বিন লাদেন ও আইএসআই
বিন লাদেনের উত্থান ও তাঁর কর্মকান্ডের পিছনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এরও সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে সোভিয়েতবিরোধী আফগান যুদ্ধে বিন লাদেন যে ভূমিকা পালন করেছিলেন আইএসআইয়ের সহযোগিতা ছাড়া সে ধরনের ভূমিকা পালন সম্ভব ছিল না। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে বিন লাদেন প্রথমে এসে উপস্থিত হন পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখানে বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি সংগঠিত করেন এবং ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন। পেশোয়ারের এসব প্রশিক্ষণ ঘাঁটির সবই ছিল আইএসআইয়ের নজরদারির মধ্যে। তারা এসব প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে দরকার মতো উপকরণ দিয়ে সাহায্য করত। বিন লাদেনের ঘাঁটিও যে তা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না এ কথা বলাই বাহুল্য। আফগান সঙ্কট সৃষ্টি হবার পর থেকেই পাকিস্তান এই সঙ্কটকে তার ভূ-রাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার হয়েছে আইএসআই। অচিরে আইএসআই আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদেরও বাহনে পরিণত হয়। ভারতের বিরুদ্ধে শিখ সন্ত্রাসবাদ ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল আইএসআই এর। সে অভিজ্ঞতা এবার তারা প্রয়োগ করল আফগানিস্তানে।
আফগান ‘জিহাদকে জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিল পাকিস্তানকে আর সেই সাহায্য আফগানদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম হলো আইএসআই। আইএসআই এক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের শতকরা ৭০ ভাগ বণ্টন করল আফগান ইসলামী দলগুলোকে। বিশেষ করে গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের হিজব-ই-ইসলামীকে। মার্কিন অর্থপুষ্ট প্রশিক্ষণ অবকাঠামোও প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল আইএসআই। তার ফলে আফগান মুজাহিদরা ছাড়াও পাকিস্তানের নিজস্ব স্বার্থে আরব জিহাদীদের থেকে শুরু করে আঞ্চলিক গ্রুপগুলোও প্রশিক্ষণ সুবিধা পেল। আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার আরব মুজাহিদকে শুধু হিজব-ই-ইসলামীর সাথেই ট্রেনিং দেয়া হয়। তখন থেকে আইএসআই প্রতিমাসে গড়ে এক শ’ আরব মুজাহিদকে ট্রেনিং দিতে থাকে। এরা পেশোয়ারে সামরিক শিক্ষা লাভ করে আফগানিস্তানে যায়। এবং আফগানিস্তান থেকে ফিরে এসে সুদান ও ইয়েমেনে উচ্চতর পর্যায়ে ট্রেনিং নেয়। আরব ছাড়াও ভারতীয় কাশ্মীরের হাজার হাজার ইসলামী যোদ্ধা এবং কিছু সংখ্যক জঙ্গী শিখকেও ট্রেনিং দেয়া হয়।
১৯৮৬ সালে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) ও তার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ র্যডিকেল তরুণদেরকে পাকিস্তানে আফগান মুজাহিদ শিবিরগুলোতে উচ্চতর ট্রেনিং গ্রহণের জন্য পাঠাতে শুরু করে। পরে এদের দেখাদেখি মিসরের ‘আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’ এবং সিরিয়া ও লেবাননের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনের সদস্যরাও পাকিস্তানের ওসব শিবিরে ট্রেনিং নিতে যায়। জেনে রাখা ভালো যে, আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’র সদস্যরাও সাদাত হত্যায় অংশ নিয়েছিল। ইয়াসির আরাফাতের তৎকালীন সামরিক প্রধান খলিল আল ওয়াজির ওরফে আবু জিহাদ জর্দানের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও তার সদস্যদেরকে আফগানিস্তানের লড়াইয়ে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, আইএসআই আয়োজিত প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে আরব মুজাহিদদের বিশেষ করে মিসরীয়, জর্দানী ও ফিলিস্তিনীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও তাদের সবাইকে যে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল তা নয়। প্রশিক্ষণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এদের অনেকে ‘উধাও’ হয়ে যেত। পরবর্তীকালে এদের নিয়েই গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের এলিট বাহিনী। এসব বিদেশী স্বেচ্ছাসেবককে কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য স্যাম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার, অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থায় বোমা বিস্ফোরণ, উন্নত ধরনের প্লাস্টিক বিস্ফোরক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর পাশাপাশি দেয়া হয় ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারায় ব্যাপক দীক্ষাদান, যার ফলে তারা একেকজন গোঁড়া ও জানবাজ লড়াকুতে পরিণত হয়। এইভাবে আফাগানিস্তান ও পাকিস্তান প্রশিক্ষণ লাভ ও জিহাদে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামী জিহাদের এক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। গোটা আশির দশক জুড়ে মূলত আফগান যুদ্ধের কারণে অস্ত্রশস্ত্রের ঢালাও সরবারাহের ফলে করাচী আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়।
এই জিহাদের সাথে শুধু ফিলিস্তিনীরাই নয়, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, বার্মা, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স এবং আফ্রিকার অনেক দেশের নাগরিকও যুক্ত হয়ে পড়ে বলে ডা. ইয়াসিন রিজভী নামে এক শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানী সাংবাদিক উল্লেখ করেন। এরা বিভিন্ন দেশে অন্তর্ঘাত ও জিহাদী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল যোগায়। আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণ কাঠামোয় যৌথ প্রশিক্ষণ লাভ এবং অনেক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশের ইসলামী জিহাদীদের ও তাদের সংগঠনগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে ওঠে। তাই দেখা যায় যে আশির দশকের শেষদিকে পাকিস্তানী পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত দুই কাশ্মীরী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন এবং ইখওয়ান আল মুসলিমীন তাদের ভারতবিরোধী লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। তেমনি সাহায্য পেয়েছে বসনিয়ার মুসলমানরা। কসোভোর আলবেনীয়রা এবং ফিলিপিন্স ও মালয়শিয়ার জিহাদীরা। বিন লাদেনের আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের পিছনে আইএসআই কতটা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা অন্যত্র আলোচনায় বিশদভাবে দেখা যাবে।
আফগান ‘জিহাদকে জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিল পাকিস্তানকে আর সেই সাহায্য আফগানদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম হলো আইএসআই। আইএসআই এক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের শতকরা ৭০ ভাগ বণ্টন করল আফগান ইসলামী দলগুলোকে। বিশেষ করে গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের হিজব-ই-ইসলামীকে। মার্কিন অর্থপুষ্ট প্রশিক্ষণ অবকাঠামোও প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল আইএসআই। তার ফলে আফগান মুজাহিদরা ছাড়াও পাকিস্তানের নিজস্ব স্বার্থে আরব জিহাদীদের থেকে শুরু করে আঞ্চলিক গ্রুপগুলোও প্রশিক্ষণ সুবিধা পেল। আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার আরব মুজাহিদকে শুধু হিজব-ই-ইসলামীর সাথেই ট্রেনিং দেয়া হয়। তখন থেকে আইএসআই প্রতিমাসে গড়ে এক শ’ আরব মুজাহিদকে ট্রেনিং দিতে থাকে। এরা পেশোয়ারে সামরিক শিক্ষা লাভ করে আফগানিস্তানে যায়। এবং আফগানিস্তান থেকে ফিরে এসে সুদান ও ইয়েমেনে উচ্চতর পর্যায়ে ট্রেনিং নেয়। আরব ছাড়াও ভারতীয় কাশ্মীরের হাজার হাজার ইসলামী যোদ্ধা এবং কিছু সংখ্যক জঙ্গী শিখকেও ট্রেনিং দেয়া হয়।
১৯৮৬ সালে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) ও তার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ র্যডিকেল তরুণদেরকে পাকিস্তানে আফগান মুজাহিদ শিবিরগুলোতে উচ্চতর ট্রেনিং গ্রহণের জন্য পাঠাতে শুরু করে। পরে এদের দেখাদেখি মিসরের ‘আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’ এবং সিরিয়া ও লেবাননের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনের সদস্যরাও পাকিস্তানের ওসব শিবিরে ট্রেনিং নিতে যায়। জেনে রাখা ভালো যে, আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’র সদস্যরাও সাদাত হত্যায় অংশ নিয়েছিল। ইয়াসির আরাফাতের তৎকালীন সামরিক প্রধান খলিল আল ওয়াজির ওরফে আবু জিহাদ জর্দানের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও তার সদস্যদেরকে আফগানিস্তানের লড়াইয়ে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, আইএসআই আয়োজিত প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে আরব মুজাহিদদের বিশেষ করে মিসরীয়, জর্দানী ও ফিলিস্তিনীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও তাদের সবাইকে যে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল তা নয়। প্রশিক্ষণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এদের অনেকে ‘উধাও’ হয়ে যেত। পরবর্তীকালে এদের নিয়েই গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের এলিট বাহিনী। এসব বিদেশী স্বেচ্ছাসেবককে কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য স্যাম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার, অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থায় বোমা বিস্ফোরণ, উন্নত ধরনের প্লাস্টিক বিস্ফোরক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর পাশাপাশি দেয়া হয় ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারায় ব্যাপক দীক্ষাদান, যার ফলে তারা একেকজন গোঁড়া ও জানবাজ লড়াকুতে পরিণত হয়। এইভাবে আফাগানিস্তান ও পাকিস্তান প্রশিক্ষণ লাভ ও জিহাদে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামী জিহাদের এক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। গোটা আশির দশক জুড়ে মূলত আফগান যুদ্ধের কারণে অস্ত্রশস্ত্রের ঢালাও সরবারাহের ফলে করাচী আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়।
এই জিহাদের সাথে শুধু ফিলিস্তিনীরাই নয়, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, বার্মা, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স এবং আফ্রিকার অনেক দেশের নাগরিকও যুক্ত হয়ে পড়ে বলে ডা. ইয়াসিন রিজভী নামে এক শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানী সাংবাদিক উল্লেখ করেন। এরা বিভিন্ন দেশে অন্তর্ঘাত ও জিহাদী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল যোগায়। আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণ কাঠামোয় যৌথ প্রশিক্ষণ লাভ এবং অনেক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশের ইসলামী জিহাদীদের ও তাদের সংগঠনগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে ওঠে। তাই দেখা যায় যে আশির দশকের শেষদিকে পাকিস্তানী পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত দুই কাশ্মীরী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন এবং ইখওয়ান আল মুসলিমীন তাদের ভারতবিরোধী লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। তেমনি সাহায্য পেয়েছে বসনিয়ার মুসলমানরা। কসোভোর আলবেনীয়রা এবং ফিলিপিন্স ও মালয়শিয়ার জিহাদীরা। বিন লাদেনের আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের পিছনে আইএসআই কতটা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা অন্যত্র আলোচনায় বিশদভাবে দেখা যাবে।
সৌদি আরবে বিন লাদেন, নয়া সঙ্কট
আফগান মিশন শেষ করে ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবে ফিরে গেলেন ওসামা বিন লাদেন। ততদিনে তিনি অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়েছেন আরও বেশি র্যডিকেল। স্বদেশে অনেকে তাঁকে বীরের মর্যাদা দিল। অনেকে তাকে নেতা মানল। প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে তিনি একজন ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে গেলেন। অসংখ্য মসজিদে ও ঘরোয়া সমাবেশে বক্তৃতা দিলেন। এসব বক্তৃতায় জ্বালা ছিল, আগুন ছিল। অনেক বক্তৃতা রেকর্ড হলো। এগুলোর আড়াই লাখ ক্যাসেট প্রকাশ্যে বিক্রি হলো। অনেক বক্তৃতায় এমন বিষয় ছিল যে সেগুলোর ক্যাসেট বিক্রি হতে লাগল গোপনে। সৌদি রাজপরিবার তখনও বিন লাদেনের র্যাডিক্যাল চিন্তাধারাকে নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী বা বিপজ্জনক ভাবেনি।
তাই বিন লাদেন তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াননি। এইভাবে কিছুদিন চলার পর ওসামা বিন লাদেন গুছিয়ে বসার চেষ্টা করলেন। পরিবারের যে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছিল তাঁর জেদ্দা শাখার কাজকর্ম দেখাশোনা করতে লাগলেন। নিজের পরিবার নিয়ে উঠলেন সাদাসিধা এক এ্যাপার্টমেন্টে। নিজের প্রচারিত ইসলামী জীবনধারা বাস্তবে অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। এইভাবে ১৯৮৯ সাল পেরিয়ে ১৯৯০ সালের অর্ধেকটা সময় চলে গেল। তারপর এলো ১৯৯০ এর ২ আগস্ট। ইরাক কুয়েতে হামলা চালিয়ে দখল করে নিল। সৌদি আরবে দেখা দিল আতঙ্ক। কুয়েতের আমির ও তাঁর পরিবারের নেতৃত্বে কুয়েতী উদ্ধাস্তুর ঢল নামল সে দেশে।
সাদ্দাম হোসেন সৌদি আরবও আক্রমণ করতে পারেন এমন হিস্টিরিয়া পেয়ে বসল রিয়াদকে। এই নতুন সঙ্কটের মুখে ওসামা বিন লাদেন জেদ্দা থেকে তক্ষুণি রিয়াদে চলে গেলেন। তার দিক থেকে সাহায্যের প্রস্তাব দিলেন সরকারকে। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী শাহজাদা সুলতানের সঙ্গে দেখা করলেন। সৌদি আরবের আত্মরক্ষার জন্য ১০ পৃষ্ঠার এক পরিকল্পনা পেশ করলেন তাঁর কাছে। তা ছাড়া বললেন যে, তাঁর পারিবারিক কোম্পানির মতো বিশাল নির্মাণ কোম্পানির হাতে যেসব ভারি প্রকৌশল সরঞ্জাম আছে, সেগুলো দিয়ে সৌদি আরবকে রক্ষার জন্য অতিদ্রুত বেশিকিছু সুরক্ষিত ব্যূহ গড়ে তোলা যাবে। তাছাড়া আফগান যুদ্ধে লড়াইয়ে পোড়খাওয়া যে বিপুলসংখ্যক সৌদি মুজাহিদ আছে তাদের রিক্রুট করে সৌদি বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করা যেতে পারে। দরকার হলে এই লোক সংগ্রহের কাজটা তিনিও করতে পারেন বলে জানালেন। সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান শাহজাদা তুর্কির কাছেও একই প্রস্তাব দিলেন তিনি। তার সঙ্গে বাড়তি একটা কথা বললেন এই যে, আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ এই সৌদিদের কুয়েতে জেহাদ পরিচালনার মূল শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। উপসাগরের তেল ক্ষেত্রগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী তখন সৌদি আরবের ওপর ভর করে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে ব্যাপারে বিশেষ সজাগ থেকে বিন লাদেন সৌদি নেতাদের বার বার হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, এসব ‘বিধর্মী’ বাহিনীকে যেন সৌদি আরবের পবিত্র ভূমিতে আমন্ত্রণ না জানানো হয় কিংবা আসতে না দেয়া হয়। কেননা, তা হলে বেশির ভাগ সৌদির এবং সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি মারাত্মক আহত হবে। এই উদ্বেগ প্রকাশ করার সময়ও ওসামা বিন লাদেন সৌদি রাজপরিবারের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু তিনি হতাশ হয়ে দেখলেন যে তার কথা কেই গ্রাহ্য করল না। সাদ্দাম বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কিত বাদশাহ ফাহাদ ও তার কোটারি ১৯৯১ সালের জানুয়ারী মাসে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর জন্য দরজা খুলে দিলেন। এই বাহিনী উপসাগর যুদ্ধে ইরাককে হারানোর পরও তখন থেকে মার্কিন সৈন্য রয়ে গেল সৌদি আরবে। বিন লাদেন আগে থেকে জানতেন মুসলমানদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র। বিশেষ করে ইসলামী জিহাদীরা পবিত্র ভূমিতে বিধর্মীদের উপস্থিতির দ্বারা ইসলামের অবমাননা সহ্য করবে না। এজন্য তারা দেখে নিতে পারে সৌদি নেতাদের ।
অবশ্য সৌদি এলিটশ্রেণীর মধ্যে একমাত্র ওসামা বিন লাদেনই যে মার্কিন বাহিনীর আগমনের বিরোধিতা করেছিলেন, তা নয়। আরও অনেকেই করেছিল। সেই ১৯৯০ এর আগস্ট মাসেই বাদশাহ ফাহাদ স্বদেশে মার্কিন বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে ওলামা সমাজের অনুমোদন চেয়েছিলেন। কিন্তু ওলামাদের সবাই ছিল এর ঘোরতর বিরুদ্ধে। বাদশাহর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরই কেবল গ্রান্ড মুফতী শেখ আব্দুল আজিজ বিন বাজ অনিচ্ছার সঙ্গে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন অনুমোদন করেছিলেন। তবে শর্ত ছিল যে, ইরাকী হুমকির অকাট্য প্রমাণ দেখাতে হবে। ওদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিক চেনি প্রয়োজনের এক মিনিট বেশি মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে থাকবে না বলে আশ্বাস দেয়ার পর বাদশাহ ফাহাদ মক্কায় এক বৈঠকে সাড়ে তিনশ’ ওলামার কাছ থেকে এই ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি আদায় করে নেন। সম্মতিটা তারা অবশ্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিয়েছিলেন। মার্কিন সৈন্য মোতায়েন প্রশ্নে রাজপরিবারের সঙ্গে ওলামাদের বিরোধের এই খবরটি সৌদি আরবের সকল মহলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে শুধু সৌদি আরবে নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের র্যডিকেল ও জিহাদপন্থী মুসলমানদের মধ্যে মার্কিন বিরোধিতার প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়।
সৌদি নেতারা ওসামা বিন লাদেনের কথায় কর্ণপাত না করায় তার মনে নিদারুণ যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মার্কিনবিরোধী এই জোয়ার দেখে তার সব যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। নতুন বলে বলীয়ান হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু তখনও তিনি মধ্যপন্থা অনুসরণ করেছিলেন এক দিকে তিনি কুয়েত হামলার জন্য ইরাকের নিন্দা করছিলেন এবং ইরাকী বাহিনীকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন, অন্যদিকে একই সঙ্গে তিনি মার্কিন নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনীর উপস্থিতিকে ইসলামের ঘোরতর অপবিত্রকরণ আখ্যা দিচ্ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি মার্কিন পণ্য বর্জনেরও ডাক দেন।
কিন্তু আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে তিনি তখনও পর্যন্ত মুখ খোলেননি। সামান্যতম সমালোচনাও করেননি। সৌদি রাজপরিবারকে চ্যালেঞ্জ না করে বিন লাদেন তখন বিপুলসংখ্যক জিহাদপন্থী মুসলিমদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। আফগানিস্তানের শেখ তামিমীসহ বেশিরভাগ মুজাহিদ নেতা তখন সাদ্দাম হোসেনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই সমর্থনের পিছনে তাদের যুক্তি ছিল এই যে কুয়েতকে রক্ষা করার চাইতে ইসলামের ঘোর দুশমন যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলা করার গুরুত্ব অনেক বেশি। তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে এবং আরবের পবিত্র ভূমিতে বিদেশী বাহিনী ডেকে এনে আল-সৌদ রাজপরিবার মুসলমানদের তীর্থস্থানসমূহের হেফাজতকারী হিসাবে তাদের এতদিনের বৈধ অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। আফগানিস্তানের দিনগুলো থেকে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মীদের আনেকেই এই বক্তব্যের সোচ্চার প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু বিন লাদেন ছিলেন সৌদি বাদশাহর অনুগত প্রজা। তখনও তার বিশ্বাস ছিল যে সৌদি রাজপরিবারের উপরমহল যাদের অনেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা আছে, মার্কিন ও বিদেশী সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাদশাহকে প্রভাবিত করতে পারবে। তখনও পর্যন্ত তার আশা ছিল যে, রিয়াদ আমেরিকার বিপুল চাপ কাটিয়ে উঠতে পারবে। তাই বিদেশী সৈন্য আসতে দেয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও বিন লাদেন তার অনুগত্য রেখেছিলেন বাদশাহর প্রতি।
সৌদি রাজশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সুদানের পথে বিন লাদেন
সৌদি আরবে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন প্রশ্নে কোন মহলের সমালোচনা বারদাশত করতে প্রস্তুত ছিল না সৌদি সরকার। তাই এ প্রশ্নে প্রথম দিকে বিন লাদেনের সমালোচনা আর অন্যান্য র্যাডিক্যাল ইসলামীদের সমালোচনার মধ্যেও যে একটা অবস্থানগত পার্থক্য ছিল, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার কোন প্রয়োজনই সরকারের মনে হয়নি। সৌদি আরবে বিন লাদেনের জনপ্রিয়তা তখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছিল। এই জনপ্রিয়তা এক পর্যায়ে সৌদি সরকারের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার ওপর বিন লাদেন এখন সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করায় তাকে আল-সৌদ রাজপরিবারের শাসনের প্রতি হুমকি হিসাবে গণ্য করা হতে লাগল। সমালোচনা বন্ধ করতে ওসামা বিন লাদেনের ওপর নানাভাবে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করল সৌদি সরকার। প্রথম প্রথম এই বলে হুশিয়ার করে দেয়া হলো যে, তাকে যেসব লোভনীয় কনট্র্যাক্ট দেয়া হয়েছে, সমালোচনা বন্ধ না করলে সেগুলো বাতিল করা হবে।
যখন দেখা গেল ওতে কোন কাজ হচ্ছে না তখন নতুন হুমকি এল, তার সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হবে। তাতেও যখন কাজ হলো না তখন বাবা, ভাই, শ্বশুরকুল ও অন্য আত্মীয়স্বজনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলো লাদেনের মুখ বন্ধ করার জন্য। সৌদি কর্মকর্তারা হুমকি দিলেন, কথা না শুনলে রাজপরিবারের সাথে লাদেন পরিবারের যে বিশেষ সম্পর্ক আছে তা ছিন্ন হয়ে যাবে এবং গোটা পরিবারের ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে পড়বে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, একই সময় সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক, তিনি যেন সৌদি রাজতন্ত্রবিরোধী অন্তর্ঘাতী শক্তির সাথে যোগ না দেন তা নিশ্চিত করা এবং দুই. আফগান যুদ্ধে অভিজ্ঞ সৌদি স্বেচ্ছাসেবকদের যে বিশাল নেটওয়ার্ক সৌদি আরবে আছে, তারা যেন সরকারবিরোধী ভূমিকা না নেয় সে চেষ্টা করা। রিয়াদ ভালোমতোই জানত বিন লাদেন সৌদি রাজতন্ত্রবিরোধী ইসলামী জিহাদ আন্দোলনে যোগ দিলে তার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণেই সে আন্দোলন তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্তরে প্রচন্ড বেগবান হয়ে উঠবে।
যাই হোক, উপসাগর যুদ্ধে একদিন শেষ হলো। স্বদেশের ওলামাদের দেয়া শর্তের কথা ভুলে গিয়ে সৌদি সরকার বিদেশী সৈন্য স্থায়ীভাবে মোতায়েনের সুযোগ দিলেন। ওসামা বিন লাদেন এবার আর সৌদি বাদাশাহর অনুগত প্রজা হিসাবে থাকতে পারলেন না। তিনি আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, রিয়াদকে দুটো পথের যে কোন একটা বেছে নিতে হবে, হয় স্বল্পমেয়াদী নিরাপত্তা নয়ত ইসলামের পবিত্র ভূমির হেফাজতকারী হিসাবে ন্যায়সঙ্গত বৈধতা। দেখে গেল, রিয়াদ প্রথমটিকেই বেছে নিয়েছে। কাজেই এবার সৌদি সরকারের সরাসরি বিরোধিতা করা ছাড়া আর কোন পথ রইল না বিন লাদেনের সামনে। রিয়াদও বুঝল যে, বিল লাদেনসহ ইসলামী জিহাদীরা এবার একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের সাথে সমঝোতার আর উপায় নেই। বিন লাদেন আর সৌদি সরকারের মধ্যে এখন সরাসরি বৈরিতা দেখা দিল। সে বৈরিতা এত বৃদ্ধি পেল যে, বিন লাদেন নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে লাগলেন। নিজের জন্য বটেই, এমনকি তাদের বৃহত্তর পরিবারটি জন্যও, যে পরিবারে আছেন তার ভাই ও অন্যরা।
নিরাপত্তাহীনতার কারণে ওসামা বিন লাদেন তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পাড়ি জমালেন ইসলামী জিহাদের নতুন স্বর্গ হাসান আল তুরাবির সুদানে। বিন লাদেন যখন সুদানে পৌঁছলেন তার আগেই সে দেশটির আধ্যাত্মিক নেতার আসন অলঙ্কৃত করে বসেছেন হাসান আব্দুল্লাহ আল তুরাবি। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুনের সমারিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জেনারেল ওমর আল বাশির ক্ষমতায় আসার পর তুরাবি ঐ অবস্থানে পৌঁছেন। গোঁড়া মুসলমান বশির সুদানে ইসলামী শাসন কায়েমের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও গণঅসন্তোষের কারণে পারেননি। বশিরের সমর্থপুষ্ট হয়ে তুরাবি এবার সুদান সরকারের প্রধান আদর্শগত তাত্ত্বিক ও পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়ালেন। আধুনিক যুগের অন্যতম খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ হাসান আব্দুল্লাহ আল তুরাবি সম্পর্কে এখানে দু’টি কথা না বললেই নয়। কারণ বিন লাদেনের বিশ্ব জিহাদ আন্দোলনের সাথে তুরাবির নিবিড় যোগসূত্র আছে।তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে। তা হলো ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিন লাদেন সুদানে ছিলেন এবং এ সময়টা ছিল তার গঠনমূলক অধ্যায়। কাজেই ইসলামী জিহাদের স্বরূপ বুঝতে গেলে তুরাবি সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা দরকার। ১৯৩২ সালে দক্ষিণ সুদানের কাসালায় অত্যন্ত ধার্মিক পরিবারে তুরাবির জন্ম। বাবা ব্যবসায়ী হলেও ইসলামের একজন বিদগ্ধ পন্ডিত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আধুনিকপন্থীও ছিলেন। সুদান ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকার সময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে তুরাবি পরিবারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বাবার ভূমিকা তুরাবির শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তিনি সুদানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছেন আর ইসলামের ওপর শাস্ত্রীয় শিক্ষা লাভ করেছেন বাবার কাছে। চিরায়ত আরবী সংস্কৃতি ও কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ঘটে। ১৯৫৫ সালে তুরাবি খার্তুমের ব্রিটিশ পরিচালিত গার্ডেন কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তবে তার ঢের আগে সেই ১৯৫১ সাল থেকে তিনি ছিলেন মিসরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের খার্তুম শাখার গোপন সদস্য। অচিরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক লিবারেশন মুভমেন্টের প্রধান হয়ে দাড়ান। ওটা ছিল ব্রাদারহুডেরই অঙ্গ সংগঠন।
তুরাবির মন ইসলামের প্রতি নিবিষ্ট হলেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে কখনও উপেক্ষ্য করেননি। এদিক থেকে তিনি সহকর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে আইনশাস্ত্র পড়তে যান। ১৯৫৭ সালে সেখানে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে সরবোন থেকে আইনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তুরাবি ইংরেজী ও ফরাসী ভাষা অনর্গল বলতে পারেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে তার ভাল পরিচয় আছে। যুক্তরাষ্টসহ ইউরোপের প্রচুর দেশ সফর করেছেন এবং এখনও করছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তুরাবি বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপ ও ব্যক্তির কোয়ালিশন ইসলামিক চার্টার ফ্রন্ট গঠন করে তার ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করতে থাকেন।
ইসলামী বুদ্ধিজীবী মহলে তিনি রাজনৈতিক ইসলাম অর্থাৎ ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর একজন শীর্ষস্থানীয় প-িত বা বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁড়ান। তাই সুদানে ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল বশির যখন তুরাবিকে ইসলামী সামরিক একনায়কতন্ত্র পরিচালনায় সাহায্য করার আহ্বান জানালেন তখন তাতে সাড়া দিতে ভুলেননি তুরাবি। সুদানকে সুন্নী ইসলামের পুনরুজ্জীবনের কেন্দ্রে পরিণত করার এমন সুযোগ তিনি হারাতে চাননি। ওসামা বিন লাদেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সুদানে ছিলেন। এ সময়টা সুন্নী ইসলামী আন্দোলনের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি বিন লাদেনের জন্যও ছিল বিশ্ব ইসলামী জিহাদের অন্যতম স্থপতি হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার পর্যায়। ইতোপূর্বে উপসাগর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলামী জিহাদীরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছে যে, সৌদি আরব ও কুয়েতের শাসকদের মতো দুর্নীতিবাজ শাসকরা টিকে থাকতে পারছে-শুধু এই কারণে যে পশ্চিমী দেশগুলো তাদের এই ক্রীড়ানকদের সর্বাত্মকভাবে রক্ষা করতে ওয়াদাবদ্ধ থাকছে। এমনকি এজন্য ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করতে বা যুদ্ধে যেতেও তাদের দ্বিধা নেই। এ অবস্থায় দেশে দেশে ইসলামী সমাজ ও শাসন কায়েম করতে হলে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আগাত হানা ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করে ইসলামী জিহাদীরা। এই ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিলেন তুরাবি। ১৯৯১ সালের হেমন্ত থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামী জিহাদ, আন্দোল ও সংগ্রামের বিস্ফোরণ ঘটে। বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন এ সময় সুন্নী জিহাদী নেটওয়ার্কে একীভূত হয়ে গঠন করে নয়া ইসলামিস্ট ইন্টারন্যাশন্যাল, যা ছিল ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুডের ধর্মীয় কাঠামোর আওতায় কর্মরত বিভিন্ন জিহাদী সংস্থার ছত্রছায়া সংগঠন।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ইসলামিক ইন্টরন্যাশনালের জিহাদী অঙ্গ সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট। সুদানে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অবস্থানকালে ওসামা বিন লাদেন এই নতুন ইসলামিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, বিশেষ করে এর অঙ্গ সংগঠন আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট এর আবির্ভাবের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রেখেছিলেন। সে সময় তিনি আজকের মতো আদর্শগত ও তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে অন্যতম প্রাণপুরুষ না হলেও তখনকার ঘটনাপ্রবাহের প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন- এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট সাধারণ মানুষের কাছে ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন অব ইসলাম’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসলামী জিহাদের যে উত্তাল জোয়ার বইছে, তার অগ্রসারিতে আছে ‘আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট’। এর শীর্ষ পর্যায়ের জিহাদীরা সাধারণভাবে আফগান বলে পরিচিত। এমনটা হওয়ার কারণও আছে। এর অধিকাংশই পাকিস্তানে আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে একত্রে ট্রেনিং নিয়েছিল এবং অনেকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ থেকে ‘ইসলামিস্ট লিজিয়ন’ ইসলামী মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত ও প্রসারিত করার জন্য তার জিহাদী সদস্যদের গোটা এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ছড়িয়ে দেয়।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সুদানে অবস্থানকালে বিন লাদেন আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের একজন সংগঠক হিসাবে ইসলামিক এ্যারাব পিপলস কনফারেন্স, পপুলার ইন্টরন্যাশনাল আর্গানাইজেশন, ইসলামিক মুসলিম ব্রাদারহুড প্রভৃতি সংগঠন ও ফোরামের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সমপৃক্ত হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে হাসান তুরাবির ঘনিষ্ঠ সানিধ্যেও আসেন। ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাদের মধ্যে চিন্তার আদান প্রদান হয়। তুরাবি লাদেনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রভূত অবদান রেখেছিলেন। অচিরেই বিন লাদেন তুরাবির ইনার সার্কেলের একজন সদস্য হয়ে দাঁড়ান।
চলমান...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন