Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(৮)



১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি আয্যাম ফিলিস্তিনী সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই যুক্তিতে যে, এই সংগ্রাম ইসলামী জিহাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ না হয়ে জাতীয় বিপ্লবের আদর্শের দ্বারা চালিত হচ্ছে। সম্পর্ক ছিন্ন করার পর আয্যাম জেদ্দায় গিয়ে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে থাকেন। ওসামা বিন লাদেন তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। লাদেন আয্যামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এমন প্রমাণের অভাব নেই। জেদ্দায় আয্যাম তাঁর এই মতবাদ দাঁড় করান যে, পাশ্চাত্যের অশুভ প্রভাব থেকে মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য ‘জিহাদ’ শুধু অপরিহার্যই নয়, এটাই একমাত্র পথ। ১৯৮০ সালে আয্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে আফগানিস্তানে চলে যান। তবে আফগান যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পাকিস্তানী ও আফগান নেতারা তাঁকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ না নিয়ে শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী তাঁকে ইসলামাবাদের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির লেকচারার নিয়োগ করা হয়। আয্যাম সে চাকরিতে যোগ না দিয়ে আফগান সীমান্তের কাছে পেশোয়ারে চলে যান। এবং আফগান জিহাদের পিছনে তাঁর সময় ও শক্তির পুরোটাই উৎসর্গ করেন। সেখানে তিনি বায়তুল আনসার নামে একটি শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বায়তুল আনসার’ আফগান জিহাদে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তানে আগত প্রথম ইসলামী স্বেচ্ছাসেবক দলটিকে গ্রহণ করে ও ট্রেনিং দেয়। এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিন লাদেনও ইসলামী আন্তর্জাতিক জিহাদী ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে যান। এবং আয্যামের ঘনিষ্ঠতম একজন শিষ্য হয়ে দাঁড়ান।শেখ আয্যামের ছিল শিক্ষা, ভাবধারা ও চিন্তাশক্তি। আর বিন লাদেনের ছিল অর্থবিত্ত, জ্ঞান ও কর্মোদ্যম। আয্যামের ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেন লাদেন। আয্যাম ও লাদেন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন মাকতাব-আল খিদমাহ বা মুজাহিদীন সার্ভিস ব্যুরো। লাদেন অচিরেই এই ব্যুরোকে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত করেন। যার কাজ হলো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে সাধারণ থেকে সর্বস্তরের জ্ঞানসম্পন্ন ইসলামপন্থীদের খুঁজে বের করা এবং আফগানিস্তানে বিভিন্ন কাজে তাদের রিক্রুট করা। 


১৯৮০-র দশকের শেষভাগ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, সৌদি আরব ও কয়েকটি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসহ ৫০টি দেশে বিন লাদেনের ঐ আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের শাখা ও রিক্রুটমেন্ট কেন্দ্র স্থাপিত হয়ে যায়। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বিপুল সংখ্যক আরবের আগমণ ঘটেছিল। তাদের গ্রহণ করে ফ্রন্টে পাঠাতে গিয়ে বিন লাদেন লক্ষ্য করেন যে, আফগানিস্তানের বন্ধুর পরিবেশের মুখোমুখি হওয়ার আগে এই আরবদের উপযুক্ত ট্রেনিং দেয়া ও পরিবেশের সঙ্গে ধাতস্ত করে নেয়া দরকার। সেটা বিবেচনা করেই আয্যাম ও বিন লাদেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় স্থানে মাসাদাত-আল আনসার স্থাপন করেন। আরব মুজাহিদদের জন্য এটা এমন এক কেন্দ্রীয় ঘাঁটি হিসাবে কাজ করবে যেখানে স্বদেশের বাইরে থেকেও স্বদেশের পরিবেশ পাওয়া যাবে। এসব কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বিন লাদেন বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে অসংখ্য জিহাদ পন্থী মুসলিম ও মুজাহিদের সঙ্গে যোগযোগ স্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর জিহাদ পরিচলনার সহায়ক হয়েছে।


সোভিয়েত ও আফগান সরকারের আর্টিলারি বাহিনীর মুখে মুজাহিদদের অবস্থা খুবই নাজুক- এ দিকটার কথা চিন্তা করে বিন লাদেন সৌদি আরব থেকে ভারি প্রকৌশল সরঞ্জাম নিয়ে আসেন। সড়ক নির্মাণ ত্বরান্বিত করা এবং মুজাহিদদের জন্য স্থাপনা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রথমে তিনি তার পরিবারের কিছু বুলডোজার আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। এরপর সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর বেশকিছু কোম্পানির কাছ থেকে নানা ধরনের ভারি সরঞ্জাম আনার ব্যবস্থা করেন। এগুলোর সাহায্যে মুজাহিদদের জন্য ভূগর্ভে ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। আশ্রয়স্থল বানানো হয়েছিল। এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে সামরিক সাহায্য আসতে থাকায় বিন লাদেন আফগান, পাকিস্তানী ও আরব মুজাহদীদের ভারি প্রকৌশল সরঞ্জাম ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি আফগানিস্তানের পূবাঞ্চলে মুজাহিদদের জন্য এক সুরক্ষিত ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজে হাত দেন- যেখানে সড়ক,সুড়ঙ্গ পথ, হাসপাতাল ও গুদাম সবই থাকবে।

আফগান যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মিসর থেকেও বিপুলসংখ্যক মুজাহিদ সে দেশে পাড়ি জমায়। সেখানে তারা নিজেদের তৎপরতা চালোনোর জন্য একটা নিরাপদ ঘাঁটি খুজে পায়। আফগানিস্তানে আগত প্রথম দিকের মিসরীয়দের একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আহমদ শাকি আল ইসলামবুলি। ইনি বর্তমানে বিন লাদেনের সিনিয়র মুজাহিদ কমান্ডারদের একজন। তার আরও একটি পরিচয় আছে যা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা হলো ১৯৮১ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট সাদাত যার হাতে নিহত হয়েছিলেন সেই খালিদ আল ইসলামবুলি তার ভাই। মিসরের শুদ্ধি অভিযানের পর থেকেই তারা পালাতক ছিলেন। আফগানিস্তানে গিয়ে তারা অচিরেই একটি সুসংবদ্ধ আরব বিপ্লবী দল গড়ে তোলে। আর এই দলটি আজ পর্যন্ত বিন লাদেনের অতি বিশ্বস্ত কমান্ডার ও সৈনিকদের হার্ডকোর অংশ। ১৯৮৩ সালে শাকি আল ইসলামবুলি করাচীতে গিয়ে মিসর থেকে লোক ও অস্ত্র আনা নেয়ার একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। নেটওয়ার্কটা এখনও চালু আছে। 


১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে ওসামা বিন লাদেন মুজাহিদদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার এবং স্বেচ্ছাসেবক রিক্রুট করে আফগানিস্তানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে স্বদেশে ফিরে যান। সেই লক্ষে তিনি সৌদি শাসক গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকে কাজে লাগাতে ভোলেননি। অচিরেই বাদশা ফাহাদের ভাই প্রিন্স সালমান, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। 

সৌদিদের স্বার্থোদ্ধারে বিন লাদেন

 

বিন লাদেন যখন আফগান যুদ্ধে বিভিন্ন মহলের সাহায্য সহযোগিতা সংগ্রহে ব্যস্ত সৌদি আরব তখন এই তরুণ মুজাহিদ নেতাকে নিয়ে ভাবছিল অন্যকথা। সে সময় আরব উপদ্বীপ মস্কোপন্থী বিভিন্ন দেশের বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত বা ঘেরাও হয়ে পড়তে পারে এমন ধারণা সৌদিদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। তৎকালীন সোভিয়েত প্রভাববলয়ের দেশ দক্ষিণ ইয়েমেনে এবং লোহিত সাগর তীরবর্তী আফ্রিকা শৃঙ্গে সোভিয়েত,পূর্ব জার্মানি ও কিউবার সামরিক উপস্থিতি ক্রমাগত বেড়ে চললে সৌদি আরব রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সৌদিরা আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ ইয়েমেনের প্রতি বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করে চললেও তাদের মাথায় অন্য চিন্তা খেলতে থাকে। 

সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ইয়েমেনে এডেনের শেষ সুলতান তারিক আল-ফাদলির নেতৃত্বে গোপনে গোপনে এক ইসলামী বিদ্রোহের আয়োজন করা হয়। কমিউনিস্টবিরোধী এই বিদ্রোহীদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ওসামা বিন লাদেনকে “সেচ্ছাসেবক” মুজাহিদ ইউনিট গঠন করতে বলা হয়। এই কাজের জন্য পুরো আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল রিয়াদ এবং এর পিছনে সৌদি রাজ দরবারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদ ছিল। বিন লাদেন আফগানিস্তানে যেতে ইচ্ছুক নানা শ্রেণীর ইসলামী সেচ্ছাসেবী এবং সৌদি হোয়াইট গার্ডস-এর বিশেষ বাহিনী (এদের আনুষ্ঠানিকভাবে ছুটি দেয়া হয়েছিল সদস্যদের নিয়ে “স্ট্রাইক ফোর্স” বা আক্রমণকারী বাহিনী গঠন করেন। দক্ষিণ ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের এই লাড়াইয়ে বিন লাদেন এতখানি জড়িয়ে পড়েন যে, দক্ষিণ ইয়েমেনী বাহিনীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু যতই উৎসাহ থাকুক এই কমিউনিস্টবিরোধী জিহাদ খুব একটা বিকাশ লাভ করতে পারেনি। তেমন কোন সাফল্য দেখতে না পেয়ে রিয়াদ শেষ পর্যন্ত গোটা কার্যক্রম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তবে বিন লাদেনের এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। ইতিমধ্যে সাবেক সুলতান তারিক আল-ফাদলি যিনি তখন সানরা নির্বাসিত ছিলেন, তার সাথে বিন লাদেনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ঘনিষ্টতার কারণেই বিন লাদেন নব্বইয়ের দশকে তারিক আল ফাদলি ও অন্যান্য ইয়েমেনী মুজাহিদ কমান্ডারের সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিলেন। 

ওদিকে দক্ষিণ ইয়েমেনে বিশেষ অভিযানে ওসামার ভূমিকায় খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন সৌদি নেতৃবৃন্দ। তারা তাকে আকর্ষণীয় কনট্রাক্ট দিয়ে খুশি করতে চাইলেন। আশির দশকের প্রথমদিকে মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কাজটা ওসামার বাবা মোহাম্মদ বিন লাদেনের কোম্পানিরই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওসামাকে সম্মানিত করার জন্য বাদশাহ ফাহাদ মদিনার মসজিদ সম্প্রসারণের কনট্রাকটি নিজের হাতে তাকে দেন। ওসামাকে জানানো হয় যে, শুধু এই কনট্রাক্ট থেকেই তার নিট ৯ কোটি ডলার মুনাফা হবে। শোনা যায় যে, বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গে সেই সাক্ষাতকারে ওসামা কনট্রাক্টের অফার সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার পরিবর্তে আফগান জিহাদে আরও ব্যাপক পরিসরে সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার জন্য বাদশাহর প্রতি আহ্বান জানান। বাদশাহ ফাহাদ, যুবরাজ আব্দুল্লাহ ও শাহজাদা তুর্কী সৌদি আরবের জন্য আফগান পরিস্থিতির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব সম্পর্কে আগে থেকেই নিঃসন্দেহ ছিলেন। বিন লাদেনের আহ্বান তাদের মনে যে বেশ দাগ কেটেছিল তাতে সন্দেহ নেই। কনট্রাক্টটি প্রত্যাখ্যান করায় ওসামার তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। কারণ শেষ পর্যন্ত ওটা তার বাবাই পেয়েছিলেন। ওসামা পরে আফগানিস্তানে তার বিশ্বস্তজনদের বলেছেন, জিহাদের পিছনে তিনি যত অর্থ ব্যয় করেছেন তার সাথে তার ব্যবসাও প্রসারিত হয়েছে, সম্পদও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

আফগানদের সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের প্রভাব মুসলিম বিশ্বের ওপর সত্যিকার অর্থে পড়তে শুরু করে আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ। মূলত এটা প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা এবং ওসামা বিন লাদেনের কর্মতৎপরতার ফলেই সম্ভব হয়। তার আগ পর্যন্ত আরব ইসলামপন্থীরা নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় আফগানিস্তানের ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিল। ১৯৮৫ সালে শত শত আরব আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করে। এদের বেশির ভাগই ছিল জিহাদ পন্থী মুসলিম। আশির দশকের প্রথমদিকে আফগানিস্তনে আরবদের সংখ্যা যেখানে ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার সেখানে আশির দশকের মাঝামাঝি ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার আরব শুধু হিজবে ইসলামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। আরব ইসলামী সংগঠনগুলো জিহাদের ওপর অধ্যয়ন ও চর্চার জন্য তাদের কতিপয় কমান্ডারকে আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলো। সেখানকার মুজাহিদ শিবিরগুলোতে তারা যে ধরনের উন্নত ইসলামী শিক্ষা লাভ করেছিল সে ধরনের শিক্ষা অনেক আরব রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রদ্রোহাত্মক বলে নিষিদ্ধ।

আশির দশকের মাঝামাঝি আফগানিস্তান সারা বিশ্বের ইসলামী জিহাদীদের চুম্বুকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে। মিসরীয় ও অন্যান্য আরব ইসালামী গ্রুপ অবশ্য তার আগে থেকে পেশোয়ারকে তাদের প্রবাসী সদর দফতর হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এখন ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার ফলে তারা একটা আন্তর্জাতিক জিহাদ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বদেশে তৎপরতা চালানোর পশ্চাৎবর্তী ঘাঁটি হিসাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে ব্যবহার করতে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আফগানিস্তানে প্রথম জিহাদ আন্দোলন ব্যুরো খুলেছিলেন ডা. আইমান আল-জাওয়াহিরি। ১৯৮৪ সালে মিসরের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের লে. কর্নেল আবুদ আল-জুমুরের গুপ্ত সংগঠন ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের জন্য এই ব্যুরো খোলা হয়। জুমুর এ জিহাদ আন্দোলনের সামরিক কমান্ডার ছিলেন। সাদাত হত্যাকা-ের প্রক্কালে তিনি ধরা পড়েন।আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক মুজাহিদদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করলে জাওয়াহিরি মিসর থেকে পালিয়ে যান। জাওয়াহিরি বর্তমানে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী এবং তাঁর সংগঠনের একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার। আফগানিস্তানে বিদেশী সেচ্ছসেবকদের প্রথম জেনারেশনের সদস্যদের নিয়েই আজ সেখনকার ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের হাই কমান্ড গঠিত। এই সদস্যদের সবাই বিন লদেনের দারুণ অনুগত।    

বিন লাদেনের আফগান মিশন শেষ।

আশির দশকের মাঝামাঝি আফগানদের সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তার আগেই ওসামা বিন লাদেন একজন সাহসী ও কুশলী কমান্ডার হিসাবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৬ সালে তিনি আরব মুজাহিদ ইউনিটের সেনাধ্যক্ষ হিসাবে জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৮৭ সালে তিনি পাকতিয়া প্রদেশের শাবানে সোভিয়েত-আফগান যৌথ অবস্থানের ওপর আঘাত হানেন। তাঁর নেতৃত্বে আরব ও আফগান মুজাহিদদের সম্মিলিত বাহিনী শত্রুব্যূহ ভেদ করে। প্রচ- হাতাহাতি যুদ্ধের পর মুজাহিদ বাহিনী শেষ পর্যন্ত হটে যেতে বাধ্য হয়। বিন লাদেনের হাতে আজও যে কালাসনিকভ রাইফেলটি দেখা যায়, সেটা তিনি এই যুদ্ধে এক রুশ জেনারেলের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। পাকতিয়া যুদ্ধে পরাজয় সত্ত্বেও বিন লাদেনের মনোবল এতটুকু ক্ষুণ হয়নি। বরং তিনি আরও দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আরব ও আফগান মুজাহিদদের কাছে তিনি হয়ে দাঁড়ান এক ব্যতিক্রম চরিত্রের বীর, যিনি সৌদি আরবের প্রাসাদ জীবন ছেড়ে চলে এসেছেন বন্ধুর আফগানিস্তানে। আফগান জীবনে একীভূত হয়ে গেছেন। তাদের একজন হয়ে লড়েছেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিন লাদেন তার ভাবপুরুষ শেখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আয্যমের সঙ্গে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারকাজে গেছেন। প্রচারকাজ চালাতে গিয়ে শেখ আয্যাম আফগান মুজাহিদদের উদ্দেশে যা বলেছেন সেগুলোই আজ বিন লাদেনের বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাকের মর্মবাণী হিসাবে কাজ করছে। তার জিহাদের লক্ষ্য একটা একীভূত প্যান ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা, যা শেষ পর্যন্ত গোটা মুসলিম বিশ্ব শাসন করবে। আর যতক্ষণ সেই খিলাফত বা আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁর এই জিহাদ চালিয়ে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর। 

আশির দশকের গোটা অধ্যায় জুড়ে ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবের শসকগোষ্ঠী বিশেষ করে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে ছিলেন। ঐ সংস্থার প্রধান শাহজাদা তুর্কী আল-ফয়সালের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। বাবার মতো ওসামা বিন লাদেনও বিভিন্ন কার্যক্রমে সৌদি আরবের বিভিন্ন মহলে অর্থ সাহায্য গোপনে পৌঁছে দেয়ার একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছিলেন। এসব কার্যক্রমের একটা ছিল আফগান মুজাহিদদের সাহায্য দান। আল সৌদ রাজপরিবার এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন যেসব ইসলামী সংগঠন আফগানিস্তানে তৎপর ছিল তাদের এই জাতীয় অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেয়া রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল। তথাপি এ কাজটা বিন লাদেনের হাত দিয়ে ঘটত। সুসম্পর্কের কারণেই বিন লাদেনকে এজন্য সৌদি রাজপরিবার বা অন্যদের বিরাগভাজন হতে হয়নি। শেখ আয্যাম ও বিন লাদেন মিলে পেশোয়ারে বাইতুল আনসার নামে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিলেন গোটা আশির দশক জুড়ে তা চালু ছিল।

 এ সময় আফগান যুদ্ধে লড়বার জন্য যেসব আরব স্বেচ্ছাসেবক এসেছিল তাদের ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এ সব সংগঠন থেকে তারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে বাইতুল আনসার একেকটি দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের একেকটি গ্রুপে সংগঠিত করে, যাতে করে তারা নিজ নিজ দেশে গিয়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ করে। যেমন তাজিক নেতা আহমাদ শাহ মাসুদের কমান্ডে থেকে লড়াই করেছিল প্রায় তিন হাজার আলজেরীয় স্বেচ্ছাসেবক। এদেরই একটা বড় অংশ নিয়ে পরবর্তীকালে গঠিত হয় ‘আলজেরীয় লিজিয়ন’। ৯০ এর দশকের প্রথম দিকে এই আলজেরীয় লিজিয়নের সদস্যরা স্বদেশ আলজেরিয়ায় গিয়ে অতিমাত্রায় আক্রমানত্মক ও রক্তক্ষয়ী কর্মকা-ে অংশ নিয়েছিল। এখানে আরেকটি তথ্যও জেনে রাখা ভালো যে, আহমাদ শাহ মাসুদের সাথে আলজেরীয় জিহাদী কমান্ডার হাজ বুনুয়ার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

যাই হোক রুশবিরোধী আফগান যুদ্ধের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেন ও তার অনুসারীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এভাবে এক সময় এলো ১৯৮৯ সাল। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হলো আফগানিস্তান থেকে। কাবুলে থেকে গেল সোভিয়েত সামরিক সাহায্যপুষ্ট নজিবুল্লাহ সরকার। এই সরকারের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নিল আফগান মুজাহিদ ও তাদের সাহায্যকারী বিশেষ জিহাদীরা। এখানে একটা কূট চাল চালাল পাকিস্তানের আইএসআই। রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের এক মাস পর ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে মুজাহিদ বাহিনী এক বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালাল জালালাবাদে। ঐ অভিযান আফগান সঙ্কটের নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেয়। কাবুল সরকারের মূল সামরিক শক্তি ছিল জালালাবাদে। পাকিস্তান বোঝাল জালালাবাদ দখল করতে পারলে কাবুল সারকার পাকা ফলের মতো টুপ করে ঝরে পড়বে। মুজাহিদরা সে কথায় বিশ্বাস করল। চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য বিপুল সাহায্য দিল যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। মুজাহিদদের মতো অতি নিয়মিত বাহিনীর এ ধরনের আক্রমণাভিযানের জন্য যেরূপ রণনীতি ও রণকৌশল নেয়া উচিত তা নিতে না দিয়ে আইএসআই তাদের জালালাবাদের সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা ঘাঁটিসমূহ ও বিশাল আর্টিলারি বাহিনীর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর জন্য উসকে দিল। ইসলামাবাদ জানত সে ধরনের সম্মুখ আক্রমণে কচুকাটা হবে আক্রমণকারীরা। আইএসআই ঠিক এমনটাই চাইছিল। কারণ পাকিস্তানের কাছে ট্রেনিং ও অন্যান্য সাহায্য পেলেও মুজাহিদরা তখন ইসলামাবাদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এরা কাবুলের ক্ষমতায় গিয়ে বসলে ব্যাপারটা পাকিস্তানের মোটেই সুখকর হতো না। সে জন্য তাদের শক্তিক্ষয় করতে চাইছিল পাকিস্তান। জালালাবাদে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ আক্রমণ চালাতে গিয়ে মুজাহিদ বাহিনী এমন কচুকাটা হয় যে তারা আর শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে টিকে থাকতে পারেনি। 

ওসামা বিন লাদেন ও তার বহু অনুসারী জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এবং মুজাহিদ বাহিনীর ব্যাপক ও অর্থহীন নিধন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আয্যাম, বিন লাদেন ও অন্যান্য মুজাহিদ নেতারা পরে এই বিপর্যয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানেন যে, তারা আসলে মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এবং সেই ষড়যন্ত্র পাকিস্তানের হাত দিয়ে বাস্তবায়িত করা হয়েছে। ঐ বছরের ২৪ নভেম্বর পেশোয়ারে শেখ আয্যামের গাড়িতে রাখা এক অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল বোমা ফাটিয়ে দুই ছেলেসহ আয্যামকে হত্যা করা হয়। হত্যার দায়দায়িত্ব আজ পর্যন্ত কেউ স্বীকার করেনি। তবে এর পিছনে আইএসআই-এর হাত আছে বলে ধারণা করা হয়। এর অল্পদিন পরই বিন লাদেন তাঁর আফগানিস্তান মিশন শেষ হয়েছে মনে করে সৌদি আরব ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

চলমান...


মন্তব্যসমূহ

Ad Code

Responsive Advertisement