঠনগুলো মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত ইরান-সুদান স্ট্রাটেজির দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। ইরান-সুদান স্ট্রাটেজির মূলকথা ছিল এই যে, গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে মার্কিন বাহিনীকে এমন অবস্থায় ফেলতে হবে যাতে সোমালিয়া তাদের জন্য একাটা ফাঁদ বা চোরাবালিতে পরিণত হয়। সোমালিয়ায় মার্কিন বাহিনীর ওপর আক্রমণের মহড়া হিসাবে দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেনে কিছু কিছু মার্কিন স্থাপনার উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব স্থাপনা সোমালিয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করেছিল।

 ইয়েমেনে বিন লাদেনের ব্যাপক যোগাযোগ থাকায় এই আক্রমণের সার্বিক পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তার হাতে অর্পিত হয়। সময়ের দিক থেকে প্রচন্ড চাপের মুখে কাজ করে বিন লাদেন আক্রমণ ত্বরান্বিত করার জন্য পুরানো ও পরীক্ষিত লোকজনকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। ইয়েমেনী “আফগানদের” অর্থাৎ আফগান যুদ্ধে অভিজ্ঞ ইয়েমেনের ইসলামী স্বেচ্চাসেবকদের নিয়ে প্রধান আক্রমণকারী দল গঠন করা হয়। মূল পরিকল্পনায় এডেনে মার্কিন সৈন্যদের ব্যবহৃত কয়েকটি হোটেল এবং সমুদ্র ও বিমানবন্দরে মার্কিন স্থাপনায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যবস্থা ছিল। সকল বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মুখে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করার জন্য ওসামা বিন লাদেন এডেনের শেষ সুলতান ও জিহাদী ইসলামী শেখ তারিক আল ফাদলিকে তার লন্ডন প্রবাস ছেড়ে ইয়েমেনে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে এই অভিযানের দায়িত্ব নিতে রাজি করান। ফাদলিকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি গোপনে ইয়েমেনের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সময় বাঁচানোর জন্য এই স্কিমের প্রয়োজনে বিপুল অঙ্কের অর্থ ইয়েমেনে বিন লাদেনের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পাঠানো হয়।

ডিসেম্বরের প্রথমদিকে ‘ইয়েমেনী ইসলামিক জিহাদ’ নামক সংগঠনের ছত্রছায়ায় আক্রমণকারী দল সংগঠিত হয়। প্রায় ৫শ উন্নত ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইয়েমেনী আফগানের মধ্য থেকে মূল জিহাদীদের বেছে নেয়া হয়। এরা ছিল তারিক আল ফাদলির প্রত্যক্ষ কমান্ডের অধীনে। তাদের মূল ঘাঁটি ছিল সাদাহ এলাকায়। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে বিন লাদেন ও ফাদলি এডেনে আগ থেকে ইসলামী জিহাদের যেসব ঘাতক স্কোয়াড ছিল তাদের দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকদের হত্যা এবং আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বোমা হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যান। ২৯ ডিসেম্বর ইসলামী জিহাদীরা এডেন হোটেল ও গোল্ডেন মুর হোটেলে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটায়। এতে তিন আমেরিকান নিহত ও ৫জন আহত হয়। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে গোটা পরিকল্পনা জট পাকিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে। মার্কিন বিমানবাহিনীর পরিবহন বিমানগুলোকে লক্ষ্য করে আঘাত হানার প্রস্তুতি নেয়ার সময় এডেন বিমানবন্দরের প্রান্তে রকেট লঞ্চারসহ জিহাদীরা ধরা পড়ে। অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর ৮ জানুয়ারি শেখ ফাদলি ও তার সহকর্মীরা এডেন কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা দেন। গোটা অভিযানের নেপথ্যে যে বিন লাদেন ছিলেন তা ফাঁস হয়ে যায়। 

সোমালিয়া: চূড়ান্ত আঘাতের প্রস্তুতি


সোমালিয়ায় মার্কিনবিরোধী লড়াই শুরু হওয়ার আগে ১৯৯২-এর শেষভাগ থেকে ১৯৯৩ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সুদান থেকে শুরু করে ইয়েমেন, সোমালিয়া ও ওগাদেন পর্যন্ত আফ্রিকা শৃঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী জিহাদীদের মোতায়েন সম্পন্ন হয়ে যায়। এদের মধ্যে ইরানের আল-কুদ্স বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট আফগানরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইয়েমেনের ইসলামিক জিহাদের এলিট ইউনিট। তার ওপর সমর পরিকল্পকদের চাপে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তান থেকে আরও তিন হাজার আফগান যোদ্ধা নিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য এই আফগানরা ছিল বিভিন্ন দেশের ইসলামী যোদ্ধা যারা আফগানিস্তানের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এই আফগানরা তাদের সাথে ভারি অস্ত্রপাতি এবং জিহাদী কাজে ব্যবহার্য সাজসরঞ্জাম নিয়ে এসেছিল, যার মধ্যে ছিল উচ্চশক্তির বিস্ফোরক, অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল বোমা, বুবি-ট্রাপ পুতুল এবং কিছু স্টিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র। এই আফগান এলিট ফোর্স ইয়েমেনের আল-মারাকিশাহ পর্বতাঞ্চলের সাদাহ এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে।

 ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সোমালিয়ার লড়াই বিস্তার লাভ করার মুখে বিন লাদেন অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামসহ এই আফগানদের বিমানযোগে দ্রুত ইয়েমেন থেকে সোমালিয়ায় স্থানান্তর করেন। পরে এক মিসরীয় সাংবাদিকের কাছে বিন লাদেন বলেছিলেন যে, ঐ অভিযানে তাঁর একান্তভাবে নিজের ৩০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছিল। একই সময় সরাসরি ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন ইরানী পাসদারান ও সোমালীয় জিহাদীদের সুদানে সংগঠিত করা হয়। যাতে করে তারা অতর্কিত সুইসাইড অভিযান চালানোর কৌশলে পারদর্শী সুদানী ইসলামিক ইউনিয়নের (ঝওটচ) ইউনিটগুলোকে সাহায্য সমর্থন যোগাতে পারে। তাছাড়া সোমালিয়ায় হস্তক্ষেপ করার জন্য আলাদাভাবে রেখে দেয়া বেশ কয়েক শ’ আফগানকে সোমালিয়ায় পাঠানোর আগে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য লিবীয় সীমান্তের কাছে রাখা হয়। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি খার্তুমে জিহাদ বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে আফ্রিকা শৃঙ্গ পরিস্থিতির পার্যালোচনা করে সোমালিয়ায় জিহাদ বিস্তার করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গ্রীন সিগনাল দেয়া হয়।

 সেই বৈঠকে জেনারেল ফারাহ আইদিদের সিনিয়র কমান্ডাররাও অংশ নেন। এই বৈঠক পরবর্তী ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে আইদিদ ও তাঁর প্রধান সামরিক ও গোয়েন্দা সহকর্মীরা পর পর ইরান, ইয়েমেন, সুদান, ইথিওপিয়া ও উগান্ডা সফর করে মূল পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময়ের দিকে শেখ আইদিদ খার্তুমে ইরাকী দূতাবাসে ইরাকী গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। বলাবাহুল্য তুরাবি ছিলেন এসব বৈঠকের আয়োজক। বাগদাদ আইদিদকে ব্যাপকভিত্তিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে বছরের বসন্তে মোগাদিসু অভিযান সাদ্দাম হোসেনের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যে, তিনি তাঁর ছেলে কুসায়কে সোমালিয়া তথা আফ্রিকা শৃঙ্গে মার্কিনবিরোধী অভিযানে ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব দেন। খার্তুমে ইরাকী গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এ সময় বলতে শোনা যায় যে, সাদ্দাম হোসেন সোমালিয় যুদ্ধে বড় ধরনের বিজয় অর্জনে সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলেন।


অচিরেই সাদ্দাম হোসেনের নিজস্ব স্পেশাল সিকিউরিটি এজেন্সির সদস্যসহ বেশকিছু গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞের আগমনে খার্তুমে ইরাকী দূতাবাস স্ফীত হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্যকারীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালের জুন মাসের মধ্যে ইরানী পাসদারান, লেবাননী হিজবুল্লাহ, আরব আফগান এবং সুদানের ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট, সোমালিয়ার ঝওটচ, কেনিয়ার ইসলামিক রিপাবলিক অর্গানাইজেশন, ইসলামিক ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অব ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া ইসলামী জিহাদসহ তুখোড় ইসলামী জিহাদীদের বেশকিছু দল সোমালিয়ায় গোপনে মোতায়েনের কাজ সম্পন্ন হয়। তার ওপর বিন লাদেন নিয়ে আসেন বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামসহ প্রায় তিন হাজার মুজাহিদ সদস্য। সামগ্রিকভাবে এই ইসলামী বাহিনীর সিংহভাগ অংশ বিন লাদেনের সংগৃহীত খামারগুলোতে এসে জড়ো হয়। সেখানে তারা তাদের পশ্চাদবর্তী স্থাপনা গড়ে তোলে। এসব নিরাপদ আশ্রয় থেকে তাদেরকে অভিযান চালাতে পাঠানো হয়।গ্রিষ্মের প্রথমদিকে প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ইসলামী জিহাদীরা রাজধানী মোগাদিস্যুতে মার্কিন ও জাতিসংঘ বাহিনীর ওপর বোমা হামলাসহ বেশকিছু এ্যামবুশ শুরু করে।

 ১৯৯৩ সালের ৫ জুন এক বড় ধরনের এ্যামবুশ চালিয়ে তারা জাতিসংঘ বাহিনীর ২৩ সৈন্যকে হত্যা করে। স্থানে স্থানে মার্কিন ও জাতিসংঘ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এসব সংঘর্ষের আশু ও নাটকীয় প্রভাব পড়ে জেনারেল আইদিদের পতাকাতলে সমবেত ইসলামী জোটের শক্তি ও সংহতির ওপর। একটা একীভূত হাই কমান্ডের আবির্ভাব ঘটে।এই লড়াই চালাতে গিয়ে আইদিদ ব্যাপক জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন বাহিনীর মোকাবালা করে তিনি বীরের আসন লাভ করেন। মার্কিন বিরোধী অভিযান চালানোর ফলে সোমালিয়ার অনেক ট্রাইব এবং রাজনৈতিক-সামরিক শক্তি আইদিদের সোমালী ন্যাশনাল এ্যালায়েন্সের (ঝঘঅ) নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে যোগ দেয় এবং আইদিদকে তাদের সর্বাধিনায়ক হিসাবে মেনে নেয়। এদিকে একটানা চোরাগোপ্তা হামলা ও বোমাবাজির জবাবে মার্কিন ও জাতিসংঘ বাহিনী প্রবল গোলাবর্ষণ শুরু করে। ফলে রাজধানী মোগাদিসুতে সংঘর্ষের ব্যাপক বিস্তার হয়।

১১ জুন আইদিদ ও তাঁর কয়েক সিনিয়র কমান্ডার খার্তুমে গিয়ে ‘পিপলস এ্যারাব এ্যান্ড ইসলামিক কংগ্রেস’-এর ছত্রছায়ায় এক গুপ্ত পরামর্শ সভায় মিলিত হন। তুরাবির সভাপতিত্বে এই সভায় সোমালিয়ায় জিহাদের বিস্তার ঘটানোর এবং ইসলামী জিহাদীদের সাহায্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই কংগ্রেসেই বিন লাদেন তুরাবির ইনার সার্কেলের অন্যতম উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মিসরীয় নেতা আইমান-আল-জাওয়াহিরিও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। জুন মাসের খার্তুম বৈঠকের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এই যে, সোমালিয়ায় অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে বাগদাদকে বৃহত্তর ভূমিকা গ্রহণের সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয় এবং ভিয়েতনামে যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে গেরিলা যুদ্ধে টেনে আনার লক্ষ্যে ইরাকী-সুদানী-ইরানী সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

১৩ থেকে ২৫ জুন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েক দফা বিমান হামলা চালায়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সোমালী মিলিশিয়ারা প্রবল প্রতিরোধ দেয়। তারা মার্কিন স্থল সেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং আইদিদকে ধরার জন্য ‘কোবরা’ গানশিপের অভিযানে ব্যর্থ করে দেয়। ওদিকে খার্তুম সম্মেলন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সারির বেশকিছু জিহাদ বিশেষজ্ঞ গোপনে সোমালিয়া এমনকি মোগাদিসুতে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করেন। জাওয়াহিরিকে সরাসরি সোমালীল্যান্ডে পাঠানো হয়। অন্যদিকে খার্তুমে ওসামা বিন লাদেন আরেকটি যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলছিলেন।

বলা যেতে পারে তিনি হাজার হাজার লোককে গোপনে সুদান থেকে তৃতীয় রাষ্ট্র ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া দিয়ে সোমালিয়ায় আনার সুবিশাল উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ মরুভূমির চরম বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। গোটা উদ্যোগের জন্য বিন লাদেন ট্রাক ও জ্বালানি খাদ্য, পানি, অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক ও মেডিক্যাল কিট প্রভৃতি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যে সোমালিয়ায় ইসলামী জিহাদ অবকাঠামো সুসংহত হতে শুরু করেছে। তাঁদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মোগাদিসুর দক্ষিণে ওরং কিসমানু, বার্দহিরি, মারকা ও গালকাইওতে। গালকাইও ছিল আইদিদের অন্যতম ঘাঁটি। ইরানী গোয়েন্দারা বোসাসোতে গোপনে ট্যাংকবিধ্বংসী ও বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র বসায়। এছাড়া ইরাকের এলিট স্ট্রাইক ফোর্স-আস সাইকা কমান্ডোর প্রায় ১২ শ’ সদস্য সোমালিয়ায় মোতায়েন করা হয় মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলায় অংশ নেয়ার জন্য। তার ওপর ইসলামী জিহাদ বিশেষজ্ঞদের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও সংগঠিত প্রায় ১৫ হাজার সোমালী মার্কিনবিরোধী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল।

বিন লাদেনের চোখে যুক্তরাষ্ট্র

১৯৯৩ সালের ১২ জুলাই মোগাদিসুতে মার্কিন হামলার পর পরই জেনারেল আইদিদ আহূত সিনিয়র কমান্ডারদের বৈঠকে বোসাসোয় মোতায়েন বিভিন্ন দেশের জিহাদী বাহিনীকে ব্যাপক তৎপরতা শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়। সাহায্যকর্মীসহ মার্কিন ও জাতিসংঘ সেনাদের ওপর হামলা ঐ মাসে শুধু মোগাদিসুতে নয়, গোটা মধ্য সোমালিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সোমালী নাগরিকদের হত্যার বদলা নিতে আইদিদ অনুসারীদের যে কোন স্থানে মার্কিন বানিীর ওপর আঘাত হানতে বলে দেয়া হয়। আইদিদ বাহিনী মার্কিন দূতাবাসে ও জাতিসংঘ অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে। জুলাইয়ের গোটা সময় ধরে এই বিক্ষিপ্ত হামলা চলতে থাকে। প্রচার মাধ্যমে জেনারেল আইদিদকে ইচ্ছা করেই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে।

 যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘসহ সবার দৃষ্টি আইদিদের কর্মকা- এবং বক্তব্য-বিবৃতির ওপর নিবদ্ধ তখন তারই ছত্রছায়ায় মোগাদিসু শহরে যুুদ্ধে নতুন অংশগ্রহণকারীর আগমণ হয়। এরা হল ভ্যান গার্ড অব দি সোমালি ইসলামিক স্যালভেশন। ৩ আগস্ট সংস্থা নিজস্ব বেতার ঘোষণায় ও প্রচারপত্রে ‘শয়তান’ মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ বিস্তারের জন্য সোমালীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই দিন শেখ আইদিদের বেতার ভাষণেও একই কথা উচ্চারিত হয়। ১৯৯৩ এর আগস্টের প্রথমভাগে আইদিদ বাহিনী ও তার মিত্ররা দক্ষিণ মোগাদিসুতে বড় ধরনের লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। এ সময় সোমালী ইসলামিক স্যালভেশন মুভমেন্ট (ঝওঝঘ) যোদ্ধারা প্রথমবারের মতো মার্কিন সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে রিমোর্ট কন্ট্রোল বোমার সাহায্যে চার মার্কিন সৈন্যকে হত্যা করে। এরপর আরও বেশকিছু অভিযান চালায়। 

১৯৯৩ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সোমালী ইসলামিক ইউনিয়ন পার্টির (ঝওটচ) পতাকাতলে ইসলামী এলিট বাহিনী মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।৬ সেপ্টেম্বর তারা মোগাদিসুতে জাতিসংঘ অবস্থানে একের পর এক বহু হামলা চালায়। ৫ সেপ্টেম্বর এদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আইদিদ বাহিনী জাতিসংঘ বাহিনীর ৯ নাইজেরিয়ান সৈন্য হত্যা করে। কোণঠাসা নাইজেরীয়দের উদ্ধারে মার্কিন সৈন্যদের ব্যাপক হস্তক্ষেপ এবং প্রচন্ড গোলাগুলি চালাতে হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর আইদিদ বাহিনীর সঙ্গে মার্কিন সৈন্যদের তুমুল লড়াই হয়। মার্কিন বাহিনী অসংখ্য অসামরিক নাগরিক হত্যা করে। এরপর শুরু হয় সহিংসতার বিরামহীন চক্র। ১৫ সেপ্টেম্বর আইদিদ ও মুজাহিদ বাহিনী দিনের বেলায় জাতিসংঘ সদর দফতরে মর্টার হামলা চালায়। ইসলামী জিহাদীরা ও সোমালী ন্যাশনাল এ্যালায়ন্স মার্কিন হেলিকপ্টার অ্যাম্বুশ করতে শুরু করে। ২৬ সেপ্টেম্বর মোগাদিসুতে একটা ব্ল্যাকহক গুলি করে ভূপাতিত করে। উৎফুল্ল সোমালী জনতা নিহত মার্কিন বৈমানিকের লাশ রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় টেনে নিয়ে যায়। ১৯৯৩ সালের শরতের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী জিহাদীদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার ফলে সোমালিয়ায় সংঘর্ষের বিস্তার ঘটেছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে,

মোগাদিসুকে আমেরিকানদের জন্য দ্বিতীয় বৈরুত বা দ্বিতীয় কাবুল বানানো। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ইসলামী জিহাদীরা পরিস্কার টের পেয়ে যায়, আমেরিকানরা মোগাদিসুর চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেছে। এখন বাকি রয়েছে তাদের অবমাননার সঙ্গে বিদায় দেয়ার পালা। মোগাদিসুর লড়াইটা ছিল ইসলামিক ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল কমান্ডের অধীনে পরিচালিত প্রথম বড় ধরনের লড়াই। হাসান আল-তুরাবি সার্বিক কর্মকান্ডের সিনিয়র নেতার ভূমিকায় আবির্র্ভূত হন। 

আইমান আল জাওয়াহিরি, আবদুল্লাহ জাভেদ (আফগান) ও কামারুদ্দীন ধারবান (আলজিরীয়) সরাসরি তাঁর অধীনে থেকে সমরিক তৎপরতা চালান। ওসামা বিন লাদেন ছিলেন লজিষ্টিক্যাল সাপোর্টের দায়িত্বে। ১৯৯৩ সালের শরতে জাওয়াহিরি সরাসরি সোমালিয়ায় থেকে আইদিদের সিনিয়র সামরিক সহকর্মী হিসাবে কাজ করেন। সোমালিয়া যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ড কমান্ডার জাওয়াহিরি তাঁর সঙ্গে সেখানে আলী আল রশিদীকে নিয়ে যান। তিনি আবু উবায়দা আল বানসিড়ি বা আবু উবায়দা আল বানজাসিড়ি নামেও পরিচিত। জাওয়াহিরির অতি বিশ্বস্ত বন্ধু আল রশিদী মিসরীয় পুলিশ বাহিনীতে ইসলামী জিহাদের গুপ্ত সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ সালে তাঁকে সাদাত হত্যাকান্ডের পর গ্রেফতার করা হয়। পরে ১৯৮৬ সালে তিনি সুকৌশলে আফগানিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি বিন লাদেনের বাহিনীতে যোগ দেন এবং দু’জনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যান। আল রশিদী ছিলেন লাদেনের ডান হাত। 

---চলমান।

মন্তব্যসমূহ

Ad Code

Responsive Advertisement