Ad Code

Responsive Advertisement

সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১২)

১৯৯৩ সালে আল রশিদী মোগাদিসুতে জাওয়াহিরির এলিট ইউনিটগুলোর একটি ইউনিটের কমান্ডে ছিলেন। ইসলামী জিহাদীদের সমর্থনপুষ্ট সোমালীদের লড়াইয়ের শক্তি সামর্থ যে কি বিশাল আকারে বেড়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ হচ্ছে ১৯৯৩ সালের ৩ অক্টোবরের ঘটনা। ঐ দিন বিকালে মার্কিন সৈন্যরা জেনারেল আইদিদের দুই উপদেষ্টাসহ ২২ সোমালীকে বন্দী করলে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে যায়। সহস্রাধিক সোমালী যোদ্ধা মার্কিন সৈন্যদের ঘিরে ফেলে অ্যাম্বুশ করতে থাকে। তারা দু’টো মার্কিন হেলিকপ্টার ভূপাতিত করে এবং একটানা ১১ ঘন্টা ধরে মার্কিন সৈন্যদের ওপর গুলি বর্ষণ করে চলে। ১৮ মার্কিন সৈন্য নিহত ও ৭৮ জন আহত হয়। পরদিন সোমালীরা মোগাদিসুর রাজপথে মার্কিন সৈন্যদের লাশ নিয়ে বিজয় উৎসব করে। ৩ অক্টোবরের লড়াইয়ে জাওয়াহিরি ও আল রশিদী দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশেষ করে অ্যাম্বুশগুলো আল রশিদীর সার্বিক কমান্ডে হার্ডকোর ইসলামী জিহাদীরা এবং প্রধানত আরব আফগান ও ইরাকীরা চালিয়েছিল। আরব আফগানদের মধ্যে আলজেরীয় ও মিসরীয় মুজাহিদরা ছিল। ইরাকীরা ভারি অস্ত্র, বিশেষ করে হেলিকপ্টার বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারে অংশ নিয়েছিল। ৩ অক্টোবরের লড়াইয়ের পর মার্কিন বাহিনীকে সোমালীয়া থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়

। পরবর্তীকালে বেশ কিছু বিবৃতি ও সাক্ষাতকারে বিন লাদেন বলেছেন যে, সোমালিয়ার অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মনে করেন। সোমালিয়াতেই প্রথম তিনি নেতৃত্বের পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ ও নীতি নির্ধারণের মতো জটিল বিষয়ে অংশ নেন। তিনি ইরান ও ইরাকের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। মোগাদিসুর লড়াইয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন। বিন লাদেন মোগাদিসুর লড়াইকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর অন্যতম প্রধান সাফল্য বলে মনে করেন। এই সাফল্য থেকে তিনি স্থিরনিশ্চিত হন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগর থেকেও হটিয়ে দেয়া সম্ভব। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর চোখে কাগুজে বাঘের চেয়ে বেশি কিছু নয়।

সৌদি পাসপোর্ট বাতিল; বিন লাদেনের ছদ্মনাম ধারণ

১৯৯৪ সালে বিন লাদেনকে বেশ কিছু কর্মসূচীর দায়িত্ব নিতে দেখা যায়। এ জন্য তাঁর বেশ কয়েকটা দেশ সফরে যাবার প্রয়োজন পড়ে। এসব সফরে গিয়ে  তিনি নিজেকে জটিল র্কাযক্রমের যোগ্য ব্যবস্থাপক ও দক্ষ সংগঠক হিসাবে প্রমাণ করেন। সেই কর্মসূচীগুলোর বেশিরভাগ আজও চালু আছে। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর বন্ধু বা মিত্রদের কিংবা তাদের ইউরোপে রেজিস্টিার্ড কোম্পানির ব্যক্তিগত জেট বিমান ব্যবহার করে তিনি নির্বিঘে যেখানে সেখানে যেতে সক্ষম হন। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর সৌদি পাসপোর্ট বাতিল হবার পর তিনি ভিন্ন নাম ধারণ করে সুদানী কুটনৈতিক পাসপোর্টে বিদেশ যাতায়াত করতে থাকেন। তবে পাশ্চাত্য ও স্থানীয় গোয়ান্দা সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান হুমকি সত্বেও বিন লাদেন জিহাদপন্থী মুসলিম নেতাদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কখনই নিজের আসল পরিচয় গোপণ করার চেষ্টা করেননি।১৯৯৩ সালের শেষ দিকে মুজাহিদরা বড়ধরনের বিজয় উৎসব পালন করে। কারণ, তারা আফ্রিকা শৃঙ্গ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে দিতে পেরেছে। কাজেই পরবর্তী বছরটি নিজ নিজ শক্তিকে পুনর্বিন্যস্ত ও সংগঠিত করাই ছিল বিন লাদেন ও তাঁর সহকর্মীদের জন্য সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সময়।

 সোমালিয়ার ঘটনার পর ইসলামী জিহাদ বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অন্যতম মার্কিনবিরোধী ও পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। সেই সঙ্গে ইসলামী জিহাদী ব্যবস্থায় নতুন কিছু দেশ সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। দেশগুলোর একটি হচ্ছে পাকিস্তান। এই সময় কাশ্মীরের প্রক্সি যুুদ্ধে এবং আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। উভয় ক্ষেত্রে বিন লাদেনকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী শক্তিগুলো কি রকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।এমনকি স্বয়ং জিয়াউল হকও দেশে শরয়ী আইন চালুর ব্যবস্থা করেছিলেন। জিয়াউল হকের মৃত্যুর কিছুদিন পর নির্বাচরে মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন বেনজীর ভুট্টো। পাশ্চাত্যপ্রীতি ও গণতন্ত্রের ধ্বজা ধারণ সত্বেও তিনি কতিপয় মৌলিক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সরকারকে অনুসরণ করে চলেন। 

যেমন  একটি হলো ইসলামী জোটের অন্যতম মুখ্য সদস্যে পরিণত হওয়া এবং দ্বিতীয়টি হলো চীনের নেতৃত্বে ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ট্রান্সএশীয় অক্ষশক্তি তথা মার্কিনবিরোধী র‌্যাডিকেল জোটে সক্রিয় অবদান রাখা। সেই লক্ষে পাকিস্তান ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে স্ট্যাটিজিক সহযোগিতা জোরদার করে তোলে। পাকিস্তান এসব জোটে সুস্পষ্ট ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। সেটা হলো ইসলামাবাদ ইসলামী জোটের সামরিক শক্তির উন্নয়ন এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তিসহ সকল ধরণের সমরাস্ত্রের উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান আমেরিকার তৈরী অস্ত্রের খুচরা অংশসহ পাশ্চাত্যের  অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আইনী-বেআইনী উভয় পথেই সংগ্রহ করবে। পাকিস্তানে সরকারের আড়ালেও এক অদৃশ্য সরকার থাকে। ক্ষমতায় যে-ই আসুক তাকেই এই অদৃশ্য সরকারের মূলনীতিগুলো মেনে চলতে হয়। জিয়াউল হক বা বেনজীর বা নাওয়াজ শরীফ এদিক থেকে কোন ব্যতিক্রম নন।

আমাদের এখানে আলোচ্য সময়টি হলো ১৯৯৩-৯৪ সাল। এসময়ে পাকিস্তানে বেনজীর ভুট্টো আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। এসময় যুদ্ধোত্তর এবং উপসাগর যুদ্ধোত্তর পাকিস্তানের জন্য নতুন স্ট্যাটেজি নেয়া হয়। সেটা হলো ইসলামী ব্লক ও ট্রান্স-এশিয়ান এক্সিসের সঙ্গে আরও বেশি করে একীভূত হওয়া। পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ স্থির নিশ্চিত হন যে, এই দুটো জোটের মধ্যেই পাকিস্তানের ভবিষ্যত নিহিত। তাই ইসলামী আন্দলনের পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনার জন্য হাসান আল তুরাবি ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে খার্তুমে পপুলার অ্যারাব এ্যন্ড ইসলামীক কনফারেন্স  এর অধিবেশন আহবান করলে পাকিস্তান যে তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু  নেই। সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা জানিয়েছিল যে, ইসলামী বিশ্বের গতিপ্রকৃতি, চীনের পরিবর্তনশীল স্ট্যাটেজি এবং পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ সমস্যার প্রেক্ষিতে বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানের সর্বোত্তম স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ইসলামাবাদ ইসলামের  র‌্যাডিকেলপন্থীদের স্ট্র্যাটেজি অনুসরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সম্মেলনে বেনজীর ভুট্টো তাঁর এক উপদেষ্টা পাঠান, যিনি তুরাবি ও অন্যান্য মুসলিম নেতার সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে পিপলস পার্টির ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন এবং আশ্বাস দেন যে, এই দল ইসলামের সমালোচনা করবে না, ইসলামী আইন যতটুকু  যা প্রবর্তিত হয়েছে তা তুলবে না এবং কাশ্মীরে  ভারতবিরোধী জিহাদে দৃঢ় সমর্থন দেবে।

 উপদেষ্টা আরো জানান যে, পাকিস্তান আফগানিস্তান সমস্যার ইসলামী সমাধান খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর।পপুলার অ্যারাব এ্যান্ড ইসলামিক কনফেরান্স অধিবেশনে আর্মড ইসলামিক মুভমেন্টের কাঠামোর মাধ্যে পাকিস্তানের ভূমিকা, বিশেষ করে ইসলামী সশস্ত্র সংগ্রাম তথা আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের প্রতি ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সক্রিয় সাহায্য-সমর্থন দেয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধারা হয়। সরকারী পর্যায়ে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেনজীর ভুট্টোর দুই বিশ্বাসভাজন-সেনাবাহিনীর সাবেক চীফ অব স্টাফ ও ইরানে ঘনিষ্ঠ মিত্র  জেনারেল মীর্জা আসলাম বেগ এবং আইএসআই এর প্রাক্তন প্রধান জেনারেল হামিদ গুল, যিনি আশির দশকের শেষ দিকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিদেশী মুজাহিদদের আগমনকে উৎসাহিত করেছিলেন। এঁরা দু’জনেই ছিলেন র‌্যাডিকেল ইসলামীদের ঘোর সমর্থক।  তুরাবি কাশ্মীরী মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় পাকিস্তানের অঙ্গিকারকে অভিনন্দিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সত্ত্বেও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করেন। এবং এ ব্যাপারে গোটা মুসলিমবিশ্বের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা আশ্বাস দেন যে, আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদী তৎপরতার প্রতি সমর্থন বন্ধ বা হ্রাস করার ব্যাপারে পাশ্চাত্যের চাপের কাছে ইসলামাবাদ নতিস্বীকার করবে না। তারা জোর দিয়ে বলেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও অন্যান্য সাহায্য পাওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনেক সময় আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদীদের দমন করার কিংবা তাদের অবকাঠামো খর্ব করার  ভান ধরতে হবে। তবে সেটা হবে কেবল লোক দেখানো ব্যাপার মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী জিহাদীদের প্রতি ইসলামাবাদের সাহায্য সমর্থন প্রসারিত হবে। 

আবার আইএসআই

খার্তুম সম্মেলনে পাকিস্তান যে ওয়াদা করেছিল তা রক্ষার জন্য পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসএই কোমর বেঁধে লেগে পড়ে। ১৯৯৪ সালে ইরানী গোয়েন্দা সংস্থা ভিভাক এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আইএসআই আফগানিস্তানে জিহাদী  অবকাঠামোর, বিশেষ করে আরব ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের প্রশিক্ষণ স্থাপনাগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটায়। আইএসআই ইন্সট্রাক্টরদের চারটি প্রশিক্ষণ শিবিরে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় যেখানে “বিদেশী আফগানদের” (অর্থাৎ আফগান নয় এমন বিদেশীদের) উন্নত অস্ত্র ব্যবহার কৌশল, অত্যাধুনিক বোমা ও বুবি ট্র্যাপ তৈরি এবং সুইসাইড অপারেশন পরিচালনার উপায় শেখানো হতো। এখানে “আইএসআই” প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে এই জন্য যে, পরে দেখা যাবে কিভাবে আইএসআই-এর সঙ্গে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। যাই হোক, আইএসআই ও ভিভাক-এর যৌথ উদ্যোগে যেসব প্রশিক্ষণ শিবিরের উন্নয়ন ও সাম্প্রসারণ ঘটানো হয় তার একটি ছিল আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে খোস্ত ও জাওয়ারের মধ্যবর্তী একটি এলাকায়। আশির দশকে আইএসআই এর প্রশিক্ষণ শিবিরটি আফগান মুজহিদ কমান্ডার জালালুদ্দীন হাক্কানীর জন্য চালাত।

 ১৯৯৮ সালে সেখানে প্রায় একশ’ পাকিস্তানী এবং ৩০ জনেরও বেশি আরব ইন্সট্রাক্টর সারা বিশ্বের ৪০০ থেকে ৫০০ ইসলামী যোদ্ধাকে ট্রেনিং দিচ্ছিল। শিবিরটি সম্পূর্ণ পেশাদারী কায়দায় চালিত হয়। সেখানে প্রত্যেক প্রার্থীকে প্রশিক্ষণের জন্য গ্রহণ করার আগে আইএসআই বিশেষজ্ঞরা পূর্ণাঙ্গ শারীরিক,  মানুষিক ও মেডিক্যাল পরীক্ষা নিত এবং নিরাপত্তামূলক তল্লাশি চালাত। বিষয়ভেদে কোর্সগুলো হতো ৪ মাস থেকে ২ বছর মেয়াদী। ১৯৯৪-৯৫ সালে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৩৫০ জন ছিল তাজিক (এদের ১০০ জন ছিল তাজিকিস্তানের এবং বাকিরা ছিল আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বঞ্চলের) ও প্রায় ১০০ জন ছিল চেচেন সৈন্য। এছাড়া ৩ টি গ্রুপ ছিল বসনিয়া-হারজেগোভিনার, ২টি গ্রুপ ছিল ফিলিস্তিনী,  ১টি গ্রুপ ছিল ফিলিপিন্সী, ১টি গ্রুপ ছিল মোলদাভীয় এবং ২টি গ্রুপ ইউক্রেনীয় (প্রধানত ক্রিমীয় তাতার)। ছাত্রদেরকে ১২ থেকে ১৪ জনের একেকটি স্টাডি টিমের ভাগ করা হতো। নিরাপত্তার কারণে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ বা টিমের মধ্যে যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ রাত্রিকালীন কোর্সও পরিচালনা করা হতো এবং এসময়ে প্রশিক্ষণার্থীদের পরিচিতি ও তৎপরতা বা কার্যক্রম গোপন রাখতে হতো। ১৯৯৮ সালের আগস্টের লাদেনের ঘাঁটিতে মার্কিন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় এ ধরনের কয়েকটি প্রশিক্ষণ শিবিরকেও টার্গেট করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে অপর যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সম্প্রসারণ ঘটানো হয় তার মধ্যেছিল গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হিজবে ইসলামীর ঘাঁটি বলে পরিচিত চর সিয়াবের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এছাড়া পাশ্চাত্যে এবং পাশ্চাত্যপন্থী মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোতে বিশেষ ধরণের অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাছাই করে রাখা দু’শরও বেশি আরব যোদ্ধার জন্য আইএসআই আলাদাভাবে বড় ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালিয়েছিল। আইএসআই পরিচালিত অন্যান্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আফগনিস্তানের বাকি অঞ্চলে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। 

১৯৯৪-৯৫ সালে জিহাদী সংগঠনগুলোর জন্য দেয়া লজিস্টিক্স গোয়েন্দা অর্থে ও অন্যান্য সাহায্যের বেশির ভাগই আইএসআই পৃষ্টপোষকতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানী সংগঠন যথা হরকত-উল আনসার ও মারকাজ আল দাওয়াত আল আরশাদের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান হরকত-উল আনসারের নেতারা গর্ব করে দাবি করেন যে, তাঁদের যোদ্ধারা কাশ্মীর, ফিলিপিন্স, তাজিকিস্তান, বসনিয়া-হারজেগোভিনাসহ বিভিন্ন স্থানে লড়ছে। ১৯৯৫ সালে মারকাজ-আল দাওয়াত আল আরশাদও অনুরূপ দাবি করে জানায় যে, তাদের মুজাহিদরা কাশ্মীর ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিম ইউরোপ, বসরিয়া ও চেচনিয়ায় তৎপর আছে। আফগানিস্তান সঙ্কটে পাকিস্তানের জড়িয়ে পড়া এবং সেখানকার বিশাল জিহাদী ব্যবস্থার লালান পালনে তার সাহয্য-সহায়তা যে শুধু ইসলামী সংহতির চেতনা থেকে হয়েছে তা নয়। এর মধ্যে জাতীয় স্বার্র্থের ব্যাপারটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে আফগানিস্তানের সড়ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পথ সন্ধান করায় আইএসআই এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গোপন তৎপরতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আইএসআই কুশা-হেরাট কান্দাহার-কোয়েটা মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণে এক উচ্চাভিলাষী কার্যক্রমে হাত দেয়। সাবেক সোভিয়েত মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে পশ্চিম ও দক্ষিণ আফগানিস্তান হয়ে এই সড়ক মিশে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক ব্যবস্থার সঙ্গে যে সড়ক ব্যবস্থা দেশের সর্ব প্রধান বন্দর করাচী পর্যন্ত বিস্তৃত। সুতরাং এটা হলো মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকা একমাত্র স্টাট্যাজিক স্থল পথ যা পুনর্নির্মাণ করা হলে অপেক্ষাকৃত সহজে বিশাল বিশাল কনভয় এপথ দিয়ে বহন করা যেতে পারে। এই পথের সঙ্গে মধ্য এশিয়া থেকে তেল ও গ্যাসের পাইপ লাইন করাচী বন্দর পর্যন্ত নেয়া হলে পাকিস্তানের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তা হবে একান্তই গুরুত্বপূর্ন।

 পাকিস্তান যে কোন মূল্যে এ গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথটির ওপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছিল। আইএসআই এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে সব কার্যক্রম চালায় বলা যেতে পারে তারই পরিণতি বা ফলস্বরূপ তালেবান শক্তিটির উত্থান ঘটে। পাকিস্তানের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর ১৯৯৮ সালে স্বীকার করেন যে, ১৯৯৪  সালে তারই নির্দেশনায় তালেবানদের সংগঠিত করা হয়েছিল। কথাটার মধ্যে যথেষ্ট সত্যতা আছে। তালেবানদের সৃষ্টি ও শক্তি বৃদ্ধি ইসলামাবাদের সকল সরকার (এমনকি বেনজীর ভুট্টোর সরকার) কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে এবং সেই মিশন আইএসআই দ্বারা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই তালেবানরাই এখন আফগানিস্তানের প্রায় গোটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমেরিকার প্রবল চাপ সত্ত্বেও এই তালেবানরা ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানের দিকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাকে রক্ষা করছে। 

বলকান অঞ্চলে বিন লাদেন

আফগানিস্তান, আফ্রিকাশৃঙ্গ এবং অন্যান্য এলাকার জিহাদীদের সংগ্রামের সঙ্গে যতই নিজের সংশ্লিষ্টতা থাকে না কেন ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবের তখনকার ক্রমবর্ধমান সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন থেকে নিজেকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেননি। বাদশাহ ফাহাদের স্বাস্থের দ্রুত অবনতি ঘটলেও তার স্থলে কে সিংহাসনে আরোহণ করবেন সে সম্পর্কে তখনও সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছিল না। ফলে উত্তরধিকার প্রশ্নে আল সৌদ রাজপরিবারের অংশীদারদের মধ্যে তিক্ত বিরোধ এবং তা থেকে উদ্ভুত সঙ্কট গ্রাস করে ফেলেছিল সৌদি আরবকে। শীর্ষ স্থানীয় শাহজাদাদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অতৃপ্ত লোভ-লালসার বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জিহাদী ও র‌্যাডিকেল শক্তি এই বিক্ষোভ ও বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবে খাঁটি ইসলামী জীবনধারা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এটা  মূলত ছিল ইসলামপন্থীদের আন্দোলন। রিয়াদ এ আন্দোলন মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ব্যাপক ধরপাকড় চালিয়ে তাদের বিনা বিচারে আটকে রাখে। এভাবে চরম দমননীতির দ্বারা আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া হয়। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি এই আন্দোলন বাস্তব কোন হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। সৌদি আরবের ভিতরের ও বাইরের এই পরিস্থিতি বিন লাদেনের রাজনৈতিক বিকাশের পথে একটা মোড় পরিবর্তন হিসাবে কাজ করে। 

১৯৯৩-৯৪ সালে তিনি আল-সৌদ রাজপরিবারের এককভাবে দেশ শাসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সব রকমের যুক্তি বিচার বিবেচনা করে তিনি স্থির নিশ্চিত হন যে, এই পরিবারটি দেশ পরিচালনার কোন বৈধতা নেই। তাই একদা যিনি সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাকে অতুলনীয় সার্ভিস যুগিয়েছিলেন এবং উপসাগর সঙ্কটের সময় দৃঢ়ভাবে রাজপরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই এখন রাজপরিবারের ঘোরতর ও আপোষহীন শত্রু হয়ে দাঁড়ান। রিয়াদের প্রতি বিন লাদেনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এই বিবর্তনের ব্যবহারিক তাৎপর্য আছে। তিনি এখন সৌদি আরবে ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করার উপায়, বিশেষ করে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর উত্তরোত্তর দমন নিপীড়নের মুখে কি করে সেই আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা এবং এর পাশাপাশি সৌদি আরবে ভবিষ্যত অভ্যুত্থানের অগ্রসেনা হিসাবে কিভাবে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলা যায় সে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। বিন লাদেন অবশ্য এ ব্যাপারে সচেতন থেকেছেন যে শেষোক্ত দায়িত্বটি পালন করা যথেষ্ঠ দুরূহ এবং প্রচুর সময়সাপেক্ষ। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী অভিযানের ভিত্তি রচিত হয়। হাসান আল তুরাবি ও তার আন্তর্জাতিক ইসলামী আন্দোলনে বিন লাদেন ও জাওয়াহিরির মতো ‘আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ’ জিহাদী নেতাদের গুরুত্ব ও কার্যকরী ভূমিকার কথা বুঝতে পেরে তাদের অনেক বড় দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেন। লাদেন ও জাওয়াহিরিকে মুখ্য অবস্থানে রেখে এক নতুন কমান্ড কাঠামো নির্মিত হয়। ইসলামী জিহাদ এখন ইউরোপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। 

বিন লাদেন ও জাওয়াহিরি দু’জনেই বলকান অঞ্চল, বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও কসোভোয় র‌্যাডিকেল ইসলামীদের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দুটোই কাজে লাগিয়েছিলেন। খার্তুম ও লন্ডন থকে বিন লাদেন বলকান অঞ্চলে মানবিক ত্রাণ সংগঠনের নেটওয়ার্ক ব্যাপক আকারে সম্প্রসারিত করেন। সেই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তুলেন সহায়ক ঘাঁটি। ঐ ত্রাণ সংগঠনগুলোই গোটা বলকান অঞ্চলে হাজার হাজার মুজাহিদ ধারণ করে আছে। কোন নির্দিষ্ট মানবিক সাহায্যে সংগঠন বন্ধ হলে,  কোন ইসলামী জিহাদী গ্রেফতার বা বহিষ্কার হলে সামগ্রিক জিহাদী নেটওয়ার্কের ওপর লক্ষণীয় কোন প্রভাব পড়ত না। বিন লাদেন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত এই নেটওয়ার্কটির যথেষ্ট নমনীয়তাও ছিল। প্রায়ই এক একটা সংগঠন অদৃশ্য হয়ে যেত। যে জায়গায় গজিয়ে উঠত নতুন সংগঠন। এছাড়া বিপুল সংখ্যক ছদ্মবেশী ইসলামী জিহাদী প্রায়ই এক সংগঠনের আনুগত্য ছেড়ে অন্য সংগঠনের আনুগত্য গ্রহণ করত। তার ফলে জিহাদীদের সন্ধান বের করতে পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উদ্যোগ বহুগুণ জটিল আকার ধারণ করত।

 বলকান অঞ্চলে ইসলামী জিহাদীদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা ও অন্যান্য তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে বিন লাদেন একটা গোপন অর্থ ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছিলেন। তার গড়া সামগ্রিক নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধান করার জন্য বিন লাদেন অন্তত একবার বসনিয়া, আলবেনিয়াসহ বলকান অঞ্চল সফরে গিয়েছিলেন যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে। অন্যদিকে আইমান আল জাওয়াহিরি বলকান অঞ্চলে বহু স্তরবিশিষ্ট ফরোয়ার্ড ও অনসাইট কমান্ড এ্যান্ড কন্ট্রোল সিন্টেম গড়ে তুলেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল বসনিয়ার মুসলমানদের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় মুজাহিদদের অবদান রাখা এবং সেই সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদী তৎপরতা চালানো। তার কমান্ড পোস্টগুলোর মধ্যে অফ-সাইট পোস্টগুলো ছিল ইতালি ও বুলগেরিয়ায় এবং অন-সাইট পোস্টগুলো ছিলো ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হারজেগোভিনা এবং আলজিরিয়ায়। জাওয়াহিরি গোটা বলকান অঞ্চলে অতি সুদক্ষ জিহাদীদের বেশ কয়েকটি সেলও গড়ে তুলেছিলেন এবং যাবতীয় আর্থিক খরচের ব্যাবস্থা করেছিলেন বিন লাদেন।বিন লাদেন ও জাওয়াহিরি পশ্চিম ইউরোপে বেশ কয়েকটি বড় ধরণের জিহাদী প্রকল্পেও জড়িত ছিলেন। পশ্চিম ইউরোপে তৎপরতা চালানোর সুবিধার্থে জাওয়াহিরি দাড়ি-গোফ কামিয়ে পাশ্চাত্যের পোষাক ধারন করে চেহারা একদম বদলে ফেলেছিলেন। জওয়াহিরির ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্কের মূল লক্ষ্য ছিল জরুরী পরিস্থিতিতে খুবই মারাত্মক ধরনের জিহাদী তৎপরতা পরিচালনা ও তত্ত্ববধানের জন্য যথাস্থানে অতি সুযোগ্য লোক নিয়োগ করা।  

ফিলিপিন্সে জিহাদ বিস্তারে লাদেন

ফিলিপিন্সে ইসলামী জিহাদের বিস্তারে বিন লাদেনের প্রভূত অবদান আছে। বলা যেতে পারে এ কাজে তিনি নিজেই জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে বিন লাদেন জিহাদী কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় শুরু করেন। তারই অংশ হিসাবে প্রথমে যে বড় ধরনের নেটওয়ার্কে তিনি সাহায্যকারীর ভূমিকায় জড়িত ছিলেন পরবর্তিকালে সেটি ফিলিপিন্সে বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে একাধারে ত্রাস ও চমক সৃষ্টি করেছিল। গ্রাউন্ডওয়ার্ক তৈরির জন্য বিন লাদেন সেই ১৯৯৩ সালের শীতকালেই ফিলিপিন্সে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপগুলোর মুসলিম জনগোষ্ঠিকে সাহায্য করতে আগ্রহী একজন ধনাঢ্য সৌদি বিনিয়োগকারী হিসেবে হাজির করেন। এ উদ্দেশ্যে সেখানে বেশ কিছু সম্পত্তি কেনেন, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলেন। এসব কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য সরকারী কর্মকর্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। যাই হোক, এভাবেই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর ছদ্ম পরিচয়ে লাদেন ফিলিপিন্স নেটওয়ার্কের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীকালে বিন লাদেনের অবাধ যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে এ দায়িত্বটা তিনি তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ জেএল খলিফার কাছে হস্তান্তর কারেন। প্রয়োজনীয় অর্থ এখন কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়ে থাকে। 

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে খলিফাকে ইমিগ্রেশন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে সানফ্রানসিসকোতে আটক করা হয়। ১৯৯৪ সালের প্রথম দিক থেকে তুখোড় জিহাদীদের বেশ কিছু “সেল” যাদের সিংহভাগই হলো আরব “আফগান” তারা ফিলিপিন্সে এসে দেশের সর্বত্র, বিশেষত বড় বড় শহরে ঘাঁটি গেড়ে বসে। এদের মধ্যে সিনিয়র কমান্ডার ছিলেন রামজী আহমদ ইউসুফ। ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলার গোটা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেছিলেন তিনি। ইউসুফের নেতৃত্বে আগত এই দলটির লক্ষ্য ছিল পূর্ব এশিয়ায় জিহাদী হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে জিহাদী হামলা পরিচালনার জন্য ফিলিপিন্সকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। প্রথম দিকে নেটওয়ার্কটি কিছু তড়িঘড়ি কাজ করে বসে বলে সাফল্য পায়নি। যেমন ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের ম্যানিলা সফরকালে তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কর্ডন ভেদ করার জন্য আগে থেকে যে সব গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার দরকার ছিল নেটওয়ার্ক তা করতে পারেনি। এবং পারেনি বলেই হত্যার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পূর্ব এশিয়ায় বড় ধরনের যে সব অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল পোপ পলকে হত্যা করা এবং একই সঙ্গে দু’টো যাত্রীবাহী মার্কিন বিমান বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়া। নেকওয়ার্কটি ফিলিপিন্সের সবচেয়ে বড় ইসলামী জিহাদী সংগঠনের নেতা আবু সায়াফকে ম্যানিলা সরকারের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম জোরদার করে তুলতে অত্যাধুনিক অভিযান পরিচালনায় সাহায্য করারও পরিকল্পনা করেছিল। ১৯৯৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর ইসলামী জিহাদী নেটওয়ার্কের সদস্য রামজী ইউসুফ সেবু থেকে টোকিও গামী ফিলিপিন্স এয়ারলাইন্সের  একটি যাত্রিবাহী বোয়িং ৭৪৭ বিমানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। জাল ইতালীয় পাসপোর্টে যাত্রীর ছদ্মবেশে বিমানে উঠে ইউসুফ নিজে বোমাটি পেতে রেখে ম্যানিলায় যাত্রা বিরতিকালে নিরাপদে নেমে যান। বিমানটি ওকিনাওয়ার আকাশে থাকাকালে বোমা বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু ওটা খুব ছোট তথা স্বল্পশক্তির ছিল বলে বিস্ফোরিত হলেও বিমানটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়নি। এরপর ইউসুফের সহযোগী সাইদ আকরাম দু’তিন স্থান থেকে হংকং অভিমুখী দু’টো মার্কিন বোয়িং ৭৪৭ মিমানে একই সঙ্গে মধ্য আকাশে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু লাদেনের ঐ নেটওয়ার্কটি ভেঙ্গে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা কর্যকর করা যায়নি। নেটওয়ার্কটির ভাগ্যই ছিল মন্দ।

 ১৯৯৫ সালের জানুয়ারীতে ম্যানিলায় পোপের প্রাণনাশের চেষ্টাও একইভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। বোমা তৈরির সময় উপাদান মিশ্রণে কোন ভুল হয়ে থাকবে যে কারণে বিষাক্ত ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। এ অবস্থায় ইউসুফ ও অন্যান্য জিহাদী তাদের এ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে সাইদ আকরাম ধরা পড়েন। ইউসুফ সহ অন্যরা থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান। সেখান থেকে যান পাকিস্তানে। সিআইএ এসব তথ্য নিখুঁতভাবে যোগার করেছিল। এমনকি ইউসুফ কোন যায়গায় লুকিয়েছিল সে তথ্যটিও। ইউসুফের আত্মগোপন স্থলটি ছিল একটা এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। বিন লাদেনরই একটি কোম্পানী ওটা ভাড়া নিয়েছিল। মার্কিন সরকার এসব সুনির্দিষ্ট তথ্য ইসলামাবাদের কাছে পেশ করলে ইসলামাবাদের সহযোগীতা করা ছাড়া বিকল্প আর কিছু ছিল না। নইলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলতে পারত। মার্কিন-পাকিস্তানী আইন প্রয়োগকারী দল ইউসুফকে ধরতে গেলে ঐ এ্যাপার্টমেন্টে বসবাসরত ইউসুফের আর সকল কমরেড ও জিহাদীকে আইএসআই আগেই সরিয়ে ফেলে। শুধু ইউসুফ ধরা পড়ে। তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
-----চলমান।

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১১)


ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ায় সেই সত্তরের দশক থেকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনের আন্দোলন চলছিল। ইথিওপিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯৯১ সালের মে মাসে একটি চুক্তি হয়। তদানুযায়ী প্রেসিডেন্ট হাইলে মেঙ্গিসটু মরিয়ম পদত্যাগ করেন এবং মেলেস জেনাবির নেতৃত্বে বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। সংগঠনগুলোর বেশির ভাগই ছিল মুসলিম প্রধান। এগুলোর এধ্যে ইরিত্রিয়া যুক্তফ্রন্ট ১৯৯৩ সালের মে মাসে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।অন্যদিকে সোমালিয়ায় ১৯৯০ সাল থেকে বিদ্রোহী তৎপরতায় নিয়োজিত সংগঠনগুলোর সবাই ছিল প্ল্যানভিত্তিক। তার মধ্যে প্রধান প্রধান সংগঠন হলো ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস (হাউয়ি ক্লান), সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (ইসাক ক্লান), সোমালি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট, (ওগাদেনি ও কিসমায়ু ক্লান) এবং সোমালি ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (রাহানওয়েন ক্লান।) ১৯৯২ সালে সোমালিয়ায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের জন্য প্রাকৃতিক কারণ খরা যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী ছিল মানুষের নিজের ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট সঙ্কট।

 একদিকে উপজাতীয় যুদ্ধ এবং অন্যদিকে সোমালিয়ার প্রধান নেতাদের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই এই বিপর্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সোমালিয়ায় ক্ষমতায় আসেন ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেসের অন্যতম নেতা আলী মাহদি মোহাম্মদ। কিন্তু ১৯৯১ সালের প্রথমদিকে ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মাহদী মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন অংশ ও সংগঠনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফারাহ আইদিদের নেতৃত্বাধীন অংশের মধ্যে বড় ধরনের ভাঙ্গণ ধরে। পরে তা ক্ষমতার তিক্ত লড়াইয়ের রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত ইউএসসি ভেঙ্গে যায়। ১৯৯২ সালে রাজধানী মোগাদিসুতে দুই পক্ষের ক্লান ও সাব ক্লানগুলোর মধ্যে যে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয় তাতে রাজধানীর বেশিরভাগ নগরিক সুবিধা ও সেবা ব্যবস্থা ধসে পড়ে। ইতোমধ্যে সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ ত্রাণে জাতিসংঘ ও পাশ্চাত্য দেশগুলো খাদ্য সাহায্য পাঠায়। সাহায্যের, বিশেষ করে খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য সরকারী বাহিনী ও আইদিদের অনুগত বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই বেঁধে যায়। সাহায্য লুট হয়ে যায়। এই পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক মিশনের নামে সোমালিয়ায় ১৯৯২ সালের নভেম্বরে এক বড় আকারের সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিলে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া হয়।

 জেনারেল আইদিদ হুমকি দেন যে, যে কোন বৈদেশিক সৈন্য মোতায়েন করা হলে সোমালিয়ায় রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। একদিকে সাহায্য ও অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য আইদিদ বাহিনী অন্যান্য সংগঠন যথা এসএনএ, এসএলএ, এসপিএন, এসডিএম প্রভৃতির সঙ্গে জোট গড়ে তোলে এবং গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথগুলো দখল করে নেয়। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আলী মাহদী মোহাম্মদ ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার প্রতিনিধিদের নিয়ে আইদিদবিরোধি জোট গঠন করেন। গৃহযুদ্ধ যখন জোরেশোরে চলছে এ অবস্থায় সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত অসংখ্য দাতব্য বা সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সোমালিয়ায় ইসলামী জিহাদীদের উপস্থিতি বেড়ে যায়। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ অত্যাসন্ন হয়ে ওঠার মুখে তারা বিদেশী সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে এবং বলে যে, এই সাহায্য নিয়ে আসার নামে পাশ্চাত্য আসলে সোমালিয়াকে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার পাঁয়তারা করেছে

। জিহাদীরা ইসলামিক ওয়ার্ল্ড এ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্ল্ড মুসলিম রিলিফ অর্গানাইজেশন প্রভৃতির ছত্রছায়ায় কাজ করে চলে। এগুলোর পিছনে বিশাল আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল বলে এগুলোকে কেউ ঘাটাতে সাহস পেত না। আসলে এগুলো ছিল জিহাদী নেটওয়ার্কের অংশ। এই নেটওয়ার্কের বেশকিছু ফ্রন্ট সংগঠন ওসামা বিন লাদেনের গড়া। মুজাহিদদের সাহায্যের জন্য নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে সোমালিয়ায় এক সুপ্রতিষ্ঠিত আর্থিক নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব ছিল। বিভিন্ন জিহাদপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠন এতে অর্থ যোগাত। ১৯৯১ সালের শেষদিকে এই নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ লাভের মধ্য দিয়ে সোমালিয়ার ইসলামী আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা চূড়ান্তরূপে বিন লাদেনের হাতের মুঠোয় চলে আসে। ফলে তার পক্ষে সোমালিয়ায় মার্কিনবিরোধী অভিযানে অর্থ যোগাতে এবং সে অভিযান অব্যাহত রাখতে কোন বেগ পেতে হয়নি।

সোমলিয়ায় দুর্ভিক্ষ ও গৃহযুদ্ধ বিস্তৃত হবার পাশাপাশি সেখানে জিহাদী ইসলামীদের ঘাঁটি সুসংহত ও প্রসারিত করার জন্য ইরান-সুদানের যৌথ প্রয়াস অব্যাহত থাকে। তারই অংশ হিসাবে সুদানে ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, কেনিয়া ও উগান্ডার যোদ্ধাদের জন্য আরও অনেক প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। বলা বাহুল্য, সেগুলো খোলার পিছনে ওসমা বিন লাদেনেরই ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। ১৯৯২ সালের শরতে তুরাবি গোটা পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিনবিরোধী তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশ দেয়ায় অল্পদিনের মধ্যে সুদান থেকে সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় জিহাদী নেতা ও বিশেষজ্ঞের অতিরিক্ত দল পাঠানো হয়।

 সে বছরের ২২ নভেম্বর সোমালিয়ায় মার্কিন সৈন্য প্রেরণ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে এই সব জিহাদী মোতায়েনও বৃদ্ধি পায়। সোমালিয়ার এই জিহাদীদের বলে দেয়া হয়েছিল যে, জিহাদী তৎপরতা চালানো ছাড়াও তারা মিলিশিয়াদের ট্রেনিং ও নেতৃত্ব দেবে। এজন্য তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সাজসরঞ্জামও দেয়া হয়। এই মিলিশিয়াদের অনেকে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের ভিতরে থেকে কাজ করেছে। অন্যরা করেছে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। বেশির ভাগ জিহাদী ইরিত্রিয়া হয়ে সোমালিয়া গেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিরা গোপনে সমুদ্র পথে এসে দক্ষিণ সোমালিয়া ও কেনিয়ায় নেমেছে। সোমালিয়ার এই জিহাদীরা সুদানের মাধ্যমে তেহরানের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিলো। আশির দশকের প্রথম দিকে বৈরুতে মার্কিন শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিরিয়া ও ইরান যেভাবে হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করেছিল ঠিক একইভাবে সোমালিয়ার এই জিহাদীদের মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছিল ইরান।

সোমালিয়া সঙ্কটে বিন লাদেন-২

আমেরিকান মেরিন সোমালিয়ার সৈকতে এসে নামে ১৯৯২-এর ডিসেম্বরের প্রথমভাগে। প্রথম কিছুদিন তাদের শান্তিপূর্ণভাবেই কাটে-স্থানীয় বাহিনীর সঙ্গে বড় ধরনের কোন সংঘর্ষের সম্মূখীন হতে হয়নি। পরিস্থিতি তখন তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকলেও সুদান ও ইরান লোহিত সাগর ও আফ্রিকা শৃঙ্গের ওপর যৌথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এজন্য ইসলামী জিহাদী শক্তিসমূহের প্রশিক্ষণ ও মোতায়েন সম্পন্ন করা হয়। সোমালিয়া এরা স্থানীয় শক্তিগুলোর পূর্ণ সমর্থন লাভ করে। যেমন- সোমালিল্যান্ডের নেতা আবদুর রহমান আহমদ আলী টুর যিনি তার এলাকায় শরয়ী আইন ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন তুরাবির অতি ঘনিষ্টজন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সুদান ও ইরানের সাহায্য পেয়েছিলেন। মধ্যসুদানে তুরাবি ও ওসামা বিন লাদেনের সবচেয়ে সক্রিয় ও অনুগত সমর্থক ছিলেন মোগদিসুর সাবেক পুলিশপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আবশির, যিনি সোমালী স্যালভেশন ডেমোক্র্যটিক ফ্রন্টের (ঝঝউচ) অন্যতম নেতা ছিলেন।

 সুদান, মিসর, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের “সেচ্চাসেবকরা” ১৯৯২ সালে ঝঝউচ এর বাহিনীতে যোগ দেয়। তা ছাড়া জেনারেল আইদিদ ও সুদান সরকারের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার অংশ হিসাবে আইদিদ আগে থেকেই সুদানের বৈষকি ও সামরিক সাহায্য পেয়ে আসছিলেন। ওদিকে ইথিওপিয়ায় ইরান ও সুদানের সাহায্যপুষ্ট ওরোমো লিবারেশন ফ্রন্ট রুপান্তরিত হয়ে গঠিত হয় ইসলামীক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ওরোমো। এই রূপান্তর সোমালিয়ার পরিস্থিতিরি ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। ১৯৯৩ সালে বিন লাদেন আয়োজিত ও সংগঠিত কিছু কিছু সরবরাহ পথ ওরোমো নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। জিবুতিতে তুরাবির সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন সে দেশের নিরাপত্তাপ্রধান ইসমাইল ওমর গুয়েলের চাচা। অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ জিবুতি দিয়ে সোমালিয়া পাঠানো হতো। প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এসব নেটওয়ার্ক তৈরি করা ও পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হতো এবং সেই অর্থ গোপনে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ারও দরকার হতো। সে দায়িত্বটা অনিবার্যরূপে এসে পড়েছিল বিন লাদেনের ওপর। তিনি নিরাপদে সেই অর্থ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন।

 শুধু তাই নয়, ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি সুদান ও ইরান পূর্ব আফ্রিকায় তাদের তৎপরতার ব্যাপক বিস্তার ঘটালে প্রচলিত আর্থিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেই প্রয়োজন মিটানো যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় বিন লাদেন ও তাঁর দল ইউরোপ ও পূর্ব আফ্রিকাজুড়ে তাঁদের প্রচলিত ব্যাবসায় ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টগুলো কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কোন কোন ক্ষেত্রে বিন লাদেন ও তাঁর বন্ধুরা অর্থের গোপন প্রবাহ ত্বরান্বিত করার জন্য পূর্ব আফ্রিকায় বেশ কিছু ছদ্ম কোম্পানি ও ভূয়া এ্যাকাউন্ট খুলে বসেছিলেন।১৯৯২ সালের শরৎকালের মধ্যে সোমালিয়ায় ইসলামী সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে বর্ধিত ও সম্প্রসারিত হয়। তাদের তৎপরতার কেন্দ্র হয় মোগাদিসু, মারকা ও বোসাসো। তুরাবির সৃষ্ট সোমালি ইসলামিক ইউনিয়ন পার্টি (ঝওটচ) উত্তরে বোসাসোয় এবং দক্ষিণে মারকা ও জামামিতে তাদের প্রবল উপস্থিতির স্বাক্ষর রাখে। 

ইথিওপিয়া সীমান্তের কাছে সোমালিল্যান্ড ওগাদেনে মুজাহিদদের জন্য আরও কিছু প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এ ক্ষেত্রেও বিন লাদেন গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুদান সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বেস ক্যাম্প ও গুদাম ইথিওপিয়ার মাটিতে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলে বিন লাদেন সেখানে বৈধ আন্তর্জাতিক কোম্পানী খোলেন। এই কোম্পানিগুলো তখন ঐ এলাকায় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে। এসব প্রকল্পের ছত্রছায়ায় ইথিওপিয়ায় অর্থ প্রেরণ করা হতে থাকে। এই অবকাঠামো সোমালিয়ায় মুজাহিদদের জোয়ার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। 

১৯৯২-এর ডিসেম্বরে মার্কিন মেরিন সোমালিয়ার সৈকতে নামার আগেই জিহাদী ইসলামী সংগঠনগুলো মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত ইরান-সুদান স্ট্রাটেজির দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। ইরান-সুদান স্ট্রাটেজির মূলকথা ছিল এই যে, গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে মার্কিন বাহিনীকে এমন অবস্থায় ফেলতে হবে যাতে সোমালিয়া তাদের জন্য একাটা ফাঁদ বা চোরাবালিতে পরিণত হয়। সোমালিয়ায় মার্কিন বাহিনীর ওপর আক্রমণের মহড়া হিসাবে দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেনে কিছু কিছু মার্কিন স্থাপনার উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব স্থাপনা সোমালিয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করেছিল।

 ইয়েমেনে বিন লাদেনের ব্যাপক যোগাযোগ থাকায় এই আক্রমণের সার্বিক পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তার হাতে অর্পিত হয়। সময়ের দিক থেকে প্রচন্ড চাপের মুখে কাজ করে বিন লাদেন আক্রমণ ত্বরান্বিত করার জন্য পুরানো ও পরীক্ষিত লোকজনকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। ইয়েমেনী “আফগানদের” অর্থাৎ আফগান যুদ্ধে অভিজ্ঞ ইয়েমেনের ইসলামী স্বেচ্চাসেবকদের নিয়ে প্রধান আক্রমণকারী দল গঠন করা হয়। মূল পরিকল্পনায় এডেনে মার্কিন সৈন্যদের ব্যবহৃত কয়েকটি হোটেল এবং সমুদ্র ও বিমানবন্দরে মার্কিন স্থাপনায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যবস্থা ছিল। সকল বাধাবিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মুখে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করার জন্য ওসামা বিন লাদেন এডেনের শেষ সুলতান ও জিহাদী ইসলামী শেখ তারিক আল ফাদলিকে তার লন্ডন প্রবাস ছেড়ে ইয়েমেনে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে এই অভিযানের দায়িত্ব নিতে রাজি করান। ফাদলিকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি গোপনে ইয়েমেনের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সময় বাঁচানোর জন্য এই স্কিমের প্রয়োজনে বিপুল অঙ্কের অর্থ ইয়েমেনে বিন লাদেনের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পাঠানো হয়।

ডিসেম্বরের প্রথমদিকে ‘ইয়েমেনী ইসলামিক জিহাদ’ নামক সংগঠনের ছত্রছায়ায় আক্রমণকারী দল সংগঠিত হয়। প্রায় ৫শ উন্নত ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইয়েমেনী আফগানের মধ্য থেকে মূল জিহাদীদের বেছে নেয়া হয়। এরা ছিল তারিক আল ফাদলির প্রত্যক্ষ কমান্ডের অধীনে। তাদের মূল ঘাঁটি ছিল সাদাহ এলাকায়। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে বিন লাদেন ও ফাদলি এডেনে আগ থেকে ইসলামী জিহাদের যেসব ঘাতক স্কোয়াড ছিল তাদের দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকদের হত্যা এবং আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বোমা হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যান। ২৯ ডিসেম্বর ইসলামী জিহাদীরা এডেন হোটেল ও গোল্ডেন মুর হোটেলে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটায়। এতে তিন আমেরিকান নিহত ও ৫জন আহত হয়। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে গোটা পরিকল্পনা জট পাকিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে। মার্কিন বিমানবাহিনীর পরিবহন বিমানগুলোকে লক্ষ্য করে আঘাত হানার প্রস্তুতি নেয়ার সময় এডেন বিমানবন্দরের প্রান্তে রকেট লঞ্চারসহ জিহাদীরা ধরা পড়ে। অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর ৮ জানুয়ারি শেখ ফাদলি ও তার সহকর্মীরা এডেন কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা দেন। গোটা অভিযানের নেপথ্যে যে বিন লাদেন ছিলেন তা ফাঁস হয়ে যায়। 

সোমালিয়া: চূড়ান্ত আঘাতের প্রস্তুতি


সোমালিয়ায় মার্কিনবিরোধী লড়াই শুরু হওয়ার আগে ১৯৯২-এর শেষভাগ থেকে ১৯৯৩ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সুদান থেকে শুরু করে ইয়েমেন, সোমালিয়া ও ওগাদেন পর্যন্ত আফ্রিকা শৃঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী জিহাদীদের মোতায়েন সম্পন্ন হয়ে যায়। এদের মধ্যে ইরানের আল-কুদ্স বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট আফগানরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইয়েমেনের ইসলামিক জিহাদের এলিট ইউনিট। তার ওপর সমর পরিকল্পকদের চাপে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তান থেকে আরও তিন হাজার আফগান যোদ্ধা নিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য এই আফগানরা ছিল বিভিন্ন দেশের ইসলামী যোদ্ধা যারা আফগানিস্তানের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এই আফগানরা তাদের সাথে ভারি অস্ত্রপাতি এবং জিহাদী কাজে ব্যবহার্য সাজসরঞ্জাম নিয়ে এসেছিল, যার মধ্যে ছিল উচ্চশক্তির বিস্ফোরক, অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল বোমা, বুবি-ট্রাপ পুতুল এবং কিছু স্টিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র। এই আফগান এলিট ফোর্স ইয়েমেনের আল-মারাকিশাহ পর্বতাঞ্চলের সাদাহ এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে।

 ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সোমালিয়ার লড়াই বিস্তার লাভ করার মুখে বিন লাদেন অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামসহ এই আফগানদের বিমানযোগে দ্রুত ইয়েমেন থেকে সোমালিয়ায় স্থানান্তর করেন। পরে এক মিসরীয় সাংবাদিকের কাছে বিন লাদেন বলেছিলেন যে, ঐ অভিযানে তাঁর একান্তভাবে নিজের ৩০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছিল। একই সময় সরাসরি ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন ইরানী পাসদারান ও সোমালীয় জিহাদীদের সুদানে সংগঠিত করা হয়। যাতে করে তারা অতর্কিত সুইসাইড অভিযান চালানোর কৌশলে পারদর্শী সুদানী ইসলামিক ইউনিয়নের (ঝওটচ) ইউনিটগুলোকে সাহায্য সমর্থন যোগাতে পারে। তাছাড়া সোমালিয়ায় হস্তক্ষেপ করার জন্য আলাদাভাবে রেখে দেয়া বেশ কয়েক শ’ আফগানকে সোমালিয়ায় পাঠানোর আগে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য লিবীয় সীমান্তের কাছে রাখা হয়। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি খার্তুমে জিহাদ বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে আফ্রিকা শৃঙ্গ পরিস্থিতির পার্যালোচনা করে সোমালিয়ায় জিহাদ বিস্তার করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গ্রীন সিগনাল দেয়া হয়।

 সেই বৈঠকে জেনারেল ফারাহ আইদিদের সিনিয়র কমান্ডাররাও অংশ নেন। এই বৈঠক পরবর্তী ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে আইদিদ ও তাঁর প্রধান সামরিক ও গোয়েন্দা সহকর্মীরা পর পর ইরান, ইয়েমেন, সুদান, ইথিওপিয়া ও উগান্ডা সফর করে মূল পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময়ের দিকে শেখ আইদিদ খার্তুমে ইরাকী দূতাবাসে ইরাকী গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। বলাবাহুল্য তুরাবি ছিলেন এসব বৈঠকের আয়োজক। বাগদাদ আইদিদকে ব্যাপকভিত্তিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে বছরের বসন্তে মোগাদিসু অভিযান সাদ্দাম হোসেনের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যে, তিনি তাঁর ছেলে কুসায়কে সোমালিয়া তথা আফ্রিকা শৃঙ্গে মার্কিনবিরোধী অভিযানে ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব দেন। খার্তুমে ইরাকী গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এ সময় বলতে শোনা যায় যে, সাদ্দাম হোসেন সোমালিয় যুদ্ধে বড় ধরনের বিজয় অর্জনে সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলেন।


অচিরেই সাদ্দাম হোসেনের নিজস্ব স্পেশাল সিকিউরিটি এজেন্সির সদস্যসহ বেশকিছু গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞের আগমনে খার্তুমে ইরাকী দূতাবাস স্ফীত হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্যকারীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালের জুন মাসের মধ্যে ইরানী পাসদারান, লেবাননী হিজবুল্লাহ, আরব আফগান এবং সুদানের ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট, সোমালিয়ার ঝওটচ, কেনিয়ার ইসলামিক রিপাবলিক অর্গানাইজেশন, ইসলামিক ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অব ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া ইসলামী জিহাদসহ তুখোড় ইসলামী জিহাদীদের বেশকিছু দল সোমালিয়ায় গোপনে মোতায়েনের কাজ সম্পন্ন হয়। তার ওপর বিন লাদেন নিয়ে আসেন বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামসহ প্রায় তিন হাজার মুজাহিদ সদস্য। সামগ্রিকভাবে এই ইসলামী বাহিনীর সিংহভাগ অংশ বিন লাদেনের সংগৃহীত খামারগুলোতে এসে জড়ো হয়। সেখানে তারা তাদের পশ্চাদবর্তী স্থাপনা গড়ে তোলে। এসব নিরাপদ আশ্রয় থেকে তাদেরকে অভিযান চালাতে পাঠানো হয়।গ্রিষ্মের প্রথমদিকে প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ইসলামী জিহাদীরা রাজধানী মোগাদিস্যুতে মার্কিন ও জাতিসংঘ বাহিনীর ওপর বোমা হামলাসহ বেশকিছু এ্যামবুশ শুরু করে।

 ১৯৯৩ সালের ৫ জুন এক বড় ধরনের এ্যামবুশ চালিয়ে তারা জাতিসংঘ বাহিনীর ২৩ সৈন্যকে হত্যা করে। স্থানে স্থানে মার্কিন ও জাতিসংঘ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এসব সংঘর্ষের আশু ও নাটকীয় প্রভাব পড়ে জেনারেল আইদিদের পতাকাতলে সমবেত ইসলামী জোটের শক্তি ও সংহতির ওপর। একটা একীভূত হাই কমান্ডের আবির্ভাব ঘটে।এই লড়াই চালাতে গিয়ে আইদিদ ব্যাপক জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন বাহিনীর মোকাবালা করে তিনি বীরের আসন লাভ করেন। মার্কিন বিরোধী অভিযান চালানোর ফলে সোমালিয়ার অনেক ট্রাইব এবং রাজনৈতিক-সামরিক শক্তি আইদিদের সোমালী ন্যাশনাল এ্যালায়েন্সের (ঝঘঅ) নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে যোগ দেয় এবং আইদিদকে তাদের সর্বাধিনায়ক হিসাবে মেনে নেয়। এদিকে একটানা চোরাগোপ্তা হামলা ও বোমাবাজির জবাবে মার্কিন ও জাতিসংঘ বাহিনী প্রবল গোলাবর্ষণ শুরু করে। ফলে রাজধানী মোগাদিসুতে সংঘর্ষের ব্যাপক বিস্তার হয়।

১১ জুন আইদিদ ও তাঁর কয়েক সিনিয়র কমান্ডার খার্তুমে গিয়ে ‘পিপলস এ্যারাব এ্যান্ড ইসলামিক কংগ্রেস’-এর ছত্রছায়ায় এক গুপ্ত পরামর্শ সভায় মিলিত হন। তুরাবির সভাপতিত্বে এই সভায় সোমালিয়ায় জিহাদের বিস্তার ঘটানোর এবং ইসলামী জিহাদীদের সাহায্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই কংগ্রেসেই বিন লাদেন তুরাবির ইনার সার্কেলের অন্যতম উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মিসরীয় নেতা আইমান-আল-জাওয়াহিরিও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। জুন মাসের খার্তুম বৈঠকের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এই যে, সোমালিয়ায় অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে বাগদাদকে বৃহত্তর ভূমিকা গ্রহণের সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয় এবং ভিয়েতনামে যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে গেরিলা যুদ্ধে টেনে আনার লক্ষ্যে ইরাকী-সুদানী-ইরানী সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

১৩ থেকে ২৫ জুন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েক দফা বিমান হামলা চালায়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সোমালী মিলিশিয়ারা প্রবল প্রতিরোধ দেয়। তারা মার্কিন স্থল সেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং আইদিদকে ধরার জন্য ‘কোবরা’ গানশিপের অভিযানে ব্যর্থ করে দেয়। ওদিকে খার্তুম সম্মেলন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সারির বেশকিছু জিহাদ বিশেষজ্ঞ গোপনে সোমালিয়া এমনকি মোগাদিসুতে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করেন। জাওয়াহিরিকে সরাসরি সোমালীল্যান্ডে পাঠানো হয়। অন্যদিকে খার্তুমে ওসামা বিন লাদেন আরেকটি যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলছিলেন।

বলা যেতে পারে তিনি হাজার হাজার লোককে গোপনে সুদান থেকে তৃতীয় রাষ্ট্র ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া দিয়ে সোমালিয়ায় আনার সুবিশাল উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ মরুভূমির চরম বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। গোটা উদ্যোগের জন্য বিন লাদেন ট্রাক ও জ্বালানি খাদ্য, পানি, অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক ও মেডিক্যাল কিট প্রভৃতি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যে সোমালিয়ায় ইসলামী জিহাদ অবকাঠামো সুসংহত হতে শুরু করেছে। তাঁদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মোগাদিসুর দক্ষিণে ওরং কিসমানু, বার্দহিরি, মারকা ও গালকাইওতে। গালকাইও ছিল আইদিদের অন্যতম ঘাঁটি। ইরানী গোয়েন্দারা বোসাসোতে গোপনে ট্যাংকবিধ্বংসী ও বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র বসায়। এছাড়া ইরাকের এলিট স্ট্রাইক ফোর্স-আস সাইকা কমান্ডোর প্রায় ১২ শ’ সদস্য সোমালিয়ায় মোতায়েন করা হয় মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলায় অংশ নেয়ার জন্য। তার ওপর ইসলামী জিহাদ বিশেষজ্ঞদের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও সংগঠিত প্রায় ১৫ হাজার সোমালী মার্কিনবিরোধী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল।

বিন লাদেনের চোখে যুক্তরাষ্ট্র

১৯৯৩ সালের ১২ জুলাই মোগাদিসুতে মার্কিন হামলার পর পরই জেনারেল আইদিদ আহূত সিনিয়র কমান্ডারদের বৈঠকে বোসাসোয় মোতায়েন বিভিন্ন দেশের জিহাদী বাহিনীকে ব্যাপক তৎপরতা শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়। সাহায্যকর্মীসহ মার্কিন ও জাতিসংঘ সেনাদের ওপর হামলা ঐ মাসে শুধু মোগাদিসুতে নয়, গোটা মধ্য সোমালিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সোমালী নাগরিকদের হত্যার বদলা নিতে আইদিদ অনুসারীদের যে কোন স্থানে মার্কিন বানিীর ওপর আঘাত হানতে বলে দেয়া হয়। আইদিদ বাহিনী মার্কিন দূতাবাসে ও জাতিসংঘ অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে। জুলাইয়ের গোটা সময় ধরে এই বিক্ষিপ্ত হামলা চলতে থাকে। প্রচার মাধ্যমে জেনারেল আইদিদকে ইচ্ছা করেই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে।

 যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘসহ সবার দৃষ্টি আইদিদের কর্মকা- এবং বক্তব্য-বিবৃতির ওপর নিবদ্ধ তখন তারই ছত্রছায়ায় মোগাদিসু শহরে যুুদ্ধে নতুন অংশগ্রহণকারীর আগমণ হয়। এরা হল ভ্যান গার্ড অব দি সোমালি ইসলামিক স্যালভেশন। ৩ আগস্ট সংস্থা নিজস্ব বেতার ঘোষণায় ও প্রচারপত্রে ‘শয়তান’ মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ বিস্তারের জন্য সোমালীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই দিন শেখ আইদিদের বেতার ভাষণেও একই কথা উচ্চারিত হয়। ১৯৯৩ এর আগস্টের প্রথমভাগে আইদিদ বাহিনী ও তার মিত্ররা দক্ষিণ মোগাদিসুতে বড় ধরনের লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। এ সময় সোমালী ইসলামিক স্যালভেশন মুভমেন্ট (ঝওঝঘ) যোদ্ধারা প্রথমবারের মতো মার্কিন সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে রিমোর্ট কন্ট্রোল বোমার সাহায্যে চার মার্কিন সৈন্যকে হত্যা করে। এরপর আরও বেশকিছু অভিযান চালায়। 

১৯৯৩ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সোমালী ইসলামিক ইউনিয়ন পার্টির (ঝওটচ) পতাকাতলে ইসলামী এলিট বাহিনী মার্কিন সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।৬ সেপ্টেম্বর তারা মোগাদিসুতে জাতিসংঘ অবস্থানে একের পর এক বহু হামলা চালায়। ৫ সেপ্টেম্বর এদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আইদিদ বাহিনী জাতিসংঘ বাহিনীর ৯ নাইজেরিয়ান সৈন্য হত্যা করে। কোণঠাসা নাইজেরীয়দের উদ্ধারে মার্কিন সৈন্যদের ব্যাপক হস্তক্ষেপ এবং প্রচন্ড গোলাগুলি চালাতে হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর আইদিদ বাহিনীর সঙ্গে মার্কিন সৈন্যদের তুমুল লড়াই হয়। মার্কিন বাহিনী অসংখ্য অসামরিক নাগরিক হত্যা করে। এরপর শুরু হয় সহিংসতার বিরামহীন চক্র। ১৫ সেপ্টেম্বর আইদিদ ও মুজাহিদ বাহিনী দিনের বেলায় জাতিসংঘ সদর দফতরে মর্টার হামলা চালায়। ইসলামী জিহাদীরা ও সোমালী ন্যাশনাল এ্যালায়ন্স মার্কিন হেলিকপ্টার অ্যাম্বুশ করতে শুরু করে। ২৬ সেপ্টেম্বর মোগাদিসুতে একটা ব্ল্যাকহক গুলি করে ভূপাতিত করে। উৎফুল্ল সোমালী জনতা নিহত মার্কিন বৈমানিকের লাশ রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় টেনে নিয়ে যায়। ১৯৯৩ সালের শরতের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী জিহাদীদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার ফলে সোমালিয়ায় সংঘর্ষের বিস্তার ঘটেছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে,

মোগাদিসুকে আমেরিকানদের জন্য দ্বিতীয় বৈরুত বা দ্বিতীয় কাবুল বানানো। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ইসলামী জিহাদীরা পরিস্কার টের পেয়ে যায়, আমেরিকানরা মোগাদিসুর চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেছে। এখন বাকি রয়েছে তাদের অবমাননার সঙ্গে বিদায় দেয়ার পালা। মোগাদিসুর লড়াইটা ছিল ইসলামিক ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল কমান্ডের অধীনে পরিচালিত প্রথম বড় ধরনের লড়াই। হাসান আল-তুরাবি সার্বিক কর্মকান্ডের সিনিয়র নেতার ভূমিকায় আবির্র্ভূত হন। 

আইমান আল জাওয়াহিরি, আবদুল্লাহ জাভেদ (আফগান) ও কামারুদ্দীন ধারবান (আলজিরীয়) সরাসরি তাঁর অধীনে থেকে সমরিক তৎপরতা চালান। ওসামা বিন লাদেন ছিলেন লজিষ্টিক্যাল সাপোর্টের দায়িত্বে। ১৯৯৩ সালের শরতে জাওয়াহিরি সরাসরি সোমালিয়ায় থেকে আইদিদের সিনিয়র সামরিক সহকর্মী হিসাবে কাজ করেন। সোমালিয়া যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ড কমান্ডার জাওয়াহিরি তাঁর সঙ্গে সেখানে আলী আল রশিদীকে নিয়ে যান। তিনি আবু উবায়দা আল বানসিড়ি বা আবু উবায়দা আল বানজাসিড়ি নামেও পরিচিত। জাওয়াহিরির অতি বিশ্বস্ত বন্ধু আল রশিদী মিসরীয় পুলিশ বাহিনীতে ইসলামী জিহাদের গুপ্ত সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ সালে তাঁকে সাদাত হত্যাকান্ডের পর গ্রেফতার করা হয়। পরে ১৯৮৬ সালে তিনি সুকৌশলে আফগানিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি বিন লাদেনের বাহিনীতে যোগ দেন এবং দু’জনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যান। আল রশিদী ছিলেন লাদেনের ডান হাত। 

---চলমান।

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(১০)

গোপন লেনদেনে বিন লাদেন

বৈরী পরিস্থিতির কারণে সৌদি আরবে টিকতে না পেরে ১৯৯১ সালে সুদানে চলে গেয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন। ভেবেছিলেন সেখানে নতুন করে ব্যবসায়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবেন। পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে স্থির হয়ে বসবেন। শেষের উদ্দেশ্যটি অবশ্য পূরণ হয়নি। তবে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন ইসলামী জিহাদ আন্দোলন সংগঠনে। ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে গিয়ে বিন লাদেন আগে সুদান ও অন্যান্য দেশে বিশেষ করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও পূর্ব আফ্রিকায় কোথায় কী বিনিয়োগের সুযোগ আছে তা পরীক্ষা করে দেখেন। 

আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে অর্থ সংস্থান বেশ আকর্ষণীয় ও লাভজনক বিনিয়োগ। ওদিকেই বিন লাদেনের ঝোঁক ছিল বেশি। সেদিকেই তিনি ঝুঁকে পড়লেন এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থলগ্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এই সুসম্পর্কের বদৌলতে পরবর্তীকালে তিনি হয়ে দাঁড়ান বিশ্বব্যাপী ইসলামী জিহাদীদের অর্থ প্রেরণ ও আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম। কিভাবে সেটা ঘটল তার একটা পটভূমি আছে এবং এখানে সে সম্পর্ক দু’চার কথা না বললেই নয়। বিসিসিআই ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা কে না জানেন। ১৯৯১ সালের ৫ জুলাই ব্যাংকটি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানত উপরসাগরীয় আরব দেশগুলোর ধনী শেখদের অর্থ সংস্থানে গঠিত ব্যাংকটি পাকিস্তানীদের দ্বারা পরিচালিত হতো।

 বিসিসিআই কত রকম গোপন কর্মকান্ডে যে জড়িত ছিল তার ঠিক নেই। জিহাদী, মুসলিম গুপ্ত সংস্থা ও মুজাহিদদের অর্থ যোগাত। অস্ত্রশস্ত্র ও স্পর্শকাতর স্ট্র্যাটেজিক প্রযুক্তি কেনার ব্যাপারে গোপন আর্থিক লেনদেন করত। উন্নয়নশীল বিশ্বের দুর্নীতিবাজ নেতাদের মেরে দেয়া টাকা পয়সা গচ্ছিত রাখা বা অন্যত্র পাচার করা এসব কাজ তো ছিলই। আশির দশকের বিসিসিআই ব্যাংক ছিল আফগান মুজাহিদদের সিআইএ’র দেয়া গোপন সাহায্য হস্তান্তরের প্রধান মাধ্যম। সৌদি আরব, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশও তাদের গোপন কার্যক্রমের জন্য বিসিসিআইয়ের বিচিত্র কৌশলকে কাজে লাগাত।

 কাজে কাজেই আফগান মুজাহিদরা ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠনও যে বিসিসিআই-কে ব্যবহার করেছিল তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সেসব গোপন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট কোন নথিপত্র রাখেনি। নিজেদের জড়িত থাকারও কোন প্রমাণ রাখেনি। আর্থিক শক্তির দিক দিয়ে ব্যাংকটি ছিল অন্তঃসারশূন্য এবং সত্যিকারের আর্থিক সচ্ছলতা কখনই ছিল না। কাজেই ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে ব্যাংকটি যখন বন্ধ করে দেয়া হলো, ক্লায়েন্টদের অনেকেই পথে বসল। জিহাদী ও অন্যান্য গুপ্ত সংস্থার গচ্ছিত বিপুল অঙ্কের অর্থ শুধু যে খোয়া গেল তাই নয়, তাদের লেনদেন পরিচালনার একান্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আর কোন প্রতিষ্ঠানও রইল না। 


বিশ্বব্যাপী নতুন ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের জোয়ার যখন সৃষ্টি হতে চলেছে তখন এসব কার্যক্রমে গোপনে ও নিরাপদে অর্থ সংস্থানের এমন একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের অনুপস্থিতি আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের চিন্তায় ফেলল। এই সমস্যার সমাধান এনে পপুলার ইন্টারন্যাশনাল আর্গ্যানাইজেশন এবং আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট এর জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনঃর্নিমাণ করতে পারবে এমন একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা তীব্ররূপে অনুভূত হলো। আর্থিক ক্ষেত্রে এ ধরনের ভজঘট অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এনে দেয়ার ব্যাপারে সে সময় খার্তুমে ওসামা বিন লাদেনের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ ছিলেন না। সেটা বুঝতে পেরেই স্বয়ং তুরাবি ১৯৯১ সালের গ্রীষ্মে সরাসরি এ ব্যাপারে বিন লাদেনের সাহায্য কামনা করলেন। ইসলামী জিহাদ তৎপরতায় সহায়তা দানের জন্য একটা নির্ভরযোগ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্ব তুরাবি সর্বদাই অনুভব করেছিলেন। বশির যখন ক্ষমতা দখল করলেন ততদিনে সুদান গোটা অঞ্চলের, বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকার ইসলামী জিহাদ আন্দোলনে অর্থ সংস্থানের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 

আশির দশকের শেষদিকে তুরাবির তত্ত্বাবধানে ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুড পাশ্চাত্যে পরিচালিত কয়েকটি বড় ধরনের ইসলামী অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। যেমন- ইসলামিক হোল্ডিং কোম্পানি, জর্ডানিয়ন ইসলামিক ব্যাংক, দি দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, দি ফয়সাল ইসলামীক ব্যাংক প্রভৃতি। ১৯৯১ সালে আজিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় তাকওয়া ব্যাংক। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুড এই তাকওয়া ব্যাংককে জিহাদীদের বিশ্বব্যাংক হিসাবে গণ্য করতে থাকে। যার লক্ষ্য হচ্ছে পাশ্চাত্যের অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া। ইসলামী জিহাদী সংস্থা বা আন্দোলনগুলো একদিকে তাদের গোপন কার্যক্রমে আর্থিক লেনদেনের জন্য বহুলাংশে বিসিসিআইয়ের ওপর নির্ভর করে চলছিল এবং অন্যদিকে নতুন ইসলামী ব্যাংকগুলোকেও তাদের কর্মকান্ডের সঙ্গে ধাতস্থ করে তুলেছিল। ঠিক এমনি সময় হলো বিপর্যয়। বিসিসিআই মুখ থুবড়ে পড়ল। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুডের কাজকর্ম তখন অর্থাভাবে ব্যাহত হতে লাগল।

 ইসলামী আন্দোলনগুলোতে আর্থিক সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে সুদান ও ইরানের মধ্যে একটা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। ইরান সেই অর্র্থ পাঠানোর আগেই তা গোপনে সঞ্চিত রাখার বা ট্রান্সফার করার মতো এ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করার দরকার হয়ে পড়ল। এ অবস্থায় বিন লাদেন স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন। তিনি নিজের কোম্পানির ইন্টারন্যাশনাল এ্যাকাউন্টকে ইসলামী তহবিলের ভেন্যু ও ফ্রন্ট হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ দিলেন। এভাবে ১৯৯১ সালের শেষদিকে তেহরানের পাঠানো ৩ কোটি ডলার জমাও হলো বিন লাদেনের কোম্পানির এ্যাকাউন্টে। বিশ্বজুড়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের ব্যাংকগুলোর কাজকর্ম এবং তারা কোথায় কোথায় গোপনে অর্থ পাঠাচ্ছে তার ওপর তীক্ষ নজর রেখে চলছিল। বিন লাদেনের কোম্পানির এ্যাকাউন্টে অর্থ ট্রান্সফারের কাজটা প্রকাশ্যেই ঘটেছিল এবং তা থেকে কারও কিছুই সন্দেহ করার কারণ ঘটেনি। কেননা লাদেনের তখনকার বাহ্যিক পরিচয় একজন ধনকুবের ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছু ছিল না। 

বিন লাদেনের বিস্ময়কর নেটওয়ার্ক


বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধ হবার ফলে দেশে দেশে ইসলামী জিহাদী কার্যকলাপের পিছনে বিভিন্ন মহলের দেয়া অর্থ গোপনে প্রেরণের ক্ষেত্রে সাময়িক অচলাবস্থা দেখা দিলেও এভাবে বিন লাদেন তার একক বুদ্ধি ও চাতুর্যের দ্বারা তা দূর করতে সক্ষম হন। বিন লাদেন এরপর ব্যবস্থাটিকে আরেকটু প্রসারিত করেন। ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সুদানী ব্যাংকে বিন লাদেন তাঁর কোম্পানির নামে বেশ কিছু এ্যাকাউন্ট খোলেন। এই এ্যকাউন্টগুলোই গোপনে অর্থ প্রেরণ ও ট্রান্সফারের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। এভাবেই আলজিরিয়ায় নির্বাচনের প্রাক্কালে ধনী ইরানীদের এবং শেখ শাসিত উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর র‌্যাডিকল ইসলামপন্থীদের দেয়া ১ কোটি ২০ লাখ ডলার খার্তুমে ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক শাখায় গচ্ছিত রাখা হয়। সেখান থেকে তা পোপনে পাচার করা হয় আলজিরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টকে সাহায্য করার জন্য। বলাবাহুল্য, ঐ নির্বাচনে স্যালভেশন ফ্রন্ট কার্য ত বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৯২ সালের প্রথমদিকে সুদানে এভাবে আরও ২ কোটি ডলার ট্রান্সফার করা হয়। তার পর সেখান থেকে পাঠানো হয় আলজিরিয়ায়। এরও উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টকে সাহায্য করা। ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি ইরান জিহাদী প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সুদানকে ৩ কোটি ডলার সাহায্য দেয়। এটা হার্ড কারেন্সিতে দেয়া হয়েছিল। অবশ্য এই অর্থের সিংহভাগ লন্ডনের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়, যা ছিল তুরাবির নিয়ন্ত্রণে। পরে ঐ অর্থ আন্তর্জাতিক জিহাদী তৎপরতায় ব্যয় হয়েছিল। সুদানে জিহাদী প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচ খার্তুম তার জাতীয় বাজেট থেকে মিটিয়েছিল। 

বিন লাদেন জানতেন যে, গোপনে অর্থ প্রেরণ ও বিলিবণ্টনের যে ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলেছেন সেটা একটা সাময়িক জোড়াতালি ব্যবস্থা মাত্র। এর চেয়ে অনেক বেশি সুসংবদ্ধ ও স্থায়ী ব্যবস্থা থাকা দরকার। তুরাবিও এই ধারণার সাথে একমত ছিলেন। ওদিকে আফগান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার আফগানিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য পাশ্চাত্যে চোরাচালান করার এবং এই ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা জিহাদী নেটওয়ার্ক বিস্তারে সাহায্যের জন্য যথাযথ সংস্থাকে পাঠানোর ব্যাপারে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যেও অর্থ লেনদেনের আরেক কৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বিন লাদেন এ ব্যাপারে দ্বৈত কৌশল অবলম্বন করলেন। প্রথমে তিনি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকে বেশকিছু এ্যকাউন্ট খুললেন এবং ওগুলোতে নিজের টাকা ও তুরাবির ধনবান সমর্থকদের টাকা জমা রাখলেন। এই টাকা অন্যান্য লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধানত কোল্যাটারল বা জামানত হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে অপেক্ষাকৃত ন্যায়সঙ্গত কিছু কিছু খরচও এসব এ্যাকাউন্ট থেকে মিটানো হয়েছিল। যেমন, ১৯৯৩ সালে সুদান ও অন্যান্য এলাকায় অবস্থানরত আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ সৈনিকদের খাদ্য ও ঔষধপত্র সংগ্রহের খরচ মিটানোর জন্য বিন লাদেন দুই মিলিয়ন ডলারের একটি চেক দিয়েছিলেন। চেকটি ছিল ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংকে বিন লাদেনের ব্যক্তিগত একটি এ্যাকাউন্টের। চেকটা তিনি নিজের হাতে তুরাবিকে দিয়েছিলেন বলে বিন লাদেন দাবি করেন। 

কিন্তু ওটা ছিল ছোটখাটো অঙ্কের লেনদেন। বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন পরিচালনার জন্য আরও ব্যাপক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। সেই লক্ষ্যে বিন লাদেন এবং তুরাবির অনুগত কিছু সুদানী ধনী ব্যবসায়ী খার্তুমের শামাল (নর্থ) ইসলামিক ব্যাংকে মূলধন যুগিয়েছিলেন। বিন লাদেন দাবি করেছেন যে, ব্যাংকের মূলধন বাবদ তিনি দিয়েছিলেন ৫ কোটি ডলার। তবে সে অর্র্থটা তার নিজের ছিল, নাকি অন্য কারও ছিল জানা যায়নি। ইসলামী জিহাদের আর্থিক প্রয়োজন মিটাতে শামাল ব্যাংকের মাধ্যমে অনেক রকম লেনদেন করা হয়। এ ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে দেয়ার জন্য সুদান সরকার খুশি হয়ে বিন লাদেনকে পশ্চিম সুদানে ও করডোফানো এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ একর জমির মালিকানা দিয়ে দেন। বিল লাদেনের পক্ষ থেকে আজও এ জমি চাষাবাদের কাজে এবং গবাদিপশু পালনে ব্যবহার করা হচ্ছে।বিন লাদেন উদ্ভাবিত এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কী পরিমাণ অর্থ জড়িত ছিল তার একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে, খুব সম্ভবত ১৯৯৩ বা ৯৪ সালে তুরাবি ইসলামিক এ্যাবার পিপলস কংগ্রেস এর আওতাভুক্ত দেশগুলোতে ইসলামী জিহাদ পরিচালনায় অর্থ সংস্থানের জন্য একটা বিশেষ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রায় ১০ কোটি ডলার এই তহবিল গঠনের জন্য দেয়া হয়। তহবিল দেখাশোনার জন্য তুরাবির সহকর্মী ইব্রাহিম আল-সানুসিকে চেয়ারম্যান করে একটি বিশেষ কমিটিও গঠিত হয়। এই তহবিল ছিল ধরনের অসংখ্য তহবিলের একটি। 

কিন্তু এ ছিল সবে শুরু। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ বিন লাদেন তাঁর আফগান জীবনের সময়কার সহায্যদাতা ও পারিবারিক যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন যার প্রকৃত স্বরূপ বের করতে পারা চরম শত্রুর দিক থেকেও ছিল অসম্ভব। প্রথমে বিন লাদেন তাঁর নব উদ্ভাবিত আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থাটিকে আইমান আল-জাওয়াহিরির জিহাদী নেটওয়ার্কের সাহায্যার্থে কাজে লাগান। বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও সহকর্মী জাওয়াহিরি সে সময় ইউরোপে অতিউন্নত ধরনের এক জিহাদী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছিলেন। জাওয়াহিরির জিহাদী নেটওয়ার্কে অর্থ সংস্থানের কাজটি সে সময় “ব্রাদারহুড গ্রুপ’ নামে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপটির মূল শক্তি হিসাবে ছিল এবং সম্ভাবত এখনও আছে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর ১৩৪ আরব ধনকুবের। 

এঁদের মাধ্যমে অতিসুকৌশলে জিহাদীদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেয়া হতো। উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া যাতে তারা সাহায্যদাতা দেশেগুলোর সাথে জিহাদীদের কোন রকম যোগসূত্র বের করতে না পারে। ‘ব্রাদারহুড গ্রুপের’ প্রধান সদস্যরা পাশ্চাত্যে অর্থলগ্নির ক্ষেত্রে সুপরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে এদের ৬৫ জনের বড় বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান আছে। নয়া ব্যবস্থায় এসব কোম্পানি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান জিহাদীদের আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম, ছত্রছায়া ও ফ্রন্ট হিসাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে নিযুক্ত জিহাদী বা তাদের নেতৃবৃন্দকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লোকদেখানো চাকরি দিয়ে এবং ব্যবসায়িক ভিসার ব্যবস্থা করে ওসব দেশে তাদের বৈধ উপস্থিতির পথ সুগম করে দিয়েছে। এভাবে বিন লাদেনের উদ্ভাবিত গোটা আর্থিক ব্যবস্থাটি অতি দক্ষতার সাথে ও সুচারুরূপে চলছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এই যে, গোটা পাশ্চাত্যের কোথাও জিহাদীদের উদ্দেশ্যে দেয়া অর্থ ধরা পড়েনি বা আটক হয়নি। বিন লাদেন আয়োজিত এই বিস্ময়কর নেটওয়ার্ক জেনেভা, লন্ডন, শিকাগোসহ বিশ্বের দেশে দেশে নীরবে নিঃশব্দে লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করে চলেছে। 

চ্যারিটির ছত্রছায়ায় জিহাদী কর্যক্রম


১৯৯৩ সালের মে মাস। একজন সিনিয়র জিহাদী কমান্ডারের কাছ থেকে উদ্ধার করা কিছু নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে মিসরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশ্চর্য এক তথ্য পেলেন। বলা যেতে পারে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল। তারা জানতে পারলেন যে, মিসরীয় জিহাদীদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম ও প্রিন্টিং প্রেস কিনতে সাহায্য করার জন্য একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ আসছে এবং সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিন লাদেনের সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কোনটি, কিছুতেই তার হদিস বের করা গেল না। মিসরীয় গোয়েন্দারা একটা বড় অঙ্কের অর্থের চালানের কথাও জানতে পারলেন, যা জিহাদী নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। কিন্তু কিছুতেই ঐ অর্থের প্রবাহ রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তারা বুঝলেন, এ জাতীয় অর্থের চালান মিসরে প্রায়ই এসে থাকে। তবে কোন পথে সেটা প্রহেলিকাই থেকে গেল।

 ১৯৯৪ সালে মিসরীয় নিরাপত্তা সার্ভিস হিসাব করে দেখে যে, প্রতিবছর অজ্ঞাত সূত্র থেকে মিসরে এ জাতীয় অর্থ গড়ে ৫০ কোটি মিসরীয় পাউন্ড এসে থাকে। অস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনা, জিহাদী অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের বেতনভাতা দান, কারারুদ্ধ বা আটক মুজাহিদদের পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ প্রভৃতি কাজে ঐ অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে। সে সময় একটানা অসংখ্য জিহাদী কর্মকান্ড ঘটছিল মিসরে এবং সেগুলোর সাথে অর্থের ঐ অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের একটা নিবিড় যোগসূত্র ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিদেশ থেকে আগত কিছু চেক আটক করা হলেও মিসরের নিরাপত্তা বিভাগ এসব অর্থের উৎসের যেমন হদিস বের করতে পারেনি, তেমনি পারেনি এর প্রবাহ বন্ধ করকে। এমন ব্যাপার শুধু যে মিসরের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল তা নয়, আরও বেশ কিছু দেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অর্থ সরবরাহের এমনি অদৃশ্য ব্যবস্থা বিন লাদেনের উদ্ভাবিত বলে মনে করা হয়। বিন লাদেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যা প্রায় বৈধ মর্যাদা পেয়েছিল। বিশেষ করে পাশ্চাত্যে পরাজিত ইসলামী জিহাদীদের জন্য বিন লাদেন এ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। ব্যবস্থাটি প্রথমে আল-কায়দা ফাউন্ডেশন নামে একটি সাহায্য সংস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি বিন লাদেন ও তার ভাবপুরুষ শেখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম মিলে ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রুশবিরেধী আফগান যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও প্রেরণ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।

 ঐ যুদ্ধ শেষ হবার পর ফাউন্ডেশনটি পুনর্গঠিত করা হয় এবং এর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ পাঠানো হয় সারা বিশ্বে বিশেষ করে বসনিয়া, আলবেনিয়া ও কসোভোর মতো এলাকার ইসলামী কেন্দ্র ও মানবিক ত্রাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায্যের জন্য, যেখানে মুজাহিদরা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার লড়াইয়ে নিয়োজিত। পরবর্তীকালে এই ফাউন্ডেশনকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানবিক সাহায্য সংগঠন গড়ে ওঠে। ব্যহ্যিকভাবে মনে হতে পারে যে, এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। ভিতরে ভিতরে নিবিড় যোগাযোগ আছে। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অর্থ ও লোকবলও অহরহ দেয়া নেয়া হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষে এদের মধ্যকার সত্যিকারের যোগসূত্র বের করা কিছুতেই সম্ভব হয়নি। এসব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান ও মানবিক প্রকল্পগুলো ইসলামী জিহাদীদের ছত্রছায়া বা আশ্রয়ই শুধু দেয় না, তার চেয়ে ঢেড় বেশি কিছু দিয়ে থাকে। এরা ব্যাপক পরিসরে সামাজিক ও মানবিক সার্ভিসও দেয়। স্কুল, নার্সারি, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খামার, ওয়ার্কশপ প্রভৃতি তার অন্তর্গত। সামগ্রিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুস্থ জনগোষ্ঠীকে আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা যোগায়। তার ফলে এরা জনগোষ্ঠীর ব্যাপক ও যথার্থ সমর্থন লাভ করে থাকে। ইসলামী জিহাদে এদের টেনে আনাও সহজতর হয়। ১৯৯৩ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় প্রায় দু’ডজন চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান ও মানবিক প্রকল্পের ছত্রছায়ায় ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার ইসলামী জিহাদী কাজ করেছে বলে জানা গেছে। এগুলো বিন লাদেনের উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। 

১৯৯৬ সালে জনৈক মিসরীয় সাংবাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিন লাদেন তার আর্থিক ও মানবিক তৎপরতার ক্ষেত্র ও পরিধির কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, তার সাহায্যের আওতায় আছে ১৩টি দেশ যথা আলবেনিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ড, ব্রিটেন, রুমানিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, লেবানন, ইরাক এবং কিছু উপসাগরীয় দেশ। এক পর্যায়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, তার সাহায্য আসে বিশেষ করে হিউম্যান কনসার্ন ইন্টরন্যাশনাল সোসাইটি নামে একটি সংস্থা থেকে, যা ১৯৮২ সালে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জন্ম আফগানিস্তানে হলেও দারিদ্রক্লিষ্ঠ আফগানিস্তান এক পয়সাও এর তহবিলে দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে সৌদি আরব ও শেখ শাসিত উপসাগরীয় দেশগুলোর বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যাক্তি ও সমর্থকদের দেয়া সাহায্য গোপনে ঐ সোসাইটির তহবিলে জমা করা হয় এবং পরে তা বিভিন্ন মানবিক সাহায্য সংস্থাকে ছড়িয়ে দেয়া হয় যেগুলো আসলে জিহাদীদের ছত্রছায়া হিসাবে কাজ করেছে। সোসাইটির প্রধান কার্যালয় রয়েছে স্টকহোমে এবং এর শাখা অফিস বিশ্বের সর্বত্র ছাড়িয়ে আছে। যেমন ব্রিটেনে আছে আল-মুসাদাই সোসাইটি। বার্লিনে আছে আল-নাজদা (ত্রাণ) সোসাইটি। ইতালিতে আছে ইসলামিক সাপোর্ট সোসাইটি, জাগ্রেবে আছে মুত্তয়াকাক সোসাইটি এবং পেশোয়ারে আছে বায়তুল-আনসার। 

---চলমান।

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(৯)

 

 

বিন লাদেন ও আইএসআই

বিন লাদেনের উত্থান ও তাঁর কর্মকান্ডের পিছনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এরও সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে সোভিয়েতবিরোধী আফগান যুদ্ধে বিন লাদেন যে ভূমিকা পালন করেছিলেন আইএসআইয়ের সহযোগিতা ছাড়া সে ধরনের ভূমিকা পালন সম্ভব ছিল না। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে বিন লাদেন প্রথমে এসে উপস্থিত হন পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখানে বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকদের তিনি সংগঠিত করেন এবং ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন। পেশোয়ারের এসব প্রশিক্ষণ ঘাঁটির সবই ছিল আইএসআইয়ের নজরদারির মধ্যে। তারা এসব প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে দরকার মতো উপকরণ দিয়ে সাহায্য করত। বিন লাদেনের ঘাঁটিও যে তা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না এ কথা বলাই বাহুল্য। আফগান সঙ্কট সৃষ্টি হবার পর থেকেই পাকিস্তান এই সঙ্কটকে তার ভূ-রাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার হয়েছে আইএসআই। অচিরে আইএসআই আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদেরও বাহনে পরিণত হয়। ভারতের বিরুদ্ধে শিখ সন্ত্রাসবাদ ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল আইএসআই এর। সে অভিজ্ঞতা এবার তারা প্রয়োগ করল আফগানিস্তানে।

 আফগান ‘জিহাদকে জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিল পাকিস্তানকে আর সেই সাহায্য আফগানদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম হলো আইএসআই। আইএসআই এক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের শতকরা ৭০ ভাগ বণ্টন করল আফগান ইসলামী দলগুলোকে। বিশেষ করে গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের হিজব-ই-ইসলামীকে। মার্কিন অর্থপুষ্ট প্রশিক্ষণ অবকাঠামোও প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল আইএসআই। তার ফলে আফগান মুজাহিদরা ছাড়াও পাকিস্তানের নিজস্ব স্বার্থে আরব জিহাদীদের থেকে শুরু করে আঞ্চলিক গ্রুপগুলোও প্রশিক্ষণ সুবিধা পেল। আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার আরব মুজাহিদকে শুধু হিজব-ই-ইসলামীর সাথেই ট্রেনিং দেয়া হয়। তখন থেকে আইএসআই প্রতিমাসে গড়ে এক শ’ আরব মুজাহিদকে ট্রেনিং দিতে থাকে। এরা পেশোয়ারে সামরিক শিক্ষা লাভ করে আফগানিস্তানে যায়। এবং আফগানিস্তান থেকে ফিরে এসে সুদান ও ইয়েমেনে উচ্চতর পর্যায়ে ট্রেনিং নেয়। আরব ছাড়াও ভারতীয় কাশ্মীরের হাজার হাজার ইসলামী যোদ্ধা এবং কিছু সংখ্যক জঙ্গী শিখকেও ট্রেনিং দেয়া হয়।

১৯৮৬ সালে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) ও তার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ র‌্যডিকেল তরুণদেরকে পাকিস্তানে আফগান মুজাহিদ শিবিরগুলোতে উচ্চতর ট্রেনিং গ্রহণের জন্য পাঠাতে শুরু করে। পরে এদের দেখাদেখি মিসরের ‘আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’ এবং সিরিয়া ও লেবাননের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনের সদস্যরাও পাকিস্তানের ওসব শিবিরে ট্রেনিং নিতে যায়। জেনে রাখা ভালো যে, আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’র সদস্যরাও সাদাত হত্যায় অংশ নিয়েছিল। ইয়াসির আরাফাতের তৎকালীন সামরিক প্রধান খলিল আল ওয়াজির ওরফে আবু জিহাদ জর্দানের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও তার সদস্যদেরকে আফগানিস্তানের লড়াইয়ে অংশ নিতে উৎসাহিত করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, আইএসআই আয়োজিত প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে আরব মুজাহিদদের বিশেষ করে মিসরীয়, জর্দানী ও ফিলিস্তিনীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও তাদের সবাইকে যে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল তা নয়। প্রশিক্ষণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এদের অনেকে ‘উধাও’ হয়ে যেত। পরবর্তীকালে এদের নিয়েই গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের এলিট বাহিনী। এসব বিদেশী স্বেচ্ছাসেবককে কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য স্যাম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার, অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থায় বোমা বিস্ফোরণ, উন্নত ধরনের প্লাস্টিক বিস্ফোরক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর পাশাপাশি দেয়া হয় ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারায় ব্যাপক দীক্ষাদান, যার ফলে তারা একেকজন গোঁড়া ও জানবাজ লড়াকুতে পরিণত হয়। এইভাবে আফাগানিস্তান ও পাকিস্তান প্রশিক্ষণ লাভ ও জিহাদে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামী জিহাদের এক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। গোটা আশির দশক জুড়ে মূলত আফগান যুদ্ধের কারণে অস্ত্রশস্ত্রের ঢালাও সরবারাহের ফলে করাচী আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়।

এই জিহাদের সাথে শুধু ফিলিস্তিনীরাই নয়, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, বার্মা, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স এবং আফ্রিকার অনেক দেশের নাগরিকও যুক্ত হয়ে পড়ে বলে ডা. ইয়াসিন রিজভী নামে এক শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানী সাংবাদিক উল্লেখ করেন। এরা বিভিন্ন দেশে অন্তর্ঘাত ও জিহাদী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল যোগায়। আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণ কাঠামোয় যৌথ প্রশিক্ষণ লাভ এবং অনেক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশের ইসলামী জিহাদীদের ও তাদের সংগঠনগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে ওঠে। তাই দেখা যায় যে আশির দশকের শেষদিকে পাকিস্তানী পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত দুই কাশ্মীরী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন এবং ইখওয়ান আল মুসলিমীন তাদের ভারতবিরোধী লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। তেমনি সাহায্য পেয়েছে বসনিয়ার মুসলমানরা। কসোভোর আলবেনীয়রা এবং ফিলিপিন্স ও মালয়শিয়ার জিহাদীরা। বিন লাদেনের আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের পিছনে আইএসআই কতটা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা অন্যত্র আলোচনায় বিশদভাবে দেখা যাবে।

সৌদি আরবে বিন লাদেন, নয়া সঙ্কট

আফগান মিশন শেষ করে ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবে ফিরে গেলেন ওসামা বিন লাদেন। ততদিনে তিনি অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়েছেন আরও বেশি র‌্যডিকেল। স্বদেশে অনেকে তাঁকে বীরের মর্যাদা দিল। অনেকে তাকে নেতা মানল। প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে তিনি একজন ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে গেলেন। অসংখ্য মসজিদে ও ঘরোয়া সমাবেশে বক্তৃতা দিলেন। এসব বক্তৃতায় জ্বালা ছিল, আগুন ছিল। অনেক বক্তৃতা রেকর্ড হলো। এগুলোর আড়াই লাখ ক্যাসেট প্রকাশ্যে বিক্রি হলো। অনেক বক্তৃতায় এমন বিষয় ছিল যে সেগুলোর ক্যাসেট বিক্রি হতে লাগল গোপনে। সৌদি রাজপরিবার তখনও বিন লাদেনের র‌্যাডিক্যাল চিন্তাধারাকে নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী বা বিপজ্জনক ভাবেনি।

 তাই বিন লাদেন তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াননি। এইভাবে কিছুদিন চলার পর ওসামা বিন লাদেন গুছিয়ে বসার চেষ্টা করলেন। পরিবারের যে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছিল তাঁর জেদ্দা শাখার কাজকর্ম দেখাশোনা করতে লাগলেন। নিজের পরিবার নিয়ে উঠলেন সাদাসিধা এক এ্যাপার্টমেন্টে। নিজের প্রচারিত ইসলামী জীবনধারা বাস্তবে অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। এইভাবে ১৯৮৯ সাল পেরিয়ে ১৯৯০ সালের অর্ধেকটা সময় চলে গেল। তারপর এলো ১৯৯০ এর ২ আগস্ট। ইরাক কুয়েতে হামলা চালিয়ে দখল করে নিল। সৌদি আরবে দেখা দিল আতঙ্ক। কুয়েতের আমির ও তাঁর পরিবারের নেতৃত্বে কুয়েতী উদ্ধাস্তুর ঢল নামল সে দেশে।

 সাদ্দাম হোসেন সৌদি আরবও আক্রমণ করতে পারেন এমন হিস্টিরিয়া পেয়ে বসল রিয়াদকে। এই নতুন সঙ্কটের মুখে ওসামা বিন লাদেন জেদ্দা থেকে তক্ষুণি রিয়াদে চলে গেলেন। তার দিক থেকে সাহায্যের প্রস্তাব দিলেন সরকারকে। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী শাহজাদা সুলতানের সঙ্গে দেখা করলেন। সৌদি আরবের আত্মরক্ষার জন্য ১০ পৃষ্ঠার এক পরিকল্পনা পেশ করলেন তাঁর কাছে। তা ছাড়া বললেন যে, তাঁর পারিবারিক কোম্পানির মতো বিশাল নির্মাণ কোম্পানির হাতে যেসব ভারি প্রকৌশল সরঞ্জাম আছে, সেগুলো দিয়ে সৌদি আরবকে রক্ষার জন্য অতিদ্রুত বেশিকিছু সুরক্ষিত ব্যূহ গড়ে তোলা যাবে। তাছাড়া আফগান যুদ্ধে লড়াইয়ে পোড়খাওয়া যে বিপুলসংখ্যক সৌদি মুজাহিদ আছে তাদের রিক্রুট করে সৌদি বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করা যেতে পারে। দরকার হলে এই লোক সংগ্রহের কাজটা তিনিও করতে পারেন বলে জানালেন। সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান শাহজাদা তুর্কির কাছেও একই প্রস্তাব দিলেন তিনি। তার সঙ্গে বাড়তি একটা কথা বললেন এই যে, আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ এই সৌদিদের কুয়েতে জেহাদ পরিচালনার মূল শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। উপসাগরের তেল ক্ষেত্রগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী তখন সৌদি আরবের ওপর ভর করে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে ব্যাপারে বিশেষ সজাগ থেকে বিন লাদেন সৌদি নেতাদের বার বার হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, এসব ‘বিধর্মী’ বাহিনীকে যেন সৌদি আরবের পবিত্র ভূমিতে আমন্ত্রণ না জানানো হয় কিংবা আসতে না দেয়া হয়। কেননা, তা হলে বেশির ভাগ সৌদির এবং সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি মারাত্মক আহত হবে। এই উদ্বেগ প্রকাশ করার সময়ও ওসামা বিন লাদেন সৌদি রাজপরিবারের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু তিনি হতাশ হয়ে দেখলেন যে তার কথা কেই গ্রাহ্য করল না। সাদ্দাম বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কিত বাদশাহ ফাহাদ ও তার কোটারি ১৯৯১ সালের জানুয়ারী মাসে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর জন্য দরজা খুলে দিলেন। এই বাহিনী উপসাগর যুদ্ধে ইরাককে হারানোর পরও তখন থেকে মার্কিন সৈন্য রয়ে গেল সৌদি আরবে। বিন লাদেন আগে থেকে জানতেন মুসলমানদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র। বিশেষ করে ইসলামী জিহাদীরা পবিত্র ভূমিতে বিধর্মীদের উপস্থিতির দ্বারা ইসলামের অবমাননা সহ্য করবে না। এজন্য তারা দেখে নিতে পারে সৌদি নেতাদের । 

অবশ্য সৌদি এলিটশ্রেণীর মধ্যে একমাত্র ওসামা বিন লাদেনই যে মার্কিন বাহিনীর আগমনের বিরোধিতা করেছিলেন, তা নয়। আরও অনেকেই করেছিল। সেই ১৯৯০ এর আগস্ট মাসেই বাদশাহ ফাহাদ স্বদেশে মার্কিন বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে ওলামা সমাজের অনুমোদন চেয়েছিলেন। কিন্তু ওলামাদের সবাই ছিল এর ঘোরতর বিরুদ্ধে। বাদশাহর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরই কেবল গ্রান্ড মুফতী শেখ আব্দুল আজিজ বিন বাজ অনিচ্ছার সঙ্গে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন অনুমোদন করেছিলেন। তবে শর্ত ছিল যে, ইরাকী হুমকির অকাট্য প্রমাণ দেখাতে হবে। ওদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডিক চেনি প্রয়োজনের এক মিনিট বেশি মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে থাকবে না বলে আশ্বাস দেয়ার পর বাদশাহ ফাহাদ মক্কায় এক বৈঠকে সাড়ে তিনশ’ ওলামার কাছ থেকে এই ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি আদায় করে নেন। সম্মতিটা তারা অবশ্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিয়েছিলেন। মার্কিন সৈন্য মোতায়েন প্রশ্নে রাজপরিবারের সঙ্গে ওলামাদের বিরোধের এই খবরটি সৌদি আরবের সকল মহলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে শুধু সৌদি আরবে নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের র‌্যডিকেল ও জিহাদপন্থী মুসলমানদের মধ্যে মার্কিন বিরোধিতার প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়।

 সৌদি নেতারা ওসামা বিন লাদেনের কথায় কর্ণপাত না করায় তার মনে নিদারুণ যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মার্কিনবিরোধী এই জোয়ার দেখে তার সব যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। নতুন বলে বলীয়ান হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু তখনও তিনি মধ্যপন্থা অনুসরণ করেছিলেন এক দিকে তিনি কুয়েত হামলার জন্য ইরাকের নিন্দা করছিলেন এবং ইরাকী বাহিনীকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন, অন্যদিকে একই সঙ্গে তিনি মার্কিন নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনীর উপস্থিতিকে ইসলামের ঘোরতর অপবিত্রকরণ আখ্যা দিচ্ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি মার্কিন পণ্য বর্জনেরও ডাক দেন।

 কিন্তু আল-সৌদ রাজপরিবারের বিরুদ্ধে তিনি তখনও পর্যন্ত মুখ খোলেননি। সামান্যতম সমালোচনাও করেননি। সৌদি রাজপরিবারকে চ্যালেঞ্জ না করে বিন লাদেন তখন বিপুলসংখ্যক জিহাদপন্থী মুসলিমদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। আফগানিস্তানের শেখ তামিমীসহ বেশিরভাগ মুজাহিদ নেতা তখন সাদ্দাম হোসেনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই সমর্থনের পিছনে তাদের যুক্তি ছিল এই যে কুয়েতকে রক্ষা করার চাইতে ইসলামের ঘোর দুশমন যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলা করার গুরুত্ব অনেক বেশি। তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে এবং আরবের পবিত্র ভূমিতে বিদেশী বাহিনী ডেকে এনে আল-সৌদ রাজপরিবার মুসলমানদের তীর্থস্থানসমূহের হেফাজতকারী হিসাবে তাদের এতদিনের বৈধ অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। আফগানিস্তানের দিনগুলো থেকে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মীদের আনেকেই এই বক্তব্যের সোচ্চার প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু বিন লাদেন ছিলেন সৌদি বাদশাহর অনুগত প্রজা। তখনও তার বিশ্বাস ছিল যে সৌদি রাজপরিবারের উপরমহল যাদের অনেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা আছে, মার্কিন ও বিদেশী সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাদশাহকে প্রভাবিত করতে পারবে। তখনও পর্যন্ত তার আশা ছিল যে, রিয়াদ আমেরিকার বিপুল চাপ কাটিয়ে উঠতে পারবে। তাই বিদেশী সৈন্য আসতে দেয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও বিন লাদেন তার অনুগত্য রেখেছিলেন বাদশাহর প্রতি।

    সৌদি রাজশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সুদানের পথে বিন লাদেন


সৌদি আরবে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন প্রশ্নে কোন মহলের সমালোচনা বারদাশত করতে প্রস্তুত ছিল না সৌদি সরকার। তাই এ প্রশ্নে প্রথম দিকে বিন লাদেনের সমালোচনা আর অন্যান্য র‌্যাডিক্যাল ইসলামীদের সমালোচনার মধ্যেও যে একটা অবস্থানগত পার্থক্য ছিল, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার কোন প্রয়োজনই সরকারের মনে হয়নি। সৌদি আরবে বিন লাদেনের জনপ্রিয়তা তখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছিল। এই জনপ্রিয়তা এক পর্যায়ে সৌদি সরকারের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার ওপর বিন লাদেন এখন সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করায় তাকে আল-সৌদ রাজপরিবারের শাসনের প্রতি হুমকি হিসাবে গণ্য করা হতে লাগল। সমালোচনা বন্ধ করতে ওসামা বিন লাদেনের ওপর নানাভাবে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করল সৌদি সরকার। প্রথম প্রথম এই বলে হুশিয়ার করে দেয়া হলো যে, তাকে যেসব লোভনীয় কনট্র্যাক্ট দেয়া হয়েছে, সমালোচনা বন্ধ না করলে সেগুলো বাতিল করা হবে। 

যখন দেখা গেল ওতে কোন কাজ হচ্ছে না তখন নতুন হুমকি এল, তার সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হবে। তাতেও যখন কাজ হলো না তখন বাবা, ভাই, শ্বশুরকুল ও অন্য আত্মীয়স্বজনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলো লাদেনের মুখ বন্ধ করার জন্য। সৌদি কর্মকর্তারা হুমকি দিলেন, কথা না শুনলে রাজপরিবারের সাথে লাদেন পরিবারের যে বিশেষ সম্পর্ক আছে তা ছিন্ন হয়ে যাবে এবং গোটা পরিবারের ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে পড়বে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, একই সময় সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক, তিনি যেন সৌদি রাজতন্ত্রবিরোধী অন্তর্ঘাতী শক্তির সাথে যোগ না দেন তা নিশ্চিত করা এবং দুই. আফগান যুদ্ধে অভিজ্ঞ সৌদি স্বেচ্ছাসেবকদের যে বিশাল নেটওয়ার্ক সৌদি আরবে আছে, তারা যেন সরকারবিরোধী ভূমিকা না নেয় সে চেষ্টা করা। রিয়াদ ভালোমতোই জানত বিন লাদেন সৌদি রাজতন্ত্রবিরোধী ইসলামী জিহাদ আন্দোলনে যোগ দিলে তার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণেই সে আন্দোলন তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্তরে প্রচন্ড বেগবান হয়ে উঠবে। 


যাই হোক, উপসাগর যুদ্ধে একদিন শেষ হলো। স্বদেশের ওলামাদের দেয়া শর্তের কথা ভুলে গিয়ে সৌদি সরকার বিদেশী সৈন্য স্থায়ীভাবে মোতায়েনের সুযোগ দিলেন। ওসামা বিন লাদেন এবার আর সৌদি বাদাশাহর অনুগত প্রজা হিসাবে থাকতে পারলেন না। তিনি আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, রিয়াদকে দুটো পথের যে কোন একটা বেছে নিতে হবে, হয় স্বল্পমেয়াদী নিরাপত্তা নয়ত ইসলামের পবিত্র ভূমির হেফাজতকারী হিসাবে ন্যায়সঙ্গত বৈধতা। দেখে গেল, রিয়াদ প্রথমটিকেই বেছে নিয়েছে। কাজেই এবার সৌদি সরকারের সরাসরি বিরোধিতা করা ছাড়া আর কোন পথ রইল না বিন লাদেনের সামনে। রিয়াদও বুঝল যে, বিল লাদেনসহ ইসলামী জিহাদীরা এবার একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের সাথে সমঝোতার আর উপায় নেই। বিন লাদেন আর সৌদি সরকারের মধ্যে এখন সরাসরি বৈরিতা দেখা দিল। সে বৈরিতা এত বৃদ্ধি পেল যে, বিন লাদেন নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে লাগলেন। নিজের জন্য বটেই, এমনকি তাদের বৃহত্তর পরিবারটি জন্যও, যে পরিবারে আছেন তার ভাই ও অন্যরা। 

নিরাপত্তাহীনতার কারণে ওসামা বিন লাদেন তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পাড়ি জমালেন ইসলামী জিহাদের নতুন স্বর্গ হাসান আল তুরাবির সুদানে। বিন লাদেন যখন সুদানে পৌঁছলেন তার আগেই সে দেশটির আধ্যাত্মিক নেতার আসন অলঙ্কৃত করে বসেছেন হাসান আব্দুল্লাহ আল তুরাবি। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুনের সমারিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জেনারেল ওমর আল বাশির ক্ষমতায় আসার পর তুরাবি ঐ অবস্থানে পৌঁছেন। গোঁড়া মুসলমান বশির সুদানে ইসলামী শাসন কায়েমের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও গণঅসন্তোষের কারণে পারেননি। বশিরের সমর্থপুষ্ট হয়ে তুরাবি এবার সুদান সরকারের প্রধান আদর্শগত তাত্ত্বিক ও পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়ালেন। আধুনিক যুগের অন্যতম খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ হাসান আব্দুল্লাহ আল তুরাবি সম্পর্কে এখানে দু’টি কথা না বললেই নয়। কারণ বিন লাদেনের বিশ্ব জিহাদ আন্দোলনের সাথে তুরাবির নিবিড় যোগসূত্র আছে।তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে। তা হলো ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিন লাদেন সুদানে ছিলেন এবং এ সময়টা ছিল তার গঠনমূলক অধ্যায়। কাজেই ইসলামী জিহাদের স্বরূপ বুঝতে গেলে তুরাবি সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা দরকার। ১৯৩২ সালে দক্ষিণ সুদানের কাসালায় অত্যন্ত ধার্মিক পরিবারে তুরাবির জন্ম। বাবা ব্যবসায়ী হলেও ইসলামের একজন বিদগ্ধ পন্ডিত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আধুনিকপন্থীও ছিলেন। সুদান ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকার সময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে তুরাবি পরিবারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বাবার ভূমিকা তুরাবির শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তিনি সুদানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছেন আর ইসলামের ওপর শাস্ত্রীয় শিক্ষা লাভ করেছেন বাবার কাছে। চিরায়ত আরবী সংস্কৃতি ও কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ঘটে। ১৯৫৫ সালে তুরাবি খার্তুমের ব্রিটিশ পরিচালিত গার্ডেন কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তবে তার ঢের আগে সেই ১৯৫১ সাল থেকে তিনি ছিলেন মিসরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের খার্তুম শাখার গোপন সদস্য। অচিরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক লিবারেশন মুভমেন্টের প্রধান হয়ে দাড়ান। ওটা ছিল ব্রাদারহুডেরই অঙ্গ সংগঠন।

তুরাবির মন ইসলামের প্রতি নিবিষ্ট হলেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে কখনও উপেক্ষ্য করেননি। এদিক থেকে তিনি সহকর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে আইনশাস্ত্র পড়তে যান। ১৯৫৭ সালে সেখানে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে সরবোন থেকে আইনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তুরাবি ইংরেজী ও ফরাসী ভাষা অনর্গল বলতে পারেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে তার ভাল পরিচয় আছে। যুক্তরাষ্টসহ ইউরোপের প্রচুর দেশ সফর করেছেন এবং এখনও করছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তুরাবি বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপ ও ব্যক্তির কোয়ালিশন ইসলামিক চার্টার ফ্রন্ট গঠন করে তার ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করতে থাকেন।

  ইসলামী বুদ্ধিজীবী মহলে তিনি রাজনৈতিক ইসলাম অর্থাৎ ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর একজন শীর্ষস্থানীয় প-িত বা বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁড়ান। তাই সুদানে ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল বশির যখন তুরাবিকে ইসলামী সামরিক একনায়কতন্ত্র পরিচালনায় সাহায্য করার আহ্বান জানালেন তখন তাতে সাড়া দিতে ভুলেননি তুরাবি। সুদানকে সুন্নী ইসলামের পুনরুজ্জীবনের কেন্দ্রে পরিণত করার এমন সুযোগ তিনি হারাতে চাননি। ওসামা বিন লাদেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সুদানে ছিলেন। এ সময়টা সুন্নী ইসলামী আন্দোলনের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি বিন লাদেনের জন্যও ছিল বিশ্ব ইসলামী জিহাদের অন্যতম স্থপতি হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার পর্যায়। ইতোপূর্বে উপসাগর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলামী জিহাদীরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছে যে, সৌদি আরব ও কুয়েতের শাসকদের মতো দুর্নীতিবাজ শাসকরা টিকে থাকতে পারছে-শুধু এই কারণে যে পশ্চিমী দেশগুলো তাদের এই ক্রীড়ানকদের সর্বাত্মকভাবে রক্ষা করতে ওয়াদাবদ্ধ থাকছে। এমনকি এজন্য ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করতে বা যুদ্ধে যেতেও তাদের দ্বিধা নেই। এ অবস্থায় দেশে দেশে ইসলামী সমাজ ও শাসন কায়েম করতে হলে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আগাত হানা ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করে ইসলামী জিহাদীরা। এই ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিলেন তুরাবি। ১৯৯১ সালের হেমন্ত থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামী জিহাদ, আন্দোল ও সংগ্রামের বিস্ফোরণ ঘটে। বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন এ সময় সুন্নী জিহাদী নেটওয়ার্কে একীভূত হয়ে গঠন করে নয়া ইসলামিস্ট ইন্টারন্যাশন্যাল, যা ছিল ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম ব্রাদারহুডের ধর্মীয় কাঠামোর আওতায় কর্মরত বিভিন্ন জিহাদী সংস্থার ছত্রছায়া সংগঠন। 

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ইসলামিক ইন্টরন্যাশনালের জিহাদী অঙ্গ সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট। সুদানে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অবস্থানকালে ওসামা বিন লাদেন এই নতুন ইসলামিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, বিশেষ করে এর অঙ্গ সংগঠন আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট এর আবির্ভাবের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রেখেছিলেন। সে সময় তিনি আজকের মতো আদর্শগত ও তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে অন্যতম প্রাণপুরুষ না হলেও তখনকার ঘটনাপ্রবাহের প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন- এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট সাধারণ মানুষের কাছে ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন অব ইসলাম’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসলামী জিহাদের যে উত্তাল জোয়ার বইছে, তার অগ্রসারিতে আছে ‘আর্মড ইসলামিক মুভমেন্ট’। এর শীর্ষ পর্যায়ের জিহাদীরা সাধারণভাবে আফগান বলে পরিচিত। এমনটা হওয়ার কারণও আছে। এর অধিকাংশই পাকিস্তানে আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে একত্রে ট্রেনিং নিয়েছিল এবং অনেকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ থেকে ‘ইসলামিস্ট লিজিয়ন’ ইসলামী মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত ও প্রসারিত করার জন্য তার জিহাদী সদস্যদের গোটা এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ছড়িয়ে দেয়।

 ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সুদানে অবস্থানকালে বিন লাদেন আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের একজন সংগঠক হিসাবে ইসলামিক এ্যারাব পিপলস কনফারেন্স, পপুলার ইন্টরন্যাশনাল আর্গানাইজেশন, ইসলামিক মুসলিম ব্রাদারহুড প্রভৃতি সংগঠন ও ফোরামের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সমপৃক্ত হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে হাসান তুরাবির ঘনিষ্ঠ সানিধ্যেও আসেন। ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাদের মধ্যে চিন্তার আদান প্রদান হয়। তুরাবি লাদেনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রভূত অবদান রেখেছিলেন। অচিরেই বিন লাদেন তুরাবির ইনার সার্কেলের একজন সদস্য হয়ে দাঁড়ান। 

চলমান...

 

LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(৮)



১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি আয্যাম ফিলিস্তিনী সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই যুক্তিতে যে, এই সংগ্রাম ইসলামী জিহাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ না হয়ে জাতীয় বিপ্লবের আদর্শের দ্বারা চালিত হচ্ছে। সম্পর্ক ছিন্ন করার পর আয্যাম জেদ্দায় গিয়ে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে থাকেন। ওসামা বিন লাদেন তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। লাদেন আয্যামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এমন প্রমাণের অভাব নেই। জেদ্দায় আয্যাম তাঁর এই মতবাদ দাঁড় করান যে, পাশ্চাত্যের অশুভ প্রভাব থেকে মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য ‘জিহাদ’ শুধু অপরিহার্যই নয়, এটাই একমাত্র পথ। ১৯৮০ সালে আয্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে আফগানিস্তানে চলে যান। তবে আফগান যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পাকিস্তানী ও আফগান নেতারা তাঁকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ না নিয়ে শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী তাঁকে ইসলামাবাদের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির লেকচারার নিয়োগ করা হয়। আয্যাম সে চাকরিতে যোগ না দিয়ে আফগান সীমান্তের কাছে পেশোয়ারে চলে যান। এবং আফগান জিহাদের পিছনে তাঁর সময় ও শক্তির পুরোটাই উৎসর্গ করেন। সেখানে তিনি বায়তুল আনসার নামে একটি শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বায়তুল আনসার’ আফগান জিহাদে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তানে আগত প্রথম ইসলামী স্বেচ্ছাসেবক দলটিকে গ্রহণ করে ও ট্রেনিং দেয়। এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিন লাদেনও ইসলামী আন্তর্জাতিক জিহাদী ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে যান। এবং আয্যামের ঘনিষ্ঠতম একজন শিষ্য হয়ে দাঁড়ান।শেখ আয্যামের ছিল শিক্ষা, ভাবধারা ও চিন্তাশক্তি। আর বিন লাদেনের ছিল অর্থবিত্ত, জ্ঞান ও কর্মোদ্যম। আয্যামের ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেন লাদেন। আয্যাম ও লাদেন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন মাকতাব-আল খিদমাহ বা মুজাহিদীন সার্ভিস ব্যুরো। লাদেন অচিরেই এই ব্যুরোকে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত করেন। যার কাজ হলো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে সাধারণ থেকে সর্বস্তরের জ্ঞানসম্পন্ন ইসলামপন্থীদের খুঁজে বের করা এবং আফগানিস্তানে বিভিন্ন কাজে তাদের রিক্রুট করা। 


১৯৮০-র দশকের শেষভাগ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, সৌদি আরব ও কয়েকটি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসহ ৫০টি দেশে বিন লাদেনের ঐ আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের শাখা ও রিক্রুটমেন্ট কেন্দ্র স্থাপিত হয়ে যায়। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বিপুল সংখ্যক আরবের আগমণ ঘটেছিল। তাদের গ্রহণ করে ফ্রন্টে পাঠাতে গিয়ে বিন লাদেন লক্ষ্য করেন যে, আফগানিস্তানের বন্ধুর পরিবেশের মুখোমুখি হওয়ার আগে এই আরবদের উপযুক্ত ট্রেনিং দেয়া ও পরিবেশের সঙ্গে ধাতস্ত করে নেয়া দরকার। সেটা বিবেচনা করেই আয্যাম ও বিন লাদেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় স্থানে মাসাদাত-আল আনসার স্থাপন করেন। আরব মুজাহিদদের জন্য এটা এমন এক কেন্দ্রীয় ঘাঁটি হিসাবে কাজ করবে যেখানে স্বদেশের বাইরে থেকেও স্বদেশের পরিবেশ পাওয়া যাবে। এসব কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বিন লাদেন বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে অসংখ্য জিহাদ পন্থী মুসলিম ও মুজাহিদের সঙ্গে যোগযোগ স্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর জিহাদ পরিচলনার সহায়ক হয়েছে।


সোভিয়েত ও আফগান সরকারের আর্টিলারি বাহিনীর মুখে মুজাহিদদের অবস্থা খুবই নাজুক- এ দিকটার কথা চিন্তা করে বিন লাদেন সৌদি আরব থেকে ভারি প্রকৌশল সরঞ্জাম নিয়ে আসেন। সড়ক নির্মাণ ত্বরান্বিত করা এবং মুজাহিদদের জন্য স্থাপনা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রথমে তিনি তার পরিবারের কিছু বুলডোজার আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। এরপর সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর বেশকিছু কোম্পানির কাছ থেকে নানা ধরনের ভারি সরঞ্জাম আনার ব্যবস্থা করেন। এগুলোর সাহায্যে মুজাহিদদের জন্য ভূগর্ভে ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছিল। আশ্রয়স্থল বানানো হয়েছিল। এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে সামরিক সাহায্য আসতে থাকায় বিন লাদেন আফগান, পাকিস্তানী ও আরব মুজাহদীদের ভারি প্রকৌশল সরঞ্জাম ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি আফগানিস্তানের পূবাঞ্চলে মুজাহিদদের জন্য এক সুরক্ষিত ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজে হাত দেন- যেখানে সড়ক,সুড়ঙ্গ পথ, হাসপাতাল ও গুদাম সবই থাকবে।

আফগান যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মিসর থেকেও বিপুলসংখ্যক মুজাহিদ সে দেশে পাড়ি জমায়। সেখানে তারা নিজেদের তৎপরতা চালোনোর জন্য একটা নিরাপদ ঘাঁটি খুজে পায়। আফগানিস্তানে আগত প্রথম দিকের মিসরীয়দের একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আহমদ শাকি আল ইসলামবুলি। ইনি বর্তমানে বিন লাদেনের সিনিয়র মুজাহিদ কমান্ডারদের একজন। তার আরও একটি পরিচয় আছে যা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা হলো ১৯৮১ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট সাদাত যার হাতে নিহত হয়েছিলেন সেই খালিদ আল ইসলামবুলি তার ভাই। মিসরের শুদ্ধি অভিযানের পর থেকেই তারা পালাতক ছিলেন। আফগানিস্তানে গিয়ে তারা অচিরেই একটি সুসংবদ্ধ আরব বিপ্লবী দল গড়ে তোলে। আর এই দলটি আজ পর্যন্ত বিন লাদেনের অতি বিশ্বস্ত কমান্ডার ও সৈনিকদের হার্ডকোর অংশ। ১৯৮৩ সালে শাকি আল ইসলামবুলি করাচীতে গিয়ে মিসর থেকে লোক ও অস্ত্র আনা নেয়ার একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। নেটওয়ার্কটা এখনও চালু আছে। 


১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে ওসামা বিন লাদেন মুজাহিদদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার এবং স্বেচ্ছাসেবক রিক্রুট করে আফগানিস্তানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে স্বদেশে ফিরে যান। সেই লক্ষে তিনি সৌদি শাসক গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকে কাজে লাগাতে ভোলেননি। অচিরেই বাদশা ফাহাদের ভাই প্রিন্স সালমান, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। 

সৌদিদের স্বার্থোদ্ধারে বিন লাদেন

 

বিন লাদেন যখন আফগান যুদ্ধে বিভিন্ন মহলের সাহায্য সহযোগিতা সংগ্রহে ব্যস্ত সৌদি আরব তখন এই তরুণ মুজাহিদ নেতাকে নিয়ে ভাবছিল অন্যকথা। সে সময় আরব উপদ্বীপ মস্কোপন্থী বিভিন্ন দেশের বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত বা ঘেরাও হয়ে পড়তে পারে এমন ধারণা সৌদিদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। তৎকালীন সোভিয়েত প্রভাববলয়ের দেশ দক্ষিণ ইয়েমেনে এবং লোহিত সাগর তীরবর্তী আফ্রিকা শৃঙ্গে সোভিয়েত,পূর্ব জার্মানি ও কিউবার সামরিক উপস্থিতি ক্রমাগত বেড়ে চললে সৌদি আরব রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সৌদিরা আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ ইয়েমেনের প্রতি বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করে চললেও তাদের মাথায় অন্য চিন্তা খেলতে থাকে। 

সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ইয়েমেনে এডেনের শেষ সুলতান তারিক আল-ফাদলির নেতৃত্বে গোপনে গোপনে এক ইসলামী বিদ্রোহের আয়োজন করা হয়। কমিউনিস্টবিরোধী এই বিদ্রোহীদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ওসামা বিন লাদেনকে “সেচ্ছাসেবক” মুজাহিদ ইউনিট গঠন করতে বলা হয়। এই কাজের জন্য পুরো আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল রিয়াদ এবং এর পিছনে সৌদি রাজ দরবারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদ ছিল। বিন লাদেন আফগানিস্তানে যেতে ইচ্ছুক নানা শ্রেণীর ইসলামী সেচ্ছাসেবী এবং সৌদি হোয়াইট গার্ডস-এর বিশেষ বাহিনী (এদের আনুষ্ঠানিকভাবে ছুটি দেয়া হয়েছিল সদস্যদের নিয়ে “স্ট্রাইক ফোর্স” বা আক্রমণকারী বাহিনী গঠন করেন। দক্ষিণ ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের এই লাড়াইয়ে বিন লাদেন এতখানি জড়িয়ে পড়েন যে, দক্ষিণ ইয়েমেনী বাহিনীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু যতই উৎসাহ থাকুক এই কমিউনিস্টবিরোধী জিহাদ খুব একটা বিকাশ লাভ করতে পারেনি। তেমন কোন সাফল্য দেখতে না পেয়ে রিয়াদ শেষ পর্যন্ত গোটা কার্যক্রম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তবে বিন লাদেনের এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। ইতিমধ্যে সাবেক সুলতান তারিক আল-ফাদলি যিনি তখন সানরা নির্বাসিত ছিলেন, তার সাথে বিন লাদেনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ঘনিষ্টতার কারণেই বিন লাদেন নব্বইয়ের দশকে তারিক আল ফাদলি ও অন্যান্য ইয়েমেনী মুজাহিদ কমান্ডারের সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিলেন। 

ওদিকে দক্ষিণ ইয়েমেনে বিশেষ অভিযানে ওসামার ভূমিকায় খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন সৌদি নেতৃবৃন্দ। তারা তাকে আকর্ষণীয় কনট্রাক্ট দিয়ে খুশি করতে চাইলেন। আশির দশকের প্রথমদিকে মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কাজটা ওসামার বাবা মোহাম্মদ বিন লাদেনের কোম্পানিরই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওসামাকে সম্মানিত করার জন্য বাদশাহ ফাহাদ মদিনার মসজিদ সম্প্রসারণের কনট্রাকটি নিজের হাতে তাকে দেন। ওসামাকে জানানো হয় যে, শুধু এই কনট্রাক্ট থেকেই তার নিট ৯ কোটি ডলার মুনাফা হবে। শোনা যায় যে, বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গে সেই সাক্ষাতকারে ওসামা কনট্রাক্টের অফার সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার পরিবর্তে আফগান জিহাদে আরও ব্যাপক পরিসরে সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার জন্য বাদশাহর প্রতি আহ্বান জানান। বাদশাহ ফাহাদ, যুবরাজ আব্দুল্লাহ ও শাহজাদা তুর্কী সৌদি আরবের জন্য আফগান পরিস্থিতির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব সম্পর্কে আগে থেকেই নিঃসন্দেহ ছিলেন। বিন লাদেনের আহ্বান তাদের মনে যে বেশ দাগ কেটেছিল তাতে সন্দেহ নেই। কনট্রাক্টটি প্রত্যাখ্যান করায় ওসামার তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। কারণ শেষ পর্যন্ত ওটা তার বাবাই পেয়েছিলেন। ওসামা পরে আফগানিস্তানে তার বিশ্বস্তজনদের বলেছেন, জিহাদের পিছনে তিনি যত অর্থ ব্যয় করেছেন তার সাথে তার ব্যবসাও প্রসারিত হয়েছে, সম্পদও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

আফগানদের সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের প্রভাব মুসলিম বিশ্বের ওপর সত্যিকার অর্থে পড়তে শুরু করে আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ। মূলত এটা প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা এবং ওসামা বিন লাদেনের কর্মতৎপরতার ফলেই সম্ভব হয়। তার আগ পর্যন্ত আরব ইসলামপন্থীরা নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় আফগানিস্তানের ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিল। ১৯৮৫ সালে শত শত আরব আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করে। এদের বেশির ভাগই ছিল জিহাদ পন্থী মুসলিম। আশির দশকের প্রথমদিকে আফগানিস্তনে আরবদের সংখ্যা যেখানে ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার সেখানে আশির দশকের মাঝামাঝি ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার আরব শুধু হিজবে ইসলামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। আরব ইসলামী সংগঠনগুলো জিহাদের ওপর অধ্যয়ন ও চর্চার জন্য তাদের কতিপয় কমান্ডারকে আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলো। সেখানকার মুজাহিদ শিবিরগুলোতে তারা যে ধরনের উন্নত ইসলামী শিক্ষা লাভ করেছিল সে ধরনের শিক্ষা অনেক আরব রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রদ্রোহাত্মক বলে নিষিদ্ধ।

আশির দশকের মাঝামাঝি আফগানিস্তান সারা বিশ্বের ইসলামী জিহাদীদের চুম্বুকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে। মিসরীয় ও অন্যান্য আরব ইসালামী গ্রুপ অবশ্য তার আগে থেকে পেশোয়ারকে তাদের প্রবাসী সদর দফতর হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এখন ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার ফলে তারা একটা আন্তর্জাতিক জিহাদ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বদেশে তৎপরতা চালানোর পশ্চাৎবর্তী ঘাঁটি হিসাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে ব্যবহার করতে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আফগানিস্তানে প্রথম জিহাদ আন্দোলন ব্যুরো খুলেছিলেন ডা. আইমান আল-জাওয়াহিরি। ১৯৮৪ সালে মিসরের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের লে. কর্নেল আবুদ আল-জুমুরের গুপ্ত সংগঠন ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের জন্য এই ব্যুরো খোলা হয়। জুমুর এ জিহাদ আন্দোলনের সামরিক কমান্ডার ছিলেন। সাদাত হত্যাকা-ের প্রক্কালে তিনি ধরা পড়েন।আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক মুজাহিদদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করলে জাওয়াহিরি মিসর থেকে পালিয়ে যান। জাওয়াহিরি বর্তমানে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী এবং তাঁর সংগঠনের একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার। আফগানিস্তানে বিদেশী সেচ্ছসেবকদের প্রথম জেনারেশনের সদস্যদের নিয়েই আজ সেখনকার ইসলামী জিহাদী আন্দোলনের হাই কমান্ড গঠিত। এই সদস্যদের সবাই বিন লদেনের দারুণ অনুগত।    

বিন লাদেনের আফগান মিশন শেষ।

আশির দশকের মাঝামাঝি আফগানদের সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তার আগেই ওসামা বিন লাদেন একজন সাহসী ও কুশলী কমান্ডার হিসাবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৬ সালে তিনি আরব মুজাহিদ ইউনিটের সেনাধ্যক্ষ হিসাবে জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৮৭ সালে তিনি পাকতিয়া প্রদেশের শাবানে সোভিয়েত-আফগান যৌথ অবস্থানের ওপর আঘাত হানেন। তাঁর নেতৃত্বে আরব ও আফগান মুজাহিদদের সম্মিলিত বাহিনী শত্রুব্যূহ ভেদ করে। প্রচ- হাতাহাতি যুদ্ধের পর মুজাহিদ বাহিনী শেষ পর্যন্ত হটে যেতে বাধ্য হয়। বিন লাদেনের হাতে আজও যে কালাসনিকভ রাইফেলটি দেখা যায়, সেটা তিনি এই যুদ্ধে এক রুশ জেনারেলের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। পাকতিয়া যুদ্ধে পরাজয় সত্ত্বেও বিন লাদেনের মনোবল এতটুকু ক্ষুণ হয়নি। বরং তিনি আরও দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আরব ও আফগান মুজাহিদদের কাছে তিনি হয়ে দাঁড়ান এক ব্যতিক্রম চরিত্রের বীর, যিনি সৌদি আরবের প্রাসাদ জীবন ছেড়ে চলে এসেছেন বন্ধুর আফগানিস্তানে। আফগান জীবনে একীভূত হয়ে গেছেন। তাদের একজন হয়ে লড়েছেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিন লাদেন তার ভাবপুরুষ শেখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আয্যমের সঙ্গে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারকাজে গেছেন। প্রচারকাজ চালাতে গিয়ে শেখ আয্যাম আফগান মুজাহিদদের উদ্দেশে যা বলেছেন সেগুলোই আজ বিন লাদেনের বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাকের মর্মবাণী হিসাবে কাজ করছে। তার জিহাদের লক্ষ্য একটা একীভূত প্যান ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা, যা শেষ পর্যন্ত গোটা মুসলিম বিশ্ব শাসন করবে। আর যতক্ষণ সেই খিলাফত বা আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁর এই জিহাদ চালিয়ে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর। 

আশির দশকের গোটা অধ্যায় জুড়ে ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবের শসকগোষ্ঠী বিশেষ করে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে ছিলেন। ঐ সংস্থার প্রধান শাহজাদা তুর্কী আল-ফয়সালের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। বাবার মতো ওসামা বিন লাদেনও বিভিন্ন কার্যক্রমে সৌদি আরবের বিভিন্ন মহলে অর্থ সাহায্য গোপনে পৌঁছে দেয়ার একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছিলেন। এসব কার্যক্রমের একটা ছিল আফগান মুজাহিদদের সাহায্য দান। আল সৌদ রাজপরিবার এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন যেসব ইসলামী সংগঠন আফগানিস্তানে তৎপর ছিল তাদের এই জাতীয় অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেয়া রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল। তথাপি এ কাজটা বিন লাদেনের হাত দিয়ে ঘটত। সুসম্পর্কের কারণেই বিন লাদেনকে এজন্য সৌদি রাজপরিবার বা অন্যদের বিরাগভাজন হতে হয়নি। শেখ আয্যাম ও বিন লাদেন মিলে পেশোয়ারে বাইতুল আনসার নামে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিলেন গোটা আশির দশক জুড়ে তা চালু ছিল।

 এ সময় আফগান যুদ্ধে লড়বার জন্য যেসব আরব স্বেচ্ছাসেবক এসেছিল তাদের ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এ সব সংগঠন থেকে তারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে বাইতুল আনসার একেকটি দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের একেকটি গ্রুপে সংগঠিত করে, যাতে করে তারা নিজ নিজ দেশে গিয়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ করে। যেমন তাজিক নেতা আহমাদ শাহ মাসুদের কমান্ডে থেকে লড়াই করেছিল প্রায় তিন হাজার আলজেরীয় স্বেচ্ছাসেবক। এদেরই একটা বড় অংশ নিয়ে পরবর্তীকালে গঠিত হয় ‘আলজেরীয় লিজিয়ন’। ৯০ এর দশকের প্রথম দিকে এই আলজেরীয় লিজিয়নের সদস্যরা স্বদেশ আলজেরিয়ায় গিয়ে অতিমাত্রায় আক্রমানত্মক ও রক্তক্ষয়ী কর্মকা-ে অংশ নিয়েছিল। এখানে আরেকটি তথ্যও জেনে রাখা ভালো যে, আহমাদ শাহ মাসুদের সাথে আলজেরীয় জিহাদী কমান্ডার হাজ বুনুয়ার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

যাই হোক রুশবিরোধী আফগান যুদ্ধের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত ওসামা বিন লাদেন ও তার অনুসারীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এভাবে এক সময় এলো ১৯৮৯ সাল। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হলো আফগানিস্তান থেকে। কাবুলে থেকে গেল সোভিয়েত সামরিক সাহায্যপুষ্ট নজিবুল্লাহ সরকার। এই সরকারের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নিল আফগান মুজাহিদ ও তাদের সাহায্যকারী বিশেষ জিহাদীরা। এখানে একটা কূট চাল চালাল পাকিস্তানের আইএসআই। রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের এক মাস পর ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে মুজাহিদ বাহিনী এক বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালাল জালালাবাদে। ঐ অভিযান আফগান সঙ্কটের নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেয়। কাবুল সরকারের মূল সামরিক শক্তি ছিল জালালাবাদে। পাকিস্তান বোঝাল জালালাবাদ দখল করতে পারলে কাবুল সারকার পাকা ফলের মতো টুপ করে ঝরে পড়বে। মুজাহিদরা সে কথায় বিশ্বাস করল। চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য বিপুল সাহায্য দিল যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। মুজাহিদদের মতো অতি নিয়মিত বাহিনীর এ ধরনের আক্রমণাভিযানের জন্য যেরূপ রণনীতি ও রণকৌশল নেয়া উচিত তা নিতে না দিয়ে আইএসআই তাদের জালালাবাদের সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা ঘাঁটিসমূহ ও বিশাল আর্টিলারি বাহিনীর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর জন্য উসকে দিল। ইসলামাবাদ জানত সে ধরনের সম্মুখ আক্রমণে কচুকাটা হবে আক্রমণকারীরা। আইএসআই ঠিক এমনটাই চাইছিল। কারণ পাকিস্তানের কাছে ট্রেনিং ও অন্যান্য সাহায্য পেলেও মুজাহিদরা তখন ইসলামাবাদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এরা কাবুলের ক্ষমতায় গিয়ে বসলে ব্যাপারটা পাকিস্তানের মোটেই সুখকর হতো না। সে জন্য তাদের শক্তিক্ষয় করতে চাইছিল পাকিস্তান। জালালাবাদে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ আক্রমণ চালাতে গিয়ে মুজাহিদ বাহিনী এমন কচুকাটা হয় যে তারা আর শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে টিকে থাকতে পারেনি। 

ওসামা বিন লাদেন ও তার বহু অনুসারী জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এবং মুজাহিদ বাহিনীর ব্যাপক ও অর্থহীন নিধন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আয্যাম, বিন লাদেন ও অন্যান্য মুজাহিদ নেতারা পরে এই বিপর্যয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানেন যে, তারা আসলে মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এবং সেই ষড়যন্ত্র পাকিস্তানের হাত দিয়ে বাস্তবায়িত করা হয়েছে। ঐ বছরের ২৪ নভেম্বর পেশোয়ারে শেখ আয্যামের গাড়িতে রাখা এক অত্যাধুনিক রিমোট কন্ট্রোল বোমা ফাটিয়ে দুই ছেলেসহ আয্যামকে হত্যা করা হয়। হত্যার দায়দায়িত্ব আজ পর্যন্ত কেউ স্বীকার করেনি। তবে এর পিছনে আইএসআই-এর হাত আছে বলে ধারণা করা হয়। এর অল্পদিন পরই বিন লাদেন তাঁর আফগানিস্তান মিশন শেষ হয়েছে মনে করে সৌদি আরব ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

চলমান...


LIFE OF BIN LADEN--বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক --বিন লাদেন --জীবনের কিছু স্মৃতি।--পর্ব--(৭)


 
ফাইল ছবি

 অনুবাদকের কথা,


বিশ্বময় জিহাদিদের অবাধ বিচরণ। জিহাদের পদচারণা থেকে কোন রাষ্ট্র, কোন অঞ্চলই যেন বাকি নেই। মহা প্ররাক্রান্ত আমেরিকার মাটিও নয়। ইতোমধ্যে বলকান অঞ্চল থেকে আফগানিস্তান হয়ে ফিলিপিন্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এক নতুন ধরণের জিহাদ। বিশ্ব কট্টরপন্থী মুসলিমদের জিহাদ। সেই জিহাদের প্রাণ পুরুষ আজ ওসামা বিন লাদেন। তার গুপ্ত বাহিনীর সদস্যরা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের দেশে দেশে। জিহাদ চালানোর জন্য তারা তৎপর রয়েছে বসনিয়া, আলবেনিয়া, কাশ্মিরে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিন লাদেন হয়ে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত পুরুষ। আমেরিকার বিরুদ্ধে তিনি ঘোষণা করেছেন সর্বাত্মক যুদ্ধ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ঘাঁটিতে ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র হেনে লাদেনকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। পারেনি! পারেনি! এখন জীবিত হোক, মৃত হোক তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। আমেরিকা লাদেনের মাথার দাম ঘোষণা করেছে ৫০ লাখ ডলার। কিন্তু লাদেন যেন প্রহেলিকা। তাকে ধরা যায় না-ছোঁয়া যায় না। বিশ্বজুড়ে লাদেন বাহিনীর জিহাদী কর্মকান্ডের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ১৯৯৮ সালের আগষ্টে নাইরোবি ও দারুস সালামে মার্কিন দূতাবাসের বাইরে যুগপত বোমা বিষ্ফোরণ তার অন্যতম। এ বছর প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের বাংলাদেশ সফর কালে জয়পুরা গ্রাম পরিদর্শনের কর্মসূচি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়।  মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ নাকি গোপন সূত্রে খবর পায় যে, লাদেন বাহিনী চোরাগোপ্তা আঘাত হানতে পারে।কে এই ওসামা বিন লাদেন? কিভাবে কোন পটভূমি থেকে ঘটল তার উত্থান? কেমন করেই বা চালিত হয় তার গুপ্ত বাহিনীর কর্মকা-? তিনি কি পথভ্রষ্ট কোন সন্ত্রাসী মাত্র? নাকি নিশির মতো ঘোরে পাওয়া এক সৌদি বিলিওনেয়ার যিনি ঐশ্বর্য ও বিলাসী জীবন ছেড়ে সুদূর আফগাস্তিানের এক গুহায় বসে জাল বুনে চলেছেন তার বিশ্ব পরিকল্পনার? ইয়োসেফ বাদানস্কির ‘বিন লাদেন॥ দি ম্যান হু ডিক্লেয়ার্ড ওয়ার অন আমেরিকা’ গ্রন্থ এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অবলম্বনে এখানে পরিবেশিত হচ্ছে সেই বহুল আলোচিত মানুষটির বিচিত্র কাহিনী।

 প্রথম জিবন

 

 ওসামা বিন লাদেন। শীর্ণ একহারা গড়ন। শশ্রুমন্ডিত চেহারা। বয়স ৪৩ এর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এই মানুষটির কম্পিউটারের ওপর ভাল দখল আছে। চার স্ত্রী ও ১৫টির মতো ছেলেমেয়ে। তাদের নিয়ে বসবাস করছেন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের একটি গিরিগুহায়। সেখানে ট্যাপের পানি সেই। শীতের হিংস্র ছোবল থেকে বাঁচবার জন্য গুহাটিকে গরম রাখার কোনরকম ব্যবস্থা আছে মাত্র। আর সেই সঙ্গে আছে গুপ্তহত্যা, কমান্ডো আক্রমণ ও বিমান হামলার আশঙ্কা। এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয় লাদেনকে। অথচ এমনি ঝুঁকিময়, বিপদসঙ্কুল ও অনিশ্চিত জীবন যাপন করার কথা ছিলো না লাদেনের। বাবার পথ ধরে তিনি হতে পারতেন সৌদি আরবের একজন নামী নির্মাণ ঠিকাদার। হতে পারতেন একজন ধনকুবের, যার ব্যংক ব্যালেন্স থাকত শত শত কোটি  ডলারের। অথচ তিনি প্রাচুর্যের জীবন ছেড়ে বেছে নিয়েছেন এক বন্ধুর পথ। অত্যন্ত কঠিন পরিবেশে থেকে তিনি নিজেকে উৎসর্গিত করেছেন এমন এক মিশনে যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘জেহাদ’। জিহাদের জন্য উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ও সুখ-স্বাচ্ছন্দময় জীবন পরিত্যাগ করেছেন এমন মানুষ অবশ্য বিন লাদেন একা নন, আরও অনেকেই আছেন। তাদের একজন ডা. আইমান আল জাওয়াহিরি। ইনি লাদেনের দক্ষিণ হস্ত। চল্লিশের শেষ কোটায় বয়স। মিসরের অন্যতম শীর্ষ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞহতে পারতেন তিনি। কিন্তু বিপুল সম্ভামনাময় ক্যারিয়ার ও প্রচুর্যের জীবন ছেড়ে তিনি মিসর সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেন এবং দেশত্যাগে বাধ্য হন। লোভনীয় পারিশ্রমিকে তাকে পশ্চিম ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বসবাস করতে থাকেন। লাদেন ও জাওয়াহিরী আজ পাশ্চাত্যের চোখে সবচেয়ে কুখ্যাত মুসলিম জিহাদী নেতা। তবে তাঁরাই একমাত্র নন। এঁদের মতো আরও শত শত অধিনায়ক আছেন এবং তাদেরও প্রত্যেকের অধীনে আছে হাজার হাজার জিহাদী। এঁরা সবাই যুক্তরাষ্ট তথা গোটা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন ‘জিহাদে’ লিপ্ত। ১৯৯৮ সালের আগস্টে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিষ্ফোরণ তাদের সর্বশেষ বড় ধরণের জিহাদী হামলার দৃষ্টান্ত। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই নব্য র‌্যডিকেল ইসলামী এলিটদের আবির্ভাব উন্নয়নশীল বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনা। সধারণত সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও বিক্ষুব্ধ অংশ থেকে সন্ত্রাসবাদী ও র‌্যডিকেলরা জন্ম নিলেও এই  নেতারা এসব শ্রেণী থেকে আসেননি, এসেছেন বিত্তবান ও বিশেষ সুবিধাভোগী অংশ থেকে। এঁরা শুধু উচ্চ শিক্ষিতই নন, পাশ্চাত্যের মননশীলতার দ্বারাও প্রভাবিত। ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদীদের থেকেও তাঁরা আলাদা। ওসামা বিন লাদেন, আইমান আল জাওয়াহিরি এবং তাঁদের সত্তর ও আশির দশকের টালমাটালময় সময়ের ফসল।



বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তাদের জিহাদী রাজনীতি র‌্যডিকেলিজমকে আলিঙ্গন করার ব্যাপারটা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলো হলো সত্তরের দশকে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে একই সঙ্গে আরব জাতির সমৃদ্ধি ও সত্তার সঙ্কট, ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এবং আশির দশকের আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী সংগ্রাম। ওসামা বিন মুহাম্মদ বিন লাদেনের জন্ম সম্ভবত ১৯৫৭ সালে সৌদি আরবের রিয়াদ নগরীতে। বাবা মুহাম্মদ বিন লাদেন তখন ছিলেন ছোটখাটো একজন ঠিকাদার। ভাগ্যের সন্ধানে তিনি ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবে আসেন। মোহাম্মদ বিন লাদেনের স্ত্রী ছিল বেশ কয়েকটি, সন্তান সংখ্যা ৫০-এরও বেশি। এদেরই একজন বিন লাদেন। মোহাম্মদ বিন লাদেন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন বলে সন্তানদের শিক্ষাদানে কার্পণ্য করেননি। ষাটের দশকে তার পরিবার সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে হিজাজে চলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মদিনায় বসতি স্থাপন করে। ওসামা বিন লাদেন তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বেশিরভাগই পেয়েছিলেন মদিনায় ও  পরবর্তীকালে জেদ্দায়।


সত্তরের দশকে তেল সঙ্কটকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর বিপুল আর্থোপার্জন মোহাম্মদ বিন লাদেনের ভাগ্যের  চাকা বদলে দেয়। হিজাজে উন্নয়নের জোয়ার বইতে থাকে এবং সেই সাথে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে লাদেনের নির্মাণ ব্যবসা। এই নির্মাণ ব্যবসার সূত্রেই সৌদি এলিটদের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ ঘটেছিল তার । অচিরেই আল-সৌদ পরিবারের সবচেয়ে উঁচু মহলের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠে। নির্মাণ কাজে তিনি শুধু উৎকর্ষ ও উন্নত রুচিই এনে দেননি, আভিজাত্যও সৃষ্টি করেছিলেন। সেই সঙ্গে আল-সৌদ পরিবারকে গোপন কিছু সার্ভিসও দিতেন তিনি। তার মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন স্থানে অর্থ প্রেরণ। শীর্ষ মহলের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগে মোহাম্মদ বিন লাদেন তার ব্যবসায়কে সম্প্রসারিত করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ নির্মাণ কোম্পানিতে পরিণত করেন এবং তার নাম দেন বিন লাদেন কর্পোরেশন। আল-সৌদ পরিবার লাদেনের কোম্পানিকে মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ নবরূপায়ন ও পুননির্মাণের দায়িত্ব দেন। এতে কোম্পানির মর্যাদা আরও বেড়ে যায়। সত্তরের দশকে বিন লাদেন কোম্পানি উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটি আরব দেশের রাস্তাঘাট, ভবন, মসজিদ, বিমানবন্দরসহ গোটা অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত হয়ে পড়ে।ওসামা বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন এ যেন কথাই ছিল। প্রথমে তিনি জেদ্দার হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে সেখানকার কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতির ওপর অধ্যয়ন করেন। বাবা কথা দেন ওসামাকে তার কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব দেবেন। রাজ দরবারের সাথে বিন লাদেনের সরাসরি যোগাযোগ আছে। সেই যোগাযোগের সুযোগে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কনট্রাক্টগুলো বাগিয়ে আনতে পারবে তার কোম্পানি। ওসমার সত্তরের দশকটা আর দশটা বিত্তবান ও প্রভাবশালী সন্তানদের মতোই শুরু হয়েছিল। সৌদি আরবের কঠোর ইসলামী জীবনধারার বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে তিনি প্রমোদ ভ্রমণে যেতেন কসমোপলিটন বৈরুতে। হাই স্কুল ও কলেজে পড়তেই তার বৈরুতে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল।

বিন লাদেনের ভাব পুরুষ

 

 ভোগ বিলাসের উপকরণ বেশি আকর্ষণ করতে পারেনি বিন লাদেনকে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইলী যুদ্ধের পর থেকে তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যায়। তখনও মাঝে মধ্যে প্রমোদ ভ্রমণে বৈরুত যেতেন বটে, তবে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামাতে থাকেন। ইসলামী বইপত্র পড়া তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। এবং আলেম ওলামাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। ওসামার জীবনে এই পরিবর্তনটা আসলে ছিল সত্তরের দশকের আরব ও মধ্য প্রাচ্যের অস্থির সময়ের প্রতিফলন। এই অস্থির সময়ের একটি ফসল ছিল র‌্যডিকেল ইসলামী চিন্তাধারা।সে সময় র্যাডিকেল ভাবধারার অন্যতম পাঠ্যস্থান ছিল জেদ্দা নগরী। জেদ্দা বন্দর দিয়ে সৌদি আরবে পণ্য আনা নেয়ার পাশাপাশি মিসর ও অন্যান্য দেশ থেকে র‌্যডিকেল ইসলামী প্রচার পুস্তিকা ঢালাওভাবে চলে আসত। তা ছাড়া জেদ্দার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলর‌্যর‌্যডিকেল ইসলামী বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের কর্মকান্ডে মুখর হয়ে উঠেছিল। বিন লাদেনসহ জেদ্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র এই র‌্যডিকেল ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ডের সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তী পর্যায়ে মিশর র‌্যডিকেল আন্দোলনের জোয়ার, ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানের শাহের বিরুদ্ধে ইসলামী শক্তির বিজয় এবং খোদ সৌদি আরবে র‌্যডিকেল শক্তির অভ্যুত্থান চেষ্টা (কাবার মসজিদুল হারাম দখলের ঘটনা) বিন লাদেনের মতো তরুণদের প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এরপর ঘটে আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন। আগ্রাসনের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই রুশ দখলদারীর বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় মুজাহিদ বাহিনীর তৎপরতা। আমেরিকা ও সৌদি আরব পাকিস্তানের মাধ্যমে মুজাহিদদের অস্ত্র, রসদ, অর্থসহ যাবতীয় সাহায্য যোগাতে থাকে। সোভিয়েত হামলার পর মুজাহিদদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়বার জন্য প্রথম যে ক’জন আরব আফগানিস্তানের গিয়েছিল ওসামা বিন লাদেন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বলা যেতে পারে যে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বিন লাদেন আফগানিস্তানের পথে প্রথমে পাকিস্তানে যান। সেখানে পৌঁছে আফগান মুজাহিদদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখে হতবাক হয়ে যান। অবশেষে নিজেই রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করে আফগান যুদ্ধের জন্য লোক সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন। বিন লাদেন এ কাজের জন্য যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন পরবর্তী কয়েক বছরে তাঁর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলোর হাজার হাজার আরব যোদ্ধা আফগানিস্তানে পৌঁছে।


আফগানিস্তানে অবস্থানের প্রথমদিকে শেখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আয্যাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন অব ইসলাম’ নামে আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের অতি দক্ষ ও জানবায একটি হার্টকোর বাহিনী প্রতিষ্ঠায় আয্যামই ছিলেন আসল ব্যক্তি। আয্যাম প্রসঙ্গে এখানে দুটো কথা না বললেই নয়। কারণ প্রকৃত অর্থে এই মানুষটি ছিলেন বিন লাদেনের ভাব পুরুষ। আয্যামের জন্ম ১৯৪১ সালে সামাবিয়ার জেনিন শহরের কাছে এক গ্রামে। ১৯৭৩ সালে তিনি মিসরের আল আযহার  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী আইনশাস্ত্রের ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। মধ্যবর্তী সময়টিতে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। কায়রোয় থাকাকালে তিনি  ইসলামী জিহাদীদের সংস্পর্শে আসেন। এ সময় বেশকিছু ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে যাঁরা পরবর্তীকালে আফগানিস্তানে বড় ধরনের প্রভাব রেখেছিলেন। 

চলমান...

 

Ad Code

Responsive Advertisement