Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

শহীদ ড.আব্দুল্লাহ আযযাম (রাহিঃ) জিবনী

শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী . আসবাহ আল হারতিয়া৷ ফিলিস্তিনের জেনিন
প্রদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম৷ যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পাতায় এ গ্রামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ৷ কারণ এ গ্রাম জন্ম দিয়েছে বহু মহামানবকে, বহু মুজাহিদ আর সমরবিদকে, বহু দার্শনিক আর চিন্তাবিদকে, বহু সাহিত্যিক আর ভাষাবিদকে৷ . ১৯৪১ সাল৷ আসবাহ আল হারতিয়া তখন পরাধীন। ইহুদিদের পদভারে রক্তাক্ত৷ দুরন্ত বায়ুর বুকে সন্তানহারা মায়েদের আহাজারি৷ এতিম শিশুদের আর্তচিৎকার৷ অসহায় বৃদ্ধ আর বৃদ্ধাদের চোখে চোখে অশ্রুর বান৷ কৌমার্যছিন্ন যুবতী আর তরুণীদের চোখে প্রতিশোধের লেলিহান আগুন৷ ঠিক তখন আসবাহ আল হারতিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এক নবজাত সন্তান৷ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম৷ পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত হন ইসলামী আকিদাহ-বিশ্বাসে৷ মহব্বত করতে শিখেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, আল্লাহর পথে জিহাদে রত বীর বাহাদুরদেরকে, সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদেরকে। আখিরাতের চিন্তা-ফিকির আর শাহাদাতের তামান্না শৈশব থেকেই তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠতে থাকে।  .

 আব্দুল্লাহ আযযাম একটু ব্যতিক্রমধর্মী - সদা গভীর, নিষ্ঠাবান, চিন্তায় ডুবে থাকা এক কিশোর৷ নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা তাঁর চরিত্রকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে৷ অল্প বয়সেই তিনি দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। ইসলামি চিন্তা-চেতনাকে মুসলমানদের মাঝে জাগ্রত করতে পেরেশান হয়ে পড়েন৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই তাঁর অসাধারণ গুণাবলি দেখে শিক্ষকরা হতবাক হয়ে যেতেন। তারা ভাবতে থাকেন, আমাদের এ সন্তান কালের ব্যবধানে নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে৷ হয়তো আল্লাহ তা'লা তাঁর দ্বারা ইসলামের সংস্কারের কাজ করাবেন৷ সুনামের সাথেই তিনি লেখাপড়া করতে থাকেন৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া সুনামের সাথেই শেষ করেন৷ ক্লাসে সবার চেয়ে ছোট হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সুদর্শন ও মেধাবি। এরপর তিনি এগ্রিকালচারাল কাদরী কলেজে ভর্তি হন এনং সেখান থেকেই ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। .


তারপর দক্ষিণ জর্দানের আদ্দির নামক গ্রামে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন৷ কিন্তু তাঁর পিপাসার্ত মন তখনো ছিল অস্থির-উতলা। তাই দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়াহ বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৬ সালে শরিয়াহ(ইসলামী আইন) এর ওপর বিএ ডিগ্রি লাভ করেন৷ . ১৯৬৭ সাল। ইহুদিরা পশ্চিম তীর দখল করে নিল৷ রক্তে রঞ্জিত হল পশ্চিম তীর৷ চোখের সামনে দেখলেন, নির্যাতন আর নিপীড়নের ভয়াল চিত্র৷ বুক ফাটা আহাজারি, কান্না আর বিলাপের অসহনীয় বেদনায় টানটান করতে থাকে তাঁর হৃদয়। চোখেই জমাট বেঁধে যায় অশ্রু। তিনি শপথ করলেন, না, আর নয়। ইহুদীদের দখলদারিত্বের অধীনে তিনি আর থাকবেন না। . তাঁর পেশিতে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে। চিরচেনা শান্ত সমাহিত সেই আযযম যেন জলন্ত অঙ্গার। তবে অত্যন্ত নীরব। দারুণ চিন্তাশীল। সময়ের ব্যবধানে হলেও তিনি সফলতার মুখ দেখতে চান।


 অত্যাচারীদের হাত গুটিয়ে দিতে চান চিরতরে। . ১৯৭০ সাল। তিনি তখন জর্দানে। ইসরাঈলি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিলেন। শুরু হল তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়। চিন্তায় লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে দৃঢ়পপদে এগিয়ে চললেন। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর অনুধাবন করলেন, না, তাঁকে আরও পড়ে হবে। তাঁকে আরও শিখতে হবে। অল্পবিদ্যা নিয়ে সামনে এগোনো যে বড়ই কঠিন। অত্যন্ত দুষ্কর। তাই তিনি চলে এলেন মিশরে। ভর্তি হলেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার তিনি ইসলামী আইন শাত্রে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করলেন। ১৯৭১ সালে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান্ডিত্যের পুরষ্কার লাভ করেন। সে বছরই তিনি ইসলামি আইনের বিজ্ঞান ও দর্শন ( উসুলুল ফিকাহ) এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে মিশরে অবস্থানকালে শহীদ সাইয়্যেদ কুতুবের রহ. (১৯০৬-১৯৬৬) পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। . শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম দেড় বছর ফিলিস্তিননের জিহাদে অতিবাহত করেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জিহাদে কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু এসময় তিনি মানসিকভাবে প্রশান্ত ছিলেন না।


কারণ তিনি দেখতেন, যারা ফিলিস্তিন জিহাদে রত তারা ইসলাম থেকে অনেক দূরে। মাঝে মধ্যেই তিনি দুঃখ করে বলতেন, ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য এটা কোন ধরনের জিহাদ হচ্ছে, যেখানে মুজাহিদ ভাইয়েরা প্লেইং কার্ড, গান শোনা আর টেলিভিশনে অশ্লীল ছবি দেখে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে! তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতেন, হাজারো মানুষের জনবহুল জায়গায় সালাতের জন্য আহ্বান করা হলে একেবারেই অল্প সংখ্যক লোক উপস্থিত হয় যাদের হাতের আঙ্গুলী দিয়ে গোনা সম্ভব, এদের দিয়ে কী জিহাদ হবে! তাই তিনি তাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তারা তাঁকে প্রতিহত করত। বাধা দিত।  একদিন তিনি এক মুজাহিদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ফিলিস্তিনের এ অভ্যুত্থানের সাথে কি দ্বীনের কোনো সম্পর্ক আছে? তখন সেই মুজাহিদ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলল, এই অভ্যুত্থানের পশ্চাতে দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই।  . এ কথা শুনার পর তাঁর মন ভেঙে যায়। তিনি ফিলিস্তিনের রণাঙ্গন ত্যাগ করে সৌদি আরব চলে আসেন। জেদ্দায় অবস্থিত বাদশা আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মাঝে ইসলামের নির্মল চেতনা ও জিহাদি জযবা সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠদানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারেন, মুসলিম উম্মাহর বিজয় ফিরিয়ে আনতে পারবে ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনী। এ ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়।


 তখন থেকে জিহাদ আর বন্দুক হয়ে যায় তাঁর প্রধান কাজ আর বিনোদনের সঙ্গী। তিনি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ঘোষণা করতে থাকেন, আর কোন সমঝোতা নয়, নয় কোন আলাপ আর আলোচনা। জিহাদ আর রাইফেলই হবে সমাধানের একমাত্র পথ। . ১৯৮০ সাল। হজ্জে এসেছেন এক আফগান মুজাহিদ। সহসা তার সাথে দেখা হয়ে যায় ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. এর। কথার তালে তালে সখ্যতা বৃদ্ধি পেল। একের পর এক শুনলেন আফগান জিহাদের অবিশ্বাস্য কাহিনীমালা। মুজাহিদদের ত্যাগ, কুরবানী আর আল্লাহর সাহায্যের কাহিনীমালা শুনতে শুনতে ড. আব্দুল্লাহ আযযাম অভিভূত হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, এতোদিন ধরে তিনি এ পথটিই খুঁজে ফিরছেন। এরই তালাশে আছেন। এরপর তাঁন মন অস্থির হয়ে উঠে। অশান্ত হয়ে উঠে। তিনি বাদশাহ আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চলে আসেন। . শুরুতে তিনি ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আফগান মুজাহিদ নেতার সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। তখন আফগান জিহাদ সম্পর্কে তিনি বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করেন। নানা বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। চলমান জিহাদের রূপরেখা অনুধাবন করেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পুরোপুরিভাবে আফগান জিহাদে আত্মনিয়োগ করেন। হৃদয়-মন, মেধা-যোগ্যতা, অর্থ-সম্পদ সবকিছু অকাতরে উজাড় করে দান করেন।


 আত্মতৃপ্ত শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের কন্ঠ চিরে বার বার রাসূলের ﷺ এই বাণীটি মুজাহিদদের মাঝে ছাড়িয়ে পড়ত,  “আল্লাহর পথে জিহাদের ময়দানে এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকা ষাট বৎসর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” তারপর তা তাদের হৃদয়ে ছুঁয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করত। শাহাদাতের আশায় তাদের অস্থির করে ছাড়ত। ব্যাকুল করে দিত। . আব্দুল্লাহ আযযাম ও তাঁর প্রিয় শিষ্য উসামা বিন লাদেন পেশোয়ারে অবস্থানকালে মুজাহিদদের সেবা সংস্থা বায়তুল আনসারে যোগ দেন। এ সংস্থা আফগান মুজাহিদদের সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করত। নতুন মুজাহিদদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে সম্মুখ যুদ্ধে প্রেরণ করত। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর পরিবারকেও নিয়ে আসেন।

. এরপর আব্দুল্লাহ আযযাম আরো সামনে অগ্রসর হলেন। জিহাদের প্রথম কাতারে গিয়ে শামিল হলেন। হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সম্মুখ লড়াইয়ে। অসম সাহসিকতায় বীরের মত যুদ্ধ করতে লাগলেন। আল্লাহর রাহে জীবন দেওয়ার জন্য তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। ছুটে চললেন এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে। এক রণক্ষেত্র থেকে আরেক রণক্ষেত্রে। আহ! এ যেন আরেক জীবন। এ জীবনের কোন মৃত্যু নেই। এর স্বাদ, রঙ আর প্রকৃতি একেবারে আলাদা। অনন্য। . তিনি আফগানিস্তানের অধিকাংশ প্রদেশে ছুটে গেলেন। লোগার, কান্দাহার, হিন্দুকুশ পর্বতমালা, পাঞ্জশির উপত্যকা, কাবুল আর জালালাবাদে ছুটে চললেন বিরামহীন গতিতে। ফলে আফগান রণাঙ্গনের সাধারণ যোদ্ধা ও মুজাহিদদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সখ্যতা হয়। বন্ধুত্ব হয়। সবাই তাঁকে তাঁর হৃদয়ের উদারতা, জিহাদী জযবা, আল্লাহর রাহে জীবন দেয়ার আকুতি, মুসলিম উম্মাহর দরদী ব্যক্তিত্বের কারণে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতে থাকে। মহব্বত করতে থাকে। . এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন পেশোয়ারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এবার তিনি একেবারে টইটম্বুর। গোটা আফগান রণাঙ্গনের সমস্যা-সমাধান তাঁর মস্তিষ্কের কোষে কোষে। জিহাদের এই কাফেলাকে সঠিক পথে পরিচালনার ও চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার তামান্নায় তিনি অধীর অস্থির। তাই মুজাহিদদের মাঝে সংস্কারমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন।

মুজাহিদদের পরিশুদ্ধ করতে লাগলেন। জিহাদের পথে নানা বিভ্রান্তির আলোচনা করতে লাগলেন। বিভক্ত মুজাহিদদের গ্রুপগুলোকে একই কাতারে শামিল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের সেই বক্তৃতা সংকলনই পরবর্তীতে ‘ফি জিলালি সুরাতিত তাওবাহ’ নামক গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়। . আফগান মুজাহিদ নেতাদের মাঝে তাঁর প্রভাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাই সবাই তাঁকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। তাঁর প্রস্তাব, পরিকল্পনাকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারতো না। . এরপর তিনি মুসলিম উম্মাহকে জিহাদের ব্যাপারে জাগ্রত করার দিকে মনোনিবেশ করেন। আফগান জিহাদের পবিত্র আহ্বানকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে ছুটে যান বিশ্বের বহু দেশে। সাক্ষাৎ করেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও সমাজসেবক ব্যক্তিত্বদের সাথে। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতে থাকেন। চারদিকে ছুটতে থাকে অনল প্রবাহ। তিনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য, শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের লুন্ঠিত ভুমিকে উদ্ধারের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। . অবসরে তার কলমও ছুটতে থাকে। তিনি জিহাদ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পুস্তকও রচনা করেন। যা এখনো পাঠককে আন্দোলিত করে। আলোড়িত করে। জিহাদের পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে।

পুস্তকগুলোর শীর্ষে রয়েছে- এসো কাফেলাবদ্ধ হই, আফগান জিহাদে আর-রহমানের নিদর্শনসমূহ, মুসলিম ভূমিসমূহের প্রতিরক্ষা ইত্যাদি। . শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের অবিরাম প্রচেষ্টা, মেহনত-মুজাহাদা সফলতার আলো দেখতে পায়। তিনি বিশ্বের মুসলমানদেরকে আফগান জিহাদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ফলে আফগান জিহাদ শুধু আফগান জনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা আফগান জিহাদে অংশগ্রহণ করতে ছুটে আসতে থাকে। তারা ইহুদি-খ্রিস্টানদের হাতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলিম মা-বোনদের উদ্ধারে শপথ গ্রহণ করতে থাকে এবং প্রত্যেক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে। . তিনি তাঁর মানসপটে একটা চিত্রই এঁকেছিলেন। তা হল, জিহাদের মাধ্যমে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বারবার বলতেন, পৃথিবীর বুকে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। তাই তিনি বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাবকে অকুষ্ঠ চিত্তে প্রত্যাখান করেছেন।

আর দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাবেন যতক্ষণ পর্যন্ত হয় তিনি বিজয়ী হবেন, নতুবা তাঁকে হত্যা করা হবে। . আফগান রণাঙ্গন ছিল তাঁর স্বপ্নের চারণভূমি। তাই তিনি বলতেন, আমি কখনও জিহাদের ভুমি পরিত্যাগ করব না, তিনটি অবস্থা ছাড়া। হয় আমি আফগানিস্তানে নিহত হব, নতুবা পেশোয়ারে নিহত হব, নতুবা হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হবে। . একদিন মিম্বারে খুতবাহ দানকালে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আমি মনে করি, আমার প্রকৃত বয়স হচ্ছে নয় বৎসর। সাড়ে সাত বৎসর কেটেছে আফগান জিহাদে আর দেড় বৎসর কেটেছে ফিলিস্তিন জিহাদে। এছাড়া আমার জীবনের বাকী সময়গুলোর কোনো মূল্য আমার কাছে নেই।” তিনি আরও বললেন, জিহাদ পরিত্যাগ করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এক আল্লাহর ইবাদাত করা হবে। জিহাদ চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সব নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করা হবে। জিহাদ চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের সম্মান ও লুন্ঠি্ত ভুমিগুলো ফিরিয়ে আনা হবে। জিহাদ হল চিরস্থায়ী মর্যাদার পথ। .

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ্য করে জুমআর খুতবায় বলতেন, মুসলিম জাতি কখনও অন্য জাতি দ্বারা পরাজিত হয়নি। বরং আমরা আমাদের নিজেদের লোকদের কাছেই পরাজিত হয়েছি। . শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারি ব্যক্তি ছিলেন। ধর্মানুরাগ, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, সংযমশীলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক অলংকার। তিনি কখনও কারো সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন না। তরুণদের তিনি ভিন্ন চোখে দেখতেন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সব ধরনের ভয়-ভীতি মাড়িয়ে হৃদয়ের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি নিয়মিত সিয়াম পালন করতেন। বিশেষ করে নবী দাউদের (আলাইহিস সালাম) সুন্নাহ অনুযায়ী একদিন সিয়াম পালন করতেন, আরেকদিন বিরত থাকতেন। এভাবে তিনি সারা বৎসর সিয়াম পালন করতেন। সোমবার ও বৃহস্পতিবার তিনি সিয়াম পালন করতেন এবং অন্যদেরও এ দু’দিন সিয়াম পালন করতে উৎসাহিত করতেন। . একবার এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। পেশোয়ারে কিছু উগ্র স্বভাবের লোক ঘোষণা দিল, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম কাফের হয়ে গেছে। কারণ তিনি মুসলমানদের সম্পদ অপচয় করছেন। 

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম এ সংবাদ শুনে বিস্মিত হলেন না। ক্ষিপ্তও হলেন না। তাদের সাথে কোন রুঢ় আচরণও করলেন না। বরং তাদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে দিলেন। এরপরও কিছু লোক বিরত হল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে কটু কথা বলতে লাগল। অপবাদ ছড়াতে লাগল। শাইখ আযযাম কিন্তু একেবারেই নীরব। নির্বিকার। তিনি তাদের সম্পর্কে কিছুই বললেন না। বরং নিয়মিত তাদের নিকট উপহার সামগ্রী পাঠাতে লাগলেন। তারপর একসময় তাদের ভুল ভাঙ্গলো। তখন তারা বলতে লাগল, আল্লাহর কসম, আমরা কখনোই শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের মতো মানুষ দেখিনি। তিনি আমাদের নিয়মিত অর্থ ও উপহার সামগ্রী দিয়ে যেতেন। অথচ আমরা তার বিরুদ্ধে কটুবাক্য বলতাম। . শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের চেষ্টা ও মুজাহাদার ফলে আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি মুজাহিদ গ্রুপ একত্রিত হল।

তারা একই আমিরের নির্দেশে চলতে লাগলো, ফলে শত্রুদের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে পড়লো। মুজাহিদরা প্রত্যেক ফ্রন্টে বিজয়মালা ছিনিয়ে আনতে লাগলো। এ অবস্থায় শত্রুরা তাঁকে সহ্য করতে পারছিল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করল। তাঁকে হত্যার কৌশল খুঁজতে লাগল।  . পেশোয়ারে তিনি এক মসজিদে নিয়মিত জুমআর নামায পড়াতেন। নামাযের আগে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতেন। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ তাঁর বক্তৃতা শুনতে ছুটে আসতো। ১৯৮৯ সালে শত্রুরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে তার মিম্বারের নিচে একটি প্রচন্ড শক্তিশালী টিএনটি বিস্ফোরক রেখে দিল। এটা এতোই ভয়াবহ ছিল যে তা বিস্ফোরিত হলে পুরো মসজিদটি ধ্বসে পড়তো। মসজিদের হয়তো কেউই বাঁচতো না। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন। তাই তা বিস্ফোরিত হয়নি! . এইদিকে শত্রুরা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল।

১৯৮৯ সালের ২৪শে নভেম্বর। শুক্রবার। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম যে পথ দিয়ে জুমআর নামায আদায় করতে যেতেন সে পথে শত্রুরা তিনটি বোমা পুঁতে রাখল। রাস্তাটি ছিল সরু। একটির বেশি গাড়ি তা দিয়ে অতিক্রম করতে পারত না। দুপুর ১২.৩০ মিনিটে শাইখের গাড়িটি ঠিক বোমা যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল সেখানে এসে থামল। সে গাড়িতে ছিলেন শাইখ ও তাঁর দুই ছেলে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ। তাঁর আরেক পুত্র তামীম আদনানী আরেকটি গাড়িতে করে পিছনে পিছনে আসছিল। . শাইখ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেন। আর তখনই বিকট শব্দ করে শত্রুদের পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণের ভয়াবহ আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো শহর। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।

তারপরই মসজিদ ও আশপাশের মানুষেরা দৌঁড়ে এল। . কিন্তু ইতোমধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। ঘটনাস্থলে তাঁর গাড়ির বিক্ষিপ্ত টুকরো ছাড়া আর কিছুই পেল না। বিস্ফোরণের ফলে শাইখের দুই ছেলের দেহ ১০০ মিটার উপরে উঠে গিয়েছিল। তাদের দেহ বিভিন্ন গাছের ডালে, বৈদ্যুতিক তারের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের দেহকে রক্ষা করলেন। দেহটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় একটি দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় পাওয়া গেল।তখন তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।  .


তাঁর শাহাদাতের সংবাদে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে এলো। কান্নার রোল পড়ে গেল। মুজাহিদদের শিবিরে শিবিরে সেই কান্না ছড়িয়ে পড়লো। স্তব্ধ হয়ে গেল তাঁর বন্ধু-বান্ধব আর নিকটতম ব্যক্তিরা। . “ওরা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরের পূর্ণ বিকাশ ছাড়া আর কিছুই চান না, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।” .

 ১৯৯৯ সাল। আল-জাজিরা টিভি চ্যানেল শাইখ উসামা বিন লাদেনের এক সাক্ষাৎকার নিল। তিনি তাতে বললেন, “শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একক কোন ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মাহ। একটি জাতি। তাঁর শাহাদাতের পর মুসলিম মায়েরা তাঁর মতো দ্বিতীয়জন জন্ম দিতে পারে নাই।”

 . টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে, “বিংশ শতাব্দীতে জিহাদকে পুনর্জাগরণে তিনিই দায়ী।” . চেচনিয়া জিহাদের ফিল্ড কমান্ডার ইবনুল খাত্তাব রহ. বলতেন, “১৯৮০- এর দশকে শহীদ শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম ছিলেন এমন একটি মুদ্রিত নাম যাঁর কথা চেচনিয়ার জিহাদের ময়দানগুলোতে আজও বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলছে। . আর শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম বলতেন, “কেউ জিহাদের ময়দানে ইন্তেকাল করলে সে যেন ‘শহীদী কাফিলার সাথে’ গিয়ে শরীক হল।” . আল্লাহ শাইখকে কবুল করুন।

. লেখকঃ নাসীম আরাফাত মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি দাজ্জালি সিষ্টেম





খালিদ সাইফুল্লাহ

দাজ্জাল vs মুসলিম

জন্ম নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ সেক্স, আযল করা ও ইসলামের বিধান (A-Z বিস্তারিত পড়ুন এবং সচেতন হোন, প্লিজ)

জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের পটভূমি :
জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Birth control) আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই (Malthus) এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হ’ল বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত An essay on population and as it effects, the future improvment of the society. (জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এর প্রভাব) নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস (Francis Place) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন (Charles knowlton) ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত The Fruits of philosophy নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন।

আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন (New Malthusian Movment) নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডাঃ নোল্টনের (Fruits of philosophy) গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডাঃ ড্রাইসডেল (Drysdale)-এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়।

১৮৭৯ সালে মিসেস বাসন্ত-এর রচিত Law of population (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (Birth Control Clinics) খুলে দেয়। [1]

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রকাশ্যে সন্তান হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারণা চলছে। যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’, দুইটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিক গর্ভবর্তী মায়ের সেবার নামে গর্ভপাত ঘটানোর গ্যারেজে পরিণত হয়েছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি :

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দু’প্রকার : (১) সাময়িক ব্যবস্থা ও (২) স্থায়ী ব্যবস্থা।

[১] সাময়িক ব্যবস্থা :

(ক) আযল তথা যোনির ভিতরে বীর্যপাত না করা (With drawal)

(খ) নিরাপদ সময় মেনে চলা (Safe period) ।

(গ) কনডম ব্যবহার। (ঘ) ইনজেকশন পুশ। (ঙ) পেশীতে বড়ী ব্যবহার। (চ) মুখে পিল সেবন ইত্যাদি।

[২] স্থায়ী ব্যবস্থা :

(ক) পুরুষের অপারেশন। (খ) নারীর অপারেশন।

(ক) পুরুষের অপারেশন : পুরুষের অন্ডকোষে উৎপাদিত শুক্রকীটবাহী নালী (Vas deferens) দু’টি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে, কিন্তু বীর্যে xy ক্রমোজম শুক্রকীট না থাকায় সন্তান হয় না। [2]

(খ) নারীর অপারেশন : নারীর ডিম্বাশয়ে উৎপাদিত ডিম্ববাহী নালী (Fallopian Tube কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পূর্ণ xx ক্রমোজম ডিম্ব (Matured Ovum) আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। [3]

নারী অথবা পুরুষে যেকোন একজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অপর জনকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। কারণ নারীর ডিম্ব পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত না হ’লে সন্তানের জন্ম হয় না। [4]

জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল :

জন্মনিয়ন্ত্রণের বহুবিদ কুফল রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-

ব্যাভিচারের প্রসার :

ব্যাভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَاءَ سَبِيْلاً

‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)

কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরও একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তাহ’ল অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হবার আশংকা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়ার ফলে, এ আশংকা থেকে একদম মুক্ত। যারা নৈশক্লাবে নাচ-গান করে, পতিতা বৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে উঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা করে না। তাছাড়া কখনও হিসাব নিকাশে গড়মিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামের সন্তান হত্যার গ্যারেজে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে।

ইংল্যান্ডে প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৮৬ জন নারী বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অবৈধ সন্তান জন্মের সময় এদের শতকরা ৪০ জন নারীর বয়স ১৮-১৯ বছর, ৩০ জন নারীর বয়স ২০ বছর এবং ২০ জন নারীর বয়স ২১ বছর। এরা তারাই যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও এ দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছিল। [5] সেখানে প্রতি তিন জন নারীর একজন বিয়ের পূর্বে সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। ডাঃ চেসার তার রচিত ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন’। [6]

Indian Council for Medical Research-এর ডিরেক্টর জেনারেল অবতার সিংহ পেইন্টাল বলেন, We used to think our women were chaste, But people would be horrified at the level of promise culty here. অর্থাৎ আমাদের নারীদেরকে আমরা সতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অবৈধ যৌনকর্ম এখানে এতবেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লোকে এতে ভীত না হয়ে পারে না। [7]

আমেরিকার বিদ্যালয় সমূহে অশ্লীল সাহিত্যের চাহিদা সর্বাপেক্ষা বেশী। যুবক-যুবতীরা এসব অধ্যয়ন করে অশালীন কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়া হাইস্কুলের শতকরা ৪৫ জন ছাত্রী স্কুল ত্যাগ করার পূর্বে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর এদের যৌন তৃষ্ণা অনেক বেশী। [8] বৃটেনেও শতকরা ৮৬ জন যুবতী বিয়ের সময় কুমারী থাকে না। [9] প্রাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় অধিকাংশ খন্ডকালীন যৌনকর্মী হিসাবে অর্জন করে থাকে। মঙ্গোলয়েড দেশসমূহে যৌন সম্পর্কীয় বিধি-বিধান অত্যন্ত শিথিল। থাইল্যান্ডের ছাত্রীদের বিপুল যৌনতা লক্ষ্য করা যায়। [10]

চীনের ক্যান্টন শহরে কুমারীদের প্রেম বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। [11] পশ্চিমা সভ্যতার পূজারীরা সর্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। [12] চীনে যৌন স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত পোষ্টারে যার সাথে খুশী যৌন মিলনে কুণ্ঠিত না হবার আহবান জানানো হয়। [13] ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার দাবীতে পুরুষের মত নারীরাও নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃংখল ও অনাচারী এবং সুযোগ পেলেই হন্যে হয়ে তৃপ্ত করত যৌনক্ষুধা। অশুভ এই প্রবণতার ফলে বৈবাহিক জীবন ও পরিবারের প্রতি চরম অনিহা সৃষ্টি হয়। [14] অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৭৫ লাখ নারী পুরুষ বিবাহ ব্যতীত ‘লিভ টুগেদার’-এ। [15]

প্রাশ্চাত্যের যুবতীরা যাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে, সেজন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে গর্ভনিরোধের দ্রব্যাদি দেয়া হয় এবং এ সকল দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়ে তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। এমনকি মায়েরা কন্যাদেরকে এই সকল দ্রব্য ব্যবহারের কায়দা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদির ব্যবহার সম্পর্কে স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বের করে এবং বিশেষ কোর্সেরও প্রবর্তন করে। এর অর্থ হ’ল- সকলেই নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছে যে, যুবক-যুবতীরা অবৈধ যৌন সম্ভোগ করবেই। [16]

প্রাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সবচাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান জন্ম, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ ও যৌন ব্যাধিই এর প্রমাণ। অপর দিকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে কোন আইন-বিচার ও আইনী শাস্তির বিধান নেই। বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। [17]

সম্প্রতি ভারতেও অবৈধ যৌন সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর নির্বিঘ্নে বিবাহ বন্ধন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত ঘটানোর হিড়িক পড়ে গেছে।

জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব :

নারীর ব্যাভিচার দিনদিন প্রসার লাভ করে চলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মারাত্মক জটিল সব রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণু নাশক ঔষধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণা কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তেই নারী দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃংখলা (Nervous instability) দেখা দেয়। যেমন- নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষমেজায, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যান্সার, অনিয়মিত ঋতু, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। [18] নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গণরিয়া, এমনকি এইডস-এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়। [19]

সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি হয়। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচ. আই. ভি (HIV)। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ. আই. ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন। [20] বল্গাহীন ব্যাভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। [21]

এছাড়া জন্ম নিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে নানা প্রকার রোগ বদঅভ্যাসের প্রসার ঘটেছে। তন্মধ্যে কনডম ব্যবহার বা আযল করার জন্য নারীরা মিলনে পরিতৃপ্ত না হ’তে পেরে অবৈধ মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, স্তনচাকা বা পিন্ড, স্তন ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে স্তনে এ ধরনের ব্যথা ও পিন্ড তৈরী হয় এবং ৭৫% নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে। [22] বুক ও জরায়ুর কার্সিনোমা হ’তে পারে শর্করা জাতীয় খাদ্য সহ্য হয় না, লিভার দুর্বল হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যহত হয়, বুকের দুধ কমে যায় এবং Lactation কম হয় এবং দেহে ফ্যাট জমা হয়। [23] এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও স্থানচ্যুতি সহ আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জন্মের হার কমে যাওয়া :

আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করেন

وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ

‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’(ইসরা ১৭/৩১)

কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল,

وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ

‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)

এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্রের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সেজন্যেই ক্রমশঃ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে হরাস পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বংশধর উৎপাদন ব্যাহত হ’লে মানব জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী সক্রিয় হবে।

জাহেলী যুগে সন্তানের আধিক্য থেকে বাঁচার জন্য লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত। গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে, সবগুলোই মানব বংশ ধ্বংসের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ। [24]

জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করেছে। [25] জন্মনিয়ন্ত্রণ জন্মহার হরাসের একমাত্র কারণ না হ’লেও অন্যতম প্রধান কারণ একথা নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হরাস পাওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ জন্ম নিয়ন্ত্রণের দরুণ ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের জন্ম হার হরাস প্রাপ্তির কারণ গুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার কারণেই জন্মহার হরাস পাচ্ছে। [26]

ফ্রান্স সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। একশত বছর পর সেখানে প্রতিটি যেলায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমে যেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার হার কমে যাওয়ার ফলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বে তার প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়। [27]

ফিডম্যান বলেন, সমষ্টিগতভাবে আমেরিকান শতকরা ৭০টি পরিবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে জন্মনিরোধের প্রচেষ্টা। [28] যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্যের লোকেরা জন্ম নিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর সভ্যতার কারণে অন্যান্য জাতিও বিপদের সম্মুখীন।

সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাতে ক্রমশঃ পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালবাসা হ্রাস এবং অবশেষে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তাছাড়া নারীদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে বৈকল্য দেখা দেয় এবং তার মেজাজ দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠে, ফলে দাম্পত্য জীবনের সকল সুখ-শান্তি বিদায় নেয়। সন্তানই স্বামী-স্ত্রীকে চিরদিন একত্রে সংসার গঠনের ভূমিকা রাখে। এজন্য বলা যায়, সন্তানই পরিবার গঠনের সেতুবন্ধন।

ইউরোপ ও আমেরিকাতে দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং জন্মনিরোধ আন্দোলন প্রসারের সঙ্গে তালাকের সংখ্যাও দিন দিন দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, সেখানে এখন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। [29]

সমস্ত ইউরোপের সামাজিক দৃশ্যপট বদলে যায় শিল্প বিপ্লবের অভিঘাতে। আমূল পরিবর্তন আসে গ্রামীন জীবনেও, ভেঙ্গে যায় পারিবারিক জীবনের ভিত। নারীরা কল-কারখানায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে শুরু করে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান তরুণ নিহত হ’ল। ফলে বিধবা হ’ল অগণিত নারী। যুদ্ধ বিড়ম্বিতা নারীরা বাধ্য হয়ে পুরুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে কারখানা মালিকের নিকটে শ্রম বিক্রয়ের পাশাপাশি কমনীয় দেহটাও মনোরঞ্জনের জন্য দিতে হ’ল। যৌবনের তাড়নায় ইন্দ্রিয় ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য তাকে বেছে নিতে হ’ল অবাধ বিচরণের পথ। আর নারীর মনের গভীরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হ’ল অতৃপ্ত যৌনতা এবং দামী পোশাক ও প্রসাধনীর প্রতি প্রচন্ড মোহ। [30]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে চরিত্রের ক্ষতি সাধিত হয়। এ ব্যবস্থা নারী-পুরুষের অবাধ ব্যভিচারের সনদ দিয়ে থাকে। কেননা এতে জারজ সন্তান গর্ভে ধারণ ও দুর্নাম রটনার ভয় থাকে না। এজন্য অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। Dr. Westr Marck তার বিখ্যাত গ্রন্থ Future of Marriage in Western Civilaization-এ বলেন, গর্ভনিরোধ বিদ্যা বিয়ের হার বাড়াতে পারে। কিন্তু এর ফলে বিয়ে বন্ধন ছাড়াই যৌন মিলনের পথও অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায়। [31]

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে শিশুরাও তাদের মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়। যদি অন্য ছোট-বড় ভাই বোন খেলার সাথী হিসাবে থাকে, তবে তাদের সাথে একত্রে থাকা ও মেলামেশা, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি শিক্ষণীয় গুণাবলী তার মাঝেও প্রস্ফুটিত হয়। মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, একাকিত্বের ফলে শিশুদের মন-মগজের সুষ্ঠু বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এমনকি দু’টি শিশুর বয়সের পার্থক্য বেশী হ’লে নিকটস্থ ছোট শিশু না থাকার কারণে বড় শিশুটির মস্তিষ্কে (Neurosisi) অনেক ক্ষেত্রে রোগও সৃষ্টি হয়। [32]

অর্থনৈতিক ক্ষতি :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি এ সমস্ত উপকরণ ব্যবহারের জন্য জাতীয় রাজস্বে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। এটাকে এক ধরনের অপচয় বললেও ভুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তোমরা) অপব্যয় কর না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (ইসরা ১৭/২৭)

‘খাও ও পান কর, অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পসন্দ করে না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)

বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ জনসংখ্যা হ্রাস জনিত যুক্তি দিন দিন অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হ’ল- জন্মহার ধারাবাহিকভাবে (Topering) কমে যাওয়ার ফলে একদিকে পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হরাস পায়। পক্ষান্তরে বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। [33] কেনসি হাসান বলেন, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করলে সমাজের অর্থনৈতিক তৎপরতাও অনেক বেড়ে যায়। সে সময় সম্প্রসারণকারী শক্তিগুলি (Expansive) সংকোচনকারী শক্তিগুলির (Contractive) তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়। তখন অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। আর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা হ্রাস পায়।

প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানী করে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। এই বিশাল জনসংখ্যা যদি শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, তাহ’লে এ জনসংখ্যা ক্ষতির কারণ না হয়ে আশীর্বাদের কারণ হবে। যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রাজস্ব খাতে বিরাট ভূমিকা রাখছে, নিশ্চয়ই তা বেকারত্ব দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

অন্যথা ‘পরিবার পরিকল্পনার’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে জনশক্তির অপমৃত্যু, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবক্ষয়। এই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় কনডম, ইনজেকশন, বড়ি ও খাবার পিল ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে যে খাবার পিল বিতরণ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিন্তু বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী যে পিল বের করেছে তা উচ্চ মূল্যে (৫০-৮০ টাকা) ক্রয় করে জনগণ ব্যবহার করছে। এতে পুঁজিবাদীরা জনগণের পকেট ফাঁকা করে চলেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে।

গ্রামাঞ্চলে একটি শিশুর জন্ম দানের জন্য এত টাকা ব্যয় করতে হয় না, যত টাকা ব্যয় করতে হয় জন্মনিরোধ উপকরণাদি ক্রয়ের জন্য। [34]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে শ্রমজীবী লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলে পুঁজিবাদীরা উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানী করে মিল-কারখানায় উৎপাদন করছে। এতে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা হরাস পাওয়ার ফলে পণ্যের ব্যবহারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে আসছে। অতএব জন্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের কোন সুফল বয়ে আনেনি বরং অর্থনৈতিক ও নৈতিকতার মহা ক্ষতির কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান :

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। কিন্তু মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল কি? যদি একটু চিন্তা করি, তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-এর একাকীত্ব দূর করতে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে হাওয়া (আঃ)-কে শুধু সৃষ্টি করেননি। বরং আরও একটি বিশেষ কারণে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’ল মহান আল্লাহ তাদের ঔরশজাত সন্তান দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। আর সমস্ত মানব তাঁর (আল্লাহর) একত্ব ঘোষণা পূর্বক দাসত্ব করবে। এ হ’ল আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টির একান্ত উদ্দেশ্য। আমরা সেই অনাগত সন্তানদের নির্বিঘ্নে হত্যা করে চলেছি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

َوَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ

‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই রিযিক দান করব’ (আন‘আম ৬/১৫১)

আলোচ্য আয়াতে খাবারের অভাবের আশংকায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই দিব’। ‘আমিই দিব’ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা হ’ল অনাগত সন্তানদের রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর খাদ্য ভান্ডারে খাবারের হিসাব অকল্পনীয়। আবার তিনি বললেন,

‘নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক ভুল’ (ইসরা ১৭/৩১)

তিনি যথার্থই বলেছেন, অনাগত সন্তান হত্যা করা বিরাট ভুল। ভূপৃষ্ঠে একচতুর্থাংশ স্থল, বাকী সব সাগর, মহাসাগর। কিন্তু বর্তমানে মহাসাগরে হাওয়াইন দ্বীপপুঞ্জের মত ছোট-বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে এবং নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের আবাদী জমি ও বাসস্থান বাড়ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (কাহাফ ১৮/৪৬)

আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায়। আর সন্তান হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। [35]

জনৈক রুশ লেখক তার Biological Tragedy of Woman গ্রন্থে বলেছেন, নারী জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানববংশ রক্ষা করা। [36] যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য মানববংশ বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর। নারী দেহের বৃহত্তম অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। [37] মা হাওয়াসহ পৃথিবীর সমস্ত নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানব বংশ রক্ষা ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোতে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন।

আযল-এর বিধান :

প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আযল’ করার যে প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হাদীছে স্পষ্ট আলোচনা আছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-

১. জাবির (রাঃ) বলেন,

كُنَّا نَعْزِلُ وَالْقُرْآنُ يَنْزِلُ

‘আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম অথচ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। [38]

অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে ‘আযল’ সম্পর্কে কোন নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা নিষেধ করেননি।

২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,

আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে (দাসী) বন্দী করে নিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রমণীদের প্রতি আকর্ষণ জাগে। যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে উঠে এবং এ অবস্থায় ‘আযল করাকেই আমরা ভাল মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাবে বললেন, তোমরা যদি তা কর তাতে তোমাদের ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন, তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। [39]

৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

তুমি কি সৃষ্টি কর? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখ, সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা রয়েছে। [40]

ইবনে সীরীন-এর মতে, لاعليكم ان لاتفعلوا এ বাক্যে ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধের একেবারে কাছাকাছি এতে কোন সন্দেহ নেই। [41]

হাসান বছরী বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলের একথায় ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট ভৎর্সনা ও হুমকি রয়েছে। [42]

ইমাম কুরতুবী বলেছেন, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় রাসূল (ছাঃ) যেন বলেছেন, لاتعزلوا وعليكم ان لاتفعلوا তোমরা ‘আযল’ কর না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য। [43]

রাগিব ইসফাহানীর মতে, ‘আযল’ করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থানে নিক্ষেপ না করা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ। [44]

মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন যে, ইবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম যাঁরা ‘আযল’ পসন্দ করতেন না। [45]

عزل অর্থ হ’ল, পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া যেন শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভেতরে স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়।[46]

আইয়ামে জাহেলিয়াতে যেসব কারণে সন্তান হত্যা করা হ’ত, বর্তমান যামানায় জন্মনিয়ন্ত্রণও ঠিক একই কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী যুগের ‘আযল’-এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে যুগে তিনটি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আযল’-এর প্রচলন ছিল।

(এক) দাসীর গর্ভে নিজের কোন সন্তান জন্মানো তাঁরা পসন্দ করতেন না, সামাজিক হীনতার কারণে।

(দুই) দাসীর গর্ভে কারো সন্তান জন্মালে উক্ত সন্তানের মাকে হস্তান্তর করা যাবে না, অথচ স্থায়ীভাবে দাসীকে নিজের কাছে রেখে দিতেও তারা প্রস্ত্তত ছিল না।

(তিন) দুগ্ধপায়ী শিশুর মা পুনরায় গর্ভ ধারণ করার ফলে প্রথম শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশংকা অথবা পুনরায় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মায়ের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের আশংকা, কিংবা সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার অনুপযুক্ত তা চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযোগ্য বিবেচনায় এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

উপরোক্ত তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম দু’টি কারণ আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হয়েছে। শেষের তিন নম্বর কারণ ব্যতিরেকে সম্পদ সাশ্রয়ের জন্য ও নিজের আমোদ-প্রমোদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ নয়।


পরিশেষে বলব, জন্মনিয়ন্ত্রণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। বরং জনসংখ্যাকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদন বাড়ানো, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়ণের মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে না বুঝে পরাজয় বরণ করা। একটি কাপড় কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হ’লে কাপড়টি বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের যুগে আমরা মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!!



[1] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃঃ ১৩-১৫।
[2] . ডা. এস.এন. পান্ডে, গাইনিকলজি শিক্ষা, (কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭), পৃঃ ১২৪।
[3] . ঐ, পৃঃ ১২৫।
[4] . ঐ, পৃঃ ১৪।
[5] . Sehwarz Oswald, The Psycology of Sex (London : 1951), P. 50.
[6] . Cheser Is Chastity Outmoded, (Londen : 1960), P. 75.
[7] . নারী ৯৭ পৃঃ; হাফেয মাসঊদ আহমদ; আত-তাহরীক (বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে নারী : একটি সমীক্ষা-) (৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা জানুয়ারী ২০০৩), পৃঃ ৪
[8] . George Lindsey, Revolt of Modern Youth P-82-83.
[9] . দৈনিক ইনকিলাব, ৬ই জুন ১৯৯৮ ইং।
[10] . মাসিক পৃথিবী (প্রশ্চাত্যে যৌন বিকৃতি, জুলাই ২০০১ইং, পৃঃ ৫২-৫৩।
[11] . জহুরী খবরের খবর, ১ খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[12] . মরিয়ম জামিলা, ইসলাম ও আধুনিকতা, ৯৯ পৃঃ।
[13] . খবরের খবর, ১ম খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[14] . সায়্যেদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, ৯৮ পৃঃ।
[15] . দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ এপ্রিল ২০১১, পৃঃ ৫।
[16] . নারী, পৃঃ ৮৫; আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০০৩, পৃঃ ৪।
[17] . ইসলাম ও আধুনিকত, পৃঃ ২৩।
[18] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬২।
[19] . Her self, Dr. Lowry, P-204.
[20] . কারেন্ট নিউজ (ডিসেম্বর সংখ্যা ২০০১), পৃঃ ১৯।
[21] . The New Straits Jimes, (Kualalampur, Malaysia, 23 june 1988), P-9.
[22] . প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১০, পৃঃ ৪।
[23] . গাইনিকলজি শিক্ষা, পৃঃ ১২৩।
[24] . মাওলানা আব্দুর রহিম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।
[25] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১২৮।
[26] . Report of the Royal Commission on population (1949), P-34.
[27] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১১২।
[28] . Family Planning Sterility and Population Growth (Newyork : 1959), P-5.
[29] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৮-৬৯।
[30] . ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৯৮-১০১।
[31] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৯।
[32] . David M Levy, Maternal Over Protiction- (Newyork : 1943), P-35.
[33] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৭৩।
[34] . British Medical Journal, (London : 8 July, 1961), P-120.
[35] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৪০।
[36] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৫৮।
[37] . The Psychology of Sex, P-17.
[38] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৪।
[39] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৬।
[40] . সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০৩৮।
[41] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩।
[42] . ঐ।
[43] . ঐ।
[44] . ঐ, পৃঃ
[45] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১০১-১০২।
[46] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।

আপনি কি নিজের অজান্তেই মুনাফিক্বদের একজনে পরিণত হয়েছেন?


আজকে মুসলিম উম্মাহ যখন সেকুলারদের সাথে রক্তাক্ত যুদ্ধে আক্রান্ত, তোমার জন্য এটা জরুরি যে তুমি নিজের অবস্থান সম্পর্কে যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে নাও যে নিজের অজান্তে তুমি মুনাফিক্বদের একজনে পরিণত হও নি, যাদের ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “ওরা হলো যে সব লোক, যারা ঘরে বসে থেকে নিজেদের ভাইদের সম্বন্ধে বলে, যদি তারা আমাদের কথা শুনত, তবে নিহত হত না। তাদেরকে বলে দিন, তাহলে তোমাদের উপর থেকে মৃত্যুকে ঠেকাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক” (সূরা আল ইমরানঃ ১৮৬)।

মনে রাখবেন, নিফাক্ব তার কদর্য রুপ নিয়ে তখনই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যখন মুসলিমরা কোণঠাসা থাকে এবং শত্রুরা চারিপাশ থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। কাজেই সেই সব মুনাফিক্বদের মত হয়ো না যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ”… তোমাদের বিরুদ্ধে জড় হয়েছে বহু লোক, অতএব তাদের ভয় করো (এবং ঘরে ফিরে যাও)…”, বরং সেইসব মু’মিনদের মত হও যাদের একথা শুনে “…ঈমান বেড়ে গেল, আর তারা বললোঃ আল্লাহ্ আমাদের জন্য যথেষ্ট ও তিনি অতি উত্তম রক্ষাকারী…” (সূরা আলে-ইমরানঃ১৭৩)

বনী ঈসরাঈলের মত দুর্বলচিত্তের মানুষ হয়ো না, যারা ফির’আউন ও তার সেনাবাহিনীকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠেছিল, “…আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম”, বরং হযরত মূসা (আঃ) এর মত, যিনি বলেছিলেন, “কখনই না! নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমার সাথে আছেন এবং আমাকে পথ দেখাবেন” (আশ-শু’আরাঃ৬২)।

আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা তার বান্দাদেরকে এমনই কিছু সুক্ষ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে চালিত করেন যাতে করে তিনি “পৃথক করতে পারেন অপবিত্র ও না-পাককে, পবিত্র ও পাক থেকে” (আল-আনফালঃ ৩৭)

এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি জেনে নেন “কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী” (সূরা আনকাবূতঃ ৩)

মুনাফিক্বরা অন্ধ, তাই তারা দুনিয়াবী শক্তি ও ক্ষমতাকে ওপারে কী আছে (গায়েবী সাহায্য) তা অনুধাবন করতে অসমর্থ, তাই তারা যুদ্ধে নামার আগেই হাল ছেড়ে দেয়। হতে পারে মু’মিনদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র নেই, কিন্তু তাদের আছে বুক ভরা আশা এবং আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা, “…আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাগণ অবশেষে পৃথিবীর অধিকারী হবে” (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৫)।

মু’মিনরা যা বিশ্বাস করে, এবং মুনাফিক্বরা যা বিশ্বাস করে বলে দাবি করে, তার মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক, বস্তুত, উভয়ের বিশ্বাসের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। মুনাফিক্বরা কখ্নই তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসা বলতে কী বোঝায় তা বোঝে না, তারা বোঝে না আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া কী জিনিষ। আর এ কারণে তারা এটাও বুঝে না কেন একটি ছেলে তার ঈমানের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কী করে স্বেছায় মৃত্যুকে বেছে নেয় এবং সকল বিশ্বাসীদেরকে নিয়ে একযোগে আগুনের গর্তে ঝাঁপ দিয়ে শহীদ হয়ে যায়। তারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় ইবরাহীম (আঃ) জেনেবুঝে এমন কিছু কেন করে বসবেন যার জন্য তাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হয় (এটি হল ঈমান, যার বাস্তবতা তাদের ধরাছোঁয়ার বাহিরে) ইবরাহীম (আঃ) কিংবা মূসা (আঃ) দের হৃদয় এবং মুনাফিক্বদের হৃদয়, দুটো দুই মেরুর বাসিন্দা। আল্লাহ আমাদের অন্তরকে তাদের মত করে দিন এবং নিফাক্ব থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমীন।

সুন্নাত ও বিদায়াতের পরিচয়



পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের হিদায়াতের জন্য যুগে যুুগে আম্বিয়ায়ে কিরাম (আ.)কে প্রেরণ করেছেন। সেই সুমহান ধারার সর্বশেষ পয়গাম্বর হলেন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আল্লাহ তা‘আলা সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করা, তাঁর অনুসারী হওয়া, তাঁকে সম্মান করা সকল উম্মতের মুহাম্মদী তথা সকল মুসলমানের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসার প্রতি তাগিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন-

قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

“(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ¶মা করে দিবেন। আর আল্লাহ পরম ¶মাশীল দয়ালু। (সূরাহ আলে-ইমরান, আয়াত : ৩১)

এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি বা মহব্বত লাভ করার জন্য হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করাকে শর্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে যত বেশী মহব্বত করবে, তার অনুকরণ-অনুসরণে যে যত বেশী যত্নবান হবে, সে তত বেশী আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা ঈমানের দাবী-এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভালবাসার কিছু ধাপ বা স্তর রয়েছে। যেমন, আমরা আমাদের মাকে ভালবাসি, স্ত্রীকেও ভালবাসি, আবার কন্যাকেও ভালবাসি। এখন প্রশ্ন হল, মায়ের ভালবাসা যেমন স্ত্রীকে দেয়া যাবে না, তেমনি স্ত্রীর ভালবাসা মাকে দেয়া যাবে না। আবার কন্যার ভালবাসা যেমন স্ত্রীকে দেয়া যাবে না, তেমনি স্ত্রীর ভালবাসাও কন্যাকে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সকল ভালবাসাকে যদি সমান্তরালে মূল্যায়ন করা হয়, তবে সামাজিক ও পারিবারিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।

জাগতিক ক্ষেত্রে যেমন ভালবাসার শ্রেণী বিন্যাস রয়েছে, আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসার ক্ষেত্রেও তেমনি সংশ্লিষ্ট ধাপ বা স্তর রয়েছে। সুতরাং মহান আল্লাহকে তাঁর রবুবিয়্যাত অনুযায়ীই মহব্বত করতে হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের আসনেই মহব্বত করতে হবে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের কিছু বাতিল বিদ‘আতপন্হী লোক আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বতের এ সীমাকে লংঘন করে আল্লাহর বিভিন্ন রবুবিয়্যাতের গুণকে রাসূলের জন্য সাব্যস্ত করে। এভাবে তারা নবীজীকে ভালবাসার নামে এমন কিছু আকীদা পোষণ করে থাকে-যা সরাসরি শিরক কিংবা বিদ‘আত। তারা নবীজীর জন্ম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে মনগড়া কাল্পনিক কিছু অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তেমনি মীলাদের নামে মনগড়া গলদ তরীকায় দরূদ পাঠ করে, নবীজীকে হাজির-নাজির বিশ্বাস করে মীলাদের মজলিসে দাঁড়িয়ে কিয়াম করে, নবীজীকে ইলমে গাইবের অধিকারী মনে করে, তাঁকে মুখতারে কুল বিশ্বাস করে ইত্যাদি শিরকী আকীদা পোষণ করে এবং বিভিন্ন বিদ‘আত কাজ করে।

ইসলাম মহান আল্লাহর সর্বশেষ পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবন বিধান। এর মধ্যে কোন প্রকার সংযোজন-সংকোচন বা সংশোধন কিংবা পরিবর্তন-পরিবর্ধেনর অবকাশ নেই। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের ৮১ দিন পূর্বে দশম হিজরী সনের ৯ জিলহজ্জ শুক্রবার বাদ আসর বিদায় হজ্বের দিনে সোয়া ল¶ সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর বিশাল সমাবেশে ইসলামের পূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার প¶ থেকে পবিত্র কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-

اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا

“আজকের দিনে তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করলাম। ”

(সূরাহ মায়িদা আয়াত, আয়াত নং ৩)

উপর্যুক্ত আয়াতে কারীমা থেকে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। আর আকীদা ও আমলের সমষ্টির নাম হল দ্বীন। সুতরাং আমল ও আকীদা কোনটিতেই কোনরূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার অবকাশ নেই। এ উভয় ক্ষেত্রে হিদায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি মৌলিকভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

অতএব, শরীয়তের দলীল দ্বারা সমর্থিত নয়-এমন কোন বিষয় যদি দ্বীনের সাথে কেউ সংযোজন করে, তবে তা হবে বিদ’আত। আর সংযোজনকারীকে বলা হবে বিদ’আতী।

সুন্নাত ও বিদ’আত দুই বিপরীতার্থক আরবী শব্দ। ইসলামী তাহযীবের যতগুলো মৌলিক পরিভাষা রয়েছে, যে সব পরিভাষার উপর ইসলামী জীবন ব্যবস্হার সম্যক অনুধাবন নির্ভরশীল, এ দু’টো শব্দ তারই মধ্যে গণ্য। এ দু’টো শব্দের সঠিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ এবং এ দু’টোর দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের আকীদা ও আমল-আখলাক যাচাই ও পরখ করা একান্তভাবে জরুরী।

বস্তুত সুন্নাত ও বিদ‘আত সম্পর্কে সম্যক অবগতির অভাবে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বিভিন্ন ভ্রান্তির জাল বিস্তার লাভ করে। অপরদিকে দ্বীনের কাজ নয় বা কোন প্রকার সাওয়াবের কাজ নয়, এমন কোন বিষয়কেও অতি পুণ্যের কাজ মনে করা হয়।

আলোচ্য প্রবন্ধে সুন্নাত ও বিদ’আত-এর সংজ্ঞা এবং উভয়ের পার্থক্যের বিশদ আলোচনার পাশাপাশি কতিপয় কুরআন ও সুন্নাহ বিবর্জিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত-এর মাসলাকের বিরোধী কিছু শিরক ও বিদ’আতী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীস থেকে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

 

সুন্নাত শব্দের অর্থ


সুন্নাত (السّنَّۃَ)-এর আভিধানিক অর্থ : পথ। যেমন, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

سُنَّۃَ اللّٰہِ الَّتِیۡ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلُ ۚۖ وَ لَنۡ تَجِدَ لِسُنَّۃِ اللّٰہِ تَبۡدِیۡلًا

“আল্লাহর সুন্নাত-যা পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে রয়েছে এবং আল্লাহর এ সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন দেখবে না কখনো। ” (সূরাহ ফাতাহ, আয়াত : ২৩)

পবিত্র কুরআনে এই সুন্নাতকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَنَّ ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

“নিশ্চয়ই এ হচ্ছে আমার সঠিক সফল দৃঢ় পথ। অতএব, তোমরা এ পথই অনুসরণ করে চলবে। এ ছাড়া অন্য পথের অনুসরণ করবে না। তা করলে তোমাদের এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের এরূপ-ই নির্দেশ দিয়েছেন; যেন তোমরা ভয় করে চল। ” (সূরাহ আন‘আম, আয়াত নং ১৫৩)

আলোচ্য আয়াতে কারীমায় ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ বলতে সেই বিষয়ই বুঝানো হয়েছে, যা বোঝায় ‘সুন্নাত’ শব্দ থেকে।

সুন্নাত শব্দের পারিভাষিক অর্থ
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ, আদত-অভ্যাস এবং তাঁর কার্যানুমোদন অর্থাৎ তিনি যা করেছেন ও করতে বলেছেন এবং তাঁর সামনে যা করা হয়েছে-যাতে তিনি তাতে কোনরূপ আপত্তি করেননি, তৎসমুদয় কাজই হলো মূলত রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত।

সেই সাথে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এবং তাবিয়ীন ও তাবে-তাবিয়ীন (রহ.)গণের দ্বীন সম্পর্কীয় কথা, আকীদা-বিশ্বাস এবং আমল-আখলাকও রাসূলে কারীমের নির্দেশানুযায়ী সুন্নাতের অন্তভর্ুক্ত। যেমন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عَلَيْكُم‘ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الخُلَفَاءِ الرَّشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ

“আমার সুন্নাত এবং আমার সত্যানুসারী খলীফাগণের সুন্নাত তোমাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। ”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে ইরশাদ হয়েছে-

وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ

“তোমরা যদি তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর, তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে গোমরাহ হয়ে যাবে। ” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৪))

রাসূলের সুন্নাত মানে রাসূলের আদর্শ, রাসূলের কর্মবিধান। আর তা অনুসরণ না করা মানে তার বিপরীত কর্মাদর্শ মেনে চলা। তাহলে যে লোক রাসূলের বিপরীত কর্মাদর্শ পালন ও অনুসরণ করে চলবে, সে কিছুতেই ইসলামপন্হী হতে পারে না। সে কখনো মুসলিম হতে পারে না।



বিদ‘আত শব্দের অর্থ


বিদ‘আত (اَلْبِدْعَةُ)-এর আভিধানিক অর্থ : কোনরূপ পূর্ব-নমুনা না দেখে এবং অন্যকিছুর অনুকরণ-অনুসরণ না করেই কোন কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা। আর দ্বীনের ক্ষেত্রে যে বিদ‘আত সংঘটিত হয়ে থাকে, তার সংজ্ঞা হল-দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদ‘আত হচ্ছে এমন কোন বিষয় নবআবিষ্কার করা, যার অস্তিত্ব পূর্বে ছিলো না এবং যার প্রতি শরীয়তে কোনরূপ অনুমোদন নেই। তা শরীয়তের নিয়ম হিসেবে বা ছাওয়াবের কাজ মনে করে করাই হচ্ছে বিদ‘আত। (মিরকাত শরহে মিশকাত)

ইমাম নববী (রহ.) বলেন-“শরীয়তে এমন সব কাজ করা বিদ‘আত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। ”

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) বলেন-“হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল না এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করাকেই শরীয়তের পরিভাষায় বিদ’আত বলা হয়। (মিরকাত)

বিদ‘আত সম্পর্কে হাদীস শরীফে সতর্ক করা হয়েছে। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ

“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে-যা এই দ্বীনের মধ্যে নেই, তা বাতিল বলে গণ্য হবে। ”

(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন-“যে লোক ইসলামে এমন কোন বিষয় প্রবেশ করাবে এবং তাকে ইসলামের কাজ বলে চালিয়ে দিবে, যার অনুকূলে কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল বিদ্যমান নেই, তা-ই প্রত্যাহারযোগ্য। আর এরই অপর নাম বিদ‘আত। ” (মিরকাত, শরহে মিশকাত)

আল্লামা আইনী (রহ.) স্বীয় উমদাতুল ক্বারী গ্রন্হে বলেন-“মূলত বিদ‘আত হল এমন নতুন কাজ আবিষ্কার করা যার কোন অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল না।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বুখারী শরীফের শরাহ-গ্রন্হ ‘ফাতহুল বারী’তে বলেন-“বিদ‘আতের অর্থ হলো-এমন নতুন কাজ-যার কোন দৃষ্টান্ত পূর্ববতর্ী যুগে নেই। আর শরীয়তের পরিভাষায় যা সুন্নাতের পরিপন্হী, তা নিন্দনীয়।

মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (রহ.) ‘তা‘লীমুল ইসলাম’ কিতাবে বলেন-“বিদ‘আত ওই বিষয়গুলোকে বলা হয়, যার ভিত্তি শরীয়তে বিদ্যমান নেই। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীসে যার দলীল পাওয়া যায় না এবং সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়ীন ও তাবি-তাবিয়ীনদের যুগে যার অস্তিত্ব ছিল না, অথচ দ্বীনের কাজ মনে করে তা পালন করা হয়।

মাওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানী (রহ.) স্বীয় তাফসীরগ্রন্হে বলেন-“কুরআন-সুন্নাহ এবং খাইরুল কুরুন অর্থাৎ প্রাথমিক তিন যুগে যে কাজের মূল ভিত্তি নেই, তা দ্বীনের কাজ মনে করে করাই হলো বিদ‘আত।

 

বিদ‘আতের প্রকারভেদ


সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত ধারণা হল-বিদ‘আত দু’প্রকার। একটি হলো বিদ‘আতে হাসানাহ অর্থাৎ ভাল বিদ‘আত এবং অপরটি হলো বিদ‘আতে সাইয়্যিআহ অর্থাৎ মন্দ বিদ‘আত। বিদ‘আতের এই বিভাগও একটি অভিনব বিদ‘আত। কেননা, বিদ‘আত মাত্রই মন্দ। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে- كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ“প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। ” সুতরাং বুঝা গেলো-ইসলামে ভাল বিদ‘আত বলতে কিছু নেই।

অথচ একশ্রেণীর মানুষ বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ দু’ভাগে করে বহুসংখ্যক বিদ‘আতকে ভাল বানানোর প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। যা নিতান্তই নিন্দনীয়।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং তাদের ভ্রষ্ট পথ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। যেমন, তিনি প্রায়ই খুতবায় ইরশাদ করেন-

إِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ

“সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হিদায়াত হলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথনির্দেশনা। আর সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হলো নব-আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ। অনন্তর প্রতিটি বিদ‘আত গোমরাহী এবং প্রতিটি গোমরাহী দোজখের মধ্যে পড়বে। ” (সহীহ বুখারী)

অপর এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ , وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ

“সাবধান, তোমরা নব-আবিষ্কৃত কাজসমূহ থেকে দূরে থাকবে। কারণ, প্রতিটি নব-আবিষ্কৃৃত কাজই বিদ‘আত আর প্রত্যেক বিদ‘আতই হচ্ছে গোমরাহী। ” (সুনানে আবু দাউদ)

বস্তুত বিদ‘আতে হাসানা বা সাইয়্যিআহ-এর যে বিভক্তি করা হয়, আসলে তা হলো আভিধানিক অর্থে, শরীয়তের পরিভাষায় নয়। যেমন-হযরত উমর (রা.) জামা’আত সহকারে নিয়মিত ২০ রাক‘আত তারাবীহ আদায়ের আয়োজনকে উত্তম বিদ‘আত বলেছেন। এটা তিনি বলেছেন আভিধানিক অর্থ হিসেবে অর্থাৎ বিষয়টি নতুনভাবে ইন্তিজামের সাথে চালু করা হয়েছে-যদিও তার আমল ইসলামে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিলো।

অনুরূপ দ্বীনী ইল্‌মকে জিন্দা রাখার জন্যে নিয়মিত মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, কুরআন হাদীসের সঠিক জ্ঞানলাভের জন্যে নাহু, সরফ, বালাগাত, মান্তেক ইত্যাদি ইলমের অধ্যায় তৈরী করা, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের নব-আবিষ্কৃৃত যানবাহন এবং যোগাযোগের যাবতীয় যন্ত্রপাতি, মাইক্রোফোন, টেলিফোন, মোবাইল, রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার ইত্যাদি এবং বাসা-বাড়ীর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন-বিদ্যুৎ, লাইট, ফ্যান, এসি, ফ্রিজ ইত্যাদি নব-শাব্দিক অর্থে আবিষ্কৃত হলেও পারিভাষিক অর্থে বিদ‘আত নয়। কেননা, এগুলো কেউ ইসলামের আমল বা ছাওয়াবের বিষয় মনে করে ব্যবহার করে না। দুনিয়াবী জরুরতের জন্য ব্যবহার করে।

সুতরাং মূলকথা এই দাঁড়ালো যে, সুন্নাতে রাসূলের মধ্যে নেই বা সাহাবায়ে কিরামের আমলেও নেই অথবা আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ইজতিহাদপ্রসূতও নয়, বরং তাদের যুগের পরের লোকেরা নিজেদের খেয়াল-খুশী তো ইবাদত-বন্দেগীর নামে যেসব নতুন বিষয় সৃষ্টি করেছে অথবা খাইরুল কুরুনের কোন বিষয়ের মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-সংকোচন বা সংশোধনের পথ অবলম্বন করা হয়েছে, এসবই হলো মনগড়া আমল বা বিদ‘আত।

সকল মুসলমানের এ বিদ‘আত থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। বরং সকলের ঈমানী দায়িত্ব হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত অনুসারে জীবন নির্বাহ করা।

আল ইগতিয়াল : গুপ্তহত্যার বিষয়ে ইসলামী বিধান – শাইখ আবু জান্দাল আল আযদী (ফারিস আল জাহরানি)







আল ইগতিয়াল : গুপ্তহত্যার বিষয়ে ইসলামী বিধান – শাইখ আবু জান্দাল আল আযদী (ফারিস আল জাহরানি)

গুপ্ত হত্যার শর্ত


১) যে ব্যক্তি এ কাজ করবে তাকে অবশ্যই সঠিক ইসলামী আকীদার ধারক হতে হবে।
২) যাকে হত্যা করা হবে তাকে অবশ্যই ইসলামী শরিয়া মোতাবেক এই শাস্তির উপযুক্ত হতেহবে অর্থাৎ শুধু হত্যা যোগ্য অপরাধ হলেই চলবে না যেমন ব্যভিচার বা হত্যা; বরং নিশ্চিতভাবে এমন প্রকৃতির অপরাধী হতে হবে যার উপর এই শাস্তি প্রয়োগের বৈধতা রয়েছে।

ইসলামি শরিয়াতে গুপ্ত হত্যার বৈধতা!

মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনী অধ্যয়ন করলে একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাদের জিহাদ তথা সামরিক কৌশল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুপ্ত হত্যা ছিলো একটি শিল্প হিসেবে বিবেচ্য বিষয় এবং তাদের সামরিক কর্মকাণ্ডের একটি অন্যতম অংশ। আল্লাহর পথে জিহাদ ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য হুকুম আহকাম ইসলামে যেমন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তেমনি একই হুকুমের আওতাভুক্ত হবে গুপ্তহত্যার এই শিল্প কলা।
আমরা এই আলোচনায় কাফেরদের নেতৃস্থানীয় যে সব লোকেরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো, যেসব লোকেরা আল্লাহ্*তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে কষ্ট দিয়েছিল তাদেরকে হত্যার কিছু ঘটনা তুলে ধরবো, এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআন ও হাদিসের ভাষ্যসমুহ উপস্থাপন করব, সালাফ আস সালেহীন ওলামায়ে কেরামগন তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কিতাব সমুহে এসব ভাষ্য ও ঘটনা থেকে যেসব ফিকহী মাসআলা মাসায়েল বের করেছেন তা পেশ করবো। আমাদের পাঠকদের সদয় অবগতির জন্য মুল আলোচনা আরম্ভ করার আগেই স্বরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ‘আইম্মাতুল কুফুর’ বা কুফুরের নেতাদের গুপ্তহত্যার বৈধতা এমনই একটি স্বতঃসিদ্ধ মাসআলা যে সালাফ আস সালেহীনদের কেউই এর বৈধতার ব্যপারে দ্বিমত পোষণ করেননি।

কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গুপ্ত হত্যার দলীল


১ম দলীলঃ কাফির মুশরিকদের হত্যার সাধারণ বিধান

আল্লাহ্* রব্বুল আলামিন ঈমানদারদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-

 

فَاقْتُلُواالْمُشْرِكِينَحَيْثُوَجَدْتُمُوهُمْوَخُذُوهُمْوَاحْصُرُوهُمْوَاقْعُدُوالَهُمْكُلَّمَرْصَدٍ

তোমরা মুশরিকদেরকে হত্যা করো যেখানেই তাদেরকে পাও, তাদেরকে ধরো, তাদেরকে বেঁধে ফেলো, তাদেরকে হত্যার জন্য ঘাটিতে ওঁত পেতে অপেক্ষা করতে থাকো। (সূরা আত তাওবা, আয়াত ৫)

এ আয়াতে গুপ্ত হত্যার বৈধতার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ইমাম কুরতুবী রহঃ এ আয়াতের ‘উকু‘দু লাহুম কুল্লা মারসদ‘ এর ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ হলো,

اقعدوالهمفيموضعالغرةحيثيُ رصدون

অর্থাৎ তাদের উপর আক্রমন করার জন্য, তাদেরকে হত্যা করার জন্য, অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমনের জন্য গোপন ঘাটিতে ওঁত পেতে থাকো।
এরপর ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন,

وهذادليلعلىجوازاغتيالهمقب لالدعوة

অর্থাৎ এ আয়াতের মধ্যে এ কথার স্বপক্ষে দলীল রয়েছে যে মুশরিদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পূর্বেও হত্যা করা বৈধ।
(তবে মনে রাখা দরকার যে এ হুকুম কেবল রক্ষণাত্নক জিহাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কেননা আক্রমনাত্নক যুদ্ধের ক্ষেত্রে অবশ্যই আক্রমন শুরু করার পূর্বে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে।)
এই আয়াত কুফফারদের ধরার জন্য গোপন ঘাটি তৈরী, তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা ও তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার বৈধতা দেয়। এ কারণে মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ ইমাম ইবনুল আরাবী রহঃ তার তাফসীর গ্রন্থ আহকামুল কুরআনে বলেন ‘আমাদের ফকীহগন তাদেরকে হত্যার জন্য ওঁত পেতে থাকা এবং তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দেয়ার পূর্বে গুপ্তভাবে হত্যা করা প্রসঙ্গে বলেন যে এ হত্যার ব্যপারে যথেষ্ট মজবুত দলীল প্রমাণ রয়েছে’।
ইমাম ইবনে কাসীর রহঃ তার তাফসীর গ্রন্থে এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে বলেন – وَاحْصُرُوهُمْوَاقْعُدُوا لَهُمْكُلَّمَرْصَد

لاتكتفوابمجردوجدانكملهمبل اقصدوهمبالحصارفيمعاقلهموح صونهموالرصدفيطرقهمومسالكه محتىتضيقواعليهمالواسعوتضط روهمإلىالقتلأوالإسلام

অর্থাৎ ‘তাদেরকে তোমাদের হাতের নাগালে পেয়ে তারপর হত্যা করবে শুধু এমন চিন্তা করে বসে থাকা যথেষ্ট নয়; বরং এ আয়াত বলছে যে তোমরা তাদের বাড়ি ঘরে, তাদের শহর নগরে গিয়ে তাদেরকে আক্রমন করো, ঘাটি স্থাপন করো, ওঁত পেতে থাকো, তাদেরকে ঘিরে ফেলে অবরোধ করে রাখো যাতে করে পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং তারা এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় যে হয় যুদ্ধ করতে হবে অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে হবে’।
বিংশশতাব্দিতে বিশ্বব্যপি জিহাদকে পুনরুজ্জীবনের প্রান পুরুষ মুজাহিদ শায়খ শহীদ ডঃ আব্দুল্লাহ আযযাম রহঃ তার সুরা আত তাওবার তাফসীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে কুফফারদেরকে সতর্ক করার পূর্বেই তাদেরকে গুপ্তভাবে হত্যা করা জায়েয; আর এখানে যেহেতু আল্লাহ্* তায়ালা একাজের হুকুম দিয়েছেন অতএব গুপ্ত হত্যার আমল একটি সুস্পষ্ট বোধগম্য ফরয হুকুম।



২য় দলীলঃ কিসাস বা সমান শাস্তির বিধান প্রয়োগ

আল্লাহ্*রব্বুল আলামিন এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বলেন-

فمناعتدىعليكمفاعتدواعليهبمثلمااعتدىعليكم

যে তোমাদের উপর বাড়াবাড়ি করেছে তোমরাও তার উপর ঠিক ততো খানি বাড়াবাড়ি করবে যতো খানি তারা তোমাদের উপর করেছে।(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৯৪)

 

والذينإذاأصابهمالبغيهمينتصرونوجزاءسيئةسيئةمثلهافمنعفاوأصلحفأجرهعلىاللهإنهلايحبالظالمينولمنانتصربعدظلمهفأولئكماعليهممنسبيلإنماالسبيلعلىالذينيظلمونالناسويبغونفيالأرضبغيرالحقأولئكلهمعذابأليم

(ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হল) তারা যখন অন্যায় বাড়াবাড়ির শিকার হয় তখন তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে; আর দুষ্কৃতির বদলা হল তার সমপরিমাণ দুষ্কৃতি; তবে (কল্যাণকর মনে করে) যে মাফ করে দেবে এবং সংশোধন করে দেবে তার বিনিময় আল্লাহ্*র কাছে রক্ষিত; নিশ্চয়ই তিনি যালিমদেরকে মোটেই ভালোবাসেন না। আর যুলমের শিকার হয়ে যদি কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করে তবে তাদের উপর কোন অভিযোগ দায়ের করা চলবে না; অভিযোগ তো কেবল তাদের উপর যারা মানুষের উপর যুলুম করবেএবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করে বেড়াবে; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা আশ শূরা, আয়াত ৩৯-৪২)

 

وإنعاقبتمفعاقبوابمثلماعوقبتمبه

আর তোমরা যদি তোমাদের শত্রুদেরকে শাস্তি দাও তাহলে ঠিক সেইভাবে তাদেরকে শাস্তি দিবে যেভাবে তারা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। (সূরা আন নাহল, আয়াত ১২৬)

এ সকল আয়াত সমুহ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হলেও এর সামগ্রিক হুকুম সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য। কেননা আল কুরআনের কোন আয়াত বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হলেও সে আয়াতের হুকুম কেবল সেই ঘটনার সাথেই খাস নয় বরং একই রকম সকল ঘটনার ক্ষেত্রেই সে আয়াতের হুকুম সমান ভাবে জারী থাকবে। এ ব্যপারে ইসলামের মূলনীতি হল العبرةبعموماللفظلابخصوصالسبب অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণ করা হবে শব্দের সাধারণ অর্থের উপর ভিত্তি করে; শুধু আয়াত নাযিলের ঘটনার সাথে হুকুমকে খাস করা হবে না।
অতএব আজ কুফফাররা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন অভিযান পরিচালনা করে, গুপ্তচর বৃত্তি করে, ড্রোন আক্রমন করে মুসলিম জাতির বীর সন্তান মুজাহিদদেরকে হত্যা করে, নারী শিশু সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যা করে তাহলে আমাদের পক্ষেও যেভাবে সম্ভব আমরা তাদেরকে আমাদের গুপ্ত হত্যার শিকারে পরিণত করবো, আমরাও তাদের নেতাদেরকে হত্যা করবো, তাদের বেসামরিক সাধারণ মানুষ ওনারী শিশুদেরকে হত্যা করবো। তারা যদি আমাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করে আমরাও তাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করবো। তারা যদি আমাদের কাউকে অপহরণ করে আমরাও তাদের লোকদেরকে অপহরণ করবো, তারা আমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করে নিলে আমরাও তাদের সম্পদ বৈধ কারণে যেভাবে সম্ভব ছিনিয়ে নেব।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহঃ এ আয়াত সমূহের ব্যখ্যায় বলেন, এ সব আয়াত সমূহ প্রমাণ করেযে জান মাল, সহায় সম্পদ, ঘর বাড়ি নারী শিশু যাবতীয় ক্ষেত্রে সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ।
সমান প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধতা ইসলামী শরিয়তে এমনই স্বীকৃত একটি বিধান যে স্বয়ং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও এ কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা বা সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ; অতএব যে অপরাধের কারণে যে শাস্তি মুসলমানদের উপর প্রয়োগ বৈধ সে বিধান কুফফারদের ক্ষেত্রে তো সন্দেহাতীত ভাবে কার্যকর।
অতএব আমেরিকা ও তার দোসররা যেহেতু গোটা পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অবরোধ আরোপ করে ইরাকে নারী শিশু সহ দশ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করছে, আফগানিস্তানে আবাল বৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করে চলছে; ইয়েমেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে চলছে তাদের গোপন ড্রোন আক্রমন সেহেতু তাদের যে কোন নাগরিককে একই ভাবে পৃথিবীর যে কোন স্থানে যে কোন উপায়ে হত্যা করা, তাদের দেশে বোমা হামলা চালানো, তাদের নারী শিশুদেরকে হত্যা করা, তাদেরকে অপহরণ করা, তাদের টাকা পয়সা ধন সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া ও তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করা সম্পূর্ণ বৈধ।

আল্লাহ্*রব্বুল আলামিন এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বলেন-


فمناعتدىعليكمفاعتدواعليهبمثلمااعتدىعليكم

যে তোমাদের উপর বাড়াবাড়ি করেছে তোমরাও তার উপর ঠিক ততো খানি বাড়াবাড়ি করবে যতো খানি তারা তোমাদের উপর করেছে।(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৯৪)

 

والذينإذاأصابهمالبغيهمينتصرونوجزاءسيئةسيئةمثلهافمنعفاوأصلحفأجرهعلىاللهإنهلايحبالظالمينولمنانتصربعدظلمهفأولئكماعليهممنسبيلإنماالسبيلعلىالذينيظلمونالناسويبغونفيالأرضبغيرالحقأولئكلهمعذابأليم

(ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হল) তারা যখন অন্যায় বাড়াবাড়ির শিকার হয় তখন তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে; আর দুষ্কৃতির বদলা হল তার সমপরিমাণ দুষ্কৃতি; তবে (কল্যাণকর মনে করে) যে মাফ করে দেবে এবং সংশোধন করে দেবে তার বিনিময় আল্লাহ্*র কাছে রক্ষিত; নিশ্চয়ই তিনি যালিমদেরকে মোটেই ভালোবাসেন না। আর যুলমের শিকার হয়ে যদি কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করে তবে তাদের উপর কোন অভিযোগ দায়ের করা চলবে না; অভিযোগ তো কেবল তাদের উপর যারা মানুষের উপর যুলুম করবেএবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করে বেড়াবে; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা আশ শূরা, আয়াত ৩৯-৪২)

 

وإنعاقبتمفعاقبوابمثلماعوقبتمبه

আর তোমরা যদি তোমাদের শত্রুদেরকে শাস্তি দাও তাহলে ঠিক সেইভাবে তাদেরকে শাস্তি দিবে যেভাবে তারা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। (সূরা আন নাহল, আয়াত ১২৬)

এ সকল আয়াত সমুহ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হলেও এর সামগ্রিক হুকুম সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য। কেননা আল কুরআনের কোন আয়াত বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হলেও সে আয়াতের হুকুম কেবল সেই ঘটনার সাথেই খাস নয় বরং একই রকম সকল ঘটনার ক্ষেত্রেই সে আয়াতের হুকুম সমান ভাবে জারী থাকবে। এ ব্যপারে ইসলামের মূলনীতি হল العبرةبعموماللفظلابخصوصالسبب অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণ করা হবে শব্দের সাধারণ অর্থের উপর ভিত্তি করে; শুধু আয়াত নাযিলের ঘটনার সাথে হুকুমকে খাস করা হবে না।
অতএব আজ কুফফাররা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন অভিযান পরিচালনা করে, গুপ্তচর বৃত্তি করে, ড্রোন আক্রমন করে মুসলিম জাতির বীর সন্তান মুজাহিদদেরকে হত্যা করে, নারী শিশু সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যা করে তাহলে আমাদের পক্ষেও যেভাবে সম্ভব আমরা তাদেরকে আমাদের গুপ্ত হত্যার শিকারে পরিণত করবো, আমরাও তাদের নেতাদেরকে হত্যা করবো, তাদের বেসামরিক সাধারণ মানুষ ওনারী শিশুদেরকে হত্যা করবো। তারা যদি আমাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করে আমরাও তাদের শহর নগর বন্দরে বোমা বর্ষণ করবো। তারা যদি আমাদের কাউকে অপহরণ করে আমরাও তাদের লোকদেরকে অপহরণ করবো, তারা আমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করে নিলে আমরাও তাদের সম্পদ বৈধ কারণে যেভাবে সম্ভব ছিনিয়ে নেব।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহঃ এ আয়াত সমূহের ব্যখ্যায় বলেন, এ সব আয়াত সমূহ প্রমাণ করেযে জান মাল, সহায় সম্পদ, ঘর বাড়ি নারী শিশু যাবতীয় ক্ষেত্রে সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ।
সমান প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধতা ইসলামী শরিয়তে এমনই স্বীকৃত একটি বিধান যে স্বয়ং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও এ কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা বা সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ; অতএব যে অপরাধের কারণে যে শাস্তি মুসলমানদের উপর প্রয়োগ বৈধ সে বিধান কুফফারদের ক্ষেত্রে তো সন্দেহাতীত ভাবে কার্যকর।
অতএব আমেরিকা ও তার দোসররা যেহেতু গোটা পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অবরোধ আরোপ করে ইরাকে নারী শিশু সহ দশ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করছে, আফগানিস্তানে আবাল বৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করে চলছে; ইয়েমেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে চলছে তাদের গোপন ড্রোন আক্রমন সেহেতু তাদের যে কোন নাগরিককে একই ভাবে পৃথিবীর যে কোন স্থানে যে কোন উপায়ে হত্যা করা, তাদের দেশে বোমা হামলা চালানো, তাদের নারী শিশুদেরকে হত্যা করা, তাদেরকে অপহরণ করা, তাদের টাকা পয়সা ধন সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া ও তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করা সম্পূর্ণ বৈধ।

৩য় দলীলঃ কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ড


এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিলো ৩য় হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখ রাতে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি দলকে প্রেরণ করেন, তিনি তাদেরকে বিদায় জানানোর সময় বলেন, ‘আল্লাহ্*র নামে তোমরা বেরিয়ে পড়ো, হে আল্লাহ্* তুমি তাদেরকে সাহায্য করো’ এর পর তিনি ঘরে এসে সালাত আদায় করতে থাকেন এবং তাদের সফলতার জন্য আল্লাহ্*র দরবারে কান্নাকাটি করে মোনাজাত করতে থাকেন।
জাবিররাঃ থেকে বর্ণীত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক দিন বলেন,

منلكعببنالأشرففإنهآذىالله ورسوله

‘কা’ববিন আশরাফকে হত্যার জন্য কে আছো? সে আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে কষ্ট দিয়েছে’।

আল্লাহ্*র রসূলের একথা শুনে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহরাঃ বলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ আপনি কি সত্যিই চান আমি তাকে হত্যা করে ফেলি? তিনি বলেন, হ্যা আমি তাই চাই। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহরাঃ বলেন, তাহলে আমাকে কিছু (মিথ্যা কথা) বলার অনুমতি দিন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমার যা প্রয়োজন বলো। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ কা’ব বিন আশরাফের কাছে এসে আল্লাহ্*র রসূলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন এ ব্যক্তি আমাদের কাছে শুধু সাদাকা চায়, সে তো আমাদেরকে মহা কষ্টে ফেলে দিয়েছে! তখন সে বলে যে, এখন পর্যন্ত আর কিইবা দেখেছো, সে তো তোমাদেরকে শেষ করে ছাড়বে। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ তখন বলেন, একবার যেহেতু তাঁর অনুসারীর খাতায় নাম লিখিয়েছি এখন আর তাঁর শেষ না দেখে ছাড়ছি না। যাই হোক শোনো, আমরা তোমার কাছে এসেছিলাম (এই বিপদের সময়) তুমি আমাদেরকে এক দুইসা’ ধার দেবে এই জন্য। সে বললো, আচ্ছা তা দেয়া যাবে তবে তার বিনিময়ে আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখতে হবে। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ বললেন আচ্ছা তুমিই বলো তুমি কী বন্ধক চাও; সে (নরপিচাশ) বললো, তোমাদের নারীদেরকে আমার কাছে বন্ধক রাখো। (রাগ ক্ষোভ সব চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকার ভান করে তার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে) তিনি বললেন, আমরা কিভাবে আমাদের নারীদেরকে তোমার কাছে বন্ধক রাখি অথচ তুমি হচ্ছো আরবের সবচেয়ে সুদর্শন সুপুরুষ! তারপর সে বললো, তাহলে তোমাদের সন্তানদেরকে বন্ধক রাখো; তিনি বললেন, কিভাবে আমরা আমাদের সন্তারদেরকে বন্ধক রাখি বলো, তাহলে তো লোকেরা গালাগালি দিয়ে তাদেরকে বলবে যে, এই তোদেরকেই তো মাত্র এক দু’ সা’ এর বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছিলো! তার চেয়ে বরং আমরা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তোমার কাছে বন্ধক রাখি। অবশেষে সে সম্মত হয়। তারা রাতে গোপনে তার সাথে দেখা করার কথা বলে চলে যান।
রাতের বেলা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ কা’ব বিন আশরাফের দুধ ভাই আবু নায়লাকে সাথে নিয়ে আসলেন। তারা দু’জন তাকে ডাক দিলে সে যখন নেমে আসতে যাচ্ছিলো তখন তার স্ত্রী তাকে বললো, ‘এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো? আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তার কথা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝড়ে পড়ছে’। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে সে বলেছে, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তার মুখের আওয়াজের সাথে রক্ত বেরিয়ে আসছে’। সে বললো, আরে! এতো আমার বন্ধু মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ ও আমার দুধভাই আবু নায়লা এসেছে, ওদের সাথে একটু কথা বলতে যাচ্ছি।
মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ আবু নায়লা ছাড়াও আরও দু’জনকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন আবু আবস বিন হাবর ও উব্বাদ বিন বিশার রাঃ। তিনি তাদেরকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন যে, তিনি তার ঘাড় ধরে যখন তার মাথা নুইয়ে দেবেন তখন যেন তারা তাদের কাজ সেরে ফেলে।
অতঃপর সে যখন নেমে এলো তারা বললো বাহ! তোমার শরীর থেকে তো চমৎকার সুঘ্রান আসছে! সে বললো, হ্যা তা তো হতেই পারে কারণ আমার কাছে রয়েছে আরবের সবচেয়ে সুগন্ধিনি নারী। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ বললেন আমি কি একটু তোমার চুল থেকে ঘ্রান শুঁকে দেখতে পারি? সে বললো, অবশ্যই, এই নাও শুঁকে দেখো; সে একবার শুঁকে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষন পর আবার বললো, (ওহ যা ঘ্রান!) আমাকে তোমার মাথাটা আরেকবার শুঁকতে অনুমতি দেবে? এবার সে তার মাথার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথাটা নিচু করে ধরে অন্যদের বললো, এবার তোমাদের কাজ সেরে ফেলো, আর তারা সাথে সাথে তাকে হত্যা করে ফেলে। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
কা’ব বিন আশরাফ নিহত হওয়ার পর তার জাতির ইহুদীরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, আমাদের একজন অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে আপনার অনুসারীদের দ্বারা গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বলেন, তার মতো একই রকম চিন্তার যেসব লোকেরা পালিয়ে গেছে তাদের মতো সেও যদি পালিয়ে যেত তাহলে তার এই দশা হতো না, কিন্তু সে আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আমাদেরকে অপমান করেছে; আর ভবিষ্যতেও কেউ যদি এমন দুঃসাহস দেখায় তাহলে সেও তার ঘাড়ের উপর তলোয়ার ছাড়াকিছু দেখতে পাবে না। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ওসীরাতে ইবনে হিশাম)
ফতহুল বারী গ্রন্থে ইবনে হাজার রহঃ ইকরামা রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর গোটা ইহুদী সম্প্রদায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের কাছে এসে তাদের নেতার গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা তাকে জানায়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রক্ত পনের ব্যপারে কোন কথা না বলে বরং তাদেরকে তিনি মনে করিয়ে দিতে লাগলেন যে সে আল্লাহ্* তায়ালা, তাঁর রসুল ও ঈমানদারদের সম্পর্কে কি সব আপত্তিকর কথাবার্তা বলে বেড়াতো। এত টুকুতেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে ভবিষ্যতেও যদি কেউ তার মতো আচরণ করে তাহলে তার পরিণতিও একই রকম হবে। হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ বলেন কাউকে দাওয়াহ না দিয়ে হত্যার বৈধতার ব্যপারে এ ঘটনা একটি মজবুত দলীল।
কা’ব বিন আশরাফের কুকীর্তির মধ্যে অন্যতম ছিল সে মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা দিতো, আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আপত্তিকর কথাবার্তা বলতো এবং মুসলিম নারীদের সম্পর্কে অশ্লীল কবিতা রচনা করতো ইত্যাদি।
হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ এ প্রসঙ্গে আরও বলেন,

وفيهجوازقتلالمشركبغيردعوة إذاكانتالدعوةالعامةقدبلغت ه

এ ঘটনার মধ্যে সাধারন ভাবে ইসলামের দাওয়াত সবার কাছে পৌঁছে গেলে যে কোন মুশরিককে ব্যক্তিগত ভাবে ইসলামের দাওয়াত না দিয়ে হত্যা করার বৈধতা রয়েছে।
ইমাম বুখারী রহঃ এ হাদিসটিকে জিহাদ অধ্যায়ে ‘যুদ্ধে মিথ্যা বলা’ অনুচ্ছেদে সংকলণ করেছেন।
ইমাম নববী রহঃ এ হাদিসের ব্যখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “কা’ব বিন আশরাফই প্রথম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে নিরাপত্তা চুক্তি লংঘন করেছে, আর মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রাঃ ও তাকে প্রথমে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে তারপর তাকে হত্যা করেছেন বিষয়টি এমন নয়। কাযী আইয়ায রহঃ সহীহ মুলিমের শরাহ গ্রন্থ আল মিনহাজের মধ্যে বলেন, ‘কারো জন্য একথা বলা বৈধ নয় যে কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ড কোন বিশ্বাসঘাতকতা ছিল’; আলী ইবনে আবী ত্বালিব রাঃ এর মজলিসে কোন এক ব্যক্তি এমন মন্তব্য করলে তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন”।
অতএব আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত কোন কাফিরকে গুপ্ত হত্যা করাকে যদি কোন ব্যাক্তি গাদ্দারি বা বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যায়িত করে কিংবা বলে যে এভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা ইসলামে হারাম তাহলে সে ব্যক্তি নির্ঘাত আল্লাহ্*র কিতাব ও রসূলের সুন্নাহকে মিথ্যা সাব্যস্তকারী পথভ্রষ্ট।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ ‘আস স-রিমুল মাসলুল’ গ্রন্থে এ হাদিসের উপর আলোচনা পেশ করে বলেন ‘আল আযা’ শব্দটি প্রয়োগ হয় এমন লঘু শ্রেনীর দুষ্কৃতি বুঝানোর জন্য যার দ্বারা মানুষের অন্তরে কষ্ট দেয়া হয় পক্ষান্তরে ‘যারার’ শব্দটি ব্যবহার হয় সক্রিয় ভাবে চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কাউকে (মানসিক শারীরিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ভাবে) প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে। তাই নিছক ‘আযা’ এর কারণেই যেখানে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ ব্যক্তিকে হত্যা করা আবশ্যক হয়ে যায় সেখানে কেউ যদি আল্লাহ্* তায়ালা কিংবা তাঁর রসুলকে গালি গালাজ করে, দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেতা হলে তার হুকুম কী হতে পারে তা সকলেরই জানা। আর একটি বিষয় হলো এ ঘটনা প্রমাণ করে যে আল্লাহ্*তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে যে কষ্ট দিবে তাকে হত্যা করা যে কোন মুসলমানের জন্য হালাল। এ ঘটনা আরও প্রমাণ করে যে আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে যদি কেউ কষ্ট দেয়, তাদের প্রতি অপমানজনক বা অশোভনীয় কোন কাজ যদি কেউ করে তাহলে তার সাথে মুসলমানদের সম্পাদিত সকল শান্তি চুক্তি স্বয়ংক্রিয় ভাবে বাতিল হয়ে যায়।


৪র্থ দলীলঃ ইবনে আবুল হুকায়েক আবু রাফে’র হত্যাকাণ্ড


আবুরাফে’ ছিলো খায়বার অঞ্চলে বসবাসকারী একজন ইহুদী নেতা, হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। এই ব্যক্তি ছিলো সেসব লোকদের অন্যতম যারা মক্কার মুশরিদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উস্কানি দিতো। সে খন্দক যুদ্ধে মক্কার মুশরিকদেরকে উস্কানি দাতাদের অন্যতম হোতা। ৫ম হিজরী সনের যুলকা’দাহ কিংবা যুলহজ্জ মাসেতাকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার সুত্রপাত হিসেবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক ইমাম যুহরী, আব্দুল্লাহ ও কা’ব বিন মালেক রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন যে, আওস এবং খাযরাজ গোত্রের লোকেরা একে অপরের সাথে ইসলামের জন্য যুদ্ধে কোন গোত্র কেমন ভুমিকা পালন করেছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতো। অন্যান্য দিক থেকে উভয় গোত্র প্রায় সমান সমান থাকলেও আওস গোত্র দ্বারা সংগঠিত কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ডের মতো কোন উদাহরণ খাযরাজ গোত্রের লোকেরা উপস্থাপন করতে পারলো না। তখন তারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললো, ইয়া রসুলাল্লাহ, আপনি আমাদেরকে এমন এক ব্যক্তির নাম বলে দিন যাকে হত্যা করে আমরা আওস কর্তৃক কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার কৃতিত্বের সমতা রক্ষা করতে পারি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাদেরকে আবু রাফে’কে হত্যার নির্দেশ দেন।
এই অভিযানে পাঁচজন সাহাবীর একটি জামাহ অংশ নেয়। তারা হলেন (১) আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক (২) মাসউদ বিন সিনান (৩)আব্দুল্লাহ বিন উনায়স (৪) আবু কাতাদা বিন হারিস (৫) খুযা’য়ী বিন আল আসওয়াদ রাঃ।
সহীহ আল বুখারিতে বারা বিন আযিব রাঃ এর সুত্রে বর্ণীত রয়েছে যে তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের একটি দলকে ইহুদী আবু রাফে’কে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন (আবু আতীক রাঃ) এগিয়ে গিয়ে ইহুদীদের দুর্গে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমি গিয়ে তাদের পশুর আস্তাবলে প্রবেশ করলাম আর তারা দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিল। এদিকে তাদের একজনের একটি গাধা হারিয়ে গিয়েছিলো; তারা গাধাটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লে আমিও গাধা খোঁজার ভান ধরে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তাদেরকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমিও তাদের সাথে গাধা খোঁজ করছি। অবশেষে গাধাটি পেয়ে গেলে তারা যখন দুর্গে প্রবেশ করে তখন আমিও তাদের সাথে আবার দুর্গে প্রবেশ করি। তারপর আমি লক্ষ করলাম যে তারা দুর্গের ফটক বন্ধ করে চাবিটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিলো।অতঃপর তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি চাবি নিয়ে ফটক খুলে রেখে (অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে) আবু রাফে’র ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। আমি ‘ও আবু রাফে’ বলে ডাক দিলে সে আমার ডাকে সাড়া দিলো। আমি তার আওয়াজ দ্বারা তার অবস্থান অনুমান করে তরবারির আঘাত হানলাম, আর অমনি সে চিৎকার করে উঠলো; আর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যেন তার সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এসেছে এমন ভান করে আমি আবার ঘরে প্রবেশ করে গলার স্বর পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও আবু রাফে’ (চিৎকার করলে কেন) তোমার কী হয়েছে? সে বলল, তোমার মা ধ্বংস হোক (তাড়াতাড়ি আসছো না কেন) কি হল তোমার, কে যেন আমার ঘরে ঢুকে আমাকে আঘাত করেছে। তিনি (আবু আতীক) বলেন, অতঃপর আমি আমার তরবারি তার পেটের উপর রেখে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলাম যে তার (মেরুদণ্ডের) হাড্ডি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকার শব্দ হল। (এরপর তার চিৎকারে ও বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দে অন্যরাও জেগে উঠে দরজা খুলতে লাগলো) অতঃপর আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে গিয়ে পড়ে গেলাম এবং এতে আমার পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। যাই হোক কোন মতে আমি বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলাম। আমি তাদেরকে বললাম, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি (আবু রাফে’র) মৃত্যু সংবাদ প্রচারকারিণীর ঘোষণা শুনতে না পাই ততক্ষন পর্যন্ত আমি এ স্থান ত্যাগ করবো না। সত্যিই হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবু রাফে’র মৃত্যু সংবাদ না শুনে আমি সে স্থান ত্যাগ করলাম না। মৃত্যু সংবাদ যখন আমি শুনলাম তখন আমি দাড়িয়ে গেলাম এবং আমার যেন কোন ব্যথাই ছিলো না। অবশেষে আমি আল্লাহ্*র রসূলের কাছে গিয়ে আবু রাফে’কে হত্যার খবর দিলাম। (বুখারী হাদিস নং ৩০২২, ৩০২৩, ৪০৩৮-৪০৪০; আধুনিক প্রকাশনীর ছাপায় হাদিস নং২৮০০ এবং ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ছাপায় হাদিস নং ২৮১০)
(বিভিন্ন হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থে এ ঘটনার আরও খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। আগ্রহী পাঠকগণ চাইলে তা পড়ে আরও বেশী উপকৃত হতে পারেন।)
এক বর্ণনায় রয়েছে যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসার পর তিনি তার পায়ের ব্যথার স্থানে তাঁর মুবারক মুখের থুথু লাগিয়ে দেন এবং আবুল আতিক রাঃ বলতেন এরপর তিনি কখনো সেখানে কোন ব্যথা অনুভব করেননি।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় অবশ্য রয়েছে যে তারা পাঁচজনই দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স রাঃ তার উপর তরবারির আঘাত হানেন; আব্দুল্লাহ বিন আতিক রাঃ এর পা ভেঙ্গে যায় এবং তারা তাকে ধরাধরি করে বের করে নিয়ে আসেন ইত্যাদি।
হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ এই হাদিসের ব্যখ্যায় ফতহুল বারী গ্রন্থে বলেন, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছে এমন মুশরিকদেরকে হত্যার বৈধতা সহ আল্লাহ্*র রসূলের (আনীত দ্বীনের) বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে শক্তি সম্পদ কিংবা জবান দ্বারা কেউ যদি তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে তাদেরকে যে কোন উপায়ে হত্যা করা এবং যুদ্ধরত কাফিরদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির ব্যপারে এ ঘটনা থেকে বৈধতা পাওয়া যায়।


৫ম দলীলঃ খালিদ বিন সুফিয়ান আল হুযায়লীর হত্যাকাণ্ড

খালিদ বিন সুফিয়ান ছিল বনু হুযায়ল গোত্রের লোক। সে আল্লাহ্*র রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মদীনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেছিল। ইমাম আহমাদ রহঃ তার মুসনাদে এবং অন্যন্য অনেক হাদিস সংকলকগন আব্দুল্লাহ বিন উনায়স রাঃ থেকে এ ঘটনার বর্ণনা সংকলন করেছেন। তিনি বলেন,

دعانيرسولاللهصلىاللهعليهو سلمفقال: إنهقدبلغنيأنخالدبنسفيانال هذلييجمعليالناسليغزونيفائ تهفاقتله

একদিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডেকে বলেন ‘আমার কাছে এই সংবাদ এসেছে যে খালিদ বিন সুফিয়ান আল হুযায়লী আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোকজন জড় করছে, অতএব তুমি গিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলো’।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنلسفيانالهذلييهجونيويشت منيويؤذيني

‘সুফিয়ান আল হুযায়লীকে শায়েস্তা করার মতো কে আছো? সে আমাকে অপমান করছে, কষ্ট দিচ্ছে!’

আব্দুল্লাহ বিন উনায়স রাঃ বলেন, আমি আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, আপনি আমার কাছে তার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন যাতে আমি তাকে চিনতে পারি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার চেহারার দিকে তাকালেই তোমার মধ্যে একটা ঘৃণা ও বিরক্তির উদ্রেক হবে। এরপর আমি প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হয়ে পড়লাম, আমি যখন তার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম তখন ঠিক তেমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম যেমনটি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছিলেন। তাকে দেখলাম সে অস্থিরতার সাথে কাঁপছে আর পায়চারী করছে। সেখানে দেখলাম কিছু পতিতাদের আনাগোনা রয়েছে যারা তার কাছে আসা যাওয়া করতো। আমাকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কে? আমি বললাম, আমি আপনার কথা শুনে এবং আপনার বাহিনী প্রস্তুত করার খবর শুনে যোগ দিতে এসেছি। আমি তার সাথে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলাম, এরপর (এক নির্জন গলি পথে এসে) সে যেই আমাকে সুযোগ করে দিলো আমি অমনি তার উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম এবং হত্যার পর রাস্তার ইটা বালু পাথর ইত্যাদি দিয়ে তাকে ঢেকে ফেললাম।

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেন ‘অতঃপর রাত গভীর হয়ে পড়লে লোকেরা যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন আমি চুপচাপ তাকে হত্যা করে তার মাথা কেটে নিয়ে এলাম। তারপর যখন তার কাটা মাথা নিয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলাম তখন তিনি আমাকে দেখেই বললেন, – أفلحالوجهঅর্থাৎ তোমার চেহারা সফলতায় উদ্ভাসিত হয়েছে; আমি বললাম ইয়া রসুলাল্লাহ আমি আল্লাহ্*র ইচ্ছায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বললেন, তুমি সত্য বলেছো। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে তাঁর ঘরে প্রবেশ করে আমাকে একটি লাঠি উপহার দিয়ে বললেন, হে আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স, এই লাঠিটি কেয়ামতের দিন আমার ও তোমার মাঝে (সম্পর্কের) নিদর্শন স্বরূপ তোমার কাছে রেখে দাও।

– إنأقلالناسالمتخصرونيومئذٍ

খুব কম মানুষই সেদিন এমন লাঠির অধিকারী হবে।

বর্ণনাকারী বলেন, আব্দুল্লাহ রাঃ সেই লাঠিটিকে তার তলোয়ারের সাথে লাগিয়ে রেখেছিলেন, তিনি সেটিকে সব সময় সাথে সাথে রাখতেন এমনকি মৃত্যুর সময় তিনি এটি তার সাথে দিয়ে দিতে নির্দেশ দেন; আর এভাবে সে লাঠিটি তার কাফনের মধ্যে দিয়ে তাকে দাফন করা হয়।


ষষ্ট দলিল: ইহুদী নারীর হত্যাকান্ড

ইমাম শা’বী রহঃ হযরত আলি রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন, এক ইহুদী মহিলা ছিল যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি গালাজ করতো এবং তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন রকম আপত্তিকর মন্তব্য করতো। অতঃপর এক ব্যক্তি তার শ্বাসনালী চেপে ধরে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকে মেরে ফেলে। এ ঘটনা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলে তিনি সে মহিলার কোন রক্তমুল্য পরিশোধের নির্দেশ দেননি। ইমাম আবু দাউদ রহঃ ও অন্যান্য সংকলকগণ এঘটনা বর্ণনা করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন এ হাদিসটি উত্তম, কারণ ইমাম শা’বী রহঃ আলী রাঃ কে দেখেছেন এবং তার থেকে তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া এ বর্ণনা যদি মুরসাল শ্রেণীরও হয়ে থাকে তবে ইমাম শা’বী রহঃ জ্ঞানীদের কাছে সহীহ মুরসাল বর্ণনাকারী হিসেবেই পরিচিত। তার থেকে যতো মুরসাল বর্ণনা রয়েছেতা সবই সহীহ, আর তিনি আলী রাঃ বর্ণীত হাদিসের ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া এই হাদিসের অন্যান্য বর্ণনাকারীগণও নির্ভরযোগ্য এবং এর সমর্থনে ইবনে আব্বাস রাঃ এর বর্ণনাও রয়েছে। অতএব এ হাদিসটি হয় খবরে ওয়াহেদ অথবা এর অর্থের দিক থেকে অন্তত ওয়াহেদ শ্রেণীর; আহলে ইলমগন এ হাদিস এবং এমন অন্যান্য যেসব ঘটনা সাহাবীদের থেকে বর্ণীত রয়েছে তা থেকে দলীল গ্রহণে মোটেই ইতস্ততঃ করেননি।
এ ঘটনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, নারী হোক কিংবা পুরুষ, যিম্মী হোক বা চুক্তিবদ্ধ, এমনকি যদি মুসলিম নামধারীও হয় তবুও আল্লাহ্*র রসূলের শানে অসম্মান জনক কথা বললে তাকে হত্যা করা সম্পূর্ণ বৈধ। কারণ এ ঘটনায় অপরাধী হল একজন মহিলা এবং সে মদীনার চুক্তিবদ্ধ ইহুদী সম্প্রদায়ের লোক ছিল

সপ্তম দলীলঃ মুশরিকদের গুপ্তচরকে হত্যার ঘটনা


সালামা ইবনু আকওয়া রাঃ বর্ণনা করেন একবার রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন এক সফরের সময় তাঁর কাছে মুশরিকদের পাঠানো একজন গুপ্তচর আসলো। সে এসে তাঁর সাহাবীদের সাথে বসে বেশ কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে চলে গেলো। এরপর (যখন তিনি জানতে পারলেন যে সে গুপ্তচর ছিলো তখন) তিনি বললেন اطلبوهواقتلوه তাকে খুঁজে বের করে এনে হত্যা করে ফেলো। তারপর (কোন এক সাহাবী) তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করে ফেলে; রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহতের কাছে থাকা মালামাল হত্যাকারীকে প্রদান করেন। (সহীহ আল বুখারী হাদিসনং ৩০৫১, সহীহ মুসলিম হাদিস নং ১৭৫৩, আধুনিক প্রকাশনীর ছাপায় বুখারির হদিসনং ২৮২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছাপায় বুখারির হাদিস নং ২৮৩৩; মুসনাদে আহমাদ হাদিস নং ১৬৫২৩)

অষ্টম দলীলঃ আসমা বিনতে মারওয়ানের হত্যাকাণ্ড



শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ তার‘আস স-রিমুল মাসলুল আ’লা শাতিমির রসুল’ নামক গ্রন্থে এবং ইমাম মাকরিযী রহঃ‘ইমতাউল ইসমা’ নামক গ্রন্থে এ ঘটনাটি সংকলন করেছেন।

ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, খুতামা গোত্রের এক মহিলা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের শানে অপমান জনক কথাবার্তা বলতো; রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক দিন বলেন, আমার পক্ষ থেকে তাকে শায়েস্তা করার কে আছো? সেই মহিলার গোত্রের এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বলল, আমি আছি ইয়া রসুলাল্লাহ। অতঃপর সে তাকে হত্যা করে এসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খবর দেয়। তিনি খবর শুনে (তার রক্তপন প্রসঙ্গে) তিনি বলেন দু’টো রাম ছাগলও তার (রক্তপণের) ব্যাপারে বাদানুবাদ করতে পারে না। (অর্থাৎ তার রক্তপন পরিশোধের কোন প্রশ্নই ওঠে না)
আসহাবুল মাগাযী বা যুদ্ধের ঘটনা সংকলকগনের অনেকেই আরও বিস্তারিতভাবে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইমাম ওয়াকেদী রহঃ বলেন, আব্দুল্লাহ বিন হারিস ফুযায়ল থেকে তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করে যে আসমা বিনতে মারওয়ান ছিল ইয়াযিদ বিন হিসান আল খত্তামির অধিনস্ত। সে আল্লাহ্*র রসুলকে কষ্ট দিতো এবং ইসলামের সমালোচনা করত এবং এ উদ্দেশ্যে সে কবিতা রচনা করতো।
উমায়র বিন আদি আল খত্তামী রাঃ এই দুষ্ট মহিলার কথাবার্তা শুনে বলেন, হে আল্লাহ্* আমি তোমার নামে একটি মান্নত করছি, আমি যদি মদিনায় ফিরতে পারি তাহলে আল্লাহ্*র রসূলের তরফ থেকে আমি তাকে হত্যা করবো। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর থেকে ফিরে আসার পর এক রাতে উমায়র বেরিয়ে পড়েন তার মিশন সফল করতে। তিনি গভীর রাতে এসে তার ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি অন্ধকারে হাতড়ে তাকে বের করে বুঝতে পারেন পান যে সে তার এক বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। তিনি বাচ্চটিকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পেটের মধ্যে তলোয়ার ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেন। মিশন শেষ করে এসে তিনি আল্লাহ্*র রসূলের সাথে ফজর সালাত আদায় করেন।অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমায়রের দিকে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি আসমা বিনতে মারওয়ানকে হত্যা করে ফেলেছ? তিনি বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য করবান হোক ইয়া রসুলাল্লাহ, হ্যা আমি তাকে হত্যা করেছি।
উমায়র রাঃ ভয় পাচ্ছিলেন যেসে মহিলাকে হত্যার কারণে আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আবার কোন ঝামেলা এসে পড়ে কি না; তাই সংশয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রসুলাল্লাহ এ কারণে কি আমার উপর (রক্তমুল্য পরিশোধের) কোন দায় ভার বর্তাবে? তিনি বলেন তার (রক্তমুল্যের) ব্যাপারে দুটো রাম ছাগলও বাদানুবাদ করতে পারে না। অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আশপাশে যারা ছিল তাদেরকে লক্ষ করে বললেন, তোমাদের যখন মন চাইবে এমন কোন ব্যক্তির দিকে তাকাতে যে আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছে তখন তোমরা উমায়র বিন আদি এর দিকে তাকাবে। ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ তখন বলেন, তোমরা এই অন্ধ ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখ যে আল্লাহ্*র আনুগত্যে ঝাপিয়ে পড়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা শুনে বলেন-

لاتقلالأعمىولكنهالبصير

তাকে অন্ধ বল না সে তো চক্ষুষ্মান

উমায়ের রাঃ যখন আল্লাহ্*র রসূলের কাছ থেকে বেরিয়ে এসে তার নিজ গোত্রের এলাকায় আসলেন তখন লোকেরা সেই মহিলার দাফন কাফনে ব্যস্ত ছিলো। তারা তাকে মদিনার দিক থেকে আসতে দেখে সন্দেহ করলো; তাকে জজ্ঞাসা করলো, উমায়র! তুমিই কি এই মহিলাকে হত্যা করেছ? তিনি বললেন, হ্যা আমিই হত্যা করেছি,

فكيدونيجميعاثملاتنظرون

অতএব তোমরা সবাই মিলে আমাকে শায়েস্তা করার যে কোন ফন্দি আঁটতে পারো, আর আমাকে ( তা প্রতিরোধের) কোন অবকাশই দিও না। যার হাতে আমার প্রান আমি সেই সত্ত্বার কসম করে বলছি, তোমরা সকলেও যদি তার মতো একই কথা বলতে তাহলে আমি একা তোমাদের সবার উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তাম; হয় আমি নিহত হতাম অথবা তোমাদেরকে হত্যা করে ফেলতাম।
তার এই সাহসী পদক্ষেপের ফলে আল্লাহ্*র ইচ্ছায় সেই দিনই বনী খুতামার উপর ইসলাম বিজয়লাভ করে। এই গোত্রের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও এতো দিন গোত্রের লোকদের ভয়ে তা গোপন করে রাখতেন; এই ঘটনার পর তারাও প্রকাশ্যে তাদের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। কবি হাসসান বিন সাবিত উমায়র বিন আদির প্রশংসা করে কবিতাও রচনা করেছেন।
এ ঘটনাটি মুহাম্মাদ বিন সা’দ তার তাবাকাতের মধ্যেও সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাঃ দের মাঝে এটা একটা সাধারণ প্রচলন ছিল যে, আল্লাহ্*র রসুলকে কেউ কষ্ট দিয়েছে একথা তারা জানতে পারলে তারা তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে ফেলতেন, কেননা তার এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে এটাই তার প্রাপ্য। কেবল আল্লাহ্*র রসূলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সাপেক্ষে তিনি যদি কাউকে ক্ষমা করে দিতেন তবেই কেউ হত্যার হাত থেকে বাঁচতে পারতো। তবে এ ধরণের অপরাধী কোন ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রার্থনার আগেই যদি কেউ হত্যা করে ফেলত তাহলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হত্যাকারীকে কোন দোষারোপ করতে না, বরং তাকে বাহবা দিতেন এবং তার প্রশংসা করতেন; কেননা সে তো আল্লাহ্* তায়ালা এবং তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছে। যেমন ওমর রাঃ এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলেন এ কারণে যে, সে আল্লাহ্*র রসূলের বিচারে সন্তুষ্ট হয়েছিলো না। আসমা বিনতে মারওয়ান ও অন্য এক ইহুদী নারীকে হত্যার দৃষ্টান্তও একই রকম।
আল্লাহ্*র রসূলের ইন্তেকালের সাথে সাথে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আর বাকি রয়ে গেছে কেবল শাস্তি প্রয়োগের বিধান।

নবম দলীলঃ ইহুদী আবু আফাকের হত্যাকাণ্ড


সীরাত ও যুদ্ধের ঘটনা সংলকদের অনেকেই এ ঘটনা সংকলণ করেছেন। ইমাম ওয়াকেদী রহঃ বর্ণনা করেন যে বনু আমর গোত্রের এক অতিশয় বয়স্ক বৃদ্ধ ছিল যাকে আবু আফাক বলে ডাকা হতো; তার বয়স হয়ে গিয়েছিলো একশত বিশ বছর। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুউ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমন করলে সে ইসলামে তো প্রবেশ করেইনি বরং আদা জল খেয়ে তাঁর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বদর যুদ্ধের জন্য মদিনা থেকে বের হন তখন তাঁর হিংসার আগুন আরও জ্বলে ওঠে, সে যা খুশি তাই বলা আরম্ভ করে, সে আল্লাহ্*র রসূলের শানে অপমানজনক কবিতা লিখে প্রচার করতে লাগে এবং তাঁর সাহাবীদের নামেও বিভিন্ন রকম কুৎসা রটনা আরম্ভ করে।
সালিম বিন উমায়র রাঃ তার এসব শুনে বলেন, আমি মানত করলাম যে হয় আমি তাকে হত্যা করবো অথবা আমি নিহত হব; মদিনায় ফিরে তিনি অপেক্ষায় থাকেন কখন সুযোগ পাওয়া যায়। অতঃপর এক দিন তিনি সেই মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে গেলেন। এক গরমের রাতে আবু আফাক বাইরে শুয়ে ছিল। সালিম বিন উমায়র আস্তে করে তার কাছে গিয়ে শরীরের মাঝখান থেকে এমনভাবে তলোয়ার চালিয়ে দেনযে সে প্রায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। আল্লাহ্*র শক্র তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করে দেয়; সালিম বিন উমায়র চুপিসারে সরে পড়েন। তারপর তার আস পাশের লোকেরা এসে জড় হয়ে বলতে থাকে, আল্লাহ্*র কসম আমরা যদি তার হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পারি তাহলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবো।
ইমাম ওয়াকেদী রহঃ বলেন আবু আফাকের হত্যাকাণ্ড হিজরতের বিশ মাসের মাথায় শাওয়াল মাসে সংগঠিত হয়েছিলো। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন, ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছিলো কা’ব বিন আশরাফের ঘটনার পূর্বে; আর এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে চুক্তিবদ্ধ কোন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরাও যদি আল্লাহ্* তায়ালা কিংবা তাঁর রসূলের শানে অপমানজনক কিছু বলে তাহলে সে ব্যক্তির নিরাপত্তা রহিত হয়ে যায়।

দশম দলীলঃ আসওয়াদ আল আনসীর হত্যাকাণ্ড


আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, তাবাকাতে ইবনে সা’দ, সীরাতে ইবনে হিশাম, তারিখে তাবারী সহ ইসলামের ইতিহাসও আল্লাহ্*র রসূলের যতো সীরাত গ্রন্থ রয়েছে তার প্রায় সকল গ্রন্থেই এ ঘটনা বিশুদ্ধ সনদে সংকলিত হয়েছে। বিভিন্ন সংকলকের বর্ণনার মধ্যে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে সামান্য তারতম্য থাকলেও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক কোন মত পার্থক্য নেই। আমরা এখানে সে সব বর্ণনাসমূহের সমন্বিত একটি ধারা বর্ণনা তুলে ধরবো।
বিদায় হজ্জের পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন তখন বিভিন্ন দিকে ভণ্ডদের মিথ্যা নবুওত দাবীর ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এসব মিথ্যা নবুওত দাবীদারদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিল ইয়েমেনের আসওয়াদ আল আনসী। সে আগে থেকেই গণক শ্রেণীর লোক ছিল, সে যাদু বিদ্যায়ও পারদর্শী ছিল। সে বেশ প্রভাবশালীও ছিল; মানুষকে বিমোহিত ও মন্ত্রমুগ্ধ করার এক বিশেষ দক্ষতা ছিল তার। এসব কারণে সে শুধু সমাজের সাধারণ মানুষের উপরই নয় বরং সমাজের উচুস্তর ও বিত্তশালী লোকদের উপরও সে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে নিজেকে এক রহস্যময় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জনসমক্ষে বের হওয়ার সময় বিশেষ এক ধরণের মুখোশ পড়ে বের হতো।
আসওয়াদআল আনসীর হত্যাকাণ্ডে যিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন তিনি হলেন ফিরোজ আদ দায়লামী। ইয়েমেনে সে সময় যারা প্রভাবশালী ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবনা সম্প্রদায়ের লোকজন। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল পারস্যের সাসানী শাসক শ্রেণীর উত্তর পুরুষ যারা দীর্ঘ দিন ইয়েমেনকে শাসন করেছে এবং এদের মায়েরা ছিল স্থানীয় আরব। ফিরোজ আদ দায়লামি ছিলেন ইয়েমেনের এই আবনা সম্প্রদায়ের লোক।
ইসলামের আবির্ভাবের সময় আবনাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল বাজান এবং সে–ই পারস্য সাম্রাজ্যেরপক্ষ থেকে এ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। যখন সে ইসলামের সত্যতা তথা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আসমানী দাওয়াতের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হল তখন পারস্য সাম্রাজ্য থেকে আনুগত্য প্রত্যাহার করে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার অধিনস্ত লোকেরাও তাকে অনুসরণ করে ইসলাম গ্রহণ করে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে শাসক হিসেবে বহাল রাখেন। কিন্তু আসওয়াদ আল আনসীর আবির্ভাবের কিছু দিন পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আসওয়াদ আল আনসীর গোত্র বনু মুদহিজ সর্বপ্রথম তার মিথ্যা নবুওতের দাবীর প্রতি সমর্থন জানায়। সে তার গোত্রীয় বাহিনী নিয়ে সান’য়া আক্রমন চালিয়ে এখানকার গভর্নর বাধানের পুত্র শাহারকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রী দাদওয়াহকে সে জোরপূর্বক নিজে গ্রহণ করে। সান’য়া থেকে সে আস পাশের অঞ্চলে একের পর এক অভিযান চালাতে থাকে। তার এই অতর্কিতে আক্রমনের ফলে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হাদরা মাওত থেকে তায়েফ ওআল আহসা থেকে এডেন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল তার দখলে চলে আসে।
আসওয়াদ আল আনসীর ফিতনা যখন প্রায় ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন তখন একটি চিঠি দিয়ে মু’য়ায বিন জাবাল রাঃ এর নেতৃত্বে দশ জন সাহাবীকে ইয়েমেনের বিশস্ত অনুসারীদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি যে কোন মুল্যে আসওয়াদ আল আনসীর ফিতনা নির্মূল করার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ্*র রসূলের চিঠি পাওয়ার পর ফিরোজ আদ দায়লামী তার অন্যান্য সাথী সঙ্গীদেরকে নিয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বৈঠকে বসেন। এ ব্যাপারে ফিরোজ আদ দায়লামী বলেন-
‘আমরা আগে থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম আসওয়াদ আল আনসীকে শায়েস্তা করার জন্য, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম না। এরপর আল্লাহ্*র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি পাওয়ার পর আমাদের নৈতিক শক্তি বহু গুনে বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের প্রত্যেকে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে এ দায়িত্ত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য। এদিকে আসওয়াদ আল আনসী তার একের পর এক সফলতার কারণে বেশ অহংকারী হয়ে পড়ে; ফলে সে তার সেনাপতিদের সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করা আরম্ভ করে যে স্বয়ং তাদেরও মনে হচ্ছিলো যে, পান থেকে চুন খসলে তারাও যে কেউ যে কোন সময় তার আক্রোশের শিকার হয়ে যেতে পারে। তার একজন সেনাপতি ছিল কায়েস বিন ইয়াগুস; আমি আমার চাচাত বোন দাদাহকে নিয়ে একদিন কায়েসের সাথে সাক্ষাত করে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম এবং তাকে বললাম যে, তার হাতে তুমি শায়েস্তা হওয়ার আগে বরং তুমি তাকে শায়েস্তা করে ফেলো। সে আমাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয় এবং আমাদেরকে সে আসওয়াদ আল আনসীর বেশ কিছু গোপন তথ্য সরবরাহ করে। এরপর আমরা তিনজন পরিকল্পনা করলাম যে আমরা তাকে দুর্গের ভেতর থেকে আক্রমন করবো এবং আমাদের অন্য ভাইয়েরা বাহির থেকে থেকে আক্রমন করবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আমাদের আত্মীয়া দাদওয়ায়হকেও আমাদের দলে ভেড়াবো, যার স্বামীকে হত্যা করে আসওয়াদ আল আনসীতাকে জোর পূর্বক নিজের স্ত্রী বানিয়ে নিয়েছিলো। আমরা আসওয়াদ আল আনসীর দুর্গে গিয়ে দাদওয়ায়হ এর সাথে সাক্ষাত করে তাকে বললাম, তুমি ভালো করেই টের পাচ্ছো যে এই ব্যক্তি তোমার জীবনকে কিভাবে দুর্বিষহ করে তুলেছে, সে তোমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তোমার সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ সবাইকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদেরকে হত্যা করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ্*র রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে এই ফিতনাকে চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্য এই চিঠি পাঠিয়েছেন। তুমি কি এ ব্যপারে আমাদেরকে সহযোগিতা করবে?
সে বললো, আমি কিভাবে তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে পারি? আমি তার ইতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরে সরাসরি বলে ফেললাম যে আমরা তাকে হত্যা করতে চাই। আমার কথা শুনে সে বললো, ‘আল্লাহ্*র কসম আমিও মনে মনে একই কথা ভাবছিলাম, সেই সত্ত্বার কসম যিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমি তার অধীনে থাকলেও আমার মনে আমার ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে কখনো বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়নি, আল্লাহ্* তায়ালা আমার জন্য তার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেননি; আল্লাহ্*র কসম! আমি যখন থেকে তাকে দেখে আসছি তাকে কেবল মিথ্যাচারী, ভণ্ড, প্রতারক ও শয়তান রূপেই দেখে আসছি; তার থেকে আমি আজ পর্যন্ত ভালো কিছু দেখিনি’।
আমি তাকে বললাম, এখন বলো কিভাবে আমরা তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে পারি। সে তো সব সময় নিরাপত্তা রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
সে আমাদেরকে দুর্গের একটি পরিত্যক্ত রুমের কথা বলে বললো, তোমরা রাতের প্রথম প্রহরে ওখান থেকে প্রবেশ করবে, ওখানে তোমাদের জন্য অস্ত্র ও আলোর ব্যবস্থা করা থাকবে, আর স্বয়ং আমিও সেখানে থাকবো।
আমি বললাম, তুমি যা বলেছো মন্দ নয় তবে এভাবে প্রবেশ করতে গেলে আমরা নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি, তুমি তার চেয়ে আমার কাছে তোমার একজন বিশ্বস্ত একজন কাজের লোককে পাঠাও, আমি তাকে বুঝিয়ে দেবো, দুর্গের কোন স্থানে ভেতর থেকে একটি প্রবেশপথ তৈরি করে রাখলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে।
এরপর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আমরা একদিন রাতে আমাদের তৈরি করা নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে প্রবেশ করলাম, পরিকল্পনা মাফিক সেখানে অস্ত্র ও আলো আগে থেকেই রাখা ছিল; আমরা আস্তে করে আল্লাহ্*র শত্রুর রুমের দিকে অগ্রসর হলাম, আমার আত্মীয়াকে তার দরজায় দাঁড়ানো পেলাম, সে আমাদেরকে তার অবস্থান স্থল দেখিয়ে দিলো। আমরা তার ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম সে গভীর ঘুমে নাক ডাকছে। আমি তার গলায় তলোয়ার চালাতেই সে ষাঁড় জবাই করার সময় যেভাবে শব্দ করে সেভাবে গোঙ্গানি দিয়ে উঠলো। শব্দ শুনে রুমের অদুরে দাড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীরা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছে? কিসের শব্দ হল এটা?
দাদওয়ায়হ তাদেরকে বলল, তোমরা তোমাদের কাজে যাও, আল্লাহ্*র নবীর উপর ওয়াহী অবতীর্ণ হচ্ছে! একথা শুনে তারা চলে গেলো।
আমরা সকাল অব্দি দুর্গের মধ্যেই অবস্থান করলাম। ফজরের সময় ঘনিয়ে এলে আমি একটি ওয়ালের উপর উঠে তিন বার তাকবীর দিলাম; তারপর আযান দেয়া আরম্ভ করলাম, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ (আমি স্বাক্ষ দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ আল্লাহ্*র রসুল )বলে তার সাথে আমিযোগ করলাম ‘ওয়া আশহাদু আন্না আসওয়াদআল আনসী আল কাযযাব’ (এবং আমি আরও স্বাক্ষ দিচ্ছি যে আসওয়াদ আল আনসী হল মহা মিথ্যাবাদী)।
এটাই ছিল আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সংকেত যার দ্বারা আমাদের অন্য সাথীরা মিশন সফল হওয়ার সুসংবাদ পাবে।
আমি এই ঘোষণা দেয়ার পর চারিদিক থেকে মুসলমানরা আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনি দিয়ে একযোগে আক্রমন করে। সকালের আলো ফুটে ওঠার আগেই তার দুর্গের পতন ঘটলো এবং আমাদের মিশন সফল হল এবং সাথে সাথে আমরা বিশেষ দুত মারফত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহ্*র শত্রুর সদলবলে নিহত হওয়ার সংবাদ প্রেরণ করি। কিন্তু বার্তা বাহক মদিনায় পৌঁছে দেখতে পায় যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই রাতেই ইন্তেকাল করেছেন। তবে অন্যান্য সাহাবীদের থেকে তারা জানতে পারেন যে যখন আমাদের অপারেশন সফল হয় তখনই তিনি এ সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন’।
ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণীত আছে যে, যে রাতে আসওয়াদ আল আনসী নিহত হয় সে রাতেই আসমান থেকে ওয়াহির মাধ্যমে আল্লাহ্*র রসূলের কাছে তার নিহত সংবাদ আসে। তিনি আমাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন, আসওয়াদ আল আনসী নিহত হয়েছে। এক মুবারক পরিবারের এক মুবারক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছে। জিজ্ঞাসা করা হল সে ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, ফিরোজ ফিরোজ।

হে আল্লাহ্*! তুমি আমাদের সত্যকে সত্য হিসেবে দেখিয়ে দাও এবং তা অনুসরণের তাওফিক দাও; আর মিথ্যাকে আমাদের মিথ্যা হিসেবে দেখিয়ে দাও এবং আমাদেরকে তা পরিহার করে চলার তাওফিক দাও।

আমাদেরকে তোমার সেই সব বান্দাদের কাতারে শামিল করো যারা তোমার সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে।

আমাদেরকে তুমি তোমার সেই সব বান্দাদের দলে শামিল করো যাদের জান মাল তুমি কবুল করে নিয়েছো।

হে আল্লাহ্*! তুমি আমাদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মুহাব্বাতকে দূর করে দাও, তুমি আমাদের অন্তরে জিহাদের এমন অনন্ত তামান্না তৈরি করে দাও যাতে আমরা আমাদের জান মাল তোমার রাস্তায় কোরবানী করার আগে কিছুতেই ক্ষান্ত না হই।

হে আল্লাহ্* তুমি মুসলিম উম্মাহকে তোমার দ্বীনের দিকে উত্তম ভাবে ফিরিয়ে আনো।

আমীন!!!



Ad Code

Responsive Advertisement